মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_১১

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_১১
#মৌরিন_আহমেদ

মেয়েটা ঘর পরিষ্কার করে চলে যাবার পর ঘরে ঢুকলো ধ্রুব। টিনের দরজা লাগিয়ে দিয়ে টুলের উপর কাঁধের ব্যাগটা রাখলো। সেখান থেকে একটা নোটবুক বের করে চৌকিটার উপর বসলো। কোলের ওপর প্যাডটা রেখে কি যেন একটা লিখতে শুরু করলো।

– স্যার, আপনার জন্য ওস্তাদে পাঠাইছে…

মেয়েলি কণ্ঠ শুনে খাতার উপর থেকে চোখ তুলে তাকালো ধ্রুব। দেখলো দু’হাতে খাবারের প্লেট আর গ্লাস নিয়ে দাড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। কৃষ্ণবর্ণ গায়ের রং হলেও মুখটা তার অসম্ভব মায়াবী! এর বয়স খুব একটা বেশি হওয়ার কথা না। বড়জোর পনেরো ষোল হবে। পরনে একটা বেশ পুরাতন কাপড়। কাঁধের দু’পাশে দু’টো বেনি ঝুলানো। এমন অদ্ভুদ সুন্দর মেয়ে জীবনে আর কখনো দেখেছে কী না মনে করার চেষ্টা করলো ও। নাহ্, দেখে নি। কুচকুচে কালো অথচ মুখের মায়াবী গড়ন দেখে যে কারোরই মন গলে যাবে। যেন সে কতদিনের পরিচিত! ধ্রুব ওর দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় বললো,

– এখানে রাখো।

মেয়েটা কিছু না বলে চৌকির অপর প্রান্তে সেগুলো নামিয়ে রাখলো। প্লেটে একটা সিদ্ধ ডিম আর ঠেসে ঠেসে দেয়া খিচুড়ি চোখে পড়ছে। সেখান থেকে ধোঁয়া উড়ছে, মানে গরম। এখনই হয় তো নামিয়ে আনা হয়েছে। আর একটা কাঁচের গ্লাসে পানি। মেয়েটা সভয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– আপনার কি আর কিছু লাগবো, স্যার?

ধ্রুব প্লেটটার দিকে একঝলক তাকিয়ে জবাব দিলো,

– নাহ্।… নাম কি তোমার?

মেয়েটা ভীত চোখে ওর মুখের দিকে তাকালো। ওর দৃষ্টি এবং মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বললো,

– মিনারা

– বাড়ি কই? নাকি এ বস্তিতেই জন্ম? থাকো কই?

মেয়েটা এবার আগেরচেয়ে দ্বিগুণ ভয়ে এদিক ওদিক তাকালো। আশেপাশে কেউ নেই দেখে জানালো,

– দামুদারপুর। এইখানে কয়দিন হইলো আইছি।…

– একাই এসেছ? না বাবা-মাসহ?

– আমার আব্বা বাইচা নাই, স্যার!.. মায়ে আর ছোটভাই মিলা গেরামে থাকি।… আমি আইছিলাম এইখানে কাজ করবার….

– তা কাজ করো কই?

– এখনো করি না। ওস্তাদে কইছে কোথাও একটা পাঠায় দিবো।….

– মালেক?

– জে…

মেয়েটা হঠাৎ এগিয়ে এলো ওর দিকে। যেন গোপনে কিছু একটা বলবে ওকে। ধ্রুবও আগ্রহী হয়ে মাথা এগিয়ে দিল। কিন্তু আর বলা হলো না। ওই মুহূর্তে ঘরের দরজায় মালেককে দেখা গেল। সে গলা উঁচিয়ে বলছে,

– ওই মা*, তোর আসতে কতক্ষণ লাগে?.. খালি কাম ফাঁকি দেয়ার ধান্ধা না?… তোর মায়েরে দেখিস, এইমাসে একটা ট্যাকাও পাঠামু না…

মেয়েটা বাড়তি কিছু বলার সুযোগ পেল না। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো। ধ্রুব বেশ বুঝতে পারলো এই বস্তিতে সমস্যা আছে। সব সমস্যার আঁখড়া হলো এই বস্তি!

