#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ২৪
ইবতিহাজ ঘুমিয়েছে। দুপুরে খাওয়ার পর মিমের জমপেশ একটা ঘুম দেয়ার অভ্যেস। ইচ্ছে থাকলেও ঘুমটা আজকে আর হবে না। স্কুলের খাতা দেখতে হবে। মিম খাতা কলম নিয়ে পিঠের নিচে একটা বালিশ নিয়ে আয়েশ করে বিছানায় পা ভাজ করে।বসে পড়লো।
সবুজের কয়েকদিন ধরে এমন অবস্থা হয়েছে যে বউ এর ভয়ে বাহিরে যাওয়া বেমালুম ভুলে গেছে। মিমকে বিন্দুপরিমাণ বিশ্বাস করার আগ্রহটাই মরে গেছে। দেখা গেল আর ভিতরেই ঢুকতে দিলো না। অনিদ্দষ্টকালের জন্য বউ কাছে যাওয়া বন্ধ!নাহ্ এ হতেই পারেনা।
মিম একমনে খাতা দেখছে । ইশ্ কেমন ম্যাডাম ম্যাডাম লাগছে। ইদানীং কেমন যেন রগচটাও হয়েছে কথায় কথায় চোখ রাঙ্গায়।
সবুজ বেশ কিছুক্ষন ধরে মিমকে অবজার্ভ করতে লাগলো।
হালকা কলাপাতা রঙ্গের শাড়ী সাথে গোলাপি ব্লাউজ। শাড়ীটা একটু পাতলা টাইপের ব্লাউজের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এক পাশে হেলে থাকায় তিলটার সাথে নীলচে রগটাও ধবধবে ফর্সা গলায় অদ্ভুত মোহনীয় লাগছে। এই জীনিসটা ওর আগে কেন চোখে পড়েনি!
হুম পড়বে কি করে আগেতো মিমকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সৌভাগ্যই হয়নি। ইশ্ মেয়েটা ওকে পাগল করে ছাড়বে। সবুজ আচমকা মিমের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গলার কাছের তিলটায় চুমো খেতেই মিম শিউরে উঠে হাতে থাকা কলম খাতা সব ফেলে দেয়। মুখে বলে উঠে,
” এই হচ্ছে কি? এইভাবে খাতার উপর কেউ হুমডি খেয়ে পড়ে? খাতাগুলোতো নিচে পড়ে কুচকে যাচ্ছে। স্টুডেন্টসরা এই খাতা দেখে কি বলবে? আমি কি এইগুলার সাথে যুদ্ধ করেছি?”
” কি আর বলবে? বলবে যে ম্যাম আর স্যার খাতার উপর বাসর করেছে । বেচারা খাতা? ”
বুকের মাঝে টেনে নিতে নিতে সবুজ কথাগুলো বললো।
মুহুর্তেই মিম রাগে ফুঁসতে লাগলো,
” এই একদম বাজে বকবেন না। আপনার মাথায় এতো দুষ্টু চিন্তাভাবনা কেন? খাতাগুলো হাত দিয়ে সরান বলছি।”
সবুজ এক হাত দিয়ে খাতাগুলো নিয়ে বেডসাইড টেবিলে রাখলো।
” আপনাকে বলেছিনা আমাকে খালি গায়ে জাপটে ধরবেন না?”
” কেন কি সমস্যা? তোমার ভালো লাগছেনা?”
” কচুটা লাগছে। ইশ আপনার এইসব বুকের লোমগুলো আমার গালে সুড়সুড়ি দিচ্ছেতো অসহ্য লাগছে।”
সবুজ হো হো করে হেসে উঠলো।
মিম আর কিছু বললোনা। এই অসহ্যরকমের গায়ে পড়ে লোকটাকে কিছুতেই শায়েস্তা করা যাবেনা। তাই নিঃশ্বব্দে বুকে মুখ লুকিয়ে রাখলো।
” মিম সোনা, তোমাকে কিছু বলতে চাই?”
