ভালোবাসার রাত পর্ব ৩

ভালোবাসার-রাত
#রোকসানা
পর্ব (৩)
ঘুমের ঘোরেই তীলের মনে হলো কেউ তার উপর উঠে আসছে। তার পড়নের জামাটায় কেউ হাত দিয়ে পেটের দিক থেকে জামাটা সরাচ্ছে। তীল ঝট করে চোখ খুলতেই মাথাভর্তি ঝাঝড়া চুল দেখতে পেলো। মাথাটা আসতে আসতে নিচের দিকে যাচ্ছে। তীলকে অবাক করে দিয়ে তিলের পেটের ডানপাশটাতে কামড় বসিয়ে দিলো৷ তীল চিৎকার করতে নিলেই ওর মুখটা চেপে ধরে এক জোড়া চোখ তার দিকে চেয়ে রইলো,
“” আমি শাড়ী পরাতে গেলেই তোর কান্না পায়,ব্যথা লাগে,সুড়সুড়ি লাগে। আর এখন নিজে পেট বের করে শাড়ী পড়ে ছেলেদের পাগল করে বেড়াচ্ছিস? তাও আমাদের বাড়িতে আমারি ফ্রেন্ডের? এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে তীল!””
ব্যথায় তীলের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে কানে গিয়ে ঠেকছে। মুখ থেকে হাতটা সরে যেতেই তীল চাপা স্বরে বলে উঠে,
“” লিদ ভাইয়া??””
“” তুই এখনো ‘র’ বলা শিখিসনি??””
রিদের প্রশ্নের শেষে প্রশ্নবোধক চিন্হ হিসেবে ওর চাহনি কাজ করলো। তীল সেই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।
“” নাকি ইচ্ছে করেই আমার নামকে অপমান করছিস?””
রিদের মুখের চোয়ালের সাথে সাথে হাতটাও শক্ত করে চেপে ধরলো তীলের গালদুটো।
“” গালে কি মেখেছিলি? বালুর মতো চিকচিক করছিলো! আর আর ঠোটে কি দিয়েছিলি? গোবর মেখেছিলি নাকি? তোর কি মনে হয় এইসব আবিজাবি মাখলেই ছেলেরা তোর জন্য পাগল হয়ে যাবে?? গাদার মতো তোর পিছে ঘুরঘুর করবে?””
রিদ এমনভাবেই গালদুটো চেপে ধরেছে যে তীল কথা বলার জন্য ঠোটদুটোও এক করতে পারছেনা। অনেক কষ্টে ঠোট না নাড়িয়ে বলতে চাইলো,
“” লিমা জোল কল….””
“” চুপ! তোর ঐ তুতলানো কন্ঠ নিয়ে একটা কথাও বলবিনা। এখন পর্যন্ত ‘র’ বলাই শিখলিনা,তোর সাথে কথা বলা মানেই আমার মেজাজ আরো খারাপ করা।””
রিদ তীলের উপর থেকে হালকা সরে আসতেই তীল উঠে বসে পড়ে। নিজের জামাটা ঠিক করতে নিলেই রিদ আবার ওর পেটটা খামচে ধরলো। রিদের কামড়ের জায়গায় পুনরায় খামচে ধরায় ব্যথায় হালকা কুকিয়ে উঠলো তীল। নিজের একটা হাত রিদের হাতের উপর চেপে ধরতেই রিদ বলে উঠলো,
“” সিগরেট খেয়েছিস কখনো?””
রিদের প্রশ্নে তীল মাথা নাড়িয়ে না বলতেই রিদ নিজের খামচিটা আরেকটু গভীর করে বললো,
“” এইবার তো দাত বসিয়েছি, নেক্সটটাইম এতো কষ্ট করবোনা। জ্বলন্ত সিগারেট লাগিয়ে দিবো!””
