My First Crush পর্ব -৩২ ও শেষ

#My_First_Crush
#পর্ব-৩২ (শেষ পর্ব)
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

(হৃদি)
কিছু মানুষের গুঞ্জনের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলেই সামনে জাহিদ ভাই, মুনিয়া আর অফিসের কিছু স্টাফদের দেখে আমি কিঞ্চিৎ বিস্মিত চোখে তাকালাম। পরক্ষণেই আমার চোখ গেলো আমার নিজের অবস্থানের দিকে। আমার গায়ে রাইয়ানের শার্ট জড়ানো। রাইয়ান ছাদের রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে বসা। আর আমি তার বুকে মাথা রেখে এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম। নিজেকে ধাতস্থ করার আগ মুহুর্তেই মুনিয়া বিদ্রুপের সাথে বলে উঠলো,
‘এটাই দেখার বাকি ছিল! তাই তো বলি দুজনের এতো ঘনিষ্ঠতা কিসের? এই জন্যই বুঝি সুপারভাইজার সাহেব সব কাজে হৃদিকেই খুঁজতেন।’
আমি ঝট করে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে রাইয়ানও চোখ মেলে জাগ্রত হলো। সবাই বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় অপমানে একদম গুটিয়ে গেলাম আমি। এমন আকস্মিক ঘটনায় গতরাতের কোনোকিছু মাথাতেও এলো না। আটকে রইলাম বর্তমানেই। মুনিয়া আরো কিছু বলতে নিলে জাহিদ ভাই থামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘হয়েছে। সবাই নিচে চলো এখন।’
জাহিদ ভাইয়ের কথায় সবাই চলে যেতে গেলো। সবশেষে জাহিদ ভাইও যাবার আগে একবার আমার দিকে যেই দৃষ্টিতে তাকালেন তাতে সঙ্কোচে একদম জমে গেলাম আমি। এই অফিসে জয়েন করার পর জাহিদ ভাই আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। তাকে আমি বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করি। তিনি আমাকে নিয়ে যা ভাবছেন তা ভাবতেই আমার কান্না পেয়ে গেলো। চোখে পানি চলে এলো আমার। রাইয়ান আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘হৃদি, তুমি মন খারাপ করো না। চলো, আমরা এখনই গিয়ে আমাদের সত্যিটা জানিয়ে দিয়ে আসি। ‘
এই বলে রাইয়ান আমার হাত ধরলো। আমার মাথা এমনিতেও গরম ছিল। যার ফলে ভুলভাবে রিয়্যাক্ট করে ফেললাম আমি। এক ঝটকা দিয়ে রাইয়ানের হাত ছাড়িয়ে রাগ নিয়ে বললাম, ‘প্লিজ রাইয়ান, এবার তো অন্তত আমাকে রেহাই দাও। আমাকে দয়া করে একটু একা থাকতে দাও। আমি কতবার বলেছি তুমি চলে যাও, চলে যাও! এবার তুমি খুশি হয়েছো? সবকিছু ছেড়ে আমি এখানে নতুন করে নিজের জন্য একটা দুনিয়া গড়ে তুলেছিলাম, একটু শান্তি চেয়েছিলাম। তোমার জন্য সেটাও……!’

আর কিছু বলতে পারলাম না। থেমে গেলাম। একবারও পেছনে না তাকিয়ে চলে এলাম সেখান থেকে। আর অফিসেও ঢুকলাম না। বাসায়ও ফিরে গেলাম না। নিরিবিলি একটা লেকের ধারে কাঠের বেঞ্চিতে মুষ্টিবদ্ধ দু হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলাম সারাক্ষণ। ভালো লাগছিলো না একদমই কিছু। মন অত্যাধিক খারাপ হয়ে রইলো। ঘন্টা দুয়েক কি তিন এভাবেই কাটলো আমার। এরপর আস্তে ধীরে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলাম আমি। এলোমেলো চুল কানের দু’পাশে গুঁজে, গতকালের সাদা কুর্তি পরনে সেভাবেই অন্যমনষ্ক মনে ফিরে গেলাম বাসায়। বাসায় ঢুকে সোজা চলে গেলাম নিজের রুমে। বিছানার উপর চোখ যেতেই দেখলাম সেখানে একটা কারুকার্যময় ছোট কাঠের বাক্স রাখা। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম সেখানে। বাক্সের উপর একটা সবুজ রঙের ব্রেসলেট। ঠিক যেন আমার সেই ছিঁড়ে যাওয়া প্রিয় ব্রেসলেট।
___________________________________________________
(রাইয়ান)

