মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নড়ছে সাদাফ৷ প্রচুর রক্ত ক্ষরণে জ্ঞানহীন অবস্থায় অবজারভেশনে পড়ে আছে সাদাফ৷ এক হাতে সে-লাইন পুশ হচ্ছে৷ অন্য হাতে ব্লাড পুশ হচ্ছে। বেঁচে থাকার আশঙ্কা নেই বলে দিয়েছেন ডক্টর। তবুও শেষ অব্ধি চেষ্টা করবেন৷ বন্ধু মহলে চিন্তার ছাপ ভেসে উঠেছে। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না? আরাফ ডক্টরের পিছনে ছুটাছুটি করছে৷ ছোঁয়া, অর্পি, মেঘা বসে বাসে চোখের অশ্রু মুছে যাচ্ছে৷ বুকের ভেতর তীব্র বেদনা প্রাণের চেয়ে বন্ধু হারানোর ৷ আরাফ আরও হাফ ব্যাগ রক্ত দান করছে সাদাফকে৷ আরাফ এর আগেও এক ব্যাগ রক্ত দান করেছে সাদাফকে৷ ডক্টর মানা করলে আরাফ ডক্টরের কলার ধরে চেচিয়ে বলল,
“আমার বন্ধু বেঁচে না থাকলে আমি রক্ত দিয়ে কি করব? আমি সাদাফের জন্য আমার দেহ থেকে সবটুকু রক্ত নিলেও আমি হাসিমুখে দিব৷”.
ডক্টর ভয়ে ভয়ে বলল,
“আপনি ভুল করছেন৷ আমরা জানি একজন সুস্থ ব্যক্তি দুই পাউন্ড ব্লাড দান করতে পারেন৷ এতে করে তার ক্ষতি হতে পারে৷ আপনি তো একটু আগে এক পাউন্ড ব্লাড দান করলেন৷ এখন আপনাকে রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন।”
অর্পি আরাফকে টেনে ডক্টরের সাথে বিনয়ী স্বরে বলল,
“প্লিজ ডক্টর আঙ্কেল। আরাফের কোন ক্ষতি হবে না৷ আমরা এই মুহুর্তে কোন ব্লাড সংগ্রহ করতে পারছি না৷ আমরা বাঁধন নামে ব্লাড গ্রুপে পোস্ট করে দিয়েছি এবং এডমিনকে ফোন করেছিলাম৷ এই মুহুর্তে O+ ব্লাড পাওয়া যাচ্ছে না৷ আমাদের কাছে সাদাফ যেমন আরাফও তেমন৷ আমি আপনার পায়ে পড়ি৷”
মেঘা আহত কন্ঠে বলল,
“আরাফকে আমরা প্রচুর পরিমাণ ফল খাওয়াব। আর হ্যাঁ আমরা ব্লাড পেলে সাদাফের সাথে সাথে আরাফের দেহেও পুশ করব। তাহলে আরাফের কোন ক্ষতি হবে না৷”
ডক্টর কথা না বলে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ দেখতে শুনতে আরাফ মাশাল্লাহ। বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী৷ মিনিট দুয়েক পর ডক্টর বলল,
“মি. আরাফ আপনি আমাদের সাথে আসেন৷ আপনার কাছ থেকে আমরা হাফ পাউন্ড ব্লাড নিতে পারব৷ পরবর্তীতে ব্লাড দরকার পড়লে আমি দিব৷ আমার ব্লাড গ্রুপ O+। বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা দেখে আমি খুবই মুগ্ধ। আপনাদের বন্ধুত্ব চিরকাল বেঁচে থাকুক৷
সকলের মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে উঠল৷ প্রায় ৮ ঘন্টা হতে চলছে সাদাফের জ্ঞানহীন বিছানায় শুয়ে আছে৷ কেউ বাসায় যায়নি৷ সবাই হসপিটালে রয়ে গেছে৷ ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের অনেকে এসেছিল৷ একে একে সবাই অজুহাত দেখিয়ে চলে গেছে৷ ডক্টর বলে দিয়েছেন আটচল্লিশ ঘন্টার আগে কিছুই বলতে পারবে না৷ পড়ন্ত দুপুরটা তাদের জীবনে কাল হয়ে ধরা দিয়েছে৷
___
তোলপাড় ক্যাফেডিয়ামে বসে চায়ের আড্ডা দিচ্ছে ছয় জোড়া চোখ। মেঘা চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলল,
“মামা আরও গরম গরম সিঙ্গারা দেন৷ এতো কম সিঙ্গারায় মন ভরে৷”
রঙ্গন মাথায় চাপড়ি মে’রে বলল,
“ব্যাডি মানুষের পেট ভরে তো চোখ ভরে না৷ তুই একে একে ছয়টা সিঙ্গারা খাইছিস৷ আর আমরা দুইটা করে খাইছি৷ তোর পেটে আরও জায়গা আছে?”
