অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব -০৪+৫

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৪
#তাশরিন_মোহেরা

স্নিগ্ধ সকালের এক স্নিগ্ধ পরিবেশ। পরিষ্কার নীল আকাশে সাদা মেঘ উড়ছে। ঠান্ডা মনোরম বাতাস বইছে। তবে এই স্নিগ্ধ, মনোরম দিনের শুরুটা আমার মোটেও ভালো হয়নি। অনিবার্য কারণে আজ মুখর আমায় মুগ্ধকে পড়াতে আসতে না করেছে। তাই ভেবেছি সকালে আজ একটু দেরিতে উঠবো। কিন্তু তা আর হলো কই? সকাল আটটা থেকে ফোনটা আমার বেজেই যাচ্ছিলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ফিসফিসিয়ে কেউ বলছে,

‘তিথু, জলদি রেডি হয়ে ভার্সিটি চলে আয়।’

কে কল দিয়েছে তা আর দেখার প্রয়োজন পড়লো না আমার। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,

‘এই সাতসকালে আমি ভার্সিটি গিয়ে কি করবো, রূপক ভাই?’

রূপক ভাই পুনরায় ফিসফিস করে বলছে,

‘একটু কাজ আছে। আয় না, আমার বোন!’

আমি তাকে আর না করতে পারলাম না। এই মানুষটা হলো ভার্সিটির এক বড় ভাই। নাম রূপক খন্দকার। নিত্যদিনই তার কিছু না কিছু কাজ পড়ে যায়। আর সেই কাজে সাহায্য করার একমাত্র ব্যক্তি হলাম আমি। দিন নেই, ক্ষণ নেই তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসতে হয় আমার। আজও এর ব্যতিক্রম হলো না! খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

ভার্সিটি ঢুকতেই দেখলাম একগাদা পেইজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপক ভাই। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আবার কি হলো, বলো তো! কে তোমায় আবার কাজ দিলো?’

রূপক ভাই আহ্লাদের সুরে বললো,

‘তুই ছাড়া এই ভার্সিটিতে আমার আর কে আছে বল? দেখতে একটু হাবাগোবা বলে কেউই আমার সাথে মিশতে চায় না। তাই তোকেই বারবার বিরক্ত করি কাজ দিয়ে।’

আমি তাকে থামিয়ে বললাম,

‘আর মাখন ঢলতে হবে না, রূপক ভাই। কি কাজ আছে তা-ই বলো!’

রূপক ভাই আমাকে ক্যান্টিনে নিয়ে গেল। সেখানে দেখলাম এক মেয়ে বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে। রূপক ভাই আমাকে বললো,

‘ইনি হলেন আমার এক বছরের সিনিয়র আপু, রূপন্তী।’

এটুকু বলেই রূপক ভাই আমাকে ইশারায় বললো,

‘সালাম দে!’

আমিও সৌজন্যতার সহিত মেয়েটাকে সালাম দিলাম। কিন্তু, আশ্চর্য! সালামের উত্তর দেওয়া তো দূর, মেয়েটা আমার দিকে ফিরেও দেখলো না। ব্যাপারটা আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। রূপক ভাই এবার বললো,

‘আপুর সামান্য কিছু এসাইনমেন্ট আমাদের করে দিতে হবে। সেজন্যই তোকে ডাকলাম। আমি অর্ধেক করবো আর তুই বাকি অর্ধেক।’

কিন্তু এসাইনমেন্টের বাহার দেখে মনে হলো না ‘সামান্য কিছু’। হয়তো সারা বছরের সবটাই আমাদের দিয়ে করাতে চাইছে এই মেয়ে। আমি রূপক ভাইকে ফিসফিসিয়ে বললাম,

‘এই মেয়ে আমাদের ব্যবহার করছে, রূপক ভাই।’

রূপক ভাইও আমাকে ফিসফিস করে বললো,

‘আরেহ! মেয়ে মেলা বড়লোক। এই কাজটা করে দিলে আমাদের লাভই হবে, তিথু। তুই ভাবিস না।’

মেয়ের হাবভাব আমার বিন্দুমাত্র পছন্দ হলো না। বড়লোক বলে ভার্সিটিতে দাপট দেখাচ্ছে। তার চোখ দেখেই বোঝা যায় মনটা অহংকারে ঢেকে পড়েছে সম্পূর্ণ। কিন্তু রূপক ভাইকে না করার ইচ্ছে আমার নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই এসাইনমেন্টগুলো নিতে হলো।

.

