#একজন_সঙ্গে_ছিলো
#লেখাঃনিপা
পর্ব-৭/ শেষ পর্ব
রিশিতা এসির মধ্যে বসে থেকেও সমানে ঘামছে। ফারজানা সেদিকে একবারও খেয়াল না করে খুব মনযোগ দিয়ে কফি বানাচ্ছেন।
রিশিতার সামনে কফি রেখে ফারজানা একদম রিশিতার মুখোমুখি বসেছে।
-ডঃ রিশিতা আমি জানি আপনি আমার কাছ থেকে অনেক কিছু শোনার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। এক এক করে সব বলবো।
প্রথমেই বলি, আপনার সাথে দেখা করার আগে আমি প্রনবের সাথে দেখা করেছি। আপনার স্বামীর কাছে জানতে পারলাম সেদিন প্রনবের সাথে রেস্টুরেন্টে কথা বলার পর আপনি অসুস্থ হয়ে যান। তো সেখান থেকেই আমি প্রনবের সাথে কন্টাক্ট করি।
আপনার বলা প্রনবের অংশটুকু সত্যি, সেটার ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই কারন প্রনব ও আমাকে এই সেইম গল্প বলেছে।
-আমি শুধু শুধু আপনাকে কেনো মিথ্যা কথা বলবো?
-প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যতটুকু বলেছেন তার মধ্যে শুধু অসুস্থতার অংশটুকু মিথ্যে বাকি সব সত্যি!
রিশিতা উত্তেজিত হয়ে বলল, আপনি কেনো বার বার বলছেন যে আমার অসুস্থতা মিথ্যে? আমি কেনো শুধু শুধু অসুস্থতার নাটক করবো?
-আপনি শান্ত হয়ে বসুন আর ব্যাপারটা আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন। আপনি শুধু শুধু নাটক করছেন না, নাটক করার যথেষ্ট কারন আপনার আছে।
প্রথম থেকেই বলি,,,,,,
প্রনব কে দেখে আপনার পছন্দ হয়ে গেল, আপনি প্রনবের প্রেমেও পড়লেন কিন্তু প্রনব আপনাকে তেমন পাত্তা দিলো না, যেটা আপনার ইগোতে লাগল। তারপর থেকে আপনার টার্গেট ছিলো প্রনব ও যেন আপনার প্রেমে পরে কিন্তু প্রনব আপনার প্রেমে পরলো আর সেই সাথে আপনাকে ভালোবাসতেও শুরু করলো। কিন্তু আপনি প্রনব কে ভালোবাসতেন না। হয়তো আপনি তখন ভালোবাসা কি সেটাই বুঝতেন না! যদি বুঝতেন তবে প্রনব যখন বলেছিল, সে তার বন্ধুদের ছাড়তে পারবেনা তখনই বুঝতেন যে এই ছেলেটার মানুষকে ভালোবাসার শক্তি প্রচন্ড।
আপনি চাইলেন প্রনবের সব এটেনশন শুধু আপনি হবেন তাই বিভিন্ন ধরনের মেন্টাল প্রেশার দিতে শুরু করলেন। কিন্তু প্রনব ছিলো তার সিদ্ধান্তে অনড়।
এক্সিডেন্টলি প্রনবের পরিবার আপনার সম্পর্কে জেনে যায় আর তারা আপনাকে বিভিন্নরকম থ্রেট দেয়, তার জন্যেও আপনি প্রনব কে দায়ী করেন। প্রনবের সেখানেও কোনো দোষ ছিলো না, আর ওর ফ্যামিলি যেটা করেছে সেটা অন্য যে কোনো ফ্যামিলিই করতো। এমনকি আপনার ফ্যামিলিও এটাই করতো!
