#My_First_Crush
#পর্ব-২১
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
(হৃদি)
পিকনিক শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ঘনিয়ে এলো। জাগতিক সব বিষয় ঘটার ক্ষেত্রেই একটি ভালো দিক থাকে। এই পিকনিকের ভালো দিকটি যা পেলাম তা হলো রাইয়ানের মুড অবশেষে ঠিক হয়েছে।
এই মুহুর্তে নিজের স্টাডি রুমে বসে অফিসের কাজ করছে সে। আজ ঠান্ডাটাও যেন একটু বেশি বেশি লাগছে। সাদা রঙের একটা পাতলা সোয়েটার আর কান টুপি পরে কফি মগ হাতে রাইয়ানের স্টাডি রুমে গেলাম আমি। রাইয়ানের পূর্ণ মনোযোগ তার হাতে ধরে রাখা ফাইলের দিকে। আমি নিঃশব্দে তার সামনের চেয়ারটি টেনে বসলাম। কফি মগটি রাখলাম সামনে। রাইয়ান অন্যমনষ্ক ভাবে আমার কফি মগটি তার জন্য ভেবে হাত বাড়িয়ে নিতে গেলো। আমি কফি মগটি হালকা একটু পাশে সরিয়ে দিলাম। রাইয়ানের হাত আবারও কফি মগের কাছে গেলে সরিয়ে দিলাম অন্যপাশে। রাইয়ানের এবার ধ্যান ভাঙলো। আমার দিকে তাকাতেই আমি ভাব নিয়ে বললাম,
‘এটা আমার কফি।’
রাইয়ান জানতে চাইলো,
‘আমারটা?’
‘আমার পেটে।’
রাইয়ান ভ্রু কুঁচকালো। আমি বললাম,
‘পরপর দু মগ কফি খেয়ে ফেলেছি আমি।’
‘আজকে ঘুমানোর ইচ্ছে নেই?’
‘ঘুম যখন আসার তখন আসবেই।’ এরপর একটু সিনেমার ডায়লগের ন্যায় বললাম,
‘দু মগ কফি কখনো আমার ঘুমের পথে বাঁধা হতে পারবে না।’
রাইয়ান হেসে ফেললো। আমি বললাম,
‘হাসার কথা তোমার মনেও আছে? আমি তো ভাবলাম এই দুই দিনে বোধহয় হাসতে কিভাবে হয় তুমি সেটাই ভুলে গেছো।’
আমি এবার আরেকটু খোলাখুলি হলাম। বললাম,
‘আমি কিন্তু সেদিন আমার কথাটা পুরোপুরি শেষ করতে পারিনি।’
ফাইল থেকে আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকালো রাইয়ান। আমি বলতে লাগলাম,
‘যদিও অ্যালেনের বর্ণনা করতে গেলে ওর সেসব দিকের কথাও বলতে হয়। তবুও ওকে দেখতে যতোই ভালো লাগুক না কেন, মেরুন রঙ সহ পৃথিবীর সকল রঙের শার্টেই আমার কাছে সবথেকে বেশি ভালো লাগে তো তোমাকেই।’
আমি লক্ষ করলাম রাইয়ানের চোখে মুখে একধরণের সুক্ষ্ম লাজুক ভাব ফুটে উঠেছে। তা দেখে আমি বললাম,
‘যাক! আজকে একটা নতুন জিনিস জানলাম। প্রশংসা শুনলে মেয়েদের মতো ছেলেরাও আসলে লজ্জা পায়।’
চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার মাথার টুপিটা টেনে চোখ ঢেকে দিয়ে চলে গেলো রাইয়ান। আমি টুপি ঠিক করে হাসিমুখে পেছনে ঘুরে রাইয়ানের দিকে তাকালাম। রাইয়ান লাপাত্তা।
ঘুমানোর আয়োজনে রুমে ঢুকতেই খেয়াল হলো আমার ফোনটা এখনো ব্যাগ থেকে বের করাই হয়নি। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে পাওয়ার বাটন চাপতেই স্ক্রিনে আমার ছবি ভেসে উঠলো। আমি কিঞ্চিৎ অবাক হলাম। কারণ আমার ফোনের ওয়ালপেপারে তো আমি আমার ছবি দেইনি। তখনই ফোনটা এপিঠ ওপিঠ ঘোরাতেই খেয়াল হলো এটা তো আমার ফোনই না। অ্যালেনের। হয়তো আজ পিকনিকে পাশাপাশি ফোন রাখায় ভুলে তারটা নিয়ে চলে এসেছি আমি। কিন্তু অ্যালেন আমার ছবি তার ফোনের ওয়ালপেপারে লাগিয়েছে কেন? তবে কি…..
