ভালোবাসার-রাত
#রোকসানা রাহমান
পর্ব (৬)
শাওয়ার শেষে বের হতে গেলেই তীল বুঝতে পারলো তার দরজা খুলছেনা। বারবার সিটকিনি নাড়িয়ে চাড়িয়েও যখন দরজা খুলতে পারলোনা,ভয়ে তীলের গলা শুকিয়ে এলো। চিৎকার করে আম্মুকে ডাকছে আর দরজা বাড়ি দিচ্ছে। দরজার ওপাশ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে উঠলো,
“” গলা ভেংগে চিল্লালেও কেউ শুনতে পারবেনা। বাসায় কেউ নাই।””
রিদের কন্ঠ পেয়ে তিলের কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো। এমনি শুকনো কাঠ যা রোদের কঠোর তাপে শুকিয়ে ফাটল ধরেছে। তাহলে কি বাইরে থেকে উনিই লাগিয়ে রেখেছে?? আবার কি করলাম? আবার কোন অন্যায়ের শাস্তি পাবো আমি?
তীল দরজা থেকে হাত সরিয়ে সোজা লম্বা সুপারির গাছ হয়ে দাড়িয়ে গেলো। কাল রাতের শাস্তি পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কি কি করেছে সবকিছু সময়সীমা ভেবে সাজাতে লাগলো। তেলাপোকা বলেছিলাম দেখে তো উনি শাস্তি দিয়েইছিলেন তাহলে? তারপর আর কি ভুল করছি?? তীল বারবার মনে করার চেষ্টা করেও কিছু খুজে পাচ্ছেনা। ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মাথার মগজটা পানিতে চুবিয়ে রাখতে তাহলে যদি ঠিকঠাক মতো সাড়া দিতো। তীলের ভাবনার মাঝেই ওয়াশরুমের লাইটটাও অফ হয়ে গেলো। আর সাথে সাথেই তীল চিৎকার করে দরজায় বারি মারতে শুরু করে।
“” লিদ ভাইয়া,আপনি তো জানেন আমি অন্ধকালকে ভয় পাই! দলজা খুলুননা প্লিজ!এমন কেন কলছেন?””
রিদ তীলের বিছানার উপর শুয়ে আছে। হাত দুটো মাথার নিচে নিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“”চল একটা গেম খেলি,যদি তুই বের করতে পারিস তোকে আমি কেন অন্ধকারে বন্দী করে রেখেছি তাহলে ছেড়ে দিবো। এখন তুই ঠিক কর তুই শাস্তির সময়টা কতটা নিবি।””
“” আমি জানিনা। আপনি বলে দিন। তাল আগে আমাকে বেল হতে দিন,লিদ ভাইয়া। খুব ভয় কলছে!””
“” ভয়কে জয় করতে শিখ। আর শাস্তির কারনটা খুজে বের কর। আমার ঘুম ঘুৃম পাচ্ছে। বেশি লেট করলে কিন্তু আমি ঘুমিয়ে যেতে পারি। আর যদি ঘুমিয়ে যাই তাহলে সে ঘুম কখন ভাংগে আমার জানা নাই!””
তীলের বালিশে মাথা রাখতেই সমানে হামি উঠছে রিদের। এটা কি ঘুমকাতুরে বালিশ নাকি? এই ভর সন্ধ্যায় ঘুম পাচ্ছে কেন? আমি তো এই টাইমে কখনো ঘুমাইনা। চোখগুলো কেমন ভার ভার হয়ে আসছে। চোখের পাতাতে জ্বালা ধরেছে। তাহলে কি এটাতে তীলের ছোয়া আছে দেখে এমন ঘুম পাচ্ছে? রিদের মনে এক ভালো লাগার শিহরন বয়ে গেলো। যার ছোয়ামাখা সামান্য বালিশেই আমার চোখে এমন ঘুম নামিয়ে দিতে পারে তাহলে ও নিজেই যদি আমার বালিশ হয়ে যায় তাহলে তো ২৪ ঘন্টায় আমি ঘুমে ঢুলবো! ও মাই গড,কী মারাত্মক কান্ডটায় না হবে!
তীল ওয়াশরুমের ছোট জানালাটা খুলে দিলো। ওখান দিয়ে ছড়িয়ে পড়া ছোট্ট আলোর ঝিলিক পুরো রুমটাকে আলোময় না করতে পারলেও অন্ধকারের গভীরতাকে খানিকটা কমিয়ে এনেছে। কিন্তু তা তীলের মনের ভয়কে খুবই নগন্য পরিমানে কমাতেই সামর্থ্য পেলো। তীল দরজা থেকে মুখ সরিয়ে ছোট,সরু জানালার দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুব দিলো। কিন্তু হাজারবার সব ঘটনা ধাপে ধাপে মিলিয়েও কিছু খুজে পেলোনা। পরক্ষনেই মনে হলো ছোটবেলার স্মৃতিতে ডুব দিলে কেমন হয়??
