রক্ষিতা শেষ পর্ব

# রক্ষিতা
# Part – 12( শেষ পর্ব)
# Writer: Taslima Munni

নদী দূরে সরে যাচ্ছে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। আমার মা-বাবা,বাবার সাথে খিলখিল করে হাসা মেয়েটা, আমার চিরচেনা আঙিনা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে…. নাকি আমি সরে যাচ্ছি??
এবার আমি বুঝতে পারছি বাঁচার সব চেষ্টা বৃথা। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেও এমন ভিশন হয়!
হঠাৎ আমি নিজেকে দেখতে পাই শুনশান নীরব এক অন্ধকার প্রান্তরে। খোলা প্রান্তরে শুধু অন্ধকার! এই অন্ধকারেও হালকা হালকা দেখা যাচ্ছে চারিদিক। কোথাও কেউ নেই। ভয় পাচ্ছি আমি। ভীষণ ভয়।
আমি কি মারা গেছি? মৃত্যুর পরে এখানে আনা হয়েছে?
কে কথা বলছে? হঠাৎ করে এতো মানুষের আওয়াজ! কোলাহল! কে আমার নাম ধরে ডাকলো? – মামা?
না, অইতো সুমনা ডাকছে। কিন্তু কোথায়? আকাশ ডাকছে, বাবা- মা কথা বলছে! সবাই কথা বলছে! এতো মানুষের কোলাহল! কিন্তু আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না কেন??
– তোমরা কোথায়? আমাকে নিয়ে যাও।
আমি গলা ফাটিয়ে ডাকছি…. কিন্তু….
ঐ তো এইখানে দেখা যাচ্ছে… আমি ছুটে যাই।
মুখ থুবড়ে পড়ে গেছি। না এখানে কেউ নেই,কেউ ছিলো না ।
কিন্তু সবার কথা শুনতে পাচ্ছি… এই অন্ধকার খোলা ময়দানে…. একি! শব্দগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে! আর কোনো শব্দ, আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না… সব ক্ষীণ হয়ে গেছে…
আবার সেই নীরবতা।
মাঠের শেষ প্রান্তে একটা ঘন জঙ্গলের মতো দেখতে পাচ্ছি। এটা কি?
জঙ্গল নয়,এটা কোনো প্রাচীর মনে হচ্ছে। কিসের প্রাচীর? কি আছে প্রাচীরের ঐ পাশে?
হঠাৎ অদৃশ্য একটা শক্তি আমাকে ঘিরে ফেলে। আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যেতে চাইছি না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি একটা ঝলমলে আলো সেই প্রাচীরের গায়ে! যেন একটা ফটক!
আমাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে।
হে আল্লাহ, তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও, একটা বার বাঁচার সুযোগ দাও,এই প্রাচীর পেরিয়ে গেলে আর কোনো দিন ফিরতে পারবো না এপাশে।
আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইলাম, সব ব্যর্থ হয়ে গেল।আমি ফটকের ঠিক সামনে। ভীষণ অভিমান হলো।
কার উপর জানি না।
নিতে চাও আমায়? বেশ নিয়ে যাও..
ঠিক এই মুহূর্তে আমার না কোনো ব্যথা করছে, না কোনো যন্ত্রণা, না কোনো অনুভূতি। এক সেকেন্ডের জন্য সব থমকে গেছে, সাথে আমিও।
আমার চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেল।

রোগীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে দেখে নার্স ভয় পেয়ে ডাক্তার ডেকে আনে।ডাক্তার ছুটে আসে। অপারেশন পরবর্তী সংকট! রোগী জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে অপারেশনের ঝক্কি সামলাতে পারছে না। শারীরিক অবস্থা কিছুতেই পেরে উঠছে না।রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ডাক্তাররা ছোটাছুটি শুরু করলো।
আকাশ আই,সি,ইউ এর বাহিরে বসে আছে। ডাক্তার যেতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলো কি হয়েছে ডাক্তার কিছু বলেনি।তাড়াতাড়ি রোগীর কাছে গেলেন।
পরে ডাক্তারের ছোটাছুটি দেখে আকাশ বুঝতে বাকি রইলো না যে কাজলের অবস্থা ভালো নয়।
– ডক্টর, কি হয়েছে আমাকে বলুন।কাজল কেমন আছে?
– দেখুন একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে।
আকাশ খুশি হয়ে বললো – আমি দেখা করতে পারি?
– সরি,জ্ঞান ফিরেছে ঠিক, কিন্তু..
– কিন্তু কি ডক্টর?
– অপারেশন পরবর্তী কিছু ঝুঁকি থেকে যায়।এই ধাক্কা সামলানো রোগীর পক্ষে কঠিন।
অপারেশন এর পর একটা অস্বস্তি আর অপারেশনের জায়গায় ব্যথা এটা জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে তীব্র হয়ে যায়। রোগীকে এটা সামলে নিতে হয়।এখন যদি এই অবস্থায় রক্তক্ষরণ হয় তবে রোগী মারাও….
আমরা আবারও ঘুমের ইনজেকশন আরও কিছু মেডিসিন দিয়েছি। এখন শুধু অপেক্ষা করতে হবে কখন জ্ঞান ফিরে, কারণ উনার খুব ধকল গেছে যে…. এটা খুবই আশঙ্কাজনক!

