#এবরশন
পর্ব আট
লিখা —মিনহাজ মাহমুদ
.
রিভাকে অপারেশনের জন্য বাইরে নেওয়া হয়েছে । সেটা অবশ্য রিভার অগোচরেই । তবুও রিভার জানা ।
রিভা বেডে শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছে । বাইরের হসপিটাল গুলো বেশ উন্নত । পুরো রুমে এখন রিভা একা । কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে রিভা দরজার দিকে তাকালো । দরজার দিকে তাকিয়ে অবাকের উচ্চ ধাপে পদার্পণ করলো । মানুষটি তার খুব চেনা । রিভার জীবনে যেন খালি আকস্মিক কিছুই ঘটছে । এটাও যে ঘটবে তা সত্যিই আকস্মিক !
রিভা তাড়াতাড়ি উঠতে নিলেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল ।
ডাক্তার রিভার চোখ দূটো টেনে টেনে দেখছেন । প্রেসার মাপছেন একজন অল্প বয়সী নার্স । রিভা বেডে আধো শোয়া অবস্থায় বসে আছে । ডাক্তার সাহেব কণ্ঠ স্বর উচু করে ইংরেজি তে বললেন
– when , what happened ? that’s reason you senseless ?
রিভা কোনো উত্তর দিল না । একটু পরে বলল
-আমি দরজার সামনে মিনহাজকে দেখেছি । আর তাই দ্রুত নামতে যেয়ে , আর কিছু মনে নেই ।
পাশের এক নার্স বলল
-you are from bangladesh ?
রিভার ভাই বলল
-yes .
ওই নার্সটি হেসে বলল
-আমিও বাঙ্গালী , কিন্তু বাংলাদেশের নয় । আমার বাসা কলকাতা ।
বাইরের দেশে যেয়ে নিজের ভাষার কোনো মানুষ পেলে আসলেই খুব ভালো লাগে ।
ওই নার্সটা আবার বলল
-আমার নাম রিনা । আমি ৮ ঘন্টা আপনাদের সাথে থাকবো । কোনো সমস্যা হলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন । যদি আমি ডিউটি তে নাও থাকি তবুও জানাবেন । যথাযথ চেষ্টা করবো আপনাদের সাহায্য করতে ।
আর পেশেন্টের এমন আজেবাজে কথায় কান দিবেন না । কারণ তিনি প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে আছেন । তিনি যেটা ভাবেন কিছুক্ষণ পর সেটার অস্তিত্ব অনুভব করেন । কিন্তু আদৌও সেটার যথাযথ অস্তিত্ব থাকে না । আর ওনার এই সমস্যার কারণে একটু এমন হতে পারে । আপনারা যথা সম্ভব পেশেন্টের পাশে থাকতে চেষ্টা করবেন ।
তাহা স্টেশনে বসে আছে । একটু পরেই ট্রেন আসবে । হুইছেল দিতে দিতে একটা ট্রেন এসে স্টেশনে থামলো । এটাই তাহার গন্তব্যে যাওয়ার আগন্তুক । তাহা উঠে দাড়িয়ে লাগেজটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতেই একজন পরিচিত মানুষকে দেখে অবাক হলো । তাহা কোনোভাবেই এটা আশা করেনি । কয়েকবার চোখ ডলেও একই দৃশ্য পরিলক্ষিত হলো তাহার কাছে ।
সামনে আয়ান দাড়িয়ে আছে । আয়ানের চেহারায় দুশ্চিন্তা আর অপরাধ বোধের ছাপ । তাহা আয়ানকে পাশ কাটিয়ে ট্রেনের উদ্দেশ্যে যেতে নিলেই আয়ান তাহার হাত ধরলো । তাহাও কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চিতরূপে দাঁড়িয়ে রইলো । মাথায় শুধু চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে । আয়ান তাহার সামনে যেয়ে দাড়ালো । তবুও এখনও কোনো টুঁ শব্দের ধারে কাছে যায়নি ।
আশেপাশের লোকজন অবাক চোখে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে । তাকিয়ে থাকায় স্বাভাবিক ।
আয়ান তাহার হাত দুটি ধরে বলল
-আমাকে ক্ষমা করো । আর আমার সাথে এখন আবার বাসায় চলো । তোমার সাথে অন্যায় করতে পারি না । যা হয়েছে তার জন্য লজ্জিত ।
তাহা আয়ানের কাছ থেকে হাত দুটি ছাড়িয়ে বলল
-কোথায় ফিরে যেতে বলছেন ? যেখান থেকে আমাকে বের করে দিতে পারলে খুশি হয় সেখানে ? নাহ , সেটা আর সম্ভব নয় । আর আমি তো আপনাদের বাড়ির কলঙ্ক । আমি আপনাদের বাসায় থাকলে আপনাদের মানসম্মান নষ্ট হয়ে যাবে । আপনারা সমাজের লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না । তার চেয়ে ভালো হয় আপনি আপনার পরিবারের মতে আর একটি বিয়ে করে নিলে । না না ! ভয় পাবেন না । আমি কোনো বাধা দিতে আসবো না । পুলিশের কাছেও যাবো না । একদম নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন ।
তাহার চোখের কোণা বেঁয়ে সারি বেধে জল নামছে । চোখের কাজল লেপ্টে যাচ্ছে । আয়ান তাহার দিকে তাকালো । ওর কি বলা উচিৎ বুঝতে পারছে না । তাহার চোখের জল মুছে দিল আয়ান । আয়ানের হাতে তাহার চোখের জলের সাথে কাজলের কিছু কণার মিশ্রণের অস্তিত্ব বিদ্যমান ।
