মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_১০ #মৌরিন_আহমেদ

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_১০
#মৌরিন_আহমেদ

ঘর থেকে বেরোল ধ্রুব। একটা অল্পবয়সী মেয়ে এসেছে ঘরটা পরিষ্কার করার জন্য। সে মুখটা ওড়না দিয়ে বেঁধে ঝাড়ু হাতে কাজ করছে। টুলে, চৌকিতে যখন বাড়ি দিচ্ছে তখন ‘খসখস’ করে শব্দ হচ্ছে আর ‘ভুরভুর’ করে ধুলো উড়ছে। এমন ধুলোয় ধ্রুব থাকতে পারবে না, শ্বাস নিতে কষ্ট হবে। তাই বেরিয়ে এলো।

রুমটার ঠিক দরজা বরাবর একটা টিউবওয়েল। আর পাশেই সিমেন্টের বস্তা দিয়ে মোড়ানো বস্তির পাবলিক টয়লেট। বাইরে থেকেই বলে দেয়া যায়, ওটার অবস্থা কতো শোচনীয়! গোসল করার জন্য আলাদা কোনো বাথরুম নেই। নিশ্চয় টিউবয়েলের এই খোলা জায়গাতেই কাজ সারতে হবে! ধ্রুবর পরিবেশ থেকে উঠে আসা অন্য কেউ এ ব্যবস্থা দেখলে নিশ্চয়ই নাক সিটকাতো কিন্তু ধ্রুব বলেই কিছু বললো না! তার মাঝে বিশেষ কোনো ভাবাবেগ নেই। বরং সে অনেক আগ্রহের সাথেই সারা এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছে!

টিউবয়েলের পেছনে একটা কংক্রিটের ওয়াল। তাতে চুনকাম করা। ওপাশে কয়েকটা বাড়ি আছে। সেগুলোকে এই বস্তি থেকে আলাদা করার জন্য ওয়ালটা গাঁথা। তার সাদা চুনের রঙের উপর বিভিন্ন কালার দিয়ে স্প্রে করা। মার্কার আর খোয়া (ইটের টুকরা) দিয়ে কী সব হাবিজাবি লেখাও দেখা যাচ্ছে। এরমধ্যে চোখে পড়ার মতো বিষয় হচ্ছে, মার্কার দিয়ে দেয়ালে একটা রগরগে ধাঁচের মানুষের ছবি আঁকা। সম্পূর্ন নগ্ন এক তরুণী। কাজটা যে বস্তির ছেলেপুলের সেটা বুঝতে বাকি রইলো নাআর। বস্তির ছেলেরা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী হোক বা না হোক এসব অশ্লীল বিষয়ে আগ্রহ একরাশ!

ছবিটা নজরেআসার সাথে সাথেই দেয়াল থেকে চোখ সরিয়ে নিলো ধ্রুব। দেয়ালের নিচে কয়েকটা খোয়া চোখে পড়লো। তারই একটা তুলে নিয়ে ঘষে দিল দেয়ালটায়। ব্যাস! হয়ে গেছে। এবার আর ঘর থেকে বের হয়েই এই বিশ্রী ছবিটা নজরে আসবে না।

আধঘন্টার মধ্যে পুরো বস্তিটাই প্রায় ঘুরে ফেললো ধ্রুব। কিন্তু কোথাও তার সেই কাঙ্খিত জিনিসের দেখা পেল না। মালেকের কথা অনুযায়ী এখানেই কোথাও ড্রাগের আড়ৎ আছে। মদ তৈরি, বিদেশি মদ, বিশেষ করে ফেনসিডিল, হেরোইন আর ইয়াবার চালান করা হয় এখান থেকে। এ শহরে ড্রাগের যতো কেনাবেচা হয় সব এখান থেকেই হয়। তারমানে এখানেই কোথাও আছে সে জায়গাটা। কিন্তু পুরো তল্লাটে মদ কেন, একটা কাঁচের বোতলও চোখে পড়লো না। ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে যাচ্ছে ধ্রুব।

