#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৮
তাহেরা মাথা নিচু মুখ কাচুমাচু করে মুনের সামনে বসে আছে। আর মুন অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাহেরার দিকে তাকিয়ে আছে। তাহেরা ভয়ে বার বার ঢোক গিলছে। তাহেরা অনেক কষ্টে সাহস করে মিনমিনিয়ে গলায় বলে,
—“সরি মুন। আমার জন্য তোর…….”
মুন তাহেরা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শ্বাসিয়ে বলল,
—“তোমার জন্য আমার জীবনটা টা শেষ হয়ে গেছে। তোমাকে হেল্প করে আমার নিজের লাইফটা হেল হয়ে উঠেছে। ওই শালা আঁধারের বাচ্চা আমার জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে দিয়েছে।”
তাহেরা কিছুই বুঝতে পারছেনা। তাই অবুঝ ভঙ্গিতে বলল,
—“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না মুন। কি বলছিস তুই এসব? উনি তোর লাইফ তেজপাতা করে দিয়েছে মানে?”
মুন যা হয়েছিল তার ঠিক উল্টো টা তাহেরা কে শুনাতে লাগলো,
—“তাহলে শোনো। বিয়ে শেষে বাসর রাতে আমি যখন ওই রাক্ষসটার রুমে বসে ছিলাম তখন হঠাৎ উনি রুমে ঢুকেই আমাকে ওনার বেড থেকে টেনে নামিয়ে ফ্লোরে ছুরে মারলেন। তারপর অনেক বাজে বাজে কথা বলতে লাগলো আমাকে, আব্বু কে আমাদের পুরো পরিবার কে। আমি তবুও একটা টু শব্দটিও করি নি। মুখ বুঝে সব সহ্য করেছি। ওনার বলা শেষ হতেই উনি বেডে গিয়ে শুয়ে আমার দিকে কুশন ছুরে মেরে বললেন নিচে নাহলে সোফায় গিয়ে শুতে। তাহলে ভাবো কত অসভ্য লোক? কারণ উনি নাকি আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানেন না। ওই রাক্ষস টা নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাই আমি যেন তার কাছে কিছু আশা না করি। জানো আমি এতো কিছুর পরেও একটা কথাও মুখ থেকে বের করি নি। চুপচাপ ওনার কথা মতো সোফায় গিয়ে শুয়ে পরি। উনি সব সময় আমার সাথে ধমক মেরে কথা বলে। কখনো নরম গলায় মিষ্টি করে কথা বলে না। একটুও আদর করে না।”
—“তারপর!”
—“তারপর………”
বললে বলতে সামনে তাকাতেই মুন দেখে ওর যমরাজ দরজার সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। আঁধার আবারো সহজ ভাবে বলল,
—“তারপর বলো?”
মুন আঁধার কে দেখে শুকনো একটা ঢোক গিললো। আঁধারের মুখের ভাব ভঙ্গি এখনো সাধারণ। তাহেরা আস্তে করে কেটে পরল। আর যাওয়ার আগে মুনের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
—“বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। এখন আমি যাই।”
মুন শুধু অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না। আঁধার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর ধীরে ধীরে মুনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মুনের ছোট্ট প্রান পাখি উড়ে যায় যায় অবস্থা। মুন পেছাতে পেছাতে তোতলা আওয়াজে বলল,
—“আ-আপনি আ-আগাচ্ছেন কে-কেনো?”
—“তুমি পেছাচ্ছো তাই?”
—“দেখুন….”