হৃদি,
ছোট্ট একটা শব্দ দিয়ে কি এক আকাশ অনুভূতি বোঝানো সম্ভব? আমি কি বোঝাতে পেরেছি? তুমি কি বুঝতে পেরেছো? আমার জীবনের অদ্যপান্ত বদলে দেওয়া মেয়েটির নাম পড়তে গিয়ে তুমি কি আমার অফুরন্ত অনুভূতির উপলব্ধি করতে পেরেছো? যতোটা অনুভূতি তোমার নামটি লিখতে গিয়ে আমার মনে প্রস্ফুটিত হয়েছিল! আমার জীবনের সবচাইতে বড় আফসোসটা কি জানো? তোমার জন্য আমি আমার অনুভূতিগুলো কখনো শব্দ দিয়ে প্রকাশ করে বোঝাতে পারবো না। এই একটা জায়গাতেই আমি দূর্বল, অজ্ঞ, ভাষাহীন। আমার শব্দভান্ডার তন্নতন্ন করে খুঁজেও একটি উপযুক্ত শব্দ বের করতে আমি ব্যর্থ। ভরসা একটা তুমিই। বুঝে নিবে তো?

তুমি জানো? পূর্বে যখন আমি কারো ভালোবাসার কথা শুনতাম, একজনের জন্য আরেকজনের স্যাক্রিফাইজের কথা শুনতাম, তাদেরকে নেহাৎ বোকা ভাবতাম আমি। ভাবতাম, এতোটা বোকা কেউ কিভাবে হতে পারে! যে কিনা নিজের ভালোটাই বোঝে না। অন্যের কথা আগে ভাবে! বন্ধুমহলের আড্ডায় এই বিষয়ে কতোটা হেসেছিও। শুধু যতদিন পর্যন্ত না তুমি আমার জীবনে এলে আর আমার ভাবনার জগতে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে ফেললে। কিন্তু এখন, অবশেষে আমি এই অনুভূতিটা জানি। আমি জানি, কেন কারো জন্য নিজের সবটুকু উজার করে দিতে ইচ্ছে হয়। কেন তার মুখের হাসিটা সবথেকে বড় অর্জন মনে হয়। কেন কারো দুঃখ সব নিজের নামে মালিকানা করে ফেলারও সাধ জাগে। আর, এই অনুভূতিটা………. সবথেকে সুন্দর। সত্যি! আমাকে এই অনুভূতিটা উপলব্ধি করতে সুযোগ দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ হৃদি। তবে ছোট্ট একটা আফসোসও হয়। আই উইশ, এই অনুভতিটা নয় বছর আগেই আমি অনুভব করতে পারতাম! প্রথম দেখায় তোমার মতো আমিও তোমার প্রেমে পড়তাম! লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখে কল্পনায় আমিও তোমার ছবি আঁকতাম। একটা দুটো ভরে ফেলতাম ডায়েরির পাতা, আমার নিখাদ অজস্য অনুভূতিতে। মাঝে এতগুলো বছর নষ্ট না হতো। তুমি তো আমার সম্পূর্ণ পৃথিবীটাই বদলে দিয়েছো হৃদি। তোমার মতো করে এতো ভালো আমাকে আর কে বাসতে পারবে? এখন আমি বুঝতে পেরেছি কেন দাদীমা তোমাকেই আমার জন্য বাছাই করেছিল। আসলে আমাদের জীবনে সবথেকে প্রয়োজনীয় হলো মানসিক শান্তি। দিনশেষে আফসোস হীন একটা প্রশান্তির ছাপ নিয়ে ঘুমানো। যেটা অনেক দামী দামী জিনিস থেকেও পাওয়া না যেতে পারে আবার কোন ক্ষুদ্র বিষয় থেকেও পাওয়া সম্ভব। জীবনে মানসিক শান্তি দেওয়া একটা মানুষের সবথেকে প্রয়োজন। আর এই মানসিক শান্তিটা আমি তোমার থেকে পেয়েছি। তোমাকে নিজের জীবনে পেয়ে সেই প্রথম আমি এমন সময় কাটিয়েছি। সবকিছু অন্যরকমই সুন্দর হয়ে উঠেছিল। তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমার মতো একটা আবেগহীন মানুষের মনেও অনুভূতির সঞ্চার করে ফেলেছো। তুমি আমাকে বুঝিয়েছো জীবনে ভালো থাকা বলতে আসলে কাকে বলে। আর এর জন্য আসলে কি প্রয়োজন। প্রকৃত সুখ কিসে পাওয়া যায়। যেখানে যোগ্য অযোগ্য বিষয়গুলোও আর ম্যাটার করে না। সবথেকে বড় সাহায্য তো এটাই তাই না! তুমি সবসময় একটা কথা বলতে যে তুমি কখনোই আমার নাগাল পাও না। যদি এমনই হয় তাহলে না হয় আমি তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াবো হৃদি। সবসময় পাশাপাশি থেকে আমরা একসাথে সামনে আগাবো। এতেও কি হতো না?

