গল্পের শেষ পাতায়

গল্পের শেষ পাতায়
অন্তরা

০৫.০২.২০১৭
সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আজ আমি চলে এসেছি। ৪০হাজার টাকার বিনিময়ে। হ্যাঁ, মাত্র ৪০হাজার টাকার বিনিময়ে আমি আমার ভালোবাসাকে বিক্রি করে দিয়ে চলে এসেছি। জানিনা শুভ্র কখনো আমায় ক্ষমা করবে না! করতে পারবে কি না! তবে নিজেকে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। বিবেকের কাছে চির টা কাল অপরাধী হয়েই রয়ে যাবো। কিন্তু কি করবো! আমি যে আর এভাবে এমন করে পারছিলাম না। চোখের সামনে গর্ভধারীনি মা আমার ধুকে, ধুকে মরছিলো। এটা যে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।

০৯-০২-২০১৭
‘ও’ আমায় আজ নিতে এসেছিলো। যাইনি। এক মুহূর্তের জন্যও ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি আমি। মিনিট ত্রিশেক ও আমার অসুস্থ মায়ের পাশে মাথা নিচু করে বসেছিলো। তারপর চলে যায়। ও চলে গেলে মায়ের পাশে গিয়ে বসি। পূর্বের ন্যায় মা আমার শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য বিশদ লেকচার দেয়। জবাবে কিচ্ছু বলিনি মাকে। নিঃশব্দে শুধু রুম ত্যাগ করে নিজের রুমে চলে আসি। বালিশ বুকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। ‘আমি স্বার্থপর। বড্ড বেশী স্বার্থপর। তুমি বরং আমায় ভুলে যেও শুভ্র। তোমার মায়ের কথা মেনে নিয়ে ওনার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে নাও। সুখী হবে তুমি। পিতৃত্বের যে সুখ আমি তোমাকে এতদিনে দিতে পারিনি সে সুখ তোমাকে তোমার দ্বিতীয় স্ত্রী দিবে….!’

১৪.০২.২০১৭
গতকাল ছিলো পহেলা ফাল্গুন। আমার জন্মদিন। প্রতি বছরের মতো এবার আর শুভ্রকে সাথে করে জন্মদিন উৎযাপন করতে পারিনি। পারিনি ওকে বলতে ‘বড্ড বেশী ভালোবাসি তোমাকে।’ তবে রাত্রি এগারোটার দিকে কল দিয়েছিলো ‘ও’। জানতে চেয়েছিলো- কি চাই আমি! এবারের জন্মদিনে উপহারসরূপ আমি ওর থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। বলেছিলাম, তোমার সাথে সংসার আমি করবো না। কেনো করবো না কারণ জানতে চেয়ো না। জবাবে ও বলেছিলো- ‘আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি কি খুব সুখী হবে? যদি হও, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। তুমি সুখে থাকো, এটাই আমি চাই। মনে-প্রাণে চাই।’

০৭-০৯-২০১৭
অনেকগুলো মাস পর ডায়েরী নিয়ে বসলাম। মাকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম সকালে। ক্যানসারের শেষ ‘কেমো’টা’ দিয়ে আসলাম। হাতে অবশিষ্ট যে টাকা ছিল মায়ের জন্য ঔষধ কিনেই শেষ হয়ে গেছে। এদিকে বাড়ির পাশে যে একটু জমি ছিল সেটাও বিক্রি করে দিয়েছি। আর সে টাকাও প্রায় শেষের দিকে।

২৭-০৯-২০১৭
দিনকে দিন মায়ের শরীরের অবস্থা খারাপ থেকে অধিকতর খারাপের দিকে যাচ্ছিল। হাতে একটাও টাকা ছিল না। দিগ্বিদিক শূন্য আমি বেহায়ার ন্যায় ছুটে যায় শ্বশুর বাড়িতে। শুভ্রর সামনে দাঁড়ানোর মতো কোন যোগ্যতায় আমার অবশিষ্ট ছিল না। লুকিয়ে তাই শাশুড়ির সাথে দেখা করি। করজোড়ে সাহায্য চাই। আমার শাশুড়ি আমার হাতে শেষ বারের মতো ০৫হাজার টাকা তুলে দেয়। পরম যতনে সে টাকা বুকে নিয়ে ছুটে আসি বাড়ির দিকে। বাজার থেকে কিছু ঔষধপত্র আর ফলমূল কিনে বাড়িতে প্রবেশ করি। ততঃক্ষণে অনেকবেশী দেরী হয়ে গেছে। মা আমার ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোকে পাড়ি জমান।

৩০-০৯-২০১৭
নাহ! আমি বাপের বাড়িতে না। আমি এখন আমার শ্বশুর বাড়িতে। জানি না কে বা কারা সেদিন শুভ্রকে মায়ের মৃত্যর সংবাদ দিয়েছিল। সংবাদ শুনে শুভ্র ছুটে গিয়েছিল আমাদের বাড়িতে। মায়ের দাফনকার্য শেষে ও সেদিন আমার সাথেই থেকেছিলো। তিনদিন পর সমস্ত রীতিনীতি শেষে ও আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসে। এই মুহূর্তে আমার অবস্থান শুভ্রর রুমের এককোণে। কর্ণারে যে ছোট্ট টেবিলটা আছে সেখানে চুপটি করো বসে ডায়েরী লিখছি। দরজায় করাঘাতের আওয়াজ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ‘ও’ আসছে। আজ এ পর্যন্ত’ই….