এরপর প্রনব আপনাকে বলল, সে সম্পর্ক রাখতে চায় না কারন তার ফ্যামিলি চায় সে অন্য কাউকে বিয়ে করুক। এই কথাগুলোও সে আপনাকে ভালোবেসে বলেছিল বা বলা যায় আপনার ভালোর জন্যে বলেছিল! আপনি খেয়াল করে দেখুন রিশিতা, প্রনব কি বলেছিল? আমি আর এই সম্পর্ক টা রাখতে চাই না কারন আমার ফ্যামিলি চায় আমি মিমকে বিয়ে করি কারন মিম খুব ভালো স্টুডেন্ট।
ও জানতো যে আপনি আর পরিক্ষা দিচ্ছেন না তাই মিমের কথা বলে পড়াশোনার জন্যে উস্কে দিচ্ছিল আপনাকে। কতোটা ভালোবাসলে মানুষ নিজের কথা না ভেবে তার প্রিয়জনের কথা ভাবতে পারে! ওই সময় কিন্তু প্রনবের মানসিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিলো না তাও ও আপনার পড়াশোনার কথা ভেবে দিনের পর দিন নিজেকে কষ্ট দিয়ে দূরে সরে থেকেছিল।
-বাহ! এতো ভালোবাসা ছিলো যখন তাহলে আমি ফ্যামিলি ছাড়া কিভাবে পড়াশোনা করছিলাম, কিভাবে টাকা পয়সার যোগার হচ্ছিলো, সেই খোঁজ কেনো নেয়নি?
-সেটার কারন প্রনব জানতো না যে আপনার ফুপুও আপনাকে ভুল বুঝেছিলো।
এরপর শুভ্র নিঃস্বার্থভাবে এসে আপনার পাশে দাঁড়ায়। হয়তো প্রথমদিন থেকেই শুভ্র আপনাকে পছন্দ করতো, কারন আপনি বলেছেন ক্লাসে স্যার যখন আপনাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় তখন শুভ্রর চোখে কোনো মুগ্ধতা ছিলো না। হয়তো আগে থেকেই আপনার খোঁজ খবর নিয়েছিল তাই ওই ব্যাপারটা তাকে আর নতুন করে চমকে দেয় নি!
প্রনবের সাথে সম্পর্ক যখন ভেঙে যাওয়ার পথে তখনই শুভ্র আপনার জীবনে আসে। আপনার তখন প্রনবের শূন্য যায়গায় কাউকে বসানোর ছিলো তাই সেই যায়গায় শুভ্র কেও বসালেন। এরপর দেখলেন শুভ্র আপনাকে বিভিন্ন হেল্প করতে লাগল, যেটা আপনাকে খুব মুগ্ধ করলো। আর শুভ্রর কাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া আপনার আর কিছুই করার ছিলো না। তাই ভাবলেন যে আপনি শুভ্রর আত্মীয় স্বজন হীন অন্ধকার জীবনে আলো হয়ে থাকবেন, আর তাছাড়া আপনি বুঝেও গিয়েছিলেন যে শুভ্র আপনাকে পছন্দ করে। আপনি আরও একটা কথা ভেবেছিলেন, শুভ্রর আপন বলতে কেউ নেই আর আপনি যদি শুভ্রর জীবনে প্রবেশ করতে পারেন তবে আপনিই হবেন শুভ্রর জীবনের একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন। এর মধ্যেই আপনার জীবনে আবারও এসে গেলো প্রনব। এবার আপনি ভাবলেন শুভ্র তো আছেই আর এই সুযোগে প্রনবকে একটা শিক্ষা দেয়া যাক।
সমস্যা হলো তখন, যখন শুভ্র প্রনবের কথা জেনে গেলো। আপনি ভয় পেয়ে গেলেন শুভ্রকে হারানোর, তাই প্রনবকে সব বলে দিলেন কিন্তু শুভ্রকে বলার সাহস করতে পারলেন না।
এরপর চারবছর শুভ্র আপনার সাথেই ছিলো কিন্তু আপনি আপনার ভালোবাসার কথা শুভ্রকে বলেন নি কিন্তু আকার ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। আপনার ইগোর কারনেও আপনি কখনও শুভ্রকে ভালোবাসার কথা বলেন নি, আর শুভ্র বলেনি অভিমানের জন্য।