হঠাৎ একটা টিনের ঘরের পাশ দিয়ে যেতেই কানে এলো কিছু ছিটেফোঁটা শব্দ। কারো গোঙানির শব্দ। সাথে কারও। চাপা গজরানী। যেন কেউ কাউকে চাপা স্বরে ধমকা-ধমকি করছে। সম্ভবত সাথে মারছেও! নয় তো এভাবে গোঙ্গাবে কেন? সাধারণ রাগারাগি তে কেউ কাঁদতে বসলে গোঙানির আওয়াজ তো পাওয়ার কথা নয়! হঠাৎ শব্দ!

কেউ প্রচন্ড জোরে কোনোকিছু কে আঘাত করলো। নারীকণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো কেউ! এবার একইসাথে ফোঁপানি আর গোঙানির আওয়াজ! চাপা গর্জনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ধ্রুব দেয়ালে কান পাতল। বেশ বুঝতে পারলো। সেখানে দু’একজনের শব্দ হচ্ছে না। বরং বেশ কয়েকজন মিলে এমন করছে। আর এটা কোনো সাধারন বস্তি পরিবারও না যে অশিক্ষিত স্বামী-স্ত্রী মারামারি করবে। এখানে ঘটনা অন্য কিছু!

যারা গোঙাচ্ছে বা ফোঁপাচ্ছে তারা কথা কাটাকাটি কিংবা পাল্টা জবাব দিচ্ছে না। তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না। তারমানে মারটা শুধু একপক্ষের। সম্ভবত কোন বিষয় নিয়ে শাসন চলছে। ও একমুহুর্ত দাড়িয়ে থেকে কী যেন ভাবলো। কেউ দেখে ফেলার আগেই দ্রুত প্রস্থান করলো জায়গাটা থেকে!

______________________

আকাশের সূর্যটার এখন খুব দেমাগ। নিজের প্রখর রোদ দিয়ে মানুষকে তার ভাব দেখাচ্ছে। এই রোদে দাড়িয়ে থাকা মুশকিল! রিকশার জন্য ক্যাম্পাসের গেটে দাড়িয়ে আছে অনন্যা। কানিজ কে একটু আগেই রিকশায় তুলে দিয়েছে। কিন্তু এখন নিজে রিকশা পাচ্ছে না। ও ছায়ায় দাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আশেপাশে দাড়ানোর মতো কোনো জায়গা নেই। ছায়ায় যেতে হলে রিকশায় আর যাওয়া হবে না! যে গরম তাতে হেঁটেও শান্তি নেই!

তবুও এতক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে সমস্যা ছিল না। কিন্তু এখন আছে। ওর পেছনে এসে দাড়িয়েছে ইফতির দুই চ্যালা। শানীল আর অরুণ। অরুণ তো অনেক্ষণ ধরে শীষ বাজানো শুরু করেছে। আর মাঝে মাঝে বাজে গান গাইছে। সেগুলো যে ওকে উদ্দেশ্য করে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। দু’জনে সবচেয়ে বিরক্তিকর এবং অসস্তিকর যে কাজটা করছে তা হলো নিজেরা নিজেরা কী যেন নিয়ে ফিসফাস করে কথা বলছে। আর ‘খ্যাঁক খ্যাঁক’ শব্দ করে বিশ্রী মার্কা হাসি হাসছে। অনন্যা এতে প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করলেও কিছু বলতে পারছে না। আজ ওর সাথে কেউ নেই। এখন যদি ওদের কিছু বলে ক্ষেপিয়ে দেয় তো নিজের ক্ষতি!

আর অযথা সময় নষ্ট করলো না ও। আশেপাশের দিকে একবার তাকিয়ে ভীতমুখে হাঁটা শুরু করলো। রিকশার জন্য আর অপেক্ষা করা সম্ভব না। তাহলে বড় কোনো ঝামেলায় পড়ে যেতে হবে!

