‘কাতরতা’
‘ইসরাত জাহান দ্যুতি’
____________________
– ‘আবহাওয়াটা কিন্তু দারুণ স্যার! বসন্তকাল মানেই কেমন বাতাসে প্রেম প্রেম, রোমান্স রোমান্স গন্ধ| ইশ! এই সময়টাতেই বদ মাইয়াটা ব্রেক আপ করে দিলো| আর দুইটা মাস পরে করতে পারতি! সারা বছর কুত্তার মতো পিছে পিছে দৌঁড়ালি, আতু বললেই ফ্ল্যাটে চলে আসতি| আর শরীরে এই জ্বালা ধরানো ঋতুতেই তোকে মরতে হলো!’
শিহাবের যেন এখনি ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে মেরে আসতে মন চাচ্ছে| চোখ মুখে স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠেছে তার|
ছাদের অর্ধেক জায়গাটা ফটোশ্যুটের জন্য বড় বড় ফুল গাছের টব, দোলনা দিয়ে সাজানো| ছাদের আরেক প্রান্তে শিহাব স্বপ্নের পাশে বসে তার মাথার ওপর ছাতাটা ধরে আছে| কোনো গল্পসঙ্গী ছাড়াই নিজে নিজে কথা বলে যাচ্ছে সে| আর সেটা সে বুঝতে পারল যখন দেখল তার স্যার স্বপ্ন ফোনের স্ক্রিনে নামি দামী ফটোগ্রাফার রিয়াদের সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড ঝিলাম করিমের কয়েকটা ছবি সে বারবার জুম করে দেখছে| শিহাবের কোনো কথাই তার কান অবধি পৌঁছেছে কিনা সন্দেহ| শিহাব একবার ছাদের অপর প্রান্তে দোলনার দিকে তাকাল| যেখানে ফটোগ্রাফার রিয়াদের ক্যামেরাতে এখনকার বিখ্যাত মডেল সিমির ফটোশ্যুট চলছে| স্বপ্নের এই ব্যাপারটা হজম করতে শিহাবের বেশখানি কষ্ট হলো| তার স্যারের এত বড় স্টুডিওতে কত শত সুন্দরী মডেল প্রতিনিয়ত এসে কাজ করে| এই মুহূর্তে যার শ্যুট চলছে তার পিছেই রীতিমত কত স্টুডিওর মালিক, বড় বড় মডেল তারকা ঘুরঘুর করে| তার প্রতিও স্বপ্ন স্যারের সামান্যতম আগ্রহ পেল না সে|
অবশ্য কয়েকজনের সঙ্গে বেশ সখ্যতা আছে তার স্যারের| আর যাদের সাথে সখ্যতা তারা অধিকাংশই চোখে লাগা সুন্দরী| যারা একটাবার তার স্যারের চোখের ইশারা পেলেই দৌঁড়ে তার ফ্ল্যাটে চলে আসবে| অথচ তাদের প্রতিও তার স্যারের আগ্রহ কখনোই এত বেশি দেখেনি শিহাব যতটা ঝিলামের মাত্র কয়েকটি ছবির প্রতি তার আগ্রহ দেখল| আর এ ব্যাপার যদি একবার রিয়াদের চোখে ধরা পড়ে তো এ স্টুডিওতে বড়সড় একটি সিনেমার তুফানের পরিবর্তে বাস্তবিক তুফান হয়ে যাবে দুজনের মাঝে| শিহাব ছাতাটা নামিয়ে রেখে কণ্ঠ ছেড়ে ডেকে উঠল স্বপ্নকে|
– ‘স্যার সিমি ম্যাম আপনার কাছেই আসছে|’
স্বপ্ন ফোনের স্ক্রিন থেকে নজর তুলে দেখল সিমি সামনের চেয়ারটা টেনে তার পাশেই বসার পরিকল্পনা করছে| ফোনটা সামনের টি টেবিলের ওপর রেখে কণ্ঠে ছেড়ে একজন কর্মচারীকে ডাকল| তাকে বলল – ‘কফির ব্যবস্থা করো|’
ক্যামেরার ছবিগুলো দেখতে দেখতে রিয়াদ স্বপ্নের পাশে এসে বসল| তাকে বলল – ‘স্বপ্ন আপনি একবার ছবিগুলো দেখলেনও না|’
স্বপ্ন নির্বকার ভঙ্গীতে বলল – ‘তুমি দেখলেই হবে|’
– ‘রিয়াদ ভাই যতই দেখুক| আপনার কি একবার দেখা উচিত নয়?’
সিমি বেশ অভিমানের সুরেই যেন বলল স্বপ্নকে| স্বপ্ন তখন সিমির নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎ মৃদু হেসে উঠল| রিয়াদের হাত থেকে এরপর ক্যামেরাটা নিয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকল| স্বপ্ন বেশ বুঝতে পারে তার প্রতি এই মেয়েগুলোর প্রবল আকর্ষণ| আর নিঃসন্দেহে সে এই ব্যাপারগুলো বড্ড উপভোগ করে| তার জন্য যে যত বেশি কাতর তার প্রতি সে ঠিক তত বেশিই কঠোর| কারণ সে সব সময়ই মেয়ে জাতিকে তার জন্য কাতর হতে দেখতে ভেতরে ভেতরে অসম্ভব সুখ অনুভব করে| সে চায় এই মেয়েগুলো তার জন্য সব সময়ই এমন কাতর হোক| এমনও সময় সে তৈরি করেছে যখন এই মেয়েগুলো স্বামী সন্তান ফেলেই ছুটে এসেছে তার কাছে| আর সে সারাটা রাত তাদেরকে মেইড হিসেবে ট্রিট করে গেছে| একটা সময় ছিল যখন সে চোখের সামনে দেখত তার একটিমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন তার বড় বোনটা প্রতিটা রাত ছটফট করত, কাতর থাকত তার স্বামী মানুষটার ফিরে আসার অপেক্ষায়| আর যখন সেই মানুষটা বাড়ি ফিরত তখন স্বপ্ন দেখত তার বড় বোনের শোয়ার ঘরটা থেকে শুধু আর্তনাদের আওয়াজ| যে আওয়াজ তার বোনটার| স্বপ্ন কারণ খুঁজে পেত না ওই মানুষটা তার পুতুলের মতো বোনটার প্রতি কীভাবে এত নির্দয় হতে পারত? আর কেনই বা হতো! এরপর একদিন সে কারণও অবশ্য সে নিজ চোখেই দেখতে পায়| তার বোনের শোয়ার ঘরটাতে তার বোনের পরিবর্তে ওই মানুষটার সঙ্গে প্রতি রাতে এক একটি নতুন মুখের স্থান| সেই মানুষটাও ছিল এমন একটি স্টুডিওর-ই মালিক| আর সেই মেয়েগুলোও ছিল আজকের এই সিমির মতোই এক একজন|
.
