অন্তরিক্ষ প্রণয় পর্ব -০৪

#অন্তরিক্ষ_প্রণয়
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৪
নিয়ন স্তব্ধ হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনের ভয়টা সত্যি হয়ে গেলো। তার মনের রানী অন্যকাউকে ভালোবাসে। নিয়নের অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে নিজেকে। ওর মনে হচ্ছে, যদি প্রিয়তা তার অনুভূতি জানার পর তাকে আর সহ্য করতে না পারে!

নিয়নের স্তব্ধতা কাটে রাত্রির ডাকে। রাত্রি নিয়নের কাছে এসে বলছে,

–আমাদের ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করা উচিত। প্রিয়তার অনেক কিছু মনে পড়ছে। ইনশাআল্লাহ সে জলদি সুস্থ হবে।

নিয়ন রাত্রির কথা শুধু শুনলো। কোনো বাক্যব্যয় করলো না। রাত্রি মলিন হেসে নিয়নের মনের তোলপাড় বুঝে বলে,

–তুই ওর মেন্টাল কন্ডিশন জানতি। ওর অতীত তোর জানা ছিল না। এখন অতীতে কি হয়েছে তা না জেনে ওর মাঝে হৃদয় হারিয়ে বসলি। ওর অতীতকে ও এখনো ভালোবাসে তাই তুই নিজেকে স্ট্রং কর যাতে পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নিতে পারিস।

নিয়ন নিভু কাতর স্বরে বলে,
–ভালোবাসার অনুভূতি বলে কয়ে আসে না। হুট করে এসে যায়। আমি ওর বর্তমানকে দেখেছি, অতীতকে না। অতীতকে প্রাধান্য দিয়ে কাউকে ভালোবাসলে কি আদোও ভালোবাসা হয়? আমি কিভাবে ওর প্রতি দুর্বল হয়েছি আমি নিজেও জানি না।

রাত্রি আর কিছু না বলে নিয়নের কাঁধে হাত রেখে মলিন হাসি দিয়ে চলে যায়। নিয়ন প্রিয়তার দিকে তাকায়। মেয়েটা হেসে হেসে খেলছে কারন রাত্রি তাকে বলেছে আকাশকে এনে দিবে।
নিয়ন ভাবে,
“যদি মেয়েটার জীবনে আকাশ নামে কারো অস্তিত্ব না থাকতো! খুব কি ক্ষতি হতো? অসুস্থ মেয়েটাকে সে নাহয় সারা জীবন আগলে রাখতো নিজের কাছে।”

পরেরদিন,,
সাইকোলজিস্টের কাছে প্রিয়তাকে নিয়ে যায় নিয়ন। রাত্রির এক সিনিয়রের সাথে অপারেশনে থাকতে হবে। আর তাছাড়া প্রিয়তার জন্য নিয়ন ও রাত্রি অনেক ছুটি নিয়েছে। এখন সাইকোলজিস্ট যদি হাওয়া বদল নিয়ে কিছু বলে তো তখন আবারো ছুটি লাগবে। এজন্য নিয়ন ও রাত্রি ছুটি নিতে চায় না। নিয়নের আজ রোগীর চাপ কম বিধায় সময় বের করে প্রিয়তাকে নিয়ে গেছে।
সাইকোলজিস্ট প্রিয়তাকে হিপনোটাইজ করে। তারপর কিছু কিছু জানতে পারে কারন প্রিয়তার সব কিছু মনে পড়েনি।
সাইকোলজিস্ট জানতে পারে,
“আকাশ প্রিয়তার স্বামী। প্রিয়তাকে আকাশ অনেকটা ভালোবাসে। প্রিয়তার বন-জঙ্গল ভালো লাগে। নিরিবিলি পরিবেশ ভালো লাগে। বাবা-মাকে মিস করে তবে তারা রাগ করে আছে।”

মানে সব কিছু আধো আধো। ওর স্মৃতিতে এখনো সব আসেনি। সাইকোলজিস্ট আরেকটা ইলেকট্রিক শকের পর হাওয়া বদলকে সাজেস্ট করলো।

__________
এক মাসের বেশি সময় কেটে যায়। প্রিয়তা পাগলামি করে না ধরতে গেলে। শান্ত হয়ে থাকে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে প্রিয়তাকে নিয়ে নিয়ন ও রাত্রি সিলেটে ঘুরতে এসেছে। প্রিয়তা চা বাগানে এসে কিছুক্ষণ পর পর থেমে থেমে যায়। বিষয়টা রাত্রি লক্ষ্য করে। রাত্রি ভাবে,

