#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-১৫
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★অতীত,
সেদিন থেকেই সূচনা হয় প্রহর খুশির প্রেমকাব্যের। দুটি মনের মিলনের ছন্দপতনে মুখোরিত হয় পবন মেলা। মেঘের ভেলায় চড়ে দুজন হারিয়ে যায় অচেনা কোন রাজ্যে। সহস্র বুলির ফুলঝুরি খুলে বসে। হাওয়ায় ভাসতে থাকে তাদের প্রেমানন্দের মিষ্টি সুবাস।
সেদিনের পর এক মাস পার হয়ে গেছে।এই একমাসে প্রহরের সব বদলে যায়। বদলে প্রহরের জীবন ধারা। প্রহরের জীবনে খুশি সত্যিকারের খুশির প্রলয় নিয়ে এসেছে। নিজেকে ওর এতো সুখী আগে কখনোই মনে হয়নি। প্রহরের জীবন এখন খুশিময়। প্রেমের আরম্ভ টা খুশির তরফ থেকে ছিল। তবে এখন প্রহর খুশির চাইতেও বেশি পাগল খুশির জন্য। খুশির প্রাণচাঞ্চল্য, ওর পাগলামো সবই যেন প্রহরের এখন সুখের মূলমন্ত্র। খুশির ছোট ছোট বায়না,ওর আবদার গুলো পূরণ করাই এখন প্রহরের একমাত্র গুরুদায়িত্ব। এক মুহূর্তের জন্যেও খুশির ঠোঁটের হাসি বিলিন হতে দেয়না প্রহর। এই হাসিই যে ওর জীবনের সর্বোচ্চ পরম পাওয়া। তাইতো হাজার কষ্ট হলেও খুশির সব আবদার পুরন করে ও। যার দরুন প্রহরকে কখনো খুশির হাতের রান্না করা খাবার নামক বিষও হাসিমুখে সাবার করতে হয়।খুশি প্রায়ই প্রহরের জন্য নতুন রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে নিয়ে আসে। আর খুশির মন রাখতে বেচারা প্রহরকে সেগুলো পেটে চালান করতে হয়। তারওপর আবার প্রশংসাও করতে হয়। আবার কখনো খুশির আবদার পুরন করতে রাতভর ভিডিও কলে কথা বলতে হয়। যদিও বলার কাজটা শুধুই খুশির থাকে। প্রহরতো কেবলই নীরব শ্রোতার ভূমিকা পালন করে।খুশি নিজেই রাতভর কথা বলার আবদার করে ঘন্টাখানিক যেতে না যেতেই ঘুমে তলিয়ে যায়। আর প্রহর মুচকি হেসে তাকিয়ে থাকে। তার দুষ্টুপরি টাকে দেখতে দেখতে রাত পার করে দেয় সে। এভাবেই বহমান হতে থাকে ওদের প্রেমের ভেলা।
প্রহরের জীবনের এই বদলানো রুপ জিদান সাহেবও খেয়াল করেছেন।তিনি লক্ষ্য করেছেন তার ছেলে এখন হাসিখুশি থাকা শুরু করেছে। তার বর্ণনা অনুযায়ী প্রহর এখন নরমাল হতে শুরু করেছে। ব্যাপার টাই তিনি খুশিই হচ্ছেন। তার ছেলের জীবনে যে কিছু একটা ঘটেছে তার আভাস পাচ্ছেন তিনি। তবে প্রহরকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সময় হলে হয়তো প্রহর নিজেই বলবে। ছেলেটা যে জীবনে একটু সুখী হচ্ছে এটাই বড়ো কথা।
আজ প্রহরের প্রেম নিবদনের এক মাস পূর্ণ হয়েছে। আর খুশি বায়না ধরেছে সে আজকের এই দিনটাকে মান্থলি এনিভার্সারি হিসেবে পালন করবে। আজকে সে প্রহরের সাথে ফার্মহাউসে গিয়ে এই দিনটাকে সেলিব্রেট করবে। যদিও প্রহরের এসবকিছু অহেতুক অর্থহীন মনে হয়। তবুও খুশির জিদের কাছ বরাবরই তাকে হার মানতে হয়। নাহলে যে জনাবা অভিমান করে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। যেটা প্রহরের পক্ষে এফোর্ট করা সম্ভব না। তাই খুশির আদেশ অনুযায়ী গাড়ি নিয়ে ওদের বাসার সামনে এসে হাজির হয়েছে। একটু পরেই হাসিমুখে বেড়িয়ে এলো খুশি। প্রহর চোখের সানগ্লাস খুলে সানগ্লাসের একট হ্যান্ডেল দাঁতের মাঝে ধরে রেখে, মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো ওর মন ময়নার পানে। মেয়েটা এতো কিউট কেন? ওর এই হাসি মুখখানা জাস্ট পাগল করে দেয় প্রহরকে। মন চায় শুধু সারাক্ষণ চোখের সামনে বসিয়ে রাখি আর দেখতে থাকি।
খুশি হেলেদুলে এসে প্রহরের মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে দুষ্টু হেসে বললো।
–জানি আমি একটু বেশিই সুন্দর তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে? আমার বুঝি শরম করে না?
প্রহর এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো।
–শরম আর তোমার? এটাও সম্ভব?
–আরে অসম্ভবের কি আছে? লজ্জা আমার কাছেও আসে। হ্যাঁ কিন্তু আমি ওরে পাত্তা দেইনা সেটা আলাদা ব্যাপার। আমি আবার ওসব অদরকারী জিনিসে পাত্তা দেইনা।
–হয়েছে। এখন দয়া করে গাড়িতে উঠে বসুন।
খুশি হেঁসে দিয়ে ফটাফট গাড়িতে উঠে বসলো। প্রহর মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। আর খুশিও মেতে উঠেছে তার নিজস্ব উদ্যমে। গাড়ির জানালা খুলে ইচ্ছেমতো বাতাসে চুল উড়াচ্ছে। মিউজিক সিস্টেমে সং প্লে করলো।
♬ দো দিল চাহাতকে মাড়ে
♬ অর দোনো হি কাওয়া রে
♬ সামঝা কারো ইশারে
♬ এনি হাও মাট্টি পাও
♬ ধারকান দিল কি পারমানু
♬ ভেজে মে হে কিটানু
♬ হাল্লা কারতে হে সারে
♬ এনি হাও মাট্টি পাও
♬ ও বাহোমে আ ভাড়লে এএ
♬ ইকবার তো কারলে
♬ সোনিয়ে হিরিয়ে মেরে নাল কুচি কু
♬ লাবু জু, লাবু জু
♬ ও দিল সারসো দা ক্ষেত হে জামিদার তু
♬ লাবু জু লাবু জু
♬ বারে খারচে কারাতি হার শানিবার তু
♬ লাবু জু লাবু জু
♬ লিপ গ্লোস মে লাগতিহে ধুয়াদার তু
♬ লাবু জু লাবু জু
♬ ও মেরে নাল বাসালে ঘার পারিবার তু
গানের তালে তালে বসে থেকেই হাত আর মাথা নাড়িয়ে নাচতে লাগলো খুশি। প্রহরের সানগ্লাস টা নিজে পড়ে নিয়ে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ব্রেক ডান্স করতে লাগলো। প্রহর শুধু মুচকি হেসে খুশির কার্যকলাপ দেখছে। খুশি নিজে নাচতে নাচতে আবার প্রহরের হাতের ওপর দিয়ে আঙুল নাচাচ্ছে। এভাবেই খুশির প্রাণবন্ত আর উৎসাহের মাঝেই ওরা ফার্মহাউস পৌঁছে গেল। গাড়ি থামাতেই খুশি ফটাফট নেমে দৌড়ালো। প্রহর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে হাসলো। এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। এখানে আমার সাথে সময় কাটানোর কথা বলে আসে, অথচ এখানে এসেই আমার কথা বেমালুম ভুলে যায়। ছুটে যায় ওই পশুপাখি গুলোর কাছে। যতক্ষণ থাকে পশুপাখি আর বাকি কর্মচারীদের সাথেই আড্ডায় মেতে থাকে। আমি যে এখানে আছি তার কোন হুঁশই থাকে না ম্যাডামের। তাকে অনেক খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়।
