ভাইবা
.
.
— “কোন খুশিতে যে ফ্রিল্যান্সিং শিখতে গেছিলাম! জীবনটা ত্যানাত্যানা হয়ে যাচ্ছে একদম।”
মনের মধ্যে নিজেকে নিজেই ধুয়ে ফেলছে বর্ষা।
— “কী ভাবছো?যাও ম্যানেজারের কাছে।সিগনেচার টা করিয়ে নিয়ে এসো।”
সহকারী কর্মীর কর্কশ স্বরে তার দিকে লক্ষ্য করে বর্ষা।একটা কাগজ সই করিয়ে আনার মত সাহস নাকি এই ব্যাটার নেই। বর্ষা আমতা আমতা সুরে বলল,
— “বলছিলাম যে আমাকেই যেতে হবে?”
— “তাছাড়া কী?ম্যানেজার যা খিটখিটে।তারউপর একটু পর লাঞ্চ ব্রেক।এখন তুমি আসছো একাউন্ট খুলতে।শুধু তোমার চাচার জন্য খুলে দিচ্ছি।না হলে এমন টাইমে তো…!”
— “ঠিক আছে যাচ্ছি।”
বিরক্তির সুরে বলে চলে এলো বর্ষা।আই.সি.টি প্রজেক্ট থেকে বর্ষা ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ শিখছে। সেখান থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ এমাউন্ট ভাতা হিসেবে সরকার প্রদান করবে সকলের।আর তার জন্য প্রত্যেক ফ্রিল্যান্সারকে সোনালী ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে হবে।সেই কাজেই বর্ষা তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল এক্সামের মাঝে সেই ফরিদপুর থেকে নিজস্ব থানা তে ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে চলে এসেছে।আসার পর থেকে কী যে নাজেহাল হতে হচ্ছে। ভোটার আইডি কই, নাগরিকের সনদপত্র নেই কেনো?কী দিয়ে একাউন্ট খুলতে এসেছো কতরকম যে হাবিজাবি প্যারা! সরকারী বা আইনী ক্ষমতা হাতে থাকলে বর্ষা সবকয়টা কে বুঝিয়ে দিতো এত প্যারা দেওয়ার ঝাল।যখনই কোনো সমস্যাতে পড়ে বর্ষা তখনই তার এই কথাটাই শুধু মনে আসে। কেনো যে তার বাপ প্রভাবশালী হলো না?যাকগে এত ভেবে লাভ নাই। ম্যানেজারের রুমে ঢুকতে ঢুকতে সহকারী কর্মীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতে দিতে আসলো বর্ষা।এখন এই বুড়ো টাকলা ম্যানেজার যে কী যাত্রা দেখাবে কে জানে। ভেতরে প্রবেশের জন্য নক করে অনুমতি চাইল বর্ষা।
— “আসব স্যার?”
— “আসুন।”
কিছু সময়ের জন্য বর্ষা থম মেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো।সে মনে মনে ম্যানেজারের চেহারার যা কল্পনা করেছিল তেমন তো নয়।ইয়া মাবূদ! কী শ্রী ম্যানেজারের! এটা কী আদৌ ম্যানেজার?একে তো বড়লোক বাপের হারামী পোলা বলা চলে।আর যাই হোক ম্যানেজারের কাতারে পড়ে না সে।ব্লেজার টা সে চেয়ারের গায়ে পরিয়ে রেখেছে।ব্ল্যাক শার্টের দু তিনটা বোতাম খোলা।নিচে সে রূপা ব্র্যান্ডের সাদা গেঞ্জি পরেছে সেটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।আর হাতে ওটা কী?ছোটখাটো একটা দুই পাখার ফ্যান ই বলা চলে ওটাকে।হাতে ধরে মুখের কাছে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাতাস খাচ্ছে।বিদ্যুৎ নেই নাকি ফ্যান-এসি নেই? কই সবই তো আছে।তাহলে ব্যাটারির ফ্যানের বাতাস খাচ্ছে কেনো?টেবিলের উপর কফির মগে লম্বা নল ঢুকিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে সে কফি খাচ্ছে আরামে।এটাকে কোন কায়দার কফি খাওয়া বলে?
— “আপনি কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?”
— “জি না।বসতে পারি? সজাগ হওয়ার মতো করে চমকে উঠে বললো।
— “হুম বসুন।কী প্রয়োজন?”
— “এই কাগজটাতে একটা সিগনেচারের প্রয়োজন ছিল।”
— “কেন প্রয়োজন ছিল?”
— “সেটা তো কাগজ দেখলেই বুঝতে পারবি হারামজাদা আলবলদ।” কথাটা কেবল মনে মনেই উচ্চারণ করল বর্ষা।মুখে বললো,
— “আমি একটা একাউন্ট খুলতে চাইছি।তার জন্য এই কাগজটাতে আপনার সিগনেচার লাগবে।”
চেয়ারের সঙ্গে হেলান দিয়ে আধখোলা চোখে তাকিয়ে আছে ম্যানেজার কাগজটার দিকে।পাঁচমিনিট হয়ে গেছে ম্যানেজার আগের মতোই তাকিয়ে দেখছে কাগজটা।মাথায় ছিট আছে নাকি সেটাই ভাবছে বর্ষা।ধুম করেই সোজা হয়ে বসে কাগজটা এমন গতিতে হাতে তুলে নিলো ম্যানেজার, দেখে মনে হলো পূর্বের হারানো কোনো জিনিস ফিরে পেলো সে।ম্যানেজারের এমন রিয়্যাকশন ব্যাপারটা বর্ষার পুরো মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো।কাগজটা হাতে নিয়ে দশ সেকেন্ডের মতো বর্ষার দিকে সে চেয়ে আছে।আন্দাজ করার চেষ্টা করছে যে বর্ষার বয়সের লেভেল টা ঠিক কতো? ম্যানেজারের ভাব দেখে চোখের পলক ফেলার কথা একদমই ভুলে গেছে বর্ষা।
— “মেয়ে তুমি ওইভাবে তাকিয়ে কী দেখছো?”
