#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২৩
#তাশরিন_মোহেরা
‘আব্বা, আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি!’
কথাটুকু বলার পরই চোখ খিঁচে বসে আছি। কেননা আমি জানি কথাটা শুনতেই আব্বা আমাকে এই মুহুর্তেই ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেবেন গালে। চোখটা হালকা খুলে দেখলাম আব্বার অবস্থা। তিনি হাতটা উঁচালেন। এখনি বোধহয় মারবেন। তাই আবারো চোখ খিঁচে ফেললাম। কিন্তু মাথায় হাতের স্পর্শ পেলাম। অবাক হয়ে চোখটা খুলতেই দেখলাম আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমাকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘আমি জানি মা, তুই কাউকে ভালোবেসেছিস। আর যাই হোক, আমি তো তোর বাবা! আর এটাও জানি তুই কাকে ভালোবাসিস!’
আমি আরো অবাক হলাম। সেকি? আব্বা কি করে জানলো আমি মুখরকে ভালোবাসি? আমি তো কখনো বলিনি আব্বাকে! তবে? আবারো মাথাটা খাটিয়ে মনে করতে লাগলাম। আমি ভুলে নামটা বলে দেইনি তো! কিন্তু কবে বললাম তা মনে করতে পারলাম না। আব্বা আমার ভাবনার মাঝে বলে উঠলো,
‘তুই নিশ্চয়ই ঐ রূপক ছেলেটাকে ভালোবাসিস, তাই না তিথি? আমি এতো না করার পরও ছেলেটাকে ভালোবাসতে গেলি, মা! আমি একজন খারাপ বাবা হতে চাইছিনা বলেই রাগটা সামলে রেখেছি এতোদিন। ভেবেছি তুই ছেলেটাকে ছেড়ে দিবি, কিন্তু এখন তো দেখছি আমার সামনেই বড় মুখে বলছিস তুই ছেলেটাকে ভালোবাসিস!’
আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। রাগে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। আব্বা এসব কি যা তা বলছে! মাথা থেকে এখনো রূপক ভাইয়ের ভুতটা তবে চাপেনি! রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললাম,
‘আপনি কি বলছেন এসব, আব্বা? রূপক ভাইকে কেন আমি ভালোবাসতে যাবো?’
আব্বা বললেন,
‘শান্ত হ, মা! আমি তোর হাবভাব বুঝে গেছি বলে তোর রাগ করাটা স্বাভাবিক। আর তুই মিথ্যা বললেও আমি বুঝি তোর অনুভূতি!’
‘কচু বোঝো তুমি! রূপক ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক শুধুমাত্র ভার্সিটির চার দেয়ালের মাঝেই বন্দী। আমি মুখরকে ভালোবাসি। মুখর শিকদারকে ভালোবাসি আমি!’
আব্বা আমার এমন রাগত ভাব বোধহয় আশা করেননি। তিনি এবার আমার সামনে এগিয়ে বললেন,
‘মুখর শিকদার? কে সে? যার জন্য আমার মেয়েটা এভাবে তার বাবার সাথে বেয়াদবি করছে? এজন্যই তো বলি, এসব ভালোবাসা মানুষকে অন্ধত্ব এনে দেয়! ধ্বংস ডেকে আনে, শুধুই ধ্বংস!’
আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়! আব্বার সাথে একটু বেশিই উঁচু গলায় কথা বলে ফেলেছি! তা মানছি আমি! কিন্তু তাই বলে আব্বা সরাসরি মুখরকে টেনে আনবেন এতে? আমার সহ্য না হওয়া সত্ত্বেও চুপচাপ দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছি। না হয় আবারো আমার নিখোঁজ ভালোবাসা নিয়ে আব্বা যা নয় তা বলবেন।
বড় বড় শ্বাস ছেড়ে শান্ত হলাম। আব্বাকে বললাম,
‘ভুল হয়ে গেছে, আব্বা! আর কখনো বেয়াদবি করবো না। তবে আমি সত্যিই মানুষটাকে ভালোবাসি!’