০৩-১০-২০১৭
অনেকগুলো মাস পর সেদিনই প্রথম শুভ্রর মুখোমুখী হয়। কেনো জানি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না! নিজের প্রতি নিজেরই লজ্জা হচ্ছিল। ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তবুও বহুকষ্টে ওর দিকে তাকালাম। ওকে দেখে ভেতর টা আমার মোচড় দিয়ে উঠে। এ আমি কাকে দেখছি?! ওর সুন্দর মুখটা শুকিয়ে একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছিল। এতটাই মলিন দেখাচ্ছিল ওর মুখ মন্ডল যে ওকে চিনতে আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। ঘোর কাটে ওর কথায়। ‘২৪ঘন্টা’য় ১দিন, ০৭দিনে ১সপ্তাহ, ৩০দিনে ১মাস আর ১২মাসে একবছর জানো তো!’ নিচের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলাম, জ্বি! জানি। ও আবারো বলতে শুরু করল, তোমাকে অজস্রবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কি হয়েছে? তুমি বলো নি। আনতেও গিয়েছিলাম বহুবার। প্রতিবার প্রত্যাখাত হয়ে ফিরে এসেছি। শেষ বার তুমি আমার কাছে মুক্তি চেয়েছিলে। কিচ্ছু বলিনি আমি। নিরবে সবকিছু সয়ে গেছি। কিন্তু মা?! ওনি মেনে নিতে পারেননি। পারেননি চোখের সামনে একমাত্র সন্তানের ধুকে, ধুকে মরাটা সহ্য করতে। ওনার কাছে যেটা ভালো মনে হয়েছে সেটাই ওনি করছেন। ওনি আমার বিয়ের জন্য পাত্রী ঠিক করেছেন। বিয়ে করবো আমি। এখান এখানে প্রথমা স্ত্রী হিসেবে তোমার অনুমতি নেয়াটা বড্ড জরুরী। কি বলো তুমি?

০৫-১০-২০১৭
অসহনীয় যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখে হাসিমুখে সেদিন আমি ওকে ২য় বিবাহের জন্য অনুমতি দিই। তাছাড়া যে আমার আর কিছুই করার ছিল না! একদিকে ওর মায়ের থেকে নেয়া টাকা অন্যদিকে ওকে পিতৃত্বের সুখ দিতে না পারা। দুটোই আমাকে বড্ড পীড়া দিতো। যার দরুন নির্দ্বিধায় রাজী হয়ে যাই। অনুমতি দেই ওকে ২য় বিবাহের। আর ওর মায়ের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ হই বিয়ের ঠিক আগের দিন চলে যাবো এ ঘর, এ বাড়ি ছেড়ে। চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। আজ আর কিচ্ছু লিখতে পারছি না…

০৭.১০.২০১৭
শুভ্র,
চলে যাচ্ছি আমি। তোমার থেকে অনেক অনেক দুরে চলে যাচ্ছি আমি। জানি তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত ভালো থাকতে পারবো না। অনেক কষ্ট হবে আমার। অশ্রু ঝরিয়েছি, আরো ঝরাবো। তবু তোমার সুখের দিকে তাকিয়ে কোনো দিন ভালোবাসার দাবী নিয়ে তোমার সামনে দাঁড়াবো না। কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না তোমাকে। কারণ, নিজে কষ্ট করতে পারব কিন্তু যাকে ভালোবাসি তাকে কষ্ট দিতে পারবো না। আমি তোমাকে পাবার উপর্যুক্ত নই, এতটুকু সান্ত্বনা বুকে নিয়ে ভুলে থাকার চেষ্টা করবো তোমাকে।
জানি, পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষটিকে এত সহজে হারিয়ে ফেলার বেদনায় জমে থাকা নীল কষ্টের তুষারগুলো গলে গলে পড়বে অশ্রু হয়ে। তোমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া পেছনের স্মৃতিগুলোই আমাকে পীড়া দেবে বেশি। বার বার তা ভেসে উঠবে হৃদয়ের ক্যানভাসে।
আজ যাবার বেলায় একটা সত্যি কথা বলে যাই। অনেক ভালোবাসি তোমাকে। এ জীবনে হয়তো মনে হয় না তোমার মতো আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো। ভালো থেকো। অনেক, অনেক ভালো। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি,
লাবণ্য।

১৩.০২.২০১৮
তুমি আজ আমার কাছ থেকে অনেক অনেক দুরে। আমি একাকী দিন কাটাচ্ছি। যখন গভীর ঘুমে ডুবে যাই, তখন দেখি, তুমি আমার পাশে বসে আছো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছো। আমাকে আদর করে বুকে টেনে নিচ্ছো। আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। লাফ দিয়ে উঠে বিছানায় বসি। তোমাকে হাতড়ে বেড়াই চারিদিকে। কিন্তু কোথায় তুমি? চারিদিকে শুধুই অন্ধকার। তখনই বুঝতে পারি, এটা বাস্তব নয়, স্বপ্ন। শুধুই স্বপ্ন।

#গল্পের_শেষ_পাতায়
#অনামিকা_ইসলাম_অন্তরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here