— “কিছুনা স্যার। ভড়কে গিয়ে বললো।”
— “এইটুকুনি মেয়ে এখন একাউন্ট খুলে কী করবে শুনি?”
বলে রাখা ভালো বর্ষার হাইট সর্বোচ্চ পাঁচ ফিট এক হবে। আর তার উপর সে আজ লাল রঙের ফ্লোর টাচ গোল জামা পরে এসেছে।সোনালী রঙের ওড়নাটা কাঁধের একপাশ দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া,চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে একটু খোপা করার স্টাইলে বাঁধা।আর দু পাশের কলি থেকে লম্বা কোকড়ানো অল্প কিছু চুল কাঁধ পর্যন্ত ঝুলে আছে।ঠোঁটে তার গাড়ো লাল লিপস্টিক, বড় বড় দুটো চোখ, হালকা আইলাইনারের টান পড়েছে সেই চোখে আর গায়ের রংটা তার লালচে ফর্সা।দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও ছেলেদের চোখে লাগার মতো সৌন্দর্য তার।তাকে এই বেশে দেখলে নির্ঘাত মনে হবে ক্লাস নাইন টেনের স্টুডেন্ট সে।
— “টাকা আসবে স্যার।”
— “সে তো আমিও জানি টাকা আসবে, টাকা যাবে, টাকা থাকবে।তো এত অল্প বয়সে দরকার পড়ল কেনো?”
— “আই.সি.টি প্রজেক্ট থেকে একাউন্ট খুলতে বলেছে।”
— “আই.সি.টি প্রজেক্ট থেকে? ফ্রিল্যান্সিং, কল সেন্টার, আউটসোর্সিং এর কাজ শিখছো?”
— “জি স্যার।”
— “তা পড়ো কীসে?”
— “বিবিএ থার্ড ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম চলছে।”
অবাক হয়ে অজান্তেই ম্যানেজারের ভ্রু জোড়া উঁচু হয়ে গেল।বলল,
— “ওহ্। তো কী সাবজেক্ট নিয়ে পড়ছো?”
— “ফাইন্যান্স।”
— “বাহ্ দারুণ বিষয়!সাবজেক্ট ফাইন্যান্স, কাজ শিখছো কম্পিউটারের।তোমার তো ফিউচার ব্রাইট।এস.এস.সি. এইচ.এস.সি.’র রেজাল্ট কী?”
— “4.81 আর 4.75।”
— “ভালোই।তবে জিপিএ ফাইভ নেই।ওটা ব্যাপার না।মনে তো হচ্ছে স্টুডেন্ট ভালো।অনার্সের রেজাল্ট কেমন?”
— “ফার্স্ট ক্লাস।”
— “গুড।ব্যাংকের জব করার ইচ্ছা আছে?”
— “জি।”
মুখ গোমড়া করে উত্তর দিচ্ছে বর্ষা।বিরক্তিতে গা জ্বলে যাচ্ছে ওর।
— “তাহলে একজন ফিউচার ব্যাংকারের ভাইবা নেওয়ায় যায়? কী বলো?”
— “জি।”
— “ভয় পাচ্ছো নাকি?”
— “না না ভয় কিসের?আপনি যা শোনার শুনতে পারেন স্যার?”
মনে আত্মবিশ্বাস এনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে বর্ষা।বুঝতে দেওয়া যাবেনা সে রীতিমত ভয়ে কাঁপাকাঁপি শুরু করেছে।মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো সে।ম্যানেজার তাকে প্রথমে নিজের নাম, বাপের নাম, জেলার নাম,গ্রামের নাম যতরকম নামের প্রজাতি আছে সব নাম জানতে চাইলো।।এরপরের প্রশ্ন,
— “চাকরির ক্ষেত্রে সব থেকে বড় যোগ্যতা কী বলো তো?”
বোবা বনে অসহায় মুখ করে বসে আছে বর্ষা।যদি এই প্রশ্নটা পাত্রপক্ষ এসে করতো সংসার সামলাতে কী যোগ্যতা প্রয়োজন বা যদি কোনো প্রেমীক শুনতো প্রেম করার জন্য কী যোগ্যতা প্রয়োজন? তাহলে সে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে যোগ্যতার চ্যাপ্টার মুখস্ত করিয়ে দিতো তাদের।
— “পারবেনা তাইতো? আচ্ছা ই আই আর এর সূত্রটা বলো তো?”
— “কীসের সূত্র?”
— “ই আই আর।”
— “মনে নেই স্যার।এটা কোন ক্লাসের সূত্র?”
— “তুমি সত্যিই বিবিএ পড়ছো তো? এটা তোমাদের বিবিএ ফাইন্যান্স এরই সূত্র।আচ্ছা যাই হোক, নেক্সট প্রশ্ন করি।উপরি ব্যায় প্রত্যক্ষ খরচ না পরোক্ষ খরচ বলো?”
— “ভুলে গেছি।”
— “এটাও পারোনা? আচ্ছা বলো খতিয়ানের প্রয়োজন কেনো?”
