##অপেক্ষারা
৫২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
প্রায় অনেকটা সময় যাবত হতবাক হয়ে সায়েমের কর্মকান্ড লক্ষ করছে নাজ। বাড়ির একটা শোবার ঘরের সবগুলো ফার্নিচার বের করে, ঘরটাকে নতুন করে সাজাচ্ছে। ঘরের দেয়ালজুড়ে নানান কার্টুনের ছবি, এক কোণে ছোট্ট একটা দোলনা আর বাচ্চাদের একটা বিছানা। সারা ঘরটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট বড় বিভিন্ন খেলনা। এতগুলো খেলনা একসঙ্গে জীবনে দেখেনি নাজ।
নাজ বিস্মিত গলায় বলল, “এতগুলো খেলনা দিয়ে আমার বাচ্চা একা খেলবে?”
সায়েম ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমাদের!”
“ওই একই কথা। কিন্তু এতগুলো খেলনার কী দরকার? পুরো এলাকার বাচ্চারা এগুলো দিয়ে খেলতে পারবে।”
“তুমি বুঝবে না নাজ। ছোটবেলায় বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলনা দিয়ে খেলতে হয়। এতে তাদের ইমাজিনেশন পাওয়ার বাড়ে।”
“ও পৃথিবীতে আসবার পরেই না হয় এগুলো আনতে। আমরা তো জানিই না ছেলে হবে না-কি মেয়ে। ছেলে হলে এই পুতুলগুলো দিয়ে কী করবো? আর মেয়ে হলে এই গাড়িগুলো দিয়েই বা কী করবো?”
“তোমাকে কে বলেছে, মেয়েরা গাড়ি দিয়ে আর ছেলেরা পুতুল দিয়ে খেলতে পারে না? খেলনার মধ্যে কোনো জেন্ডার থাকে না, মানুষের মস্তিকে থাকে।”
নাজ ঠোঁট উল্টে বলল, “বাব্বাহ! দিন দিন ফিলোসফার হয়ে যাচ্ছে দেখি।”
“কী আর করা? তোমার মতো বাচ্চার সাথে থাকতে থাকতে জ্ঞান দেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“এই! আমি তোমাকে হেল্প করি?”
সায়েম সতর্ক গলায় বলল, “একদম না! যাও ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও, আমাকে হেল্প করতে হবে না।”
“রেস্ট তো সারাদিনই নিলাম, একটা মানুষ আর কত রেস্ট নিতে পারে? দাও না হেল্প করতে, তোমার ঘর সাজানো দেখে আমারও লোভ লাগছে।”
“আচ্ছা, বেশি কিছু করতে হবে না। এখানে বসে ড্রেসগুলো গোছাও।”
বাচ্চাদের জামাগুলোকে সাধারণত রঙের ভিত্তিতে আলাদা করে দেওয়া হয়। গোলাপী বা লালাভ রংগুলো মেয়েদের পোশাকে এবং নীলাভ রংগুলো ছেলেদের পোশাকে। এরজন্যেই গোলাপীকে মেয়েদের রং বলা হয়।সায়েম ভেবে পায় না একটা রং কী করে শুধুমাত্র ছেলেদের বা শুধুমাত্র মেয়েদের হয়। রং তো রংই। একে আবার আলাদা করে দেওয়ার কী আছে।
বাবুর জন্যে সায়েমের আনা পোশাকগুলোর মধ্যে নীল রঙও আছে আবার, গোলাপীও আছে। ছেলে বা মেয়ে যাই হোক, এই দুটো রংই পড়বে সে। নাজ বাবুর বিছানাটায় বসে পোশাকগুলো ভাঁজ করতে করতে কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। ঘরের পুরো দেয়ালজুড়ে কার্টুনের ওয়ালপেপার লাগানো হবে। এসব কাজে সাধারণত সায়েম বাইরে থেকে মিস্ত্রি ভাড়া করে আনে। তবে আজ সবকিছু নিজের হাতেই করছে।
নাজ আনমনে বলে ফেলল, “তুমি অনেক ভালো বাবা হবে।”
সায়েম ঠোঁটের কোণে বিচিত্র এক হাসির আভাস নিয়ে বলল, “কী করে বুঝলে?”