আজও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। খুশি এসেই মেতে উঠেছে সবার সাথে। এইকয়দিনেই এখানকার পশুপাখি আর কর্মচারী গুলোরও খুশির সাথে খুব ভাব হয়ে গেছে। খুশি আসলে তাদেরও অনেক ভালো লাগে। মেয়েটা সবাইকে মাতিয়ে রাখে। খুশি আসতেই স্যামি আর জনি দৌড়ে এলো খুশির কাছে। খুশিও হাসিমুখে তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে বললো।
–কিরে জনি স্যামি কেমন আছিস তোরা? আমার কথা মনে পরেছে তোদের? আর স্যামি তোর ক্যাটরিনার সাথে লাভ স্টোরি কেমন চলছে রে? এখন তো ক্যাটরিনা একেবারে যুবতী হয়ে গেছে। দেখিস আবার অন্য ছেলে ছাগল আবার ওকে পটিয়ে না ফেললে হয়। তাই তুই যত দ্রুত সম্ভব ওর বাবা মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যা।
স্যামি লেজ নাড়িয়ে খুশির গা ঘেঁষে ঘেউঘেউ করলো। খুশি তখন বলে উঠলো।
–ও আচ্ছা আমি তোর জন্য নিয়ে যাবো তোর প্রস্তাব? আচ্ছা ঠিক আছে চল। আজই তোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো। আর আজই তোদের বিয়েও দিয়ে দিবো।
খুশি স্যামির সাথে যেতে যেতে গাইতে লাগলো।
♬ বন্ধু তোর বারাত নিয়া আমি যাবো
খুশি ক্যাটরিনার মায়ের কাছে এসে বললো।
–শুনুন আন্টি আমি আমার ভাই স্যামির জন্য আপনার মেয়ের পা চাইছি। আমার ভাই লাখে একজন।নাম্বার ওয়ান হ্যান্ডসাম বয়। সকল কুকুরনিদের ক্রাশ বয়। আপনার মেয়েকে অনেক সুখে রাখবে। সারাজীবন ঘাস আর ভুষিতে ভরিয়ে রাখবে। কখনো কোন অসুবিধা হতে দিবেনা। আর ছয় মাসের মাথায়ই আপনাকে নানি হওয়ার সুখ দিবে। তাই আর না ভেবে ফটাফট রাজি হয়ে যান।
ক্যাটরিনার ম্যা ম্যা করে উঠলো। আর খুশি হাতে তালি বাজিয়ে বললো।
–বাহ্ বাহ্ অনেক ভালো। তাহলে বিয়ে পাকা হয়ে গেল। আমরা এখনই ওদের বিয়ে দিবো। আপনারা রেডি হয়ে যান। আমি বর বউকে সাজিয়ে নিয়ে আসছি।
প্রহর খুশিকে অনেকক্ষণ ধরে না দেখতে না পেয়ে ওকে খোঁজার জন্য বাইরে এলো। বাইরে এসে যা দেখলো তাতে বেচারার চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। ফার্মের সামনে খোলা জায়গায় সব কর্মচারী রা গোল হয়ে বসে আছে। আর মাঝখানে বসে আছে দ্যা গ্রেট খুশি রাণী। ওর সামনেই স্যামি আর খুশির সেই ক্যাটরিনা। স্যামিকে বরের মতো আর ক্যাটরিনাকে বউয়ের মতো সাজিয়ে রেখেছে। একটু পরে খুশি বলে উঠলো।
–হ্যাঁ তাহলে শুরু করা যাক? তো ফার্মহাউসের নিবাসি টমির সুপুত্র স্যামি, দশ আটি তরতাজা ঘাস দেনমোহর নগদ বুঝিয়া পাইয়া তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করিলে বলো কবুল। ওহ তুমি তো আর কবুল বলতে পারবে না তাই ম্যা..বলো।
ক্যাটরিনা একটু পরে ম্যা করে উঠলো। খুশি হাতে তালি বাজিয়ে বললো।
–বাহ্ বাহ্ অনেক ভালো। তাহলে বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। তাহলে এখন আমরা সবাই ওদের সুখি জীবনের জন্য মোনাজাত করি।
খুশির কথামতো সবাই দুই হাত তুলে মোনাজাত ধরে দোয়া দরুদ পড়া শুরু করলো।
খুশির এই মহানুভাব কারসাজি দেখে প্রহর তব্দা খেয়ে গেল।ছাগল আর কুকুরের বিয়ে? আই মিন লাইক সিরিয়াসলি? এটা শুধু এই পাগলীর দাড়াই সম্ভব। এতো প্রকৃতির নিয়মকেই উল্টে ফেললো।আর এই আবাল গুলোও কম না। খুশির সাথে বোধহয় এরাও পাগল হয়ে গেছে। প্রহর ওদের সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো।
–কি হচ্ছে এসব?
খুশি প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আরে তুমি এসে গেছ? দেখ দেখ আমি কতো মহান কাজ করেছি। ওদের ভালোবাসাকে মিলিয়ে দিয়েছি। আসো তুমিও এসে ওদের আশীর্বাদ দাও। তুমিই তো ওদের আসল অভিভাবক। তাই তুমি ওদের সুখী জীবনের আশীর্বাদ দাও।আসো আসো।
প্রহরের এখন উপলব্ধি হচ্ছে ও এখানে এসেই বোধহয় মস্তোবড় ভুল করে ফেলেছে। এখন কি ওকেও এই পাগলামিতে সামিল হতে হবে? প্রহর কোনমতে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–আমার একটা জরুরি কাজ মনে পড়ে গেছে। আমি এখুনি আসছি। তোমরা কন্টিনিউ করো কেমন?
কথাটা বলেই কোনমতে কেটে পড়লো প্রহর। এখানে থাকা মানেই ইজ্জতের ফালুদা করা।
প্রহর ড্রয়িং রুমে বসে ল্যাপটপে কিছু মেইল চেক করছে। খুশিতো সেই যে এসেই হৈ হুল্লোড়ে মেতে আছে। এখন পর্যন্ত একবারও প্রহরের কাছে আসার সময় হয়নি ম্যাডামের। তাই অগত্যা বসে বসে নিজের কাজ করছে। কিছুক্ষণ পরেই খুশি রাণী হেলেদুলে এলো। প্রহরের পাশে সোফায় ধপ করে বসে পড়ে, প্রহরের কাঁধ জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে ক্লান্ত সুরে বললো।
–অ্যাম সো টায়ার্ড। বিয়ে শাদি পাড়ি দেওয়া চারটি খানি কথা না। কত্তো ঝামেলা বাপরে।
প্রহর মুচকি হেসে এক হাত উঠিয়ে খুশির কাঁধ জড়িয়ে নিয়ে বললো।
–কি হলো ম্যাডামের? দুষ্টুপরি টার ব্যাটারি লো হয়ে গেছে বুঝি?
–হুমম অনেক…
–নো টেনশন। আমি এখুনি আমার দুষ্টুপরি টার জন্য এনার্জি যুক্ত জুস বানিয়ে আনছি ওকে? সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাদের আবার বের হতে হবে।
–ওকে
প্রহর উঠে গিয়ে খুশির জন্য জুস আর কিছু স্নাকস নিয়ে এলো। খুশি ততক্ষণে টিভি চালু করে দিয়ে দেখতে লাগলো। তখনই টিভির স্কিনে ব্রেকিং নিউজ দেখতে পেল। দুই রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষের কারণে রাস্তায় অবরোধ আর দাঙ্গা মারামারি হচ্ছে। যার দরুন রাস্তায় গাড়ি বের করা যাবে না। প্রহর নিউজ টা দেখে চিন্তিত সুরে বললো।
–ওহ নো। এটা আমাদের যাওয়ার রাস্তা। এখন আমরা ফিরবো কিভাবে?
খুশি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–তারমানে আমরা বাসায় যেতে পারবোনা? আমাদের রাত এখানেই কাটাতেই হবে?
প্রহর ভাবছে খুশি হয়তো বাসায় না যেতে পারা নিয়ে ভয় পাচ্ছে। তবে প্রহরকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে খুশি অতি উৎসাহিত কন্ঠে বললো।
–সত্যিই??? হায় কি রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার। ♬ হাম তুম এক ফার্মহাউস মে বান্দ হো
♬ অর রাস্তা বান্দ হো যায়ে
♬ সোচো কাভি এইসা হো তো কেয়া হো
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–আর ইউ সিরিয়াস? এমন একটা সিচুয়েশনে তোমার মজা লাগছে? তোমার ভয় করছে না বাসায় সবাই কি বলবে?
