অগোচরে তুমি পর্ব -২২+২৩

#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার

২২.

ঘড়ির কাটা বলছে দশটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট।কাজী অফিসের ভেতরে বসে আছে কলি আর তনিমা।আর দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছটফট করছে মেহেনূর।সূর্যের প্রখরতার জন্য চোখ ধরা যাচ্ছে না।ডান হাতে থাকা মোবাইলটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতটা কপালের উপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে রাস্তার দিকে তাকালো।সারা রাস্তায় একটা গাড়িও দেখা যাচ্ছে না।ওইদিকে কাজী সাহেব তাড়া দিচ্ছে বার বার।উনাকে আবার অন্যকোথাও নাকি বিয়ে পড়ানোর জন্য যেতে হবে।মেহেনূর একটু উঁকি দিয়ে কাজী অফিসের ভেতরটায় দেখে নিলো।কলি চুপচাপই বসে আছে।তনিমা সারা ঘর জুড়ে হাটছে আর একটু পর পর কাজী সাহেবকে বাচ্চাদের মতো এটা ওটা জিজ্ঞাস করে উনার মাথা বিগড়িয়ে দিচ্ছে।কাজী সাহেব ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে যখন বিরক্ত তখন এক ধমক দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে বসিয়ে রাখে।এমনিতেই তার দেরি হয়ে যাচ্ছে তারউপর তনিমার যত আজগুবি কথাবার্তা।তনিমা কাজীর দিকে মুখ ভেংচি দিয়ে কলির পাশে গিয়ে বসে।মেহেনূর ঠোঁট টিপে হেসে আবার দৃষ্টি সড়িয়ে নেয়।অদূরেই একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে।হাতে থাকা গোল্ডেন ফিতের ঘড়িটায় এক পলক তাকিয়ে সময়টা দেখে নিলো মেহেনূর।দশটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট।কাজী অফিসের সামনে পর পর দুইটা গাড়ি এসে থামলো।প্রথম গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসলো রাওনাফ আর রোশনি।অপর গাড়ি থেকে অর্ক, দিহাদ, অয়ন আর রোশান।মেহেনূর সবাইকে নিয়ে কাজী অফিসের ভেতরে চলে যায়।

– কলি তুই বিয়ে করছিস?

উৎকন্ঠিত স্বরে অয়নের বলা কথাটা শুনতে পেয়ে সবাই চকিতে তাকালো অয়নের দিকে।অয়নের দৃষ্টি স্থির দরজার বাম পাশে পেতে রাখা সোফাটায়।অয়নের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই তাকালো সেদিকে।কলি লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে আছে।দিহাদ,অর্ক, অয়ন বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে কলির দিকে।অর্ক, অয়ন দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় কলির দিকে।ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো দিহাদ।ওর হৃদপিণ্ডটা কাজ করছে না।মনে হচ্ছে শরীরটা ক্রমশ দূর্বল হয়ে যাচ্ছে।বুকের ভেতরটায় চিনচিনিয়ে ব্যাথা করছে।গলা শুকিয়ে আসছে।

– কাকে বিয়ে করছিস তুই?

অর্ক অবাক হয়ে কলির দিকে প্রশ্ন ছুড়ল।সবার উপস্থিতিতে অর্কের এই প্রশ্নে কলি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।

– কি হলো বল?

কলির নীরবতায় অধৈর্য হয়ে অর্ক ফের বললো।কলি ইতস্ততভাবে আঙুল উঁচিয়ে দরজার দিকে ইশারা করলো।অর্ক দরজার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলল,

– দিহাদকে?

নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো দিহাদ।চটজলদি মুখ তুলে তাকালো কলির দিকে।চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের।লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় কলি।দিহাদ বিস্মিত হয়ে তাকায় মেহেনূরের দিকে।মেহেনূর মাথা উপর নিচ নেড়ে দিহাদকে আশ্বস্ত করে যে,ও যেটা শুনতে পেয়েছে সেটা সত্যি।দিহাদ চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস টানে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুখে হাসি ফুটিয়ে সম্মুখে এগোয়।

_________________

মাহবুব সাহেবকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করছে কলি।এই মানুষটা ওর বাবার অভাবটা কিছুটা হলেও পূরণ করেছেন।ওর দুঃসময়ে একমাত্র এই মানুষটাই তো ওর পাশে ছিল।ওর জন্মদিনে ওকে রাত বারোটায় ঘুম থেকে তোলে সারপ্রাইজ দিতেন প্রতিবার।কলি রেজাল্টে খুশি হয়ে পাড়ার সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতেন।অনেক সময় কলি না চাওয়া সত্ত্বেও অনেক কিছু পেয়েছে এই মানুষটার কাছ থেকে।কলির কাছে মাহবুব সাহেব ওর বাবার সমতুল্য। একজন বাবা তার সন্তানের জন্য যতটা করেন, মাহবুব সাহেবও নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছেন।কলি এই মানুষটার কাছে চিরঋণী।মাহবুব সাহেবও কলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চোখের জল ফেলছেন।কলিকে তিনি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।যদিও তিনি অনেক ক্ষেত্রে অপারগ ছিলেন। তাও তিনি সাধ্যমতো কলিকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন।

আজ যেন কলির কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।কিছুতেই ওর কান্না থামছে না।আকলিমা বেগমও (মাহবুব সাহেবের স্ত্রী) এসেছেন।তিনিও নীরবে চোখের জল ফেলছেন।এই অনাথ মেয়েটার প্রতি এতটা নির্দয় না হলেও পারতেন।হয়তো সেটাই ভেবেই কাঁদছেন।মেহেনূর চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে অমায়িক হাসি।কাউকে হাসি খুশি দেখলে ওরো ভালো লাগে।দিহাদের চোখে মুখে কৃজ্ঞতামিশ্রিত তৃপ্তির হাসি।মেহেনূর এমন কিছু করতে চলেছে এটা দিহাদের কল্পনাতেও ছিল না।