“তোমার ছেলেমানুষী দেখে। বাচ্চা আসার খবর শোনার পর থেকে দিন দিন নিজেই বাচ্চা হয়ে যাচ্ছ। দেখো! ও আমার থেকে তোমাকেই বেশি ভালোবাসবে।”
সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “কেন তুমি কি জেলাস?”
“অবশ্যই জেলাস! হুট করে কেউ এসে আমার ভালোবাসায় ভাগ বসাবে, আর আমি মেনে নেবো?”
সায়েম হঠাৎই কাজ থামিয়ে নাজের পাশে এসে বসলো।
অনেকটা সময় একদৃষ্টিতে নাজের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার মনে হয় ও এলে আমি আর তোমাকে আগের মতো ভালোবাসবো না?”
নাজ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
“আর আমার কী মনে হয় জানো?”
“কী?”
“আমার মনে হয় তুমি আস্ত একটা বোকা।”
নাজ আহত গলায় বলল, “মানে?”
“আমি তোমাকে ভালোবেসেছি ঠিকই, কিন্তু কী করে ভালো না বেসে থাকা যায় তা শিখিনি। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে নাজ, যাই হয়ে যাক না কেন, আমি সারাটাজীবন এভাবেই তোমাকে ভালোবাসবো।”
নাজ আর্দ্র গলায় বলল, “সত্যি তো?”
“এখনো সন্দেহ আছে?”
নাজ কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই লক্ষ করলো সায়েমের ফোন বেজে উঠেছে। সায়েম পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো স্ক্রিনে মায়ের নাম ভেসে উঠছে।
ফোনটা রিসিভ করে সায়েম স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যালো? কেমন আছো মা?”
হাসনা বেগম কোমল স্বরে বললেন, “ভালো আছি। তুই কেমন আছিস বাবা? বৌমা ভালো আছে?”
“হ্যাঁ, আছে। কথা বলবে?”
“পরে বলবো। আগে তোর সঙ্গে জরুরি কথাটা সেরে নিই।”
“আমার সঙ্গে আবার কী জরুরি কথা?”
হাসনা বেগম লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “শোন সায়েম, আগামী সপ্তাহে কনার পরীক্ষা শেষ হচ্ছে। আমি ঠিক করেছি তার পরপরই আমরা ঢাকায় চলে যাবো। বৌমার ডেলিভারির আগ পর্যন্ত সেখানেই থাকবো। এই সময়ে মেয়েদের নানান অসুবিধা হয়। আশেপাশে কোনো গুরুজন না থাকলে সেই অসুবিধা সামাল দেবে কী করে?”
“বাহ্! বেশ তো! আমি তো সেই কবে থেকে বলছি আমাদের সঙ্গে এসে থাকার জন্যে। এতদিন পর কথাটা কানে গেল তোমার।”
“তুই তো জানিস বাবা, ঢাকা শহরে পরপর কয়েকটা দিন থাকলেই আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। তবুও এবার আমার নাতি বা নাতনির কথা ভেবে রাজি হয়েছি।”
“ভালো ডিসিশন নিয়েছো। এখন আমিও অফিসে গিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। কনার পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই চলে আসবে।”
“সেটা আর তোকে শিখিয়ে দিতে হবে না। কই, বৌমাকে দে তো! ওকেও জানিয়ে দিই।”
সায়েমের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নাজ হাস্যোজ্জ্বল গলায় বলল, “আমাকে জানাতে হবে না মা। আমি নিজেই পাশ থেকে শুনছিলাম।”
হাসনা বেগম চিন্তিত গলায় বললেন, “তোমার ওপর আমার এতটুকুও ভরসা নেই বৌমা। যেমন ছেলেমানুষ তুমি! দেখা গেল ভুল করে ভারী একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভার্সিটিতে চলে গেছ। আমি এবার নিজেই গিয়ে তোমার দেখাশোনা করবো। তোমার মাকেও কতো করে বললাম, ভাবি আমাদের সঙ্গে চলুন। দুই বেয়ান মিলে একসঙ্গে মেয়েটার যত্ন করি। উনি না-কি নিজের বাড়ি ফাঁকা রেখে কোথাও যাবেনই না।”
নাজ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “হ্যাঁ সায়েম…”
কথাটা শেষ করার আগেই থেকে গেল। সায়েম সায়েম ডাকার মধ্যে যদিও অন্যায়ের কিছু নেই তবুও শাশুড়ির সামনে কেমন যেন লজ্জা লাগছে।
নাজ আবারও ইতস্তত করে বলল, “মানে উনিও মাকে বলেছিল…”
“থাক থাক, নিজের স্বামীর নাম ধরে ডাকবে না তো কি আমার নাম ধরে ডাকবে?”