—“দেখতেই তো আসছি।”
—“একদম কাছে আসবে না বলে দিচ্ছি।”
মুন পেছাতে পেছাতে একদম দেয়ালের সাথে মিশে যায়। আর পেছানোর কোনো জায়গা নেই। মুন পারলে এখন দেয়ালের ভিতর ঢুকে যেত। আঁধার আসতে আসতে একদম মুনের কাছে এসে গেছে। আঁধার আর মুনের মধ্যে এক হাতের দূরত্ব। মুনের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। এই প্রথম বার কোনো পুরুষের এতো কাছে এসেছে। মুনের দম বন্ধ হয়ে আসছে। ও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হৃদপিন্ডটা জোরে জোরে লাফাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বেরিয়ে আঁধারের বুকের সাথে বারি খাবে। আঁধার হয়তো মুনের হার্ট বিট খুব ভালো করেই শুনতে পারছে। আঁধার আরেকটু মুনের দিকে আঘাতেই মুন চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলল,
—“প্লিজ, প্লিজ এরকম কিছু করবেন না।”
আঁধার ভ্রু কুঁচকে বলল,
—“কেনো? একটু আগে তুমিই তো তোমার বোনকে বলে ছিলে, আমি তোমার সাথে মিষ্টি করে কথা বলি না। তোমাকে আদর করি না। তাহলে এখন কি প্রবলেম?”
মুন চোখ বন্ধ রেখেই করুন সুরে বলল,
—“আর জীবনে ও বলব না। এবারের মতো মাফ করে দিন।”
আঁধার মুনের থেকে দূরে সরে গেল তারপর বলল,
—“এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। আর পড়াশোনায় ফোকাস করো। এবার কান ধরে একপায়ে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকো?”
বলেই আঁধার বেডে গিয়ে বসল। আঁধারের কথা শুনে মুন দ্রুত চোখ খুললো আর দেখলো আঁধার বেডে বসে আছে। আঁধার আবারো বলল,
—“মুখটাকে পেঁচার মতো করে এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? কথা কানে যায় নি? কান ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি।”
মুন মিনমিন করে বলল,
—“এটা কিন্তু অন্যায়। আপনি এটা করতে পারেন না।”
আঁধার ভ্রু বাকিয়ে বলল,
—“আমি কি করতে পারি সেটা দেখতে চাও? দু’মিনিটের মধ্যে কান ধরে এক’পায়ে না দাঁড়ালে একটু আগে যেটা করা বাকি ছিল সেটা এখন করব।”
মুন এ কথা শুনে দ্রুত কান ধরে এক পায়ে দাঁড়ালো। মুন ইনোসেন্ট ফেস করে আঁধারের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আঁধারের সেদিকে কোনো ভুক্ষেপ নেই। সে তো মহা মূল্যবান কাজ ইয়ানি মোবাইল টিপতে ব্যস্ত। মুন মনে মনে বলে,
—“আমার জীবনটা মনে কান ধরে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই পাড় হয়ে যাবে।”
.
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। পশ্চিম আকাশে লাল টকটকে আগুনের গোলার মতো সূর্য টা ধীরে ধীরে সাগরের বুকে মিশে যাচ্ছে। আকাশ নিজেকে কমলা, লাল ও হলুদ রঙের মিশ্রণে নিখুঁত ভাবে সাজিয়েছে। মনে হচ্ছে কেউ খুব যত্ন নিয়ে এই আকাশ টা কে এঁকেছে। গাছপালার রং ও কমলা মনে হচ্ছে। চারদিকে মন ভোলানো মুগ্ধ বাতাস বইছে। সেই বাতাসের সাথে সাথে উড়ছে কোমর অবধি লম্বা কালো চুল। খুব খোশ মেজাজে নদীর পাড়ে কবির খানের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে মুন। আদরের কন্যার আবদারেই তার এখানে আসা। কবির খান খুব আদর যত্নে বড় করেছে এই মেয়েটিকে। যখন যেটা চেয়েছে সেটাই এনে দিয়েছে। না চাওয়ার আগেই পারলে সামনে এনে হাজির করত। বড্ড অভিমানী মেয়ে তার। সাথে রাগ আর জেদ তো ভরপুর আছেই। কিন্তু কখনো তার কথা উপর কথা বলেনি। কখনো কোনো আদেশ অমান্য করেনি। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বিয়ের কথাটাই বলা যায়। কবির খান আড়ালে চাপা শ্বাস ছাড়লেন। সে কি কোনো অপরাধ করেছে? সে তার ছোট্ট মেয়েটির প্রতি অন্যায় করে নিত? ওর জীবনটা নষ্ট করে দেয় নি তো? মুন সংসার জীবনের জন্য এখনো অনেক ছোট। মুন এসবের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। কিন্তু কবির খানের আঁধারের উপর পুরো বিশ্বাস আছে। আঁধার তাকে কথা……..। মুনের কথায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ে বাস্তবে ফিরলো কবির খান।
—“আব্বু একটা কথা জিজ্ঞেস করব? রাগ করবে না তো?”