খুশি ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলো।
–আরে টেনশন নট। আমি বাসায় বলে এসেছি আমি দিয়ার বাসায় যাচ্ছি। আর এখন বাবাকে ম্যাসেজ করে দিবো যে রাস্তায় অবরোধের কারণে আজ রাত ওদের ওখানেই থাকবো। ব্যাস হয়ে গেল।
–আর ইউ শিওর? কোন সমস্যা হবে নাতো?
খুশি প্রহরের গা ঘেঁষে বসে বললো।
–আরে শিওর শিওর। আরে ওসব ছাড়োনা। ভাবো আজ আমরা দুজন একা এখানে থাকবো। তোমার রোমান্টিক রোমান্টিক ফিলিং আসছে না? এমন রোমান্টিক মুহূর্তে কি করতে মন চাচ্ছে তোমার?
প্রহর কোন ভাবাবেগ ছাড়াই বলে উঠলো।
–রান্না করতে।
খুশি কপাল কুঁচকে বললো।
–হোয়াট? রান্না কোথাথেকে আসলো এর মাঝে?
–কোথাথেকে আবার আসবে? পেটের দায়ে এসেছে। রাতে এখানে থাকতে হলে খাবার খেতে হবে না? তাই আমি এখন যাচ্ছি রান্না করতে যাচ্ছি। তুমি বসে বসে টিভি দেখ।
কথাটা বলে প্রহর খুশির মুখে একটা বিস্কিট ঢুকিয়ে দিয়ে কিচেনের দিকে চলে গেল।
খুশি বিস্কুটে কামড় দিয়ে মুখ বেকিয়ে বললো।
–আনরোমান্টিকের ড্রাম একটা।
বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। প্রহর রাতের ডিনারের প্রস্তুতি করতে লাগলো। খুশি একটু পরে এসে বললো।
–আরে আমি থাকতে তুমি কেন কষ্ট করছ? আমি রান্না করছি। তুমিতো জানোই আমি কত টেস্টি খাবার বানাতে পারি। তুমি যাও আমি রান্না করছি।
খুশির খাবারের কথা মনে করতেই প্রহর জোরপূর্বক হেসে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ তাতো অবশ্যই। তোমার মতো টেস্টি খাবার তো আর কি আর আমি বানাতে পারি। তবে আজকে একটু আমাকে তোমার জন্য রান্না করতে দাও প্লিজ? তোমার হাতের খাবার আমরা নাহয় অন্যদিন খাবো ওকে?
–আচ্ছা ঠিক আছে। যাও আজকে তোমাকেও সুযোগ দিলাম।
বেচারা প্রহর যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। খুশির খাবার নামক টর্চার থেকে তো রক্ষা পেল। বাইরে কেমন মেঘের গর্জন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। খুশি প্রহরের কাছে এসে উৎসাহী কন্ঠে বললো।
–ওয়াও দেখ বাইরে মেঘ ডাকছে। এই মুহূর্তে বৃষ্টি হলে পরিবেশটা আরও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে তাইনা?
কথাটা বলে খুশি প্রহরের হাতে হালকা ধাক্কা মারলো। তবে এতে প্রহরের মাঝে খুব একটা ভাবান্তর হলো না। সে তার মতো পেয়াজ কাটায় মনযোগ দিলো।
প্রহরের কোন রেসপন্স না দেখে খুশি নিজ মত্তে তার আপন কর্ম শুরু করে দিল। সিঙ্কের ওপর কয়েক রকম সবজি নিয়ে একসাথে গেঁথে মাথায় ক্রাউনের মতো পড়ে, প্রহরের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে শিস বাজালো। প্রহর খুশির দিকে তাকালে খুশি দুই হাত ছড়িয়ে বললো।
–কেমন লাগছে আমাকে?
প্রহর হালকা হেঁসে বললো।
–মাইন্ডব্লোয়িং, একদম আমার সবজি রাণী মনে হচ্ছে।
খুশি হি হি করে হেঁসে দিল। বাচ খুশির এই মাছুম হাসিটাই যেন প্রহরের মনে তৃপ্তির জোয়ার আনার জন্য যথেষ্ট। খুশি এবার গায়ের ওড়নাটা দুই হাতে মাথার উপর দিয়ে উড়িয়ে ধরে, প্রহরের আশেপাশে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে লাগলো।
♬ এখন তো সময় কাছে আসার
♬ এ দুটি হৃদয় ভালোবাসার
♬ তুমি যে একা, আমিও যে একা
♬ লাগে যে ভালো, ও প্রিয়
♬ ও প্রিয়
খুশির কার্যকলাপে প্রহর হালকা হেঁসে খুশির কপালের সাথে নিজের কপাল আলতো করে টোকা মেরে বললো।
–এই দুষ্টুপরি এমন জ্বালালে রান্না করবো কিভাবে? ক্ষুধায় যখন পেটে ইদুর দৌড়াবে তখন সব রোমাঞ্চ জানালা দিয়ে পালাবে বুঝেছ?
খুশি দুই হাতে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে বললো।
–আরে কে বলেছে? না খেলে কিছুই হয় না। আমিতো দুপুরেও খাইনি। কই তাতে তো কিছু হয়নি।
প্রহর খুশির হাত নামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এক মিনিট! তারমানে তুমি লাঞ্চ করোনি?
এইরে কি বলে ফেললো খুশি? ভুল সময় ভুল কথা বলে ফেলেছে। এখন এই প্রহরতো ওকে ভস্ম করে দিবে। খুশি জোরপূর্বক হেসে বললো।
–কই কি বললাম?কিছুই না। তুমি রান্না করো আমি বরং বাইরে যাই।
কথাটা বলে খুশি এখান থেকে কেটে পড়ার চেষ্টা করলেও তা হলোনা। প্রহর খুশির হাত শক্ত করে ধরে শক্ত গলায় বললো।
–কি হলো এখন পালাচ্ছ কেন? তোমাকে না আমি বলেছি খাবারের অনিয়ম করবে না। তাহলে তুমি সারাদিন না খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? আর একটি বার আমাকে কিছু বললেও না?
–আরে কি খাওয়া খাওয়া লাগিয়ে রেখেছ? আমার এতো খেতে ইচ্ছে করে না।
–শাট আপ। খেতে ইচ্ছে করে না। বাহ্ কতো সুন্দর কথা। এখন চুপচাপ বাইরে গিয়ে বসে থাকো। আমি এখুনি কিছু বানিয়ে আনছি। তারপর নিজের হাতে আজ পুরো খাবার খাওয়াবো।
খুশির এখন নিজের ওপরই রাগ লাগছে। কে বলেছিল না খাওয়ার কথা বলতে? এখন আমাকে এই খাবারের টর্চার পোহাতে হবে। খুশি মুখ লটকিয়ে বাইরে চলে গেল। খুশির গাল ফুলানো দেখে প্রহর হালকা হেঁসে আবারও রান্নায় মনোযোগ দিলো।
___
রাতের ঘনত্ব আরও গভীর হচ্ছে। ঘরির কাটা দশটায় গিয়ে ঠেকেছে। মেঘ তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ বাইরে বর্ষণ ঘটাচ্ছে। ডিনার শেষ করে প্রহর একটু ফার্মের দিকে গিয়েছিল। পশুপাখি গুলো ঠিক আছে নাকি দেখতে। ফার্ম থেকে কিছুক্ষণ পরেই ফিরলো প্রহর। ছাতাটা দরজার পাশে রেখে এগিয়ে এসে দেখলো খুশি ড্রয়িং রুমে নেই। প্রহর ভ্রু কুঁচকে ভাবলো মেয়েটা আবার কোথায় গেল? এখানেই তো টিভি দেখছিল? আবার বৃষ্টিতে ভিজতে চলে গেল নাতো? এতোবার করে মানা করে গিয়েছি তারপরও বোধহয় চলে গেছে ভিজতে। একে নিয়ে আর পারলাম না।
প্রহর দ্রুত উঠে রুমে এসে দেখলো খুশি রুমেও নেই। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো যা ভেবেছিল তাই হচ্ছে। ছাদের দরজা তালা মেরে রাখায় ম্যাডাম ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থেকেই মাথা বাইরে বার করে দিয়ে উপর দিকে মাথা ঘুরিয়ে হা করে বৃষ্টির পানি খাচ্ছে আর আনন্দ করছে। প্রহর দ্রুত গিয়ে খুশির হাত ধরে বললো।
–এই পাগলী কি করছ? তোমাকে না মানা করেছি ভিজতে? সরে আসো তাড়াতাড়ি। ঠাণ্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে যাবেতোরে বাবা।
খুশি জেদ ধরে বললো।
–না না আরেকটু থাকি না প্লিজ প্লিজ??
