অন্তরিক্ষ প্রণয় পর্ব -০৭

#অন্তরিক্ষ_প্রণয়
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৭
প্রিয়তা বাকরুদ্ধ। আকাশের এই চাচা ওকে কতোটা ভালোবাসতো! আজকাল তো আপন চাচাও এমনটা করে না। আকাশ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

–এখন আমি শূন্য। তাই কাউকে জীবনে জায়গা দিয়ে জীবন নষ্ট করতে চাইনা। যেদিন আমার মনে হবে আমার জীবনে কেউ আসতে পারে এমন এবিলিটি আমার আছে, সেদিন জীবন সঙ্গিনী খুঁজবো।

প্রিয়তা অশ্রু টইটম্বুর নয়নে চেয়ে বলে,
–এটা বললেই পারেন যে আমাকে আপনার পছন্দ না। আমি তো আর মেহের আপুর মতো সুন্দরী না! আমাকে আপনি কেনই বা পছন্দ করবেন! সমস্যা নাই। আমার জীবনে প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি আপনার জন্য তাই আমি হয়তো কখনো আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। জীবনের উনিশটা বসন্ত কাউকে আমার হৃদ কুটিরে জায়গা দিতে পারিনি। আর যখন জায়গা দিলাম! থাক। ভালো থাকবেন। মেহের আপু খুব সুন্দর। সুখী হোন তাকে নিয়ে।

আকাশ হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার চোখ মুখ বলে দিচ্ছে এমনটা সে ভাবেওনি। প্রিয়তা চোখ মুছে চলে যেতে নিলে আকাশ ওর হাত ধরে আটকায়। তারপর সগোউক্তি করে বলে,

“পূর্ণিমার চাঁদও ততোটা সুন্দর না,
যতোটা তুমি আমার চোখে!”

চমকে তাকায় প্রিয়তা। আকাশ চোখে হেসে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তা এবার বাচ্চাদের মতো কেঁদে দেয়। আকাশ হকচকিয়ে যায়। হুট করে কান্না কেন করলো! আকাশ প্রিয়তার হাত ছেড়ে দুই কাঁধে হাত রেখে বলে,

–তুমি কাঁদছো কেনো? প্লিজ কেঁদো না। আমি তোমাকে হার্ট করতে চাইনি।

প্রিয়তা নাক টেনে আকাশের হাতে চাঁপড় মেরে বলে,
–এতো বোকা কেন আপনি? বোকা বলেই তো ওই মেহের আপনাকে তার বয়ফ্রেন্ড বলে সবার কাছে।

আকাশ মুচকি হেসে বলে,
–কারো মুখে বলাতেই কি আমি তার হয়ে যাবো! আমি তো ইতিমধ্যে এক ভীত হরিণির মায়ায় আসক্ত। আমার হৃদ অন্তরিক্ষে সে একমাত্র প্রণয়িনী! সে আমায় প্রণয়িনী।

লাজুক হাসে প্রিয়তা। জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম কারো কাছ থেকে নিজের জন্য হৃদয় থেকে ভালোবাসার অনুরুক্তি। নারী হিয়া আজ লাজে রাঙা। লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে প্রিয়তার। আকাশ এক হাত দিয়ে থুতনি ধরে প্রিয়তার মাথা উঁচু করায় তারপর বলে,

–এই ছন্নছাড়া জীবনে তোমাকে ভালোবাসতে ভয় করে। আমার জন্য যদি তোমার জীবন নষ্ট হয়ে যায়! আমি কখনো চাইনা তোমার জীবন নষ্ট হোক। তোমার সুখের জন্য আমি আমার আকাশও তোমায় লিখে দিতে পারি আবার আমার আকাশ যদি তোমার অমঙ্গলের কারন হয় তো সেটা সরিয়েও নিতে পারি!