.
আজ মহাবিরক্ত ঝিলাম| যেদিনই সে রিয়াদের সঙ্গে দেখা করার সময় বের করে আর ঠিক সেই সেই দিনই রিয়াদের পাশে তার কাছে এই পৃথিবীর সব থেকে ঘৃণ্যতম মানুষটা বসে থাকে| ঠিক আজও রিয়াদের পাশে বসে আছে ঝিলামের চোখে সেই জঘন্য মানুষ স্বপ্ন|
ঝিলাম একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করে| পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটি একমাত্র সে-ই| দুটো বোন তার এখনো ঘাড়ে| যার জন্য প্রতিটা দিনের প্রতিটা মুহূর্ত সে পরীশ্রমের ওপর থাকে| অফিসে ওভার ডিউটি করে সে যেচে পড়েই| বলা চলে তার অবস্থানটা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই| কিন্তু তার রুচি, পোশাক, কথাবার্তা, চলাফেরাতে তা কেউ খুব সহজেই ধরে উঠতে পারে না| সে মানুষটা সৌখিন না হলেও যথেষ্ট পরিপাটিভাবেই থাকতে চেষ্টা করে সে| প্রচন্ড খারাপ অবস্থাতেও সে অগোছাল থাকতে পারে না| অভ্যাসই বলা চলে তার এটাকে|
বড় একটি রেস্টুরেন্টের মাঝে একটা সাইডে তারা তিনজন এক টেবিলে| সপ্তাহে একটা দিন ঝিলাম রিয়াদের সঙ্গে দেখা করতে আসে তাও আবার রিয়াদের লাঞ্চ টাইমে| কারণ এ সময়টুকু আর বিশেষ কয়েকটাদিন রাতের সময়টুকু ছাড়া রিয়াদের দেখা করার কোনো সময় নেই| কিন্তু ঝিলাম কোনোভাবেই রাতেরবেলা রিয়াদের সঙ্গে দেখা করতে রাজি নয়| যার জন্য সে স্বপ্নের মতো জঘন্য মানুষটাকে সহ্য করেই রিয়াদের সঙ্গে তার লাঞ্চ টাইমেই দেখা করতে আসে|
ঝিলাম কটমট চোখে স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠল রিয়াদের ওপর| রিয়াদকে বলল – ‘তোমার খাওয়া কি এখনো শেষ হয়নি?’
রিয়াদ তখন আজকে তার শ্যুটের মাঝে একটা ঘটনা নিয়েই কথা বলছিল ঝিলামের সাথে| ঝিলামের হঠাৎ রাগান্বিত কণ্ঠে রিয়াদ আঁতকে উঠে| ঝিলামের মুখোমুখি স্বপ্ন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দু’হাতে ফোনটা নিয়ে তার নজর বিদ্ধ করে রেখেছে ঝিলামকে| এই লোকটাকে নিয়ে ঝিলাম অনেক নোংরা কথা শুনেছে| বিভিন্ন পত্রিকাতে পড়েওছে| আর সে যখনই এই লোকটার মুখোমুখি হয় তখনই সে খেয়াল করেছে তার দিকে কেমন বেহায়া চাউনিতে আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে| যা দেখলে ঝিলামের সারা শরীর জ্বলে উঠে| লোকটাকে সে একদমই সহ্য করতে পারে না শুধু তার এই বেহায়া চাউনির জন্যই| এ কারণেই ঝিলাম এই মুহূর্তে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ রিয়াদের প্রতি| ঝিলাম বলল রিয়াদকে – ‘তখন থেকে খেয়েই চলেছ| এত খাওয়া শিখেছ কবে থেকে?’
– ‘কোথায় এত খেলাম? মাত্র হাফ প্লেট রাইস খেলাম!’
– ‘ঠিক আছে তুমি আরও হাফ খাও| আমি উঠছি|’
এই বলে ঝিলাম উঠতে গেলে রিয়াদ বাঁ হাতে ঝিলামের ওড়না টেনে ধরে উদগ্রীব হয়ে বলল – ‘প্লিজ প্লিজ আর পাঁচটা মিনিট বসো সোনা| আমার খাওয়া শেষ| শুধু ওয়াশরুমে যাব আর আসব|’
ঝিলাম বসলে রিয়াদ হাতটা মুছে দ্রুত ওয়াশরুমে ছুটল|
প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে ঝিলাম বসে আছে| মাঝেমাঝে তার ইচ্ছা হয় এই মুহূর্তে তার দিকে বেহায়া চাউনিতে বসে থাকা লোকটার গালে বেশ কয়েকটা অনবরত থাপ্পড় লাগাতে| কিন্তু তার সমস্যা একটাই, সে কখনোই কারো প্রতি সামান্য কঠোর কথাও বলতে পারে না| বিরক্ত হয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে অনিচ্ছা নিয়েই ফোন চাপছে সে| হঠাৎ সামনের পুরুষটির গম্ভীর কণ্ঠ থেকে প্রশ্ন এলো – ‘তোমদের রিলেশনটা যেন কত দিনের?’
ঝিলাম অনাগ্রহের সঙ্গে একটু সময় নিয়ে জবাব দিলো – ‘সাত মাস|’
– ‘কীভাবে হলো তোমাদের সম্পর্কটা? মানে প্রপোজটা করেছিল কে?’