প্রহর বুঝতে পারলো এভাবে কাজ হবে না। সে রুম গিয়ে একটা শুঁকনো টাওয়াল নিয়ে আবার খুশির কাছে এসে খুশিকে সোজা পাঁজা কোলে তুলে নিল। খুশিকে কোলে নিয়েই ব্যালকনির সোফায় এসে বসলো। তারপর হাতের তোয়ালেটা দিয়ে খুশির মাথা মুছে দিতে দিতে বলতে লাগলো।
–তোমাকে নিয়ে আর পারিনা। আমার একটা কথাও কেন শোননা তুমি? এরপর অসুস্থ হয়ে পড়লে কি করবো আমি?
কথা বলতে বলতে প্রহরের দৃষ্টি আটকে গেল খুশিতে। ভেজা চুলে স্নিগ্ধ খুশিকে দেখে প্রহরের ঘোর লেগে আসছে। নিজের ইন্দ্রিয় গুলোর ওপর ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে সে। চোখের দৃষ্টিতে তিব্র নেশা ভর করছে।বাইরে ঝুম বৃষ্টি আর শীতল বাতাস। এমন রোমাঞ্চকর পরিবেশে প্রিয়তমার এমন মোহনীয় রুপ দেখে গলা শুঁকিয়ে আসছে প্রহরের। শুকনো ঢোক গিলে প্রহর খুশির ভেজা চুল গুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে,নেশালো কন্ঠে বললো।
–এমন পাগল কেন করছ দুষ্টুপরি? এভাবে পাগল করলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ কিভাবে রাখবো?
খুশি মায়াবী হেঁসে দুই হাতে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো।
–তো কে বলেছে এতো নিয়ন্ত্রণ করতে? এতো নিয়ন্ত্রণ করে কি বাবা রামদেব হওয়ার শখ জেগেছে নাকি?
প্রহর খুশির গালে হাত বুলিয়ে বললো।
–এছাড়া যে কোন উপায় পাগলী। আমরা যে এখনও স্বামী স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হইনি।
–ওও এই কথা? এটা কোন ব্যাপার হলো? আচ্ছা চলো আমরা এক্ষুণি বিয়ে করে নিচ্ছি। আমি যখন ক্যাটরিনা আর স্যামির বিয়ে করাতে পারি তাহলে আমার টা কেন পারবো না? হ্যাঁ তাহলে শুরু করি। তো আমি, পিতা
মোঃ রাকিব হাসানের একমাত্র কন্যা খুশি হাসান, গুলশান নিবাসী জিদান মেহরাবের একমাত্র ছেলে প্রহর মেহরাবকে একশত এগারো টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া, এই রাত আর এই বৃষ্টিকে সাক্ষী রেখে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করিলাম। কবুল, কবুল, কবুল। এখন তুমি বলো।
প্রহর মুচকি হেসে বলে উঠলো।
— আমিও আমার দুষ্টুপরিকে জনম জনমের জন্য নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে মেনে নিলাম। কবুল, কবুল, কবুল।
–বাহ্ এইতো হয়ে গেল বিয়ে। এখন থেকে তুমি আমার স্বামী,আর আমি তোমার স্ত্রী।এন্ড নাও ইউ ক্যান কিস ইউর ব্রাইড।
প্রহরের নেশা বেড়ে যাচ্ছে। খুশির আহ্বানে নিজেকে আর আটকাতে পারলোনা প্রহর। এক হাতে খুশির কোমড় জড়িয়ে ধরে আরেক হাত খুশির চুলের মাঝে দিয়ে খুশির গোলাপি অধর যুগলে ডুব দিলো। শুষে নিতে লাগলো খুশির মধুর ভান্ডারের মধু। খুশি প্রহরের চুল খামচে ধরে নিজেও ভেসে গেল এই নতুন মোহের ভেলায়। দুজনের এই ক্রিয়া চললো মিনিট পাঁচেক। এরপর প্রহর ইতি টেনে খুশির কপালে কপাল ঠেকিয়ে ভারি নিঃশ্বাস ছেড়ে নেশা ভরা কন্ঠে বললো।
–এখনকার জন্য এর থেকে বেশি যাওয়া যাবে না সোনা। বাকিটা পরে। যখন আমাদের সত্যি সত্যিই বিয়ে হবে। আমার দুষ্টুপরি টা আরেকটু বড়ো হবে। লাল টুকটুকে বউ সাজবে। সবার সামনে ধুমধাম করে আমাদের বিয়ে হবে। তখন আমার দুষ্টুপরি টাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিবো।
খুশি প্রহরের চোখে চোখ রেখে বললো।
–সত্যিই এমন হবে তো?
খুশির এমন প্রশ্নে বুকের মাঝে কেমন ধুক করে উঠলো প্রহরের। প্রহর ঝট করে খুশিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে বললো।
–হবে তো মানে কি? অবশ্যই হবে। আল্লাহ আমাদের কে বাঁচিয়ে রাখলে অবশ্যই হবে। আমার দুষ্টুপরি টা শুধুই আমার। আর আমারই বউ হবে।
খুশি বুঝতে পারছে প্রহর বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। তাই ওর মাইন্ড চেঞ্জ করার জন্য বলে উঠলো।
–কিন্তু আমার তো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার ইচ্ছে।
প্রহর খুশির মুখ সামনে এনে অবাক সুরে বললো।
–হোয়াট? পালিয়ে বিয়ে? লাইক সিরিয়াসলি? এটা আবার কেমন ইচ্ছে?
–হ্যাঁ। আমার না অনেক ইচ্ছে মুভির নায়ক নায়িকাদের মতো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো। মজা হবে না?
প্রহর হেঁসে দিয়ে বললো।
–তুমি সত্যিই পাগলী। এমন অদ্ভুত ইচ্ছে শুধুমাত্র তোমারই হতে পারে।
এভাবেই প্রহরের বুকে মাথা রেখে নানান কথার ফুলঝুরি সাজাচ্ছে খুশি। ধীরে ধীরে এখন চোখে ঘুম নেমে আসছে ওর। প্রহরের বুকেই নিজেকে এলিয়ে দিল ঘুমের রাজ্যে পারি দেওয়ার জন্য। তবে কেমন যেন অসুবিধা হচ্ছে। খুশি অসুবিধার কারণ টা বুঝতে পারলো। এবং সেটা সরানোর কাজে লেগে পড়লো। তখনই প্রহর উপলব্ধি করলো খুশি ওর শার্টের বোতাম খুলছে। প্রহর মুচকি হেসে বললো।
–এই দুষ্টু, কি হচ্ছে এসব হ্যাঁ?