কি মনে করে যেন আমি আমার বার্থডে ডেট ফোনের লক পাসওয়ার্ডে ট্রাই করলাম। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা আনলক হয়ে গেলো। আমি স্তব্ধ।
___________________________________________________
হুট করে রাইয়ানের ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলতেই একটা চাপা আওয়াজ শুনতে পেলো সে। শব্দের অনুসরণে দৌড়ে বারান্দায় গেলো রাইয়ান। নিচে তাকিয়ে দেখলো হৃদি বিল্ডিংয়ের উপরে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে ‘মিঁয়ো, মিঁয়ো’ বলে ডেকে যাচ্ছে। রাইয়ান তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলো। হৃদির পাশে এসে দাঁড়াতেই দেখলো মিঁয়ো বিল্ডিংয়ের ছাদের বাইরের সরু একটা অংশে গুটিশুটি মেরে বসে করুণ স্বরে ডেকে যাচ্ছে। রাইয়ান জিজ্ঞেস করলো,
‘মিঁয়ো ওখানে গেলো কিভাবে?’
হৃদি ছল ছল চোখে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘আমি জানি না।’
রাইয়ান সেখান থেকে সরে তাড়াতাড়ি ছাদে গেলো। রেলিংয়ের বাইরে সাবধানে নামলো। সরু জায়গা ধরে এগোতে লাগলো ধীরে ধীরে। শেষ প্রান্তে গিয়ে থামতে হলো। পা ফেলার আর জায়গা নেই। রাইয়ান সেখান থেকেই হাত বাড়িয়ে দিলো মিঁয়োর দিকে। নাগাল পাচ্ছে না। এদিকে মিঁয়ো বোধহয় একটু নড়লেই মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। একেবারে শ্বাসরুদ্ধকর মুহুর্ত। হৃদির দম আটকে আসার মতো অবস্থা হলো। অবশেষে মিঁয়ো পড়ে পড়ে যায় এমন অবস্থায় মিঁয়োকে ধরতে সক্ষম হলো রাইয়ান। টলমল চোখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো হৃদি। রাইয়ান মিঁয়োকে কোলে নিয়ে নিচে চলে এলো। হৃদির সামনে এসে হৃদির কোলে তুলে দিলো মিঁয়োকে। হৃদি মিঁয়োকে কোলে নিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। রাইয়ান একবার সেদিকে তাকিয়ে হৃদির মাথায় হাত রেখে চলে গেলো।
এরপর ওরা দুজনেই চলে এলো বাসায়। হৃদি মিঁয়োকে কোলে নিয়ে সোফায় বসে রইলো। রাইয়ান একটা পানির গ্লাস নিয়ে হৃদির হাতে দিলো। এক চুমুকে সবটুকু পানি শেষ করে ফেললো হৃদি। রাইয়ান জিজ্ঞেস করলো,
‘আরো খাবে?’
হৃদি মাথা নাড়িয়ে না বলল। অনেকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। এই ঘটনা অনেকটাই নাড়িয়ে দিয়েছে তাকে। হৃদির বাবা মা মারা যাবার পর থেকেই মিঁয়ো হৃদির সাথে আছে। তার একাকীত্বের জীবনে মিঁয়োই ছিল তার একমাত্র সঙ্গী। মিঁয়োর দুষ্টমি, ছোটাছুটি, আদুরে স্বভাব এসবের জন্যই হৃদি ঐ বাড়িতে একা একা থাকতে সক্ষম হয়েছিল। তাই হৃদির কাছে মিঁয়োর গুরুত্ব অনেক বেশি৷ কখনো কখনো একটি ক্ষুদ্র প্রানীও আমাদের ভালোবাসার জগতে অনেকটা জায়গা দখল করে নেয়। হৃদির কাছে মিঁয়ো তার বাস্তব উদাহরণ।
কফিশপে গিয়ে নিজেকে খানিকটা হালকা করার চেষ্টা করলো হৃদি। আজকে ক্যাট ব্যাগপ্যাকে করে মিঁয়োকে সাথে করে নিয়ে এসেছে সে। একা বাসায় মিঁয়োকে রাখতে আজ ভরসা হচ্ছিল না তার। মিঁয়ো ব্যাগপ্যাক থেকে উঁকিঝুকি দিয়ে চারপাশটা দেখছিল। জেরিন আদুরে আদুরে কথা বলে মিঁয়োর নজর কাড়তে চেষ্টা করছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্মিত হেসে সেসব দেখছিল হৃদি। এমন সময় জেরিন বাইরে গিয়েই আবার ফিরে এসে বলল অ্যালেন এসেছে। অ্যালেনের নাম শুনতেই হৃদির চোখেমুখে একধরনের অস্বস্তি ভেসে উঠলো।
___________________________________________________
(রাইয়ান)