‘ভাইয়া রুটি বানাতে দক্ষ হতে চায় তাই আজ থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত আপনার এই রুটি আর আলুভাজিই খেতে হবে, ম্যাম!’

মুগ্ধ টেবিলে নাস্তা রাখতে রাখতে কথাটুকু বললো। তার কথা শুনে রীতিমতো একটা বড় আঘাত পেলাম। নিজের কপালটা দেয়ালে ঠু’কে ম’রে যেতে ইচ্ছে হলো আমার। এই কোন পা’পে’র শাস্তি দিচ্ছে লোকটা আমায়। মুগ্ধের কাছে জানতে চাইলাম,

‘হ্যাঁ গো, মুগ্ধ! রোজ রোজ এসব খেতে তোমার ভালো লাগে?’

মুগ্ধের মুখশ্রী দ্বিগুণ মলিন হয়ে গেল। সে দুদিকে দুবার মাথা দুলিয়ে বললো,

‘উহু! একদমই না।’

আমি দু’হাত মুট করে ভাবলাম এ নিয়ে কি করা যায়! মুখরকে কি সরাসরি বলবো, ‘আপনার রান্না খুব খারাপ, মুখর সাহেব।’ না না! একথা বলার সাধ্যি আমার নেই। তবে উপায়? কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম মনে মনে। সিনেমার নায়কদের মতোই থ্রিপিসের হাতাটা গুটিয়ে নিলাম। বেশ ভাবের সাথে হিজাবটাও ঠিক করলাম। এ দেখে মুগ্ধ অবাক হয়ে বললো,

‘ম্যাম? কি হয়েছে?’

আমি তার পিঠ চাপড়ে বললাম,

‘রান্নাটা আজ আমিই করি, কি বলো মুগ্ধ?’

মুগ্ধের নয়ন খুশিতে নেচে উঠলো। লাফিয়ে সে সম্মতি জানালো। আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেল রান্নাঘরে। সেখানে পো’ড়া পো’ড়া রুটি সেঁ’ক’ছে মুখর। পুরো রান্নাঘরটাই ধোঁয়ায় ছেঁয়ে গেছে। তা উপেক্ষা করেই আপনমনে রুটি সেঁ’কে যাচ্ছেন মুখর সাহেব। অতরিক্ত ধোঁয়ায় আমি আর মুগ্ধ কাঁশতে শুরু করলাম। এ দেখে মুখর পেছন ফেরে। ঠিক তখনি আমার চোখ যায় তার শ্যা’ম কপালে ছড়িয়ে থাকা একগুচ্ছ চুল যা ময়দা লেগে কিছুটা সাদা হয়ে গেছে। এতেও দেখতে ভারী অ’মা’য়ি’ক লাগছে মুখরকে। পরক্ষণেই নিজের কান্ডে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। নিশ্চয়ই বে’হা’য়া’র মতো তাকিয়ে ছিলাম মুখরের দিকে। তড়িৎ দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম আমি। মুগ্ধ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে তার গায়ের এপ্রোনটা খুলে আমার হাতে তুলে দিলো। উৎফুল্ল চিত্তে মুখরকে বললো,

‘ভাইয়া, আজ নাকি ম্যাম আমাদের জন্য নাস্তা বানাবেন।’

মুখর মুখটা কুঁচকে আমার দিকে একবার তাকালো। পরপরই মুগ্ধের দিকে চেয়ে বললো,

‘মানে? নাস্তা তো আমি বানিয়েছিই!’