এই তরফা ওই তরফা কোনো তরফারই উত্তর দিতে পারেনা বর্ষা।তাকে লুকা প্যাসিওলির লিখা গ্রন্থের নাম জিজ্ঞেস থেকে শুরু করে একাউন্টিং আর ফাইন্যান্স সম্পর্কিত ত্রিশটা প্রশ্ন করে সাড়ল ম্যানেজার।যার কোনো কিছুর উত্তরই বর্ষা সঠিকভাবে দিতে পারে নি।তবে প্রতিটা প্রশ্নের বিনিময়ে সে তার প্রাণখোলা হাসিটা প্রদান করেছে।
— “কিছুই তো পারোনা।পারো শুধু ছ্যাঁবলা মার্কা হাসি দিতে।”
রাগে গমগম করে উঠল বর্ষা।কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো সে।
— “ভালো করে পড়াশোনা করো।আর যেটা শিখছো সেটা ঠিকঠাক শিখতে পারলে তোমার ফিউচারে পজিশন হবে ফাটাফাটি।”
এর মধ্যে সহকারী কর্মী এসে দরজায় নক করলো।কারণ বর্ষা এসেছে পাক্কা চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে।এখনো সে কাগজ নিয়ে বের হয়নি।
— “হ্যাঁ আসেন।”
– “স্যার উনি একটা কাগজে সই করাতে আসছে।সই কি হয়ে গেছে?”
— “ওহ্, সই তাইনা?মেয়েটার ছোটখাটো একটা ভাইবা এক্সাম নিলাম বুঝলেন? কিন্তু ঘটে তো তার কিছু নেই।মেয়ের যা সাবজেক্ট আর যদি কম্পিউটারে যা শিখছে তা ধরে রাখতে পারে তাহলে তো ব্যাংকে ভালো একটা জব হয়ে যাবে।”
কাগজে সই করতে করতে কথাগুলো বললো ম্যানেজার।
– “জ্বি স্যার তা তো হবেই।তা তুমি কিছুই পারোনি কেন? ঠিকমত পড়ালেখা কইরো ঠিক আছে?”
বর্ষা শুধু ঘাড়টা নাড়াল।আজকের ভাইবা নামক প্যারা সে জীবনে ভুলবেনা।সে ভাবছে এটা যদি ছোটখাটো ভাইবা হয় তাহলে বড়সড় ভাইবা কীরকম?
রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ম্যানেজার বললেন,
— “যাওয়ার কালে যে সালাম দিয়ে যেতে হয় সেটাও জানোনা দেখছি।”
থেমে গিয়ে মুখে সেই পূর্বের হাসি বজায় রেখে বর্ষা বলল,
— “ভুলে গেছিলাম স্যার।স্যরি।”
— “হুম।”
— “আসসালামু আলাইকুম।”
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
— “আসছি স্যার?”
— “না।”
থমকে গেল সে।
— “কেন?”
— “না ঠিক আছে যাও।আর যাওয়ার আগে জামার পেছনের চেইন আর বেল্টটা ভালো করে আটকে যাও।”
হাতে কাগজ নিয়ে কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে স্বাভাবিক ভঙ্গীতে বলছে ম্যানেজার।বলার ভাবটা এমন যেনো এটা সে বর্ষাকে বলতেই পারে।অস্বাভাবিক কোনো বিষয় না। পিঠে হাত দিয়ে দ্রুত চেইনটা টেনে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলো রুম থেকে বর্ষা।ছিঃ এই ছেলেকে কোন আহাম্মক ম্যানেজার বানিয়েছে?এর থেকে রাস্তার রোডসাইড মজনু গুলোও ভদ্র। পুরো অসভ্য অভদ্র ম্যানেজার ব্যাটা।আরো কয়েকরকম গালাগালি দিয়ে কাজ শেষ করে ব্যাংক থেকে চলে আসে বর্ষা।
যেতে পথে চাচা জিজ্ঞেস করে,
– “ম্যানেজার তোকে কী জিজ্ঞেস করছিলো?দেখলাম তুই শুধু হাসছিলি।”
বর্ষার উত্তরটা এমন ছিল,
— “উনি যে কতোবড় কৌতুককারী সেটাই আমাকে বলছিলো আর আমি খিলখিল করে হাসছিলাম।”
.
.
– “নিশ্চয়ই কোনো বন্ধুকে বউ সাথে নিয়ে ঘুরতে দেখেছিস। আর তাই এখন তোর ও বউ আনার খিজি উঠেছে।”
— “কীসের খিজি? কোনো খিজি না।বউ লাগবে বউ।আর একদম ছোটখাটো বউ লাগবে।তোমার মতো কোনো সুপাড়ি গাছ চাই না।”
– “আমি সুপাড়ি গাছ?”
— “লম্……বা।”
শব্দটা টেনে বললো অভি।
– “আহাম্মক ছেলে একটা! মানুষ লম্বা মেয়ে খোঁজে আর তুই….?”