আব্বা আমার কল্পনাটাকে সত্যি করে এবার সামনে এসে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিলেন গালে। চড়টা কষে দেওয়া হলেও আমার তেমন একটা ব্যথা অনুভূত হলো না। কারণ আমি যে আগে থেকেই এটাই আশা করছিলাম। আব্বা কপট রাগ নিয়ে বললেন,
‘কখন থেকে “ভালোবাসি, ভালোবাসি” করছিস! এই ভালোবাসা আমায় অন্ধকারে ডুবিয়েছে, তোকেও ডুবিয়ে মারবে। ঠিক কতোবার তোকে সতর্ক করবো আমি? আর কখনোই বলবি না তুই কোনো ছেলেকে ভালোবাসিস। ভুলে যা এসব!’
এটুকু বলেই তিনি হনহনিয়ে চলে গেলেন। গালে হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লাম। মনটা অনেকটা হালকা লাগছে এখন! এই কথাটা এতোদিন লুকিয়ে রাখাতে মনের উপর যেন একটা শক্ত পাথর দেবেছিল। সে পাথরটা এখন সরে গেছে। কিন্তু তাতেও আমার বিন্দুমাত্র ভালো লাগছে না। কেননা যাকে ভালোবাসি সে-ই তো আমার ভালোবাসাকে সামান্যতম তোয়াক্কা না করে চলে গেছে। যেন তার কোনো পিছুটান নেই!
.
ভার্সিটিতে পরীক্ষা থাকায় আজ বাসা থেকে একটু তাড়াতাড়িই বের হতে হয়েছে। পরীক্ষার জন্য বেরিয়েছি ঠিকই তবে পরীক্ষা সম্পর্কিত কিছুই আমি পড়িনি এতোদিন! এমনকি এটুকুও জানা নেই যে আজ আসলে ঠিক কি পরীক্ষা! তবুও নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য ভার্সিটি প্রদর্শন করতে যাচ্ছি! বাসের জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। এমন সময় পাশ দিয়ে চাদর মোড়ানো একটা সুঠামদেহী লোক গেল। তার দেওয়া পারফিউমের ঘ্রাণটা সম্পূর্ণ মুখরের ব্যবহৃত পারফিউমের ঘ্রাণের মতোই। আর এই ঘ্রাণটা একটু অন্যরকমই! অনেকের সংস্পর্শে-ই আমি প্রায় গিয়ে থাকি, কিন্তু কখনো এই ঘ্রাণের পারফিউমটা মুখর ছাড়া কারো কাছ থেকে পাইনি। অন্যমনস্ক থাকায় লোকটার মুখটাও দেখতে পেলাম না। ক্ষণিকের জন্য মনটা উতলা হয়ে উঠলো। মানুষটা নিশ্চয়ই মুখর! আমার মন বলছে ছেলেটা মুখর! তাই সাতপাঁচ না ভেবেই আমি লোকটার পিছু দৌঁড়ালাম। তার কাছাকাছি এসেই কাঁধ ধরেই তড়িৎ সামনে ফেরালাম। মুখটা দেখার আগেই উচ্ছ্বাসে ভরে গিয়েছে আমার মন। তাকে ফিরিয়েই অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
‘মুখর সাহেব!’
কিন্তু! মুখটা দেখেই মনটা চুপসে গেল মুহুর্তেই। ছেলেটা মুখর নয়! সাথে সাথেই আমার উচ্ছ্বাস উড়ে গেল। মনটা তবে ভুল বললো আমায়! ছেলেটা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি জোরপূর্বক হেসে ধীরভাবে বললাম,
‘দুঃখিত!’
ছেলেটা বিড়বিড় করে বললো,
‘চোখ কি হাতে নিয়ে হাঁটেন নাকি? আজব!’
