অতঃপর সন্ধি পর্ব -০৬+৭

#অতঃপর_সন্ধি (০৬)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

সোনালী রোদে চিকচিক করছে বালি। জায়গাটা কয়দিন আগেই ভরাট করা হয়েছে। আগে এখানে এলে শীতলতায় মন ছেয়ে যেতো পানির ঠান্ডা হাওয়ায়। আর এখন ভ্যাপসা গরম। একটু ছায়া দেখে বসে আছে পুষ্পিতা। অপেক্ষা করছে মায়ানের জন্য। ক্লাস বাঙ্ক করেছে আর জারিনকেও বলেনি। চারপাশে মানুষের আনাগোনা খুব কম। এই সময় কেউ হাঁটতে বের হয় না।

কেউ পুষ্পিতার পাশে ধপাস করে বসে পড়ল। সে ভয় পেয়ে এক লাফে দূরে সরে যায়।

‘আপনি এখানে? আর আমি পুরো জায়গাটা দুইবার রাউন্ড দিলাম।’

মায়ানকে দেখে বুকে থুথু দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো পুষ্পিতা।

‘ওহ্ আপনি?’

‘কেন আরো কেউ আসার কথা নাকি?’

‘আমি আপনার মতো নাকি যে গার্লফ্রেন্ড রেখে আরেক মেয়ের সাথে টাংকি মা’রবো।’

পুষ্পিতার ছেলেমানুষী কথায় সশব্দে হেসে উঠলো মায়ান। একটা বক্স পুষ্পিতার সামনে রাখল। বক্স দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল পুষ্পিতার। প্রশ্ন করে বসল,

‘এটা কি?’

‘বলছি, তবে আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।

জিজ্ঞাসাসূচক চাহনি নিক্ষেপ করে পুষ্পিতা। খানিক নিরব থেকে মায়ান বলা শুরু করলো,

‘মেয়েদের ইন্দ্রিয় খুব প্রখর হয়। কোনো ছেলে আড়চোখে তাকালেও এরা বুঝে যায়। ছেলেদের আবার উল্টো এদের বলে কয়ে বুঝানো লাগে। মাঝে মাঝে তো বলার পরও বুঝে না।’

কথাগুলো বলে হু হা হাসতে লাগে মায়ান। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে পুষ্পিতা।

‘এগুলো আপনার কিছু কথা?’

হাসি মিলিয়ে গেলো মায়ানের।

‘না, আপনি আমাকে পছন্দ করেন। অবশ্য ভালোও বাসেন। আপনার চাহনি বা কথা বলার ধরন দেখে বুঝা যায়। বিশেষ করে গতকালকের জেলাসি।’

চিকচিক করতে থাকা বালুকণায় নিজের নাম লিখলো মায়ান। অতঃপর আবারও বলা শুরু করল,

‘আপনি উচ্চ মধ্যবিত্ত বাবার রাজকন্যা। জন্মের কখনো অভাব দেখেন নি। তবে আমি দেখেছি।স্কুলের ভর্তি হওয়ার পর খুব কমই আমি সকালের খাবার খেয়ে স্কুলে গিয়েছি। কারণ আমার বাবা নিম্নবিত্ত। নূন আনতে পান্তা ফুরায় আমাদের। আমার তিন বোন আর আমি। এক খন্ড জমি ছিলো বড় বোনের বিয়ের সময় সেটাও বিক্রি দিয়েছে বাবা। বাকি দুইবোন আমার ছোট। পড়াশোনায় একটু ভালো ছিলাম বলে এখনো চলছে। মানুষের দয়ায়।’

‘তো এসব আমাকে কেন বলছেন?’

‘কারন আমি আপনাকে ভালোবাসি।’ নির্লিপ্ত, উদাসীন স্বরে বলল মায়ান।

বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেলো। আশ্চর্যান্বিত, চমৎকৃত চোখে চেয়ে রইলো মায়ানের দিকে। অপ্রত্যাশিত কিছু শুনতে পেয়ে চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করলো পুষ্পিতার।

‘আর ঐ মেয়েটা?’