— “আমি কুটিকাটি বউ খুঁজি।”
খেতে বসে আমেনা বেগম বিরক্তির সাথে ছেলের কথাগুলো খাবারের সাথে গিলছে।তার কাছে এই কথাগুলো কেবল আজগুবি কথার মতোই লাগছে।কারণ বছর দেড় আগে এই ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ে দেখতে একটা রেস্টুরেন্ট গিয়েছিল সে।আধ ঘন্টার মধ্যে অভি আসে মায়ের দেখা পাত্রীকে দেখতে।পঁচিশ মিনিট সে কেবল স্ট্যাচু হয়ে মেয়ের সামনে বসেছিল।পঁচিশ মিনিটে এক সেকেন্ডের জন্যও সে মেয়ের দিক থেকে চোখ নামায়নি।ছেলের এমন কান্ডে আমেনা বেগম খুব লজ্জাবোধ করলেও সে বিষয়টাকে সামলে নিয়ে মেয়ে পক্ষকে বলেছিল ছেলে তাদের মেয়েকে খুব বেশি পছন্দ করেছে তাই ওভাবে দেখছে।আধা ঘন্টা পার হতেই অভি সেদিন মেয়েকে বলেছিল,
— “নাউ টাইম আপ।আমার হাতে আধা ঘন্টা সময় ছিল আপনাকে দেখার জন্য।আমি দেখে নিয়েছি।আপনার কী দেখা হয়েছে?না হলেও করার কিছু নেই। আমাকে উঠতে হবে,আসছি।”
সেইদিনের পর থেকে আমেনা বেগম পণ করে নিয়েছে যে এই ছেলে যেদিন নিজে মুখে বলবে বিয়ে করবে ঠিক সেদিনই ওর বিয়ে হবে।তাতে অভি বুড়ো হয়ে যাক, ডোন্ট কেয়ার।
.
— “আম্মা আসব?”
– “আয়।”
অভি মায়ের ঘরে ঢুকে।বাবা-মা তখনই বিছানা গুছিয়ে শুতে যাচ্ছিল।
– “এত রাতে কী দরকার পড়ল?”
— “তুমি তখন আমার কথার কোনো উত্তর দাওনি কেন?”
– “কোন কথার?”
— “তোমাকে বলে আর লাভ নেই।আব্বা আপনি আছেন আপনাকেই বলি।এখানে আমার বউয়ের স্যরি মেয়ের ডিটেইল আছে।কালকের মধ্যে মেয়ের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যাবেন।”
– “কীসের প্রস্তাব?”
বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করে আব্বা।
— “বিয়ের প্রস্তাব।”
কাগজটা বাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অভি হেলে দুলে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।বাবা-মা রীতিমত হতবাক ছেলের এহেন কর্মে।এমন অদ্ভুত চরিত্রের ছেলেকে নিয়ে তারা প্রায়ই সমালোচনা করে।নিজের বিয়ের কথা কেউ যে এভাবে বাবা-মা কে বলতে পারে তা আমেনা বেগম এবং তার স্বামী ফরিদ সাহেব উভয়েরই কল্পনার বাইরে ছিল। প্রস্তাবটি মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার সাথে সাথেই মেয়ে বাড়ির লোক প্রস্তাবটি লুফে নেয়।তাদের কথা ছেলে সরকারী ব্যাংকের ম্যানেজার।আর কী চায়? অভির বাবা-মা একটু মন বিষণ্ন করে ছিল প্রথমে। তাদের ছেলে কেমন মেয়ে পছন্দ করেছে তা ভেবে।কিন্তু মেয়েকে দেখে তাদের সবারই খুব পছন্দ হয়েছে।কিন্তু সমস্যা এক জায়গায়, মেয়ে যে ছেলের তুলনায় খুবই শর্ট।
.
.
— “তাই!”
– “আরে হ্যাঁ।তুই মেয়ে পছন্দ করেছিস আর তুই দেখিসনি মেয়ে কতো শর্ট হবে তোর থেকে?”
— “ভালো করে দেখিনি তাহলে, আবার দেখতে হবে।এখন এটা বলো তো এ বাদে আর কী সমস্যা মেয়ের?”
– “আর কোনো সমস্যা নেই।সবই ঠিক আছে।”
— “তাহলে আমি তাকে সামনাসামনি আর একবার দেখি, কী বলো?মেয়ের বাড়িতে জানিয়ে দাও আগামীকাল বিকাল পাঁচটায় আমি তার সাথে দেখা করবো।”
বর্ষা এসেছে ছেলের দেওয়া ঠিকানায় ছেলের সাথে দেখা করতে।কথা হচ্ছে ছেলে কী বায়পাসে দাঁড়িয়ে দেখা করবে? কোনো রেস্টুরেন্টে না এসে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে কেনো বললো সেটাই দাঁড়িয়ে ভাবছে বর্ষা।ভাবনার শেষ নেই।বর্ষার ধারণা ছেলের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, মাথা নিশ্চই ন্যাড়া হবে আর ন্যাড়া না হলেও ছাদ অর্ধেক ফাঁকা থাকবে।ব্যাংকের ম্যানজার, বিসিএস ক্যাডার এদের সম্পর্কে বর্ষার ধারণাগুলো এমনই। হঠাৎ একটা কালো গাড়ি এসে বর্ষার সামনে থামল।এবং তাকে জানালো অভি তাকে গাড়িতে উঠে আসতে বলেছে।গাড়ির ড্রাইভার তাকে মূল ঠিকানায় পৌঁছে দিবে।শুরুতে একটু ভয় আর সন্দেহ হচ্ছিল গাড়ির ড্রাইভারকে। কিন্তু ড্রাইভারের ইনোসেন্ট ফেস দেখে আর একটু বাদেই অভির ফোন পেয়ে বাজে ভাবনা গুলো উড়ে গেছে।ড্রাইভার একটা নামীদামী রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালো।অভি ফোন করে বলে দিলো রেস্টুরেন্টের মাঝে কোনদিকে আছে সে। অভির ডিরেকশন মোতাবেক মূল গন্তব্যে এসে পৌঁছালো বর্ষা। কিন্তু কই? ছেলে কেনো ছেলের চুলও নেই সেখানে।ভাবল হয়তো খাবার অর্ডার করতে গেছে।চুপচাপ জায়গায় এসে বসলো বর্ষা।
— “কী ব্যাপার মেয়ে? তুমি এখনো কিছু অর্ডার করোনি কেনো? নাকি এটাও জানোনা?”