—“বলো?”
—“আমি শুনেছিলাম মেয়েরা বোঝা হয়ে গেলে নাকি বাবা-মায়েরা তাদের বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দেয়। আচ্ছা আমিও কি তোমাদের কাছে অনেক বেশী বোঝা হয়ে গেছিলাম আব্বু?”
ছলছল চোখে খুবই করুণ স্বরে কথাটা বলল মুন। মুনের এই কথাটা শুনে কবির খানের বুকে তীব্র ব্যথা করতে লাগলো। তার মেয়ে তার কাছে বোঝা এটা সে কখনোই মানতে পারছে না। সে পারলে মুনকে সারাজীবন নিজের কাছে খুব যত্নে আগলে রেখে দিত। সে তো চায়নি তার এই ছোট্ট মেয়েটি কে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে। সে তো স্বপ্নে ও এ কথা ভাবেনি। কিন্তু হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেলো। একটা ঝড় এসে সব কিছু উলট পালট
করে দিলো। দিনটা শুভ ছিলো নাকি অশুভ ঠিক করতে পারছে না কবির খান। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর ভাবতে চায়না সে। সব কিছু দূর স্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে চায়। কিন্তু সেই দূর স্বপ্নের সাথে অপ্রত্যাশিত ভাবে তার কলিজার টুকরা মেয়ে ও জড়িয়ে গেছে। মুন আবারো বলল,
—“কি হলো আব্বু বলো আমি কি তোমাদের কাছে সত্যি’ই বোঝা হয়ে গেছিলাম?”
কবির খান মেয়েকে আচমকা বুকে জড়িয়ে নিলেন। সে জানে তার অভিমানী কন্যা টি খুব বেশি অভিমান করেছে তার ওপর। কবির খান মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বুকের জ্বালা মেটাচ্ছে। সে যে এই মেয়ের চিন্তায় ঠিক মতো রাতে ঘুমাতে পারে না তা কী তার এই অভিমানী কন্যা টি জানে? না জানে না। কবির খান স্নেহময়ী কন্ঠে বলল,
—“আমার মেয়েদের কখনো আমি বোঝা মনে করিনি। তোমরা দুজন তো আর দুই মা। দুটি জান্নাত আমার। তাহলে বলো মা কে কি কখনো সন্তানেরা বোঝা মনে করে?”
মুন অভিমানী কন্ঠে বলল,
—“তাহলে তুমি কেনো আমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলে?”
—“সেটা তো বলতে পারবো না আম্মু। কিন্তু একটা জিনিস বলতে পারবো। আল্লাহ কে সবসময় চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবে। মনে রাখবে আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। কিন্তু আমরা সেটা তখন বুঝতে পারি না। কিন্তু পরে ঠিকই বুঝতে পারি।”
মুন আর কিছু বলল না। শুধু মাথা নাড়লো। কারণ সে সব থেকে বেশী বিশ্বাস নিজের প্রাণ প্রিয় আব্বু কে করে। তার আব্বু কখনো না ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। আর যে সিদ্ধান্ত নেন সেটা ঠিকই হয়। মুন আইসক্রিম খাবে বলে কবির খানের কাছে আবদার করল। আর কবির খান ও হাসি মুখে মেয়ের জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসতে গেল। কবির খানের ভিতরে লুকিয়ে আছে অনেক কথা অনেক রহস্য যা সে সবার থেকে আড়াল করে রাখতে চান। মুনের বিয়েটা যতটা সহজ ও স্বাভাবিক দেখাচ্ছে আসলে ততটা স্বাভাবিক না। অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে এর পিছনে। যা শুধু কয়েক জন ছাড়া কেউ জানে না।
.