অর্ক হতভম্ব হয়ে শুধু দাঁড়িয়েই রইলো সারাটাক্ষণ।এখানে কি ঘটলো এতক্ষণ সবটা এখনো ওর কাছে ধোঁয়াশা।সকালে অয়ন গিয়ে ওকে ডেকে তুলে বলে যে,কাজী অফিস যেতে হবে।অর্ক কারণ জানতে চাইলে অয়ন বলল,মেহেনূর বলেছে কার যেনো বিয়ে আছে, কয়েকজন সাক্ষী লাগবে।নিজের ঘুম নষ্ট করে কার না কার বিয়ের সাক্ষী হতে ওর বয়েই গেছে।আর, মেহেনূর বলেছে বলেই কি কারোর বিয়ের সাক্ষী হওয়ার জন্য কাজী অফিস চলে যেতে হবে নাকি!অর্ক অয়নের কথায় পাত্তা না দিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। পরে আবার রাওনাফ ওকে ডেকে সজাগ করে জোর করে নিয়ে আসে।রাওনাফকে বার বার জিজ্ঞাস করেছিল কার বিয়ে?মেহেনূরের কি হয়? কিন্তু রাওনাফ বললো ও নিজেও জানে না,মেহেনূর শুধু ওদেরকে যেতে বলেছে।ওরা আসার পথে দিহাদকে ওর বাসা থেকে নিয়ে এসেছে।দিহাদও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল!অর্কের যতটা মনে হচ্ছে, দিহাদ নিজেও জানতো আজ ওর বিয়ে।মেহেনূর কেন করলো এটা?দিহাদ টু শব্দটাও উচ্চারণ করলো না?চুপচাপ বিয়েটা করে নিলো?ওদের মধ্যে প্রেম ছিল?তাহলে দিহাদ কেন এত আশ্চর্য হয়েছিল?যদি তাই হয়,তবে মেহেনূর কিভাবে জানলো সে কথা?ও কিভাবে কি করলো?

তবে অর্ক এটা ভেবে খুব অবাক হচ্ছে যে,এইটুকু একটা মেয়ের মাথায় এত বুদ্ধি আর এত ক্যাপাবিলিটি কিভাবে থাকে?কলি আর দিহাদের বিয়ে পড়ানোর ঠিক আগ মুহুর্তে কলির মা বাবা এখানে এসে উপস্থিত হন।তারাও নির্দ্বিধায় বিয়েটা মেনে নেন,কিচ্ছু বলেন নি।দিহাদের বাবা মা স্বশরীরে এখানে উপস্থিত না থাকতে পারলেও মেহেনূর ভিডিও কল করে তাদেরকেও এই বিয়ের সাক্ষী হিসেবে রেখেছে।উনারাও হাসি মুখে ছেলের বিয়ের মোনাজাতে হাত তুলেছেন,কিচ্ছু বলেন নি।কিভাবে পসিবল এটা?

অর্কের মাথায় কিছুই ঢুকছে না।অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়।ওর সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মেহেনূরই দিতে পারবে।অর্ক পুরো রুমে একবার চোখ বুলালো। কিন্তু কোথাও মেহেনূরকে দেখতে পেলো না।তনিমা,অয়ন আর রোশান ওদেরকেও দেখতে পাচ্ছে না।রাওনাফের কাছ থেকে জানতে পারলো ওরা নাকি চলে গেছে।অদ্ভুত!কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে?

___________________

আজকে রাওনাফ আর রোশনির বিয়ের রিসেপশন।বাসায় কত কাজ।সকাল সকাল বাড়ির ছেলে,মেয়ে, বউ সবাই মিলে কোথায় চলে গেল?এখনো ওদের ফেরার নাম গন্ধ নেই।প্রায় বিকাল হয়ে এলো বলে।একটু পর গেস্টরাও আসতে শুরু করবে।গেস্টরা এসে দেখবে যাদের বিয়ের জন্য এত আয়োজন তাঁরাই বাসায় নেই।

রেনুফা বেগম মেহেনূরকে কল দিয়ে এককুঁড়ি কথা শুনিয়েছেন।মেয়ের কোনো কান্ডজ্ঞান নেই।ভাইয়ের বিয়ে, আর ও বাড়ির বাইরে গিয়ে বসে আছে।রেনুফা বেগম কল করলে মেহেনূর ওর মাকে বলল,বর কনে বাসায় চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। আর ওর একটু কাজ আছে,সেটা শেষ করে সন্ধ্যা আগেই বাসায় ফিরে আসবে।

অর্ক,রাওনাফ আর রোশনি এক গাড়িতে আসছে।আর অর্কের গাড়িটা দিহাদকে দিয়ে এসেছে।কলি আর দিহাদ আপাতত মেহেনূরদের বাসায়ই যাচ্ছে।মেহেনূরই বলেছে ওদের বাসায় যাওয়ার জন্য।দিহাদ ড্রাইভ করছে আর কলি ওর পাশে বসে এখনো নীরবে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে।মাঝে মধ্যেই ফুঁপিয়ে উঠছে।কলির এত কান্না করাটা দিহাদের সহ্য হচ্ছে না। কলিকে কি বললে ওর কান্না থামাবে দিহাদ সেটাও বুঝতে পারছে না।দিহাদ কলির মাথাটা আস্তে করে ওর কাঁধে রেখে কলিকে এক সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।কলি যেনো এতক্ষণ এটারই অপেক্ষায় ছিল।কলিও দিহাদকে জড়িয়ে ধরে আবার হুহু করে কেঁদে দেয়।দিহাদ কলির মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শুধু শান্ত করার চেষ্টা করছে।কিন্তু কি বলে সান্ত্বনা দেবে ওর শব্দভান্ডারে যতেষ্ট শব্দ মজুদ নেই।মিনিট দুয়েক পরেই দিহাদ গাড়ির ব্রেক কষে।কলি মুহূর্তেই কান্না থামিয়ে চকিত দৃষ্টিতে তাকায় দিহাদের দিকে।দিহাদ একটা রুদ্ধশ্বাস ফেলে কলির দুগাল ধরে কপালে একটা চুমো দিয়ে করুন স্বরে বললো,

