অচিত্তাকর্ষক পর্ব -২২

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২২|

থানায় গিয়ে ঈশান চমকে গেল। হাসি ফুটে উঠল সোহানের মুখে। এস.পি স্যার একা না, উনার পাশে জারাকে দেখে দুশ্চিন্তায় ঈশানের ঘাম ছুটে গেল। মনে তার একটা প্রশ্নই এল, “মেয়েটা আবার সব বলে দিল না তো?”

ঈশান ভয়ে ভয়ে এস.পি স্যারের কাছে গিয়ে উনাকে সালাম দিল। এস.পি সালামের জবাব দিয়ে বললেন,

‘ওই কি সোহান?’

ঈশান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘জ্বি স্যার, জ্বি স্যার।’

‘কোথায় পেয়েছ ওকে?’

‘ঐ তো স্যার, আপনি যে এড্রেসটা দিয়েছেন সেখানেই।’

এস.পি সোহানকে বসতে বললেন। তারপর তিনিও অন্য একটা চেয়ার টেনে বসলেন। ঈশান দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে। বাইরে জুভান আছে, কিন্তু তাকে কিছু বলার উপায়ও পাচ্ছে না সে। এস.পি এইদিকে সোহানকে সব ঘটনা খুলে বলতে বললেন। সোহান একপলক ঈশানের দিকে তাকালেই ঈশান চোখ রাঙিয়ে তাকে কিছু বলতে বারণ করে। কিন্তু সোহান ঠিক করে নেয়, এবার আর ভয় পেয়ে পেছাবে না সে। নিজের বুকে ভেতর অদম্য সাহস জুগিয়ে সোহান একে একে সব বলতে শুরু করে। ঈশান ঐদিকে হাঁসফাঁস করছে। না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে এখানে থাকতে। সোহান এস.পি কে সব বলে দিল। ঈশানের নামেও সে কমপ্লেইন করল। ঈশান যে কতটা জঘন্য ভাবে আইনের অবমাননা করছে সেটাই সে এস.পি কে গুছিয়ে বলল। সব শুনে এস.পি ঈশানের দিকে চেয়ে বলল,

‘আপনাকে আমি সাসপেন্ড করলাম, মি. ঈশান চৌধুরী।’

ঈশান অস্থির হয়ে উঠে। রাগ দেখিয়ে বলে,

‘স্যার, ওর কথা শুনে আপনি আমাকে সাসপেন্ড করে দিলেন? স্যার, ও সব মিথ্যে বলছে, আমাকে ফাঁসানোর জন্য বলছে। স্যার, আপনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন না প্লিজ।’

‘তোমাকে ফাঁসিয়ে ওর কী লাভ? ওর সাথে কি তোমার কোনো শত্রুতা আছে?’

ঈশান জবাব দিতে পারল না। কিন্তু সে কথা ঘুরিয়ে বলল,

‘আমি কিছু জানি না স্যার, আমি শুধু এইটুকুই জানি যে ও মিথ্যে বলে আমাকে ফাঁসাচ্ছে। আর ওর কাছে কোনো প্রমাণও নেই। প্রমাণ ছাড়া আপনি কী করে ওর এই অযৌক্তিক কথাগুলো বিশ্বাস করে নিচ্ছেন স্যার?’

এস.পি কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

‘প্রমাণ চাই আপনার? এই কনস্টেবল উনাকে নিয়ে আসুন।’

একজন ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হলো। যাকে দেখে পিলে চমকালো ঈশানের। শিট, ওরা জিহাদকেও এখানে নিয়ে এসেছে। জিহাদ খুব একটা সুস্থ নয়। ওকে ধরে এনে একটা চেয়ারে বসানো হলো। তারপর এস.পি তাকেও সবকিছু বলতে বলল। জিহাদও পুরো ঘটনা আবার পুনরাবৃত্তি করল। সব শুনে এস.পি বলল,

‘আর কিছু বলার আছে আপনার, ঈশান চৌধুরী। আপনি একজন খুনীকে তার অপরাধ ঢাকতে সাহায্য করেছেন, নিরপরাধ মানুষকে বিনা কারণে কষ্ট দিয়েছেন, অপরাধীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তাদের খালাস দিয়েছেন। কী ভেবেছেন, এসব কিছু এর আগে আমার কানে আসেনি? এসেছে, আমি শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিলাম আপনাকে হাতে নাতে ধরার জন্য। অবশেষে আজ আপনার খেলার সমাপ্তি ঘটল। এবার আর কিছু বলার আছে আপনার? আরো প্রমাণ লাগবে আপনার? আমার কাছে আপনার কৃতকর্মের কিছু ছবিও আছে। আপনি চাইলে আমি সেগুলো সাংবাদিকদের কাছেও পাঠাতে পারি, কি চান আপনি ফেমাস হতে?’

ঈশান ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। হাত জোড় করে অনুনয়ের সুরে বলতে লাগল,

‘প্লিজ স্যার, এমন কিছু করবেন না। আমি নিজে থেকে চাকরি ছেড়ে দিব। তাও প্লিজ, সাংবাদিক পর্যন্ত এসব কিছু পৌঁছাতে দিবেন না। আমি অনুরোধ করছি স্যার, প্লিজ স্যার।’

এস.পি স্যার তাকে ধমক দিয়ে বললেন,

‘উঠুন। আপনার তো জেল হওয়া উচিত। এই পোশাকের মর্যাদা আপনার মতো লোভী মানুষেরা কখনোই বুঝবে না। খুলে রাখুন সবকিছু। আর শুনুন, আপনার সেই অপকর্মের সঙ্গী আপনার বন্ধু জুভানকেও এক্ষুণি এখানে আসতে বলুন। উনাকে এরেস্ট করে তবেই আপনি আপনার ব্যাচ খুলে রাখবেন। অনন্ত চাকরি শেষ হওয়ার আগে একটা ভালো কাজ করে যান। নিন, এবার কল দিন উনাকে।’