রিশিতা একটা কথাও না বলে চুপচাপ শুনতে লাগল ফারজানার কথা।
শুভ্র যখন কানাডা চলে যাবে বলল তখন আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। হয়তো আপনি শুভ্রর জন্যে কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছিলেন। আপনি শুভ্রকে সব বলে দিলেন, সব শুনে শুভ্র আপনাকে স্বাভাবিকভাবেই ভুল বুঝলো। এরপর আপনি বহু চেষ্টা করলেন শুভ্র কে ফেরানোর কিন্তু শুভ্র ফিরলো না।
শুভ্র চলে যাওয়ার পরও আপনি শুভ্রর প্রতি রাগ পুষে রাখলেন। আপনি একবারও ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন না। সবথেকে বেশী যে ব্যাপার আপনাকে কষ্ট দিয়েছে সেটা হলো শুভ্র অন্য আরেকটি মেয়েকে পছন্দ করে। সেই রাগেও আপনি শুভ্রর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি কিন্তু শুভ্রর এক্টিভিটি ঠিকই দেখতেন। এরপর শুভ্রর এক্টিভিটি দেখতে না পেয়েও আপনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। শুভ্রর তো কোনো বিপদ ও হতে পারতো! কিন্তু আপনার সে ব্যাপারে কোনো হেলদোল ছিলো না।
শুভ্র যখন টাকা না নিয়ে ভালো কাজে খরচ করতে বলল তখন আপনি ওই কাজটা করলেন যেটা শুভ্র আপনার সাথে করেছিল। আপনিও কয়েকজনের ডাক্তারি পড়ার খরচ দিলেন। এই কাজটাও করলেন শুভ্রকে দেখানোর জন্যে কারন শুভ্র শুধু আপনার দুই বছরের পড়ার খরচ দিয়েছিল আর আপনি তার থেকে বেশী দিলেন। এখানেও শুভ্রর সাথে আপনি প্রতিযোগিতা করলেন, শুভ্রর চেয়ে বেশী বেশী করে আপনি শুভ্রকে নিচু দেখাতে চাইলেন।
রিশিতা রেগে বলল, আপনি আপনার মনগড়া গল্প না বলে আমি যা জিজ্ঞেস করেছি সেটা ক্লিয়ার করে বলেন।
-আমি মনগড়া কোনো গল্প বলছিনা সেটা আপনি খুব ভালো করে জানেন রিশিতা!
শুভ্র যাওয়ার পর আপনি নিজেকে ভালোভাবে গুছিয়ে নিলেন কিন্তু আপনি মনে মনে ঠিকই শুভ্রর কাছে ঋনী হয়ে রইলেন তাই আপনি সবাইকে শুভ্রর অবদান সম্পর্কে বললেন কিন্তু শুভ্রর নামটা বললেন না।
বিয়ে করা দরকার তাই আপনি তাহমিদকে বিয়ে করলেন কিন্তু তাহমিদ কে ভালোবাসতে আপনি পারেন নি। পর পর দুইবার সম্পর্কে হেরে গিয়ে পুরুষ মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে গেলো সে কারনেও আপনি তাহমিদকে ভালোবাসতে পারেন নি।
শুভ্রর চিঠি আসার পর আপনি দিশেহারা হয়ে গেলেন। কারন আপনার মনে শুধুমাত্র শুভ্রর জন্যেই দুর্বলতা ছিলো। আপনি মরিয়া হয়ে গেলেন শুভ্রর কাছে যাওয়ার জন্যে। কারন আপনি সত্যিই শুভ্রকে একটা সেকেন্ড চান্স দিতে চাইলেন। তাহমিদকে আপনি বললেন, জানিনা ঠিক কি কারনে তাহমিদ রাজিও হয়ে গেলেন।
এই পর্যন্ত যা বললাম সব কি ঠিক আছে রিশিতা?
-আমি যা জানতে চাচ্ছি তা বার বার কেনো এড়িয়ে যাচ্ছেন?
বলছি সব। এতক্ষন যা বললাম তা তো আপনার জানা, কিন্তু এখন যা বলবো সেকথা গুলো আপনার অজানা!