” হু।”
মিমের ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে।
” মিম, অনকতো হল। আমি আর ঝামেলা চাইনা। তুমি আর তুলার বস্তাকে সাথে নিয়ে আমি সুখের সংসার সাজাতে চাই। মা বাসায় অনেক টেনশন করছে। আমাদেরতো বাড়ী ফেরা দরকার এবার। ”
মিম সবুজের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানায় উঠে বসে,
” মিম, এভাবে উঠে পড়লে কেন?”
” হুম সবাই টেনশন করছে আপনি বাড়ী ফিরে যান।”
” আমি একা যাবো বলিনিতো তোমাদের সাথে নিয়ে যাব?”
মিম নিভলো। অনুভুতিগুলো শুন্য মনে হতে লাগলো
” কি হলো কথা বলছোনা কেন?”
মিম চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়লে সবুজ খপ করে মিমের কনুইতে সজোরে টান দিলো। সামলাতে না পেরে বুকে গিয়ে পড়লো।
” কি হলো একটা কথা বললাম কানে গেলোনা। ”
কপাল ভাজ করে মিম নিচে তাকালো।
সবুজ থুতনি ধরে বেশ জোড়েই মুখটা উপরে তুললো।
“উঁহু লাগছে? ছাড়ুন।”
” দিনে সাতবেলা করে আপনি ডাকা হচ্ছে? আমিকি তোমার খালু লাগি?”
” আমি কিন্তু সত্যি ব্যাথা পাচ্ছি।”
” আমিও অনেক যায়গায় ব্যাথা পাই। ওগুলা তুমি বুঝবেনা। যাও আপাতত ব্যাগ গুছাও বাড়ি যাব।”
” আমি যাবনা। ইচ্ছে নেই। প্লিজ ফোর্স করবেননা। আমি একা বেশ আছি।”
মিম গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো।
সবুজের মেজাজ খুব চটে গেলো। ইচ্ছে হচ্ছে কয়েকটা ঠাস ঠাসি চড় বসিয়ে দিতে। সব চেয়ে বিষণরকমের যে ইচ্ছেটা পেয়ে বসেছে সেটা হলো ওকে জোড় করে তুলে নিয়ে যেতে। এরপর দেখি ওর কত জেদ!
” সবসময় গোয়ারের মত জেদ ধরে বসে থাকো কেন? সহজ জীনিস সহজ ভাষায় বুঝো না। তুমি যাবে কি না যাবে ওইটা তোমাকে জিজ্ঞাস করেছি? করি নাই? অপশন দেইনি। তুমি এখন বাসায় যাবে দ্যাটস ফাইনাল।”
সবুজ উচ্চস্বরে কথাগুলো বলে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো।
” আপনার কোন রাইট নাই আমাকে বাধ্য করার। এতো অধিকারবোধ কোথায় ছিলো যেদিন আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিলাম? কই কেউতো পাশে ছিলোনা? আমি একা স্ট্রাগল করে বাচতে শিখেছি। এত অপমানের পর ওখানে যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। আপনার বাবা-মা তাদের প্রতি আপনার দায়িত্ব আছে আপনি যান। আমি আর কারো কাছে দায়বদ্ধ নই।”
সবুজের প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করতে লাগলো এই একগুয়ে জেদি মেয়েটাকে চেচিয়ে ধমকে পোষ মানানো যাবেনা এটা এতোদিনে ও ভালোভাবেই বুঝেছে। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছেনা। সবুজ বিছানা থেকে উঠেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।
মিম শান্তভাবে পথের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
” আসছে ভালোবাসা দেখাতে। বললেই আমি নাচতে নাচতে চলে যাব। যাবনা। তর যেখানে ইচ্ছে যানা আমারে টানিস কেন। খাটাশের গুষ্ঠি খাটাশ। কাউকেই চাইনা। একাই থাকতে পারি। দরকার নাই কাউকে।”
একটুপড়েই হাত পা ছাড়িয়ে কাঁদতে বসে গেলো।
————————————
” কোথায় গিয়েছিলে তুমি? ফোনটাও বন্ধ করেছিলে? আমাদের টেনশন হয়না। খুব বড় হয়ে গেছো না।”
শিউলির চরম মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে বেয়াদব ছেলের ফোনটা জানালা দিয়ে ফেলে দিতে। গন্ডারের মত কেমন উত্তর না দিয়ে ফোন টিপেই চলেছে।
” আহা, শিউলি থামোতো। ছেলেটা মাত্রই ফিরেছে, আর তুমি এখনিই শুরু করে দিয়েছো?”
