অতঃপর তুমি আমি পর্ব ৭

গল্প – অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ৭
পিউয়ের ঘুম ভাঙ্গল ভোরবেলায়। জুনায়েদ বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। তাকে না জাগিয়ে সাবধানে বিছানা ছাড়ল সে। ফ্রেশ হয়ে নিচতলায় রান্নাঘরের দিকে এগোল। আজ সকালের নাশতাটা যদি সে নিজেই বানায়, তাহলে কেমন হয়? ঘড়িতে সাড়ে ছয়টা বাজে এখন। আধঘন্টা পরেই জুনায়েদ উঠে পড়বে। তার সামনে ব্রেকফাস্ট দিলে সে নিশ্চয়ই সারপ্রাইজড হবে! যদিও পিউয়ের সারপ্রাইজ ভাগ্য ভালো না। সবসময় জুনায়েদকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে হিতে-বিপরীত হয়েছে। তবে আজ কোনোরকম গড়বড় হবে না। নাশতা বলতে পাউরুটি টোস্টারে দিয়ে টোস্ট করতে হবে। দুটো ডিম পোচ করবে। আর দুই কাপ কফি। জুনায়েদের জন্য ব্ল্যাক আর তার নিজের জন্য দুধ-চিনি দেয়া। ব্যস, এইটুক কাজে কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। পিউ আজ জুনায়েদকে খুশি করতে চাচ্ছে তিনটা কারণে। প্রথমত, জুনায়েদকে খোশমেজাজে রাখতে হবে। ওকে সংসারের কাজ করতে দেখলে জুনায়েদ খুশি হয়। জুনায়েদ এডিনবরায় ফেরার পর থেকে সংসারের টুকিটাকি কাজ করে সে। জুনায়েদের কাছে ইতোমধ্যে নিজেকে প্রমাণ করে ফেলেছে, এখন আর সে আগের পিউ নেই। জুনায়েদ অবশ্য খুব বেশি কাজ করতে দেয় না তাকে। আগের মতোই সব কাজ নিজে করে। তাকে বলেছে, মন দিয়ে পড়াশুনা করতে। তবু সে কাজ করে কিছু না কিছু। দুপুরে ক্যাথি, সুজান, পলা, নিকোল আর অ্যান্ড্রিয়া আসতে চেয়েছে বাসায়। গার্লস গেট টুগেদার হবে আজ। তবে দুজন ছেলেও আসবে। থমাস আর অ্যালস্টার। একসাথে লাঞ্চ করবে। গল্পসল্প, হৈ-হুল্লোড় চলবে। থমাস আর অ্যালস্টার চলে যাবে বিকেলে, জুনায়েদ ফেরার আগেই। বাকিরা ডিনারের পর যাবে। বলা বাহুল্য বাসাবাড়ির অবস্থা শোচনীয় থাকবে। জুনায়েদ বিকেলে বাসায় ফিরে যেন কোনোরকম ঝামেলা না করে এবং ফ্রেন্ডদের সামনেই চিৎকার-চেঁচামেচি করে ওকে অপদস্থ না করে, সেজন্য সকাল থেকে তাকে খুশি রাখাটা জরুরি। দ্বিতীয়ত, আজ সে ইউনিভার্সিটিতে যাবে না। ক্লাসে অনুপস্থিত থাকাটা জুনায়েদের খুবই অপছন্দ। কেন ক্লাসে যাবে না এই নিয়ে হাজারটা কৈফিয়ত চায় সে। কৈফিয়ত মনমতো না হলে ওকে ঘাড় ধরে ক্লাসে পাঠাবে। নয়তো বিশাল ঝগড়া হয়ে যাবে। তৃতীয়ত, ফ্রেন্ডরা এলে জাস্ট ইট ডট কমে কল করে লাঞ্চবক্সের অর্ডার করবে এবং পাউন্ড অবধারিতভাবে জুনায়েদের পকেট থেকেই যাবে। জুনায়েদ যাতে এই নিয়ে কোনোরকম হাউকাউ না করে, সেদিকে লক্ষ রাখাটা জরুরি।
জুনায়েদের ঘুম ভাঙ্গল বেলা আটটায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই ধড়মড়িয়ে উঠল সে। পাশে পিউ নেই। কোনো এক ফাঁকে অ্যালার্ম বন্ধ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে, যার কারণে সময়মতো অ্যালার্ম বাজেনি। জুনায়েদের খুব বিরক্ত লাগল। পিউয়ের ঘুম ভেঙ্গেছে আগেই, সে অ্যালার্ম বন্ধ করেছে। অথচ সাতটায় ওকে ডেকে তোলেনি! অ্যালার্মই বা বন্ধ করার দরকার হলো কেন তার? দোতলায় কোনো সাড়াশব্দ নেই। নিশ্চয়ই বাগানে গিয়ে বসে আছে এই মেয়ে। কবে যে তার আক্কেলবুদ্ধি হবে! আচ্ছা, আপাতত এই নিয়ে মাথা