– প্লীজ আর কাঁদিস না।তোর কান্না আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।

ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসার প্রথম চুম্বন।মনে এক অন্যরকম শিহরণ,ভালো লাগা।বুকের ভেতরটা ধুকপুক ধুকপুক করছে।রগে রগে শীতল কিছু ছুটাছুটি করছে তীব্রভাবে।মনে হচ্ছে সারা শরীর থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।ওরা যতই পূর্বপরিচিত, বন্ধুই হোক না কেন, এখন ওদের মধ্যে সম্পর্কটা আলাদা।লজ্জা ভয় দুটোই খুব করে ঘিরে ধরেছে কলিকে।দিহাদের দিক থেকে চোখ সড়িয়ে মাথা নিচু করে নেয়। দিহাদ মৃদু হেসে বললো,

– আর কাঁদবি না, ঠিক আছে।

কলি মুখে কিছু বলল না। মাথা নেড়ে সায় দিলো,ও আর কাঁদবে না।দিহাদ কলির লজ্জা পাওয়া দেখে মুচকি হেসে ফের গাড়ি স্টার্ট দেয়।কলি লজ্জায় আর দিহাদের দিকে তাকাতে পারছে না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে।

___________________

রাত দশটা।ড্রাইভিং সীটে বসে আছে মেহেনূর,ড্রাইভ করছে।ঠিক ওর পাশেই বসে আছে কলি।আর ওদের পিছনে বসে আছে দিহাদ,অয়ন,আর তনিমা।সবাই দিহাদের বাসায় যাচ্ছে ওদের দিয়ে আসার জন্য।দিহাদ চেয়েছিল কলি যাতে ওর পাশে বসে।কিন্তু তনিমা বাগড়া দিয়ে নিজে বসে পড়ে।বেচারা দিহাদ ভেবেছিল, বউয়ের হাত ধরে রোমান্টিক মুডে একটু খোশগল্প করবে।কিন্তু তনিমা আর অয়নের জন্য সেটা পারলো না বিধায় মুখ গোমড়া করে বসে আছে।অয়ন,তনিমা যা-তা বলে ওকে খেপাচ্ছে।দিহাদ শুধু সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে।নেহাতি এখানে মেহেনূর আছে,নয়তো এই দুটো বাদড়কে ঘাড় ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতো সেই কখন।কলি দিহাদের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছে।মেহেনূরও হাসছে তবে মনে মনে।ভালোবাসারা পূর্ণতা পেলে মেহেনূরের খুব ভালো লাগে।”বিচ্ছেদ অনেক কষ্ট দেয়,মোমের মতো মনটাকে ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দেয় এক নিমিষেই।অথচ যখন এই ভালোবাসারাই পূর্ণতা পায় তখন মনে হয় জীবনের সেরা প্রাপ্তি হয়তো এটাই।”

মেহেনূর দিহাদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামায়।তনিমা, অয়ন সবার আগে গাড়ি থেকে নেমে আসে,তারপর মেহেনূর।দিহাদ নেমে এসে সামনের দরজাটা খুলে হাত বাড়িয়ে দেয়। কলি দিহাদের হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে আসে।তনিমা কলির কাছে গিয়ে ছটফট করে খুশিতে গদোগদো হয়ে। বললো,

– কলি, চল বাসায় চল।জানিস আজ কি করে…..

তনিমা ওর পুরো কথা শেষ করার আগেই অয়ন এসে ওর মুখ চেপে ধরে।মেয়েটার একদমই কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই।কত করে বলেছে ওর মুখটা যাতে একটু বন্ধ রাখে।কিন্তু তা না করে সারাক্ষণ শুধু বকবক করেই যাচ্ছে।তনিমার মুখ চেপে ধরায় দিহাদ কলি দুজনেই অবাক হয়ে তাকায় অয়নের দিকে।অয়ন মেকি হেসে তনিমার মুখটা ছেড়ে দিয়ে তনিমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– তুই আজ কি করেছিস না করেছিস সেগুলো কি এখনই বলতে হবে তোর?

অয়ন চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে তনিমার দিকে।তনিমা কিছু একটা আন্দাজ করে সবাইকে তাড়া দিয়ে বললো,

– চল তো তোরা ভেতরে চল।

– না তনিমা আপু।

মেহেনূরের কথা শুনে সবাই দাঁড়িয়ে যায়।সবাই মেহেনূরের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালে মেহেনূর মৃদু হেসে বললো,

– অনেক রাত হয়ে গেছে আপু।তোমাকে আর অয়ন ভাইয়াকে ড্রপ করে দিয়ে আমাকে আবার বাসায় ফিরতে হবে না।আমার ভাইকেও তো বাসর ঘরে পাঠাতে হবে।

– তাই বলে গেইট পর্যন্ত এসে বাসায় না গিয়ে চলে যাবে?