কন্ঠস্বর শুনে বর্ষা চমকে পিছে তাকায়।এই ম্যানেজারই যে তার কপালে জুটবে জানলে সে কোনোদিনও এখানে ছুটে আসতো না তার সাথে দেখা করতে।টিসুতে হাত মুছতে মুছতে অভি বর্ষার সামনে এসে বসলো।
— “কোথাও কি লেখা আছে অর্ডার শুধু ছেলেদেরই করতে হবে?”
নির্বোধ বালিকার মত মাথা এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে না জানায় বর্ষা।
— “তাহলে অর্ডার করোনি কেন?”
— “আপনার অপেক্ষাতে ছিলাম।”
— “আমি না আসলে যদি বিল তোমাকে গুণতে হয় তাই অর্ডারটা দাওনি, রাইট?ভালো বুদ্ধি।”
হাতের ছোট পার্সটা অভির মুখে ছুড়ে মাড়তে ইচ্ছে করছে বর্ষার।এতবড় অসভ্য আর অভদ্র ছেলে বর্ষা জীবনে দেখেনি। চোখ মুখ গম্ভীর করে তাকিয়ে আছে অভির দিকে।অভি বেশ বুঝতে পারছে বর্ষার রাগের লেভেলটা।অভি দুটো কফি অর্ডার করলো।
— “আমাকে কেমন লেগেছে তোমার?”
— “এটা কি সরাসরি বলা যায়?”
— “তাহলে কী টেক্সট করে বলবে?”
— “কী?”
— “সরাসরি প্রশ্ন করেছি যেহেতু তো সরাসরিই বলবে, নাকি?”
কী বলবে সেটাই ভাবছে বর্ষা।এমনিতে অভি অপছন্দ হওয়ার মতো ছেলে নয়।লম্বা পাঁচ ফিট দশ, গায়ের রং টকটকে ফর্সা আর মাথা ভর্তি সিল্কি চুল।স্বাস্থ্য মিডিয়াম যে কোনো মেয়ের পছন্দসই ফিটনেস বডি অভির।কিন্তু এই ছেলের কথাবার্তা খুবই কাটাকাটা আর ভদ্র ব্যবহার তো একদমই জানা নেই মনে হয়। একটু নির্লজ্জ ভাব ও আছে ভেতরে।কী রকম করে যেনো তাকিয়ে থাকে বর্ষার দিকে সে।তবে ছেলের গলার স্বর আর চেহারা দুটোই মনকাড়া।এই দুটো জিনিস বর্ষার বেশ লেগেছে।
— “সারারাত বসে থাকার প্ল্যান আছে নাকি?”
— “সারারাত বসে থাকবো কেন?
— “তা কথা বলছো না কেন?কেমন লাগলো আমাকে বলো?”
— “সুন্দর।”
কথাটা বলেই চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো বর্ষা।ও তো সুন্দর কথাটা বলতেই চায়নি।অভি তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। হাসিটাকে আড়াল করে বলে,
— “তোমাকে আমার কেমন লেগেছে সেটা জানতে চাইবেনা?”
— “বলুন, কেমন লাগলো আমাকে?”
লজ্জা লজ্জা ভাব করে বলে বর্ষা।
— “দেখবো তো ভালো করে তারপর তো বলবো!”
বর্ষা বলার মতো কিছু পায়না।জাস্ট ইচ্ছে করছে টেবিলের উপর উঠে গিয়ে ওর গালে ঠাস ঠাস করে দুইটা দুইটা চারটা থাপ্পড় বসাতে।অসভ্য, অভদ্র, বেয়াদব ছেলে একটা!
অভি সেই থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে বর্ষাকে।বর্ষার অস্বস্তিতে এখান থেকে উঠে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।অভি থুঁতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করে,
— “তুমি কি খালি চেইন সিস্টেম জামা পরো?”
ঘাবড়ে যায় বর্ষা।এটা কী ধরনের প্রশ্ন! একটা ছেলে একটা মেয়েকে দেখতে এসে যে এসব লুচ্চামি টাইপ প্রশ্ন করতে পারে সেটা বর্ষার অজানা ছিল।বর্ষা গম্ভীরভাবে বললো,
— “হ্যাঁ।”
— “এরপর থেকে আর পরবেনা।”
— “চেষ্টা করবো।”
— “তুমি তো আমার থেকে মারাত্বক শর্ট।”
— “হ্যাঁ সেটা আপনি দেখেননি প্রথমদিনে?”
— “দেখেছি, খুব ভালো করে দেখেছি বলেই তো ঘাড়ের নিচের লাল তিলটাও চোখে লেগেছে।”
বলার সময় গলার স্বরটা একটু নিচু করেই বললো অভি।
লজ্জাতে বর্ষার দৌঁড় দিতে ইচ্ছে করছে এখান থেকে।তার থুঁতনি, নাকের ডগা আর ভ্রু জোড়ার মাঝে নোনাপানি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।প্রচন্ড আনইজি লাগছে ওর।কেমন অস্থিরতা থেকে বমি বমিও পাচ্ছে।এটা একটা বিরাট সমস্যা ওর।যখনই খুব অস্থিরবোধ করে ও তখনই ওর ভীষণ বমি পায়।ওর চোখ মুখের অবস্থা অন্যরকম লাগছে দেখে অভি সোজা হয়ে বসে ওর দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে ধরে।
— “তুমি ঠিক আছো তো?”