রিদ তার কথা শেষ করেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো। তীল তার রিদ ভাইয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। উফ! আপনি দেখতে কি সুন্দর হয়েছেন রিদ ভাইয়া! এইটুকুন দেখায় তো আমার চোখের জ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছেন। আপনার কামড়ের ব্যথার থেকে শতগুন বেশি ব্যথা করছে চোখে। আপনাকে এতোবছর দেখতে না পারার ব্যথা! এভাবে চলে গেলেন কেন?
তীল সারারাত চোখ বন্ধ করে রিদের মুখটা বারবার মনে করার চেষ্টা করছে। কি সুন্দর মাথা ভর্তি চুল, গালভর্তি খোচা খোচা দাড়ি,আর নাকটাও কি সুন্দর লম্বা হয়েছে। ছোটবেলা তো এতো লম্বা ছিলোনা এখন এতো লম্বা কি করে হলো???
তীল ঘুম থেকে উঠেই আয়নার সামনে দাড়িয়ে পেটটা বের করে দেখছে। হালকা বেগুনি কালার দাতের আকার ধারন করে আছে। উনার দাতগুলোও নিশ্চয় অনেক সুন্দর নাহলে আমার পেটে এতো সুন্দর দাগ হলো কি করে???
“” তুই নাকি রিমার বৌভাতে যাবিনা?””
বড় আম্মুর কন্ঠ পেয়ে তীল তাড়াতাড়ী জামাটা নামিয়ে পেটটা ঢেকে ফেললো।
“” কে বললো?””
“” রিদ।””
“” রিদ ভাইয়াকে কে বললো?””
“” রিদ তো বললো তুই বলেছিস!””
“” আমি কখন…””
তীল কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। বড় আম্মুর কাছে এসে বললো,
“” বড় আম্মু,আমি এখনো ‘র’ বলা শিখিনি?””
“” মানে?””
“” এই যে আমি রিদ ভাইয়া বললাম তুমি কি রিদ শুনছো নাকি লিদ?””
“” আমি তো রিদই শুনছি তীল। তোর কি হয়েছে বলতো?””
“”আমার আবার কি হবে? কিছু হয়নি তো!””
“” তাহলে বৌভাতে যাবিনা কেন? রিমাকে আনতে যাবিনা?””
তীল ব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতে বললো,
“” তোমার ছেলে যখন বলেছে আমি যাবোনা তাহলে তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো আমি কেন যাবোনা!””
“” তুই কি বলছিস আমি তো কিছুই বুঝছি না।””
তীল ব্রাশটা মুখে নিয়ে বললো,
“” আমিও বুঝতেছিনা,বড় আম্মু!””
“” তুই আবার কি বুঝছিস না?””
“” ঐটাই তো জানিনা!””
তীল ওয়াশরুমের দরজাটা আটকিয়ে মনের সুখে দাত ব্রাশ করতে লাগলো।
নাস্তার টেবিলে বসতেই বড় আব্বুর প্রশ্নের মুখোমুখি হলো তীল,
“” তোর নাকি শরীর খারাপ? পেটে ব্যথা,মাথা ব্যথা?””
“” কে বললো,বড় আব্বু?””
“” রিদ বলেছে। কাল রাতে নাকি তুই ওর কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে খেয়েছিস??””
তীলের সামনা সামনি বসে রয়েছে রিদ। বড় আব্বুর থেকে চোখটা সরিয়ে রিদের দিকে নিলো। এমন একটা ভাব যেন সে কিছুই জানেনা। এতো বড় মিথ্যা উনি কিভাবে বললো? আমি কখন উনার থেকে ওষুধ চায়লাম? উল্টা উনিই তো,,,
“” কিরে,চুপ করে গেলি যে? তোর কি খুব বেশি শরীর খারাপ? রিমা তো তোর জন্য বসে অপেক্ষা করে আছে। ও জানালো তুই না গেলে ও আসবেইনা।””
“” এটাও কি রিদ ভাইয়া বলেছে?””
“” রিদ বলতে যাবে কেন? রিমা একটু আগে ফোন করে বললো।””
“” ওহ!””