অর্পি রঙ্গের পিছনে কিল বসিয়ে বলল,
“সালা কিপ্টামি কম কর৷ আমরা তোরটা খাইছি৷ আজ আরাফের পকেট ধ্বংস করতে আসছি৷ আমাদের যত ইচ্ছা তত খাব৷ আরাফ জুনিয়র মেয়েদের সাথে প্রেম করে আমাদের বলল না কেন?”
আরাফ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“কু*ত্তী তোরা তো পাত্তা দিবিই না৷ জুনিয়রদের সাথেও প্রেম করতে দিবি না৷ তোরা যদি আজ আমার দিকে একটু তাকাতিস তাহলে আজ আমি একটা গার্লফ্রেন্ড পেতাম৷”
মেঘা চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
“অনেক প্রেম হয়েছে। আজ আরাফের কাছ থেকে সব টাকা নিয়ে নে৷ হা*রা*মী যেন ধানমন্ডি যেতে না পারে৷ একটু আগে হা*রা*মী ওর গার্লফ্রেন্ডকে ফোন দিয়ে বলে, ‘হ্যালো জান। আজ তোমার সাথে ধানমন্ডির লেগে হাতে হাত রেখে হাঁটব। রবীন্দ্র সরোবরে হাতে হাত রেখে বসে থাকব৷”
সাদাফ বিস্ময় দৃষ্টিতে মেঘার দিকে তাকায়৷ সাদাফ সব সময় প্রেম ভালোবাসা থেকে অনেক দূরে৷ স্কুল লাইফে প্রেম করে ছ্যাঁকা খাইছে৷ ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক হলো সাদাফ৷ নিজের মনটা তখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়৷ তারপর থেকে প্রেম ভালোবাসা থেকে দূরে সাদাফ৷ সাদাফ গিটারে টুংটাং শব্দ তুলে বলল,
“মামা প্রেম করিস না৷ এর থেকে আমাদের সাথে আড্ডা দে৷ অনেক ভালো লাগবে৷”
ছোঁয়া ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সাদাফের উপর৷ কঠিন স্বরে বলল,
ছ্যাঁ*কা*ক্ষু*র তুই, একটু চুপ থাক৷ তোর এসব নীতি কথা শুনলে আমার গা জ্বলে উঠে৷ এখন প্রেম করবে না তো কখন প্রেম করবে৷ কিছুদিন পর ভার্সিটি ছেড়ে চলে যাবে৷ তখন প্রেম করবে৷ মামা তুই প্রেম কর৷ আমরা তোর পাশে আছি৷”
মেঘা রঙ্গের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তার পকেট থেকে ওয়ালেট নে মামা৷ সা*রা তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবে৷ আজ আমরাও যাব না হলে কেউ যাবে না৷”
আরাফ আহত কন্ঠে বলল,
“তোরা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নাকি শত্রু। আমি আজ তোলপাড় ক্যাফেডিয়ামে বসে বললাম, তোদের মতো বন্ধু থাকলে দেশে শত্রুর অভাব পড়বে না৷”
অর্পি চায়ের কাপে শেষ চুমু দিয়ে বলল,
“তোরা চা খাওয়া শেষ কর৷ আমাকে হলে যেতে হবে৷ জুনিয়র কিছু মেয়ে মারমারি করেছে৷ এসবের একটা সমাধান বের করতে হবে৷”
ছোঁয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হলের প্রেসিডেন্ট আসছে৷ তাদের নরম তুলতুলে চেয়ারে বসতে দে৷ প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে তার কোমরের সমস্যা হতে পারে৷”
মেঘা নরম স্বরে বলল,
“ছোঁয়া আমরা প্রায় ১ ঘন্টা থেকে কথা বলছি৷ এভাবে বসে সারা জীবন কথা বললেও কথা বলা শেষ হবে না৷ বন্ধুদের কথা কোনদিন শেষ হয়না৷ আমাদের হলে জুনিয়র মেয়েগুলো প্রতিদিন মারামারি করে৷ চুল টানাটানি তো আছেই৷ কেউ কাউকে দেখতে পারে না৷ র্যাগের দরকার পড়ে না৷ তারা নিজেরাই নিজেদের আঘাত করে৷”