আকাশের মুখে হাত দিয়ে চুপ করায় প্রিয়তা। তারপর আঁতকে উঠে বলে,
–আমার মঙ্গলের জন্যও আমি আপনাকে ছাড়তে চাই না। আমি অল্পতে তুষ্ট কিন্তু সবসময় আপনাকে আমার পাশে চাই।

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এক অন্তরিক্ষ প্রণয় দুজনকে ঘিরে।

____________

সময়ের পাতায় লিপিবদ্ধ হয় ওদের আরো অনেক ভালোবাসার অনুভূতি। দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসে। আকাশের বন্ধুরা অনেক খুশি কারন তাদের একাকি বন্ধুটার জীবন গুছাতে তার প্রণয়িনী চলে এসেছে। মেহের নামের মেয়েটা প্রিয়তাকে অনেক কষ্ট দিতে চেষ্টা করেছে। মাঝে মাঝে সিনিয়র হিসেবে টর্চার করতো কারন আকাশকে প্রিয়তা নিজের করেছে বলে। মেহেরের সিনক্রিয়েটে আকাশ একদিন রিয়াক্ট করে মেহেরকে চড় মেরেছিল। মেহের সেদিনের পর অপমানে আর আকাশের সামনে পড়েনি।

_______ভালোবাসাময় একটি বসন্ত পেরিয়ে গেলো ওদের। প্রিয়তা সেকেন্ড ইয়ারে আর আকাশ ফোর্থ ইয়ারে। আকাশ তো টপার টপারই আছে। প্রিয়তা টপার না হতে পারলেও আকাশের পড়া নিয়ে তদারকিতে টপ পাঁচ জনের মধ্যে থাকতে পারে। আকাশ শত ব্যাস্ততার মধ্যেও তার প্রণয়িনীকে সময় দেয়। দিনের একটা সময় ওদের লিখাই থাকে। আকাশের এতো ভালোবাসা, আগলে রাখা সবকিছুতে প্রিয়তা এতোটাই আসক্ত যে আকাশ যদি ফোন তুলতে একটু দেরি করে তো প্রিয়তা ব্যাস্ত হয়ে যায়। হারানোর ভয় প্রিয়তার মাঝে প্রবল। এমন না যে হারানোর ভয়ের কারনে ওরা কোনো বিবাহ ব্যাতিত ফিজিক্যাল রিলেশনে যুক্ত হয়েছে!
আকাশ প্রিয়তাকে বিয়ে করেই নিজের করতে চায়। নিজের প্রণয়িনীকে সে কলঙ্কিত করতে চায় না।

_____দেখতে দেখতে আকাশের এমবিবিএস শেষ এখন সে ইন্টার্নশিপ করছে। প্রিয়তাও থার্ড ইয়ারে উঠেছে। প্রিয়তার পরিবার মাঝে মাঝে ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের কথা তুলে প্রিয়তার কাছে। তবে প্রিয়তা বুঝেও এড়িয়ে যায়। আকাশকে বললে আকাশ মনমরা হয়ে যায়। সে অন্তত চায় না তার চাচার মতো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে হারাতে। চাচার লিখে দেওয়া মাঝারি বাগান সহ একতলা বাড়িটা তো আছে কিন্তু পরিবার বিহীন একটা ছেলে আকাশ। আকাশ প্রিয়তাকে মাঝে মাঝেই বলে,

–যদি একবার আমার হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের খোঁজ পেতাম তাহলে আর তোমাকে হারানোর ভয় থাকতো না।

ইন্টার্নশিপের ডিউটি সাথে ব্রেক টাইমে টিউশনি আবার ভর্তি কোচিংয়ে স্টুডেন্ট পড়ানো। এসব আকাশ করে। প্রিয়তার বাবা-মা যদি মেয়ের লাইফ সিকিউর করার জন্য অন্যত্র বিয়ে না দেয় সেইজন্য কঠোর পরিশ্রম করে আকাশ। সারাদিন শেষে যখন দুজন দুজনের সাথে ফোনে কথা বলে তখন সব ক্লান্তিও এক সুখকর মনে হয়। প্রিয়তার থার্ড ইয়ারের মিডেল সেমিস্টারের পর প্রিয়তাকে তার পরিবার জরুরি তলব করে। প্রিয়তা সেখানে গিয়ে জানতে পারে তার বাবা তার বিয়ের জন্য ছেলে দেখছে। দুজন ছেলে পছন্দ করেছে তারা। একজন সরোয়ার্দি মেডিকেলের নতুন হার্ট সার্জন। বয়স তার ৩০। আরেকজন চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন স্পেশালিষ্ট এবং তার বয়স ২৯।