__________________________

অনন্যার ঘরে চলছে জিজ্ঞাসা পর্ব। দুপুরে ওকে ওই অবস্থায় বাড়ীতে আনার পর ছোটখাটো হুলস্থূল পরে যায়। জোহরা বেগম আর বেদানার ছোটাছুটি দেখে মনে হয় অনন্যার কপাল ফাটে নি, বিয়ে লেগে গেছে! অনেক ঝুট-ঝামেলা করে, বাসায় ডাক্তার এনে ওকে দেখানো হলো। উনি সবকিছু দেখে একটা ঘুমের জন্য ওকে রেস্ট নিতে দিয়ে সকলে চলে গিয়েছিল। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার পরই শুরু হয়েছে আরেক হুলস্থূল!

খবর পেয়ে কানিজ ছুটে এসেছে। তাই এখন চলছে সবার জিজ্ঞাসা পর্ব! মামা, বেদানা, কানিজ সকলে মিলে ঘিরে ধরেছে ওকে। সবার কথা, কীভাবে হলো! মামা তো একপ্রস্থবকেও দিলেন। দেখে কেন হাঁট না? এতো কেয়ারলেস কেন? তাদের এমন অত্যাচারী অথচ ভালোবাসাময় মেগা এপিসোড দেখে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হলো অনন্যা। তবে ওর প্রতি সবার ভালোবাসা দেখে অবাকও হলো। সবথেকে বড় কথা, তখন ঠিক সময়ে মামা চলে না এলে খুব বিপদ হয়ে যেত! আর মামা যেহেতু শুধু ওকে দৌড়াতে দৌড়াতে পরে যেতে দেখেছেন তাই শানীল আর অরুণের পিছু নেয়ার ব্যাপারটা উনি জানেন না। তাদের ধারণা ও অসতর্ক হয়ে পথ চলতে গিয়েই এ দশা! তাই চলছে তাদের বকুনি-ঝকুনি আর জ্ঞান দেয়ার আসর! তবে এটা এদিক দিয়ে ভালো যে, ওদের ব্যাপারটা আর কেউ জানে নি। জানলে শুধু শুধু নিজেরা একটা টেনশনের মধ্যে থাকতো, তার কি দরকার? থাক না কিছু কথা নিজের মধ্যেই!…

___________________________

দু’দিন বাদে ভার্সিটিতে এলো অনন্যা। এখন ও প্রায় সুস্থ। হাত-পা’র কাটাছেঁড়া গুলো শুকিয়ে এসেছে। আর দুটো দিন গেলেই পুরোপুরি ভাবে শুকিয়ে যাবে। কপালে অবশ্য এখনও একটা ওয়ানটাইম টেপ লাগানো!

এ দুদিন অবশ্য কানিজ এসেছিল। ওই সব নোট কালেক্ট করে দিয়েছে। আবার দায়িত্ত্ব নিয়ে সেগুলো কপিও করে ফেলেছে। এখন ব্রেক টাইমে ক্যান্টিনে বসে আছে কানিজ-অনন্যা। কানিজের সামনে একটা স্যান্ডউইচের প্লেট আর অনুর হাতে চায়ের কাপ। কানিজ বললো,

– সত্যি করে বলতো অনু, সেদিন কী হয়েছিল?… পরে গেলি কী করে?

প্রশ্ন শুনে বেশ থতমত খেয়ে যায় অনন্যা। গত দু’দিন ধরে বেশ ক’বার এ ব্যাপারটা নিয়ে জানতে চেয়েছে কানিজ। কিন্তু ও বলে নি। বারবার এটা ওটা বলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। তবুও বিষয়টা নিয়ে ওর মনের সন্দেহ যায় নি। ও খুব ভালো করেই জানে, সেদিন ঠিক কি হয়েছিল সেটা কানিজের আন্দাজের বাইরে নয়! মেয়েটা যে ওকে নিয়ে এত সিরিয়াস কেন বুঝতে পারে না। বললো,

– তে… তেমন কিছুই না।.. ওই.. হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছি… আচ্ছা, আমি বুঝি না.. তুই এটা নিয়ে এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? মানুষ কি হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ে না? না কি এটা অপরাধ?

কানিজ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,

– কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছিস?… করে লাভ নেই।… তোকে আমার চেয়ে ভালো কেউ চেনে না।.. ঠিক করে বল, সেদিন কী হয়েছিল?.. ইফতিরা কি….