শুভ্র আপনার জন্যে অপেক্ষা করেছিল। ও চেয়েছিল আপনি ওকে টেক্সট করুন বা ফোন করুন। ও চেয়েছিল যে দূরে গেলে আপনি ওর প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝতে পারবেন। ও ভেবেছিল আপনি হয়তো ওর জন্যে অপেক্ষা করবেন।
শুভ্রর ৩৪ টা ডায়েরি ছাড়াও আরও দুইটা ডায়েরি ছিলো। শুভ্রর সেই বন্ধুর কাছ থেকে জেনেছি। দুটো ডায়েরিতে শুধু আপনার সম্পর্কে সেই প্রথম দিন থেকে কানাডা যাওয়ার দিন পর্যন্ত সবকিছু লেখা ছিলো। আর বাকী ৩৪ টা ডায়েরি তে সব পৃষ্ঠা জুড়ে শুধু একটা শব্দই লেখা ছিলো। ”রিশিতা”
রিশিতা মুখ চেপে নিঃশব্দে কাঁদছে।
প্রনব, তাহমিদ, শুভ্র তিনজনই আপনাকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসতো! কিন্তু আপনি একজনের ভালোবাসাও না বুঝতে পেরেছেন না অনুভব করতে পেরেছেন।
শুভ্রর কথা জানিনা, তবে তাহমিদ আর প্রনবের চোখে আপনার জন্য আমি সত্যিকারের ভালোবাসা দেখেছি।
আপনি যখন প্রনবকে বললেন যে আপনি শুভ্রকে ভালোবাসেন তখন প্রনব কিন্তু কোনো ঝামেলা করেনি কারন ও চেয়েছিল আপনি ভালো থাকুন! আপনার ভালো থাকাটাই ছিলো ওর কাছে বড় ব্যাপার। পুরো চার মাস ও ডিপ্রেশনে ছিলো! কিন্তু কখনও কি আপনার কাছে তার জন্যে অভিযোগ করেছে!?
তাহমিদ ও আপনাকে ভালোবাসে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনি যখন বললেন আপনি ওর সাথে ভালো নেই, অন্য কারো সাথে আপনি ভালো থাকবেন তখন ও একবারের জন্যেও নিজের কথা, বাচ্চার কথা না ভেবে আপনার কথা ভেবেছে।
রিশিতা মানুষ একটু ভালোবাসার জন্যে কতো হাহাকার করে আর আপনি তিনজন মানুষের পিওর ভালোবাসা পেয়েও সেটা বুঝতে পারেন নি!
হয়তো আপনি যে পরিবেশে বড় হয়েছেন সেখানে আপনি মানুষের সাথে মেশেন নি, তাই হয়তো অনেক কিছুই জানেন না! আপনি সব জায়গায় শুধু নিজের জেদ আর অহংকার নিয়ে ছিলেন! একটু যদি ব্রেন থেকে চিন্তা না করে মন থেকে ভাবতেন তবে হয়তো বুঝতে পারতেন!
রিশিতা পাথরের মতো বসে আছে,,,,,,,,,
এবার আসি আপনার অসুস্থতার ব্যাপার নিয়ে,,,,
শুভ্র চলে যাওয়ার পর আপনি প্রনবের উপর প্রচন্ড ক্ষেপে গেলেন। আপনার মনে হলো, প্রনব যদি দ্বিতীয়বার ফিরে না আসতো তাহলে শুভ্র আপনাকে ছেড়ে যেতো না।
ঠিক তেমনই ভেবেছিলেন তাহমিদের ব্যাপারে। তাহমিদ আপনার জীবনে এসেছিলেন সেজন্য আপনি তাহমিদের জীবনে জড়িয়ে যান। তাহমিদ যদি না আসতো, তবে আপনি খুব সহজে শুভ্রর কাছে যেতে পারতেন।
শুভ্র আপনার চিঠির জবাব না পেয়ে আপনার জন্যে দেশে এসে খুব খারাপ ভাবে মারা গেলো এই ব্যাপারটায় আপনি তাহমিদ কে দোষী করলেন।
বাচ্চার ব্যাপার যদি না থাকতো তবে আপনি হয়তো শুভ্রর কাছে চলে যেতে পারতেন। সব কিছু মিলিয়ে তাহমিদের উপর আপনার অনেক রাগ, কিন্তু তাহমিদ ঠান্ডা স্বভাবের তাই আপনি ঠিকঠাক ভাবে রাগ দেখাতে পারতেন না তাই তাহমিদকে কষ্ট দেয়ার অভিনব পন্থা অবলম্বন করলেন।
আপনি যখন অসুস্থ থাকার নাটক করেন তখন তাহমিদ পাগলের মতো হয়ে যায় যেটা দেখে আপনি মজা পান। আর সেই সাথে ছেলেকে কষ্ট দিতেও আপনি আনন্দ পান কারণ ছেলেটা তাহমিদের প্রান।
রিশিতা চোখ তুলে তাকালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, আপনি কিভাবে বুঝলেন আমার অসুখ টা নাটক??