‘প্রেমিকা হওয়ার বাহিরে বন্ধুবান্ধব বলেও একটা শব্দ আছে।’

বক্সটা পুষ্পিতার হাতে দিয়ে পুনরায় বলল,

‘আপনার জন্য বার্থডে গিফট কিনতে আমার ফ্রেন্ডকে নিয়ে শপিংমল গিয়েছিলাম।’

জানে পানি আসলো পুষ্পিতার। মায়ান আবারও বলতে লাগল,

‘আমি যাকে বিয়ে করবো তাকে গ্রামে থাকতে হবে। আমার বাবা মায়ের জন্য। তাকে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হবে। শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হবে। তাকে রাজরানী করে রাখার মতো ক্ষমতা আমার নাই। গ্রামের ঘরোয়া বউ হয়ে থাকতে হবে। আপনি হয়তো গ্রামের বউ হতে ইচ্ছুক নন? মাটির চুলোয় রান্নাও করতে পারবেন না। সেজন্য কিছু বলিনি আমি।’

‘ভালোবাসা এতো হিসাবনিকাশ করে হয়? প্রশ্ন করলো পুষ্পিতা।

‘এই চিন্তাটা বিয়ের আগ অবদি থাকে। বিয়ে হয়ে গেলে সবাই মানিয়ে নিতে পারে না। তখন হিসাবনিকাশের প্রয়োজন পড়ে। স্বামী স্ত্রীর দূরত্ব বাড়ে।’

‘ভালোবাসা’ এটা এমন একটা শব্দ এটার জন্য মানুষ সব করতে পারে সব। কিছুটা স্যাক্রিফাইস কিছুটা কম্প্রোমাইজ। মেনে নিতে হয় না হয় মানিয়ে নিতে হয়। কারণ লোভটা হচ্ছে ভালোবাসার মানুষের সাথে সারাজীবন কাটানোর। সুখে-দুঃখে তার পাশে থাকার।’

‘আবেগে অন্ধ হয়ে সব বলা যায়। কিন্তু প্রবলেম গুলো যখন ফেস করবেন তখন মনে হবে কতবড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনার আমাকে স্বার্থপর মনে হতে পারে। ডিরেক্ট বলে দিলাম বিয়ের পর গ্রামে থাকতে হবে। কারণ ওই মানুষ গুলো ছিলো বলে আজ আমি এখানে। তাদের মুখের হাসিটা আমার কাছে সবকিছু।’

‘কেন আপনি কি সারাজীবন স্টুডেন্ট থাকবেন? জীবনে কি কখনো প্রতিষ্ঠিত হবেন না? নাকি সারাজীবন অভাবের সাথে লড়াই করবেন?’ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো পুষ্পিতা।

‘আজকাল হাজার হাজার ছেলে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

মায়ানের কথাটা পাত্তা দিলো না পুষ্পিতা। বালিতে আঙুল দিয়ে লেখা মায়ানের নামের পাশে নিজের নাম লিখলো। মায়ানও সেইদিকে তাকিয়ে আছে। নাম লেখা শেষ করে পুষ্পিতা নিজের হাতটা মায়ানের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

‘আপনার জীবনের সকল হীনতা, অভাব, ঘাটতি সারাজীবন আপনার পাশে থেকে পূরণ করে দিতে চাই। সন্ধি?’

হাতের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে মায়ান শান্ত স্বরে বলল,

‘ভেবে বলছেন তো? সারাজীবন কিন্তু স্যাক্রিফাইসই করতে হবে।’

‘ভালোবাসা ভেবেচিন্তে হয় না মিস্টার। জাস্ট হয়ে যায়। স্যাক্রিফাইস না হয় করলাম। আপনি না হয় পাশে থেকে একটু সাহস আর ভরসা দিয়েন।’

‘তবে হউক সন্ধি একসাথে থেকে সুন্দর এক পৃথিবী গড়ার।’

_________________

পুষ্পিতার হাতের নতুন ঘড়িটা নেড়েচেড়ে দেখছে জারিন। মুখ কালো করে বলল,

‘ঘটনা ঘটার পর বলতে আসছিস কেন? একেবারে পুঁচকে টুচকে সাথে নিয়ে এসে বলতি?’