আকাশ ধপ করে এখানেই বসে পড়ে। ডাক্তার বললো – ‘আপনি চাইলে রোগীর পাশে অপেক্ষা করতে পারেন।তবে কান্নাকাটি বা শব্দ করলে সেটা সম্ভব হবে না।। আসুন আমার সাথে।’
আকাশ এখন আর কাঁদছে না।একদম চুপ হয়ে গেছে। আকাশ কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। চুপচাপ ডাক্তারের পিছনে গেল।।

৮ বছর পর।
এক পড়ন্ত বিকালে আকাশকে দেখা যায় দুটো ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ের সাথে বাগানে ভলিবল নিয়ে খেলছে। আকাশের পাঁচ বছরের জমজ দুই মেয়ে আরশি আর আভা।আকাশের স্ত্রী বাগানের চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছে, সম্ভবত কিছু লিখছে।
জীবন থেমে থাকে না। নানা উত্থান-পতনের আবর্তে জীবন চলে জীবনে নিয়মে। তেমনি সুখ-দুঃখের পালা চলতেই থাকে।
সময়ে কিংবা অসময়ে; প্রিয়জনকে হারানো আশঙ্কা বা হারানো কষ্ট কোনো কিছুর বিনিময়ে ভুলানো যায় না। এই ক্ষত সহ্য করা সত্যিই ভীষণ কঠিন।
কিন্তু সময়, সময় আমাদের অনেক কিছু সহ্য করার অভ্যাস হয়ে যায়। তবুও আমরা চাইনা কেউ হারিয়ে যাক। জীবন চক্রে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। নিয়তির বিধান মেনে নেয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। প্রিয়জনকে হারানোর ভয় বড্ড বেশিই হয়।
তবে, উপরওয়ালা যা লিখে রাখবেন তা-ই হবে,তার ব্যতিক্রম নয়।।

আকাশ নতুন করে জীবন শুরু করেছে। স্ত্রী আর পরীর মতো দুই মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখে দিন যাচ্ছে আকাশের।
দুই মেয়ে বায়না ধরলো আইসক্রিম খাবে।
তাদের বাবাকে রাজি করানো জন্য দুইজন দুইপাশ থেকে গলায় জড়িয়ে ধরে বলছে- সোনা বাবা না তুমি, তুমি তো আমাদের বেস্ট পাপা, শুধু আজকেই আইসক্রিম খাবো।প্লিজ পাপা,চলনা! প্লিজ প্লিজ প্লিজ!
মেয়েরা যখন কিছু বায়না করে, তখন আকাশকে ‘ সোনা বাবা ‘ ডাকে।
আকাশ বেশ উপভোগ করে, তাই আরও কিছু সময় রাজি না হবার অভিনয় করে। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়।
– কিন্তু তোদের আম্মু কি রাজি হবে?
– তুমি রাজি করাবে।
– ওরে বাবা! আমি নেই।
– পাপা,তুমিও কি আম্মুকে ভয় পাও??
বেচারা আকাশ!পাঁচ বছরের মেয়ে দুটোও জেনে গেছে আকাশ চৌধুরী বউকে ভয় পায়।
মুচকি হেসে বলে – ভয় পাবো না! দেখিস না আমরা খেললেই চেচামেচি করে, গুছানো সবকিছু নাকি নষ্ট করে ফেলি! আমার কানের পোকা মরে যায়!

বাবা – মেয়েদের কথার ভঙ্গি সুবিধার মনে হচ্ছে না। মেয়ে দুটো মুখচেপে হাসছে। আকাশের স্ত্রী সেটা আঁড়চোখে খেয়াল করছে।
লাইন ধরে তিনজন এসে হাজির আকাশের স্ত্রীর কাছে।
– কি চাই?
– আইসক্রিম।
– হবে না।
– প্লিজ একবার।
– নো।
– প্লিজ আম্মু,
আম্মু চলনা অনেক দিন বাহিরে যাইনা একসাথে। সামার ভেকেশন চলে যাচ্ছে।
– পরশুও বের হয়েছিলাম। মাঝখানে একটা দিন গেছে মাত্র!
– বাচ্চারা এতো করে বলছে, প্লিজ চলনা আমারও খুব ইচ্ছে করছে আজ এক যায়গায় যেতে।
– কোথায়?
– আগে চলই না।পরে দেখবে,আইসক্রিম খেতে খেতে যাবো সবাই।
– হুম!! যাও রেডি হয়ে নাও।
আরশি আর আভা খুশিতে লাফাচ্ছে।
আকাশ ওদের নিয়ে ভিতরে যাচ্ছে। আকাশের স্ত্রী তখনও লিখছে।।
আকাশ ফিরে দেখে ওর স্ত্রী উঠার নাম নেই!!
– এই কাজল! তাড়াতাড়ি আসো না! বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে।
– হুম,এইতো আসছি।লেখাটা শেষ করেই… প্রায় শেষ, পাঁচ মিনিট প্লিজ।।
– ওকে, তাড়াতাড়ি কিন্তু
আকাশ মেয়েদের নিয়ে ভেতরে যায়।কিন্তু কাজল কি লিখছে? চলুন দেখে আসি…..