ভদ্রতা বজায় রাখতেই ঝিলাম স্বাভাবিকভাবে কথা বলে যাচ্ছে| ছোটখাটো উত্তর দিলো – ‘রিয়াদ করেছিল|’
– ‘আর তুমি সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তাবটা লুফে নিলে তাই তো?’
এবার ঝিলাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল স্বপ্নের দিকে| স্বপ্ন তখন বলল – ‘মানে এটা জানতে চাচ্ছি হুট করে একটা ছেলে প্রস্তাব দিলে কোনো মেয়ে খুব সহজেই গ্রহণ করে নেয় কীভাবে এখন? আগে তো দেখতাম বছরের পর বছর একটা ছেলে একটা মেয়ের পিছে ঘুরে তারপর তার মন পেয়েছে| এই ঘোরাঘুরির পর একটা মেয়ে বিশ্বাস করেছে ছেলেটা তাকে হয়তো সত্যিই ভালোবাসে| আর এখনকার ব্যাপারগুলো এমন ছেলের পজিশন, ক্যারিয়ারই এনাফ| রাইট?’
ঝিলাম গমগমে চেহারা নিয়ে বলল – ‘আপনার ধারণা যদি এটা হয় আমি রিয়াদের পজিশন দেখে ওর প্রপোজাল অ্যাক্সেপ্ট করেছি তাতে আমার একটুও এসে যায় না|’
– ‘আমি তা কখন বললাম? আচ্ছা ছাড়ো এ কথা| আমি তো আর প্রেম করিনি কখনো তাই এ বিষয়ে হয়তো অভিজ্ঞতা কম আমার| তুমিই বলো, প্রপোজাল অ্যাক্সেপ্ট করার বিশেষ কী কারণ ছিল? রিয়াদের চেহারা না রিয়াদের যোগ্যতা? মানে একটা ছেলের প্রপোজাল অ্যাক্সেপ্ট করার জন্য এ দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?’
সটান জবাব দিলো ঝিলাম – ‘একটাও না|’
– ‘একটাও না?’
বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল স্বপ্ন| ঝিলাম এবার নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল – ‘আপনাদের এই উঁচু জায়গার মানুষগুলোর চিন্তাধারাগুলো এমন হয়ে গেছে যেখানে কারো সঙ্গে সুখে থাকার অর্থ নিশ্চয়ই যে কোনো এক পক্ষের বিত্তবান অবস্থা! বিত্তবান বলেই কেউ কারো সঙ্গে সংসার বাঁধতে রাজি হয়| আর আপনারা এটাই বিবেচনা করে জীবনে সঙ্গী নির্বাচন করেন জানি| আমাদের শ্রেণীতে আমাদের মতো কাঙালরা মানে আপনাদের চোখে তে আমরা কাঙালই| আমরা শুধু দেখি যার সঙ্গে সারাটা পথ চলব তার কাছে ভালোবাসা আর যার সঙ্গে সারাটা পথ চলবে তাকে আজীবন ভালো রাখার জন্য আত্মবিশ্বাসটা তার আছে কিনা| যদি এই আত্মবিশ্বাস তার মাঝে থাকে তবে সে রাস্তার ফকির হলেও এক সময় ওই মানুষটাকে ভালো রাখার জন্য যোগ্যতা অর্জন করে ফেলবে| ভালোবাসা আর এই আত্মবিশ্বাস থাকলেই আমরা সুখী|’
স্বপ্ন কথাগুলো শুনে হঠাৎ হা হা শব্দে হেসে উঠল| ঝিলামের সহ্যের মাত্রা এবার ধীরে ধীরে অতিক্রম করছে| স্বপ্ন কতক্ষণ পর নিজেকে সামলে ঝিলামকে আবার প্রশ্ন করল – ‘তো তুমি কী করে বুঝলে রিয়াদের মাঝে এই দুটো জিনিসই আছে? মানে কী দেখে বোঝা যায়?’
ঝিলাম কতক্ষণ চুপচাপ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে স্বপ্নকে বলল – ‘কারো বেহায়া দৃষ্টি দেখলে যেমন বোঝা যায় সে কতটা নোংরা ঠিক তেমন কারো কারো স্বাভাবিক দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় সে মানুষটা কতটা স্বচ্ছ|’
এরই মাঝে রিয়াদ ফিরে এসে ঝিলামের শেষ কথাগুলো শুনতে পেল| রিয়াদ ঝিলামের পাশে বসতেই ঝিলাম রাগান্বিত সুরেই বলল – ‘আমরা কি এখানেই বসে থাকব?’
তখন স্বপ্ন চেয়ার থেকে স্যুটটা হাতে নিয়ে বলল – ‘আমি স্টুডিও ব্যাক করি রিয়াদ| জাফর সাহেব বসে আছে অনেকক্ষণ ওনার নতুন স্ক্রিপ্ট নিয়ে|’
– ‘আপনি তো কিছুই খেলেন না| কিছু খাওয়া-দাওয়া তো করুন|’
স্বপ্ন দাঁড়িয়ে স্যুটটা গায়ে ঢুকিয়ে নিতে নিতে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে কেমন অদ্ভুতভাবে হেসে বলল – ‘আমি কখনো না খেয়ে থাকি না রিয়াদ|’
.
স্বপ্ন যেতেই রিয়াদ ঝিলামকে বলল – ‘তুমি ওনার সাথে সব সময় এমন রুড হও কেন ঝিলাম? মানুষটা সিরিয়াসলি অনেক ভালো আর দেখতেও কত সুন্দর! অথচ তুমি সব সময় তাকে নিয়ে কত ব্যাড কমেন্টস করো|’
– ‘সে কত ভালো তা তো পত্রিকার বিনোদনের পাতা খুললেই দেখা যায়| আর মানুষ সুন্দর হলেই তার ভেতরের মানুষটাও যে সুন্দর হয় তা তুমি বিশ্বাস করো?’
– ‘শোনো, পত্রিকায় যে সব খবর আসে তা যে শত ভাগ সত্য হয় তা তুমি বিশ্বাস করো? ওনার ব্যক্তিগত জীবনের গল্প শুনলে তুমি নিজেই তখন ভাববে একটা মানুষ এখনো কীভাবে এত নর্মাল আছে আর নিজ যোগ্যতায় এত অল্প বয়সে এত দূর এগিয়ে এসেছে|’
– ‘বিশ্বাস করো রিয়াদ ওনাকে জানার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই| আমার তোমাকে জানা প্রয়োজন|’
– ‘আমাকে কি এখনো জানার বাকি আছে তোমার?’