রাত ১১:৪৫ বাজে। একটু আগেই খাওয়া দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রুমে এসেছে মুন আঁধার। কিন্তু কথা হলো আঁধার এখন ঘুমাবে কোথায়? মুন আঁধারের জন্য জায়গা রেখে এক সাইডে করে শুয়ে পরেছে। আঁধার কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুনের সে দিকে ভাবান্তর নেই। আঁধার ভারি কন্ঠে বলল,
—“আমি ঘুমাবো কোথায়?”
মুন আলসেমি কন্ঠে বলল,
—“আপনি কি অন্ধ?”
আঁধার রাগি কন্ঠে বলল,
—“মানে? তুমি কি মজা করছো আমার সাথে?”
—“আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না আমি আপার জন্য পাশে জায়গা রেখে সাইড করে শুয়েছি? তারপরও আবার জিজ্ঞেস করছেন কোথায় ঘুমাবেন? তার মানে তো এ’ই যে আপনি চোখ থাকতেও অন্ধ।”
আঁধার চেঁচিয়ে বলল,
—“হোয়াট আমি তোমার সাথে বেড শেয়ার টকরবো? ইমপসিবল। এর থেকে আমি নিচে ফ্লোরে ঘুমাবো।”
মুন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
—“অ্যাজ ইউর উইশ। আজ রাতে ইঁদুর আর তেলাপোকা’র সাথে পিকনিক করবেন কেমন।”
বলে মুন চোখ বন্ধ করে নিলো। আঁধার একটা পাটি আর বালিশ নিয়ে নিচে শুয়ে পরলো। কিন্তু ঘুম আসছে না তার এপাশ ওপাশ করতে করতে ১২টা বেজে গেছে। আঁধার উঁকি দিয়ে দেখে মুন ঘুমিয়ে গেছে। তাই আঁধার উঠে ধীর পায়ে গিয়ে মুনের পাশে শুয়ে পরলো। আঁধার চোখ বন্ধ করে আছে হঠাৎ মনে হলো ওকে দুটো হাত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। আঁধার চোখ খুলে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে মুন কে দেখে।
#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৯
আঁধার মুনকে নিজের কাছে দেখে চমকে উঠলো। কিন্তু পরে বুঝতে পারে মুন ঘুমের ঘোরে ওকে কোল বালিশ মনে করে জরিয়ে ধরেছে। আঁধার মুন কে সরিয়ে দিতে গিয়েও রসালো না। কিছু একটা ভেবে ওভাবেই ঘুমিয়ে পরলো। শেষ রাতে বৃষ্টি শুরু হয়। পরিবেশ হালকা ঠান্ডা হয়ে ওঠে। মুনের শীত শীত অনুভব হয়। মুন শীতে আঁধার কে আরো পেঁচিয়ে ধরে ওর উষ্ণ শরীরের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নেয়। ঘুমের মধ্যে আঁধার অনুভব করে খুব নরম কিছু ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। আঁধারের ঘুম চট করে ভেঙ্গে যায়। মুন কে নিজের এতো কাছে দেখে আঁধার ওকে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু পারে না। আঁধার মুন কে যত নিজের থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছে মুন আরো তত আঁকড়ে ধরছে। আঁধার শেষ ব্যর্থ হয়ে ওভাবেই শুয়ে রইলো। অন্ধকার কে কাটিয়ে সূর্য নিজের আলোয় চারদিকে আলোকিত করে দিতে লাগলো। শেষ রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে আকাশ টা একদম পরিষ্কার। চার দিকে পিনপন নিরবতা। শুধু হালকা শো শো বাতাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। গাছ লতা পাতা গুলোয় বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। সব কিছু সিগ্ধ মনে হচ্ছে। এরকম পরিবেশের সাথে ধোঁয়া ওঠা কফি যেন মন টাকে আরো তরতাজা করে দিচ্ছে