— “হুম।”
বর্ষা টিসু দিয়ে মুখ মুছছে বার বার। অবস্থা তেমন ভালো লাগছেনা অভির।ও দ্রুত উঠে বর্ষার পাশে এসে বসল। পকেট থেকে সেই ব্যাটারিতে চলা ছোট ফ্যানটা বর্ষার মুখের সামনে ধরে বাতাস দিচ্ছে।তারপর জিজ্ঞস করে,
— “কোনো সমস্যা?কী হয়েছে বলো?”
বর্ষা বড় বড় করে চোখ করে তাকিয়ে আছে অভির দিকে।ঠিক কিছুতেই নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছেনা ও অভির সামনে।
— “আরে এত ঘামছো কেনো?স্ট্রোক করবে নাকি আবার? প্রেশার প্রবলেম আছে নাকি?”
— “বমি পাচ্ছে আমার।”
করুণ মুখ করে বললো অভিকে।সেই সাথে কেমন ঘন ঘন নিঃশ্বাসও পড়ছে। অভি বর্ষার অস্থিরতার কারণটা ধরতে পারলো।কিছুক্ষণ বর্ষার দিকে চেয়ে থেকে ওর একটু কাছে এগিয়ে এসে ওর পেটের মাঝ বরাবর হালকা চাঁপ দিলো।লাফিয়ে ওঠার মতো করে চমকে উঠে বসে বর্ষা।এবার সে একদমই নিস্তব্ধ।পলকহীন দৃষ্টিতে বড় বড় চোখ দুটো দিয়ে চেয়ে দেখছে অভিকে।অভি তখনো ওর খুব কাছে।এখন আর ঘাম বাড়ছেনা বর্ষার।নিঃশ্বাসও ঘন ঘন পড়ছেনা।অভি প্রশ্ন করল,
— “এখনো বমি পাচ্ছে?”
পাক্কা দশ মিনিট বর্ষা ওয়াশরুমে গিয়ে বমি করে।অভি বিরক্তকিকর ভঙ্গীতে বসে আছে।বর্ষা এসে বসতেই অভি বর্ষাকে বলে,
— “তোমার বাবা-মা কে বলো কাল সন্ধ্যায় আমার আব্বা-আম্মা আসছে।”
কথাটা শেষ করেই উঠে যায়। যাওয়ার সময় বর্ষাকে বলে গেল,
— “বিলটা দিয়ে দিও।”
অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে বর্ষা।সুস্থ থাকতে এই ছেলেকে বর্ষা কক্ষনো বিয়ে করবে না, নেভার।বাড়িতে এসে বর্ষা সাফ সাফ জানায় এই বিয়ে সে মরে গেলেও করবেনা।দরকার পড়লে ব্যাংকের গেটের দারোয়ান কে সে বিয়ে করবে তবু ওই ম্যানেজার কে না।এর কারণ কী তা সে কারো কাছে বর্ণনা করে নি।অভি বাড়িতে ফিরে মায়ের ঘরে গিয়ে বাবার সামনেই প্রশ্ন করে,
— “আম্মা? আমি যদি আমার বউকে তোমাদের সামনে কোলে করে ঘুরি তোমাদের কী কোনো প্রবলেম আছে?”
বাবা-মা স্তব্ধ।আম্মা ধমকে বলে,
– “এগুলো কী ধরনের প্রশ্ন?এমন কথার মানে কী?”
— “আসলে তোমাদের ছেলে বউ খুব শর্ট হবে তো।এর জন্য বাড়ির নানারকম কাজ, আমার কাজ তার করতে সমস্যা হতে পারে। দেখা গেলো তাকে কোলে তুলে উঁচু করে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করা লাগতে পারে।তাই বললাম আর কী! আর তোমরা যেও কাল।পাকা কথা বলে আসো।বিয়ের ডেট টা আবার এক মাস পর দিওনা।এ মাসেই দিও।এই মাসেই আমার বউ লাগবে।”
বেহায়া ছেলের কথা শুনে এবার ফরিদ সাহেব না হেসে থাকতে পারলোনা।আর সেই হাসির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমেনা বেগম।অবশেষে বর্ষার আপত্তি থাকতেও পনেরো দিনের মধ্যে অভিকে তার বিয়ে করতে হলো।অবাক করা বিষয় হচ্ছে একটা ব্যাংকের ম্যানেজার যে ছেলে সেই ছেলে মাত্র একটা প্রাইভেট কার নিয়ে বিয়ে করতে এসেছে।প্রাইভেট কারে বাবা-মা আর অভি এসেছে।বিয়ে করা শেষে বাবা-মা কে ট্যাক্সি করে চলে যেতে বলে অভি।বাবা-মা ও সেটাই করে।ব্যাপারটা সবার কাছে অবাক করা হলেও অভির কাছে পুরোটাই স্বাভাবিক।
.
— “আমি কী আর একটা বিয়ে করবো?”
— “মানে? অভির প্রশ্নে ঘুরে তাকায় বর্ষা।”
— “তো মাঝে এরকম এক হাত ফাঁকা রেখেছো কেনো?মনে হচ্ছে সামনে গিয়ে আরো একজনকে বিয়ে করে গাড়িতে তুলবো তাই তার সিট ফাঁকা রেখেছো।”
অসন্তোষ চোখে তাকিয়ে আছে বর্ষা।অভি আবার বললো,
— “মিশে এসে বসো।'”
বর্ষা একটু মিশে এসে বসে।
— “আরও মিশে বসো।”
বর্ষা আরো কিছুটা এগিয়ে এসে বসে।
— “মিশে বসতে জানোনা?”