– ‘তুমি কি সারাজীবন এই বাজে কাজগুলোই করে যাবে?’
– ‘বাজে কাজ করছি কোথায়?’
– ‘বাজে কাজই তো করছ| সেদিনও একটা ম্যাগাজিনের পাতায় দেখলাম একটা মেয়ের কী সব বাজে পোশাকে ছবি| আর সেই ছবির ফটোগ্রাফার কে? তুমি! তুমি সারাদিন এই সব মেয়ের এমন খোলামেলা ছবি তুলো এগুলো আমার একদম সহ্য হয় না| বর্তমান আমাদের চলচ্চিত্রের জগতটা দিন দিন অশ্লীল পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে| মনে হয় যেন বলিউড, হলিউডের তারকাদের মেলা আমাদের দেশের| তোমাদের ডিরেক্টর, প্রডিউসরগুলো ভুলে যাচ্ছে এটা বাংলাদেশ|’
– ‘ঝিলাম থামো তো! তুমি যে এখনো এতটা পিছিয়ো আছ তা আমি ভেবেই অবাক| কোথায় অশ্লীল! যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে এটুকু তো করতেই হবে| এটা কখনোই অশ্লীলের মাঝে পড়ে না| বরং তুমিই ব্যাগডেটেড হয়ে আছ| এমন তো আমারও শখ হয় যে আমার প্রিয় মানুষটাকে একটু নতুনরূপে দেখি|’
– ‘তুমি সত্যিই দেখতে চাও আমাকে ওইভাবে?’
– ‘অস্বাভাবিক কি? কতটুকু সময় পাই আমি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলার, একটু একাকী সময় পার করার? যতটুকুও পাই তাও সব সময় মনে হয় আমি যেন পরের বউয়ের সঙ্গে কথা বলছি| তাই সব সময় সতর্ক হয়ে কথা বলতে হয়, হাত ধরতে হয়, জড়িয়ে ধরতে হয়|’
রিয়াদের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল| বোঝা যাচ্ছে সে ভেতরে ভেতরে বড্ড অভিমান জমিয়ে রেখেছে ঝিলামের প্রতি| ঝিলাম তা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে ফেলল| তাকে বলল – ‘তো আমার ফটোগ্রাফার হিরোর এত আবদার? আমি তো এ আবদার পূরণ করতেই পারি| কিন্তু ওয়েস্টার্ন পোশাকে আমি জীবনেও রাস্তায় বের হতে পারব না|’
– ‘রাস্তায় বের হতে হবে কেন? আমার গাড়ি নেই? বাড়ি নেই আমার? গাড়ি করে সোজা আমার বাড়ি এসে নামবে| বাড়ি বসেই দেখব তোমাকে|’
– ‘হুঁ, তাতে তো আমার সমস্যা নেই| কিন্তু তার জন্য তো লিগ্যাল হতে হবে আমাদের সম্পর্কটা| আমি তো বলছিই চলো এ বছরের শেষের দিকে আমরা বিয়ে করে ফেলি| তুমিই তো শুনছ না|’
– ‘উফ্ ঝিলাম তুমি এমন কেন? এটা কেমন কথা বলো তো? তোমাকে একটু গভীরভাবে ছুঁতে গেলেই বিয়ে করতে হবে| একটু ভিন্ন সাজে দেখতে হলেই বিয়ে করতে হবে| বাসায় আসতে বললেই বিয়ে করতে হবে| মানে তোমার মতো এত স্মার্ট একটা মেয়ের সঙ্গে এই ধরনের চিন্তাগুলো যায় না| বিয়ে তো আজ না হলেও কাল করবই| তাই বলে বিয়ের আগে এটা করা বারণ, ওটা করা পাপ| এই সব আজাইরা লজিকগুলো আমার সামনে আর কখনোই দেখাবে না| পাপই যদি হবে তাহলে তোমার আল্লাহ পাক বিয়ের আগে এসব রোমান্স, এসব ফিলিংস কেন দিলেন মানুষের মধ্যে? বিয়ের পরেই এগুলো মানুষ অনুভব করত! তাহলে এত সমস্যাই ছিল না|’
রিয়াদের শেষ কথাগুলো শুনে ঝিলাম কয়েক মিনিট ধরে শুধু হাসতেই থাকল|
.