-পুরো গল্পটা বলার সময় আপনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন! অসুস্থতার কথা বলার সময় আপনার চোখ ছিলো দেয়ালের দিকে। আর আপনার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যেও অস্বাভাবিকতা ছিলো, তাই আন্দাজে ঢিল ছুড়ে দিয়েছিলাম।
তারপর আপনার রিএকশন দেখে বাকীটা বুঝেছিলাম। মস্তিষ্কের নিউরনের পরিমান কমে গেলে যে ভুলে যাওয়া রোগটা হয় সেটা সাময়িক ভুলে যাওয়া রোগ, আর তাও হঠাৎ হঠাৎ।
আর একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় ছিলো, আপনার মতে জ্ঞান হারানোর পর আপনি কিছু মনে রাখতে পারেন না অথচ জ্ঞান হারানোর পরের ঘটনাগুলো আপনি খুব সুন্দর করে বর্ননা করলেন।
-আর আমার স্বপ্নের ব্যাপারটা?
-শুভ্রর চিঠি পাওয়ার পর আপনি সবসময় শুভ্রর কথা ভাবতেন। হঠাৎ একদিন স্বপ্নটা দেখে আপনার মনে হলো হাতটা শুভ্রর। শুভ্র তার কাছে আপনাকে ডাকছে।
আর পরের স্বপ্নটার সঠিক বা যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। তবে হতে পারে প্রেগন্যান্সির সময় মেয়েদের নেগেটিভ থিঙ্ককিঙ্ক বেশী থাকে, তাই সচেতন মনে আপনি শুভ্রর ভালো টা ভাবলেও অবচেতন মনে হয়তো খারাপ কিছু ভেবেছিলেন। আর সেটা হয়তো সত্যিই ঘটে গেছে।
রিশিতা চুপ করে আছে,,,,,,
ফারজানা আবারও বলল, রিশিতা আপনার ছেলেটা তো নিস্পাপ, ওর তো কোনো দোষ নেই ওকে কেনো শাস্তি দিচ্ছেন.?
রিশিতা সেকথার জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-ফারদিন কার ছেলে? অনাথ আশ্রম থেকে এনেছিলেন?
-না ফারদিন আমার আপার ছেলে।
-আপনিও তো আপনার স্বামীকে ঠকাচ্ছেন। অন্যের ছেলেকে নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছেন সেটা ঠকানো না? আপনার স্বামী যে ছেলেকে জান দিয়ে ভালোবাসছে সেটা অন্যের ছেলে সেটা আপনি জেনেও তাকে জানাচ্ছেন না এটা কি প্রতারনা নয়?
-একটা মিথ্যের জন্যে যদি কোনো এতিম বাচ্চার ভালো হয় তবে সেটা অন্যায় নয় রিশিতা।
-আমি অন্যায়ের কথা বলছি না! আমি ঠকানোর কথা বলছি।
-হ্যাঁ আমি ঠকাচ্ছি। আমি বলতে পারতাম ওই সন্তান ওর নয়, কিন্তু আমার বলতে ইচ্ছে হয় নি কারন আমিও চাচ্ছিলাম যে ও ঠকুক। নিজের তিন ছেলে মেয়ের থেকে তিনগুন বেশী ভালোবাসে ফারদিন কে। যেদিন জানবে যে ফারদিন ওর ছেলে নয় সেদিন ওর কেমন লাগে সেটা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি।
-তাহলে বুঝলেন তো ঠকতে কেমন লাগে!!!
ফারজানা চুপ করে থাকল।
রিশিতা আবারও বলল, আপনার সব কথাই ঠিক কিন্তু একটা কথা ঠিক নয়! শুভ্রর জন্যে আমার শুধু দুর্বলতা নয় ভালোবাসাও ছিলো, কিন্তু সেটা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি ও মরে যাওয়ার পর।
-প্রনবের একটা মেয়ে আছে, ওর নাম কি জানো? “রিশিতা”
রিশিতা করুন চোখে তাকিয়ে রইলো।
রিশিতা ফারজানার দিকে তাকিয়ে বলল, শুভ্রর বন্ধু হাসান কে কিভাবে পেলেন?
-এখানে আসার তিনমাস আগে থেকেই আমি আপনাকে নিয়ে স্টাডি করেছি।
-বাহ! এটা নিশ্চয়ই তাহমিদের কাজ??
-না। তাহমিদ জানতো না। ডঃ কামাল হোসেনের উদ্যোগে সব কিছু হয়েছে।
-আচ্ছা! আপনার কি আমাকে আর কিছু বলার আছে?
-একটা উপদেশ দিতে চাই শুধু!