“সরি মা।”
“আবার সরি বলতে হবে কেন? ভেবেছো কী? কেবল এযুগের বাচ্চাকাচ্চারাই আধুনিক। চাইলে আমরা বুড়ো-বুড়িরাও আধুনিক হতে পারি।”
নাজকে রাতের খাবার খাওয়াতে বেশ ভালোই ঝামেলা পোহাতে হলো সায়েমকে। মেয়েটা দুয়েক লোকমা খাচ্ছে, আর অন্য ঘরে চলে যাচ্ছে। সায়েমকেও বাধ্য হয়ে প্লেট হাতে এক থেকে অন্য ঘরে যেতে হচ্ছে তার পিছু পিছু।
নাজ আহ্লাদী স্বরে বলল, “আমি আর খেতে পারবো না। প্লিজ!”
“আরেকটু না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো নাজ।”
“পড়লাম অসুস্থ হয়ে! তবুও খেতে পারবো না।”
“তুমি না খেলে আমার বাবুটাও তো না খেয়ে থাকবে।”
“শোনো, বাবুটা আমারও! ও আমাকে বলেছে ওরও খেতে ইচ্ছা করছে না।”
সায়েম কঠিন গলায় বলল, “নাজ, আমি রেগে যাবো কিন্তু।”
“তুমি এই অবস্থাতেও আমার ওপরে রাগ করবে?”
“অবশ্যই করবো। চুপ করে খেয়ে নাও।”
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল নাজের। যদিও প্রেগন্যান্সির এই সময়টায় তার ঘুম ভেঙে যাওয়া নতুন কিছু না। প্রতি রাতে ঘড়ির কাঁটা যখন আড়াইটার ঘরে এসে থাকে, তখনি তার ঘুমটা ভেঙে যায়। কিন্তু আজ নির্ধারিত সময়ের বহু আগেই ঘুম ভেঙে গেল। এবং ঘুম ভেঙে হওয়ার কারণটাও নাজের কাছে স্পষ্ট।
পাশে সায়েম ঘুমাচ্ছে। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় তার মায়াভরা মুখটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে নাজ। আহারে! মানুষটা এখন ডেকে তুলতে হবে ভাবতেই একরাশ খারাপ লাগা ছড়িয়ে গেল নাজের মাঝে।
তবুও উপায়ন্তর না পেয়ে নিচু এবং ক্লান্ত স্বরে নাজ ডাকল, “সায়েম? একটু উঠবে প্লিজ?”
সায়েমের ঘুমটা বোধ হয় ততক্ষণে গাঢ় পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তাই নাজের একডাকেই ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলে উঠলো, “হুঁ?”
“ওঠো না!”
“কী হয়েছে?”
“আমার খুব খারাপ লাগছে।”
সায়েম সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসলো। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “মানে? কী হয়েছে?”
নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “পেটে খুব ব্যথা করছে।”
“সে কী? কখন থেকে? আমাকে ডাকোনি কেন?”
“কী করে ডাকবো? আমার নিজেরই তো এইমাত্র ঘুম ভাঙলো।”
সায়েম আলতো স্পর্শে নাজের পেটে হাত রেখে বলল, “বেশি ব্যাথা করছে?”