রাত বারোটার পর থেকে দেড় ঘন্টা যাবৎ ঝিলাম ফোন করে যাচ্ছে রিয়াদকে| বেশিরভাগ রাতগুলোই ঝিলাম রিয়াদের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ পায় না| এ নিয়ে ঝিলাম রাগ করলেই রিয়াদ বলে স্বপ্নের কিছু কিছু মডেলের ফটোশ্যুট অনেক রাত ধরে করতে হয়| আর এমন মডেল প্রায় রাতেই থাকে স্টুডিওতে| এসব কারণেও ঝিলাম স্বপ্নকে সহ্য করতে পারে না| এই মানুষটার শুধু নাম আর চেহারাটাই সুন্দর| তাছাড়া পুরো মানুষটাই একটা অমানুষ| ঝিলাম শুনেছে এই লোকটার কারণে কয়েকজন পুরোনো জনপ্রিয় মডেল তারকাদের সংসার ভেঙেছে| অথচ দিন শেষে সে ঠিকই ব্যাচেলর মানুষ| কতবার গুঞ্জন শোনা গেছে অমুক মু্ভি খ্যাত নায়িকা, তমুক মডেলের সঙ্গে বিয়ে, দীর্ঘদিন সম্পর্ক| কিন্তু পরবর্তীতে সে সবই গুজব গল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছে| ঝিলামের মনে পড়ল একদিন সন্ধ্যার পরের ঘটনা| সেদিন রিয়াদের জন্মদিন ছিল বলে রিয়াদকে সারপ্রাইজ দিতে অফিস শেষ করে স্বপ্নের স্টুডিওতে চলে এসেছিল রিয়াদকে না জানিয়েই| আসার প্রায় আধা ঘন্টা পর রিয়াদের দেখা পায় সে| তখন রাত প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই| স্টুডিওতে থাকা সবার সঙ্গে রিয়াদের জন্মদিনটা সেলিব্রেট করার ইচ্ছা ছিল ওর| যার জন্য স্টুডিওর একটা রুমে স্পেস করে দিতে বলে সে| রিয়াদকে সেদিন প্রচন্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছিল| আর স্টুডিওতেও দু’একজন ছাড়া আর কেউ ছিলও না| যার জন্য ঝিলাম নিজেই রুম পরিষ্কার করার জন্য দোতলার একটি খোলা রুম বেছে নেয়| কিন্তু সেদিন যা দেখেছিল ওই রুমে তা দেখার পর থেকে স্বপ্নকে সে পৃথিবীর সব থেকে জঘন্য মানুষ ভাবে| আর সেদিন থেকেই সে রিয়াদকে ফোর্স করতে থাকে স্বপ্নের সঙ্গে কাজ না করার জন্য| কিন্তু রিয়াদের একটাই কথা| তার মতো এত দক্ষ আর এত দামী ফটোগ্রাফারকে স্বপ্ন ছাড়তে চায় না বলে প্রতি ঘন্টায় তাকে দশ হাজার অ্যামাউন্টও দিয়ে থাকে| আর তাই সে এত ভালো সুবিধা ছাড়তে চায় না|
রিয়াদের ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে যাচ্ছে স্বপ্নের সামনে| স্বপ্নের ইচ্ছা করছিল খুব ফোনটা রিসিভ করে ঝিলামের ঝাঁঝাল সুরের সেই মিষ্টি কণ্ঠটা শুনতে| কিন্তু যতবার কল আসছিল আর ততবারই ঝিলামের হলুদ ফর্সার হাসি মুখটা ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল| স্বপ্ন সেই মুখটা বারবার দেখার জন্যই কলটা না তুলে ফোন হাতে নিয়ে বসে রইল|
.
.
বেশ কিছুদিন যাবৎ-ই রিয়াদ ঝিলামের কল মেসেজ এড়িয়ে যাচ্ছে| যদিওবা দু এক মিনিটের জন্য কথা বলে| তাও কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে সেই যে ফোনটা রাখে রিয়াদ আর সারাটা দিন, সারাটা রাতেও রিসিভ করে না| প্রচন্ড পাগল পাগল লাগছে ঝিলামের| রিয়াদের সঙ্গে প্রায় চারদিন ধরে কোনো কথাই হয়নি| ফোন বাজে কিন্তু রিসিভ হয় না| হঠাৎ আজ ঝিলাম বাধ্য হয়েই স্বপ্নের নাম্বারটা ডায়াল করল| কিন্তু কল হওয়ার আগেই আবার কেটে দিলো সে| মানুষটার দিকে তাকাতেই তার অস্বস্তি লাগে| তাহলে কথাই বা বলবে কী করে? অনেকক্ষণ পর জড়তা কাটিয়ে উঠিয়ে ঝিলাম কল করল স্বপ্নকে| তখন রাত বাজে এগারোটার বেশি| স্বপ্নের পরিবর্তে স্বপ্নের অ্যাসিসটেন্ট শিহাব কলটা তুলল| শিহাবের কণ্ঠ পেয়ে ঝিলাম তাকে চিনতে পারল| বেশ কয়েকবার ঝিলাম তার সঙ্গে কথা বলেছে এর আগে| ঝিলাম যেন স্বস্তি পেল শিহাবের কণ্ঠ পেয়ে| ঝিলাম খুব বিষণ্ন তা শিহাব ঝিলামের কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারল| শিহাব জিজ্ঞেস করল – ‘আপনি ঠিক আছেন তো আপু?’
– ‘শিহাব ভাই, আমাকে কি রিয়াদের কোনো খোঁজ দিতে পারবেন? আসলে ওকে ফোনে পাচ্ছি না অনেকক্ষণ ধরেই|’
শিহাব ওপরের রুমটার দিকে একবার তাকাল| তার পাশেই ড্রাংক হয়ে পড়ে আছে স্বপ্ন| তার দিকেও একবার তাকাল সে| শিহাব ঝিলামের ফোনটা তোলার সময় দেখেছিল তার স্যারের ফোনের গ্যালারিটা ওপেন| আর সেই গ্যালারিতে ঝিলামের কতগুলো ছবির মাঝে ঝিলামের রাগ চোখে তাকিয়ে থাকা ছবিটা স্ক্রিন জুড়ে আছে| বোঝা যাচ্ছে ছবিটা তার স্যার বোধহয় কোনো এক সময় চুরি করেই তুলেছিল| আর সেই ছবিটাই দেখতে দেখতে সে ঘুমিয়ে পড়েছে| এই মানুষটা ওপরে ওপরে সকলের সামনে নিজেকে ডার্টি করে রাখলেও তার ভেতরটা কতখানি নির্মল আর খাঁটি তা শুধু কেবল শিহাবই জানে| শিহাব স্বপ্নের মুখটার দিকে চেয়ে থেকে বলল – ‘যদি পারেন তো এখনি সিএনজি চেপে স্টুডিও চলে আসুন|’
এটুকু বলেই শিহাব ফোন কেটে দিলো| ফোনটা কাটতেই স্বপ্ন চোখদুটো মেলে তাকাল শিহাবের দিকে| শিহাব প্রচন্ড ভয় পেলেও কেমন কঠিন গলাতে তাকে বলল – ‘এটা প্রয়োজন ছিল স্যার| আপনি প্লিজ আজ আর সেফ করবেন না ওনাকে| আপনার দোহাই লাগে|’
.