তুমিই বলেছিলে যারা ভালোবাসে তারা শুধু ভালোবাসার মানুষের ভালো চায়। তাহলে কি তুমি এটা জানো না, ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে থাকাটা আসলে কতোটা যন্ত্রণার! সেই কষ্টটাই আমাকে উপহার দিয়ে এই এক জনমে তুমি কেন আমাকে এই পৃথিবীর সবথেকে দূর্ভাগ্যবান মানুষ বানাতে চাইছো হৃদি? ভালোবাসার এত বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তুমি কি করে আমার ভালোবাসা না চিনতে পারলে হৃদি? এই কটা দিনে তুমি কি একবারও আমাকে দেখে বোঝোনি যে আমার তোমাকে কতটুকু প্রয়োজন? আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি!
————–

বাক্সের মধ্যে রাখা একটার পর একটা সাদা কাগজে রাইয়ানের হৃদিকে নিয়ে লেখা এতদিনের সকল অনুভূতির কথা পড়তে পড়তে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল হৃদির। শেষের এই চিঠিটা পড়তে গিয়ে হৃদি আর নিজেকে শক্ত রাখতেই পারলো না। কান্নায় ভেঙে পড়লো। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। পড়তেও কষ্ট হলো। তবুও বারবার মাথা ঝাঁকিয়ে পড়তে লাগলো হৃদি। পড়তে পড়তে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো। চিঠিটা পড়া শেষ হতেই হাতের সব কাগজগুলো হাত থেকে পড়ে গেলো হৃদির। ছোট্র কামরার মেঝেতে পায়ের কাছে মৃদু উড়ে উড়ে লুটিয়ে পড়তে লাগলো কাগজগুলো। সেগুলোর মধ্যেই ব্রেসলেট হাতে এক ছুটে দ্রুত বেরিয়ে গেলো হৃদি। প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো। শেষের চিঠিটা পড়ে হৃদি যা বুঝেছে, রাইয়ান কিছুক্ষণ আগেই এটা লিখেছে। এবং সেখান থেকেই হৃদি জেনেছে রাইয়ান এয়ারপোর্টে গেছে। যে করেই হোক তাকে আটকাতে হবে হৃদির। একটা সিএনজি নিয়ে হৃদি সোজা চলে গেলো এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে ভাড়া মিটিয়েই কাঁদতে কাঁদতে আবারো রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগলো হৃদি। রাইয়ানকে হারানোর প্রচন্ড ভয়ে বুকের মধ্যে দুরুদুরু করতে লাগলো তার। কোনমতে এয়ারপোর্টের প্রবেশ দ্বারে এসে পৌঁছালো হৃদি। ভেতরো ঢুকতে চাইলো। কিন্তু বাঁধ সাধলো গেটে থাকা গার্ড। আটকে ফেললো তাকে। হৃদি ফোলা ফোলা চোখমুখ নিয়ে গেটে থাকা গার্ডকে অনুরোধ করলো তাকে ভেতরে যেতে দিতে। এর মাঝে ভেতরে তাকিয়ে বারবার ডাকতেও লাগলো ‘রাইয়ান, রাইয়ান’ বলে। হৃদিকে আটকানোর মধ্যেই গেটে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ গার্ডটির নজর পড়লো হৃদির গলায় ঝোলানো অফিসের আইডি কার্ডে লেখা হৃদির নামের দিকে। হাতের সবুজ ব্রেসলেটটিও নজর আটকালো তার। একেবারে হুবহু বর্ণনার মতো। আবার রাইয়ানও!
একটু খটকা নিয়েই সে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
‘আপু, আপনি কি সেই হৃদি যিনি অনলাইনে গল্প লিখেন?’
হৃদি আস্তে করে মাথা নাড়ালো। ছেলেটি খুশি হয়ে বলে উঠলো, ‘আপু, আমি আপনার সব গল্প পড়েছি। কি দারুণ আপনার গল্পগুলো। আর মাই ফার্স্ট ক্রাশ হ্যাসট্যাগের সাথে আপনার নিজের ভালোবাসার কাহিনীটা! সেটা তো আমার সবথেকে প্রিয়। আমি কক্ষনো বাদ দেই না।’
হৃদির উদ্বেগ দৃষ্টি শুধু এয়ারপোর্টের ভেতরে দেখে ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো,
‘আপু, কোন সমস্যা হয়েছে? আমি কি কোন হেল্প করতে পারি।’
হৃদি তাড়াতাড়ি বললো, ‘আমাকে প্লিজ একটু ভেতরে যেতে দিন। রাইয়ান চলে যাচ্ছে।’
‘ভেতরে তো যেতে দিতে পারবো না আপু। রুলস নেই। তবে আমি গিয়ে চেক করতে পারি। সে কোন ফ্লাইটে যেতে পারে?’
হৃদি এক নিঃশ্বাসে বলল, ‘ইউএস।’
গার্ড ছেলেটি ভেতরে গিয়ে কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে মন খারাপ করে বলল, ‘আপু, ইউএস এর ফ্লাইট তো আরো ত্রিশ মিনিট আগেই চলে গেছে।’

