অঙ্গারের নেশা, পর্ব:২১+২২

0
1220

অঙ্গারের নেশা
পর্ব ২১

[বিঃদ্রঃ গল্প যখন আমি লেখা শুরু করেছিলাম তখন আমি চেয়েছিলাম এটা তিন পর্বের একটা অনুগল্প করতে। কিন্তু, সবার এতো আগ্রহ ছিলো তাই গল্পটা বড় করতে হলো। এটা আমি আগেও বলেছি।
সমস্যা হচ্ছে প্রতিটি গল্পের থিম লাইন আমি গল্প লেখার আগেই সাজিয়ে ফেলি৷ কিন্তু এই গল্পটা যেহেতু আমি হুটহাট লিখি তাই এটার থিমও কিছুটা বদলে গেছে। কিছু পয়েন্ট ছিলো যা প্রথমে ভাবিনি কিন্ত লেখার সময় গল্পের প্রয়োজনে লিখতে হয়েছে। তাই এখানে আমাকে একটু বিপাকে পড়তে হলো।
তো সব মিলিয়ে আমি ঠিক করেছি, অতীতের কাহিনিটা পাঁচ বছর আগের হবে। অর্থাৎ, সবকিছু ঠিকই থাকবে শুধু সময়কালটা বেশি। এটা কেনো করলাম তা পর্বের লাস্টে বুঝতে পারবেন। দুঃখিত, এটা আমার আগেই খেয়াল রাখা উচিত ছিলো। ]

এক্সিডেন্ট হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা পর ডাক্তাররা সুফিয়ানের পরিবারকে জানালো, আল্লাহর রহমতে সুফিয়ান বেঁচে থাকলেও গলায় জখম হওয়ায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই, সুফিয়ানের গলা রিকোভার করতে কয়েক মাস সময় লাগবে। রিকোভার হওয়ার পর কথা বলতে পারলেও গলায় চাপ পড়ে এমন কিছু করা যাবে না। সুফিয়ান তখনও হসপিটালের বেডে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মাথায় বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছে, তাই তার জ্ঞান ফিরতে চার পাঁচ দিয়ে দিন সময় লাগবে। জ্ঞান ফেরার পর এক মাস বেড রেস্টে থাকতে হবে। রাহাত সাহেব আর মিসেস অদিতি ছেলে বেঁচে আছে এটাতেই খুশি হয়ে গেলো। যতদিন লাগে ততদিন রেস্ট করুক৷ কিন্তু দুইদিন যাওয়ার পরই কনসার্টের জন্য মিটিং করে দিন নির্ধারিত হলো। সুফিয়ান চুক্তিবদ্ধ ছিলো প্রডিউসারের সঙ্গে। এখন যদি সুফিয়ান কনসার্টে না যায় তাহলে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে, তারচেয়ে বড় কথা সুফিয়ানের নাম অপ্রকাশিত থাকলেও একটা ছবি নেটে ভিডিও সহ আপলোডও হয়েছে। মূলত সুফিয়ানের গানে মুগ্ধ হয়েই কনসার্টের আয়োজন। প্রডিউসার মিস্টার দামান অকূলপাথারে পড়ে সুফিয়ানের বাড়িতে এসে হাজির হলেন। মিস্টার রাহাত আর মিসেস অদিতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন -‘আপনি এখানে কী করছেন?’

দামান সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন –
‘কেনো! আপনারা জানেন না? সুফিয়ানের সঙ্গে আমার কন্ট্রাক্ট সাইন হয়েছে কাল কনসার্টের জন্য। ‘

রাহাত আর অদিতি দুজনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো হতাশার শ্বাস। রাহাত সাহেব এই বাড়িতে আসার পর থেকেই সুফিয়ান নিজেদের কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের জানায়না। যত বড় কিছুই হোক নিজের ভেতর চেপে রাখে। অদিতি ব্যাপারটা আড়াল করে বললো –
‘ওহহ, হ্যা বলেছিলো তো। কিন্তু সুফিয়ানের এক্সিডেন্টের চিন্তায় ভুলে গেছিলাম আমি। ‘

‘আচ্ছা, কিন্তু এখন যে আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম। সুফিয়ান তো শুনেছি খুব অসুস্থ। তাহলে, কাল কনসার্টের কী হবে!’