সাদাফ হেঁসে বলল,
“মেঘা আর অর্পিকে লা*থি দিয়ে এখান থেকে বের করে দে৷ তাদের কপালে কোন ট্রিট নেই৷ ওইতো হলের ডালের পানি খাবে৷ সেজন্য তো রা*ক্ষ*সের মতো সিঙ্গারা খায়৷ আসলে কি জানিস? ব্যাডি মানুষ ফ্রীতে সবই খাবে৷ না খেতে পারলে নষ্ট করবে।”
অর্পি সাদাফের চুল টেনে বলল,
“কু*ত্তা তুই বার বার ব্যাডি মানুষ বলিস কেন? তোরা ধোঁয়া তুলসী পাতা নয়৷ তুই আর বলবিই না কেন ব্যাডি মানুষের কাছে ছ্যাঁকা খাইছিস৷”
অর্পির কথায় বন্ধু মহলে হাসির রেখা ফুট উঠল৷ সাদাফ আবারও গিটার টুংটাং শব্দ তুলে৷ সাদাফের গিটারের শব্দ বরাবর সবারই প্রিয়৷ যেমন গিটারের সুর তুলতে পারে তেমনই ঠোঁটের কোণে বাজে মধুর গান৷ সাদাফের ঠোঁটে বেজে উঠল৷
❝কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে?
তোমাকে দেখিতে দেয়না মোহমেঘে ;
মাঝে মাঝে তবুও দেখা পাই৷❞
আরাফ হুংকার দিয়ে বলল,
“সা*লা তুই এখনও ব্যর্থ গান বলবি৷ আমি কই একটু প্রেমে পড়ছি তুই রোমান্টিক গান বলবি। রোমান্টিক গান না বলে ব্যর্থ গান বেজে উঠছে তোর ঠোঁটের কোণে৷”
সাদাফ গিটার পাশের চেয়ারে রেখে বলল,
“আমার ঠোঁটের কোণে রোমান্টিক গান আসে না৷ রোমান্টিক খাবার পেলে রোমান্টিক গান আসবো ঠোঁটের কোণে৷”
আরাফ ওয়ালেট বের করে দশ টাকা সাদাফের দিকে এগিয়ে বলল,
“আপনার গান শুনিয়া আমি মুগ্ধ হইয়া আপনাকে দশ টাকা দান করিলাম৷ আপনার গান আমার মনের ভিতর জায়গা করে নিয়াছে৷ আমি ধন্য আপনার দেখা পাইয়া৷ জীবনটা আমার সার্থক হইয়া গেল৷ এখন ম’রি’বা’র কালে আপনার কন্ঠে একটা গান শুনিতে চাই৷”
আরাফ ওয়ালেট প্যান্টের পকেটে রাখতে যাবে ঠিক তখনই সাদাফ খ*প করে ওয়ালেট নিয়ে ফেলে৷ সকলের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা ফুটে উঠে৷ সাদাফ দৌড়ে মাঠে চলে আসে৷ সাদাফের পিছন পিছন আমরাও চলে আসলাম৷ আরাফ বিনয় স্বরে বলল,
“মামা তোদের অন্যদিন খাওয়াব৷ আজ আমাকে ঘুরতে যেতে হবে৷ তোরা আমার বন্ধু হয়ে আমার সাথে এমন কিভাবে করিস? তোদের তো একটু লজ্জা থাকা দরকার৷”
“রঙ্গন সাদাফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
” জন্মের পর লজ্জা পানির সাথে মিশিয়ে খেয়ে ফেলছি৷ আমাদের পাঁচ জনের মাঝে কারোর ল’জ্জা স’র’ম নেই৷”
ছোঁয়া মাথার উপর হাত রেখে নিজের ত্বককে দুপুরের তন্ডব রোদ থেকে রক্ষা করার বৃথা চেষ্টা করে৷ বাচ্চা সূলভ কন্ঠে বলল,
“ভাই তোরা যে যাই বলিস৷ আমার অনেক লজ্জা৷ আমি লজ্জায় জন্য বাড়িতে বিয়ের কথা বলিনা৷”
ছোঁয়ার বোকা বোকা কথা শুনে সবাই হেঁসে উঠলাম৷ আরাফ আহত কন্ঠে বলল,
“তোদের জন্য আমার প্রেম হয়ে উঠল না৷ আমার টাকা আমাকে ফিরিয়ে দে৷”
সাদাফ বলল,
“তুই কে? আমরা কেউ তোকে চিনি না৷”