প্রিয়তার বাবা চট্টগ্রাম মেডিকেলের ডাক্তারটাকে প্রিফার করছে। সরোয়ার্দি মেডিকেলের সে যোগ্যতায় ভালো হলেও ছেলের পরিবারে ছোট দুই ভাই ও বোন আছে এবং মা অসুস্থ এটা জেনে কিছুটা দ্বিমনা। কারন তাদের মেয়েও ডাক্তার হবে। তখন যদি ছেলে বা তার পরিবার মেয়ের উপর প্রেশার ক্রিয়েট করে তো! আর চট্টগ্রাম মেডিকেলের ডাক্তারটার মা-বাবা, বড় ভাই-ভাবি আছে আর এক ভাতিজি। প্রিফারেবল কম্বিনেশন। প্রিয়তাকে এসব জানানোর পর থেকে প্রিয়তা থম মেরে আছে। তার পরিবার যে রিতিমতো একজনকে বাছাই করে ফেলেছে তা সে বুঝে গেছে। কিন্তু প্রিয়তা তো আকাশ ছাড়া আর কাউকে নিজের জীবনে মেনে নিতে পারবে না!

রাতের খাবারের পর প্রিয়তা তার বাবা-মা ও ভাইকে একত্রে আসতে বলে। তারপর কিভাবে বলবে সেটাই ভাবতেই কিছু সময় লাগিয়ে দেয়। প্রিয়তার পরিবার অধীর আগ্রহে আছে হয়তো এই ভেবে যে মেয়ে তাদের এখন রাজী হবে আর চট্টগ্রামের ছেলেটাকেই পছন্দ করবে।

নিজেকে সামলে প্রিয়তা বলে,
–তোমাদের একটা কথা জানানো হয়নি।

প্রিয়তার বাবা-মা ও ভাই ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। প্রিয়তা আমতা আমতা করে বলে,
–আমি একজনকে ভালোবাসি!

কথাটা বলেই প্রিয়তা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়। বিপরিত পাশের মানুষদের রিয়াকশন কি হতে পারে তা ধারনা নেই প্রিয়তার। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর প্রিয়তার বাবা গম্ভীর স্বরে বলে,

–ছেলেটা কে?

প্রিয়তা এই প্রথম তার বাবার এভাবে কথা নিজের জন্য শুনলো। ভয়ে প্রিয়তা কান্না করে দিবে দিবে অবস্থা। প্রিয়তাকে চুপ থাকতে দেখে প্রিয়তার মা রুঢ় স্বরে বলে,

–তোমাকে আমরা পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলাম সেখানে, প্রেম করতে না। এখন চুপ করে আছো কেনো? জবাব দেও, ছেলেটা কে?

প্রিয়তার ভাই তার মাকে থামিয়ে বলে,

–আহ মা! থামো তুমি। প্রিয়কে বলতে দেও। বল প্রিয়, কাকে ভালোবাসিস?

প্রিয়তা শুকনো ঢোক গিলে বলে,
–আকাশ নামের একজনকে। সে এখন ইন্টার্ন করছে ছয় মাস হলো। আমার সিনিয়র।

প্রিয়তার ভাই বলে,
–তার মানে ছেলেও ডাক্তার। তো আব্বু-আম্মু, তোমরা বলো?

প্রিয়তার বাবা গম্ভীর স্বরে বলে,
–এবার ময়মনসিংহ যেয়ে ছেলেকে বলবে, সে যেনো তার বাবা-মাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসে।

প্রিয়তা এবার আরো ঘাবড়ে গেছে। কিভাবে বলবে যে আকাশের পরিবার নিখোঁজ! আর যাকে পরিবার মানতো সেই মানুষটা নেই। এগুলো জানলে তো ওর বাবার রিয়াকশন কি হবে সেটা প্রিয়তা ঠাওর করতে পারছে না। প্রিয়তা ভয়ে আর এগুলো বলে না। যদি কোনো ঝামেলা হয়ে যায়! আস্তে ধীরে তার ভাইয়ের মাধ্যমে বলাবে। এখন বলবে না। আগে একটু স্থিতিশীল হোক পরিস্থিতি। কোনো ভাবেই সে আকাশকে হারাতে রাজী না।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here