কিন্তু সমস্যা মিটলো না। বদ ছেলেদু’টো ঠিক ওর পেছন পেছন আসতে লাগলো। এখনো দু’জন ফিসফাস করছে আর হাসছে। তবে ওকে কিছু বলছে না। এটাই রক্ষে! অনন্যা প্রাণপণ চেষ্টা করছে এদের হাত থেকে বাঁচতে। কিন্তু কিছু হচ্ছে না। উফ্!

একটু দূর এগোতেই হঠাৎ শানীল বলে উঠলো,

– মাইয়া মানুষের হাঁটার জোর যে এতো তা তো জানতাম না রে, অরুণ!

– আমিও তো জানতাম না!

– একটা কাজ করলে কেমন হয়?

– কী কাজ?

– মাইয়াডারে তুইল্যা নিয়া যাই? ভাই খুশি… আমরাও…

– তুলবি? চল, তুলি!

এদের দুজনের কথায় স্পষ্ট করেই ইঙ্গিত দেয় ওরা অনন্যাকে নিয়েই কথা বলছে। এবং কথাবার্তার মোড় এখন বাজে অবস্থায় চলে গেছে। কিছু একটা না করলে এই বেয়াদব ছেলেদু’টো সত্যি সত্যিই উল্টোপাল্টা কিছু একটা করে ফেলতে পারে! ও ভয়ে ভয়ে পেছনে ফিরে বললো,

– আ.. আপনারা আমার পিছু নিয়েছেন কেন?

প্রশ্ন শুনে যেন দু’জনেই অবাক হয়ে গেল। একজন আরেকজনের দিকে বোকা দৃষ্টিতে তাকালো। শানীল বললো,

– আমরা আপনার পেছনে আসছি?.. কই, না তো!.. অরুণ, তুই বল তো আমরা তার পিছে পিছে আসছি?

– কই… না… একদমই না…

– আমি তো স্পষ্ট টের পেলাম আপনারা আমার পিছনে আসছেন।আপনাদের আর কাজ নেই? কেন আমার পিছনে সময় নষ্ট করছেন?

অরুণ এবারে বললো,

– কাজ নাই সেইটা কইলো কে? আমরা তো কাজেই আসছি।…

– তাহলে যান না সেখানে…

শানীল এবারে ওর দিকে তাকিয়ে বিশ্রী করে হাসলো। অরুণের দিকে তাকিয়ে বললো,

– ভাই, বল তো আমাদের কী কাজ?

– কী আবার?… মাইয়াডারে তুইল্যা নিয়া যাওয়া… ধর শা’লীরে!..

অনন্যা আর একমুহুর্ত দেরি করলো না। উল্টো দিকে ঘুরে প্রচন্ড বেগে দৌড়াতে শুরু করলো। হঠাৎ কি হয়ে গেল বুঝলো না ছেলে দু’টো। বুঝে উঠেই দৌড়াতে শুরু করলো পিছু পিছু!

দু’জন নারীর শক্তি সমান একজন পুরুষের শক্তি। সে হিসেবে অনন্যার খুব বেশি দূর যাওয়ার কথা না। ওকে খুব দ্রুতই ধরে ফেলার কথা অরুণদের। কিন্তু ওরা পারছে না। অনন্যা খুবই জোরে দৌড়াচ্ছে। কারণ ও দৌড়াচ্ছে প্রাণের দায়ে, নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে। আর এরা দৌড়াচ্ছে নিজেদের আকাঙ্খার জন্য, কামনার দায়ে। স্বভাবতই অনন্যার দায় বেশি। ওই আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাঁচবার!

দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ কি যেন হলো ওর। কিছু বুঝতে পারলো না। ব্যালেন্স হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ফুটপাতের ওপর। কপালে এতজোরে বারি খেল যে মনে হচ্ছে করোটিটা বুঝি ভেঙে দু’ভাগ হয়ে গেছে! অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে পড়ে গিয়ে হাত-পা বেখাপ্পা অবস্থায় পড়েছে! ভালোরকমের কাঁটা ছেড়া যে হয়েছে সেটাও জ্বলুনিতেই বুঝছে। কিন্তু উঠতে পারছে না। ওদিকে বখাটে গুলো নিশ্চয় দৌড়িয়ে এসেছে। এক্ষুনি ধরাশায়ী করে ফেলবে ওকে। তারপর….

রিকশায় করে বাড়ি ফিরছিলেন লেবু মামা। হাতে একটা বেশ বড়সড় শপিং ব্যাগ। তার ভেতরে নতুন কেনা ক্যামেরা। সকালবেলা মাথার ভেতরে যে নতুন ভুতটা চেপেছে তারই ইচ্ছে মেটানোর জন্য এটা কিনতে গিয়েছিলেন উনি। এবার ডিসিশান ফাইনাল! দুনিয়া থাক বা উল্টে যাক উনি এবার মার্কো পোলো লুৎফর হয়েই ছাড়বেন। ওনার স্বপ্ন উনি ভবিষ্যতের একজন সেলিব্রেটি হবেন। যদিও স্বপ্ন টা বেশিদিনের নয়। গত দু’দিন ধরে এই ইচ্ছেটা তার মাথায় প্রবল ভাবে চেপেছে। তাই দেরি না করে এখনই ক্যামেরা কিনে ফেলার কাজটা সেরে ফেললেন তিনি।

সামনে একটা তেমাথার মোড়। রিকশাটা এই রোড থেকে আরেকটা রোডে যাচ্ছে। মাঝখানে ক্রস করতে হচ্ছে আরেকটা রোড কে। সেটা ক্রস করতে গিয়েই চোখে পড়লো একটা দুর্ঘটনা। বিপরীত দিক থেকে আসা একটা মেয়ে খুব জোরে দৌড়াচ্ছিল। হঠাত্ই কিসের সাথে যেন পা বাজিয়ে ধুপ করে পড়লো ফুটপাতের ওপর। পড়ার দু’সেকেন্ড আগেই বোঝা গেল সে পড়ে যাবে, কিন্তু তবুও মেয়েটা নিজের ব্যালেন্স রাখতে পারলো না। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মামা চেঁচিয়ে উঠলো,

– এ্যাই! এ্যাই থামো!

রিকশাযওয়ালা প্রায় সাথে সাথেই ব্রেক করলেন। মামা হাতের ব্যাগটা সিটের ওপর রেখেই নেমে গেলেন মেয়েটার জন্য।

– এ্যাই মেয়ে!.. উঠো!.. পরে গেলে কেন? উঠো, উঠো!

আশেপাশের কেউ এগিয়ে এলো না। ভরা রাস্তায় একটা মেয়ে পড়ে গেল অথচ কেউ এলো না তাকে সাহায্য করতে। সবাই শুধু দৃশ্যটা উপভোগকারী দর্শক হিসেবে দাড়িয়ে থাকলো। ব্যাপারটা দেখেই বিরক্ত হলেন মামা। রাগে বিড়বিড় করে বললেন,

– কী সব মানুষ! একটা মেয়ে পড়ে গেল আর তারা কেউ এগোল না!..

তারপর মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– এ্যাই মেয়ে উঠো!.. এখানেই থাকার জন্য পড়ে গেছ না কী?

মামা হাত বাড়িয়ে টেনে তুললেন ওকে। মুখটা দেখেই চমকলেন, সে অনন্যা!

– অনু! তোর এই হাল হলো কী করে? এ্যাই!

অনন্যা তাকাতে পারছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। শুধু চোখ মেলে দেখলো মামা ওকে রিকশায় তুলছেন। কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে রক্তমাখা জায়গায় টিস্যু চেপে ধরলেন। রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে বললেন,

– ভাই চলেন….

রিকশাটা এগিয়ে চললো।

#চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here