কথাটি শুনে একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো হৃদি। চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠলো বেদনার নীল ছায়া। এই বুঝি ডুকরে কেঁদে উঠে। হৃদি আস্তে আস্তে চলে এলো সেখান থেকে। বুক ফেটে কান্না এলো তার। এয়ারপোর্টের বাইরেই একটা উঁচু ঢিবির মতো জায়গায় বসে বসে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো। এমন সময় পেছন থেকে একটা ডাক শুনলো,
‘হৃদি!’
কাঁদতে কাঁদতেই পেছনে তাকালো। দেখলো রাইয়ান দাঁড়িয়ে আছে। এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলো হৃদি। নিঃশ্বাস না ফেলেই পাগলের মতো দৌড়ে যেতে লাগলো রাইয়ানের দিকে। পায়ে পা বেজে পড়ে যেতে নিলে তাড়াতাড়ি এগিয়ে হৃদিকে ধরে ফেললো রাইয়ান। সেদিকে খেয়াল না দিয়ে রাইয়ানকে হাতের কাছে পেয়েই কাঁদতে কাঁদতে ব্যাকুল হয়ে রাইয়ানকে জড়িয়ে ধরলো হৃদি। রাইয়ান মৃদু হেসে বলল, ‘কি ভেবেছিলে আমি চলে যাচ্ছি? আমি কি সেটা লিখেছি! আমি তো এয়ারপোর্টের কাছে রাস্তার পাশের একটা টং দোকানে টিস্যু দেওয়া মালাই চা খেতে এসেছিলাম।’

এই বলে একটু হাসলো রাইয়ান। রাইয়ানের ঘাড়ে মুখ রেখে তখনও কেঁদে যাচ্ছে হৃদি। রাইয়ান বলল,
‘এই যে ধরলে, ভেবেচিন্তে রাখো। আর কখনোও কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। যাই হয়ে যাক, আমাকে নিজের থেকে কখনোও দূর করবে না। শুধু ভালোবাসবে।’

কাঁদতে কাঁদতে বাধ্য মেয়ের মতো দ্রুত মাথা দুলায় হৃদি। হৃদির মাথায় হাত রেখে স্মিত হেসে রাইয়ান বলল, ‘চলো একসাথে বাড়ি ফিরে যাই হৃদি। তুমি, আমি আর মিঁয়োর সেই ছোট্ট পরিবারটায়। আমাদের বাড়ি আমাদের অপেক্ষা করছে।’

অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা নেড়ে হৃদি আবারো তার সম্মতি জানায়। খুশি হয়ে হৃদিকে ভালোবাসার আরো উষ্ণতা দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাইয়ান। ভালোবাসার এক বিশাল সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার জন্য তো এখনও তাদের সারাজীবনই বাকি।
___________________________________________________