মুগ্ধ অভিযোগের সুরে মুখরকে বললো,

‘তোমার নাস্তা খেয়ে প্রতিদিন স্কুলে আমার বা’থ’রু’মে যেতে হয়। সবাই হাসাহাসি করে আমায় নিয়ে।’

কথাটা শুনেই শব্দ করে হেসে উঠলাম আমি। মুখর আবারো সেই বিরক্তির চাহনি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছে। হাসি থামলো আমার সাথে সাথেই। মুখর আমার কাছ থেকে এপ্রোন নিয়ে বললো,

‘আমার বাড়িতে পড়াতে এসে কেউ নাস্তা বানাক, এ আমি হতে দেবো না। অযথা ব্যস্ত হবেন না, মিস.তিথিয়া। আমি আবারো ভালো করে নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি।’

কিন্তু মুগ্ধের জেদের কাছে মুখরের ভাবটা আর টিকলো না। অতঃপর শুধুমাত্র আজকের জন্য এ ঘরের রাঁধুনি হয়ে গেলাম আমি। গরম রুটি আর আলুভাজি দিয়ে বেশ ভরপেট ভোজন হলো মুগ্ধ আর মুখরের। মুগ্ধ খাওয়া শেষ করে বললো,

‘উম্ম! ম্যাম আপনি খুব ভালো রাঁধেন। আমার তো আরও খেতে ইচ্ছে করছে।’

তখনি দেখলাম মুখর চোখ পা’কি’য়ে মুগ্ধকে ইশারা করলো। সে মাথা নিচু করে স্কুলের জন্য তৈরি হতে চলে গেল। আমি মুচকি হেসে চায়ে চুমুক দিলাম। এমন সময় মুখরের সংক্ষিপ্ত জবাব,

‘খাবার ভালো হয়েছে।’

আমি মুখরের প্রত্যুত্তরে ক্ষীণ হাসলাম। পরপরই পিনপতন নিরবতা। পরিবেশটা খুব বি’চ্ছি’রি রকমের চুপচাপ হয়ে আছে দেখে আমার ভালো লাগলো না। আবার কি বলবো তাও খুঁজে পেলাম না। এ মুহুর্তে ডাইনিং টেবিলে আমি আর মুখর ছাড়া আর কেউ নেই। তাই কিছু না বলতে পেরে কেন যেন অ’স্ব’স্তি হতে লাগলো। হঠাৎ আমার মাথায় খেলে গেল একটা দৃশ্য। প্রথম যেদিন মুখরকে দেখেছিলাম, খেয়াল করেছি মুখরের বু’কে’র কিছুটা নিচের দিকে একটা কালচে হয়ে আসা ক্ষ’ত। যা দেখেই বোঝা যায় বেশ গুরুতর আ’হ’ত হওয়ার ফল এটি। তাই কৌতুহল চাপাতে না পেরে বলে ফেললাম,

‘আচ্ছা মুখর সাহেব, আপনার বু’কে’র নিচের দিকে দাগটা কিসের?’

মুখর গ্লাসে পানি নিয়ে তাতে চুমুক দিতে যাবে, এমন সময় আমার প্রশ্নটা শুনে থমকে গেল। আমি তার দিকে বোকার মতো চেয়ে আছি। আর সাথে সাথেই মুখর হাতের পানিটুকু ছু’ড়ে মারলো আমার দিকে। হঠাৎ এমন হওয়ায় আ’তঁ’কে উঠলাম আমি। রা’গে শরীর কেঁ’পে উঠলো খানিক। তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই দেখলাম তার চোখেও আমার জন্য স্ফু’লি’ঙ্গ ঝরছে। র’ক্ত’চ’ক্ষু নিয়ে আমায় বললো,

‘আর কখনো এ নিয়ে আমায় প্রশ্ন করবেন না। নিজের লিমিটের মধ্যে থাকুন।’
#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৫
#তাশরিন_মোহেরা

‘আর কখনো এ নিয়ে আমায় প্রশ্ন করবেন না। নিজের লিমিটের মধ্যে থাকুন।’