“হুঁ।”
অবশ্য মুখে “হুঁ” না বললেও সায়েম ঠিকই বুঝতে পারতো নাজের ব্যথার তীব্রতা। মেয়েটার চোখেমুখে তা স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। খানিকক্ষণ আগেও যে মানুষটা একেবারে সুস্থ ছিল, হুট করে অচেনা এক ব্যথা কাহিল করে ফেলেছে তাকে।
নাজ ভীত গলায় বলল, “এই! এরকম তো কখনো হয়নি। আমার খুব ভয় করছে। ওর কিছু হবে না তো?”
“কিচ্ছু হবে না। শান্ত হও তো তুমি।”
সায়েম আর কথা না বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে কন্টাক্ট লিস্টে কার নম্বর যেন খুঁজছে।
নাজ বলল, “কাকে ফোন করছো?”
“ডক্টর রেহানাকে।”
“এত রাতে?”
“কেন উনিই তো বললেন, দিনে-রাতে যখনই কোনো প্রবলেম হোক তাকে কল করতে।”
ডক্টর রেহানা একটা ইমার্জেন্সির কারণে হাসপাতালেই ছিলেন। ফোন রিসিভ করেই বললেন, নাজকে।
নাজ ক্লান্ত গলায় সায়েমকে বলল, “এত রাতে আবার হসপিটালে যাওয়ার কী দরকার?”
সায়েম গম্ভীর গলায় বলল, “তোমাকে এতকিছু বুঝতে হবে না। চুপচাপ স্যান্ডেল পড়ো।”
সায়েমের মাঝে এক বিচিত্র ধরনের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা দেখতে পেল নাজ। তার সামান্য কোনো অসুবিধাতেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছেলেটা। তবে আজ সেই ব্যস্ততার সীমা পৌঁছে গেছে চূড়ান্তে। সায়েমের উদ্বেগের কাছে পরাজয় স্বীকার করে স্যান্ডেল পড়ে নাজ গাড়িতে গিয়ে বসলো।
নাজের ব্যথাটা আগের মতোই আছে।
হাসপাতাল এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। গাড়িতে বড়জোর দশ মিনিটের মত সময় লাগে। তার ওপরে এই মাঝরাতে রাস্তা বলতে গেলে ফাঁকাই। দুয়েকটা বড় বড় ট্রাক ছাড়া রাস্তায় আর কিছুই নেই। কেমন গা ছমছমে একটা পরিবেশ। সায়েমের বাম হাতটা ব্রেকের ওপরে। নাজ তার একটা হাত রাখলো সায়েমের হাতের ওপর।
সায়েম চিন্তিত গলায় বলল, “খুব বেশি খারাপ লাগছে তাই না?”
“উহুঁ।”
“এইতো, অলমোস্ট পৌঁছে গেছি।”
নাজ ক্লান্ত গলায় বলল, “তোমার কাঁধে একটু মাথা রাখি?”
“জিজ্ঞেস করার কী আছে?”
প্রিয় মানুষটার কাঁধে মাথা রাখতেই হুট করে একরাশ ঘুম নেমে এলো নাজের দুচোখ জুড়ে। মনে হচ্ছে যেন এক্ষনি তলিয়ে যাবে ঘুমের রাজ্যে।
ডক্টর রেহানা প্রায় অনেকক্ষণ যাবত কী সব চেক আপ করলেন। স্বস্তির বিষয়, বাবু একদম ঠিক আছে। প্রেগন্যান্সির সময়টাতে খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলেই মাঝে মধ্যে এমন ব্যথার আগমন হতে পারে। তিনি নাজকে পরামর্শ দিলেন সারাদিন জুড়ে অল্প অল্প খাবার খেতে। আর ঘুমের একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে নিতে। সেই সাথে কয়েকটা ওষুধের ডোজও পরিবর্তন করে দিলেন।
ব্যথা উপশমের জন্যে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ বা পেইনকিলার দেওয়া যেত। কিন্তু এখন সেসব কিছুই করা যাবে না, বাবুর অসুবিধা হতে পারে। তাই আপাতত হট ওয়াটার ব্যাগই ভরসা।
ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সায়েম ক্লান্ত ভঙ্গিতে এসে বসলো কেবিনের সামনের ওয়েটিং এড়িয়ায়। তার চোখেমুখে তীব্র উদ্বেগের ভাবটা না থাকলেও দুশ্চিন্তার ছাপ রয়েই গেছে।
নাজ অবাক গলায় বলল, “চলো, বাসায় যাবে না?”