জারিনের গাল টানল পুষ্পিতা।

‘ওলে লে কিউটি রাগ করেছে?’

‘সিঙ্গেল থেকে ডাবল হয়ে সোজা গিফট সমেত এসে সব বলতেছে।’

‘আরে আমি তো ভেবেছিলাম অন্য কিছু। হয়ে গেল অন্যকিছু।’ বলতে বলতে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো পুষ্পিতা।

‘বান্ধবী আমার সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হয়ে গেলো আমিই,,,,,’

কথা শেষ করতে পারলো না এর আগেই একেবারে স্থির, নিশ্চুপ হয়ে হয়ে গেলো জারিন। মুখের হাসিটাও মিলিয়ে গেলো।

জড়বস্তুর মতো সামনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে পুষ্পিতাও জারিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাল। বেঞ্চে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। পিছনে তানজিফ কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গলা শুকিয়ে গেল তার। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে তানজিফ তাড়াতাড়ি করে আগলে নিলো। ব্যথা পাওয়ার ভয়ে পুষ্পিতাও তানজিফের শার্ট আঁকড়ে ধরে।

______________________

ঘাস বেষ্টিত ক্যাম্পাসের একপাশে বসে আছে তিনজন। সবাই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তানজিফের মুখোমুখি মাথা নুইয়ে বসে আছে পুষ্পিতা।

‘সেই তো প্রেমে জড়ালি তবে আমার সাথে কেন নয়?’

নিরুত্তর রইলো পুষ্পিতা। এক পলক তানজিফের দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি নত করে ফেলে। তানজিফ পুনশ্চ প্রশ্ন করলো,

‘আমার এতোদিনের পাগলামি, ভালোবাসা এসব কি সত্যি তোর চোখে পড়েনি? শত অপমান, অবহেলার পরও তো আমি তোর পিছনে পড়ে ছিলাম। আমার ঠিক কোন জায়গাটায় ঘাটতি আছে বলতে পারবি?’

‘তানজিফ দেখ,,,,,’

হাতের ইশারায় জারিনকে থামিয়ে দিলো তানজিফ।

‘উত্তরটা ওকেই দিতে দে।’

নিশ্চুপ পুষ্পিতা মাথা উঁচিয়ে তানজিফের চোখে চোখ রাখল। তানজিফ তখনো পুষ্পিতার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে ছিলো।

‘ভালোবাসা বস্তুটা আত্মিক, অনুভব করার। পিছনে পিছনে ঘুরলেই ভালোবাসা হয়ে যাবে এমন না। যাকে আমি মন থেকে অনুভব করতে পারি না তার সাথে সারাটা জীবন কিভাবে কাটাবো?’

‘হয়তো-বা আমার ভালোবাসাটা অনুভব করার বদলে বিরক্তিকর ছিলো। যাইহোক তোর রিলেশনশিপ এর জন্য শুভকামনা। দোয়া করি পূর্ণতা পাক। আমাদের ট্রিট দিতে ভুলিস না।’ বলেই উঠে দাঁড়াল তানজিফ। বিষন্ন, ভগ্নহৃদয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হতেই পুষ্পিতা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,

‘তুই প্লিজ আন্টি বা মাকে কিছু বলিস না।’

মলিন হাসলো তানজিফ।

‘অন্যের ভালোবাসার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো এমন নিকৃষ্ট অন্তত আমি না।’

পুষ্পিতা মাথা নুইয়ে লজ্জিত স্বরে বলল,

‘সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি স্যরি। আসলে আমি একটু ডিস্টার্বড ছিলাম তাই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।’

‘কয়দিনের ব্যবহার জন্য স্যরি বলবি? সেই হিসাব করলে তো তোর বাকি জীবনটাই স্যরি বলতে বলতে পার হয়ে যাবে।’

অন্ধকার ঘনীভূত হলো পুষ্পিতার মুখ জুড়ে।

‘ডোন্ট বি আপসেট। আই’ম জাস্ট কিডিং। আমি কিছু মনে করিনি। আসলে ওমন ব্যবহার আমি সয়ে গিয়েছে তো তাই। আজকের পর আর কেউ তোকে বিরক্ত করবেও না। বিরক্তির কারণও হবে না।’