আঁধারের। আঁধার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা কফির মগে পাতলা ঠোঁটে চুমুক দিচ্ছে আর এই মনমুগ্ধ পরিবেশ টাকে উপভোগ করছে। আঁধার নিজেকে খুব হালকা মনে করছে। সব চিন্তা ভাবনা যেন এক নিমিষেই দূর হয়ে গেছে। এভাবেই দেখতে দেখতে পুরো পুরি ভাবে আকাশে সূর্য নিজের করে নিলো। চারদিকে ছড়িয়ে দিলো নিজের তেজস্ক্রিয় রশ্মি। আর তার এক চিলতে রশ্মি জানালার পর্দা ভেদ করে মুনের চোখে এসে বারি খেলো। সাথে সাথেই ঘুম টা ছুটে গেল। মুনের খুব বিরক্ত লাগছে সাথে রাগ ও হচ্ছে খুব। মনে মনে সূর্য কে কিছু কথা শুনিয়ে দিলো ওর এতো সুন্দর স্বপ্ন টা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য। বাস্তবে তো আর দেখতে পারবে না এরকম দৃশ্য স্বপ্নে দেখছিল। তাও এই ব্যাটা সূর্যের সইলো না। এরকম স্বপ্ন কি সচরাচর দেখা যায়? মুন আঁধারের সামনে শেরনির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আর আঁধার ভেজা বেড়ালের মত ওর সামনে কান ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহা কি দৃশ্য। মুন আফসোস করতে করতে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালো তারপর হামি দিতে দিতে ওয়াশরুমে চলে গেল। মুন ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো আঁধার কালো পেন্ট, কালো ইন করা শার্ট পরে লুকিং গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে জেল দিচ্ছে। মুন সিটি বাজিয়ে এগিয়ে গেল আঁধারের দিকে। আঁধার সিটির শব্দে পিছনে ফিরে তাকালো। মুনকে দেখে আবার সামনে ফিরে নিজের কাজ করতে লাগলো। মুন দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে মজা করে বলল,
—“কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”
আঁধার মুনের দিকে না তাকিয়ে’ই বলল,
—“কেন তুমি জানো না?”
—“হসপিটালে এতো সেজেগুজে যাওয়া লাগে? দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়ে দেখতে যাচ্ছেন। ওখানে কাজ করতে যান নাকি মেয়ে পটাতে?”
একটু রাখি স্বরে খোঁচা মেরে বলল মুন। আঁধার এবার মুনের দিকে তাকালো। আঁধার ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে মুনের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
—“কি বলতে চাও তুমি?”
—“আপনি এভাবে সেজেগুজে হসপিটালে যেতে পারবেন না। বুইড়া ব্যাডার আবার এতো ঢং কিসের?”
—“হোয়াট?”
—“বাংলা কথা বুঝেন না? আপনি এভাবে সেজেগুজে হসপিটালে যান দেখেই তো শাকচুন্নী, চুরেল, পেত্নিদের নজর আপনার উপরে। দেখলেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।”
আঁধার বিরক্তির সুরে বলল,
—“ফালতু কথা বন্ধ কর আর সরো। হসপিটালে আমার অনেক কাজ আছে।”
—“আমি জানি তো আপনি ওখানে কাজ করতে যান নাকি ওই শাকচুন্নীদের সাথে টাংকি মারতে যান?”
—“হোয়াট এই টাংকি টা আবার কি?”
—“আপনার বুঝতে হবে না। আপনি এভাবে যেতে পারবেন না মানে পারবেন না।”
—“মুন এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
—“এভাবে কেন আপনি আজ কে কোনো ভাবেই যেতেই পারবেন না। আপনি না আমার সাথে বেরাতে এসেছেন? তাহলে বেরাতে এসে আবার কাজ কিসের হু?”