গরম করার দরকার নেই। সাতসকালে মেজাজ গরম করতে ইচ্ছে করছে না। আর এখন সে নিজেকে সামলে চলে। আগের মতো কথায়-কথায় ঝগড়াঝাটি চলে না তাদের মধ্যে। দুজনই ঝামেলা এড়িয়ে চলে সযত্নে। হাতে একদম সময় নেই। তাই ফ্রেশ হয়ে দ্রুত অফিসের জামাকাপড় পরে তৈরি হলো জুনায়েদ। নাশতা খাওয়া হবে না। পিউয়ের ক্লাস আছে নয়টায়। সে মনস্থির করল, দুজন একসাথে ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে নাশতা সেরে নিবে।
জুনায়েদকে দেখামাত্র পিউ ভয়ে কুঁকড়ে গেল। আজও সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে চরম ধরনের গড়বড় করে ফেলেছে সে। পাউরুটি ব্রেড দিয়েছিল টোস্টারে, কিন্তু টাইমার সেট করতে মনে ছিল না। ব্রেড পুড়ে গেছে। সেই ব্রেডের উপর মাখন লাগিয়েছে। খাবার নিয়ে জুনায়েদের নখরামি নেই। হাতের কাছে যা পায়, তাই খেয়ে নেয়। তাই এই পোড়া ব্রেড খেতে তার কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু ডিম আর কফির বারোটা বেজে গেছে। ডিম পোচ করতে গিয়ে তেল ছিটকে এসেছিল হাতে। হাতটা কলের ঠান্ডা পানির নিচে ধরতে গিয়ে দেখে ডিমের চারদিক পুড়ে গেছে, কুসুমসহ পুরো ডিমটাই শক্ত হয়ে গেছে কেমন। কফির অবস্থা আরো খারাপ। ভুল করে একেক কাপে দুই চামচ কফি দিয়েছিল। তারপর তিতকুটে ভাবটা কমাতে চিনি দিয়েছে বেশ কয়েক চামচ। কিন্তু লাভ হয়নি কোনো। কফি এখন পুরোপুরি খাওয়ার অযোগ্য হয়ে গেছে। তার থেকেও বড় আতঙ্কের ব্যাপার হচ্ছে, এইটুক নাশতা বানাতে গিয়েই রান্নাঘরের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে সে। কাল রাতে ঘুমুবার আগে জুনায়েদ দুই ঘন্টা সময় নিয়ে পুরো রান্নাঘর ধুয়েমুছে পরিস্কার করেছে। আর আজ সকালে এই অবস্থা!
জুনায়েদ নাশতা দেখে কিছুই বলল না। এমনকি রান্নাঘরের অবস্থা দেখেও না দেখার ভান করল। শুধু বলল,
– চলো, বাইরে গিয়ে নাশতা করব আজ। তারপর তোমাকে ক্যাম্পাসে ড্রপ করে আমি অফিসে যাব।
পিউ আমতা আমতা করে বলল,
– কিন্তু আমি তো এখনো রেডি হই নাই।
– কেন? তোমার ক্লাস নাই আজ?
– আছে, যাইতে ইচ্ছে করতেছে না।
– শরীর খারাপ?
– নাহ, এমনিই। তেমন ইম্পরট্যান্ট কোনো ক্লাস নাই। আর তাছাড়া…
– তাছাড়া কী?
– সুজান, ক্যাথি, আরো দুইটা মেয়ে আজকে বাসায় আসতে চাইছে।
– তো?
– ওরা লাঞ্চ করবে।
– লাঞ্চ কী খাওয়াবা ওদের?
– ভাবতেছিলাম, অনলাইনে অর্ডার করব কীনা।
– আচ্ছা, অনলাইনেই অর্ডার কইরো।
– আমি কিচেন ক্লিন করে ফেলব দুপুরের আগেই। তুমি চিন্তা কইরো না। আসলে নাশতা বানাইতে গিয়ে।
– তোমার কিছু করা লাগবে না। কিচেন ক্লিন করতে গিয়ে আবার আরেক কাহিনি করে বসবা। থাকুক অমনেই। আমি বিকেলে এসে ক্লিন করব। তুমি এক কাজ করো। মেইন ডোরের কাছেই থাক। আমি ম্যাকডোনাল্ডস থেকে খাবার কিনে তোমাকে দিয়ে যাইতেছি। হর্ন দিলে তুমি ড্রাইভওয়েতে এসে নিয়ে যাবা। আমি নামব না গাড়ি থেকে। কী খাবা? কী আনব তোমার জন্য?
– ইয়ে, শুধু শুধু পাউন্ড খরচ করে ম্যাকডোনাল্ডস থেকে খাবার কিনবা কেন? আমি কিছু একটা খেয়ে নিব নে।
– আচ্ছা, আমি তাইলে গেলাম। তুমি যা পার, তাই খাও নাশতায়। আর দুপুরে লাঞ্চ কইরো সময়মতো। অর্ডার দিবা বুঝেশুনে। একগাদা বিল করে রাইখো না।
– তুমি লাঞ্চ নিবা না?