রিদের মানা আর রিমার অভিমানের মাঝে পড়ে তীলের নাজেহাল হওয়ার অবস্থা। সে একটা মানুষ হয়ে দুজনের কথা কিভাবে রাখবে? আর রিদ ভাইয়ারই বা কি হলো হঠাৎ সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে কেন আমি যাবোনা? আমি তো উনাকে এ কথা বলিনি। তাহলে?? এদিকে বড় আব্বু,বড় আম্মু একটু পরপর তাড়া দিচ্ছে রেডি হওয়ার জন্য। আর আম্মু তো পারলে আমাকে এভাবেই কোলে নিয়ে চলে যায়।
“” আব্বু তুমিও পেছনে বসছো তাহলে সামনে কে বসবে?””
“” তীল,আসতেছে। ওকে বসাবি।””
“” তীলও যাবে নাকি?””
রিদের বাবার উত্তর দেওয়ার আগেই তীল গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসলো। রিদ তীলের দিকে না তাকিয়েই গাড়ীতে বসে পড়লো।
রিদের দিকে তাকিয়ে তীলের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো। এবার তো আমি পেট বের করে শাড়ী পড়িনি,ঠোটে লিপস্টিক দেইনি,গালে পাউডার মাখিনি,চোখে কাজল দেইনি তবুও কেন উনার মুখে রাগ দেখতে পাচ্ছি? শুধু উনার কথা শুনলেই হবে আমার তো এ বাসার সবার কথাই রাখতে হয়। উনি এমন কেন? আসার পর থেকে মুখটাকে এমন করে রেখেছে। মুখটাতে কি একটু হাসি আনা যায় না???
“” কিরে,কি ভাবছিস?””
রিমার কথাই তীল নড়ে চড়ে উঠে,
“” ঐ আমি কি তোকে মাথায় করে নিয়ে যাবো যে আমি না আসলে তুই যাবিনা?””
“” নিতে পারলে তো ভালোই হতো। তোকে খুব মিস করছিলাম তো।””
“” তোর মিসের খেতা পুরি। বিয়ে করেও আমাকে শান্তি দিলিনা।””
তীলের কথার মাঝখানেই সিজাত তীলের খোলা চুলে একটি গোলাপ এনে গুজে দিলো।
“” আপনার এই খোলা চুলে যাতে কারো নজর না লাগে তাই গোলাপ দিয়ে নজর কাটা দিয়ে দিলাম,কেশবতী।””
“” গোলাপ দিয়ে নজর কাটা?””
সিজাত হালকা লজ্জা নিয়ে বললো,
“” জ্বী,আমিতো ভেবেছিলাম আপনি মেকাপ সুন্দরী। কিন্তু আজ আপনার নেচারাল লুক সেটা মিথ্যে প্রমান করে দিলো। আপনাকে যত দেখছি আমি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। কাল ওভাবে পালালেন কেন? আপনি কি জানেন আপনার সাথে সাথে সে রাতে আমার চোখের ঘুমও পালিয়েছে?””
“” ঘুম পালিয়েছে?””
“” জ্বী। আজকে আপনার দেখা পাওয়ায় দেখুন আমার চোখে ঘুমও চলে আসছে।””
সিজাত রিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“” রিমা আমাকে একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে? জাস্ট ১ ঘন্টার জন্য? আমার ভীষন ঘুম পাচ্ছে।””
রিমা আর তীল হা করে সিজাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।
রিমা তীলকে টানতে টানতে নিজের রুম ছেড়ে বের হয়ে আসলো।
“” উফ! এতো জোরে হাত চেপে ধরে আছিস কেন? তোদের কি মনে হয় আমি লোহা দিয়ে বানানো?””
“” তোদের মানে? তোর হাত আমি ছাড়া আর কে চেপে ধরেছে?””
তীল কথার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো,
“” রিমা দেখতো আমার ‘র টা ঠিক মতো উচারন হয় নাকি?””