দিহাদের প্রশ্নে মেহেনূর সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,

– অন্যদিন আসবো ভাইয়া।আজ আসি।

মেহেনূর গিয়ে কলিকে জড়িয়ে ধরে বললো,

– তোমাদের নতুন জীবনের জন্য রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা আর ভালোবাসা।আল্লাহর কাছে দোয়া করি তোমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হোক।আসছি,ভালো থেকো।

কলিও মেহেনূরকে জড়িয়ে ধরলো।তনিমা এগিয়ে আসলে মেহেনূর সড়ে দাঁড়ায়।কলি তনিমাকেও জড়িয়ে ধরলো।কলি অয়নকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভিমানী স্বরে বললো,

– এখন থেকেই পর করে দিচ্ছিস?

অয়ন স্মিত হেসে এগিয়ে এসে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো কলি আর তনিমাকে।তিন বন্ধু ওইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ হলো।দিহাদ তনিমা আর অয়নকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

– অনেক হয়েছে ভাই।এবার আমার বউটাকে ছাড় তোরা।যা এখন বাসায় যা।

দিহাদের কথা শুনে কলি গোলগোল করে ওর দিকে তাকায়।দিহাদ সেইসবে পাত্তা না দিয়ে গলার স্বর উঁচু করে বললো,

– মেহেনূর বোন আমার।তুমি যাও তো এই মিচকে শয়তান দুটোকে গিয়ে বাসায় রেখে আসো।নয়তো দেখবে শেষে এরা আমার বাসরটাই ভেস্তে দিয়েছে।

দিহাদের এমন মুখ কাটা কথা শুনে কলির চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম।ছিঃ, এই ছেলে কি বলে এসব।লজ্জা শরম সব কি পুড়ে খেয়ে ফেলেছে নাকি?মুখে কিচ্ছু আটকায় না।তনিমা আর অয়ন চোখ রাঙিয়ে তাকায় কলির দিকে।ওদের চোখ বলছে,শুনলি তোর জামাইয়ের কথা শুনলি?কলি ওদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।কলির চোখের চাহনি বলছে,আমিও তো সেটাই ভাবছি,ও তো আগে এরকম ছিল না।মেহেনূর সবার মুখের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হেসে তনিমা আর অয়নের দিকে চোখ পাকিয়ে বললো,

– এই যে মিচকে শয়তানের দল,বাসায় চলো।

মেহেনূরের কথার ভঙ্গিমা দেখে সবাই হেসে দেয়।তারপর সবাই চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই দিহাদ ডাকল,

– মেহেনূর।

দিহাদের ডাকে পিছনে ফিরে তাকায় মেহেনূর।দিহাদ কলিকে নিয়ে এগিয়ে যায় মেহেনূরের দিকে। কলিকে এক হাতে জড়িয়ে রেখে কৃতজ্ঞচিত্তে বললো,

– তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।কিন্তু আজ তুমি যেটা করলে সেটা আমরা কোনোদিনও ভুলতে পারবো না।

– আমি কিছুই করি নি।যা কারার উপরওয়ালাই করেছেন।আমি তো শুধু মাত্র উছিলা।আসছি আমরা।বেস্ট অফ লাক।

_______________

– Welcome to your home and congratulations for your newly life.

দারোয়ান গেইট খুলে দিয়ে কলির হাতে একটা ফুলের তোড়া দিয়ে উক্ত বক্তব্য পেশ করে।দিহাদ দারোয়ানের কথা আর কাজে টাশকি খেয়ে যায়।ও নিজেই জানতো না যে,আজ ওর বিয়ে।সেই জায়গায় দারোয়ান কিভাবে জানলো?আবার ইংলিশে ওয়েলকাম করছে?এই ইংলিশই বা কবে শিখলো?কলি ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দিহাদের দিকে তাকালে,দিহাদ ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে বুঝায় ও কিছু জানে না।দিহাদ দারোয়ানের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,

– রহিম চাচা,তুমি কি জানলে এসব।

– হেইডা হরে কইতাছি।আগে এইডা কওছে হুনি,আমার ইংরেজিডা কেমন অইছে?

– তোমাকে এইসব করতে কে বলেছে?

– ভালা অইছে না?ওই ছেড়িডা তো ভালা মতোই কইছিন,আমারই মনে থাহে না।বার বার ভুইল্লেয়া যাই।আসলে হগলে তোমরারে যে ছেড়িডা গাড়িত্তে নামাইয়া তুইয়া গেছে এই ছেড়িডাই আমারে কইছিন,তোমরা যে বালা বাড়ির ভিত্রে ঢুকবা তহন এই কথাডা কইতাম।

দিহাদ বুঝতে পারছে দারোয়ান মেহেনূরের কথা বলছে।তাও দিহাদ প্রশ্ন করলো,

– মেহেনূর?ও কখন এসেছিল?

দারোয়ান দ্রুত মাথা ঝাকিয়ে বললো,

– হ,হ,মেহেনূর,দুপুরে আইছিন।

মেহেনূর দুপুরে এখানে এসেছিল শুনে কলি আর দিহাদ দুজনেই খুব অবাক হলেও দারোয়ানের সামনে কেউ কিছু না বলে বাসার ভেতরে চলে আসে।বাসার মেইন দরজাটা খুলতেই উপর থেকে শত শত গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। কলি আর দিহাদ আশ্চর্য হয়ে সেইদিকে তাকায়।হঠাৎ করেই কলির নজর পড়ে সিঁড়ি কাছে একটা হৃদয়াকৃতির সাইনবোর্ডে।সেটায় লেখা “ওয়েলকাম মিস্টার এন্ড মিসেস।” দিহাদ আর কলি উভয়েই রীতিমতো অবাক।ওদেরকে এইভাবে কেউ সারপ্রাইজ দিবে এটা ভাবতেও পারে নি।কলি একদৃষ্টে তাকিয়ে ওই লেখাটার উপর হাত বুলাচ্ছে।দিহাদ হুট করেই কলিকে কোলে তুলে নেয়।আকস্মিক এমন হওয়ায় কলি চমকে উঠে।পরমুহূর্তেই লজ্জায় মুখ লুকায় দিহাদের বুকে।দিহাদ কলিকে কোলে নিয়েই সিঁড়ির বেঁয়ে ওর ঘরে চলে যায়।দিহাদ ঘরে গিয়ে কলিকে ঠিক বিছানার মাঝখানটায় বসিয়ে দেয়।দরজাটা আগে থেকেই খোলা ছিল তবে একটু ভিড়ানো ছিল।ঘরের ভেতর শুধু একটা ড্রিম লাইট জ্বলছে।রুমের লাইট জ্বালানোর জন্য সুইচ টিপতেই দিহাদ আর কলির চক্ষু চড়াকগাছ।পুরো রুমটা রকমারি ফুল দিয়ে ডেকোরেশন করা।কলি বিছানা দেকে নেমে ঘুরে ঘুরে পুরো ঘরটা দেখছে।ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কিছু একটা দেখতে পেয়ে দিহাদ এগিয়ে যায় সেইদিকে।আয়নায় একটা চিরকুট লাগানো।দিহাদ চিরকুটটা হাতে নেয়।ওটায় লিখা,