“হয়তো অতীতের কোনো বিশেষ মুহূর্ত এখানে আছে যার কারনে মেয়েটা থেমে থেমে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তবে চিৎকার করছে না।”

যখন ওরা রাতারগুল যাওয়ার পথে তখন বনের কাছে প্রিয়তা খুব করে নৌকা থামাতে বলে। বনের মধ্যে দর্শনার্থীদের অনুরোধে নৌকা থামানো হয় তবে বর্ষাকালে না। এখন শীতকাল তাই নৌকা থামালো। প্রিয়তা নৌকা থেকে নিজেই নেমে যায়। তারপর ভিতরের দিকে যেতে থাকে। নিয়ন ও রাত্রি দুজনেই অবাক প্রিয়তার ব্যাবহারে। কিছু যদি মনে পড়ে তো এতোটা শান্ত কেনো? এটাই ওরা দুজন বুঝতে পারছে না।

নিয়ন ও রাত্রি প্রিয়তার পিছু নিচ্ছিলো তখন হুট করে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে যায় একটা গাছের কাছে। তারপর রাত্রিকে ডেকে বলে,

–দেখো দেখো রাত, এই এই গাছটার ডালটাতে আকাশ আমায় বসিয়ে ছবি তুলে দিয়েছিল। আমার এসব ভালো লাগে। জানো রাত, ও না সব সময় বলতো এখানে বাড়ি করবে। কিন্তু!

থেমে যায় প্রিয়তা। নিয়ন ও রাত্রি উৎসুক হয়ে আছে বাকিটা শোনার জন্য। নিয়নের কষ্ট হলেও সে সামলে নিয়েছে আর এতে রাত্রি তাকে এতোদিন সাহায্য করেছে। নিয়ন জিজ্ঞাসা করে,

–তারপর কি প্রিয়তা?

প্রিয়তা বিষন্ন মনে বলে,
–আমি ছাড়া আর কেও নেই ওর।

প্রিয়তাকে রাত্রি এবার জিজ্ঞাসা করে,
–তোমার কি সব মনে পড়েছে?

প্রিয়তা মলিন হেসে বলে,
–হ্যাঁ! কাল রাতে একাকি এক রুমে অনেক জোর করে থেকেছিলাম। আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছিল। কাল রাতে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব মনে পড়েছে। সিলেট আমার প্রিয় জায়গা সব সময়। এখানে আমার আকাশকে নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে।

নিয়নের হৃদয়ক্ষরন হচ্ছে তাও তাকে সবটা জানতে হবে। রাত্রি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

–তাহলে আকাশ কই? আর তুমি সেদিন রাস্তায় পরে ছিলে কেনো? তোমার ওই অবস্থা হবার কারন কি?

রাত্রির একনাগাড়ে করা প্রশ্নে মলিন হাসে প্রিয়তা। তারপর নৌকার দিকে অগ্রসর হয়। প্রিয়তার এভাবে চলে যাওয়া দেখে রাত্রি ও নিয়ন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। এক রাতেই সব মনে পড়ে গেলো! নাকি আগেও মনে পড়েছে?

নৌকায় তিনজন উঠে বসলে নৌকা চালাতে শুরু করে কিশোর একটা ছেলে। গাছের বাঁকে বাঁকে নৌকা চলছে। শীতকাল বিধায় পানি কম নাহলে বর্ষাকালে অনেক গাছ দেখাও যায়না। প্রিয়তা আশেপাশে দেখছে। এদিকে দুজন যে উদগ্রীব হয়ে আছে তাতে ওর খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ পর নিজেই বলে,

–তোমাদের মনে প্রশ্ন উঠছে না? কিভাবে ও কখন আমার সব মনে পড়লো?