স্টুডিও পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল ঝিলামের| স্বপ্নের শরীরে তখন সাদা একটা শার্ট আর কালো প্যান্ট| শার্টের বুকটা ড্রিংকসের সময়ই ভিজিয়ে ফেলেছিল| জায়গাটুকু ঠিক সেভাবেই ভিজে আছে| হাতে তার জ্বলন্ত সিগারেট| ধোঁয়াগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে ঠোঁটদুটো ফুলিয়ে| আর ধোঁয়ার আকার হচ্ছে দখন গোলাকার| ঝিলাম নিচে বসার ঘরে পা রাখতেই স্বপ্নকে এমনভাবে দেখতে পেল| স্বপ্নের চোখদুটো অসম্ভব লাল| ঝিলামের তখন স্বপ্নকে এ অবস্থাতে বিচার করার অবস্থা নেই| শিহাবের খোঁজ করল সে এসেই| স্বপ্ন কোনো কথা বলল না| শিহাব ওপর থেকে নিচে নেমে এসে ঝিলামকে বলল – ‘তিন মাস আগে যে রুমটাতে স্বপ্ন স্যারকে দেখেছিলেন ওই রুমটার দরজাটা খুলবেন শুধু| ভেতরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই|’
ঝিলামের সব কিছু যেন কেমন অস্বাভাবিক লাগছে| মনে হচ্ছে সবটা আজ হঠাৎ এলোমেলো হয়ে যাবে| বুকের ভেতরটাতে গুড়ুমগুড়ুম আওয়াজ হচ্ছে| দ্রুত পায়ে উঠে সে ওই রুমটার সামনে গেল| রুমটা বাহির থেকে লক করা| হয়তো শিহাবই লক করে রেখেছে| দরজার লক খুলতেই দেখতে পেল অনাবৃত অবস্থাতে রিয়াদ আর একদমই অল্প বয়সী একটি মেয়ে এক সঙ্গে ঘুমিয়ে আছে| খুব সম্ভবত বিশ বছর হবে তার| ঝিলাম কী করবে বুঝতে পারল না| তার কি চলে যাওয়া উচিত না কি রিয়াদকে উঠিয়ে তাকে ইচ্ছামতো চওড়ানো উচিত সে সত্যিই বুঝতে পারল না| পুরো শরীর তার থড়থড় করে কাঁপছে| অবচেতনভাবে রুমের ভেতর পা বাড়াল সে| তখন শিহাব এসে বলল – ‘ভেতরে যাওয়ার দরকার কী? বাইরে থেকেই দেখুন| রিয়াদ স্যারের মতো এত স্কিলফুল ফটোগ্রাফার নেই আমাদের দেশে| স্যারের সঙ্গে কাজ করার জন্য তার দুটো শর্ত মানতে হয় স্যারের| রাতে যে মডেলগুলোর ফটোগ্রাফি করতে হয় ওনাকে সেই মডেলগুলোকে খোলামেলাভাবে উনি প্রায় প্রতিরাতেই ঘরে চান| কেউ বা রাজি হয় আর কেউ বা হয় না| তবে রাজি হওয়ার সংখ্যাটাই বেশি| যেদিন আপনি ওনার জন্মদিন সেলিব্রেট করতে এলেন সেদিনও উনি ঠিক এই অবস্থাতেই ছিলেন| উনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেও ওইদিনের মেয়েটাকে সামলাতে স্যার ঘরে ঢুকে মেয়েটাকে নিষেধ করতে থাকলেন সে যেন কোনোভাবেই আপনার সামনে না আসে আর কিছু যেন না বলে| আপনি বোধহয় সেদিন ওই বিবস্ত্র মেয়েটার সঙ্গে স্যারকে দেখে ভেবে নিলেন কতটা নোংরা আমার স্যার|’
কথাগুলো শেষ হতেই দরজার পাশে থাকা হাতের কাছে বড় ফুলের দানিটা পেয়ে আছাড়া মেরে বসল ঝিলাম| এরপর কান্না কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সে| ততক্ষণে রিয়াদের ঘুম ভেঙে গেছে|
.
.
স্বপ্ন যখন ঘরটাতে ঢুকল তখন সারা ঘর এলোমেলো| ঘরের জিনিস ভেঙেচুরে একাকার| স্বপ্ন নিচে বসেই ওপরের পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছিল| ঝিলাম বিছানার পাশে ফ্লোরে বসে আছে নির্জীব মানুষের মতো| কপালের এক পাশটা কাটা তার, পাঞ্চ করে বেঁধে রাখা চুলের এক পাশ খুলে ঝুলে আছে কাঁধের ওপর, গায়ের ওড়নাটাও পাশে পড়ে আছে| বাঁ হাতের কব্জিটাতে মনে হচ্ছে ভাঙা কাচ ঢুকে আছে| রিয়াদ যখন বেরিয়ে গেল তখন স্বপ্ন ঘরে এলো| রিয়াদের চেহারাও ছিল এলোমেলো| শার্টটা ছেঁড়া ছিল, ডান গালে থাপ্পড়ের লাল দাগ, মাথার চুলও এলোমেলো ছিল| বোঝা গেল দুজনের মাঝে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়েছে| স্বপ্ন দরজার মুখে দাঁড়িয়ে শিহাবকে ডেকে বলল – ‘শিহাব রে! পাশের রুমটা পরিপাটি কর তো| আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে|’
ঝিলাম নজর তুলে তাকাল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অতি লম্বা মানুষটার দিকে| আজ মানুষটার দিকে তাকাতে অস্বস্তি না প্রচন্ড লজ্জা লাগছে তার| ইচ্ছে করছে তার এক ছুটে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে| কিন্তু শরীরে যে এক ফোঁটা শক্তি পাচ্ছে না সে| শরীরটা আরও বেশি থড়থড় করে কাঁপছে| আজ সে এখান থেকে বাড়িতে যাবে কী করে?
স্বপ্ন হেঁটে এসে হঠাৎ ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল ঝিলামের পাশে| কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে তার নেশা ভরা গম্ভীর কণ্ঠে বলল – ‘মনেমনে আমার যে প্রশংসা করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু করতে পারছ না| সে প্রশংসা আমার না করে শিহাবকে গিফ্ট করো| আমার অত ঠেকা নেই বোঝানোর কার বেহায়া চাউনিতে নোংরামি আছে আর কার স্বাভাবিক চাউনিতে ভালোবাসা আছে!’