পেছনে থেকে একজন বলে উঠলো –
‘আমি হয়তোবা আপনার সাহায্য করতে পারি ‘

সবাই অবাক চোখে পেছনে তাকিয়ে দেখলো রেয়ান দাঁড়িয়ে আছে৷ দামান সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন-

‘আপনি! কীভাবে? ‘

রেয়ান ধীরে সুস্থে এগিয়ে এলো৷ সোফার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হালকা ব্যাথিত গলায় বললো –

‘ সুফি ভাই তো খুব অসুস্থ। মনে হয় না কনসার্টে অংশ নিতে পারবে। তাছাড়া এই মাসেই নাকি পরপর দুটো অনুষ্ঠানে গাওয়ার কথা। কিন্তু সুফি ভাইয়ের গলায় রক্তক্ষরণ হওয়ায় আর কখনো গাইতে পারবে না ‘

‘সে কী! একেবারে গলা নষ্ট হয়ে গেছে! কথা বলতে পারবে তো?’

‘কথা বলতে পারবে। কিন্তু আর কখনো গান করতে পারবে না অর্থাৎ সুর আসবে না ‘

দামান সাহেব অবাক হয়ে বললো-
‘তাহলে এক্ষেত্রে আপনি কীভাবে হেল্প করবেন?’

রেয়ান নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসলো৷ কপালে ডান হাতটা ঘষে বললো-
‘ হ্যা, আমি জানি সুফি ভাইয়ের মতো গান করতে পারিনা। কিন্তু, সুফি ভাইকে দেখে আমি মোটামুটি গান শিখে নিয়েছিলাম। প্রেকটিস করিনি, আগ্রহ ছিলো না। এখন যেহেতু ভাই অসুস্থ তাহলে সেক্ষেত্রে আমি পার্টিসিপেট করতে পারি। ‘

দামান সাহেব হালকা তাচ্ছিল্য করে বললো –

‘ গান পারলেই হবে না, তার সাথে চেহারাও থাকতে হবে। আপনার চেহারা দেখেই তো মানুষ চলে যাবে ‘

রেয়ানের ভেতরের রাগ আবারও উপচে উঠলো। এতক্ষণ সে ভাবছিলো আলাদা মাস্ক বানিয়ে সেটা দিয়েই শো করবে কিন্তু সেই একই খোঁটা! চেহারা! রেয়ানের ক্রুদ্ধ মন খলবলিয়ে বললো-‘ চেহারা নিয়েই এতো সমস্যা তো! এই চেহারাই আমি সারাজীবনের জন্য পাল্টে ফেলবো। সুফি ভাই সত্যিই আমাকে সবসময় নিচে নামিয়ে রেখেছে। এবার সুফি ভাই বুঝবে অধিকার না পাওয়ার ব্যাথা , সরি ভাই কিন্তু এটা আমায় করতেই হবে। নিজের জন্য একবার স্বার্থপর হয়ে দেখতে চাই আমি ‘

মনকে শান্ত করে মাথা উঠিয়ে বললো-

‘সে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। তিনদিন পর যথাসময়ে কনসার্টে আমি এসে পড়বো৷ আর চেহারাটাও কোনো প্রভাব ফেলবেনা এতে ‘

‘কিন্তু এটা কীভাবে..? ‘

‘আহা, আপনি এতো চিন্তা করছেন কেনো! আপনি যান ‘
মিস্টার দামান একরাশ চিন্তা বোঝাই করে বেরিয়ে গেলেন। কীভাবে কী হবে, ভেবেই তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে৷

তিনদিন পর, কনসার্ট শুরু হতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। কিন্তু এখনো রেয়ান এসে পৌঁছাতে পারেনি। দামান সাহেব ভাবছেন ঘোষণা করবেন যে সুফিয়ান আসতে পারবেনা। মাইক হাতে নিয়ে স্টেজে উঠতে গেলেই পেছনে কেউ তাকে ডাকলো৷ বিরক্ত হয়ে তাকাতেই হাত থেকে মাইক পড়ে গেলো। এ কীভাবে সম্ভব! স্বয়ং সুফিয়ান! কিন্তু সে তো..

লোকটি সামনে এসে দাঁড়িয়ে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেললো৷ হালকা হেসে বললো –

‘কী দামান সাহেব? অবাক হলেন?’

দামান সাহেব বাকহারা হয়ে তাকিয়ে আছেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ব্যাক্তিটি তুড়ি বাজিয়ে বললো-
‘আরে এতো অবাক হচ্ছেন কেনো?