দুজনেই ঘার নাড়ায়। তা দেখে প্রিয়তা বলে,
–লাস্ট ইলেকট্রিক শকের পর প্রায় মাঝরাতে আমি স্বপ্ন দেখে উঠে যেতাম। আসলে ওসব আমার স্বপ্ন না। ওসব আমার সাবকনসিয়াস মাইন্ডের কিছু রিলে। যা আমার স্মৃতি থেকে আবছা হয়ে গেছিলো। যা আমি ভুলে গেছিলাম কিন্তু তার ইফেক্ট রয়ে গেছিলো। এখন সেগুলো টুকরো টুকরো আকারে স্মৃতিতে প্রতিচ্ছবি আকারে ফুটে উঠছিল। গভীর রাত থাকতো তাই দুই একদিন আমার করা চিৎকার কেও শুনতে পায়নি। এরপর থেকে আর চিৎকার করতাম না। মাথা ব্যাথা করতো তবে সহ্য করে নিতাম কারন অনেক কিছুই মনে পড়ছিল। আমার পরিবার, আমার ছোটবেলা সব। আর কাল সিলেটে এসে আমি একা একরুমে থাকতে চেয়েছি তখন আমার বাকি গুলো মনে পড়েছে।

রাত্রি ও নিয়ন অবাক হয়। রাত্রি বলে,
–তারমানে তোমার সব মনে পড়ে গেছে আর তুমি মানসিক ভাবে সুস্থ হয়ে গেছো?

প্রিয়তা হাসে। নিয়ন অবাক হয়ে যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। তার আনন্দ হচ্ছে প্রিয়তার সব মনে পড়াতে তবে কষ্ট হচ্ছে প্রিয়তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে। প্রিয়তা ভাবলেশহীন ভাবে বলে,

–শুনবে আমার কাহিনী? আমার জীবনের এক চিরস্মরণীয় কাহিনী! এক বাধ্য মেয়ের অবাধ্য হবার কথন। শান্ত মেয়ের চঞ্চল হবার কথা। আমার প্রেম কথন! সুখ-দুঃখ সব মিলিয়ে। তবে দুঃখের পাল্লাটা শেষের দিকে আচানক একসাথে আসাতে আমি সহ্য করতে পারিনি। তাই তোমরা আমাকে পেয়েছো।

কথা গুলো বলে প্রিয়তা রাত্রি ও নিয়নের দিকে তাকায়। ওদের চোখে আগ্রহ দেখে প্রিয়তা বলে,
–আমি কিন্তু মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিলাম। তাও ময়মনসিংহ মেডিকেলের।

প্রিয়তার এই কথায় ওদের দুজনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। এতোদিন অনেক শুনেছে, মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রী অকালে ঝরে যায়। কেও কেও প্রেম ভালোবাসা জনিত কারনে আর কেও কেও অধিক ডিপ্রেশনে। সুইসাইডের কথাও শুনেছে।
প্রিয়তা ওদের অবাক হওয়া দেখে বলতে শুরু করে,,

অতীত________________________________________

মা-বাবার ছোট মেয়ে প্রিয়তা। পুরো নাম, প্রিয়তা নূর। দেখতে ফর্সা না হলেও উজ্জল শ্যাম সুন্দরী। মেডিকেলের ভর্তি পরিক্ষার রেজাল্ট দেখে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয় কারন প্রিয়তার রেজাল্ট খুব ভালো ছিল এইচএসসি লেভেলে এবং প্রিপারেশন ঢাকার টপ দুটোতে চান্স হবার মতো ছিল। এখন পরিবার ছেড়ে অতো দূরে ময়মনসিংহতে যেতে হবে। বাবা-মা, বড় ভাইকে ছাড়া কখনো থাকেনি প্রিয়তা। অনেক আদুরে সে। এখন চান্স পাওয়াতে ওর যেতেই হবে। একরাশ মন খারাপ ও নতুন পরিবেশে যাওয়া অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে ‘ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে’ আসে প্রিয়তা। সেখানেই তার দেখা হয় আকাশের সাথে।
আকাশ তখন সেকেন্ড ইয়ার শেষ করে নতুন থার্ড ইয়ারে। মানব কঙ্কাল নিয়ে সে ক্যাম্পাসে যাচ্ছে। কয়দিন পর এটাকে বিক্রি করতে হবে। আর আকাশ ও তার এক বন্ধু অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে এটা কিনেছে। এটাকে যত্ন করে সব সময়। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে কঙ্কাল ওরফে “বোনি” মাটিতে পরে যায়। মাটিতে পরার ফলে এক হাতের হিউমেরাস সহ রেডিয়াস ও আলনা আলাদা হয়ে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here