এটুকু বলেই মুখর থমথমে পায়ে ভেতরে চলে যায়। ভেজা শরীরে বসে আছি। আর ভাবছি, ছেলেটার বোধহয় পানি ছোড়ার রোগ আছে। এ নিয়ে দুবার হলো সে আমাকে পানি ছুড়েছে। খুব রাগ হচ্ছে আমার। দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছি।
পরক্ষণেই ভাবলাম, এতে কি আমার দোষ আছে? আমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেললাম না তো? মুখরকে আমি ১৪ দিনের বেশি জানি না। তাই তাকে হুট করে বুকের ক্ষতটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে সে কি খুব লজ্জা পেয়েছে?
সে যাই হোক, তাই বলে ছেলেটা একটা মেয়েকে এভাবে পানি ছুড়ে মারবে? সে কি মেয়ে, যে কথায় কথায় লজ্জা পাবে? আজব তো! আমার মস্তিষ্ক আমাকে নিজের দোষটা দেখতে বললেও আমার মন আমাকে বলছে যে, ‘তুই দোষী হতে পারিস না, তিথিয়া! কিছুতেই না।’ তাই দিনশেষে মস্তিষ্কের কাছে আমার মনটাই জিতে গেল। সাথে রাগটাও সপ্তমে পৌঁছালো।

হনহনিয়ে ব্যাগ নিয়ে দরজায় চলে এসেছি। জুতো জোড়া পায়ে দিতেই পেছন হতে মুখর ডাকলো,

‘মিস.তিথিয়া, মিস.তিথিয়া?’

মুখরের ডাকে আমার রাগটা কিছুটা নিভলো। মুখর তবে বুঝতে পেরেছে একটা মেয়ের সাথে তার এমন ব্যবহার করাটা মোটেও উচিৎ হয়নি! নিশ্চয়ই আমাকে সরি বলতে এসেছে ঠিক প্রথমদিনের মতো। মনে মনে খুশি উপচে পড়লেও উপরে তা দেখনোটা একদমই ঠিক হবে না। তাই আগের মতোই রাগটা খানিক বজায় রেখে পেছন ফিরলাম। মুখর তখনি সামনে এগিয়ে এলো। এক্ষুণি সে বলে উঠবে,

‘সরি মিস.তিথিয়া। আপনার সাথে এমন ব্যবহার করাটা একদমই ঠিক হয়নি।’

এ অপেক্ষার মাঝপথে মুখর মুখ খুললো,

‘ব্যাগটা দিন!’

আমি অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে আছি। ছেলেটা কি বলতে গিয়ে কি বলছে? পাগল হলো নাকি? এরপর আবারো বললো,

‘আপনি নিজের ব্যাগের বদলে মুগ্ধের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। ভাগ্যিস! আমি দেখলাম।’

আমি নিজের কাঁধের দিকে তাকাতেই দেখলাম মুগ্ধের স্কুলব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কখন যে তার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম খেয়ালই নেই। ছিঃ কি লজ্জাটাই না পেতে হলো। আমি কাচুমাচু করে ব্যাগটা মুখরের হাতে দিলাম। দেখলাম মুখর ক্ষুব্ধ নয়নে আমার দিকে চেয়ে আছে। সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে ফেললাম। আশ্চর্য তো! মনে মনে মুখরকে যাঁতাকলে পিষে ফেললেও সামনে কিছুই বলতে পারছি না। এমনকি একঝাঁক রাগ নিয়েও চেয়ে থাকতে পারছি না। ভেজা বেড়ালের মতো চুপসে আছি বরং! নিজের উপর ক্ষোভ হলো। ব্যাগটা নিয়ে বেরোতে যাবো এমন সময় মুগ্ধ বললো,

‘ভাইয়া, আমি আজকে ম্যামের সাথে স্কুলে যাই?’

আমি তার কথা শুনে ক্ষীণ হাসলাম। মুখরের দিকে তাকিয়ে দেখি সে মুগ্ধের দিকে বিরক্তিকর চাহনিতে চেয়ে আছে। তার এই চাহনিটা আমার এক বিন্দুও পছন্দ নয়। ছেলেটা কি সারাক্ষণই সবকিছুতে এমন বিরক্ত হয়? আজব তো!