কথাটুকু শুনেই ঝিলাম অবিলম্বে চোখের পানি ছেড়ে দিলো| স্বপ্ন কতক্ষণ পর বলল – ‘আমার আপুটা ছিল সেদিন সাত মাসের প্রেগনেন্ট| আপুর বরটা সেদিন রাতে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে আপুকে মারতে আরম্ভ করে| আমি আপুর কান্নার আওয়াজ পেয়ে আমার ঘর থেকে ছুটে আসি জানালার কাছে| আপুকে নেশা অবস্থায় গালি দিচ্ছিল আর খুব মারছিল| বারবার বলছিল আপুকে ‘তুই কেন ওকে ফোন করেছিলি? কোন সাহসে করেছিলি?’ এরপরই হঠাৎ আপুর সারা গায়ে মদ ঢেলে দিলো| চোখের সামনেই আগুন ধরিয়ে দিলো আমার আপুর শরীরে| আপু শুধু বারবার পেটটা আঁকড়ে ধরছিল| আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলাম| লবণ লাগা জোঁকের মতো কাতরাচ্ছিলাম| আমার আপুটা নিচে পড়ে কাতরাচ্ছিল আর আমি কিছুই করতে পারিনি| চিৎকার করতে করতে কখন যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি| যখন চোখ খুলি তখন দেখি আমার মাথাটা একজন প্রতিবেশীর কোলে| আর বসার ঘরে নিচে আমার আপুর লাশটা সাদা কাপড়ে ঢাকা| আমি বোবা হয়ে গিয়েছিলাম| মানুষ আমাকে কত কিছু জিজ্ঞেস করছিল| কিন্তু আমি কথা বলতে পারছিলাম না| ওই রাতেউ পুলিশ এসে নিয়ে যায় লোকটাকে| আমার স্বাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে লোকটার ফাঁসি হবে| আমার সঙ্গে একদিন লোকটার উকিল দেখা করতে আসে| আমাকে কত রকম কথা বলে| ভালো বাসায় আমাকে থাকতে দেবে, ভালো স্কুল কলেজে পড়াবে, ভালো খেতে দেবে আমায়| আমি শুধু সেদিন চিৎকার করে বলেছিলাম আমার আপুকে এনে দিন| আর কিছু চাই না আমি| আমার কান্না বোধহয় সেদিন উকিলের মনে লেগেছিল| আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল আমাকে টিকে থাকতে হবে এই দুনিয়াতে| বড় হতে হবে আমাকে| আমাকে যা যা বোঝাল আমি তা-ই তা-ই কোর্টে গিয়ে বললাম| আমার পক্ষের উকিলের কথাও আমি শুনলাম না| আমার মিথ্যা স্বাক্ষীতে লোকটার ফাঁসি হলো না|’
ঝিলাম এবার ছলছল চোখদুটোতে বিস্ময় নিয়ে তাকাল স্বপ্নের দিকে| স্বপ্ন ঝিলামের দিকে চেয়ে হেসে উঠল| বলল – ‘এখন নিশ্চয়ই ভাবছ আমি কত খারাপ ভাই! ভাবাটাই স্বাভাবিক| আপুকে আমি বলতাম লোকটাকে ছেড়ে দিতে| আর আমার আপু বলত তাকে ছেড়ে দিলে আমাকে নিয়ে যাবে কই? আমাদের তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই| আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি| আমি তাও বলেছিলাম পড়াশোনা ছেড়ে আমি যে কোনো কাজ করব| আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ‘তোর জন্য হলেও আমি এখানেই থাকব| তোকে অনেক বড় কিছু হতে হবে রে| সেদিনই আমি এই বাড়ি ছাড়ব|’ আমার চিন্তা করতে গিয়ে আমার আপু জানটা দিলো| এই যে আজ এত কিছু আমার| মানুষ জানে সব কিছুই আমার পরীশ্রমের ফল| কিন্ত কেউ জানে না এই সবটাই ওই লোকটার থেকে কেড়ে নেওয়া| বলতে গেলে কেড়ে নিয়ে দিয়েছিল সেদিনের ওই উকিল| আমি যদি মিথ্যা স্বাক্ষী দিই তবে আমাকে ওই লোকের সকল প্রপার্টি দিতে হবে| আর এই প্রপার্টি আমার প্রয়োজন ছিল এইযে আজকে এত ভালো থাকার জন্য| আমাকে উকিলটি বুঝিয়েছিলেন মিথ্যাটুকু না বললে আমাকে রাস্তায় জীবন পার করতে হবে| আমার যে আপু জান দিলো আমার ভবিষ্যত চিন্তা করতে গিয়ে| সেই আমি রাস্তায় জীবন কাটালে যে আমার আপু শান্তি পাবে না| এটাই তখন আমি ভেবেছি|’
এটুকু বলে স্বপ্ন থেমে গেল| অনেকক্ষণ চুপ থাকল সে| চোখদুটো তারও ভিজে এসেছে| ঝিলাম কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল – ‘এরপর?’
স্বপ্ন তার দিকে ফিরে তাকিয়ে একটু সময় চেয়ে থেকে হেসে বলল – ‘এরপরের গল্পটুকু শুনলে তুমি তো আমাকে এবার ঘৃণার বদলে ভয় পেয়ে পালাবে|’
ঝিলাম শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল – ‘পালাব না|’
– ‘শিওর?’