(হৃদি)
হাজার হাজার সুসজ্জিত ফুল দিয়ে সাজানো একটি ওয়েডিং ভেন্যু। একটু বুঝি ভুল হয়ে গেলো! আমার আর রাইয়ানের রিসিপশন ভেন্যু। আমাদের সকল আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব সবাই আমন্ত্রিত। ফ্লোরিডায় ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই দাদীমা আর বাবা মিলে আমাদের জন্য বিয়ের পরের বাদ থাকা এই রিসিপশনের আয়োজন করেন। তবে এই আয়োজনের যাবতীয় ভার নিয়েছিল রাইয়ান। ফুল থেকে শুরু করে থিম কালার সবকিছু একটা একটা করে নিজে থেকে ঠিক করেছে সে। তার সবকিছু যে একদম পারফেক্ট হতে হবে। থিম কালারটা আমার পছন্দের স্কাই ব্লু। সবকিছুতেই আমার পছন্দের প্রায়োরিটি। যা রাইয়ান নিজে থেকে চুজ করেছে। অথচ ওয়েডিং প্লানারের উপর ছেড়ে দিলেও যা অনায়াসে হয়ে যেতো। কিন্তু না! আমাদের বিয়েটা নিয়ে রাইয়ান যতোটা না বেখেয়াল ছিল, রিসিপশন নিয়ে ততই বেশি সোচ্চার সে। সবকিছুর মূলে ছিল আমাকে একটা পারফেক্ট রিসিপশন সেরিমনি দিয়ে সারপ্রাইজ দেওয়া। আর সত্যিই একদম সারপ্রাইজড আমি। আজকের সবকিছুই সুন্দর। দিনটাও সুন্দর। আবহাওয়াটাও সুন্দর। এমনকি মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ডেভিড যে কটকটা রঙের কাপল স্যুট পরে এসেছে সেটাও যেন সুন্দর। আজ তো সুন্দরেরই দিন। আজ যে আমার আর আমার রাইয়ানের দিন। আমার রাইয়ান! আমার জীবনের সেই ফার্স্ট ক্রাশ। যাকে সত্যিকার অর্থেই অবশেষে নিজের করে পেলাম আমি। আমার প্রিন্স চার্মিং এখন সত্যিই আমার। যাকে আমি ভালোবাসি। এবং যিনিও এখন আমাকে ভালোবাসেন। যদিও এই পর্যন্ত আসতে আমাকে অনেক কাঠখোর পোড়াতে হয়েছে। তবে সমস্যা নেই। শেষ ভালো যার সব ভালো তার। আজকে আমি অনেক খুশি। এতো অনেক যে আমার চেপে রাখা দুষ্কর হয়ে পড়ছে। কিন্তু রাখতে তো হবেই। নিউলি ওয়েড ব্রাইড আজ আমি। তবে চিন্তা নেই, বেশি ওভারডোজ হলে কাছে ওয়াশরুম তো আছেই। রিমেমবার?
___________________________________________________

