# রক্ষিতা
# Part -11
# Writer – Taslima Munni
না কাজল, তোমাকে সব শুনতে হবে।
সেদিন আমি ইচ্ছে করেই তোমার সাথে এমন করেছিলাম। মিথ্যা বলবো না, তোমার জন্য আমার সব ধরনের পেশন ছিলো। তাই তুমি যখন চড় মারলে আমার ভেতরে জেদ চেপে যায়, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে তোমাকে আমার করে পেতে চেয়েছি।
কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম তুমি কিছুতেই বিয়েতে রাজি হবে না। তাই অনেক টা ব্ল্যাকমেইল করেই বিয়ে টা করি।কারণ তোমাকে কোনো কিছুর বিনিময়ে হারাতে চাইনি।।
আমার জেদ ছিল ঠিকই, তারচেয়ে বেশী মনের মধ্যে একটা বাসনা ছিলো, কোথাও একটা আশা ছিল যে তোমার মাঝে সবটাই পাবো যা আমি এতো দিন খুঁজেছি।
আমি বোকার মতো হা করে আকাশের কথা শুনছি। তারপর বললাম
– এই জন্যই বুঝি দুই বছরের জন্য বিয়ে করেছিলেন?
আকাশ মৃদুহেসে বলে – তোমার কি মনে হয়, এতো কাঠখড় পুড়িয়েছি দুই বছরের জন্য?
আমি বলেছি আর তুমি সিরিয়াসলি নিয়ে বিশ্বাস করেছো। এটা দেখে আমি খুব মজা পাচ্ছিলাম। আর সত্যিটা জানাইনি আরও একটা কারণ আছে। আমি চেয়েছিলাম তোমার মনের কাছাকাছি যেতে। তুমি আমাকে অনেক খারাপ ভাবতে আর ভাববেই না বা কেন? আমি এমনই ছিলাম।কিন্ত বিশ্বাস করো আমি আমার জন্য একটা আশ্রয় চেয়েছি তোমার মধ্যে। আমার কোনো কিছুর অভাব ছিলো না। নারী – বাড়ি -গাড়ি! কিন্তু আমার নিজের একটা মানুষ ছিলো না, যাকে আকঁড়ে ধরে বাঁচবো।
আকাশের কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিনা।
– এতো দিন তো বলেননি।।
– বলার সু্যোগ হয়ে ওঠেনি।আর বলতে ইচ্ছেও করেনি। চেয়েছিলাম দুই বছর পরে যখন তুমি এই কথা তুলবে তখন বলবো।।
– তবে আজ কেন বললেন?
– আজ বলতে ইচ্ছে করছে তাই।
– ভয় পাচ্ছেন যদি কখনো আর বলতে না পারেন?
– ‘না কাজল, ভয় পাচ্ছি না। শুধু তোমার মনের জোর হতে চাইছি,তাই বললাম।
আমি ভীষণ একা। ভীষণ। তোমার বাবা-মা ছিলো, সুন্দর একটা শৈশব ছিল, কিন্তু আমার? সবাই থেকেও আমি একা। আমার শৈশব চিড়িয়াখানার বন্দী জন্তুর মতো ছিলো। বাবা-মা যখন ঝগড়া করতো আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যেতাম। আমাকে কেউ বুঝতে চায়নি।দেখো না আমার নিজের বাবা-মা ই ফেলে….
তোমার জন্য আমার সব বদলে গেছে। প্রথম দিকে জেদের বশে অনেক রাফ ব্যবহার করেছি।কিন্তু পরে নিজেই গিলটি ফিল করতাম। তোমার কাছে যাবার হাজার টা বাহানা খুঁজতাম। ‘
সাত সাগরের পানি বুঝি আজ দুজনের চোখ দিয়ে ঝরে পড়বে। কতটা সময় পাবো জানি না। হয়তো এটাই শেষ কথা আকাশের সাথে শেষ কথা। চোখ মুছে আকাশ বললো- মাঝরাতে ঘুমের ভান করে তোমাকে জড়িয়ে ধরতাম যাতে তুমি বুঝতে না পারো,আসলে আমি তোমার শরীরের ঘ্রাণ নিতে চাইতাম। জড়িয়ে ধরলে মনে হয় ফাঁকা যায়গাটা পূর্ণ হয়েছে।
আকাশ কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আমি কি বলে সান্ত্বনা দিবো আকাশ কে?