আয়ান হুট করে তাহাকে জড়িয়ে ধরলো । কোনো কথা বলা ছাড়াই । চারিপাশের মানুষ যেন ফ্রি তে সিনেমা দেখার ন্যায় তাকিয়ে আছে । ঘটনার আকস্মিকে তাহাও অবাক । সময়টা যেন থমকে গেছে ওদের দুজনের কাছে । আর চারিপাশের মানুষের যেন কোনো ব্যস্ততার প্রকট নেই । তারাও হয়তো জিরিয়ে নিচ্ছে । চারিপাশে লোকের অগনিত চাহনির অস্তিত্ব বুঝতে পেরে আয়ান তাহাকে ছেড়ে দিল ।
কিছুক্ষণ আগে দুজনেই পৃথিবীর বাইরের গ্ৰহে ছিল । এমনটাই তাদের মনে হচ্ছে ।
আয়ান তাহার হাত ধরে টেনে নিতে চাইলো । কিন্তু তাহা খুব সাবধানে আয়ানের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল । আর কোনো সুখ চাই না তাহা । জীবন নামক জিনিস টা তাকে অনেক কিছু দিয়েছে শিখিয়েছে । আর নতুন করে কিছু জানার আগ্ৰহ নেই । আয়ানের হাত থেকে তাহা লাগেজটা নিয় বলল
-যা বলেছেন এতেই আমি তৃপ্ত । আমি চাই না আমার জন্য আপনি আপনার পরিবারের কাছে ছোট হয়ে থাকেন । বুঝলেন , মায়া বড্ড খারাপ জিনিস । যা সহজে কাটিয়ে ওঠা যাই না ।
আর শেষ কথা , ভালোবাসা শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলে ।
আয়ান তাহার হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল । বলল
-তাহা , তুমি প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না । আমি খুব একা হয়ে যাবো । আমি নষ্ট হয়ে যাবো তোমার মায়ায় । তুমি যেও না তাহা ।
-না আয়ান সাহেব তা হয় না । নিয়তি কাউকে ছাড় দেয় না ।
-এমন বলো না তাহা । আমি তোমার সব কিছু মেনে নেব । প্রয়োজনে আলাদা বাসা নিয়ে আমরা নতুন করে সব কিছু শুরু করবো ।
আয়ান পাগলের ন্যায় বলেই যাচ্ছে । অশ্রু শিক্ত নয়ন দুজনেরই ।
তাহা বলল
-আমার জন্য আপনি আপনার মা বাবার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করবেন এটা তো আমি হতে দিতে পারি না । সেই ছোট্ট থেকে আপনাকে কত আদর যত্ন করে এত বড় করেছে । নিশ্চয় আপনার মুখ থেকে এই কথা শুনার জন্য নয় । আর আজ যদি আমার জন্য আপনি আপনার মা বাবার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেন । তাহলে আগামীকাল যে আমার ভাইও আমার মা বাবার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করবে না তার কি গ্যারেন্টি আছে । আয়ান সাহেব আপনি ফিরে যান । আর ভালো থাকুন পরিবারের সাথে ।
তাহা চোখ মুছতে মুছতে ট্রেনের বগিতে উঠলো । আয়ান অবাক চোখে তাহার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে । তাহা ট্রেনের বগিতে উঠে একবার পিছু ফিরে আয়ানের দিকে তাকালো । ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে । ট্রেনের হুইছেল জানান দিচ্ছে যে কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এই স্টীশন অতিক্রম করবে । আয়ানের চোখে বিস্ময় আর হাতাশা । সাথে কিছুটা না পাওয়ার বেদনা । চোখের কোণে জল চিকচিক করছে । ট্রেন তার গন্তব্য অনুসরণ করে চলেছে । সাথে তাহাকেও নিয়েছে আয়ানের থেকে অনেক দূরে ।
আয়ান পাশের বেঞ্চে মাথা ধরে বসে পড়লো ।
আশেপাশের লোকজনের আমেজ একদম বিরক্ত লাগছে আয়ানের । কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে । তবুও নিশ্চুপ চাহনি ছাড়া কিছুই করতে পারছে না ।
একদিনে মানুষ কতটা আপন হতে পারে তা আয়ান হারে হারে টেঁর পাচ্ছে ।
তাহা কেন বুঝলো না আযানের কষ্ট । এখানেই সব চেয়ে বেশি কষ্ট লাগছে আয়ানের ।
আয়ানের চোখ দিয়ে অনবরত জল বের হয়েই যাচ্ছে । কষ্টটাও ক্রমেই বাড়ছে । কিছুক্ষণ পর আয়ান অনুভব করলো তার কাধে কেউ হাত রেখেছে । আয়ান তাহা ভেবে খুশিতে পিছু ফিরেই অবাক হয়ে গেল ! আয়ানের মনে হচ্ছে সব ঠিকঠাক থাকলেও কি যেন ঠিক নেই ।
জানালার গ্ৰিল ধরে দাড়িয়ে আছে রিভা । বাইরের থেকে আসা হালকা বাতাসে রিভার চুল গুলো উড়ছে । সময়টা বিকেলের কাছাকাছি । রিভা অনুভব করলো কেউ তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে । রিভা মূহুর্তেই পিছু ফিরে অবাক হলো । অবাকের পরিমাণ অনেকখানি । একটু না ! খুব কান্না পাচ্ছে রিভার ! তবুও নিশ্চুপ ।
চলবে…
(বিতর্কিত মন্তব্য থেকে বিরত থাকুন । )
.
.
.