হৃদি আর রাইয়ানের রিসিপশনের আউটডোর ভেন্যু সমাগম হয়ে আছে উপস্থিত সকল গেস্ট-এ। অনেক বড় আয়োজন। তাই গেস্টের সংখ্যাও অনেক। হৃদি আর রাইয়ানের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সেরও প্রায় সবাই এসেছে। এসেছে ওদের পুরোনো নেইবার হুডের সকলেও। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজনে মুখরিত হয়ে আছে পরিবেশ। সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে ভেন্যুর সাজসজ্জা দেখছে। সবকিছু এতো সুন্দর! সেলফি তোলাতেও ব্যস্ত হয়ে পরেছে একেকজন। দাদীমাও আজ কম কিসে। ছেলেকে ক্যামেরামেন বানিয়ে একের পর এক পোজ দিয়ে ছবি তুলে যাচ্ছেন তিনি। ভেতরে ভেতরে এই বৃদ্ধ মহিলাটিই আজ সবচাইতে খুশি। যার বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখেও। তিনি যেমনটা ভেবেছিলেন ঠিক তাই হয়েছে। আশা পূর্ণ হয়েছে তার। ভাগ্য ভালো ডি’সোজারও আজ তাই একটাও বকা খেতে হয়নি। আর মিঁয়ো মশাইও কিন্তু থেমে নেই। কালো স্যুট আর বো টাই পরে একটা সানগ্লাস চোখে নিয়ে বিশেষ করে তার জন্য সেট করা গোলাকার উঁচু গদিতে সেই একটা ভাবের সাথে আয়েশ করে বসে আছেন তিনি। কিছু কিছু গেস্ট ইমপ্রেসড হয়ে একে একে তার পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে নিচ্ছে। রাইয়ানের পুরনো বন্ধু বান্ধবও সব এসেছে। বিশেষ কাজে অ্যালেন শহরের বাইরে থাকায় আসতে পারেনি। তবে হৃদি আর রাইয়ানের সুখী জীবনের কামনায় শুভেচ্ছা জানিয়ে ফুলের তোরা পাঠাতে ভুলেনি। বাংলাদেশে হৃদির অফিসের সকলকেও ইনভাইট করা হয়েছিল। এত দূর থেকে আসা সম্ভব না বলে তারাও মেসেজ শুভেচ্ছা জানিয়েছে হৃদি আর রাইয়ানকে। এতদিনে রাইয়ান হৃদির সম্পর্কের সত্যটা তাদেরও জানা। জিশানের পরনে একটা গাড় নীল রঙের ব্লেজার। বন্ধুদের সাথে গল্প করে ছবি তোলার জন্য তাদের টানাটানিতে স্টেজে এসে দাঁড়াতেই পাশে পায় জেরিনকে। জেরিনের পরনে হালকা বেগুনি রঙের সুন্দর একটি ফ্রক। অন্যদিনের চাইতে একটু বেশিই যেন আজ ভালো লাগছে তাকে। আড়চোখে একবার জেরিনের দিকে তাকিয়ে জিশান বলল,
‘আমার সামনের বাসাটা কিন্তু এখনও খালিই পরে আছে।’
জেরিন সামনে চোখ রেখেই ছবির জন্য হাসিমুখে পোজ দিয়ে রেখেই বলে,
‘থাকবেই তো। একটা পাগল সহ্য করার জন্য সবাই তো আর আমার মতো ধৈর্যশীল হয় না।’
‘এতো ধৈর্যশীল বলেই কি পালিয়ে গিয়েছিলেন।’
‘সামনের মাসেই আসছি।’
‘ধন্যবাদ মিস. নেইবার। কৃতজ্ঞ করলেন। ওহ! একটা কথা, রাইয়ান আর হৃদিও না প্রথমে নেইবার ছিল? আমার মনে হয় নেইবার লাভ ক্যামিস্ট্রিগুলো একটু বেশিই দারুণ হয়।’
এই বলেই জিশান মিটিমিটি হাসতে লাগলো। মুচকি হাসলো জেরিনও।

অনুষ্ঠান শুরু হবার সময় হয়ে গেলো। ব্রাইড আর গ্রুম এর জন্য খালি করে দেওয়া হলো স্টেজ। বিশাল একটা স্টেজ। দু দিক দিয়ে চলে গেছে প্রবেশদ্বারের লম্বা পথ। একটা বরের জন্য আর একটা কনের জন্য।
দু পাশ দিয়ে দুজন এসে স্টেজের মাঝখানে দাঁড়াবে। এমনই করেই সবকিছু সাজানো। স্টেজের সামনে দাঁড়ানো সকল গেস্ট অধীর আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করে আছে ওদের আগমনের জন্য। এমন অপেক্ষার মধ্যে সবার প্রথমে দেখা গেলো রাইয়ানকেই। একদম হালকা আকাশি রঙের ব্লেজার স্যুট পরনে আজকের হ্যান্ডসাম স্টার।
___________________________________________________

(রাইয়ান)
নতুন করে আবারো একটু পরিচয় দেই। আমি রাইয়ান। আজকের অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুর বিশেষ একজন। আর আমার সামনেই দাঁড়ানো হালকা আকাশি রঙের লং গাউন পরনে আমার চোখে এই পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর মেয়েটি। দ্যা মোস্ট প্রিটিয়েস্ট ব্রাইড। মাই ওয়াইফ! যে তার মায়া জড়ানো নম্র মিষ্টি হাসি মুখে ছড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে আমারই দিকে। তার গলায় আমার দাদীমার দেওয়া একটা সুন্দর নেকলেস। খোলা চুলগুলো দুপাশ দিয়ে কিছুটা সামনে এনে রাখা। তার পাশের শুভ্রতা ছড়ানো ফুলগুলোর মতোই একদম পবিত্র সে। জলের মতো স্বচ্ছ তার মন। চোখগুলো যেন মায়ায় ভরা। হাসিতে নিষ্পাপত্ব। যাকে পেয়ে সত্যিকার অর্থেই আমি আজ ধন্য। তাকে পাওয়ার গর্ব ভরা বুক নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে আমিও তার দিকেই অগ্রসর হতে লাগলাম। আজ আমার মধ্যে কোন দ্বিধা নেই। কোন কনফিউশান নেই। আমি বিনা বিভ্রান্তিতেই বলতে পারি, এই মেয়েটিকে পেয়ে আমি এই পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবান এবং সবথেকে সুখী একজন।