” আমি বুঝতে পারছিলাম মারা যাচ্ছি, আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। কোনো অনুভূতি নেই।তারপর মনে হয় কত যুগ কত আলোকবর্ষ পেরিয়ে গেছে। আমি চোখ খুলে বুঝতে চেষ্টা করছি কোথায় আমি। আমি কি মারা গেছি? মৃত্যুর পরে এখানে এসেছি?
ভালো করে চোখ খুলে দেখি আমার চিরচেনা একটা মুখ- আকাশ ; আমার হাত ধরে বসে আছে। আমি বুঝতে পারলাম আমি মারা যাইনি।
এই প্রথম অনুভব করলাম বেঁচে থাকার স্বাদ।। মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছি,শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়ি ইনজেকশন দেয়ার পর।
তারপর কয়েকমাস কেমোথেরাপি নিয়ে বছর দেড়েক পরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠি।
আমি আমার আকাশ, আরশি- আভা,এই বাড়ি, সংসার দু’হাতে আগলে রেখেছি আমার বুকে।আকাশ আর আমি দুজন দুজনের রক্ষাকবচ।একটা মুহূর্ত তাকে ছাড়া অন্যকিছু আমার ভাবনায় নেই। মেয়ে দুটো আমাদের চোখের মণি। একদিন আমাদের মেয়েরা বড় হবে, ওদের বিয়ে দিবো।
আমি আর আকাশ বুড়ো হবো! আকাশের চুলে পাক ধরবে! হয়তো মুখভর্তি দাড়ি থাকবে? কেমন দেখাবে আকাশকে?🤔🤔
আমরা দুজন বুড়ো-বুড়ি মিলে বসে বসে পুরনো স্মৃতি আওড়াবো।বুড়ো আকাশ তার বুড়ো বউকে নিয়ে রোজকার মতো সকালে হাঁটতে হাঁটতে সেই শিউলি তলায় এসে দাঁড়াবে। যখন ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকবে আকাশ কিছু ফুল কুড়িয়ে আমার আচঁলে দিবে।🙂☺

# সমাপ্ত #

ছোট্ট একটা বাস্তব ঘটনাঃ-
২০১৭ সাল,একটা মেয়ে হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে,তীব্র মাথাব্যথা। এক সপ্তাহের মধ্যে চোখ ঝাপসা থেকে ঝাপসা হয়ে যায়। অনেক ডাক্তার কারণ খুঁজে পায় না।শেষ পর্যন্ত এক ডাক্তার জানায় মেয়েটার ব্রেইন টিউমার! পরিবারের কেউ মেয়েটাকে জানায় না, কিন্তু মেয়েটা জেনে যায়। তখন মেয়েটার মনের অবস্থা কি কেউ অনুমান করতে পারেন? যে মেয়েটা জানতে পেরেছে তার সময় সীমিত!
৪ দিন এই অবস্থায় যাবার পর নিউরোলজিস্ট চূড়ান্ত রিপোর্টে জানায় – ব্রেইন টিউমার নয়,মেয়েটার হাউড্রোক্যাফালাস হয়েছে ( মস্তিষ্কে পানি জমা), যাতে মেয়েটা অন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমনকি শেষ পর্যন্ত মারা যাবে যদি এই পানি ব্রেইন থেকে বের করা না হয়। একদিন পরেই থেকে একটা সার্জারীর মাধ্যমে এক সপ্তাহ ব্রেইন থেকে পানি বের করা হয়। প্রথম যখন চোখ মেলে তখন টানা ২ ঘন্টা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত বেঁচেযায়। তবুও নতুন করে শঙ্কা দেখা দেয় ব্রেইন টিউমারের!পুনরায় পরীক্ষার মাধ্যম নিশ্চিত হয়, টিউমার নেই।
১৫ দিন হাসপাতালের তিক্ত অভিজ্ঞতা আরও মাস খানেক নিজের ভারসাম্য রেখে একা হাঁটতে পারতো না। মেয়েটার চোখ ৮০% নষ্ট হবার কথা ছিলো ( অনেকেই অন্ধ হয়ে গেছে)কিন্তু আল্লাহর রহমতে ৮০% ভালো, আর ২০% ড্যামেজ হয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে বছর দেড়েক সময় গেছে। কাজলের অসুস্থ কালীন অনুভূতি , মৃত্যুর সাথে লড়াই ; সব মেয়েটার বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিচ্ছবি। একটা প্রেমের গল্পে জীবনের এসব ঘাত-প্রতিঘাত তুলে ধরতে চেয়েছি।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here