শেষের খুঁচা দেওয়া কথাটা ঠিকই বুঝতে পারলো পুষ্পিতা। তানজিফের চোখে চোখ রাখার মতো সাহস হলো না তার। আরো বি’স্ফো’রি’ত হলো তানজিফের শেষের কথাটা শুনে,

‘ তবে আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবো। যতদিন পর্যন্ত তোকে পাওয়ার সুযোগ থাকবে আমি ততদিন অব্দি তোর অপেক্ষায় থাকবো।’

#চলবে

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।#অতঃপর_সন্ধি (০৭)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

গুটি গুটি পায়ে তিনশত পয়ষট্টি দিন পার হয়ে গেলো চোখের ইশারায় । এই তিনশত পয়ষট্টি দিনে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। গভীর থেকে গভীর হয়েছে পুষ্পিতা আর মায়ানের ভালোবাসা।

মোটা বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে মায়ান। এক লাইন পড়ছে তো আরেক লাইন মাথা থেকে ফুউউস করে বের হয়ে যাচ্ছে। একঘেয়েমি জেঁকে ধরলো তাকে আষ্টেপৃষ্টে। বইয়ে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে রইলো। ক্লান্তি আর টেনশনে চোখ লেগে গেলো তার। আতিকের ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে সে। চোখজোড়া লাল। হুট করে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।

‘ঘুমিয়ে গিয়েছিলি নাকি?’

চোখ পিটপিট করে নিঃশব্দে মাথা ঝাকায় সে।

‘তোর ফুলবানু সেই কখন থেকে কল করে যাচ্ছে।’

চোখের ঘুম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো মায়ানের।তৎক্ষনাৎ পুষ্পিতার নম্বরে ফোন লাগালো। আতিক আহাম্মকের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে।

‘আগে শুনতাম প্রেমিকা চুমু দিলে এনার্জি পাওয়া যায়। এখানের মামলাই তো অন্যরকম দেখছি। প্রেমিকার নাম নিতেই দেখি দূর্বল প্রেমিক চাঙা।’

চোখ রাঙানি দেয় মায়ান। আতিক আরো কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই মায়ান হাতে কাছে থাকা কলমটা ছুড়ে মা’রে তার উপর।

‘পড়ছিলেন বুঝি?’

ওপাশ থেকে পুষ্পিতার কন্ঠ শুনে স্বাভাবিক হলো মায়ান।

‘বই সামনে নিয়ে বসে আছি।’

পুষ্পিতা কোমল অনুরোধের সুর টানলো।

‘আপনার পরীক্ষার জন্য আমাদের মিট হয় না অনেকদিন। বিকেলে মিট করতে পারবেন? আমার চোখের তৃষ্ণাও মিটলো আর,,,,,,, ‘

কথা অসম্পূর্ণ রেখেই থেমে গেলো পুষ্পিতা। কপাল কুঁচকে মায়ান প্রশ্ন করলো,

‘আর কি?’

‘আমি নিজ হাতে বিরিয়ানি রান্না করেছি।’

‘আমার ফুলবানু বিরিয়ানি রান্না করেছে। সেটা খাওয়ার জন্য হলেও আমাকে মিট করতে হবে।’

_________________

বিগত দিনগুলোতে পুষ্পিতা আর মায়ান যতটা কাছে এসেছে এর থেকেও তিনগুণ দূরত্ব বেড়েছে পুষ্পিতা আর তানজিফের মাঝে। লাস্ট কবে তানজিফ পুষ্পিতাকে জ্বালিয়েছে মনে পড়ে না তার। ক্লাসের ফাঁকে দুজনের চোখাচোখি হলে এখন আর তানজিফ চোখ মা’রে না। বিষন্ন মুখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

পুষ্পিতার হাসোজ্জল ছবির দিকে নিমেষহীন তাকিয়ে রইলো তানজিফ। কখনো জুম করে চোখ দুইটা দেখছে কখনো বা ঠোঁট। বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করছে। অদৃশ্য যন্ত্রণায় কেমন নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার। পুষ্পিতার হাত দু’টো ধরে খুব করে বলতে ইচ্ছে করে,