আমি মুখরকে আশ্বস্ত করলাম,

‘মুগ্ধকে আমি স্কুলে দিয়ে আসতে পারবো, মুখর সাহেব। আপনি চিন্তা করবেন না।’

মুখর তার কাঁধে হাত রেখে মুগ্ধকে বললো,

‘ঠিক আছে মিনি ডেভিল! আজ তোর ম্যামের সাথে যা। দুষ্টামি করবি না আর সাবধানে যাস।’

ইশ! এমন একটা ভাব যেন আমি মুগ্ধকে কিডন্যাপ করছি। বলি কি আমি কি তাকে সাবধানে নিয়ে যেতে পারবো না? দেখতে কি এতোটাই অকর্মার ঢেকি মনে হয় আমায়? হাত মুট করে সরু চোখে মুখরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করলাম কিছুটা। মুখর আমার দিকে না তাকিয়েই ভেতরে চলে গেল। এতে আমার মনটা আরও একধাপ বিষণ্নের দিকে এগিয়ে গেল। কি এমন বললাম আমি যে এভাবে উপেক্ষা করতে হবে তার? ভীষণ রূঢ় আপনি, মুখর সাহেব! ভীষণ!

মুগ্ধকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার মাঝে সে বলে উঠলো,

‘ম্যাম, আপনার কার (গাড়ি) কেমন লাগে?’

আমি হেসে তাকে জানালাম,

‘কার তো কমবেশি সবারই পছন্দের। আমিও পছন্দ করি। নিজের একটা কার থাকলে বেশ সাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করা যায়।’

মুগ্ধও উপর নিচ মাথা দুলিয়ে বললো,

‘জ্বি ম্যাম। আমার না প্রতিদিন রোদে হেঁটে আসতে একদম ভালো লাগে না। যদি একটা নিজের কার থাকতো তবে তাতে বসে হাওয়া খেয়ে আসতাম খুব আরামে, তাই না? কি মজা হতো!’

‘হুম, ঠিক বলেছো! কিন্তু আমাদের তো নিজের কার কেনার মতো অতো টাকা নেই, তাই না!’

মুগ্ধ এবার বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো,

‘ম্যাম, আমি বড় হলে অনেক টাকা কামিয়ে একটা কার কিনবো। আর তাতে বসে আরামে বাইরে যাবো, আসবো। আপনাকেও প্রতিদিন দিয়ে-নিয়ে আসবো। ভাইয়াকেও আর কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে সবখানে ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে না।’

আমি মুগ্ধের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিলাম। দশ বছর বয়সী একটা ছেলের পরিবারের সবাইকে নিয়ে কতো চিন্তা! পরিবারের কথা তো বাদ দিলাম। আমাকে নিয়ে তার এতো চিন্তা হওয়ার তো কথা না!
মুগ্ধের মানসিকতা আমার খুব ভালো লেগেছে। দুষ্টু হলেও তার আচরণ খুব অমায়িক! যা বাকি সবাইকে ভালোবাসতে বাধ্য করে!

মুগ্ধের স্কুলের গেইটে পৌঁছাতেই তার সমবয়সী দুজন ছেলে মুগ্ধের কাঁধে হাত রেখে বললো,

‘কিরে, মুগ্ধ? কেমন আছিস?’

মুগ্ধ কাচুমাচু হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝতে পারলাম আমার সামনে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে সে লজ্জা পাচ্ছে। তাই তড়িৎ তাকে বিদেয় দিয়ে বললাম,

‘আজ তাহলে আমি যাই, মুগ্ধ! ভালো থেকো।’

সেও আমাকে বিদেয় দিয়ে স্কুলে ঢুকে পড়লো। আর আমি চটচটে মেজাজ নিয়ে পাড়ি দিলাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

.

‘এই চাশমিশ! আমাকে আরো এক কাপ কফি এনে দাও, এক্ষুণি!’

মেয়েটার কথা শুনে রূপক ভাই তার চশমাটা ঠিক করে চটজলদি ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে গেল। আর এ দেখেই আমার মেজাজটা আরও বেড়ে গেল। রূপন্তী মেয়েটা রূপক ভাইকে পেয়েছে টা কি? যখন যা খুশি তা-ই করাবে?

মেয়েটার দিকে আড়চোখে চেয়ে থাকতেই সে আমাকে ইশারা করলো। আমি তার কাছে গেলাম বিক্ষিপ্ত মনে। এরপর সে তার পা দুটো সামনে অন্য চেয়ারে রেখে আমাকে বললো,

‘এই মেয়ে! নাও, আমার পা দুটো টিপে দাও!’