এ কেমন নিয়তি?
– আকাশ?
চোখ মুছতে মুছতে বললো – বলো।
– একটা বার আমাকে জড়িয়ে ধরবেন?
আমাকে ওর বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। যদি পারতো হয়তো বুক চিড়ে ভেতরে রেখে দিতো। আকাশের কান্না বোধহয় বাঁধ ভেঙে গেছে। আমিও আকাশকে জড়িয়ে ধরেছি যেন কোনো কিছুই আমাদের আলাদা করতে না পারে।
হয়তো আর কখনো এভাবে ধরতে পারবো না। আকাশের বুকে জড়িয়ে আমার পৃথিবী ভেঙে কান্না আসছে।।
– আকাশ, আমি বাঁচতে চাই। আমি তোমার সাথে বাঁচতে চাই।
আমি পাগলের মতো আকাশের সারা মুখে চুমু খেয়ে যাচ্ছি। এই পাগলটাকে আর কখনো দেখতে পাবো না এটা মনে হতেই ওকে আবারও ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।।
আমি বাঁচতে চাইছি।আমি আকাশের জন্য বাঁচতে চাইছি।
– তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে।
– আকাশ, প্লিজ তুমি অপারেশন বন্ধ করো।আমি অপারেশন করাবো না।।
– কেন? করাবে না কেন?
– অপারেশন না করলে আমি কয়েকটা দিন থাকতে পারবো তোমার কাছে। অপারেশনে যদি মরে যাই?তবে আর একটা দিনও পাবো না…
– এই মেয়ে! একদম চুপ। আবার যদি এসব কথা বলেছো তো আমিই তোমাকে মেয়ে ফেলবো!
আকাশ কান্না কিছুতেই থামাতে পারছেনা।
এদিকে আমার মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।
– আকাশ, ভীষণ ভালবাসি তোমায়। অনেক বেশি…
– আর কোনো কথা নয়।আমি জানি তুমি আমাকে ভালবাসো। আমিও অনেক বেশি ভালবাসি তোমাকে। তাই আমার কথা শুনতে হবে। চুপ করে শুয়ে থাকো।এতো ট্রেস নেয়া ঠিক হচ্ছে না।
– তুমি আমার হাত ধরে বসে থাকো।
– এইতো আমি হাত ধরে আছি।মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমাতে চেষ্টা করো।
দুপুর থেকে আমার খাবার বন্ধ করে দিয়ে স্যালাইন দিচ্ছে। ঘুমের পরিমাণ বেড়ে গেছে আমার। যতক্ষন জেগে থাকি তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করি।
সারারাত কেটে গেছে। খুব ভোরে ঘুম ভাঙলে দেখি আকাশ আমার হাতেই মাথা রেখেই ঘুমিয়ে আছে। আমি আকাশকে দেখছি।আমার দৃষ্টি স্পষ্ট নয়,ঝাপসা। ঝাপসা চোখেও আমি দেখছি আকাশকে। একটা হাত আস্তে আস্তে ওর মাথায় রাখলাম। ঘন্টা তিনেক পরে অপারেশন। আমি জানি না আর কখনো ওকে স্পর্শ করতে পারবো কিনা।ভীষণ ভয় হচ্ছে আমার।
আমার হাতের স্পর্শে আকাশ জেগে ওঠে।
– ঘুম ভাঙলো কখন?ডাকলে না আমায়?
ক্ষীন স্বরে বললাম – এখন।
আর কোনো কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে।
আমার ভেতরে কেমন একটা করছে। মনে হচ্ছে দম আটকে আসবে। ভয় করছে,ভীষণ ভয় করছে।
সময় হয়ে গেছে। আমাকে ও.টি. তে নিয়ে যাচ্ছে। আকাশও আমার সাথে যাচ্ছে, আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে আছি।শেষ বারের মতো সবাইকে এক নজর দেখে নিলাম। অপারেশন টেবিলে নেবার আগে আমাকে স্যালাইন পাল্টে দিলো।আরও কয়েকটা ইনজেকশন দিলো।
আমার মনে হচ্ছে সারা দুনিয়া ঘুরাচ্ছে।মাথা কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। টেনে খুলে রাখার চেষ্টা করছি। আমি চোখ খোলা রাখতে চেষ্টা করছি….