“” মানে?””
“” র,র,র,র,র,র,র,র,র,র,র,র,র””
তীল সমানে র বলে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক তাকে ‘র’ টা ঠিক মতো উচ্চারন করতেই হবে রিদ ভাইয়াকে দেখিয়ে দিতে হবে সে লিদ না রিদ বলতে পারে। সে তার রিদ ভাইয়ার নামকে অপমাননা বরং ভালোবেসে উচ্চারন করে!
রিমাকে নিয়ে ফেরার সময় রিদের পাশে বসার সাহস হলোনা তীলের। মনে হয়েছে এবার তার পাশে বসলে তাকে চোখ দিয়েই গিলে খাবে। উনার ঐ ছোট ছোট চোখগুলো যখন হা করবে তখন কত বড় হবে???
বাসায় এসেই তীল সবার আগে নিজের গায়ে সেটে যাওয়া গোল্ডেন কালারের জামাটা চেন্জ করায় লেগে গেলো। যেইনা জামাটা দুহাতে ধরে উপরে তুলেছে অমনি দরজা আটকানোর শব্দ পেলো তীল৷ জামাটা ছেড়ে দিয়ে অবাক হয়ে বললো,
“” আপনি?””
রিদ দরজা আটকিয়ে তীলের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“” আমি নিষেধ করার পরও তুই রিমার শ্বশুরবাড়ি গেলি কেন?””
“” বল আব্বু…””
তীল বুঝতে পারলো এই মুহুর্তে সে আবার ‘র’ বলা ভুলে গেছে। নিজের মুখটা নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে অসহায়ভাবে রিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
“” খুব কথা শুনার মেয়ে হয়ে গিয়েছিস না? আমাকে মিথ্যা প্রমান করে দিয়ে ধেই ধেই করে আব্বুর কথা শুনে ভালো মেয়ে সাজছিস?””
তীল কি বলবে বুঝতে পারলোনা এই মুহুর্তে রিদের দিকে তাকিয়ে থাকাও তার জন্য কষ্টকর হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে মাটিতে তাকাতেই রিদের হাত এসে তীলের চুলগুলো মুঠোতে আটকে নিলো।
“” আমি এখন আপনি হয়ে গেছি? আমি তোর অপরিচিত কেউ, না?””
“” আহ! চুলে লাগছে লিদ ভাইয়া।””
“” তোর এই চুল আমি ছিড়ে ফেলবো। জানিস তো চুলের কেজি কত??””
“” লিদ ভাইয়া!””
রিদ পকেট থেকে একটা ব্লেড বের করে তীলের সামনে ধরতেই তীল ভয়ে নড়ে উঠে।
“” লিদ ভাইয়া আমি আল ঝুটি কলবোনা। আমাকে ছেলে দাও,লিদ ভাইয়া।””
“” তুই আমার কথার অবাধ্য হয়ে আজকেও ঝুটি করে স্কুলে গিয়েছিস। আর এটার শাস্তি তোকে পেতেই হবে,তীল।””
“” আল কলবোনা। ছেলে দাওনা,লিদ ভাইয়া!””
তীলের কান্না সেদিন রিদের রাগকে ধমাতে পারেনি। শাস্তি স্বরুপ তীলের মাথার কালো ঝলমলে ছোট ছোট চুলগুলো হারিয়ে ফেলেছিলো।
সেই ছোটবেলার একি কান্ড কি আজকেও ঘটতে যাচ্ছে তার সাথে? তীল রিদের হাতের ব্লেডের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে,মাথাটাও ভার ভার হয়ে আসছে। তীল রিদের দিকে তাকাতেই চারপাশে অন্ধকার হয়ে আসছে দেখতে পেলো। সবকিছু এমন অন্ধকার হয়ে আসছে কেন? বিদ্যুৎ চলে গেলো??? তীল আর কিছু ভাবতে পারলো না। কাপতে কাপতে রিদের বুকে ঢলে পড়লো
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here