– অফিস থেকেই খেয়ে নিব। যাই।
জুনায়েদ চলে যাবার পর পিউ দাঁড়িয়ে রইল ড্রাইভওয়েতে। গাড়িটা চোখের আড়াল হবার পরেও নড়ল না অনেকক্ষণ। এই জুনায়েদকে সে চেনে না। জুনায়েদের আচরণ, কর্মকান্ড ইদানিং বেশ দুর্বোধ্য লাগে। কখন কী করবে, কখন কী বলবে আগেভাগে প্রেডিক্ট করা মুশকিল। এতগুলো বছর ধরে সে জুনায়েদকে জানে। সবসময় দেখেছে, খুঁটিনাটি যে কোনো ব্যাপারে উনিশ-বিশ হলেও ধমকানো তার স্বভাব। সে নিজে খুব খুঁতখুঁতে আর পরিপাটি মানুষ। তাই স্বভাববিরুদ্ধ কিছু দেখলে ক্ষেপে যায়। অথচ আজ আদতে সেরকম কিছুই হলো না। এমনকি সুজানরা আসবে জেনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। পাউন্ড খরচ করে বাইরে থেকে লাঞ্চ অর্ডার করবে, তা নিয়েও তার মাথাব্যাথা নেই কোনো। উলটো আজকাল সে পকেট মানির নামে ওর অ্যাকাউন্টে নির্দিষ্ট পরিমাণ পাউন্ড দিতে শুরু করেছে প্রতি মাসে। এই পাউন্ড দিয়ে যাচ্ছেতাই করলেও সে কৈফিয়ত চায় না। ভুল করেও জিজ্ঞে করে না, কোন খাতে, কত পাউন্ড খরচ হয়েছে। পিউ কয়েকবার নিজ থেকে ওকে হিসেব-নিকেশ জানিয়েছে। শুনেও তেমন পাত্তা দেয়নি।
পিউ জানে না আচমকা জুনায়েদের এমন পালটে যাবার কারণ কী। তবে এটা জানে এই পরিবর্তন কোনোভাবেই শুভ নয়। তার মনের মধ্যে কুডাক দেয় জুনায়েদের এরকম পালটে যাওয়া আচরণ দেখলে। ঠিক এখন যেমন লাগছে। হাত-পা কাঁপছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে, কিছু একটা ঠিক নেই। একটা অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে দুজনের মাঝে। পাশাপাশি থেকেও তাদের মধ্যে দুরত্ব অনেক। দিনকে দিন এই দুরত্ব বাড়ছে। ডিভোর্স ক্যানসেল করার পর যখন একসাথে থাকতে শুরু করল ওরা, তখন থেকেই জুনায়েদের এই পরিবর্তন। কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব তার মধ্যে। পিউয়ের কোনো ব্যাপারেই সে এখন আর নাক গলায় না। এমনকি পাশাপাশি শুয়ে থাকে এক বিছানায়, তাও জড়িয়ে ধরে ঘুমায় না। এডিনবরায় ফিরে এসে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। সকাল নয়টা থেকে বিকেল সাতটা পর্যন্ত তার কাজ। বাসায় ফেরে আটটায়। তারপর রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরদোর পরিস্কারের কাজ করে, কাপড় ধুতে দেয় ওয়াশিং মেশিনে, রান্নাঘর পরিস্কার করে। পিউকে বরাবরের মতোই সংসারের কাজ করতে নিষেধ করে। রান্নাঘর ময়লা করে ফেলবে এই অজুহাতে রান্না করতে দেয় না। সব কাজ সে নিজেই করে। আগেও করতো, তবে আগে সে পিউকেও ঘর-সংসারের কাজে হাত লাগাতে বলত। তার কাজে ফাই-ফরমায়েশ খাটাতো ওকে দিয়ে। এখন তাও করে না। উলটো পড়াশুনার অজুহাত দেয়। বলে, মন দিয়ে পড়াশুনা করো। পড়া শেষ হলে তখন সংসারের কাজ করার জন্য অফুরন্ত সময় পাবা। কখনোবা রাত জেগে অফিসের কাজও করে। এমনও অনেকদিন গেছে, পিউ ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
উইকেন্ডে জুনায়েদ বাসায় থাকলেও হাজার রকমের কাজ থাকে তার। পিউ ওর আশপাশে ঘুরঘুর করে। কিন্তু সে যেন পিউকে চোখেই দেখে না। নিজের মতো করে কাজে ডুবে থাকে। কখনো অফিসে ওভারটাইম করতে হয়। তখন সারা সপ্তাহে এক মিনিটের জন্যও দেখা হয় না ওদের। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই জুনায়েদ অফিসে চলে যায়। তখন পিউ গভীর ঘুমে থাকে। আবার যখন ফেরে রাতের বেলায়, তখনো পিউ বেঘোরে ঘুমোয়। সেসময় পিউয়ের মনে হয় এই বাড়িতে সে আবারো একা, পুরোপুরি একা! (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here