আমি নিঃশব্দে মাথা নিচু করে পিছু হটলাম। মুখরের জন্য আজ কতো কিছুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমায়!
‘ছেলেটা আর ফিরবে না, তিথি! নিজেকে মানিয়ে নে!’
আমার বিবেকটা জাগ্রত হলো। মনকে বললাম যদি বিবেকের কথা শুনে ছেলেটাকে ভালো না বাসতাম তবে আজ হয়তো এতো কষ্ট পেতে হতো না!
ভার্সিটি গেইট থেকে বেরোতেই রূপক ভাই ডাক দিলো,
‘তিথু! তিথু!’
আমি পেছন ফিরে দেখলাম রূপক ভাই দৌঁড়ে আমার দিকেই আসছে। কাছে এসে বললো,
‘কিরে এক্সাম দিয়েই চলে যাচ্ছিস! আমার সাথে একটু দেখাও করলি না! এই কদিনে ভুলে গেলি রে!’
আমি হালকা হাসলাম। সেই হাসিটা বোধহয় দৃশ্যমান নয়। রূপক ভাই আমাকে নিয়ে একটা বটের পাশে বসলো। একপ্রকার জোর করেই বসালো সে আমায়! খানিকক্ষণ বকবক করার পর ক্লান্ত হয়ে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘কিরে? আজ একদম বোবা হয়ে গেছিস যে? কি হয়েছে?’
আমি দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বললাম,
‘নাহ! কিছু না!’
রূপক ভাই নিঃশব্দে আমাকে খানিক পর্যবেক্ষণ করলো। তাকে এভাবে দেখে থাকতে দেখে আমি হাসলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি হয়েছে, রূপক ভাই?’
সে প্রত্যুত্তরে বললো,
‘তুই হাসছিস অথচ তোর চোখ ছলছল করছে। কি হয়েছে আমায় বলবি, তিথু?’
তার কথাটা শুনে আমি আর হাসিটা মুখে রাখতে পারলাম না। আপনাআপনি ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো। শুধু কান্না আসেইনি বরং বাধভাঙ্গা অশ্রু ঝরতে লাগলো আমার চোখ বেয়ে। নিজের কান্নাটা ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে ব্যাগটা মুখের সাথে চেপে ধরলাম। এই থেকে আমার মনে পড়লো আমি কাঁদছি বলে মুখর একসময় আমায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। আমার দিকে না দেখেই আমায় শান্তিতে কাঁদতে দিয়েছে।
কি আশ্চর্য! আমি এই সময়েও লোকটার কথা ভাবছি! কেন ভাবছি? অন্য চিন্তা বাদ দিয়ে আমি কেনই বা শুধু মুখরের কথা ভাবছি? বে’হা’য়া মনটা বারবার মুখরকেই বা কেন চাইছে?
ভাঙা গলায় বলতে লাগলাম আমি,
‘মুখর সাহেব এখনো ফেরেনি, রূপক ভাই! সে আমাকে একা রেখে চলে গেছে! আমার ভেঙে যাওয়া মনটা আর সহ্য করতে পারছে না কিছু। তার অনুপস্থিতি আমি আর নিতে পারছি না, পারছি না আমি, রূপক ভাই!’
(চলবে)#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২৪
#তাশরিন_মোহেরা
অতিরিক্ত মন খারাপ দেখে রূপক ভাই আমাকে আর ভার্সিটি আটকে রাখলেন না। একটা ট্যাক্সি ডেকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাসায় এসে দেখলাম আব্বা সোফায় বসে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর খবরের কাগজ পাঠ করছেন। রান্নাঘর থেকে সুমির আওয়াজ ভেসে আসছে। সে ড্রয়িংরুমে আসতে আসতেই বলছে,
‘খালুজান, আফনে আর কিছু খাইবেন নি?’
দরজার কাছে আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে এবার আমার দিকে ফিরে বললো,
‘আফা! আইজ তাড়াতাড়ি আইয়া পড়লেন যে?’
