মায়া

মায়া
অন্তরা’আব্বা- মা কই গেলা? কইরে আশিক! দেইখ্যা যা। তোর ভাবিরে পাওয়া গেছে…!’

ছেলের চিৎকারে ছুটে আসে বাবা-মা, ছুটে আসে ছোট ভাই আশিক।
শুভ্র তখন বিছানার উল্টোদিকে উপুড় হয়ে শুয়ে মাথা নিচু করে খাটের নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেটা দেখে শুভ্রর বাবা-মা একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে।
বিস্মিত আশিক তো কৌতূহল সামলাতে না পেরে প্রশ্নই করে বসে-
“ভাইয়া! তুমি এভাবে ঝুলে আছো কেন?”
– আরে ব্যাটা ঝুলছি না দেখছি…
– কি দেখছো? আর অন্তরাপু কোথায়?
– সেটাই তো দেখছি…
– মানে কি?

খাটের নিচে তাকানোর আসল মানে বুঝাতে শুয়া থেকে উঠে বসে শুভ্র। বিছানা থেকে নিচে নেমে ছোট ভাইকে ঘাড়ে ধরে ফ্লোরে বসায়। ফ্লোরে বসে শুভ্র ওর দু’হাটু ভাঁজ করলে আশিকও দেখাদেখি সেটাই করে। তারপর দু’ভাই মিলে উঁকি দেয় খাটের নিচে। শুভ্র ওর হাত ইশারায় আশিককে দেখায়- ‘ওই দ্যাখ! দেখছস? তোর ভাবি’পু…’
খাটের নিচে চুপচাপ শান্তশিষ্ট বালিকার ন্যায় অন্তরা শুয়ে আছে। সেটা দেখে আশিকের চোখ দুটো গোল মার্বেলের ন্যায় হয়ে যায়। কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে দেখে বিষয় টা হজম করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে হাপাতে হাপাতে বলে, মা’গো, বাবা’গো তোমাদের পুত্রবধূ খাটের নিচে শুয়ে আছে আর তোমরা কি না ওরে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গেছো…!
শুভ্রর বাবা মা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো ব্যাপার টা ওনাদের মাথার উপর দিয়ে গেছে যেনো। কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।

এদিকে আশিক?! ও বসে নেই। দৌঁড়ে ডাকতে গেছে বাড়ির অন্যান্য লোকজনদের। ডাকতে গেছে অন্তরার বাবা মাকে। যারা মেয়ে নিখুঁজের সংবাদ শুনে সুদূর নরসিংদী থেকে ছুটে এসেছে। খুঁজেছেও অনেক জায়গায়। পায়নি কোথাও।

ঘটনার শুরুটা হয় সকাল ১০টা কি সাড়ে ১০টার দিকে। হোমিওপ্যাথিক ঔষধকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত হয়। হোমিওপ্যাথিকের ওই ক্ষুদ্র এবং সাদা রঙের বলের মতো ট্যাবলেট গুলো অন্তরার খুব প্রিয় ছিলো। ভোরের দিকে অন্তরা গিয়েছিলো ওর দাদী শাশুড়ির রুমে। নামাজের জন্য দাদীকে ডাক দেয়ার সময় অন্তরার নজর যায় টেবিলের এককোণে পড়ে থাকা সরু কাচের শিশি’টার দিকে। যার ভিতরে রয়েছে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ওই ছোট ছোট গোটা জাতীয় ঔষধ। ঔষধ দেখে অন্তরার চোখ চিকচিক করে উঠে লোভে। জিবে জল এসে যায়। এদিকওদিক তাকিয়ে লোকজন আসছে কি না সেটা ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ঔষধের ছোট শিশি টা ওড়নার নিচে লুকিয়ে ফেলে। তারপর দ্রুত প্রস্থান করে সে স্থান। বারান্দায় গিয়ে ঔষধগুলো একসাথে ঢেলে দেয় মুখে। দ্রুত চিবিয়ে গিলে খেয়ে ফেলে। শিশি টা রেখে আসে ময়লা ফেলার ঝুড়িতে।