“কি সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?অবশ্য আমি জানি,আপনাদের খুব ভালো লেগেছে!বেশি কিছু করতে পারি নি।ওইটুকু সময়ের মধ্যে এতটুকুই করতে পেরেছি।দুজনে মিলে একটু মানিয়ে নিবেন,কেমন।ড্রেসিং টেবিলের বাম পাশে দেখুন একটা বক্স রাখা আছে।ওইটায় ফ্লাইটের দুটো টিকিট আছে।এটা আমার ভাইয়া এবং আপুর জন্য, আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা গিফট।কাল দুপুর সাড়ে বারোটায় ফ্লাইট।এখন আপতত কক্সবাজার থেকে হানিমুনটা সেড়ে আসেন।তারপর না হয় হানিমুন ট্রিপ দিতে মালদ্বীপ গেলেন।”

চলবে………..#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার

২৩.

চারদিকে শুনশান নীরব নিঃস্তব্ধতায় ঘেরা।ফাঁকা রাস্তায় খুব ধীর গতিতে ড্রাইভ করছে মেহেনূর।মাঝে মধ্যে দু একটা গাড়ি ক্রস করছে।গাড়ির ভেতরের লাইটগুলো অফ করে দিয়ে সামনের জানালাগুলো খোলাই রেখেছে।চারদিকে ফুরফুরে সতেজ হাওয়া বইছে।জোনাকিরা দল বেঁধে রাস্তার দু’পাশে শোকসভা বসিয়েছে।দেখে মনে হচ্ছে,এক আকাশ তারা বোধহয় মাটিতে নেমে এসেছে।মেহেনূর একবার ভেবেছিল গাড়ির হেডলাইট গুলো অফ করে দিবে।জোনাকির আলোয় বাকি রাস্তাটা অনায়াসেই চলে যেতে পারবে।আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে শেষে থানায় গিয়ে এই সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হওয়ার বোকামিটা আর করলো না।লাইটগুলো থাক,তাও এইভাবেই বেশ লাগছে।আজ যদি এই গাড়িটা সাথে না থাকতো তাহলে নিশ্চিত ও এই ফাঁকা রাস্তায় হাটতো।এমন মনোরম স্নিগ্ধ মায়াবী রাতে খোলা আকাশের নিচে হাটতে কার না ভালো লাগে।অবশ্য এটা যদি কানাডা হতো তাহলে আর গাড়ির দোহাইও দিতো না।নিজের মনের তীব্র ইচ্ছাটাকেই প্রশ্রয় দিতো।তবে এই মুহুর্তে গুনগুনিয়ে একটা গান গাইলে মন্দ হয় না।এই ওয়েদারে এই গানটায় ওর মাথায় আসলো?মেহেনূর মুচকি হেসে সুর তুললো,

নীল আকাশের নিচে আমি
রাস্তা চলেছি একা!
এই সবুজের শ্যামল মায়ায়
দৃষ্টি পড়েছে ঢাকা
শনশন বাতাসের গুঞ্জণ চঞ্চল করে মন!
ডাক দিয়ে যায় এ দুটো চোখ!
আহা ও ও হো……..

গান গাইতে গাইতে লুকিং গ্লাসে এ ঝলক নজর পড়তেই ভ্রু কুঁচকে আসে মেহেনূরের।গান থামিয়ে গ্লাসের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে তাকায়।কেউ একজন বাইক নিয়ে ওর গাড়ির পিছন পিছন আসছে।মেহেনূর তুলনামূলক অনেক কম স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছে।আর এই হিসেবে ওই বাইকার ওকে ক্রস করে চলে যাওয়ার কথা।কিন্তু মেহেনূরের কেন জানি মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করে বাইকটাও আস্তে আস্তে চালানো হচ্ছে।তবে কি ওকে কেউ ফলো করছে?পরখ করে নেওয়ার জন্য মেহেনূর গাড়ির ব্রেক কষে।সাথে সাথে পিছনের বাইকটাও দাঁড়িয়ে পড়ে।আশ্চর্য,মেহেনূর অবাক হয়ে মাথা ঘুড়িয়ে পিছনে তাকায়।ও কিছু দেখে উঠার আগেই বাইকের হেডলাইটটা বন্ধ করে ফেলে।মেহেনূর কিছুক্ষণ সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে আবার গাড়িটা স্টার্ট দেয়।পরমুহূর্তেই মেহেনূর লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে বুঝতে পারে বাইকটা আবার ওর পিছুপিছু আসছে।মেহেনূর স্বাভাবিকের চেয়েও দ্রুত ড্রাইভ করছে।তবে ভয় পেয়ে নয়।পুরোপুরি কনফার্ম হওয়ার জন্য যে,বাইকটা ওকেই ফলো করছে।হুট করেই মেহেনূর আবার গাড়ি থামিয়ে দেয়।মুহূর্তেই বাইকটাও দাঁড়িয়ে পড়লো।মেহেনূর স্মিত হেসে ফের গাড়িটা স্টার্ট দেয়।সাথে সেই বাইকও।মিনিট দুয়েক পর মেহেনূর আবার সেই একই কাজ করলো।সেই সাথে ওর বাইকারও।মেহেনূরের কাছে এই বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে।অনেকবার একই ঘটনা রিপিট করে।ও বার বার এমন করছে দেখে আরেক বার ওই বাইকার ওকে ক্রস করে চলে যায়।মেহেনূর কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।পরমুহূর্তেই ওই বাইকারকে বিরক্ত করতে পেরে শব্দ করে হেসে উঠলো।