আমি বিরসতা নিয়ে বললাম,
‘এমনি! ভালো লাগছে না।’
মুখরের বিরহে এতোটাই কাবু হয়ে গেছি যে কারো সাথে কথাও বলতে ইচ্ছে হলো না। শারীরিক খারাপ লাগাটা মানুষ সইতে পারে কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা বোধহয় সবার থাকে না। হৃদয়ের অনলে দগ্ধ হয়ে প্রতিনিয়ত বাঁচার ইচ্ছেটাও লোপ পাচ্ছে! রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম। কিছুই ভালো লাগছে না আমার! জানালার পাশে গিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়লাম। পরিষ্কার আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। শূন্য মস্তিষ্ক ঠিক কি ভাবছে তা আমি জানি না! হঠাৎ ঐ আকাশে মুখরের কঠিন চাহনি ভেসে উঠলো। সাথে সাথে চোখটা বন্ধ করে ফেললাম আমি। আর তার সাথেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো আরো কয়েক ফোঁটা অশ্রু। নিজের উপরই কেমন বিরক্ত লাগছে আমার! কথায় কথায় ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদার অভ্যাস তো আমার ছিল না! তবে এই কিছুদিন ধরে কেন নিজের কান্নাগুলো আটকে রাখতে পারছি না আমি? বয়স তো কম হলো না আমার! এই বয়সে এসে এমন বাচ্চাদের মতো কাঁদাটা কি আমায় মানায়?
দরজায় কড়াঘাত পড়লো। আব্বা ডাকছেন আমায়। নিশ্চয়ই মন খারাপটা খেয়াল করেছেন! এই মন খারাপটাও যেন আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না! সকালবেলা রূপক ভাইয়ের কাছে আর এখন আব্বার কাছে ধরা পড়ে গেলাম। তবে আব্বার উপর অভিমান হয়েছে আমার ভীষণ! কেনই বা এতো অভিমান তা বুঝে উঠছি না। আব্বা তো রোজই আমায় কটুকথা শোনায়! ছোট থেকেই আব্বার কাছে শুধু ‘না’ ই শুনে এসেছি। বাইরে খেলতে যাওয়া, আব্বার সাথে শপিং করতে যাওয়া কিংবা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আবদার কখনো করতে পারিনি আমি! যতবারই আব্বার কাছ থেকে এসবের অনুমতি চেয়েছি ঠিক ততোবারই আব্বা আমায় কড়া কথা শুনিয়েছেন। শক্ত হাতে আটকে রেখেছেন আমার হাত দুটো! কোথাও যেতে দেননি! কিন্তু তাতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম। কখনো আব্বার মুখের উপর কিছু বলিনি! মুখ বুজে সবটা সহ্য করেছি শুধুমাত্র এই ভেবে, আব্বা আমার ভীষণ একা! আমায় ছাড়া তার কোনো ভরসা নেই, আপনজন নেই!