মুন গিয়ে দরজা আটকে দাঁড়ালো। আঁধার রাগি স্বরে বলল,
—“মুন সরো বলছি। দরজা ছাড়ো আমার লেইট হয়ে যাচ্ছে।”
—“আপনাকে আমি আজ কোনো ভাবেই যেতে দিবো না।”
বলেই মুন দরজা খুলে কবির খান কে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে গেল। কবির খান সোফায় বসে নিউজ পেপার পড়ছিলেন। মুনের ডাক শুনে নিউজ পেপার থেকে চোখ সরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। মুন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
—“আব্বু দেখো না ওই রাক্ষস টা আমাকে বকছে। আমি উনাকে আজ হসপিটালে যেতে বারণ করেছি তাই।”
এর মধ্যেই আঁধার ও ওখানে এসে হাজির হলো। মুন আবারো বলল,
—“জানো আব্বু উনি আমাকে সব সময় বকাবকি করে, ধমক মারে। আর আমাকে কান ধরে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে ও রাখে।”
কবির খান বিস্ফোরিত চোখে আঁধারের দিকে তাকালো। আর আঁধার তো ড্যাবড্যাব করে শুধু মুনের দিকেই তাকিয়ে আছে। মুন যে সব কবির খান কে বলে দিবে আঁধার তা বুঝতে পারেনি। মুন কাঁদার নাটক করে নাক টেনে টেনে বলল,
—“তুমি জানো আব্বু উনি তো সেদিন আমাকে মেরেও ছিলো।”
আঁধার যেন আকাশ থেকে পড়ল। ও আবার কখন মুন কে মারলো? আগের কথা গুলো সত্যি হলেও এটা মুন বানিয়ে বলছে। আঁধার একরকম চেঁচিয়েই বলল,
—“হোয়াট? কবে? কখন? কি বলছো তুমি এসব? আমি আবার তোমাকে কখন মারলাম?”
—“আপনার মনে নেই সেদিন যে মেরে ছিলেন?”
আঁধার কবির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে সে অগ্নি দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এখনি ওকে নিজের চোখের আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে রাখ করে দিবে। কবির খান মেয়ের দিকে তাকিয়ে যথেষ্ট নরম হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
—“ঠিক আছে মামনি আমি আঁধার কে বুঝিয়ে বলছি ও আর তোমাকে কখনো বকবে না। এখন তুমি যাও গিয়ে দেখতো তাহেরা ঘুম থেকে উঠেছে কি না।”
মুন মাথা নেড়ে নাচতে নাচতে চলে গেল। আর যাওয়ার আগে আঁধার কে চোখ টিপ মেরলো। আঁধার ক্ষিপ্ত চোখে মুনের দিকে তাকালো। আঁধার বলল,
—“আপনি কি আপনার মেয়ের কথা বিশ্বাস করছেন?”
কবির খান গম্ভীর কন্ঠে বলল,
—“না। আমি আমার মেয়ের চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি ও মিথ্যে বলছে। কিন্তু সাবধান ভুলেও কখনো এই ভুল করবে না। তাহলে জানো তো এর পরিণাম কি হবে?”
আঁধার মাথা নিচু করে কন্ঠ খাদে নামিয়ে জবাব দিলো,
—“হুম।ভালো করেই জানি।”
.
মুন রুমে এসে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ঊর্মি কে ফোন দিলো অনেক দিন ধরে কথা হয় না। ঊর্মি ফোন রিসিভ করে বলল,
—“হ্যা বল? কি খবর? কেমন আছিস? সংসার ক্ষ কেমন চলছে?”
—“একসাথে এতো প্রশ্ন? আচ্ছা একটা একটা করে জবাব দিচ্ছে। খবর ভালো। আমি ও অনেক ভালো আছি। আর সংসারের কথা কি আর বলবো!”
—“কেন কি হয়েছে রে?”
মুন দুঃখি কন্ঠে বলল,
—“আর জিগাইস না।”
ঊর্মি বোকার মত বলল,
—“ওকে।”
—“আরে গর্দভ মাইয়া আমি তো ওটা সিমপ্যাথির জন্য বলছিলাম।”
—“ওওওওও।”
—“এখন শোন আমার দুঃখ ভরা জীবনের কাহিনী।”
—“বল?”
—“আমার যে বিয়ে হয়েছে তা আমার কোনো দিক দিয়েই মনে হয়না। কারণ ওই রাক্ষস টা আমাকে বউ কম স্টুডেন্ট ভাবে বেশী। আর আমার উনাকে আমার জামাই কম প্রফেসর মনে হয় বেশী। আর আমার শ্বশুরবাড়িতে মনে হয় আমি বউ হয়ে নয় মেহমান হয়ে বেরাতে গেছি। এই হলো আমার কষ্টময় জীবনের কাহিনী।”
—“সত্যি’ই অনেক কষ্টময়।”
—“জানিস জামাই সুন্দর হলেও আবার প্যারা আছে?”
ঊর্মি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“কেন কেন?