খুশি ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো।
–কিছুনা। আমাদের মাঝখান থেকে এই ঝোপের বেড়াটা সরাচ্ছি। এটা আমাকে তোমার বুকে যেতে বাঁধা দিচ্ছে।
কথা বলতে বলতে খুশি প্রহরের শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খুলে দিল। তারপর পরম আবেশে প্রহরের খোলা বুকের উষ্ণতায় নিজেকে লুকিয়ে ফেললো। মিনি বিড়ালের মতো প্রহরের বুকের সাথে মিশে ঘুমিয়ে পড়লো।
খুশি ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে প্রহর আর উঠলো না। ব্যালকনিতে ঝুলিয়ে রাখা চাদরটা নিয়ে খুশির গায়ের ওপর দিয়ে ঢেকে দিল। খুশির ঘুমন্ত মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো প্রহর। আলতো করে খুশির গালে হাত বোলাতে লাগলো।এতো মায়া কেন এই মুখটাতে? এই মেয়েটা যে কবে ওর এতটা জুড়ে নিয়েছে তা বুঝতেই পারলো না প্রহর। রক্তের সাথে মিশে গেছে মেয়েটা। এখন তো খুশিকে ছাড়া ও পুরোপুরি নিঃস্ব। নিঃশ্বাস টার ওপরও এখন শুধু ওর রাজত্ব।
“দিনের সমাপ্তির বার্তা জানায় অস্তগামী রবী
তোমার সান্নিধ্যে এই কঠিন মনটাও হতে চায় কবি
তুমি মায়ার রাজ্যের রাণী
তুমি যে হৃদয়হরণী
তুমিহীনা বিরহের অনলে দগ্ধ হই প্রতিটা মুহূর্ত
তোমাতে সকল মুগ্ধতা বিরাজে, তোমাতেই সৌহার্দ
যদি পারতাম তো রাখতাম তোমায় বক্ষগহ্বরে
কিছুটা নিভৃতে, কিছুটা যত্ন করে
তোমায় ছাড়া নিশ্বাস গ্রহণও আমার বারণ
কারণ এই সত্ত্বার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে যে তোমারই বিচরণ
আমার অন্তঃকরণে তোরই পদচারণ”
প্রিয়তমাকে বুকে জড়িয়ে একসময় প্রহরও ঘুমের রাজ্যে পারি দিল।#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-১৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★রাতের ঘন বর্ষণের ইতি টেনে ভোরের নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। আলোর আভাস লাগতেই প্রহরের ঘুম ভেঙে এলো। চোখ খুলে তাকিয়ে প্রথমে প্রিয়তমার মুখদর্শন করলো। যে এখন পরম শান্তিতে তার বুক জমিনে ঘুমিয়ে আছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে খুশির এই মায়াবী মুখখানা দেখে হাজারো প্রশান্তির বাতাস ছুঁয়ে গেল প্রহরের মন মস্তিষ্ক জুড়ে। আজকের সকাল টা সবচেয়ে স্পেশাল প্রহরের কাছে। জীবন এতো সুখের হতে পারে এটা হয়তো খুশিকে না পেলে জানতোই না। প্রহর খুশির কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে, আস্তে করে খুশিকে কোলে তুলে নিল। রুমে এসে খুশিকে বেডের ওপর শুইয়ে দিল। গায়ের ওপর চাদর টেনে দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল প্রহর।
বেলা আট টা,
ফোনের রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে এলো খুশির। চোখ খুলে নিজের ফোন খুঁজতে লাগলো। টেবিলের ওপর ফোন দেখে আলসেমি ভরা শরীরে উঠে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো বাসার নাম্বার। খুশি বুঝতে পারছে এটা কার নাম্বার। ও দ্রুত ফোন রিসিভ করে অপরাধী সুরে বললো।
–সরি সরি বাবু। অ্যাম সো সরি।ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দে প্লিজ? আর কখনো এমন হবে না।
তবে ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ প্রতিত্তর এলোনা। খুশি করুন সুরে বললো।
–এখনো রাগ করে থাকবি? সরি না বাবু। আমার বাবু টা কতো ভালো। প্লিজ কথা বলনা ?দেখ তুই কথা না বললে কিন্তু আমি কেঁদে দিবো বলে দিলাম। দিবো কেঁদে?
এতক্ষণে ওপাশ থেকে নিভান মৌনতা ভেঙে বলে উঠলো।
–ঠিক আছে ঠিক আছে কাঁদতে হবে না। তুমি তো জানো আমি তোমাকে কাঁদতে দেখতে পারি না। কিন্তু তুমি এটা ঠিক করোনি। আমাকে না বলে তুমি চলে গেলে? আবার রাতেও থাকলে। একবার ফোনও করলে না। তুমি জানো না তুমি ঘুম না পারিয়ে দিলে আমার ঘুম আসেনা? তোমার ওই ড্রিম ম্যান কে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছ তুমি।
–কে বলেছে বাবু। আমার কাছে তোরচেয়ে গুরুত্ব আর কারোরই নেই। তুই আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি। আসলে কাল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পাচ্ছিলো না। তাই তোকে ফোন করতে পারিনি। এখন আর রাগ করে থাকিস না প্লিজ?
–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে যাও মাফ করে দিলাম।
–থ্যাংক ইউ বাবু। আই লাভ ইউ সোওওওওওও মাচ। আমার কিউটি, কলিজা সোনা উম্মাহহ্
প্রহর খুশির জন্য ট্রে তে করে নাস্তা নিয়ে এসেছিল। তবে দরজার কাছে আসতেই খুশির ফোনালাপ শুনতে পেল ও। খুশির এভাবে কথা বলাই ভ্রু কুঁচকে এলো প্রহরের। হাসি মুখটা গায়েব হয়ে গেল ওর। হঠাৎ রাগ এসে মাথায় ভর করলো। তবে এবার আর গতবারের ভুল করবে না প্রহর। না জেনে শুনে আগেই কোনরকম ওভার রিয়্যাক্ট করা যাবে না। তাই আপাতত নিজের রাগ দমিয়ে নিয়ে ভেতরে এলো ও। এতক্ষণে খুশির কথা শেষ হয়ে গেছে। প্রহর নাস্তার ট্রে টেবিলের ওপর রেখে খুশির কাছে এসে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–কার সাথে কথা বলছিলে?
খুশি বুঝতে পারছে প্রহর নিশ্চয় ওর কথা শুনে অন্যকিছু ভাবছে। তাই প্রহরকে আরেকটু জ্বালানোর জন্য খুশি এটিটিউট দেখিয়ে বললো।
–আছে কেউ। আমার লাইফের সবচেয়ে স্পেশাল ম্যান। যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। সে আমার জীবনে তোমার আগে থেকেই আছে।
প্রহর এবার রাগ সামাল দিতে পারলোনা। খুশির হাত শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–কে সে? নাম বলো।
খুশি বাঁকা হেসে বললো।
–এতো তাড়াহুড়োর কি আছে ডার্লিং? শুধু নাম কেন, সরাসরি দেখাই করিয়ে দিবো। আজ বিকাল ৪ টায় ****রেস্টুরেন্টে চলে এসো। দেখা করিয়ে দিবো। আর হ্যাঁ একটা কথা মনে রেখ, আমার সেই স্পেশাল ব্যাক্তি যদি তোমাকে মেনে নেয় তবেই তুমি আমাকে পাবে। নাহলে আমার কথা ভুলে যাও। বুঝতে পেরেছ? এখন সরো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
খুশি প্রহরকে পাশ কেটে মুখ টিপে হেঁসে ওয়াশরুমে চলে গেল। আর প্রহর পেছন থেকে রাগে ফেটে যাচ্ছে। স্পেশাল ম্যান হাঁ? স্পেশাল মাই ফুট। আবার সে নাকি আমাকে খুশির জন্য চুজ করবে। তারমানে কি? কোথাকার কোন ইডিয়ট এখন আমার আর খুশির ভবিষ্যৎ ডিসাইড করবে? এই স্পেশাল ম্যানকে যদি আমি স্পেশাল রুগী না বানিয়ে দিয়েছি আমার নামও প্রহর মেহরাব না। কুল ডাউন প্রহর। কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ। এখন রাগলে চলবে না। একবার ওই স্পেশাল ম্যান কে সামনে পাই তারপর দেখাবো মজা। আমার দুষ্টুপরির স্পেশাল ম্যান হওয়া তাইনা? আজ বুঝতে পারবে ও কার সাথে পাঙ্গা নিয়েছে।
___
খুশির কথামতো প্রহর টাইম অনুযায়ী রেস্টুরেন্টে এসে বসে আছে। রাগে শুধু হাত পা নাড়াচ্ছে। আর কিভাবে ওই ব্যাক্তির হাড্ডি গুড্ডি গুড়িয়ে ফেলবে সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু পরেই খুশি এলো। আরামে হেলেদুলে এসে প্রহরের সামনে চেয়ার টেনে বসলো। প্রহর আশেপাশে তাকিয়ে বললো।
–কোথায় তোমার সেই স্পেশাল ম্যান? নাকি ভয় পেয়ে পালিয়েছে।
খুশি এটিটিউট নিয়ে বললো।
–ও হ্যালো, আমার বাবু কখনো কাওকে ভয় পায়না বুঝেছ? হি ইজ ভেরি ব্রেভ। হ্যাভ সাম পেশেন্স। এখুনি আসবে আমার বাবু।
খুশির মুখে বারবার বাবু শুনে প্রহরের শরীর জ্বলে যাচ্ছে।চোখ বন্ধ করে অনেক কষ্টে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখছে। বাচ একবার শুধু আসুক ওই নমুনাটা তারপর ওর বাবুগিরি বার করছি। তখনই খুশি বলে উঠলো।
–এইতো এসে গেছে আমার বাবু।
প্রহর চোখ খুলে রাগী মুডে তাকালো সামনে। তবে সামনে নিভানকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল প্রহর। খুশির বাবু যে এই ছেলে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি প্রহর। প্রহর অবাক সুরে বললো। –এ তোমার বাবু??