সকালে ব্রেকফাস্ট করার আগে শুভ্রর বাবা ওনার বুড়ো মাকে প্রশ্ন করে- ‘ মা! আপনার হাত-পা তো আবার ফুলে গেছে। ঔষধ খান না?’
বয়স্ক মানুষ! কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, শিশি’টাই হারায় ফেলছিরে বাপ! শরীর’ডা খুব খারাপ লাগছে। আইজক্যা দিন আমার ক্যামনে যাইবো?
কিছুটা উচু গলায় শুভ্রর বাবার প্রশ্ন, কী বলছেন মা? হারায় ফেলছেন মানে? এখন ঔষধ কোথা থেকে পাবেন? আমি তো আজ কালকের মধ্যে কিশোরগঞ্জ যাবো না। আর স্টকেও তো ঔষধ নেই!
বলে রাখা ভালো শুভ্রর বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। পাশাপাশি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। শুভ্রর দাদী এলোপ্যাথিক কোন ঔষধ খেতে পারে না। যার দরুন হোমিওপ্যাথিক খাওয়াতে হয় ওনাকে।
অন্তরা যে ঔষধটা চুরি করে খেয়ে ফেলেছে সেটা আগেরদিন রাত্রে শুভ্রর বাবা তাঁর মায়ের রুমে রেখে আসছিল। কিন্তু কে জানতো সেই ঔষধ টা সকাল হতে না হতেই হারিয়ে যাবে!
যায় হোক! হারিয়ে আর কোথায় যাবে? নিশ্চয় রুমে! শুভ্রর বাবা-মা, এক কাকী এবং ভাই বোনেরা ঔষধ খুঁজার মিশনে নেমে যায়।
এদিকে অন্তরা? সবাই যখন ঔষধ খুঁজতে দোতলা’য় দাদী শাশুড়ির রুমে ব্যস্ত ও তখন একদৌড়ে নিজ রুমে চলে যায়। ঝুড়ি থেকে শূন্য শিশি টা নিয়ে ফেলে দেয় রাস্তায়।
বারান্দা দিয়ে শিশি টা রাস্তায় ফেলে দিয়ে রুমে ঢুকতেই ঘাবড়ে যায় অন্তরা। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভেতর রুমের দরজায় হেলান দেয়া অবস্থায় শুভ্র দাঁড়িয়ে।
ভয়ে কেঁদে দেয় অন্তরা। আমি ঔষধ খাইনি, আমি ঔষধ খাইনি বলে কাঁদতে থাকে।
অন্তরার বেহাল দশা’য় ভিষণ হাসি পায় শুভ্রর। কিন্তু প্রকাশ করে উল্টোটা। হাসিটা অনেক কষ্টে ভেতরে চেপে রেখে গম্ভীর গলায় ধমক দেয় অন্তরাকে। চুরি করে ঔষধ খাওয়ার অপরাধে শুভ্র তাকে অনেকগুলো কথা শুনায়।
অন্তরার কান্না আসছিল প্রচুর কিন্তু চেপে রাখে সেটা। পরে শুভ্র যখন রুম থেকে বেরিয়ে যায় তখন একটাই সিদ্ধান্ত নেয়। ‘এই মুখ নিয়ে আর যায় হোক শুভ্রর মুখোমুখি হবে না।’ যার দরুন শুয়ে পড়ে খাটের নিচে।

শুভ্ররা যৌথ পরিবার বসত করে। ওদের পরিবারে ওরা ছাড়াও আরো ২৩সদস্যের বসবাস। এ বাড়িতে তাই সারা বছর ঈদের মত হৈ-হুল্লুর লেগেই থাকে। অন্তরা যে অনেকক্ষণ ধরে বাসায় নেই ব্যাপারটা তাই কেউ প্রথমে টের পায়নি। যখন টের পায় তখন লাঞ্চ টাইম। সেই থেকে খুঁজাখুঁজির শুরু। পরে কোথাও না পেয়ে শুভ্র ওর শ্বশুর বাড়িতে খবর দেয়। খবর শুনে অন্তরার বাবা মা ছুটে আসে।
সময় তখন ৬টা। খাটের নিচে শুয়ে থাকা অন্তরার ঘুম ভাঙে। খাটের নিচ থেকেই অন্তরা ওর বাবা মায়ের আগমনের সংবাদ পায়। বিষয় টা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে ভেবে ভয়ে শিহরণ দিয়ে উঠে অন্তরার পুরো শরীর।
প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বের হয়নি বাইরে। রাত্রে অন্তরার বাবা মায়ের কথা’য় সবাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, শুভ্রর ধমক হজম করতে না পেরে ঘাড়ত্যাড়া অন্তরা কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে।
সবাই যে যার মতো নিশ্চিন্তে রাতের খাবার খেয়ে নেয়। খায়নি শুধু শুভ্র। ভেতরে তার কিছুই ঢুকছিল না। বুকের বা পাশে চিনচিনে এক ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল।
বিছানায় গা’টা এলিয়ে দেয়ার জন্য রুমে ঢুকে শুভ্র। লোডশেডিং চলছিল। অন্ধকার রুমেই শুভ্র অনুধাবন করে ছায়া জাতীয় কিছু একটা বাথরুমের ওপাশ থেকে দৌড়ে এসে খাটের নিচে ঢুকছে।
ভূত প্রেতে একদম বিশ্বাসী নয় শুভ্র। তথাপি শরীরটা কেমন যেন শিহরণ দিয়ে উঠে! মনের ভুল ভেবে মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল শুভ্র। বিদ্যুৎ চলে আসে তখনি। জ্বলে উঠে লাইট।
বিছানায় উঠে গাটা এলিয়ে দেয় শুভ্র। মিনিট ত্রিশেক অতিবাহিত হয়ে যায়। হুট করে শুভ্রর কৌতূহল জাগে খাটের নিচ টা দেখার। যেই ভাবনা, সেই কাজ। উঁকি দেয় খাটের নিচে। তারপর চেঁচিয়ে উঠে আম্মা গো, আব্বা গো বলে। তারপরের ঘটনা তো সবাই জানেনই!