একটা হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে অনু। এর কাছে লুকিয়ে কোন লাভ নেই। সব বুঝতে পারে! তাই আর না পেঁচিয়ে সোজাসুজিই বলে ফেললো,

– তুই যা ভেবেছিস তাই.. তবে সেদিন ইফতি ছিল না। ওর ওই দুই চ্যালা আছে না? শানীল আর অরুণ?.. ওই বদ দু’টোই পিছু নিয়েছিল…

সবটা বলে দেয় অনন্যা। সেটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে কানিজ। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে কী যেন ভাবে!

খানিক্ষ্ন বাদে খুব ধীরে ধীরে বুঝদারের ভঙ্গিতে বলে,

– এদের মতিগতি কিন্তু ভালো ঠেকছে না আমার কাছে.. এরা যে কী চায় সেটা কিন্তু পরিষ্কার!.. সাবধানে থাকিস!

বলেই ওর হাতটা ধরে বললো,

– অনু, ইফতিটা বড্ডো শয়তান!

অনন্যা চিন্তিত ভাবে নিজের হাতের উপরে ওর হত্যা রাখে। মুঠো করে ধরে আশ্বাসের সুরে বললো,

– সবটা আমিও বেশ বুঝেছি… কিন্তু কি করবো বল? এদের ভয়ে যদি বাসা থেকে বের হওয়া বাদ দেই, তাহলে তো ক্ষতিটা আমাদেরই… ওদের কিছুই হবে না!

– তাই তো বললাম, সাবধানে থাক! শকুনের নজর পড়েছে… সুযোগ পেলে ঠিক ছিড়ে খাবে!

– হুম।

নেক্সট ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে দেখে উঠে পড়লো চেয়ার টেনে। ব্যাগ হাতে নিয়ে ক্লাসের দিকে এগিয়ে চললো।

বটতলার নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে ইফতি। সাথে তার দুই চ্যালা শানীল, অরুণ আর তথাকথিত দুই বান্ধবী শ্রেয়া, মৌনতা। ইফতির হাতে একটা সিগারেট। সে পায়ের উপর পা তুলে সেটাতে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে আর সামনে দাড়ানো মেয়েটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আর কি যেন বলছে। ওর কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছে বাকিরা। ‘খ্যাঁক খ্যাঁক’ করে হাসছে। আর ওকে টিজ করে কিসব বলছে। বোঝাই যাচ্ছে ওরা এই মেয়েটাকে র্যাগ (ragg) দিচ্ছে!

দূর থেকে ওর শোচনীয় অবস্থা দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল অনন্যার। সাথে রাগও। এই ইফতি ছেলেটা যে নিজেকে কী মনে করে না আল্লাহই জানেন! কতবড় বেয়াদব, জুনিয়র একটা মেয়েকে ধরে পুরো গ্যাং মিলে র্যাগ দেয়! এরা কোনোদিনও শুধরাবে না যতক্ষন না কেউ একজন এসে এর প্রতিবাদ করে! প্রতিকার করে! কিন্তু প্রতিবাদটা করবে টা কে? অনন্যা? হ্যাঁ, সই! ওই যাবে ওদের সামনে। বাঁচাবে মেয়েটাকে। সাথে মুখ ঝামটা দিয়ে আসবে বদগুলোর সামনে। তাতে যদি লজ্জা হয়!
অনন্যা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওদিকটায় এগোতে নিলো। কিন্তু হাতে টান খেয়েই থেমে যেতে হলো ওকে। মুখ ফিরিয়ে দেখল কানিজ ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। অনুর কনুই ধরে মাথা নেড়ে যেতে না করছে। সে উপেক্ষা শুনলো না অনন্যা। কঠোর গলায় বললো,

– হাত ছাড়, কানিজ। ওদের একটা শিক্ষা দেয়া দরকার!

– মাথা গরম করিস না, অনু। ভুলে যাস না আমরাই ওদের সামনে ভেজা বেড়াল! এর আগেও আমরা ওদের সামনে পড়েছিলাম। আজ কিন্তু হিমু নেই!…

– কিন্তু…

– কোনো কিন্তু না। তুই ওদের সামনে যাবি না। একদম না। যদি যাস, তাহলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবি। প্লিজ, বোন বলছি, যাস না!

বলেই ওকে আর কোনো সুযোগ দিল না কানিজ। হাত ধরে টেনে ক্লাসে নিয়ে এলো।

#চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here