__________________________

ছাদে এসে দ্রুত পায়ে পাইচারি করছে অর্ক।সেই সকাল থেকে ওর মনটা অস্থির হয়ে আছে।কবে একটু মেহেনূরকে একা পাবে আর ও ওর মনে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।রাওনাফকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েই ছাদে চলে এসেছে অর্ক।ওর হাতে থাকা ফোনের বাটন চেপে সময়টা দেখে নিলো।এখন সময় একটা বেজে সাতাশ মিনিট।ঘড়ি ধরা সময়,এখন থেকে পঁচিশ মিনিট আগে অর্ক ছাদে এসেছে।মেহেনূর রাতে ঘুমানোর আগে প্রতিটি ছাদে আসে এ কথা অর্ক জানে।মেহেনূরই একদিন ওকে বলেছিল।তাছাড়া অর্ক৷ নিজেও বেশ কয়েক দিন দেখেছেও।এখন দেড়টা বাজে তো কি হয়েছে?রাত তিনটে বাজলেও মেহেনূর ছাদে আসবে।এ ক’দিনে মেহেনূরকে এতটুকু চিনতে পেরেছে অর্ক।

প্রায় আরো পাঁচ মিনিট পর মেহেনূরের দেখা মিললো।এক হাতে আড়াইশো মি.লি’র দুটো কোকের বোতল অন্য হাতে মোবাইল।মোবাইলের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো অর্কের পাশে।একটা কোক অর্কের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

– এটা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করে তারপর ধীরেসুস্থে প্রশ্ন করুন।

মেহেনূরের কথা শুনে অর্ক কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।মেহেনূর কিভাবে জানলো ও প্রশ্ন করবে বলে এখানে দাঁড়িয়ে আছে?আর ও যে ছাদে আছে মেহেনূর সেটাই বা জানলো কি করে?

– কি হলো কি ভাবছেন?আপনি ছাদে এটা আমি কি করে জানলাম?

মেহেনূরের কথা শুনে টাশকি খেয়ে যায় অর্ক। অর্ক অবাক হলেও বাহিরের ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন করলো না।অর্ক মেহেনূরের হাত থেকে কোকটা নেয়।মেহেনূর নিজের কোকটা থেকে এক ঢোক খেয়ে স্মিত হেসে বললো,

– ফ্রিজে একটাও কোক নেই।খালা মনি বললো,জীম সব খেয়ে ফেলেছে।খালুজান কোনো কারণে দোকানে গিয়েছিলেন।তাকে বললাম আমার জন্য যাতে কোক নিয়ে আসে।কারণ আমার সব কোক তার ছেলে সাবাড় করে দিয়েছে।আপনি যখন ছাদে আসছিলেন তখন আমি দেখেছিলাম।এখানে এসে আমি একা একা কোক খাবো আর আপনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবেন পরে যদি আমার পেট ব্যাথা করে!তাই আপনার জন্যও একটা নিয়ে আসলাম।এখন বলুন, আপনি কি জানতে চান?

মেহেনূর যে খুব চালাক সেটা অর্কের আর বুঝতে বাকি নেই।তাই এতো ভনিতা না করে গলা খাঁকারি দিয়ে সোজাসাপটা প্রশ্ন করলো,

– সকালে কাজী অফিসে এটা কি করলে তুমি?

অর্কের প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মেহেনূর।অবাক হয়ে বললো,

– কি করেছি?

– তুমি দিহাদের অনুমতি ছাড়াই ওর বিয়ে দিয়ে দিলে?আর দিহাদও কোনো আপত্তি জানালো না কেন?

অর্কের প্রশ্ন শুনে মেহেনূর হতভম্ব,হতবাক।এতো কাছের বন্ধু, বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও অর্ক কিছুই টের পেল না।শুধু অর্কই না,তনিমা আর অয়নও জানতো না।রাওনাফের বিয়ের জন্য তনিমা আর কলি মেহেনূরদের বাসায় এসেছিল।মেহেনূর,তনিমা আর কলি এক রুমেই ছিল।কাল রাতে ছাদ থেকে চলে যাওয়ার পর রুমে গিয়ে সবার আগে মেহেনূর তনিমাকে সবটা বলে।তনিমা সবটা শুনে পাঁচ মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল।তারপর কলিকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল।আর আজ বিয়ে পড়ানোর পর যখন মেহেনূররা দিহাদের বাসায় যাচ্ছিলো তখন তনিমা অয়কেও সবটা বললো।তনিমার মতো অয়নও বিস্মিত হয়েছিল সবটা শুনে।এখন সবটা শুনার পর অর্কেরও একই হাল হবে সেটাও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে মেহেনূর।কিন্তু অর্ক ওকে কেন এই কথা জিজ্ঞাস করছে?মেহেনূর অর্কের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে উল্টো প্রশ্ন ছুড়লো,