বর্ষা এবার গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসে।
— “হ্যাঁ এবার ঠিক আছে।এভাবেই বসতে হয়।”
বর্ষা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।অভি প্রশ্ন করে,
— “আচ্ছা তুমি সেদিন ওইভাবে বমি করলে কেনো?মনে হচ্ছিলো তিন চার মাসের পোয়াতি।”
— “কী!”
রাগে কটমট করছে বর্ষা।তারপর বলে,
— “সেদিন আপনি কী কাজটা করলেন আমার সঙ্গে?আর কী সব জিজ্ঞেস করছিলেন আমাকে?”
— “কী কাজ করেছিলাম?আর কী সব জিজ্ঞেস করেছিলাম?”
— “আপনার মনে নেই?”
— “মনে থাকবেনা কেনো? আমি সেদিন তোমার পেটের মাঝে একটু চাঁপ দিয়েছিলাম।কারণ তুমি হুদাহুদিই একটা আনএক্সপেকটেবল এক্সপ্রেশন দিচ্ছিলে।সেটা থেকে তোমাকেই ইজি করতেই…..আর তারপর তোমার ছোটখাটো একটা ভাইবা নিলাম।ভাইবাতে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম।প্রশ্ন গুলো ছিল খুবই সিম্পল।”
— “ওগুলো সিম্পল কোয়েশ্চন?”
— “তা নয়তো কী?আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি তোমার পেটে চাঁপ দেওয়াতে তুমি কেমন বোধ করছো?, বিয়ের পর আমাকে তুমি কীভাবে কীভাবে সন্তুষ্ট রাখবে?, আমার যখন তোমার উপর খুব রাগ হবে।রাগে আমি যখন তোমার কাছে আসতে চাইবোনা তখন তোমার করণীয় কী? আর লাস্ট কোয়শ্চেন ছিল আমার বেবি কন্সিভ করার জন্য তুমি কতোটুকু যোগ্য বলে মনে করো নিজেকে? ব্যাস, এতটুকুই তো। তুমি আমার সংসারের জন্য কতোটুকু পারফেক্ট তার জন্য আমি তোমার একটা ভাইবা এক্সাম নিতে পারিনা? তোমাকে যাচাই করতে পারিনা?”
অভির প্রশ্নে বর্ষা শুধু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। আসলে এই ছেলের নেচারই যে এমন সেটা বর্ষা বুঝে গেছে।অভি বর্ষার মুখের হাল দেখে রীতিমত এনজয় করছে ব্যাপারটা। সেদিন কোয়েশ্চনগুলো করার কেবল মূল উদ্দেশ্য ছিল বর্ষাকে ঘাবড়ে দেওয়া।আর ঘাবড়ে গেলে, লজ্জা পেলে ওর মধ্যে কতটুকু অস্থিরতা কাজ করে আর কেমন দেখায় ওকে সেটা দেখার জন্যই অভি ওইসব উদ্ভট উদ্ভট প্রশ্ন করেছিল।
.
সন্ধ্যার পর ওদের বিয়ের গাড়িটা একটা গলির মধ্যে ঢুকে টিনশেড ছোটখাটো একটা বাড়ির সামনে এসে থামে।অভি গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির ড্রাইভারকে তার সারাদিনের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বর্ষাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে।ঘরের অবস্থা দেখে বর্ষার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো হাল।ঘরের মধ্যে একটা চৌকি, তার পাশে একটা স্টিলের আলমারি, একটা টেবিল।টেবিলে বসে পড়া আর খাওয়া দুটোর কাজই চলে।আর পুরো ঘরটায় চারপাশ টিনশেডের।ফ্লোরের অবস্থা বেহাল।সিমেন্ট,বালি উঠে ফ্লোর চটে গেছে।
— “চেঞ্জ করার জন্য এক্সট্রা রুম নেই, এখানেই করতে হবে। ওপাশের রুমে একজন ঘুমিয়ে আছে।আর আব্বা-আম্মাকে খুঁজছো? আজকে তাদের মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।বাসররাত বলে একটা ব্যাপার-স্যাপার হবে আমার।তারা থাকলে একটু লজ্জা লজ্জা লাগবেনা?”
বর্ষার চারপাশ অন্ধকার লাগছে।এখনই ওকে বসতে হবে আর না হলে কিছু একটা ধরে দাঁড়িয়ে শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে হবে। অভি এসে দ্রুত বর্ষাকে ধরে ফেলল।মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল বর্ষা।ওকে ধরে বিছানায় বসিয়ে বলে,
— “মেয়ে তোমার সমস্যা কী বলো তো? আমার সামনে আসলেই কী তোমার বমি পায়, মাথা ঘোরে, অস্থির অস্থির লাগে?”
নিজেকে একটু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বর্ষা ভয়ংকর রাগী চোখে তাকায় অভির দিকে। তারপর বলে,
— “আপনি কি সত্যি ব্যাংকের ম্যানেজার?”
— “তো সেদিন কার কাছে ভাইবা দিলা?”
— “আমার বাবা তো বলেছিল আপনাদের উত্তরা ছয়তলা বাড়ি। বাকি পাঁচতলা আপনারা ভাড়া দিয়ে রাখেন।আর দোতলায় আপনারা থাকেন।আপনাদের নিজস্ব গাড়ি আছে।তাহলে এসব কী?”
চিল্লিয়ে বললো বর্ষা।
— “এসব কী মানে?”
— “আপনি আমাকে কোথায় নিয়েসেছেন?”
— “আমার বাড়িতে।”
— “তার মানে আপনাদের ওসব কিছুই নেই?তাহলে আমার বাবা কী ভুল দেখেছে নাকি মিথ্যা বলেছে?”