—“কারণ সব শাকচুন্নী, পেত্নি, ডাইনীদের কুনজর পরে। সব সময় ভয় হয় কখন জানি কোন চুলের এসে বশ করে নিয়ে যায়।”
ভয়ার্ত কন্ঠে বলল মুন। আঁধার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুনের কথপোকথন শুনছে। মুনের কথা শুনে কেনো জানি আঁধারের অনেক হাসি পেল। আঁধার নিঃশব্দে হাসলো। যখন মুন এরকম বোকা বোকা কথা বলে বাচ্চামো করে তখন আঁধারের খুব হাসি পায় কিন্তু আঁধার মুনের সামনে হাসে না। অনেক কষ্টে নিজের হাসি চাপিয়ে রাখে।
.
মুন আর আঁধার আজ চলে যাবে। আঁধার আর কবির খান বাইরে কারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মুন এখনো বের হয়নি। কবির খান বলেন,
—“শর্তের কথা মনে আছে তো?”
আঁধার শীতল দৃষ্টিতে কবির খানের দিকে তাকালো তারপর বলল,
—“হুম মনে আছে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”
—“আমি আগেও বলেছি আর এখনো বলছি। আমার মেয়ে যদি কখনো বলে ও তোমার কাছে থাকতে চায় না তাহলে কিন্তু ওকে আমি সারাজীবনের জন্য তোমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবো।”
আঁধার নিশ্চুপ। এই কথার কোনো উত্তর ওর কাছে
নেই। কবির খান প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
—“কাজ কেমন চলছে তোমার?”
আঁধার আড়চোখে কবির খানকে এক নজর দেখে নিয়ে বলল,
—“ভালো।”
—“আব্বু!”
মুনের চোখে জল টলমল করছে। যেন এক্ষুনি গড়িয়ে পড়বে এমন ভাব। কবির খানের শক্ত চোখ দুটো মেয়ের এমন টলমলে চোখ দেখে নিমিষেই শীতল হয়ে এলো। মুন ঝাঁপিয়ে পরলো কবির খানের বুকে। মুন যেতে চাইছে না আঁধারের সাথে ও বাড়িতে। ও কবির খানের সাথেই থাকতে চায়। এদিকে কবির খানের একটু আগে বলা কথা গুলো আঁধারের মনে হতেই ও বাঁকা চোখে কবির খানের দিকে তাকালো। কবির খান আঁধারের চোখের ভাষা বুঝতে পারছে। কবির খান মুনের মাথা টা বুক থেকে তুলে ওর গালে দু হাত রেখে বুঝিয়ে বলল,
—“মামনি তুমি এখন আঁধারের সাথে তাও। আবার যখন আসতে ইচ্ছে করবে তখন সঙ্গে সঙ্গে চলে এসো। এটাও তোমার বাড়ি ওটাও তোমার বাড়ি। আর ও বাড়িতে তো তোমার আরো দুজন আম্মু আব্বু আছে তারাও তো তোমাকে খুব মিস করছে তাই না? জানো তোমার শশুরবাবা আজ সকালেই আমাকে ফোন করে শাসিয়ে বলে দিয়েছে যেন তাড়াতাড়ি তোমাদের পাঠিয়ে দি। ওরা নাকি তোমাকে খুব মিস করছে। এখন তুমি যদি না যাও তাহলে তো ওরা খুব কষ্ট পাবে তাই না?”
মুন বাচ্চাদের মতো মাথা ঝাঁকালো। আঁধার শুধু সাইলেন্স দর্শকে মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। কবির খান মেয়ের কপালে স্নেহময় চুমু এঁকে দিলো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা চলে গেল।
চলবে,
চলবে,
[ঠিক সময়ে গল্প না দিতে পারায় আমি খুবই দুঃখিত। আর মুনের বয়স নিয়ে কি কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমি জানি মুনের বয়স টা অনেক কম। কিন্তু ষোলো বছরের একটা মেয়ে কিন্তু একে বারেই অবুঝ নয়। আর আমি ভেবে চিনতেই মুনের বয়সটা কম দিয়েছি। কিন্তু আপনাদের কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পারেন। ধন্যবাদ।]