স্বামীর কথা মনে হয় শিউলির কানে গেলোনা।
শিউলি খপ করে সবুজের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো।
সবুজ অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়।
” এই ফোনে এতোক্ষণ কি গুটুর গুটুর চলছিলো?
যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দাও । ”
” মা মিমকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম।”
” তা বাবা খুঁজে পেলে?
কেউ ইচ্ছে করে হারিয়ে গেলে তাকে কি খুঁজে পাওয়া যায়।
তুমি কি বুঝতে পারছো না ও আর এখানে ফিরতে চায় না। ফেরার হলে আগেই ফিরতো। দেখ আমরা আজ আছি কাল নেই। আমাদেরোতো ইচ্ছে হয় ছেলের বউ, নাতি পুতি নিয়ে সুখে সংসার করতে। মিমের আশাটা এবার একটু বাদ দাও বাবা। মরীচিকার পিছে ছুটেতো আর লাভ নাই।”
সবুজের মেজাজ আবার চটে যায়। ধপ করে সোফা থেকে উঠে। নিজের ঘরেদিকে পা বাড়ায়।
” সবুজ, মনকে শক্ত করো। তোমার মায়ের কথাটা একটু ভেবে দেখো ।
সোহেল সবুজকে পিছু ডেকে কথাটা শান্তভাবেই বললেন।
সবুজের খুব ইচ্ছে করছিলো মিমের কথাটা বলতে কিন্তু মেজাজটা এতোটাই বিগড়ে গেছে। ইচ্ছে হচ্ছে সব জীনিস চুরমার করে ভেঙ্গে ফেলতে। নাহ্ বাবা মাকে বুঝাতে পারে না পারে বউকে বুঝাতে। সবাই এক ক্যাটাগরির। কেউ আর ওকে বুঝার চেষ্টাটাও করলোনা।
বিছানায় বসে সবুজের খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। মেয়ে হলে এতোক্ষন ঠিক কেঁদে দিতো।
মিমকে প্রচন্ডভাবে মিস করতে লাগলো। বিছানাটা খালি খালি লাগলো। ওকে ছাড়া এক মুহুর্ত ও থাকা অসম্ভব। নচ্ছার মেয়ে কোথাকার। দেখলো জামাই রাগ করে চলে আসলো তবুও একটিবার ফোন পর্যন্ত করলোনা। ঠিক মত পৌছেছে কিনা এটা জানার জন্যেওতো মানুষ ফোন করতে পারে?
আর এদিকে কিনা ও বউ এর শোকে হেদিয়ে মরছে?
খালি একটা গানই মাথায় আসছে,
” ও পাষাণী বলে যাও, কেন ভালো বাসনি”
আচ্ছা ও যদি এখন এই গানটা গাইতে বসে তবে ওকে সবাই পাগল ঠাওরাবে।
অফকোর্স ও পাগল হয়ে যাচ্ছে। ওকে ইমেডিয়েট পাগলা গারদে যেতে হবে।
সবুজ শার্ট ঠিক করতে করতে নিচে নামে।
” কোথায় যাচ্ছো?”
” এক্সট্রেমলি সরি মা, আমার একটা ইম্পোর্টেন্ট কাজ পড়ে গেছে। আজকে বাসায় ফিরবোনা। টেনশন করোনা ফোন অন থাকবে।”
সবুজ দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।
শিউলির মুখে পানি থাকায়। গেলার আগেই মুখ থেকে পানি পড়ে গেলো । সবুজের কান্ড দেখে হেচকি শুরু হয়ে গেলো।
” রাক্ষসের মত গাণ্ডেপিণ্ডে গিললেতো হেচকি উঠবে?”
শিউলি রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।
” কি আমি গাণ্ডেপিণ্ডে গিলি? এই কথা বলার সাহস তুমি পাও কি করে।”
” তোমার হেচকিতো বন্ধ করে দিলাম। এবার যা খুশি বলো।”
সোহেল স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হে হে করে হেসে উঠলো।
চলবে…