খুশি হাসিমুখে বললো।
–হ্যাঁ এই হলো আমার বাবু। মাই ফার্স্ট লাভ। আমার একমাত্র কলিজার টুকরা ভাই। ওর নাম নিভান।
প্রহর বেচারা থতমত খেয়ে গেল। তারমানে খুশি ওর ভাইয়ের কথা বলছিল? আর আমি কিনা কিসব ভেবে বসে আছি। থ্যাংক গড। প্রহর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নিল। তারপর মুচকি হেসে নিভানের দিকে তাকিয়ে বললো।
–হেলো নিভান। হাউ আর ইউ?
নিভান দুই হাত ভাজ করে গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–অ্যাম গুড।
এতো অল্পবয়সেও এমন ম্যাচিউরিটি দেখে প্রহর একটু অবাকই হলো। খুশি এবার বলে উঠলো।
–হ্যাঁ তো যেমন টা বলেছিলাম। আমার বাবু যদি তোমাকে মেনে নেয় তবেই আমাদের সম্পর্ক সামনে এগুবে। নাহলে এখানেই দি এন্ড। আর এটা মোটেও মজা না বুঝেছ? এখন তোমরা ম্যান টু ম্যান কথা বলো। আমি একটু ঘুরে আসছি।
কথাটা বলেই খুশি উঠে চলে গেল। যেতে যেতে প্রহরকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বেস্ট অফ লাক ইশারা করে গেল।
প্রহরের একটু চিন্তা হচ্ছে। নিভান ওকে পছন্দ করবে তো? আরে এতো চিন্তার কি আছে? ছোট বাচ্চা ছেলেই তো। এক মিনিটেই ইমপ্রেস করে ফেলবো। প্রহর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–হ্যাঁ তো নিভান কি খাবে তুমি? চকলেট আইসক্রিম অর্ডার করবো তোমার জন্য?
নিভান আবারও গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–আই ডোন্ট লাইক চকলেট। আর আমার কিছু লাগলে আমি নিজেই অর্ডার করে নিবো। ইউ ডোন্ট বদার।
–ওকে ফাইন। এ্যাজ ইউ সে। বাইদা ওয়ে ইভান তুমি কিন্তু অনেক কিউট।
–আই নো। আপু বলেছে। টেল মি সামথিং আই ডোন্ট নো।
বাপরে এই ছেলে তো দেখছি আমার চেয়েও বেশি গম্ভীর। একে কিভাবে বসে আনবো?নিভান যদি আমাকে মেনে না নেয় তাহলে কি হবে? কি দিন এসে গেল তোর প্রহর? এক বাচ্চা ছেলের সামনে তোর হাওয়া টাইট হয়ে যাচ্ছে।এতো সহজে হার মেনে নিতে পারিস না তুই। শো সাম স্কিল। প্রহর আবারও জোরপূর্বক হেসে বললো।
–নিভান ইউ লাইক ভিডিও গেম? আমার কাছে লেটেস্ট ভিডিও গেম আছে। তুমি চাইলে আমি দিতে পারি।
নিভান এবার একটু নড়েচড়ে বসে বলে উঠলো।
–দেখুন আমাকে এসবের লোভ দেখিয়ে লাভ নেই। এতে করে কিছুই হবে না। তাই বাচ্চা ভেবে মন ভোলানোর চেষ্টা করার দরকার নেই। তাই আসল কথায় আসি। দেখুন আমি দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি আমার আপুকে ভালোবাসি। আপুর চেয়ে বেশি জরুরি আর কিছুই না। আপুর খুশিই আমার খুশি। আর আপুর খুশি আপনাতে। আমি শুধু এতটুকু শিওর হতে চাই যে আপনি আমার আপুকে কখনো কষ্ট দিবেন না। আপুর মুখের হাসি কখনো বিলীন হতে দিবেন না। ব্যাচ এটারই শিওরিটি চাই আমার। নাথিং ইলস।
প্রহর মুচকি হেসে স্বাভাবিক সুরে বললো।
–নিভান বলতো মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরি কি?
নিভান বলে উঠলো।
–নিঃশ্বাস।
–ঠিক বলেছ। তাহলে তুমি কি চাইবে জেনে শুনে তোমার নিজের নিঃশ্বাস কে বন্ধ করতে?
–একদমই না। এমন বোকামি আমি কেন করবো?
–এক্সাক্টলি। তো তোমার আপুও আমার জীবনে নিঃশ্বাসের কাজ করে। তো নিজের নিঃশ্বাস কে কোন কষ্ট দেওয়ার মতো বোকা নিশ্চয় আমি না। আমি হয়তো ওয়াদা করতে পারবোনা যে আমার দ্বারা কখনো কোন তোমার আপু দুঃখ পাবে না। আমি রক্ত মাংসের গড়া মানুষ। তাই স্বাভাবিক মানুষের মতো আমারও কখনো কখনো ভুল ত্রুটি হতে পারে। তবে আমার কোন ভুলের কারণে যতটা না তোমার আপু কষ্ট পাবে। তারচেয়ে হাজার গুন বেশি আমার কষ্ট হবে। তাই আমি অবশ্যই ইচ্ছে করে নিজেকে কোনরকম কষ্ট দিতে চাইবোনা। কারণ মানুষ সবার আগে নিজের ভালোটাই চায়।
প্রহরের জবাবে এবার নিভানের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। নিভান মুচকি হেসে বললো।
–আমি জানতাম আমার আপুর চয়েস কখনো ভুল হতে পারে না। কারণ আমার আপু বেস্ট টাই ডিসার্ভ করে। এন্ড ইউ আর বেস্ট ফর হার।
প্রহর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো।
–থ্যাংক ইউ নিভান। এন্ড আই মাস্ট সে,খুশি ইস রিয়েলি লাকি টু হ্যাভ এ ব্রাদার লাইক ইউ।
–উহুম। আই অ্যাম লাকি টু হ্যাভ এ সিসটার লাইক হার। আর আপুর কারণে আপনার মতো ভাইয়াও পেয়ে গেলাম। তো আমিতো ডাবল লাকি।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার মাধ্যমে প্রহর আর নিভান একজন আরেকজনের সাথে মোটামুটি ভালোই মিশে গেল। খুশি আড়াল দেখে ওদের দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। ওর জীবনের সবচেয়ে ভালোবাসার দুজনকে একসাথে মিশতে দেখে খুশির মন ভরে উঠছে।
___
যথারীতি রোজকার মতো খুশিকে কলেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রহর খুশির বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে এসে বসে আছে। একটু পরেই খুশি বেড়িয়ে এলো গেট দিয়ে। গাড়িতে বসে বলে উঠলো।
–কি ব্যাপার আজ সিভিল ড্রেসে আসতে বললে যে? আমরা অন্য কোথাও যাচ্ছি নাকি?
প্রহর ড্রাইভ করতে করতে বললো।
–হ্যাঁ আমরা আজ অন্য কোথাও যাচ্ছি।
খুশি সবসময়ের মতো দুষ্টু হেসে বললো।
–কোথায়? রুমডেটে যাচ্ছি বুঝি?
আর যথারীতি প্রহর রাম ধমক দিয়ে বললো।
–শাট আপ ইডিয়ট। মুখে মাঝে মধ্যে একটু ব্রেকও দিতে হয় তাকি জানো তুমি?