এদিকে আকাশসহ সবাই উদ্ধিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে ও.টি. এর বাইরে। সাড়ে তিন ঘন্টা পরে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। আকাশ ছুটে যায়
ডাক্তারের কাছে।
– ডক্টর??
– অপারেশন শেষ হয়েছে। ৮ ঘন্টা পরে জ্ঞান ফিরবে। তবে রোগীকে এখন ৪৮ ঘন্টা I.C.U. তে রাখা হবে অবজারভেশনে।
– আই.সি.ইউ তে কখন দিবেন, ডক্টর?
– এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
– আমি কি একবার দেখতে পারি?
– সরি মি. আকাশ। এটা এলাউ করা হয় না।
– প্লিজ, ডক্টর একবার জাস্ট দেখেই চলে আসবো।
ডাক্তার একটু ভেবে বললেন – ওকে। শুধু দেখেই চলে আসবেন, তবে আপনাকে অন্য ড্রেস পড়ে যেতে হবে। ইনফেকশনের রিস্ক আছে রোগীর।
– ওকে ডক্টর, থেংকুউ।
– আসুন আমার সাথে।
আকাশ ডাক্তারের সাথে চলে যায়।
কত মিনিট, কত ঘন্টা,কত দিন পরে চোখ খুলেছি আমি জানি না। অক্সিজেন লাগানো।চোখও পুরোপুরি খুলতে পারছিনা। মাথা নাড়ানো যাচ্ছে না। যন্ত্রণা হচ্ছে। শরীর কেমন ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে।আমি কাউকে ডাকবো এমন শক্তি পাচ্ছি না। তারপর ও সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে ডাকতে চাইলাম, কিন্তু গলার স্বর যেন বসে গেছে। বেশ কিছু সময় পরে একজন নার্স কাছে এলো।তাকে বলতে চাইলাম,কিছু বলতেও পারছিনা।হাত দিয়ে যে ইশারা করবো সে উপায় নেই,হাত উপরে তুলতে পারছিনা।কোনোরকম হাতের দুইটা আঙুল নাড়ালাম। নার্স বললো – কিছু বলবেন?
আমি ঠোঁট নেড়ে বললাম – আকাশ।কিন্তু নার্স বুঝতেই পারলো না।।
যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।যদিও অক্সিজেন লাগানো আছে, তবুও নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যেই চরম পর্যায়ের ব্যথা অনুভব করছি। চোখ যেন বেরিয়ে যাবে ব্যথার তোড়ে।খিচুনির মতো হচ্ছে।
রোগীর অবস্থা বেগতিক দেখে নার্স ভয় পেয়ে যায়।ছুটে যায় ডাক্তারের কাছে।
আমি অনুভব করতে পারছি যে আমি মারা যাচ্ছি। বারবার মনে হচ্ছে মানুষ মারা যাবার সময় এমন অনুভূতি হয়? আমি মরতে চাই না। বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। একবার শ্বাস নিলে মনে হচ্ছে এটাই শেষ, পরের নিঃশ্বাস টা আর ফেলতে পারবো না। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি- হে আল্লাহ, আমাকে বাঁচতে দাও,আকাশের জন্য বাঁচতে দাও।আমি ছাড়া ওর কেউ নেই।
এমন করুণ একটা সময়, আমি আকাশকে একা ফেলে চলে যাচ্ছি। যাচ্ছি না ; যেতে হচ্ছে। আমি লড়াই করছি বাঁচার জন্য।এমন একটা অদ্ভুত সময় আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সেই সে নদী, নৌকার বয়ে চলা।একটার পর একটা ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ আমার কানে আসছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার মা রান্নাঘরে রান্না করছে, বারান্দায় বাবার সাথে ছোট্ট একটা মেয়ে খিলখিল করে হাসছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি।এই মেয়েটা আমি?
নদী দূরে সরে যাচ্ছে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।
চলবে….