“” আহ! লাগছে লিদ ভাইয়া,আমাল নতুন চুলিগুলো ভেংগে যাচ্ছেতো। তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?? “”
তীলের কথায় টোকা রিদের গায়েই লাগলো না। তীলের বা হাতটা চেপে ধরে টানতে টানতে ছাদের সিড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাবার সাথে মেলায় ঘুরতে দিয়ে চকচক করা লাল চুড়ির বায়না করেছিলো,তিল। আর বাবাও বায়না পুরন করে, মেয়েকে হাতে পড়িয়ে দিতেই বুঝতে পারলেন,তিনি চুড়ি নয় মেয়ের হাসি কিনেছেন। আর সেই চুড়ি দিয়েই দুহাত ভরে সাজিয়ে খেলছিলো তীল। হঠাই করে খেলার মাঝখান থেকে টানতে টানতে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছে রিদ। হাতভর্তি চুড়ি থাকায় রিদের শক্ত হাতের চাপে টুকটুক করে চুড়ি ভেংগে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। রিদের পায়ের তালের সাথে তীলের ছোট ছোট পাগুলো তাল মিলাতে পারছেনা। মাঝে মাঝেই মিস করে যাচ্ছে!
“” ও লিদ ভাইয়া,বলোনা,আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?””
“”……..””
নিজেরি ভেংগে যাওয়া চুড়ির টুকরোর সাথে পা লেগে তীলেড পা কেটে গেলো। তীল কান্নাঝরিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“” আমাল পা। লিদ ভাইয়া লক্ত!””
তীলের কথায় রিদ থমকে দাড়ালো। পায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে কি হয়েছে।
“” এ্যাাা,ব্যথা,লিদ ভাইয়া লক্ত!””
রিদ এবার তীলের পা থেকে চোখ সরিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই তীল কান্না থামিয়ে রিদের দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
“” লিদ ভাইয়া,সুলসুলি! পেটে সুলসুলি লাগছে!””
রিদ কপাল গুছিয়ে তীলের পেটের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো অন্যমনস্কতায় তীলকে কোলে নেওয়ার সময় ওর জামাটা ভাজ হয়ে পেটের একপাশ থেকে সরে রয়েছে। আর রিদের হাতের আংগুলগুলো ওর পেটে চেপে বসে আছে। রিদ একটা ধমক দিয়ে বললো,
“” এতো হাসছিস কেন? তোকে আমি হাসতে বলছি?””
“” সুলসুলিতো!””
রিদ তীলকে কোল থেকে নামিয়ে আবার হাটিয়ে হাটিয়ে টেনে নিয়ে ছাদে উঠে আসলো। ছাদের কোনায় ছোট্ট খুপড়িতে তীলকে ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিলো। আর বাইরে দরজা আটকিয়ে দিতেই তীল চিৎকার করে কান্না করে রিদকে ঢাকছে।
“” তোর কি মনে হয় তুই তোর খিলখিল হাসি দিয়ে আমাকে ভুলিয়ে দিবি? রবিনের সাথে তোকে খেলতে মানা করেছিলাম না? তাও তোর ওর সাথেই খেলতে হয়? তাও দরজা আটকিয়ে?””
“” আমি তো লুকোলুকি খেলছিলাম,লিদ ভাইয়া। খুলোনা। আমাকে কালা ভুত খেয়ে ফেলবে। আমাল ভয় লাগছে।””
“” যে খেলায় দরজা আটকাতে হয় সে খেলা তুই খেলবি কেন? আমার মানা তুই শুনিস নি তো? এইবার কালা ভুতের সাথেই তুই লুকালুকি খেল। আমি দেখি তুই কত খেলতে পারিস।””
“” লিদ ভাইয়া,কালা ভুত লবিনের মতো ভালো না। আমাকে খেয়ে ফেলবে। কত বলো বলো মুখ,চোখ। আমি আম্মুল কাছে যাবো। খুলে দাও না। আল খেলবোনা।””
তীল চট করে চোখ মেলে ফেললো। আবার দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে রিদকে ডাকতে লাগলো,
“” লিদ ভাইয়া,বিশ্বাস কলো আমি সিজাতকে নিয়ে লুমে আসিনি। বলো আব্বু বললো দেখেই তো সিজাত আমাকে নিয়ে লুমে এসেছিলো। আল উনি তো দরজা আটকাননি এমনি ভিলিয়ে দিয়েছিলো। আমি কিছু কলিনি,সত্যি বলছি। এই নাক ছুয়ে বলছি। দলজা খুলে দাও না প্লিজজজজ!””