কিন্তু আজ এই অভিমানের কারণ বোধহয় তার অমত দেওয়া নয়! ভালোবাসার কথা আব্বাকে জানিয়েছি নামমাত্র! এসবে তিনি মত দেবেন এটা আশা করাটাও বোকামি! কিন্তু আমার খারাপ লাগার বিষয়টা মুখর! আব্বা মুখরকে নিয়ে যা তা ভাবছেন, এটাই আমার অভিমানের মূল উদ্দেশ্য।
দরজাটায় ইতোমধ্যেই অনেকবার ধাক্কা দিয়ে ফেলেছেন আব্বা! জেদ করেই এসব করছেন তিনি। যতক্ষণ আমি দরজা খুলবো না এভাবেই ধাক্কাতে থাকবেন। বিরক্ত হয়ে শেষমেশ দরজাটা খুলে দিলাম। ক্ষণেই সুরটা কোমল করে আব্বা বললেন,
‘আয়, নাস্তা খেতে আয় মা! অনেকদিন হলো তোর সাথে বসে নাস্তা করা হয়না।’
তার এই নিঃসংকোচ আবেদনকে আমি আর না করতে পারিনি। কোমল মুখশ্রীটা দেখেই আমার মনটা বরফের মতো গলে গেছে।
সোফায় আব্বার সাথে বসে নাস্তা করছিলাম। এমন সময় খবরের কাগজে চোখ গেল। শিরোনামে বড় করে লেখা,
‘কে ও মিলস এন্ড ফ্যাক্টরিজ এর বিভিন্ন শাখায় আগুন।’
শিরোনামটা দেখেই মনটা আরও ছোট হয়ে গেল। এদেশের কোথাও না কোথাও প্রতিনিয়ত কত মানুষ তাদের প্রাণ হারায়! সংবাদের পাতা খুলতেই এসব চোখে পড়ে প্রতিটা দিন। তাই অনেক আগেই আমি খবর পড়া ছেড়ে দিয়েছি। এসব পড়ে নিজেকে ভীষণ অনিরাপদ মনে হয়! বাইরে বের হওয়াটাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
.
ভার্সিটির রোড ধরে আগাচ্ছি, ঠিক তখনি সেদিনের ছেলেটাকে চোখে পড়লো। যে কিনা মুখরের মতো একই পারফিউম লাগিয়ে রাস্তায় ঘুরছিলো। আজ সে চোরের ন্যায় এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। এরপরই হঠাৎ একটা সরু গলির মাঝে ঢুকে পড়লো। এদিকটায় কেউ খুব বেশি যায় না। গলিটা ভীষণ গা ছমছমে! তাই নিঃশব্দ সেই গলিটা ধরে ছেলেটার যাওয়াটা আমার সন্দেহজনক মনে হলো। কিছু না ভেবেই আমি তার পিছু নিলাম। গলির সামনে আসতেই আমি থমকে গেলাম। বুকটা দুরুদুরু করছে। ছেলেটার পিছু নেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? কেনই বা আমি তার পিছু নিচ্ছি?
আচ্ছা? তার মাধ্যমে যদি মুখরের খোঁজ পাওয়া যায়? না! এ কি করে সম্ভব? মুখরের খোঁজ কেন আমি এই অজানা ছেলেটার কাছ থেকে পাবো? উল্টো আমিই যদি বিপদে পড়ি? বিপদে পড়লে তো ফোন আছেই! সাথে সাথে রূপক ভাইকে ফোন দিলেই তো সে ছুটে চলে আসবে।
এটুকু ভেবেই আমি একবুক সাহস নিয়ে গলিটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। ক্ষীণ আশা এখনো আমার হৃদয়ে বিদ্যমান। ফোনের লাইট জ্বালিয়ে ধীরপায়ে গলিটার মাঝে হাঁটছি। ভয়ে বুকটা হাতের মুঠোয় চলে আসতে চাইছে! হাত পা সবই অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে!
গলিটার পথ ধরে সোজা আসতেই একটা পুরোনো বিল্ডিং দেখতে পেলাম। যা অসম্পূর্ণ রেখেই ফেলে দেওয়া হয়েছে। বিল্ডিংটার ভেতরে জায়গায় জায়গায় বালি, সিমেন্ট পড়ে আছে। তার পাশেই খালি একটা মাঠ। এদিকটায় মানুষ খুব কমই বলা যায়। হঠাৎ বিকট শব্দে দুটো গুলির আওয়াজ হলো। সাথে সাথে চমকে উঠলাম আমি। শরীর বেয়ে অনবরত ঘাম ছুটছে আমার! হাত দুটো ভয়ে ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আশেপাশে ভয়ার্ত চোখে দেখলাম একবার। দেখি ছেলেটা বিল্ডিংটার পেছন দিক হতে আসছে। তার পায়ের দিকটায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। বেরিয়েই সে আমার দিকে ফিরলো। তার সাথে চোখাচোখি হলো আমার। ছেলেটার চোখ দুটো অসম্ভব রকমের লাল হয়ে আছে। আর সে রক্তচক্ষু নিয়ে ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে!