– আপনার এই প্রশ্নটা তো দিহাদ ভাইয়াকে করা উচিত।আমাকে কেন করছেন?
– আমি তোমার কাছ থেকে সবটা শুনতে চাই বলে ওদেরকে কিচ্ছু জিজ্ঞাস করে নি।কারণ আমি জানি এই সবকিছুর পিছনে তুমি আছো।
– বাব্বাহ্!এত জানেন আপনি।
– দেখো মেহেনূর,একদম ভনিতা করবে না।
– ওকে রিল্যাক্স।রেগে যাচ্ছেন কেন।আগে কোকটা শেষ করেন তারপর বলছি।

মেহেনূরের কথাটা বলতে দেরি অর্কের কোক শেষ করতে দেরি নেই।রুদ্ধশ্বাসে পুরোটা কোক শেষ করে বললো,

– বলো এবার।

মেহেনূর অর্কের তাড়াহুড়ো দেখে মুখ টিপে হেসে একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে।তারপর কলির অতীত বর্তমান, দিহাদ-কলির একে অপরকে ভালোবাসা,ও কিভাবে জানলো,সব অর্ককে বললো।মেহেনূরের প্রত্যেকটা কথায় অর্ক চমকিয়েছে,অবাক হয়েছে,বিস্মিত হয়েছে।হওয়ারই কথা।এতো বছর ওদের বন্ধুত্ব অথচ ওরা কেউই জানতো না কলির জীবনটা এতটা নির্মম,মর্মান্তিক।দিহাদ আর কলির আচরণেও কখনো মনে হয় নি ওরা একে অপরকে ভালোবাসে।তাহলে কিভাবে বুঝবে ওরা?অর্ক ফের প্রশ্ন করলো,

– আর দিহাদের আব্বু আম্মু?

– দিহাদ ভাইয়া বললো উনার আব্বু আম্মু কানাডায় থাকেন।আমরাও ওইখানেই থাকি।যদিও এক জায়গায় নয়।তবে ভার্চুয়াল জগতে কারো ঠিকানা খুঁজে বের করতে এখন আর খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না।উনারা কলি আপুকে তো আগে থেকেই চিনেন,জানেন।ছেলের পছন্দই উনাদের পছন্দ।কলি আপু অনাথ, এটা জানার পর অবশ্য একটু আপত্তি করেছিলেন।

– তখন তুমি তাঁদের রাজি করিয়েছো।

মেহেনূরকে বলতে না দিয়েই অর্ক বললো।মেহেনূর চুপ রইলো।অর্ক ওর জবাব পেয়ে গেছে।মেহেনূর একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে ছাদের কার্নিশে গিয়ে উঠে বসলো।অর্ক ওর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।তবে মেহেনূরকে ও যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে।এই মেয়েটা কিভাবে সবদিক এতো ইজিলি সামলে ফেলে?ওর কথার পৃষ্ঠে কেন কেউ কিছু বলতে পারে না?নাকি বলতে চায় না?এই মেয়ে কি সবজান্তা?এতটাই নিখুঁত ও?অর্ককে এই প্রশ্ন গুলো বরাবরই খুব ভাবায়।

– বাইক নিয়ে আমায় ফলো করছিলেন কেন?

নির্বিকার চিত্তে প্রশ্ন করলো মেহেনূর।ছাদ থেকে চলে আসার পা বাড়াতেই মেহেনূরের এহেন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়ায় অর্ক।বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফেলে তাকালো মেহেনূরের দিকে।কপালে চিন্তার ভাঁজ।অর্ক যে ওকে ফলো করছিল সেটা মেহেনূর কিভাবে জানলো?হুডি হেলমেটের আড়ালে ওটা অর্কই ছিল সেটা এত আত্মবিশ্বাসের সাথে কি করে বলছে ও?

– আপনার পারফিউমের স্মেলটা খুব ভালো।জানেন, আপনি আমাকে ক্রস করে চলে আসার অনেকক্ষণ পরেও স্মেলটা ছিল।কোন ব্র‍্যান্ডের পারফিউম ইউজ করেন?কোনো বিদেশী ব্র‍্যান্ডই হবে হয়তো।আচ্ছা বাদ দিন,বললেন না তো কেন ফলো করছিলেন।

মেহেনূরের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় অর্ক।কাচুমাচু মুখ করে বললো,

– একই ব্র‍্যান্ডের পারফিউম কি আর কেউ ব্যবহার করে না নাকি?

মেহেনূর ঠোঁট টিপে হাসছে।অর্ক ওকে যুক্তির কায়দায় এড়িয়ে যেতে চাইছে।অর্কের দিকে আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে ফের বললো,

– আমার কাছে সবসময়ই চুইংগাম থাকে।গাড়িতে কিছু আলপিনও ছিল।যখন গাড়ি থামিয়ে ছিলাম?তখন রাস্তায় চুইংগাম আর আলপিন ফেলে দিয়ে ছিলাম।যাইহোক,সকালে বাইকের টায়ারগুলো পরিষ্কার করে নিয়েন।