‘আমায় একটু ভালো কেন বাসলি না? তোর দহনে আর শুন্যতায় আমি যে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি ভালো নেই। রোজ তোর সাথে অভিনয় করতে করতে আমি ক্লান্ত। আমার একটু বিশ্রাম দরকার।’

তবে বলা হয় না। হয়তো আর কখনো বলা হবেও না।

‘আমি ঘুরতে যাবো ভাইয়া।’

অকস্মাৎ তিতিরের গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাবড়ে যায় তানজিফ। তিতির দেখার আগেই মোবাইল উল্টো করে ফেলল। একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালালো।

‘কি করবি তুই?’

‘ঘুরতে যাবো।’

বলে ঢং করে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করলো। তবে ছোট ছোট চুলগুলো আর কান অবদি গেলো না।

তিতিরের এমন ঢং দেখে ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো তানজিফ।

‘ঢং করে লাভ নেই ওগুলো কানের পিছনে যাবে না।’

গাল ফুলালো তিতির।

‘আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাও।’

‘তুই ঘুরবি?’

প্রফুল্ল হেসে মাথা নাড়ে তিতির। বিলম্ব না করে তানজিফ তিতিরের একটা আঙ্গুল ধরে মাথার উপরে তুলল। আঙ্গুল ধরে কয়েকবার ঘুরিয়ে বলল,

‘ঘুরতে চেয়েছিস? কয়েকবার ঘুরিয়েছি। যা গিয়ে পড়তে বস।’

ধপাস করে শুয়ে পড়লো। বালিশ জড়িয়ে ঘুমো ঘুমো গলায় বলে উঠলো,

‘যাওয়ার আগে দরজা টেনে যাস।’

নাক ফুলাচ্ছে তিতির। চোখ দুইটা লাল হয়ে কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। রাগে, ক্ষোভে সে গরগর করতে লাগে। কাল বিলম্ব না করে এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে আম্মুউ বলে উঠলো।

______________

বাদামের খোসা ছাড়িয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে মুখে দিলো পুষ্পিতা। গম্ভীর স্বরে বলল,

‘তোর চশমিশ টিচার তো আজকাল বড্ড গ্যাপ দিচ্ছে। এমন করলে কিন্তু উনার কাছে আর তোকে পড়াবো না। সাফ সাফ বলে দিবি।’

ভ্রু কুঞ্চিত করে ফারদিন দৃষ্টিপাত করলো।

‘আমার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ ভুলে গিয়েছো? আর ভাইয়ারও পরীক্ষা চলছে।’

থতমত খেয়ে গেলো পুষ্পিতা। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,

‘ ত তো? মা তো তোকে বছরের শেষ সময়েও পড়ায়।’

ফারদিন রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই পুষ্পিতা নির্বোধ, অর্থহীন হাসলো।

‘মা, একটা বক্সে বিরিয়ানি দাও তো। জারিনের জন্য নিয়ে যাবো। ফাজিলটা বিশ্বাসই করছে না আমি যে রাঁধতে পারি।’

কোনো রকম ফারদিনের সামনে থেকে উঠে এলো।

_____________________

কালো বোরকায় মুখ ঢাকা পুষ্পিতার। ভয়ার্ত চোখে সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চেনা জানা মানুষ চোখ দেখলে চিনতে পারে।

বক্স থেকে এক চামচ মুখে পুরে নিলো মায়ান।

‘আজ এভাবে বোরকা টোরকা পড়ে এসেছেন, ঘটনা কি ফুলবানু?’

‘আমার এই ফুলবানু নামটা শুনলে কিন্তু খুব রাগ হয়।’

‘কিন্তু আমার যে ভালো লাগে ডাকতে। ফুলবানুউউউউউ।’

ক্রোধান্বিত চোখে তাকায় পুষ্পিতা।

‘এভাবে তাকাবেন না ফুলবানু। আপনার চাহনি আমার কলিজায় এসে লাগে।’

এবারে পুষ্পিতা চাহনি তীক্ষ্ণ হয়ে এলো।

‘আমি আপনাকে ফুলবানু বলেই ডাকবো। আপনি যতই রাগ করেন না কেন। এখন বলেন এভাবে কেন এসেছেন?’