-বলে ফেলুন
-মা হওয়া খুব কঠিন কাজ। শুধু জন্ম দিলেই যেমন মা হওয়া যায় না তেমনি জন্ম না দিয়েও অনেকে কিন্তু খুব ভালো মাও হয়। আপনি নিজের সন্তান কে কষ্ট দিয়েন না, তাহলে বড় হয়ে ওর জীবনটাও আপনার মতো হয়ে যেতে পারে। খুব ভালো মা হয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিন, ঠিক যেমনটি দেখিয়েছিলেন মেডিকেল কলেজে টপ হয়ে! খুব বেশী কঠিন হয়তো নয়!
রিশিতা কোনো কথা বলল না।
-জানেন রিশিতা ছোট থেকেই আমার সব ব্যাপারে কৌতুহল ছিলো। আমি দেখতাম আপা একদম মা বাবার মতো, মায়ের যেরকম স্বভাব আপারও সেরকম স্বভাব। আবার বাবার মতো চেহারা, কিন্তু আমার সাথে না চেহারার মিল,আর না আছে কোনো আচরনের মিল। আমার মনে হলো আমি হয়তো আমার বাবা মার মেয়ে না, তাই খুব খেয়াল করে বাবা মার আমার প্রতি আচরণ লক্ষ্য করতে লাগলাম। কিন্তু বাবা মা আপার প্রতিও ঠিক যেমন আচরণ করতো আমার প্রতিও তেমন। তারপর মনে হলো আমি বাবা মার মেয়েই না হলে অন্যের মেয়েকে কেউ নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসবে!
অনেক বছর পর কলেজে পড়ার সময় জানলাম যে আমি আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। অথচ দেখুন আমার বাবা মা কখনও সেটা বুঝতেই দেয় নি।
রিশিতা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যেতেই ফারজানা বলল,
-রিশিতা আপনি তাহমিদ কে এতো ঘৃনা কেনো করেন?
-এই প্রশ্নের উত্তর আপনি নিজেই বের করুন। তবে উত্তর জানার পর আমার সম্পর্কে আপনার অন্য ধারণা হতে পারে!
-আর একটা কথা রিশিতা, শুভ্রর খুব আফসোস ছিলো আপনার ওই একজন সঙ্গে ছিলো বাক্যটি নিয়ে! ও চাইতো আপনি বলেন, প্রিয়জন সঙ্গে ছিলো।
রিশিতা আর এক মুহুর্তও দেরী না করে সেখান থেকে চলে গেলো।
★ ★ ★
সকাল সাড়ে নয়টায় প্রনব আর তাহমিদ দুজনকে একসাথে ডেকেছে ফারজানা।
প্রনব আর তাহমিদ দুজনেই বসে আছে ফারজানার ড্রইং রুমে। দুজনের মধ্যেই চাপা এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজমান। তাহমিদ একটু পর পর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।
-আমি জানি তাহমিদ আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে! কিন্তু আমার যে কিছু করার নেই।
তাহমিদ জোর করে একটু হেসে বলল, না ঠিক আছে। আপনি যা বলার বলুন।
-আজ তো আমি বলবো না, আপনি বলবেন আর আমি শুনবো।
-আমি কি বলবো??
-আপনার কথা বলেন, শুভ্রর কথাও বলতে পারেন!
