#গল্প
#একজন_সঙ্গে_ছিলো
#লেখাঃনিপা
পর্ব-২
রিশিতার বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বাড়ি ফিরে তাহমিদকে দেখেই ওর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।
তাহমিদ রিশিতাকে দেখেই হেসে জিজ্ঞেস করলো, তোমার ওই কাজের মেয়েটা নাকি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে?
-হু।
-আগেই বলেছিলাম যে ওকে এতো মাথায় না তুলতে এখন দেখলে তো!
-মানুষকে অবিশ্বাস করে ঠকার চেয়ে বিশ্বাস করে ঠকা ভালো।
-ছোটলোকগুলো এমনই হয় রিশিতা! ওদের তুমি যতই ভালোবাসো ওরা সেটা বুঝবে -ছোটলোকগুলো এমনই হয় রিশিতা! ওদের তুমি যতই ভালোবাসো ওরা সেটা বুঝবে না।
হাতের ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলে রেখে তাহমিদের সামনে বসে জিজ্ঞেস করলো,
-ছোটলোকদের তুমি কেনো এতো ঘৃনা করো তাহমিদ? আমিও তো ছোট ঘর থেকে এসেছি তবে কি আমার জন্যেও তোমার মনে অনেক ঘৃনা??
তাহমিদের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো, হাসি হাসি ভাব মুখে এনে বলল,
-এসব কি বলছো তুমি? ওই মেয়েটার সাথে তুমি নিজের তুলনা করছো?
রিশিতা আর কথা বাড়ালো না। ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ছেলেটার জন্যে রিশিতার খুব মায়া লাগে, ওর শৈশব যেমন কষ্টে কেটেছে ওর ছেলের শৈশবও তেমন কাটছে। মায়ের অসুস্থতার জন্য প্রায়ই মাকে ছাড়া থাকতে হয় তিন বছরের সাহিলকে। রিশিতা তো চেয়েছিল তাহমিদ আর সাহিলকে নিয়ে একটা সাধারণ জীবন কিন্তু ভাগ্যে লেখা ছিলো অন্যকিছু।
ছেলের কাছ থেকে উঠে ঘরের বাইরে যখনই যাবে তখনই তাহমিদ বলে উঠলো,
-রান্নার ঝামেলা করতে হবে না, আমি আর মা মিলে বিকেলে রান্নাটা করে নিয়েছি।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রিশিতা। রান্নার মতো কঠিন কাজ পৃথিবীতে হয়তো আর নেই! অথচ যুগ যুগ ধরে মহিলারা এই রান্নাঘর সামলে গেছে!
-তুমি আজ কোথায় গিয়েছিলে?
তাহমিদের কথাই ধ্যান ভাঙল রিশিতার।
-ও হ্যাঁ আজ ডঃ কামাল হোসেনের কাছে গিয়েছিলাম।
আতঙ্কিত হয়ে তাহমিদ জিজ্ঞেস করলো, রিশিতা তুমি কি আবার অসুস্থ হয়ে পরেছিলে নাকি? কই আমাকে তো কিছুই জানাওনি!
রিশিতা হেসে বলল, আমার অসুখ তো আজ নতুন নয়, তবুও তুমি কেনো আজও অভ্যস্ত হতে পারছো না তাহমিদ?
তাহমিদ কিছু বলল না। তবে চোখে মুখে সেই আতঙ্কিত ভাব এখনও আছে। তাহমিদ নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-ডঃ কি বলল?
রিশিতা নির্লিপ্তভাবে বলল, বলেছে আমার রোগটা শরীরের নয়, রোগটা মনের।
রিশিতা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাহমিদকে দেখছে। তাহমিদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে এর মধ্যে। রিশিতা মনে মনে বলল, আমি তোমাকে মাঝে মাঝে একদম বুঝতে পারি না তাহমিদ! কেনো এরকম হয়???
৪.
-তাহমিদ আমার কিছু টুকিটাকি জিনিস কেনার দরকার তাই ভাবছি একটু বের হবো। বেশী দূর নয় সামনের মিনা বাজারে যাব।
-আমিও তোমার সাথে যাই। সাহিল কে সামলাতে তোমার কষ্ট হবে।
রিশিতা হেসে বলল, তুমি কিন্তু আমাকে নিয়ে একটু বেশী পজেসিভ।
তাহমিদ হেসে বলল, একমাত্র বউ তুমি আমার, এই টুকু পজেসিভ না হলে কি চলে!
ব্যাংকের কাজ শেষ করে সামনের মিনা বাজারে ঢুকল প্রনব। বাসায় গেস্ট আসবে তাই কিছু মিষ্টি নেয়ার দরকার। সুইটশপে ডুকতে গিয়ে আবারও রিশিতার সাথে দেখা হয়ে গেলো। প্রনবকে দেখেই রিশিতা একরকম চিৎকার করে বলল,
-তুমি আজও আমায় ফলো করছিলে?? তোমাকে না আমি নিষেধ করলাম!
প্রনবের মেজাজ আজ প্রচন্ডরকম খারাপ হলো, তবুও ঠান্ডা গলায় বলল, এটা পাব্লিক প্লেস তোমার বাসার ড্রইং রুম নয়, যে এতো উচু গলায় কথা বলবে! কিছু বলার থাকলে সেটা অন্য কোথাও গিয়ে বলতে পারো।
রিশিতা তাহমিদের কাছে গিয়ে কিছু একটা বলে প্রনবকে সাথে নিয়েই একটা কফিশপে বসলো।
রিশিতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রনব বলল,
-কাল তুমি অনেক কিছু বলেছ, আজ আমাকে বলতে দাও!