তাকে এগিয়ে আসতে দেখে আমার শরীর হঠাৎ অচল হয়ে পড়লো। বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম আমি। চিৎকার করতে গিয়েও করতে পারলাম না। এদিকে মস্তিষ্ক বলছে, ‘দৌঁড়া তিথি! জানটা নিয়ে দৌঁড়া!’
কিন্তু পা চলছে না কিছুতেই! ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো। কিছুক্ষণ আগে যাকে গুলি করে মেরেছে, ঠিক তেমনি ভাবে আমাকেও নিশ্চয়ই মারবে! অকালেই তবে আমার প্রাণটা যাবে? মুখর সাহেব, আপনাকে দেখার আগেই আমার প্রাণটা হারাতে হলো তবে? আব্বা! আমায় ক্ষমা করবেন আপনি। আমার মৃত্যুর পর আপনি একা হয়ে যাবেন, জানি! কিন্তু কি করার? আমার আয়ু যে এটুকুই!
ছেলেটা আমার কিছুটা কাছে আসতেই হঠাৎ বাঁচার তীব্র আশা জেগে উঠলো আমার মনে। তাই চিৎকার করে আকাশের দিকে আঙুল তাক করে বললাম,
‘আয় হায়! পারমাণবিক বোমা!’
ছেলেটা চমকে পেছনে আকাশের দিকে তাকায়। আমি এ সুযোগে দিগবিদিক না দেখেই সামনে দিলাম এক ভো দৌঁড়। ছেলেটা আমার মিথ্যা অভিনয়টা বুঝতে পেরে আমার পিছু দৌঁড় দেয়। কিন্তু আমি দৌঁড়াতে গিয়ে সরু গলিটার মাঝে না ঢুকে সামনে নিস্তব্ধ রাস্তাটা ধরে আগালাম। ভুল হয়েছে ভেবে নিজেকে ধিক্কার জানালাম কয়েকবার। এদিকের কিছুই তো আমি চিনি না! তবে এখন? এখন কোথায় যাবো আমি? পেছন ফিরে দেখলাম ছেলেটা এখনো আমার পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছে! আমি এবার সত্যি সত্যি কেঁদে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়াচ্ছি। অন্ধের মতো দৌঁড়ানো যাকে বলে! মাঝে একবার হোঁচটও খেয়েছি! যা ভীষণ পীড়া দিচ্ছে এ মুহুর্তে। কিন্তু এসব ভাবার এখন উপায় নেই। চোখ বুজে প্রাণপণে দৌঁড়াচ্ছি তো দৌঁড়াচ্ছি। হঠাৎ কারো পিঠের সাথে জোরে ধাক্কা খেলাম। যার সাথে ধাক্কা খেয়েছি সে মানুষটা টাল সামলাতে পেরে আমাকে নিয়েই রাস্তায় পড়ে গেল। ছেলেটার মাথা পুরোটাই মাটির সাথে মিশে গেছে। আর আমি তার পিঠের উপর বসে আছি। ছেলেটাকে খেয়াল করারও সময় নেই এখন। নিজের জীবনটা আগে! তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়েই দৌঁড় দেওয়ার জন্য পুনরায় প্রস্তুত হলাম এমন সময় আগন্তুক আমার হাত আঁকড়ে ধরলো। চিরচেন সেই কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘মিস.তিথিয়া?’
আমি পেছন ফিরে তার মুখটা দেখার আগেই ভারসাম্য হারালাম। সবকিছু অন্ধকার দেখেই একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়তে নিলাম। কিন্তু মাটিতে পড়ার আগেই চোখ বন্ধ করেই অনুভব করলাম চিরচেনা সে হাত আমায় আগলে নিয়েছে তার বাহুডোরে। এরপর আর কিছুই আমার মনে নেই!
(চলবে)