ঈশান এক প্রকার বাধ্য হয়েই জুভানকে কল করল। তবে সে সবকিছু বলল না তাকে। শুধু থানায় আসতে বলে সে কলটা কেটে দিল। জুভান যেহেতু থানার আশে পাশেই ছিল তাই থানায় আসতে বেশি সময় লাগল না তার। সে ভেতরে গিয়ে হকচকিয়ে উঠল। বিশেষ করে জারা আর জিহাদকে দেখে। ওরা এখানে কী করছে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারল না। বিস্মিত হয়ে ঈশানের দিকে তাকাল সে। ওর চোখ মুখও কেমন যেন থমথমে। বুঝতে পারল কিছু একটা ঘাপলা আছে। এস.পি জুভান কে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘আপনিই জুভান?’

‘জ্বি।’

এস.পি প্রসন্ন হেসে ঈশান কে অর্ডার করলেন,

‘উনাকে এক্ষুণি এরেস্ট করুন।’

জুভান ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ঈশান গিয়ে সত্যিই তাকে হাতকড়া পরাল। জুভান তো হতভম্ব। সে চেতে গিয়ে বলল,

‘এসব কী করছিস ঈশান? তুই আমাকে এরেস্ট করছিস কেন?’

ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘আমরা ধরা পড়ে গিয়েছি, এখন আর কিছুই করার নেই।’

জুভানের মাথায় যেন তখন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে চেঁচাতে লাগল। অস্বীকার করতে লাগল সবকিছু। কিন্তু তাতে হলো না কিছুই। ঈশান’ই তাকে টানতে টানতে জেলখানার ভেতরে রেখে এল। তারপর এসে সে তার ব্যাচ, স্টার আর বেল্ট খুলে রাখল। জুভান ঐদিকে জেলের ভেতল হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে। সে এখনও বলে যাচ্ছে, সে কিছুই করেনি। সে নির্দোষ। এস.পি তার সামনে এসে বলল,

‘এত চিৎকার চেঁচামেচি করে কোনো লাভ নেই। আপনার বিরুদ্ধে আমাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। আপনার নিজের বোন আপনার নামে মামলা দায়ের করেছেন। আর তাছাড়া আপনি একজন খুনী। এত সহজে আপনি রেহাই পাবেন না। অনেকদিন এভাবে বেঁচে গিয়েছেন তবে আর না। এবার এই কেইসটা আমি হ্যান্ডেল করব। তাই অযথা এত উত্তেজিত হয়ে কোনো লাভ নেই, আর আপনি ছাড় পাবেন না।’

এই বলে এস.পি তার ডেস্কে গিয়ে বসেন। একটা কাগজ বের করে তিনি ঈশান কে দেন। ঈশান সেখানে সাইন করে থানা থেকে বেরিয়ে যায়। অন্য একটা জেলে জিহাদকেও রাখা হয়। আর এস.পি তারপর সোহান আর জারা কে চলে যান স্মৃতিকে উদ্ধার করতে। যাওয়ার আগে জারা একবার তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়েছিল। কেন যেন, ভাইকে ঐভাবে দেখে কোথাও একটা চিন চিন করছিল তার। তাও নিজেকে শক্ত করে মুখ ফিরিয়ে বেরিয়ে এল সে।

জুভান, জিহাদ, ঈশান এমনকি জুভানের বাবার নামেও থানায় মামলা হলো। পুলিশ গিয়ে জুভানের বাবাকেও অফিস থেকে ধরে নিয়ে এল। উনিও যে খুব ভালো, তা না। ছেলের মতো জমির প্রতি ভীষণ লোভ উনারও ছিল। আর সেই লোভে উনিও অনেক মানুষের সাথে অনেক অন্যায় করেছেন। আর এসব স্বাক্ষী স্মৃতি একা না উনার নিজের মেয়ে জারাও দিয়েছে। এখন জারার বাবা আর ভাই দুজনেই জেলে আছেন। তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ অতীতের সমস্ত ঘটনাই খুঁজে বের করে ফেলে। আর যা বাকি তা উনারা জুভান আর জুভানের বাবার মুখ থেকেই পরবর্তীতে বের করবেন।

মারিয়াম আহমেদ অনেকক্ষণ যাবত অজ্ঞান অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছেন। এত বড়ো আঘাত তিনি সামলাতে পারেননি। হাউমাউ করে কেঁদে কেটে এখন জ্ঞানহীন হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। স্মৃতি আর জারা আছে উনার পাশে। ডক্টর এসে বলেছেন, জ্ঞান কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসবে। জারা বাকরুদ্ধ হয়ে মায়ের মাথার কাছে বসে আছে। স্মৃতিও নিরব নিস্তব্ধ। ঘটনার তীক্ষ্ণ প্রবহমানতায় তার পরিক্রমা যার দিকে ছড়িয়ে পড়ছে অনেক আগেই। অনেকদিন পর নিধিও এল সেই বাড়িতে। এবার এসেই সে স্মৃতি কে জড়িয়ে ধরল। ক্ষমা চেয়ে বলল,

‘তুমি ছিলে বলেই আজ ঐ অপরাধীগুলো শাস্তি পেতে চলেছে। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ স্মৃতি।’

স্মৃতি এতে জবাব দেয়না কিছুই। সে কেবল অবাক হয়ে ভাবে,

“সত্যিই, মানুষ চেনা বড়ো দায়।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here