রিশিতা কোনো কথা বলল না।
-আচ্ছা রিশিতা তুমি সত্যি করে বলোতো তোমার সমস্যা কোথায়?
-তুমি আবার কেনো আমার কাছে ফিরে এসেছো?
-তোমার কাছে ফিরে এসেছি মানে? কাল তো কাকতালীয় ভাবে তোমার আমার দেখা হয়ে গেলো। অনেকদিন পর পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হলে মানুষ যতটুকু সৌজন্যতা দেখায় আমিও ঠিক সেরকম দেখিয়েছি। কিন্তু তা বলে তুমি পাব্লিক প্লেসে আমার সাথে যা না তাই ব্যবহার করেছো, সেটা কেনো রিশিতা??
রিশিতা কোনো উত্তর দিলো না।
-হ্যাঁ আমি মানছি অনেক বছর আগে আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিলো। সেখানে আমার অনেক ভুল ছিলো এবং সেই ভুলগুলো কে শুধরে আমি আবারও সম্পর্কটাকে বাচাঁতে চেয়েছিলাম কিন্তু,,,,,,, যাই হোক পুরোনো কথা থাক। আমার দোষটা কোথায় বলোতো? আমার বাবা মা তোমাকে মানতে চায় নি কিন্তু আমি তো তোমার পাশে ছিলাম।
-তুমি কেনো দ্বিতীয়বার আমার জীবনে ফিরে এসেছিলে, সেটাই তোমার দোষ!
প্রনব একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার মনে হচ্ছে তুমি মেন্টালি সিক!
রিশিতা চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ আমি পাগল। আর এই পাগল হবার জন্যে দায়ী তুমি, শুধুমাত্র তুমি। কারন তুমি যদি দ্বিতীয়বার ফিরে না আসতে তবে কখনও আমার জীবনটা এরকম হতো না। স্বামী সন্তান নিয়ে একটা সুন্দর জীবন হতো আমার।
অনেকক্ষন ধরে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলেও রিশিতার শেষ কথাগুলো শুনে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না প্রনব
– আমি দ্বিতীয়বার যেমন নিজের ইচ্ছায় এসেছিলাম তেমনি আবার তোমার ইচ্ছায় চলেও গিয়েছিলাম। আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম সম্পর্ক রাখতে আর তুমি কি বলেছিলে! আমার জন্যে তোমার মনে কোনো জায়গা নেই, চোখ বন্ধ করলে তুমি আমাকে দেখতে পাওনা, দেখতে পাও শুভ্রকে। শুভ্র তোমার সবকিছু, ওকে ছাড়া তোমার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারো না তাহলে আজ তোমার পাশে শুভ্র নেই কেনো? শুভ্র তোমার স্বামী না হয়ে, অন্যকেউ কেনো তোমার স্বামী হলো?
রিশিতা কিছু বলতে পারছে না উত্তেজনায় ঠোঁট কাপছে, হাত পা কাপছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অনেক কিছু বলার থাকলেও কোনো কথা গলা দিয়ে বের হচ্ছে না।
রিশিতাকে খেয়াল না করে প্রনব আবারও বলল,
-আসলে তুমি কি জানো? তুমি দুমুখো সাপ, আমার কাছে যখন তুমি ছিলে তখন তুমি বুঝতে পারোনি যে তুমি শুভ্রকে ভালোবাসো। কিন্তু আমাকে যখনই তোমার বিরক্ত লাগতে শুরু করলো তখন তুমি বুঝলে যে তোমার মনে আমার জায়গা নেই, সেখানে আছে শুভ্র! আবার হয়তো শুভ্রর কাছে যাওয়ার পর মনে হয়েছে শুভ্রর জায়গাও নেই তোমার মনে। আসলে তুমি নিজেই জানোনা যে তোমার মনে আসলে কি চলছে। না হলে আমি ভেবেছিলাম এতোদিন পর তোমার সাথে শুভ্রকে দেখবো কিন্তু না সেখানে অন্যকেউ! নিশ্চয়ই শুভ্রর প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল তাই ওকেও আমার মতো ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলে!
প্রনবের কথা শেষ হওয়ার আগে চেয়ার নিয়ে হুরমুড় করে নিচে পরে গেল রিশিতা। জ্ঞান হারানোর আগে মনে মনে বলল, তাহমিদ তুমি কোথায়!!!
হসপিটালে অনেকক্ষন ধরে ছোট্ট সাহিলকে নিয়ে বসে আছে। প্রনব বুঝতেই পারলো না যে কি হচ্ছে। একবার সাহিলের দিকে তাকালো প্রনব, মুখটা দেখতে একদম রিশিতার মতো। সাহিল এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু পর পর মাকে খুজঁছে। ছেলেটার জন্যে খুব মায়া হলো প্রনবের।
সবকিছু সামলে প্রনবের কাছে এসে তাহমিদ বলল,
-আপনাকে অনেক ধন্যবাদ প্রনব। অনেক রাত হয়ে গেছে আপনি ফিরে যান।
প্রনব ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো, আপনার স্ত্রীর কি জ্ঞান ফিরেছে?
-না। জ্ঞান ফিরতে হয়তো দুদিন সময় লাগবে?
প্রনব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে থাকলে তাহমিদ বলল,
-আমার স্ত্রীর খুব খারাপ একটা অসুখ আছে। মাঝে মাঝে দুই তিন দিন অজ্ঞান থাকে আর যখন জ্ঞান ফেরে তখন কয়েকদিন আশেপাশের কোনো কিছু চিনতে পারেনা। এমনকি আমাকে বা আমার ছেলেকেও নয়।