ফোনের রিংটোনে রিদের ঘুম ভেংগে যায়। ঘুমঘুম চোখে ফোনটা কানে নিতেই ওর বাবা বলে উঠে,
“” রিদ, আমরা জ্যামে আটকা পড়েছি তাই আসতে লেট হচ্ছে! তুই কি বাসায় নাকি বাইরে? বাইরে থাকলে এখনি বাসায় চলে যা। তীল টা একা বাসায়, অনেক রাত হয়ে গেছে। নিশ্চয় খুব ভয় পাচ্ছে। আমার ফোনে চার্জ…””
ফোনটা কেটে গেলো। রিদ বুঝতে পারলো তার বাবা কি বলতে চেয়েছিলো। ফোনে তাকিয়ে দেখে ১০ টা বেজে ৫৭। ফোনটা পাশে রেখে রিদ আবার চোখটা বন্ধ করতেই লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়ে। চারপাশে তাকাতেই মনে পড়ে সে এখনো তীলের রুমে
তীল? ও মাই গড। রিদ তরিঘরি করে ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই তীলকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে।
“” এই,তীল। আজ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লি যে? খেয়ে শুয়েছিস তো?””
তাসমিয়া বেগমের ডাকে তীল ঘুমে আটকানো চোখটা মেলে তাকায়।
“” কিরে,কিছু বলছিস না যে? খেয়ে ঘুমিয়েছিলি?””
“” আম্মু!””
“” কি?””
তিল আর কিছু বলতে পারলোনা। নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলো।
ডাইনিং টেবিলে বসে তিল সবাইকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। বিশেষ করে রিদকে। সবাইকে তো স্বাভাবিকই লাগছে তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখলাম?? তিল ভাত নাড়তে নাড়তে আবার ভাবনায় ডুব দিতেই তাসমিয়া বেগম বলে উঠে,
“” তুই এমন রাতেরবেলা হাতে চুড়ি পড়ে বসে আছিস কেন? তোর কি খাওয়ার সময় সাজুগুজু করতে ইচ্ছে হলো? হঠাৎ করে এমন সাজ পাগলি হলি কবে? তুই তো নায়িকাদেরকেও ছাড়িয়ে গেছিস।””
মায়ের কথায় তিল হাতে তাকাতেই চোখগুলো রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো। এমন লাল লাল চকচক করা চুড়ি তার হাতে কিভাবে এলো? সেতো কোনোদিন চুড়ির দোকানেই যায় না তাহলে? তিল না চাইতেও রসগোল্লার মতো করা চোখদুটো রিদের দিকে চলে গেলো।
“” তোমার মেয়ের রুপ তো খসে খসে শেষ হয়ে যাচ্ছে,কাকিমা। তাই এখন কাচ টাচ পড়ে খসে যাওয়া রুপকে আবার মুখে লাগানোর চেষ্টা করছে!””
“” চুড়ি দিয়ে রুপ লাগানো?””
“” হুম। তোমার মেয়ে ফেসবুক থেকে এগুলোই তো শিখছে! কয়দিন পর দেখবে আলালের ঘরের দুলালের সাথে ভেগে গেছে। এখনি সামলাও!””
রিদ হাতটা ধুয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। তাসমিয়া বেগম রিদের পায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সামান্য চুড়ির জন্য আমার মেয়ে আলালের ঘরের দুলালের সাথে পালাবে???
তাসমিয়া বেগম মেয়ের কাছে গিয়ে হাতের চুড়ি খুলতে নিলে তিল হাতটা ছাড়িয়ে হাটা ধরে।
তিল হাজার চেষ্টা করেও ঘুমকে বস করতে পারছেনা। বস করতে করতেই মাঝরাত হয়ে গেলো। যেইনা চোখ লেগে আসছে অমনি অদ্ভুত অদ্ভুত ফিলিং তাকে চুলকিয়ে দিচ্ছে।আর ঘুম ভেংগে যাচ্ছে।তিল শুয়ে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা শুধু মনে হচ্ছে তাকে কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ঘুমের ঘোরে বারবার নড়েচড়ে উঠছে। এপাশওপাশ করেও যখন শান্তি পেলোনা,উঠে বসতেই মনে হলো তার পাশে কেউ বসে আছে। পাশে মুখটা বাকাতেই তিল অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“”লিদ ভাইয়া””
চলবে