‘মিথ্যে বলে বাসা থেকে বের হয়েছি। যদিও মিথ্যে না। আগে জারিনদের বাসায় গিয়েছি। সেখানে বোরকা পড়ে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। কেউ যদি আমাকে চিনে ফেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’

‘এতো কষ্ট কার জন্য, ফুলবানু?’

‘শরীরে রং বেশি তাই।’

অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতা।

‘নেকাবটা কি একটু খুলবেন?

জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকায় পুষ্পিতা।

অনুরক্ত, আবেগী স্বরে কন্ঠনালী দিয়ে নির্গত হলো,

‘আপনাকে খাইয়ে দিতাম।’

পুষ্পিতার তীক্ষ্ণ চাহনি এবার শীতল হয়ে এলো। কোমল, মোলায়েম স্বরে বলল,

‘আমি খেয়েছি।এটা আপনার জন্য এনেছি।আপনি বরং খান।’

‘তবে আপনি খাইয়ে দিন।’

পুষ্পিতা উত্তেজিত স্বরে বলল,

‘আসতাগফিরুল্লাহ্, এই পাবলিক প্লেসে অন্তত আমি পারবো না।’

‘কেউ তো আপনাকে চিনবে না।’ বলে পুষ্পিতার হাতটা ধরতেই সে মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো।

কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে মায়ানের। চিন্তাগ্রস্ত গলায় প্রশ্ন করলো,

‘হাতে কি হয়েছে?’

‘কিছু না। আপনি খান।’

মায়ান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘কেন আমি দেখলে সমস্যা?’

‘না না সমস্যা কেন হবে? আসলে রান্নার সময়,,,,,’

‘যা পারেন না তা করতে যান কেন? আগে দূর থেকে দেখতে হয়। তারপর সবকিছু।’

‘মেয়ে হয়েছি হয়তো বা মা পড়াশোনার জন্য রান্নাবান্না বা কাটাকুটি করতে দেয় না। তবে রান্না মেয়েদের জীবনের সাথে জড়িত। শিখছি, এটা ব্যপার না। আমি এখন মাছ রান্না করতে পারি। তবে মাংস রান্না করতে গেলে তালগোল পাকিয়ে যায়।’

‘আমার বলা প্রথম দিনের কথাগুলো জন্য তাই না?’

প্রসঙ্গ বদলানোর পুষ্পিতা বলল,

‘বিরিয়ানি কেমন হয়েছে সেটা বললেন না তো?’

‘যে মানুষটা হাত পুড়িয়ে আমার জন্য রান্না করে এনেছে সেই রান্না নিশ্চয়ই খারাপ হবে না? তাতে আবার স্পেশাল মশলা হিসেবে ভালোবাসা আছে। এটার টেস্টই এখন অন্যরকম।’

______________________

হাতে কোণ আইসক্রিম নিয়ে তিড়িংবিড়িং করে হেঁটে যাচ্ছে তিতির। চোখেমুখে উপচে পড়া আনন্দ তার। সারা বাড়ি মাথায় তুলে তানজিফের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে।

তিতিরের পিছনে পিছনে আসছে তানজিফ। বোনের আনন্দ দেখে পলকহীন তাকিয়ে আছে সেদিকে। মানসিক যন্ত্রণা থেকে একটুখানি স্বস্তি পাওয়ার জন্য হয়তো পরিবারের মানুষগুলোই যথেষ্ট।

সহসা ঘাড় বাঁকিয়ে উদ্যানের কোণায় নজর পড়তেই চোখ স্থির হয়ে গেলে তানজিফের। একটা মেয়ে আরেকটা ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে। তিতিরে হাতটা ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলো। ছেলেটাকে চিনে সে। পাশের মেয়েটার দিকে তাকাল। আপাদমস্তক বোরকায় আবৃত। চোখগুলোর দিকে তাকাতেই বুকটা ধক করে উঠলো তার। শ্বাস আঁটকে এলো। বুকটা কাঁপছে না পাওয়ার যন্ত্রণায়।

#চলবে

আজ তাড়াহুড়ায় কি লিখছি নিজেও জানি না। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here