ঝিলাম মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল| স্বপ্ন তারপর বলতে শুরু করল – ‘লোকটা যেদিন ছাড়া পেল সেদিন আমার সঙ্গেই তারা বাসায় এলো| দু’দিন একদম চুপচাপ ছিলাম আমি| চুপচাপ ছিল সেও| পরদিন কিচেনে ঢুকি কিছু রান্না করে খাওয়ার জন্য| তখনই ডাক পড়ল লোকটার| আমার মা তুলে গালি দিয়ে আমাকে ডেকে বলল একটা কাগজে সই করে যেতে| উকিলের সঙ্গে কথা বলার পর থেকে আমি বুঝে গিয়েছিলাম সম্পত্তির কী মূল্য? আর তা আমার জন্য কতটুকু জরুরি| মনে পড়ল আপুর করা বারণের কথা| আপু যখন ভার্সিটিতে যেত তখন আমাকে বলে যেত কিচেনে ঢুকলে যেন সাবধানে গ্যাসের চুলা অন করি আর অফ করি| আপুর আগুনে পোড়া শরীরটা ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে| যা ভাবার ভেবে নিলাম কিচেনে দাঁড়িয়েই| কিছুক্ষণ পর কিচেন থেকে বেরিয়ে চুপচাপ বাসার বাইরে চলে এলাম লোকটার সামনে দিয়েই| দুই দিনের মধ্যে বাসায় ফিরলাম না| বন্ধুদের বাড়িতে থাকলাম দু’দিন| আল্লাহ পাক বোধহয় দু’দিনই রেখেছিল ওর হায়াত|’
কথাটুকু বলেই স্বপ্নের ঠোঁটে এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল| কথা থামিয়ে দিলো ওখানেই| আর ঝিলাম বিস্ময় কাটাতে পারেনি তখনো| কিছুক্ষণ পর সে জিজ্ঞেস করেই বসল – ‘মরেছিল তাহলে?’
স্বপ্ন হাসি থামিয়ে চোখ দুটো ছোটছোট করে তাকাল ঝিলামের দিকে| বলল – ‘ভাব দেখে মনে হচ্ছে থ্রিলার স্টোরি শুনছ! আস্ত একটা খুনী বসে আছে তোমার পাশে| এই খুনীকে কেউ চেনে না| আজ শুধু তুমি চিনলে| ভয় লাগছে না?’
ঝিলাম অনায়াসে মাথা নাড়িয়ে না জানাল| স্বপ্ন সেই না জানানোর ভঙ্গি দেখে সেই বেহায়া নজর ফেলে চেয়ে রইল ঝিলামের দিকে| ঝিলাম বেশি সময় পারল না সেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে| কিন্তু আজ আর এই চাউনিতে তার মনে হলো না মানুষটার দৃষ্টি নোংরা| মানুষটার পাশে বসে থাকতেও তার কোনো অস্বস্তি হচ্ছে না| স্বপ্ন উঠে দাঁড়িয়ে শিহাবকে ডাকল আবার|
– ‘শিহাব রে! ঘরটা কি গুছিয়েছিস?’
শিহাব বাইরে থেকে জবাব দিলো – ‘কমপ্লিট স্যার|’
মানুষটা উঠে যেতেই ঝিলাম অনুভব করল এই মুহূর্তে মানুষটা তাকে ফেলে চলে গেলে বড্ড একা হয়ে যাবে সে| মানুষটাকে তার খুব প্রয়োজন| কিছুক্ষণ আগেও যে কষ্টে সে পাথর হয়েছিল, কাতরাচ্ছিল সেই কষ্টটা সে এত সময় ভুলে ছিল এই মানুষটার জন্য| প্রচন্ড প্রয়োজন অনুভব করল সে স্বপ্নের সঙ্গ| স্বপ্ন ঘরের বাইরে পা ফেলার পূর্বেই ঝিলাম পেছন থেকে কাতর কণ্ঠে বলে উঠল – ‘যাবেন না প্লিজ!’
স্বপ্নের পা জোড়া থেমে গেল সেখানেই| পিছু ফিরে তাকাতেই ঝিলাম মাথাটা নিচু করে শব্দ করে কেঁদে উঠল| স্বপ্ন তখন বলল – ‘আমার আপুটাকে এই যন্ত্রণার অবসাদ থেকে মুক্তি দিতে পারিনি আমি| ওর নসিবটাই ছিল মন্দ| তোমার নসিব কিন্তু মন্দ নয়| আজকের এই ঘটনা তোমার বিয়ের পরও হতে পারত| কিন্তু আল্লাহ পাক তোমাকে কিন্তু রক্ষা করে নিলেন| আমার আপুটার প্রতি ওনার এই দয়াটুকু আর হয়েছিল না| এই যন্ত্রণার কাতরতা থেকে আমার আপুটা মুক্তি পায়নি| আর আমি আমার আপুকে হারানোর যন্ত্রণায় এখনো প্রতিটা রাত কাতরাই|’
ঝিলাম হাতের কব্জি থেকে টুকরো কাচটা বের করে হাতটা চেপে ধরে দেয়ালে ভর ঠেকিয়ে নিজেই উঠে দাঁড়াল| স্বপ্নের দিকে একবার তাকিয়ে হেঁটে এসে তার সামনে মাথা নিচু করে বলল – ‘স্বপ্ন! মাফ করে দিন আমাকে!’
স্বপ্নের দিকে তাকাল তারপর| স্বপ্নের দৃষ্টিতে চোখ পড়তেই স্বপ্নের হাসিটা আজ প্রথম খেয়াল করল ঝিলাম| আজ সে নতুন করে স্বপ্নের দুটো জিনিস আবিষ্কার করল| যার মধ্যে একটি হলো এই মানুষটার নাম আর মুখটার সঙ্গে তার হাসিটাও সত্যিই অসম্ভব সুন্দর| যে হাসিটা অল্প কয়েক পল দেখলে শুধু দেখতেই মন চায়| স্বপ্ন একটু অবাক হলো তার প্রতি ঝিলামের এক দৃষ্টি দেখে| এতক্ষণের মাঝেও যখন ঝিলাম নজর ফেলল না তখন সে তার হাসিটা ধরে রেখেই জিজ্ঞেস করল – ‘আজ কি এই বেহায়া দৃষ্টিতে ভালোবাসা দেখা যাচ্ছে নাকি?’
জীবনের সব থেকে বেশি লজ্জার মুহূর্তটুকু ছিল ঝিলামের এই মুহূর্তটুকু| স্বপ্নের কথাটুকু শুনতেই লজ্জাতে সে আর তাকাতে পারল না| মানুষটার দৃষ্টিজোড়া যে সত্যিই ভালোবাসায় পূ্র্ণ আর এই দৃষ্টি জোড়া কতখানি নির্মল তা যে সে আজ সত্যিই উপলব্ধি করেছে| ঝিলামের এমন অবস্থায় মানুষটার হাসির দমক তখন আরও বেড়ে গেছে|
_______
(সমাপ্ত)