তাহমিদ শুকনো গলায় বলল, আমি শুভ্রর কথা বলবো কিভাবে? শুভ্রর ব্যাপারে তো আমি কিছু জানিই না।
ফারজানা কঠিন গলায় বলল, একদম মিথ্যে বলবেন না। আপনি ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করতে কানাডা গিয়েছিলেন সে তথ্য আমার কাছে আছে।
প্রনব শুধু দুজনের মুখের অভিব্যক্তি দেখছে।
তাহমিদ সামনে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে তারপর বলল,
-কানাডায় আমি আর শুভ্র পাশাপাশি বিল্ডিং এ থাকতাম। আমিও যেরকম চুপচাপ স্বভাবের ছিলাম শুভ্রকেও সেরকম চুপচাপ মনে হয়েছিল। আমি সবসময় দেখতাম ও বারান্দায় বসে ডায়েরি লিখত, আমি ভেবেছিলাম হয়তো কোনো লেখক হবে হয়তো। একদিন নিজে গিয়ে আলাপ করলাম শুভ্রর সাথে। জানতে পারলাম এমবিএ করে আপাতত কিছু করছে না, বেকার বসে আছে তাই ডায়েরি লিখছে। ও নিজে থেকে কোনো কথা বলতো না, আমি যা জিজ্ঞেস করতাম তার উত্তর দিতো শুধু। দিন দিন ওর ডায়েরির প্রতি আমার আগ্রহ বাড়তে লাগল, তাই একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম কি আছে;।
যতগুলো ডায়েরি দেখিয়েছিল সবগুলো তে শুধু রিশিতার নাম লেখা ছিলো। আমি রিশিতা সম্পর্কে জানতে চাইলাম, শুভ্র খুব আগ্রহ নিয়ে রিশিতার কথা বলতো।
এভাবে কয়েক মাস আমি শুধু রিশিতার কথা শুনেই ওর প্রেমে পড়ে গেলাম। অনেক অনুরোধ করে রিশিতার একটা ছবি শুভ্রর কাছ থেকে দেখলাম! এরপর যেন আমার ঘুম হারাম হয়ে গেলো, আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না বার বার শুধু ছবির মুখটা আমার সামনে ভেসে উঠতো।
আমি দেশে এসে লুকিয়ে একদিন রিশিতাকে দেখলাম। তারপর আমার মধ্যে শয়তান ভর করলো, আমি জানতাম শুভ্র খুব ভালোবাসে রিশিতাকে আর এটাও জানতাম শুভ্র খুব শিগ্রই ফিরে আসবে। তারপরও রিশিতাকে বিয়ে করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠলাম।
রিশিতা যেদিন আমাকে জানালো যে ও আমার সাথে থাকতে চায় না সেদিন আমি খুব ভয় পেলাম।
শুভ্র চলে এলে তো আমি রিশিতার কাছে খারাপ হয়ে যাবো!
-তাই আপনি শুভ্রকে ঠান্ডা মাথায় খুন করলেন??
-হ্যাঁ!!
প্রনব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে।
-আমি জানতাম শুভ্র ফিরলে কিছুতেই রিশিতাকে আটকাতে পারতাম না, তাই শুভ্রর ফেরাটা বন্ধ করে দিয়েছি। আপনার চাইলে পুলিশকে বলে দিতে পারেন!
-পুলিশে দেয়ার হলে রিশিতাই দিতো তাহমিদ!
তাহমিদ চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো, রিশিতা জানে??
-শুভ্রর চিঠি পাওয়ার মাস দুয়েক পর হয়তো আপনার কানাডা থাকার খবর রিশিতা জানতে পারে, দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে বেশী সময় লাগল না। এরপর থেকে ওর মনে ভয় ডুকে যায় যে আপনি শুভ্রর ক্ষতি করতে পারেন, তারমধ্যে ছিলো ওই দুঃস্বপ্নটা! রিশিতা ভেবেই নিয়েছিল যে শুভ্রর ক্ষতি হবে আর সেটা আপনার দ্বারা, কিন্তু ভাবেনি যে মেরে ফেলবেন।
তাহমিদ ফ্লোরে বসে পরে নিজের মাথার চুল ছিড়ছে।
তাহমিদ যাওয়ার পরও প্রনবের বিস্ময় কাটছে না।
ফারজানা বলল, এক একজনের চিন্তাভাবনা যেমন আলাদা তেমনি ভালোবাসাও আলাদা তাই না???!!!!
-রিশিতা কি কখনও সুস্থ হবে?
-এরপর যদি আবার কখনও ভুল করে আপনার রিশিতার সাথে দেখা হয়ে যায় তবে রিশিতা সেদিন দৌড়ে এসে আপনাকে বলবে কি জানেন!!
বলবে, তোমার মতো হিরে চিনতে যদি সেদিন ভুল না করতাম তবে জীবনটা যে অন্যরকম সেটা অনেক আগেই বুঝতাম!!!
প্রনব এক দৃষ্টিতে দেয়ালের পেন্টিং গুলো দেখছে। আর ফারজানা মুগ্ধ হয়ে প্রনবের চোখের জল দেখছে আর মনে মনে বলছে তুমি কতো ভাগ্যবতী রিশিতা! মানুষ একজীবনে একজনের ভালোবাসাই পায় না আর তুমি সেখানে তিনজনের ভালোবাসা পেয়েছো!!!!
,,,,,,,,সমাপ্ত,,,,,,,,,