আমি আর হৃদি একে অপরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালাম। দুজনের দৃষ্টিতেই গভীর ভালোবাসা স্পষ্ট। গেস্টরা সবাই শব্দ করে উঠলো। গেস্টদের প্রফুল্লিত কলরবে হৃদি হেসে দৃষ্টি সামনে নেওয়ার মধ্যেই হঠাৎ অপ্রত্যাশিত একটি কান্ড করে ফেললাম আমি। পকেট থেকে একটা আংটির বাক্স বের করে হুট করেই হাঁটু গেঁড়ে হৃদির সামনে বসে পড়লাম। হৃদি বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাক্স খুলে ভেতরের হীরার আংটি উন্মুক্ত করে আমি স্পষ্ট গলায় জোরে বলে উঠলাম,

‘হৃদি, উইল ইউ স্পেন্ড ইউর হোল লাইফ উইথ মি?’

হৃদি খুশি হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার কথা শেষ হতেই হাসিমুখে জোরে বলল,
‘ইয়েস, আই উইল।’

গেস্টরা সবাই চিয়ার আপ করে উঠলো। হাত তালি দিতে লাগলো সবাই। আমি খুশি হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাক্স থেকে বের করলাম হীরার আংটি। যেটা পূর্বের মতো নিছক অবহেলায় কেনা নয়। গোটা জুয়েলারি শপ তন্নতন্ন করে ঘুরে একদম বেস্ট টা খুঁজেই কিনেছি আমি এই দামী আংটি। আমার দামী মানুষটার জন্য। আমি খুশির সাথে আংটি পড়িয়ে দিলাম হৃদির হাতে। হৃদি আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলো। হৃদির চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,
‘হৃদি, আই লাভ ইউ!’
হৃদিও হেসে আমাকে বলল, ‘আই লাভ ইউ টু রাইয়ান!’
সবাই আগের চাইতেও আরো জোরে হাত তালি দেওয়া শুরু করলো। এর মধ্যেই আমার কিছু ইংরেজ বন্ধুরা চেঁচাতে লাগলো বলে, ‘কিস হার! কিস হার!’
দেখতে দেখতে সবার মুখেই একই প্রতিধ্বনি বাজতে লাগলো। আমি মুচকি হেসে হৃদির দিকে তাকালাম।
ঘাড়ে হাত রেখে চুম্বকের মতো হৃদির কপালের কোণে লম্বা করে চুমু দিয়ে ধরলাম। হৃদি লজ্জা পেয়ে একটু সংকুচিত হয়ে মৃদু হেসে উঠলো। আমি ছাড়লাম না। বউ পাগল ছেলেটির মতো আটকে রইলাম আমার বউয়ের সাথে। এই ছোট্ট জীবনে আর দূরে থাকার ইচ্ছে নেই।

ওয়েল…..অবশেষে আমি বুঝতে পেরেছি আসলে বিয়ে নামক সম্পর্কটির জন্য সবথেকে প্রয়োজনীয় কি? মেন্টাল পিস! মানসিক শান্তি। যেটা আসে নিজের জন্য নিজের পার্টনারের ভালোবাসা থেকে। একে অপরের ভালোবাসা থাকে। আর এটা থাকলে স্যাটিসফেকশন, ট্যাটিসফেকশন এমনিতেই চলে আসে। অথচ আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটাকেই অদেখা করে রাখি। পার্টনারের মধ্যে এই কোয়ালিটি, সেই কোয়ালিটির বহর খুঁজে বেরাই। পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাই পারফেকশন। আর না পেলেই গোমড়া মুখ। ভালো লাগে না। গুরুত্ব দেই না। চোখ দেই বাইরে। বাট ট্রাস্ট মি, তোমার পার্টনারের মধ্যে যদি তোমার জন্য ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে আর কিচ্ছু লাগে না। একশো একটা কমতিও এখানে ফিকে হয়ে যায়। Because, Nobody is perfect but a love is always perfect.

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here