#অজানা_পৃথিবী
#কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_৭
কুহেলী একটু একটু করে উঠে বসলো। ঘড়িতে ঠিক কয়টা বাজে বোঝার উপাই নেই। এক জায়গাই স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে। অবছা অন্ধকারে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তির মুখটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না। দোতালার জানালায় দাঁড়িয়ে থাকার তো কোনো সিস্টেম নেই তাহলে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে কিভাবে? এরকম প্রশ্ন কুহেলীর মনে একবারও আসলো না। ও ভাবছে ওখানে হয়তো এবাড়ির কেউ থাকতে পারে। কথাটা ভেবে ওর ভয় না রাগ হচ্ছে। নতুন বউয়ের জানালায় উঁকিঝুকি মারছে এদের কি কোনো ক্লাস নেই নাকি? দেখতে ভদ্রলোক মনে হয় কিন্তু আসলেও এরা তেমন না। ও পাশ ফিরে উঠে আস্তে করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো কিন্তু কাউকে পেলোনা। খোঁলা জানালা দিয়ে দূর পযর্ন্ত দেখা যায় তাকালো। বাড়ির সামনে বিশাল বাগানের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা গিয়ে গেইট পেরিয়ে মেইন রোডের সঙ্গে মিশেছে। আকাশে ঝিকিমিকি তাঁরা জ্বলছে। চাঁদটা মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে তাই কখনও সখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। কুহেলী জানালা থেকে ফিরে আসছিল ঠিক তখনই দেখলো দূরে কারা যেনো হামু হয়ে কিছু একটা করছে। লোকগুলো সাদা কাপড় পড়েছে তাই মুখ ছাড়া সব পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কুহেলী সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে আসলো। ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছুটছে। সারা বাড়িতে নির্জনতা বিরাজ করছে। হয়তো সবাই ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করছে। কুহেলী দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। ও রীতিমতো হাপিয়ে উঠেছে কিন্তু থামলে চলবে না ভেবে আবারও দৌড় লাগালো। প্রায় গেটের সামনে একদম মানুষ কাউকে ধরে বেদম প্রহার করছে আর লোকটা চাপা কন্ঠে আত্ননাদ করছে। কুহেলী এক দৌঁড়ে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে যা দেখলো তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারলো না। মুখোশ পড়া লোকগুলো আবিরকে মারছে আর ছেলেটা পড়ে পড়ে চিৎকার করছে। কুহেলী হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওদেরকে আটকাতে শুরু করলো কিন্তু ওরা থামলো না। কিন্তু কুহেলী সতচেষ্টা করেও লোকগুলোর লাঠিটা কিছুতেই স্পর্শ করতে পারলো না। ওর এমন করে আটকাতে দেখে একজন ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিলো আর ও ছিটকে গিয়ে দূরে পড়লো। পায়ের যন্ত্রণায় ও কুকিয়ে উঠলো তবুও কষ্ট করে যখন ও উঠে দাঁড়ালো তখন দেখলো পেছনে কেউ নেই। দুর থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। ঝিঝিপোকা গুলো এতক্ষণ শান্ত ছিল ওরাও এবার দল বেধেঁ ডাকতে শুরু করলো। কুহেলীর দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে। ও এদিক ওদিক দৌঁড়াদৌড়ি করে শুরু করলো। ঠিক তখনই কেউ একজন ওকে ঝাপটে নিজের বুকের সঙ্গে আটকে ধরলো। কুহেলী লোকটাকে ধাক্কা দিতে শুরু করলো কিন্তু যখন ওকে আর ছাড়লোনা তখন ও নিজের ঠোঁটটা লোকটার হাতে রাখলো। উদ্দেশ্যে কামড়ে দেওয়া, ঠিক তখনই জুবায়ের ফিসফিস করে বলল,
> কামড়ে দিলে কিন্তু আমিও দিবো তখন বুঝবা মজা। জগিং করতে পছন্দ বললেই হতো আমি ব্যবস্থা করতাম। এভাবে রাতের বেলা বাগানে দৌড়াদৌড়ি করছো কেনো? বাড়ির লোকজন কি ভাববে শুনি?
> আপনি দেখেছেন ওরা আবিরকে কেমন মারছিলো? প্লিজ লোকগুলোকে বলুন আবিরকে ছেড়ে দিতে,
কিছু না করতে।
কহেলী জুবায়েরের কথায় উত্তর না দিয়ে নিজের মতো কথাগুলো বলে কাঁদতে শুরু করলো। ও এখন আর হাতপা ছোড়াছুড়ি করছে না।বেশ শান্ত তবে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ওর কান্নার বেগে জুবায়ের পযর্ন্ত দুলে উঠছে। মেয়েটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে জুবায়ের ওর মাথায় হাত রেখে বললো,
> কাঁদো না।চলো আমরা দুজন মিলে ওদেরকে খুঁজে বের করি। যাবে আমার সঙ্গে?