রূপকা ভাই মেয়েটার কাজ করছে টাকার জন্য। এ মুহুর্তে টাকা তার ভীষণ দরকার। তাই আমিও সায় দিয়েছিলাম রূপক ভাইয়ের প্রস্তাবে। কিন্তু সামান্য ক’টা টাকার জন্য মেয়েটা আমাকে দিয়ে পা টেপাবে, এমন দুর্দিন আমার এখনো আসেনি। নিজের আত্মসম্মানটা বজায় রেখে আমি বললাম,

‘পারবো না।’

মেয়েটা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে ধমকালো,

‘কি? এই মেয়ে কি বললা তুমি?’

আমিও এবার তার চোখে চোখ রেখে দ্বিগুণ ধমকে বললাম,

‘কানে কি ময়লা জমেছে? শুনতে পাননা?বলেছি আমি আপনার পা টিপতে পারবো না।’

মেয়েটা তৎক্ষণাৎ চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বললো,

‘শোনো! কথামতো পা টিপো। আমার কথার অবাধ্য হলে এক টাকাও পাবে না তুমি, বুঝলে?’

আমি তার আঙুলটা নিচে নামিয়ে বললাম,

‘আপনার টাকার আমার দরকার নেই। যদি টাকা দিতে না চান, তবে আপনার একটা এসাইনমেন্টও আর কমপ্লিট হবে না! লসটা কার হবে, আপু? আমার না রূপক ভাইয়ের?’

একথায় মেয়েটাকে কিছুটা অপ্রস্তুত দেখালো। সে এদিক ওদিকে চেয়ে চুপ করে গেল। আমি বাঁকা হাসলাম। হাহ্! আমায় শায়েস্তা করতে এসেছে! সে তো আর জানে না, সে যদি কচি খুকী হয় তবে আমি তার বাপ!
এমন সময় গরম কফি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হয় রূপক ভাই। তাকে বেশ ভীত দেখাচ্ছে। সে কিছুটা তোতলানোর মতো করে বললো,

‘আ-আসলে ক্যান্টিনে অনেক ভীড় থাকায় কফিটা আনতে দেরি হয়ে গেছে, আপু। সরি!’

সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে জড়সড় হয়ে। আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। ছেলে হয়েও সে সামান্য একটা বড়লোকের বখে যাওয়া দুলালিকে ভয় পাচ্ছে! কি অদ্ভুত!
রূপন্তী মেয়েটা রূপক ভাই হতে ছোঁ মেরে কফির কাপটা নিয়ে তাতে চুমুক বসালো। আমি তাকে সরাসরি হুমকি দিলাম,

‘পরেরবার থেকে রূপক ভাইকে দিয়ে আর কোনো কাজ করাবেন না। নয়তো তাকে দেওয়া এসাইনমেন্টগুলোও সময় মতো পাবেন না, বলে দিলাম।’

হুমকিতে বোধহয় কাজ হয়েছে। আমার কথায় মেয়েটা নিঃশব্দে কিছুটা নড়েচড়ে বসলো চেয়ারে। আমি রূপক ভাইকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। তাচ্ছিল্য করে বললাম,

‘কি গো রূপক ভাই! সিনিয়র হয়ে সবার কাছ থেকে কোথায় তুমি আমাকে বাঁচাবে, তা না উল্টো আমারই তোমাকে বাঁচাতে হলো।’

রূপক ভাই এতে খানিকটা লজ্জা পেয়ে বললো,

‘থ্যাংক ইউ রে!’

আমি এর সুযোগ নিয়ে বললাম,

‘তা হলে আমায় ট্রিট দাও। টং এ গিয়ে চা খাই, চলো। মনটাও ফুরফুরে হবে।’

রূপক ভাই ঠোঁটটা চওড়া করে বললো,

‘ঠিক আছে চল।’

(চলবে)
(চলবে)

(অনেক তো হলো ‘নেক্সট, নাইস’ এসব কমেন্ট! এবার গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি পাঠকমহল থেকে। ধন্যবাদ!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here