মেহেনূর কথাটা শেষ করেই হাসতে হাসতে ছাদ থেকে চলে যায়।অর্ক বিস্মিত হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলো।পরমুহূর্তেই মেহেনূর বলা কথাটার মানে বুঝতে পেরেই বুক চিঁড়ে একটা রুদ্ধশ্বাস বেরিয়ে আসে।এ তো ভারী ধুরন্ধর পাজি মেয়ে।ওর মাথায় সবসময় কিছু না কিছু চলে,সেটা অর্ক জানে। তাই বলে, এত দুষ্টুবুদ্ধিও গিজগিজ করে এই মেয়ের মাথায়?শেষে কিনা ওর শখের বাইকটার বারোটা বাজিয়ে দিলো?ও তো মেহেনূরের ভালোর জন্যই ফলো করছিল।আর এটাকে তো ফলো করা বলে না!প্রটেক্ট করা বলে।রাতের বেলা একটা মেয়ে একা একা বাসায় ফিরবে।তাই অর্ক একটু এগিয়ে দেখতে গিয়েছিল।কারণ মেহেনূর এইদিকের রাস্তাঘাট তেমন ভালো চিনেও না।এখন এটা কি ফলো করা হলো?তবে হ্যাঁ, ও চাইলে মেহেনূরের সাথে দেখা করতে পারতো।কিন্তু সেটা কেন করলো না এটার উত্তর অর্কের কাছেও নেই।হয়তো তখন মেহেনূরের পিছন পিছন চুপিচুপি আসতেই খুব ভালো লাগছিল ওর কাছে।বাসার কাছাকাছি চলে আসায় অর্ক তখন মেহেনূরকে ক্রস করে আগেই চলে আসে।মেহেনূর খুব চালাক,অর্ক সেটার প্রমাণ প্রতিবারই পেয়েছে।তবে মেহেনূর এইভাবে ওকে ধরে ফেলবে বুঝতে পারে নি।

_____________________

অর্ক মেহেনূরদের বাসা থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে সবে একটু শুইয়েছে।শরীরটা বেশ ক্লান্ত।সকালে দিহাদ কলির বিয়ে তারপর সারাদিন এটা সেটা করতে হয়েছে, সন্ধ্যার পরে আবার রিসেপশনের ঝামেলা সব মিলিয়ে শরীরটা এক্কেবারে ছেড়ে দিয়েছে।এইমুহূর্তে মনে হচ্ছে, কেউ একজন মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে মন্দ হতো না।

– আসতে পারি সাহেব?

আমেনা বেগম অর্কের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে এমন ভাবে কথাটা বললেন উনাকে দেখে মনে হচ্ছে যে, সদ্য বিবাহিত মধ্যযুগীয় এক রমনী তার বরের কাছে অত্যন্ত বিনীতভাবে আরজি জানাচ্ছে।আমেনা বেগমের স্বর শুনতেই হাসি ফুটে অর্ককের মুখে।চোখ বন্ধ রেখেই নরম গলায় বললো,

– বিবি তাঁর সাহেবের ঘরে আসলে অনুমতি চাইতে হবে এটা কোন সংবিধানে লেখা আছে বিবিজান?
– আসবো তাহলে?
– না।

আমেনা বেগম ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছেন।অর্ক বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আমেনা বেগমকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়।আমেনা তখনও নির্লিপ্ত চোখেই অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে।

– বিবিজান এই মুহূর্তে আমি মনে হয় তোমাকেই চাইছিলাম।

অর্ক আমেনা বেগমের কোলে মাথা রেখে কথাটা বললো।আমেনা বেগম অর্কের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে ভারী কণ্ঠে বললো,

– আমার তো অন্য কিছু মনে হচ্ছে।

অর্ক শুয়ে থেকেই মাথাটা হালকা কাত করে চোখ উল্টে আমেনা বেগমের দিকে তাকায়।অর্কের অবুঝ চাহনি দেখে আমেনা বেগম বললো,

– চারদিকে বিয়ের মরশুম।এই মুহূর্তে তোর দুই বন্ধু বাসর ঘরে আছে।হয়তো বউয়েরা পরম যত্ন করে ওদের মাথায়ও হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।এখন এটা ভেবে হয়তো তোরও তো ইচ্ছা জাগছে,“ইশ আজ যদি আমার একটা বউ থাকতো তাহলে আমিও হয়তো তাঁর আদর পেতাম!”

– সত্যিই আমার এই ক্লান্তি অবসান দূর করার জন্য এই দুটো হাতের খুব দরকার ছিল।

অর্ক আমেনা বেগমের হাতদুটোয় চুমো দিয়ে কথাটা বললো।

– ভাবমূর্তি খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না।এবার দেখছি স্থানী দুটো হাতের বন্দোবস্ত করতেই হবে।তা সাহেবের মনে কি কেউ আছে?

এতক্ষণে আমেনা বেগম আসল কথাটা জিজ্ঞাস করলেন।অর্কের মনে কি আছে সেটা জানার জন্যই তিনি অর্কের রুমে এসেছেন।অর্ক চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্ফুটস্বরে বললো,

“আমার হৃদয় হরনী,বিদেশিনী
নীলাক্ষী নয়নে ছিল অগ্নিঝরা চাহনি
তাঁর মসৃণ ঠোঁটের অমায়িক হাসিতে
আমি তো ডুবেছি সেই কবে
হারিয়েছি তাকে ক্ষনিকের ভুলে
আজও আমি মনের দরজা খুলে
অপেক্ষায় থাকি অন্তিম প্রহরে
হয়তো সে একদিন আসতেও পারে
আমার এই এলোমেলো নীড়ে!”

আমেনা বেগম অর্কের কথা শুনে অবাক হয়ে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছেন।পরমুহূর্তেই গলার স্বর নিচু করে নরম গলায় বললো,

– আচ্ছা বুঝলাম!আমি কি তাকে চিনি?
– হু!

অর্কের স্বর ক্ষীণ হয়ে গেছে।হয়তো ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাবে এক্ষুনি।আমেনা বেগম অর্কের প্রশ্নের উত্তর শুনে শুধু মৃদু হাসলেন।কোনো কথা বললেন না।চুপচাপ অর্কের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।কিছুসময় পরেই বুঝতে পারেন অর্ক ঘুমিয়ে পড়েছে।অর্কের মাথাটা বালিশে রেখে আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে আসেন।অর্কের পায়ের কাছে থাকা কম্বলটা কোমড় অবধি টেনে দিয়ে আমেনা বেগম চলে আসেন।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here