আশিক অন্তরার বাবা- মাকে খবর দেয়া মাত্রই তারা রুমে ছুটে আসে। ছুটে আসে শুভ্রর চাচা- চাচী, বোন এবং কাজিনরা। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে অন্তরার খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় আছে। শুভ্র এবং অন্তরার মা- বাবা উঁকি দেয় খাটের নিচে। ডাক দেয় মেয়ে কে বেরিয়ে আসার জন্য। বাবা মাকে দেখে রুমে অন্যান্য সবার উপস্থিতি কল্পনা করে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায় অন্তরা।
অন্তরা’র মনের অবস্থা টা বুঝতে পারে শুভ্র। সবাইকে চোখ ইশারায় রুম থেকে বের করে দেয়। তারপর অনেকটা নরম গলায় ডাক দেয়- ‘লক্ষ্মী! আসো, বাহিরে আসো।’
বাহির হচ্ছে না অন্তরা। ঘাপটি মেরে আছে তখনো। সেটা দেখে শুভ্র ওর হাতটা বাড়িয়ে দেয়। ‘আসো! আসো! কিচ্ছু খাইনি দুপুর থেকে। দ্রুত আসো। নাটক রেখে দ্রুত আসো।’
শুভ্রর মুখে নাটকের কথা শুনে কেঁদে দেয় অন্তরা। কাঁদতে কাঁদতেই বাচ্চাদের মত হাঁটুতে ভর দিয়ে দু’হাত দিয়ে হেটে হেটে বাহিরে বেরিয়ে আসে।
হাঁটু এবং কুনুই থেকে ময়লা ফেলছে আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে অন্তরা।
শুভ্র চলে যায় কিচেনে খাবার আনতে। খাবার এনে অন্তরাকে বহু অনুনয় বিনয় করা সত্ত্বেও খায়নি অন্তরা। বাজারে যায় শুভ্র। অন্তরার প্রিয় চিপস, কলা আর সিদ্ধ ডিম আনে। লোভ দেখায় ভাত খেলে এগুলো দেবে।
নাহ! অন্তরাকে কিছুতেই খাওয়ানো গেলো না। ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে যায় শুভ্রর। রাগে একটা থাপ্পর মেরে দু’চার কথা শুনিয়ে দেয় অন্তরাকে। তারপর লাইট নিভিয়ে দেয়।
শুভ্রর ধমকে অন্তরা ভড়কে যায়। ভয়ে চিৎকার’টাও আসছে না ভেতর থেকে। চুপচাপ শুভ্রর পাশে শুয়ে পড়ে।
ঘুমোবে না ঘুমোবে না করেও একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে শুভ্র।

সময় আনুমানিক ২টা কি আড়াইটা…
অদ্ভুত ধরনের কিছু আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙে শুভ্রর। কখনো চপচপ, কখনো মচমচ। আওয়াজ টা ঠিক মাথার পাশ থেকেই আসছিল। শুভ্রর মাথার পাশেই ছোট্ট একটা টেবিল। তার পাশে একটা চেয়ারও পাতানো রয়েছে। ইঁদুর, টিদুর নয়তো? সাবধানে ডানে তাকায় শুভ্র।
শুভ্রর চোখগুলো গোল মার্বেলের ন্যায় হয়ে যায়। ড্রিমলাইটের মৃদু আলো’য় অন্তরা বসে তখন চিপস, কলা আর ডিম খাওয়ায় ব্যস্ত।
অকস্মাৎ উঠে বসে শুভ্র। লাইটটা জ্বালিয়ে দেয় হুট করেই। অন্তরা তখনো ডিম, কলা আর চিপস খাওয়ায় ব্যস্ত। শুভ্র বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিচে নামে। সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অন্তরার।
মুহূর্তে’ই হাসি মুখ টা চুপসে যায় শুভ্রর। অন্তরার চোখে তখনো রাজ্যের ঘুম। সেই ঘুম চোখে ঢুলু ঢুলু অন্তরা খাচ্ছে।
বড্ড মায়া হয় শুভ্রর। বুক ফেটে কান্না আসছিল ওর। কান্না লুকাতে দ্রুত রুম ত্যাগ করে শুভ্র।

মিনিট খানেক পর হাতে ভাতের প্লেট এবং তরকারির বাটি নিয়ে ফিরে আসে শুভ্র।
ভিষণ ক্ষুদার্থ ছিল অন্তরা। ঘুম চোখেই শুভ্রর আধেক খেয়ে ঢেকে রাখা প্লেটটা উল্টায়। প্লেটের একপাশে পরে থাকা কিছু ভাত এবং শুকনো তরকারি দেখে দ্রুত হাত ধূয়ার জন্য জগ ভর্তি পানিতে হাত ঢুকিয়ে দেয়। তারপর সেই এটো ভাতই খাওয়া শুরু করে।
এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা অশ্রু বিন্দুগুলো গড়িয়ে পরে গাল গড়িয়ে নিচে। খাবারের প্লেট টা পাশে বিছানায় রেখে শুভ্র চেয়ারের পেছন থেকেই জাপটে ধরে অন্তরা কে। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে….

#মায়া
#অনামিকা_ইসলাম_অন্তরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here