‘অবাক হবো না?সুফিয়ানের মতোন কী করে! ‘

‘আপনি বোধ হয় জানেন না, এটা আর সেই আদি কাল নেই। ‘

‘প্লাস্টিক সার্জারি! ‘

‘ইয়েস। শো করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে মনে হয় ‘

চেহারায় অমিল হলেও কন্ঠ সুফিয়ানের সঙ্গে কিছুটা মিলে যায় রেয়ানের। এটার সুযোগ নিয়েই কাজটা করলো রেয়ান। দুই ঘন্টা পর শো শেষ করে বের হতেই দেখলো বাহিরে গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইভানান। রেয়ান হাসলো। হাসিতে বিজয়ের উচ্ছ্বাস। ইভানানকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো সে। ইভানান কাঁধ চাপড়ে গর্বিত গলায় বললো –
‘ এই হলো সাহসী ছেলে! পুরাই বাজিমাত করে দিলি’

রেয়ানও অহংকারে লেপটে থাকা হাসি হাসলো। তার ধারণা হলো, এবার তার চেহারা আছে। কেউ আর তাকে ঠেকাতে পারবে না। অথচ এটা বুঝতে পারলো না যে সে নিজেকেই হারিয়ে ফেললো। ইভানান পকেট থেকে একটা ছবি বের করে রেয়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো-‘ কাল রাতে যেসব ইনফরমেশন দিয়েছিলাম সেসব মুখস্থ করেছিস তো?’

রেয়ান ছবিটি দেখতে দেখতে বললো –
‘হুম ‘

‘তাহলে এখন যা, ঠিকানা মেসেজ করে দিয়েছি তোর ফোনে। সব ঠিকঠাক ভাবে করিস ‘

‘ঠিক আছে, কিন্তু ইভ ভাই একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। ‘

‘কী?’

‘এই মেয়ের সঙ্গে নাটক করলে তোমার কী লাভ?তুমি বলেছিলে দ্রুত সার্জারি করানোতে আমাকে সাহায্য করবে তার বদলে আমাকে এই মেয়ের সঙ্গে প্রেমের নাটক চালাতে হবে ‘

‘উফ, বেশী কথা বলিস না। তুই যা আর যা বলেছি সেসব কর ‘
রেয়ান মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো সেই ঠিকানায়।
যেতেই ইভানান ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো৷ আড়মোড়া ভেঙে গাড়ির উপর লাফ দিয়ে বসে উপর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো-
‘এবার তুই বুঝবি সুফিয়ান, আপন মানুষ ধোঁকা দিলে ঠিক কতটা কষ্ট হয় ‘

বটতলার নিচে একটা সিটে বসে অনবরত হাত কচলাচ্ছে প্রানেশা। কী ভীষণ আনন্দের অনুভূতি ! সাথে কিছুটা লজ্জাও লাগছে। মনে মনে নানা কল্পনা জল্পনা করছে৷ কেমন দেখতে মানুষটা! আনমনেই হেসে উঠলো প্রানেশা। ক্ষন বাদেই একটা গাড়ি এসে থামলো। প্রানেশা উঠে দাড়িয়ে গেলো। গেট খুলে বেরিয়ে আসলো ফর্সা ত্বকের এক মানবী। শব্দ করে হেঁটে এসে প্রানেশার সামনে হাস্যজ্জল ভঙ্গিতে বললো

‘ কেমন আছো প্রানেশা? বেশি অপেক্ষা করাইনিতো?
আমি রেয়ান তেহজিব। যার সাথে তুমি এতদিন কথা বলেছো ‘

চলবে….

অঙ্গারের নেশা
পর্ব-২২

গৌধুলি পেরিয়ে সন্ধ্যার ঘ্রাণ ঘনিয়ে আসছে। দিক দিগন্তের নানান মানুষ হালকা আনাগোনা শুরু করেছে, তাদের বেশীর ভাগই সদ্য বিবাহিত। তাই প্রেমও মাখোমাখো। কেউ একে অপরকে জড়িয়ে সূর্য ডোবার সোনালী আভায় ছড়িয়ে থাকা আকাশের দিকে মনোনিবেশ করে আছে তো কেউ আবার ভেজা বালির উপর হাতে হাত রেখে হেঁটে বেরাচ্ছে। সমুদ্রের কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে প্রানেশা। দৃষ্টি তার শান্ত নিথর। তার তিন হাত দূরে এক হাঁটু উঁচু করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সুফিয়ান। প্রানেশা একবার পেছন ফিরে চাইলো, এখনো সে পুরোটাই ভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা যে পাঁচ পাঁচটে বছর সে ধোঁকায় পড়ে ছিলো। রেয়ানের সঙ্গে মনের মিল কখনোই ছিলো না, সম্পর্কটা টিকে ছিলো রেয়ানের ধূর্ততা আর প্রানেশার মনে দাগ কেটে যাওয়া প্রথম ছয় মাসের ফোনালাপ। প্রানেশা ধীরস্থ পায়ে হেঁটে সুফিয়ানের সামনে দাঁড়ালো। সুফিয়ান মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালো। প্রানেশার থমথমে মুখটা দেখে নিজের দুই হাত দিয়ে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নিলো। প্রানেশা চেয়ে আছে অনুভূতিহীন ভঙ্গিতে। চোখের পাপড়ি ভেজা ভেজা। অতিরিক্ত ফর্সা ত্বকটা রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে আছে৷ প্রানেশার সাদা গালটায় ডান হাতে ছুঁইয়ে বললো-