একটি সবুজ রঙের ব্রেসলেট, মাঝখানে বসানো ছোট্ট আয়না। সূর্যের আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে আমার চোখে গিয়ে বিধলো। তারপর, স্ট্রিট শপ থেকে সেটির মালিকানা নিজের নামে করে নিয়ে সেটি এখন আমার হাতে। আমি ভাবতে লাগলাম এই ব্রেসলেটটা যদি হৃদি দেখে তাহলে সে ঠিক কিরকম প্রতিক্রিয়া করবে? কারণ এটি ঠিক সেই রকমই যেটা তিন বছর ব্যবহার করার পরও ছিঁড়ে যাওয়ায় হৃদি বাচ্চাদের মতো বিলাপ করেছিল। মেয়েরা আসলেই তাদের ছোট ছোট জিনিসগুলো নিয়ে খুবই পসেসিভ। হোক না সে নগন্য।
গতকালের মিঁয়োর ইন্সিডেন্টটা নিয়ে হৃদি খুব মনমরা হয়ে আছে। আগের মতো প্রফুল্লিত ভাবটা দেখা যাচ্ছে না। কাল যখন রাত করে হৃদি বাড়ি ফিরলো তখনও দেখলাম তার মধ্যে একধরনের অন্যমনষ্কতা বিরাজমান। এমনিতে তো আমি আগে বাড়ি ফিরে গেলে কফিশপ থেকে ফিরেই কত বকবক করে হৃদি। কিন্তু কাল বাড়ি ফিরে আমাকে দেখেও হৃদি কোন কথা বলল না। আমি বলতে গেলেও খেয়াল না করে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে গেলো বেডরুমে। কাঁধ থেকে ব্যাগটা রেখেই ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে। হৃদিকে একটু চিয়ার আপ করার জন্য আমি তাকে বিকেলে একটা দামী রেস্টুরেন্টে আসতে বললাম। আমি আগে থেকেই উপস্থিত ছিলাম সেখানে। হৃদি যথাসময়ে এলো। তার পরণে হলুদ রঙের স্কার্ট। মাথার ঝলমলে রেশমি চুলগুলো খোলা। হৃদি এসে আমার সামনের চেয়ারে বসলো নিঃশব্দে। আমি আমাদের দুজনের জন্য স্টেক অর্ডার করলাম। সাথে পাইন অ্যাপল জুস। আমি হৃদিকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে আসতে কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা। হৃদি স্মিত হেসে মাথা নেড়ে না জানাল। খাবার এসে পড়লে আমরা খাওয়া শুরু করলাম। কথা খুব একটা জমলো না। হৃদিকে আজ অনেক ম্যাচিয়ুরড লাগছে। অন্যদিনের তুলনায় অনেকটা চুপচাপ। বুঝলাম মিঁয়োর ব্যাপারটা এখনো প্রভাব ফেলে রেখেছে হৃদির মধ্যে। কাটা চামচ আর ছুরির টুকটাক শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ হলো না আমাদের টেবিলে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আমরা হেঁটে হেঁটেই রাস্তায় এগোতে লাগলাম। এই রাস্তাটা অনেকটা সুনসান। মাঝে মাঝে কিছু বাই সাইকেল চলে যাচ্ছে পাশ কেটে। শীতের আগমনে বইছে হিমায়িত বাতাস। রাস্তার দু পাশে দাঁড়ানো সারি সারি গাছের থেকে একটা দুটো খসছে পাতা। আমরা দুজনেই হাঁটছি চুপচাপ। পরিবেশের এই নিস্তব্ধতা অনেকটা ভারী ঠেকতে লাগলো আমার কাছে। পকেটের গায়ে হাত রাখতেই খসখস শব্দ হলো। আমি থেমে হৃদির দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। উৎসুক গলায় বললাম,
‘হৃদি, দেখেছো শীত এসে পড়েছে।’
হৃদি ঠোঁটের রেখা প্রশস্ত করে বলল, ‘হুম।’
‘এবার উইন্টারে কি প্লান?’
‘এখনো কিছু ভাবিনি।’
‘এখনো ভাবো নি। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ঠিক করে রেখেছো। কি? মুড নেই? একটু অনুমান করে দেখো তো এমন কিছু কি আছে যেটা দিয়ে আমি তোমার মন ভালো করে দিতে পারি?’
হৃদি স্মিত হেসে বলল, ‘যা পেলে আমার মন ভালো হতে পারে তাই কি তুমি আমাকে দিতে পারবে রাইয়ান?’
আমি সকৌতুকে বললাম, ‘হুম।’
হৃদি ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে মোলায়েম স্বরে বলল, ‘লেট’স গেট এ ডিভোর্স।’
আমার মুখের চাঞ্চল্যকর ভাব আস্তে আস্তে নিভে গেলো। হাতের মুঠোয় বন্দি থেকে গেলো সেই সবুজ রঙের ব্রেসলেটটি।
চলবে,