জুবায়ের কথাগুলো ওকে শান্ত করার জন্য বললো। বিষয়টা ও কিছুই বুঝেনি তবুও বলল কারণ ওকে শান্ত করতে পারলে বিস্তারিত জানতে পরবে। কুহেলী কান্না থামিয়ে ওর মুখের দিকে তাকি মাথা নাড়িয়ে যাবে বললো। ওর হাটটে সমস্যা হচ্ছে তবুও কিছুই বললো না জুবায়েরের হাত ধরে রাস্তার দিকে এগিয়ে চলল। যেতে যেতে জুবায়ের ওর থেকে বিস্তারিত জেনে নিলো। বিষয়টা ওর আছে খুব অদ্ভুত আর জটিল লাগছে। ওদের বাড়িতে এরকম লোকজন আসবে কোথা থেকে জানা নেই তবে কুহু যে মিথ্যা বলছে না এটা প্রমাণিত ওর চোখের পানি আর এমন উথলা হওয়া দেখে। মেয়েটা কিছু একটা দেখছে যেটা অন্যরা দেখতে পাচ্ছে না। আর এগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে আবির নামের ভদ্রলোকটা। হয়তো আবির নামের কেউ ছিল যে এখন বিপদে আছে নয়তো ছেলেটা কুহেলীকে বশবর্তী করতে চাইছে। জুবায়ের মাথায় নানারকম কথা চলছে। অন্যদিকে কুহেলী নিজের মতো বকবক করছে যার প্রায় অর্ধেক কথাই জুবায়েরের কান পযর্ন্ত আসছে না। ওরা গেইট পার হয়ে মেইন রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশের চাঁদ পশ্চিম আকাশে হেলে আছে। সময় চারটা বা সামান্য বেশি । জনশূন্য রাস্তায় দুজন মানব মানবীর কন্ঠ গুঞ্জন হচ্ছে। বাড়িতে বেশ কিছুবছর হয়েছে কোনো দারোয়ান নেই।অনেক খুজেঁছিল কিন্তু কেউ রাজী হয়না। অনেক পুরানো একজন ছিল কিন্তু তিনি হঠাৎ অসুস্থ হবার জন্য গ্রামের বাড়িতে আছেন। সুস্থ হলে হয়তো আবারও আসতেন যদিও বয়স তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। গরীব মানুষের কোনো অবসর হয়না পেট যতক্ষণ চলবে কাজও ততক্ষণ চালাতে হবে। মৃত্যু হলেই ওদের মুক্তি মিলে। কুহলী জুবায়েরের হাত শক্তকরে ধরে হাটছে যদিও ওর কষ্ট হচ্ছে। জুবায়ের ওকে চাইলেই কোলে নিয়ে হাটতে পারতো কিন্তু ওর এখন ইচ্ছা করছে না।বউয়ের প্রেমিক খুঁজতে বেরিয়েছে বিষয়টা ওর কাছে খুব দৃষ্টিকটু লাগছে। বউতো আর বুঝবে না। রাস্তার পাশের গাছ থেকে কাক ডাকছে। কিছুদূর এসে কুহেলী দাঁড়িয়ে পড়লো,
> কেউতো নেই এভাবে আর কতক্ষণ হাটবো?
> আমি জানতাম কেউ নেই কিন্তু তুমি তো মানতে না। তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি তোমার ফোনটা আমার কাছেই আছে। আর আবির নামে সেভ দেওয়া নাম্বারটার খোঁজ করেছি ওটা আজও কেউ ব্যবহার করেনি ফোনও যাচ্ছে না। আমার কি মনে হয় জানো?
জুবায়েরের কথা শুনে কুহু অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> কি মনে হয়?
> তুমি ভালো একটা ডাক্তার দেখাও। আমি সাহায্য করবো তোমাকে।
> কি বলতে চাইছেন এগুলো আমার মনের ভূল? শুনেন আবিরের সঙ্গে আমার তিন বছরের সম্পর্ক আর অসংখ্যবার দেখা হয়েছে। আর হঠাৎ আপনি বলেছেন ওগুলো সব মিথ্যা?
> মিথ্যা না কিন্তু কিছুতো একটা সমস্যা আছে। চিন্তা করোনা আমি আছি তো।কিন্তু তুমি আমাকে না বলে রাতে বাইরে এসেছো তাই আমি কিন্তু রাগ করেছি।
> জানালায় কেউ ছিল তাই।
> আচ্ছা চলো ফিরে যায়।হাঁটতে পারবে নাকি কোলে নিবো?
> এতক্ষণ হেটেই এসেছি।না পারলে আসলাম কিভাবে?
জুবায়েরে ওর কথায় মলিন হেসে ওকে কোলে তুলে নিলো। ওরা বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে চলে এসেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই আযান দিবে তখন লোকজন চলাচল করবে।তখন ওদেরকে এভাবে দেখে প্রশ্ন করবে।। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ওকে নিয়ে ও দ্রুতগতিতে বাড়িতে চলে আসলো। রুমে এসে ওকে নামিয়ে জুবায়ের বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো। কুহেলী পাশে বসে আছে। লোকটা হাপিয়ে উঠেছে ওকে নিয়ে হাঁটতে গিয়ে। কুহেলী পা তুলে বসে জিঙ্গাসা করলো,
> পানি খাবেন?
> না ঘুমাবো। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। আগামীকাল রাতে রুমে দরজায় লক করে ঘুমাতে হবে। বউ খুবই চনচল বাঁধতে হবে।
> অদ্ভুত লোকজন, থাকেন ঘুমিয়ে।
কুহেলীর রাগ হলো। লোকটার একটা খারাপ অভ্যাস আছে কখন কি বলতে হয় জানেনা। যখন তখন অদ্ভুত কথাবার্তা বলে। জুবায়ের ওকে পাত্তা না দিয়ে পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করলো। ক্লান্ত লাগছে ঘুম ও পাচ্ছে। কুহেলীর ঘুম হবে না মনের মধ্যে শুধু আবিরের মুখটা ভাসছে। ছেলেটা যন্ত্রণা পাচ্ছে কিন্তু ও কিছুই করতে পারছে না। কথাগুলো ভেবে ওর অস্থির লাগছে। ফজরের আযান হচ্ছে নামাজ পড়তে হবে কিন্তু পায়ের ব্যাথাটা কেমন দপদপ করছে। মনে হচ্ছে ভেঙে গিয়েছে।
চলবে