‘প্রাণ! ‘

‘হু?’

‘ সেই অঙ্গারের কথা কখনো মনে পড়েনি? ‘

প্রানেশার গাল বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। সুফিয়ান হাত পেতে জলটুকু ধরে নিজের টিশার্টের ডান পকেটে এমন ভঙ্গিতে গুঁজে রাখলো যেনো ওটা মহামূল্যবান কোনো বস্তু। প্রানেশার গলা রোধ হয়ে আছে,অদৃশ্য কিছু একটা যেনো গলা শক্ত হাতে চেপে রেখেছে। কোনো রকম মাথা নাড়িয়ে বললো-

‘পড়েছে, খুব পড়েছে ‘

সুফিয়ান যেনো তাচ্ছিল্য হাসলো। প্রানেশাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলো। সমুদ্রের ঠান্ডা পানির স্রোত হাঁটুতে ধাক্কা লাগাচ্ছে। প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ানের চাপা কষ্ট। ঠিকই তো, এতগুলো দিন সুফিয়ান একাই তাকে ভালোবেসে গিয়েছে আর তাকে কী দিতে পেরেছে প্রাণেশা! নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো সে। দুই হাতে চোখ মুছে সুফিয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো-

‘ রেয়ানকে আমার সন্দেহ হতো মাঝে মাঝে। প্রথম যেদিন আমার সঙ্গে দেখা হলো সেদিন আমার একটু সন্দেহ লেগেছিলো কারণ অঙ্গার তো আমাকে বলেছিলো সে এসে প্রথম আমার দিকে একমুঠোভর্তি তাজা বেলীফুল এগিয়ে দেবে। কিন্তু রেয়ান এসে আমার সঙ্গে ফরমাল আলাপ করেছিলো, তার চারদিন পর আমার মোবাইল থেকে নিজেই অজানার নাম্বার সহ ডিটেইলস ডিলিট করে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করলে বলে এই নাম্বারটা এখন আর সে ইউজ করে না, এক মামাতো ভাই এই সিম নিয়ে নিয়েছে। আর তাই আমিও বিশ্বাস করে নেই আমার অজানাকে ভেবে। একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অঙ্গার মানে কী? সে সাধারণ ভাবে উত্তর দিয়েছিলো ‘কয়লা ‘। সেই কথার মাঝে আমি মিষ্টতা খুঁজে পাইনি। সম্পর্ক ভাংতে চেয়েও পারছিলাম না, কীভাবে পারবো! আমার সেই কৈশোরের স্মৃতিতে যে সিলমোহর মেরে বসে আছে সেই ছয় মাসের প্রমালাপ’

কথাগুলো বলে কেঁদে উঠলো প্রানেশা। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। ভালোবাসার বিনিময়ে সে যে কিছুই দিতে পারলো না। সুফিয়ান ব্যাথিত হয়ে তাকিয়ে আছে। সে যে তার প্রাণেশ্বরীর কান্না সহ্য করতে পারে না, তার বুকে যে খুব ব্যাথা করে এই কান্নায়। প্রাণেশার কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সুফিয়ান, আদুরে কন্ঠে বললো –
‘ প্রাণ, আর কেঁদোনা। বুকে যে খুব ব্যাথা করে! ‘

প্রানেশা কাঁদতে কাঁদতে হেঁসে ফেললো৷ সুফিয়ান গাঢ় চুমু খেলো প্রাণেশার কপালে।লম্বা চুলগুলো হাতের পিঠে পেচিয়ে খেলতে খেলতে বললো-

‘চলো রুমে চলো৷ দেখেছো পুরনো কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে! ‘

প্রানেশা বুকে মাথা গুজে থেকে বললো-
‘পাঁচ বছরে আপনি একবারও আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি?’