“প্লিজ মামা আজ তো অনেককিছু ভ’ক্ষ’ণ করলি। আরও তো দিন পড়ে আছে৷ অন্যদিন খাবি৷”
সাদাফ ওয়ালেট থেকে গেটে দেখে৷ মুচকি হেঁসে বলল,
“যা আজ তোর কাছে তেমন কিছুই খাব না৷ আমরা পাঁচটা স্পিট খাব৷ তুই খাইলে খেতে পারিস৷”
মেঘা, ছোঁয়া, অর্পি বলল,
“ঠিক বলছিস সাদাফ৷ তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়৷”
আরাফ সাদাফের পিছনে দৌড়াতে থাকে৷ তাদের পিছনে দৌড়ে যাচ্ছে আরও চার জোড়া পা৷ সাদাফ রাস্তা পার হতে যাবে এমন সময় একটা পাইভেট কার এসে সাদাফের দেহকে ধাক্কা দেয়৷ নিথর রক্তমাখা অবস্থায় পড়ে আছে সাদাফ৷ সবাই চিৎকার করে বলল,
“সাদাফ৷”
আরাফ হাত পুশআপ করতে করতে সাদাফের রুমের সামনে আসে৷ অন্য মনস্ক হয়ে বসে আছে বন্ধু মহুল৷ আরাফের পরপরই রঙ্গন এসে হাজির হলো৷ ডক্টরের দেওয়া ইনজেকশনের জন্য রঙ্গন বাহিরে গেছিল৷ রঙ্গনকে দেখে আরাফ দৌড়ে রঙ্গনকে জড়িয়ে ধরল৷ ভয়ার্ত আহত কন্ঠে বলল,
“সাদাফের অবস্থা আমার জন্য আমি দায়ী৷ আমি নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারব না৷ আমি টাকাকে বেশি মূল্য দিলাম৷ আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুর কথা একবারও মাথায় আসল না৷”
মেঘা সান্ত্বনা স্বরে বলল,
“আরাফ এতে তোর কোন দোষ নেই৷ আমাদের ভাগ্য সহায় ছিল না৷ আল্লাহর কাছে এখন আমাদের একটাই প্রার্থনা আল্লাহ যেন আমাদের সাদাফকে আবার ফিরিয়ে দেন৷”
অর্পি কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“আল্লাহ আর কতো কষ্ট দিবে সাদাফকে৷ ছোট থেকেই আল্লাহ সাদাফকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছেন৷ আল্লাহ তার কাছ থেকে তার আত্মার বোনকে কেঁড়ে দিয়েছে৷ তার ভালোবাসার মানুষটাকে কেঁড়ে নিয়েছে৷ আল্লাহ আপনি এমন হবেন না৷ আপনি দয়ার সাগর৷ আল্লাহ আমাদের সাদাফকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন৷”
সকলের চোখে অশ্রু টলমল করছে৷ প্রিয় মানুষটাকে হারানোর ভয়ে মুখ কুঁচকে আছে৷ নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে৷ ডক্টর সাদাফের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলেন৷ ডক্টরের মুখটা আষাঢ়ের ঘনঘটার মতো হয়ে আছে৷ অন্ধকার বিলীন হয়ে গেছে ডক্টরের মুখে৷ উত্তেজনায় সকলে ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে৷ পাঁচ জোড়া চোখ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে ডক্টরের দিকে৷ কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে৷ দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছে না৷ ডক্টর মলিন কন্ঠে বলল,
…..!
পাঁচ জোড়া চোখ একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে৷ তাদের উপর আকাশ ভেঙে পড়ল। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না? চিন্তার ছাপ স্পর্শ ফুটে উঠেছে।
চলবে….
#অন্যরকম_প্রেমকাহিনী
#পর্ব_০১
#অধির_রায়