খুশি ভেংচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। প্রহর মুচকি হেসে বললো।
–হয়েছে আর গাল ফুলাতে হবে না। তুমি কাল তোমার ফ্যামিলির সাথে দেখা করিয়েছিলে তাই আজ আমি আমার পরিবারের সাথে তোমার দেখা করিয়ে দিবো। আমার পরিবার বলতে শুধুই আমার বাবা। আর আজ বাবার জন্মদিন।
খুশি উৎসাহী কন্ঠে বললো।
–ওয়াও, তাহলে তো আঙ্কেলের জন্য গিফট নেওয়া উচিত।
–হুম, গিফট নিয়েছি তো। বাবার সারপ্রাইজ গিফট হলো তুমি। বাবার জন্য তোমার চেয়ে বড়ো গিফট আর কিছুই হবে না। যখন সে দেখবে তার ছেলে ফাইনালি তার জন্য ছেলের বউ এনেছে। তখন সে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।
খুশি একটু মলিন সুরে।
–আঙ্কেল আমাকে পছন্দ করবে তো?
–আরে পছন্দ করবে না কেন? আমার কিউট দুষ্টুপরি টাকে কেউ না পছন্দ করে থাকতে পারে? আর তুমি আমার বাবাকে চেন না। তারজন্য তো এটাই যথেষ্ট যে আমি কোন মেয়েকে পছন্দ করেছি। তুমি জানো না সে এই দিনটার জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে।দেখবে সে তোমাকে দেখেই খুশি হয়ে যাবে।
মিনিট ত্রিশ পর ওদের গাড়ি প্রহরদের বাসার গেট দিয়ে ঢুকলো। গাড়ি থামিয়ে ওরা নেমে এসে বাসার দরজায় এসে প্রহর খুশিকে একটু দরজার আড়ালে দাড় করিয়ে দিয়ে কলিং বেলে টিপ দিল। একটু পরে জিদান সাহেব এসে দরজা খুলে দিল ।প্রহরকে দেখে বললো।
–কিরে তুই এই সময় বাসায়?
প্রহর এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো। –হ্যাপি বার্থডে বাবা। মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে।
জিদান সাহেব মুচকি হেসে বললো।
–হয়েছে হয়েছে বুড়োকালে আর বার্থডে বার্থডে খেলতে হবে না।
প্রহর ওর বাবাকে ছেড়ে দিয়ে বললো।
–বাবা তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
–সারপ্রাইজ? কি সারপ্রাইজ?
প্রহর এবার খুশিকে ডাক দিল। খুশি আস্তে করে ভেতরে এসে প্রহরের পাশে দাঁড়াল। প্রহর খুশিকে দেখিয়ে বললো।
–বাবা ও খুশি। লাভ অফ মাই লাইফ। তোমার হবু বউমা।
খুশি জিদান সাহেব কে সালাম দিল। তবে প্রহরের কথায় জিদান সাহেবের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি কতক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ বলে উঠলো।
–কত টাকা দিয়েছিস?
জিদান সাহেবের এমন উদ্ভট প্রশ্নে প্রহর থতমত খেয়ে বললো।
–টাকা? কিসের টাকা? কি বলছ বাবা?
–হ্যাঁ টাকা। কত টাকা দিয়ে মেয়েটাকে তোর গার্লফ্রেন্ড হওয়ার এক্টিং করানোর জন্য নিয়ে এসেছিস? দেখ আমাকে খুশি করার জন্য অযথা এসব করার দরকার নেই। আমি এটা মেনে নিয়েছি যে আমার ছেলে একটা অপদার্থ। তার দ্বারা এসব সম্ভব না।আর হ্যাঁ ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আমার সব সম্পত্তি তোকেই দিবো। তাই এসব নাটক করার দরকার নেই।
জিদান সাহেবের কথায় খুশি মুখ টিপে অনেক কষ্টে নিজের হাসি আটকে রাখছে। প্রহর করুন সুরে বললো।
–বাবা কি বলছ এসব? এসব কোন নাটক না। আমি সত্যিই বলছি।
–হতেই পারে না। এতো মিষ্টি একটা মেয়ে তোকে ভালোবাসবে? নো চাঞ্চ।
বেচারা প্রহরের করুন অবস্থা দেখে এবার খুশি গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–আসলে আঙ্কেল এটা সত্যি। আমি জানি এটা বিশ্বাস করাটা একটু কঠিন। আপনার এই হাঁদারাম ছেলের জন্য আমার মতো কাওকে পাওয়া অনেক টা পাথরে ফুল ফোটার মতো ব্যাপার। তবে ওইযে কথায় আছে না, লাক বাই চাঞ্চ। তেমন এটাও তাই। আমরা সত্যিই একজন আরেকজনকে ভালবাসি।
নিজেকে এভাবে পঁচাতে দেখে প্রহর চোখ গরম করে তাকালো খুশির দিকে। এতক্ষণে জিদান সাহেবের মুখে হাসি ফুটলো। তিনি প্রফুল্ল কন্ঠে বললেন।
–তারমানে প্রহর সত্যিই বলছে? আলহামদুলিল্লাহ, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে। এবারের জন্মদিনে এতো ভালো উপহার পাবো ভাবতেই পারিনি।হাঁদারাম টা এতদিনে একটা সত্যিকারের খুশির সংবাদ দিয়েছে।
প্রহর করুন সুরে বললো।
–বাবা তুমিও?
–এই তুই চুপ করতো। এসো মা এসো ভেতরে এসো। তোমার হবু শশুর বাড়িতে তোমার স্বাগতম।
জিদান সাহেব খুশিকে নিয়ে এসে সোফায় বসালো। প্রহর বলে উঠলো।
–তোমরা বসে কথা বলো আমি খাবার কিছু নিয়ে আসছি।
কথাটা বলে প্রহর কিচেনের দিকে চলে গেল।
প্রহর চলে যেতেই খুশি জিদান সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–নেন এখন শুরু করেন।
জিদান সাহেব খুশির কথা বুঝতে না পেরে বলে উঠলেন।
–শুরু করবো? কি শুরু করবো?
–আরে নিজের ডায়লগ বলেন।
–ডায়লগ? কি বলছ এসব?
–দেখুন আমি জানি এমন সিচুয়েশনে কি হয়। বাবা মা ছেলেমেয়েদের সামনে হাসিমুখে তাদের প্রেমিক/প্রেমিকা কে মেনে নেয়।তারপর তাদের অগোচরে আসল মনের কথা গুলো জাহির করে। বলে তোমার সাহস কি করে হলো আমার ছেলেকে নিজের ফাঁদে ফেলার? কোথায় তুমি আর কোথায় আমার ছেলে? এক্সক্ট্রা এক্সক্ট্রা,,।তো আপনারও নিশ্চয় এখন ওসব বলতে ইচ্ছে করছে তাইনা? তাহলে শুরু করেন।
জিদান সাহেব হেসে উঠে বললেন।
–আরে না। আমি কেন এমন বলতে যাবো? আমিতো সত্যিই খুশি তোমাদের জন্য।
খুশি এবার মলিন সুরে বললো।
–দেখুন এমন করবেন না প্লিজ। আমার কতদিনের শখ আমি ওই চৌধুরী সাহেব ওয়ালা ডায়লগ বলবো। আপনাদের সারনেমও চৌধুরী। আর আপনি বলছেন আপনি বলবেন না ওসব? তাহলে কিন্তু আমি খেলবোনা বলে দিলাম। একটু খানি বলুন প্লিজ। মজা করে হলেও বলুন।
জিদান সাহেব বুঝতে পারছেন মেয়েটা খুবই চঞ্চল আর ফিল্মি। তাই ওর মন রক্ষার্থে তিনি বলে উঠলেন।
–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে আমি বলছি।
জিদান সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে ফিল্মি কায়দায় বললেন।
–এই মেয়ে তোমার সাহস কি করে হলো আমার ছেলের দিকে হাত বাড়ানোর? কোথায় তুমি আর কোথায় আমার বাঁদর মার্কা থুক্কু হিরার টুকরা ছেলে। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চাও। বলো কত টাকা চাই তোমার? কত টাকা হলে আমার ছেলের পিছু ছাড়বে।
খুশি এবার তার মেলোড্রামা চালু করে দিল। নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো।
–চৌধুরী সা…হে….ব!! আমার ভালোবাসা এতো সস্তা না যে,আপনার সামান্য কিছু টাকার সামনে বিক্রি হয়ে যাবে। সুপার গ্লু ওয়ালা ভালোবাসা আমার। এতো সহজে ছাড়াতে পারবেন না।
–ঠিক আছে। আমার কাছে একবক্স ভরা বিদেশি চকলেট আছে। যা আমার কাছে মহামূল্যবান সম্পদ। তাও তোমাকে দিয়ে দিবো। এখন বলো ডিল পাক্কা?