সুফিয়ান খপ করে প্রানেশাকে ছাড়িয়ে আলগোছে কোলে উঠিয়ে নিলো। প্রানেশা হকচকিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বললো-
‘আরে করছেন কী! ছি ছি! সবাই কী মনে করবে! ‘

সুফিয়ান ভ্রু কুচকে বললো-
‘কে কী মনে করলো এই নিয়ে বসে আছি নাকি আমি! ওই দেখো ওরা আমাদেরও ছাড়িয়ে গেছে তো কেউ কিছু বলেছে নাকি? ‘

প্রানেশা সুফিয়ানের ইশারা বরাবর তাকাতেই লজ্জায় লাল নীল হয়ে উঠলো। দুটো ছেলে মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে কিস করছে৷ প্রানেশা চোখ খিঁচে বন্ধ করে সুফিয়ানের বুকে কিল বসিয়ে দিলো। সুফিয়ান মেকি আর্তনাদ করে বললো –
‘উফ ব্যাথা পেয়েছি! ‘

প্রানেশা জানে এই হৃষ্টপুষ্ট দেহে নরম হাতের একটা কিল চামড়াও ভেদ করবে না। সুফিয়ান ভেতরে যেতে যেতে বললো-
‘এখানে থাকলে তুমি প্রশ্ন করতেই থাকবে। তাই এখন আমরা রুমে যাবো তারপর ফ্রেশ হবো, খাবো তারপরে তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবো ‘

প্রানেশা অবাক হয়ে আছে ৷ নিজেকে খুব খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে তার। সে তো এতো সুখ পাবে কল্পনায়ও করেনি। যতকিছুই হোক সৃষ্টিকর্তা সেই আকাঙ্খিত পুরুষকে তার ভাগ্যে লিখে দিলো।

রুমে যেয়ে প্রাণেশা ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো সুফিয়ান খাবার রেডি করছে। প্রানেশা টাওয়াল পাশে রেখে খাটে বসতেই সুফিয়ান তার চিরচেনা মনোমুগ্ধকর হাসি উপহার দিয়ে বললো-

‘প্রাণ,তুমি খেতে শুরু করো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ‘

বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে। আর প্রানেশা! সে তো সেভাবেই থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম বার বোধ হয় তার হার্টবিট দ্বিগুণ বেগে চলতে শুরু করলো। সুফিয়ান তো তার সামনে এর আগেও বহুবার হেঁসেছে। কিন্তু কখনোই হার্টের গতি বেড়ে যায়নি! আনমনেই কপাল চুলকে প্রানেশা বললো-
‘তবে, আমি প্রেমে পড়ে গেলাম! ‘

সুফিয়ান বের হয়ে এসে প্রানেশাকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালে ভাজ ফেলে চোখ ছোট ছোট করে বললো-
‘কী হয়েছে প্রাণ? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ‘

প্রানেশা অপ্রস্তুত হেঁসে ‘না’ বোধক মাথা নাড়লো। সুফিয়ান প্রানেশার সঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে বিছানা ঝেড়ে বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়লো। প্রাণেশা হাতে পায়ে লোশন লাগিয়ে শুতেই শরীরে কম্পন শুরু হলো। বাম পাশে শুয়ে আছে সুফিয়ান। নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা বটে, কিন্তু তবুও প্রানেশার কাছে সবকিছু কেমন যেনো নতুন মনে হচ্ছে। এ বুঝি প্রেমে পড়ার সংকেত! সুফিয়ানের আরেকটু কাছে এসে প্রানেশা বাচ্চাদের মতো মিনমিন করে বললো-

‘আমি আরেকটু কাছে এসে শুই? ‘

সুফিয়ান মিটমিট করে হেসে বললো –

‘শোও ‘

দুই মিনিট যেতেই আবারও প্রানেশা বললো-

‘আমি একটু বুকে মাথা রাখি? ‘

‘রাখো ‘

সুফিয়ানের মুখে প্রাপ্তির খুশি। মনে আনন্দের ঢেউ। এর থেকে কত কাছে এসেছে! তারপরও মনে হচ্ছিলো কোথাও কী যেনো ফাঁকাফাঁকা। বুকে এলিয়ে থাকা মাথাটার দিকে তাকিয়ে সুফিয়ান নিজস্ব ভঙ্গিতে বললোঃ

এ ব্যাথা লাল নীল,
থাকুক না চিরদিন!
কথারা শব্দহীন,
যেনো তা তুমিহীন!
বসন্তের ঘ্রাণ নেই,
যেখানে তুমি নেই।
প্রেমেরা রঙহীন!
আমি আজ দিশাহীন।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here