— “সেটা তোমার বাবাকে ফোন করে শোনো।সে কী বলেছে তা কী আমি জানি?”
— “আমার বাবা তাহলে এখানে এসেছিল?”
— “না।”
— “তাহলে কোথায় এসেছিল?”
— ” উত্তরা।আমাদের ভাড়া করা বাড়িতে।”
বর্ষার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে অভি বলে,
— “এরকম ছোটলোকের মতো আচরণ করছো কেন?বাড়ি-গাড়ি থাকলেই কী সব সুখ পাওয়া যায়?আমার মতো এত সুন্দর একটা বর পেয়েছো। যাকে দেখলেই তোমার অস্থির অস্থির লাগে।এরকম একটা বর পাওয়া কী মুখের কথা?আর টেনশান নিওনা তো।এখন বিয়ে করেছি না?এরপর বাড়ি গাড়ি সব করবো।শুধু একটু সময় লাগবে। তুমি এত ভেবোনা কেমন?আসো শুরু করি। বিছানায় গা ভাসিয়ে দিতে দিতে বললো।
— “শুরু করি মানে?”
— “ঘুমিয়ে পড়ি।”
চিত হয়ে শুয়ে দুহাত মাথার নিচে রেখে পা নাড়াচ্ছে অভি। আর বর্ষা বধু বেশে বসে পা ঝুলিয়ে বসে কাঁদছে।সেই দৃশ্যই দেখছে শুয়ে অভি।আপাতত কোনো রিয়্যাকশন দেখাতে চাইছেনা সে।হঠাৎ করেই লোডশেডিং হয়ে পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে যায়।বিছানায় পা উঠিয়ে পিছু ফিরেই একদম অভির কাছে চলে আসে বর্ষা।অভি আগের ভঙ্গীতেই শুয়ে ছিল।গায়ের সাথে বর্ষার শরীরের ধাক্কা লাগতেই অভি পা নাড়ানো থামিয়ে দেয়।ঘরের বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ, আর ঘরের ভেতরে দুটো মানব মানবীর ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দ।এ ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব টের পাচ্ছেনা দুজন। অভির ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি।একটু সময় বাদেই বর্ষার কোমড়ে হাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নেয় সে বর্ষাকে। ওর শরীরে হাত দিতেই অভি টের পায় বর্ষা ঘেমে একদম কাঁদা।নিঃশ্বাসও পড়ছে ঘন ঘন।অভি হুমকি দেওয়ার মতো করে ওকে বলে,
— “একদম বমি করবানা কিন্তু।”
আধো আধো চোখে বর্ষা কম্বলের নিচ দিয়ে নিজের জামা কাপড় দেখছে।গায়ে কোনো গয়নাও নেই।নিজের বেহাল দেখে লজ্জায় একদম কুকড়ে যাচ্ছে সে।আস্তে আস্তে উঠে বসে চারপাশের অবস্থা দেখে একদম হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। সূর্যের কড়া রোদ জানালা ভেদ করে একদম ওর বিছানার ওপর এসে পড়েছে।জানালার দিকে তাকাতে দেখতে পেলো কাঁচের জানালার ওপাশে গাছের ডালপালা ঝাপটে পড়েছে জানালার দিকে।গাছটা কী গাছ তা ঠিক ধরতে পারছেনা।আরো ভালো করে দেখল, ইয়া বড় একটা বেডরুমে সে বসে আছে।বেডটা রুমের একদম মাঝ বরাবর।সামনের দেয়ালে অভির একার কিছু ছবি আর ওর বাবা-মায়ের সাথে কিছু ছবি।আর সেই দেয়ালের সাথে মিশিয়ে সাদা রঙের দামী সোফা, দামী কুশন। রুমের বামপাশটাতে ওয়াল শোকেস আরো দামী দামী কিছু আসবাব। সবকিছু দেখে একটা দারুণ চমক পেয়েছে বর্ষা। দেয়াল ঘড়িটা দশটা বাজার ঘন্টা দিয়ে উঠতেই বর্ষা চমকে গেলো।কেউ একজন দরজার মুখে কফি মগ হাতে নিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে।বর্ষা ঘুরে তার দিকে তাকালো। অভি দাঁড়িয়ে, পরনে অফ হোয়াইট জিন্স প্যান্ট আর হালকা আকাশী রঙের পাতলা কাপড়ের একটা শার্ট।দরজায় হেলান দিয়ে ডান হাতে কফি মগ আর বা হাত পকেটে পুরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে বর্ষার দিকে চেয়ে।তার চুলগুলো ভেজা। আর ছোট ভেজা চুলগুলো কপালের ওপর এসে পড়ে তাকে দারুণ দেখাচ্ছে।সকালের এই স্নিগ্ধ চেহারায় বর্ষা ওকে রোজ দেখলে সে নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে নিশ্চিত।ওখানে দাঁড়িয়েই অভি বর্ষাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— “কাল রাতের ভাইবাতে আপনি পাস করে গেছেন।তার জন্যই আপনাকে অভি ম্যানশনে জয়েন করিয়ে দিলাম।জবটা উপভোগ করছেন তো আপনি?”
অভির প্রশ্নের উত্তরে বর্ষার লিপস্টিক ছড়ানো ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি দোল খেলো মাত্র।
……………………………..
(সমাপ্ত)
– Israt Jahan Sobrin
পুরোনো লেখা। তাই ভুল-ত্রুটি অজস্র। কষ্ট করে বুঝে নেওয়ার অনুরোধ রইল।