খুশি এবার আরও দৃঢ় কন্ঠে বললো।
–আপনি যদি ভেবে থাকেন চকলেটের লোভ দেখিয়ে আমার মন বদলাতে পারবেন তাহলে আপনি……………………একদম ঠিক ভাবছেন। আরে এতো আকর্ষণীয় অফার কি ছাড়তে পারি নাকি? চকলেটের জন্য শুধু একটা কেন, হাজার টা বয়ফ্রেন্ড কুরবান৷ ওকে ওকে ডিলা ডান। এক হাত চকলেট দিন,অন্য হাতে ছেলে নিন।
খুশির কথায় জিদান সাহেব হো হো করে হেঁসে উঠলো। তার সাথে খুশিও খিলখিল করে হেঁসে দিল। খুশি হাত উঠিয়ে জিদান সাহেব কে হাইফাই এর জন্য ইশারা করলো।জিদান সাহেবও খুশির হাতের সাথে হাইফাই দিয়ে বললো।
–এটা সত্যিই অনেক মজার ছিল।
বাইরে ওদের শোরগোল শুনে প্রহর একটু বাইরে এসে দেখলো ওর বাবা আর খুশি অট্রহাসিতে মেতে আছে। প্রহর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর বাবার দিকে। আজ প্রথম ওর বাবাকে এমন মন খুলে হাসতে দেখছে প্রহর। প্রহরের সামনে যতই নিজেকে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক। তবে প্রহর জানে ওর বাবাও ভেতরে ভেতরে খুব একটা ভালো থাকে না। এই একাকিত্ব তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আর আজ ওর বাবাকে এভাবে মন খুলে হাসতে দেখে প্রহরের মন ভরে উঠলো।সব খুশির জন্য হয়েছে। মেয়েটা ওর নামের মতোই। যেখানে যায় শুধু খুশিই ছড়িয়ে দেয়। আমার খুশি সত্যিই এক খুশির গুপ্তধন। প্রহর তৃপ্তির হাসি দিয়ে আবারও কিচেনে চলে গেল। আপাতত ওদের একটু একসাথে থাকাই ভালো হবে।
জিদান সাহেব খুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–তুমি সত্যিই অনেক মিষ্টি খুশি মা।তোমার আমার ভালোই জমবে। আমার ছেলেটা যে এমন হিরা খুঁজে বের করবে ভাবতেই পারিনি।
খুশি মুচকি হেসে বললো।
–থ্যাংক ইউ আঙ্কেল।
–উহুম আঙ্কেল ডাকা যাবে না। শশুর কে কেউ আঙ্কেল ডাকে?
–তাহলে কি শশুর ডাকবো?
–বাবা ডাকো।
–আমার কাছে আরেকটা ভালো কুল আইডিয়া আছে। শশুরের এস, আর বাবার বি =এসবি। এখন থেকে আমি আপনাকে এসবি ডাকবো ওকে?
–ওয়াও আই লাইক ইট। এসবি, হোয়াট এ কুল নেম। আমার বাকি ফ্রেন্ডরা শুনলে জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে। তোমার মতো কুল ছেলের বউ কারোরই হবেনা ।
__
খুশি এসেছে প্রহরের রুমে। ঘুরেঘুরে দেখছে সবকিছু।তখনই প্রহর এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো।
–থ্যাংক ইউ সো মাচ খুশি। আজ তোমার জন্য বাবাকে এতো খুশি দেখলাম। ইউ আর অ্যা এঞ্জেল অফ মাই লাইফ। তুমি আমার জীবনে সত্যিকারের সুখপাখি।
–আরে হয়েছে হয়েছে এতো তারিফ করলে আমার আবার বদহজম হয়ে যাবে।
প্রহর হালকা হেঁসে বললো।
–আচ্ছা আমার রুম কেমন লাগলো তোমার?
খুশি ঠোঁট উল্টিয়ে বললো।
–একদমই ভালো না।
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কেন? কি সমস্যা?
–আরে অনেক সমস্যা। প্রথমত রুমটা মাত্রাতিরিক্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আরে এতো পরিস্কার কখনো রুম হয় নাকি? মনে হচ্ছে ল্যাবে দাঁড়িয়ে আছে।আরে রুমে একটু আধটু নোংরা না থাকলে রুমকে কি রুম মনে হয়? আর এটা কেমন রঙ সাদা? সবকিছু শুধু সাদা রঙের। কেনরে ভাই? এখানে কি কারোর শোক দিবস পালন করা হচ্ছে? আরে রুম হবে রঙবেরঙের মেলা।
খুশির কথায় খুব একটা অবাক হলো না প্রহর। কারণ এমন অদ্ভুত কথাবার্তা শুধু খুশির পক্ষেই সম্ভব। ওর তো ভেবেই ভয় লাগছে। নাজানি বিয়ের পর এই রুমটাকে কি বানিয়ে ফেলবে?
খুশি দেয়ালে টানানো গিটার দেখিয়ে বললো।
–এটা কি তুমি বাজাও? নাকি এমনই ফ্যাশনের জন্য ঝুলিয়ে রেখেছ?
–এই একটু আধটু বাজাই আরকি।
–তুমি গানও গাও বুঝি?
–হ্যাঁ ওই আরকি। তোমার মতো অতো সুরেলা কণ্ঠে তো আর গাইতে পারিনা। একটু আধটু চেষ্টা করি আরকি।
–জানি জানি আমার মতো সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া অতো সহজ না। আচ্ছা যেমনই গাও আমাকে একটু শুনাও। আমি কাজ চালিয়ে নিবো।
প্রহর হালকা হেঁসে বললো।
–আচ্ছা ঠিক আছে।যা আমার মহারাণীর ইচ্ছা।
প্রহর গিটার টা নিয়ে বাজাতে শুরু করবে তখনই খুশি বললো।
–এই এই এখানে না। চলনা নিচে যাই। এসবির সামনে গাইবে। আজ এসবির জন্মদিন না?
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এসবি? হু ইজ এসবি?
–আরে এসবি মিনস শশুর বাবা। উনার কথা বলছি।
প্রহর মাথা নেড়ে হাসলো। এই মেয়েটা পারেও বটে। বাবাকে এসবি বানিয়ে দিল। খুশি প্রহরের হাত ধরে নিচে নিয়ে এলো। এতক্ষণে ফাহিমও চলে এসেছে। প্রহরের কথামতো ওর বাবার জন্য কেক নিয়ে এসেছে। নিচে এসে খুশি সবার উদ্দেশ্যে বললো।
–এটেনশান গাইস। তো এখন প্রহর আমাদের সবাইকে গান গেয়ে শোনাবে তালিয়া।
সবাই একসাথে তালি বাজালো। প্রহর গিটারে টুংটাং ধ্বনি তুলে খুশির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গেয়ে উঠলো।
♬ ও খুশি ও খুশি তুমি কিযে রুপসী
♬ মন চায় ময়না পাখির মতো বুকের পিঞ্জরে পুষি।
♬ ও খুশি ও খুশি তুমি কিযে রুপসী
♬ মন চায় ময়না পাখির মতো বুকের পিঞ্জরে পুষি।
প্রহরের গানের সুরে খুশির মন নেচে উঠলো। খুশি নাচতে নাচতে জিদান সাহেবের হাত ধরে তার সাথে নাচতে লাগলো। ফাহিম মুখে দুই আঙুল ঢুকিয়ে শিস বাজাতে লাগলো। প্রহরের মনে হচ্ছে খুশির আগমনে এই বাড়ি নতুন আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। খুশি ওর জীবনের সর্বত্র রঙিন আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। খুশি ছাড়া ওর জীবন টা শূন্য মরুভূমি হয়ে যাবে। খুশিকে ছাড়া বাচার কল্পনাও যে এখন মৃত্যু সমান।
চলবে………
/