সায়েম ক্লান্ত গলায় বলল, “পাঁচ মিনিট বসি এখানে?”
নাজ তার পাশে বসতে বসতে শান্ত গলায় বলল, “খুব টেনশনে পড়ে গিয়েছিলে তাই না?”
“হ্যাঁ, ভয় হচ্ছিল। আসলে কী, বাবুটা আসার আগেই ওর প্রতি এত মায়া জন্মে গেছে তো। ওর কিছু হয়ে গেলে…”
নাজ সায়েমকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা, আমার এ নিয়ে কথা বলছি কেন? ডক্টর তো বললেনই ও ঠিক আছে।”
(চলবে)অপেক্ষারা
৫৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
দিনের শুরুটাই হলো অঘটন দিয়ে। আজকাল আবার নাজের আদা চায়ের প্রতি নেশা জন্মেছে। দিনের মধ্যে বেশ কয়েক কাপই খাওয়া পড়ে। সাধারণত জরিনাই আদা কুচি করে ফ্রিজে রেখে যায়। তবে আজ তা শেষ হয়ে যাওয়ায় নাজ নিজেই আদা কাটতে গেছে। তখনি ঘটে গেল অঘটনটা। নিজের অজান্তেই খুঁচ করে ছুরির ধারে আঙুল কেটে গেল।
বেশ গভীরভাবেই কেটেছে, গলগল করে রক্ত বেয়ে পড়ছে আঙুল বেয়ে। নাজ আঙ্গুলটা বেসিনের জলের প্রবাহের নিচে ধরলো। ব্যথায় সারা শরীর কাঁপছে তবুও বেচারি চুপ করে আছে। সায়েম ঘুমাচ্ছে। কোনোভাবেই যদি জেনে যায়, তাহলে এতটুকু কাটার জন্যেও হাসপাতালে নিয়ে ছুটবে।
আঙুলে ওষুধ লাগিয়ে নিজেই ব্যান্ডেজ বেঁধে নিলো নাজ। আদা চা আজ আর খাওয়া হলো না। সকালগুলো আজকাল কেমন যেন বিষন্নতায় ঘেরা। নাজের দিন শুরু হয় ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। আশেপাশের বাড়ির সকলে তখন ঘুমিয়ে। মোড়ের চায়ের দোকানটা তখনো খোলে না, পেপারওয়ালাও বিরক্ত মুখে পেপার বিলি করতে বের হয় না।
সায়েম ওঠার আগ পর্যন্ত সময়টা কাটিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে বেচারি। কাটা হাতে কোনমতে নাস্তা করে বইয়ের সামনে এসে বসলো নাজ। চতুর্থ সেমিস্টার শুরু হয়েছে কয়েকদিন হলো। এর মাঝে খুব একটা ক্লাসে যাওয়া হয়নি। বাড়িতে বসে যে খুব লেখাপড়া হচ্ছে তাও নয়। প্রায়ই নাজের শরীরটা খারাপ থাকে, পড়তে বসার মতো শক্তি বা ধৈর্য কোনোটাই সহসা হয়ে ওঠে না।
আজ যদিও শরীরটা একটু ভালো লাগছে। তবুও বইয়ের দুই তিনটা পাতা ওল্টাতেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। এমনটা প্রায়ই হয়। মনে হয় যেন তাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের সকল কিছু প্রচন্ড গতিতে ঘুরছে।
নাজ বই ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মাথা ঝিমঝিম ভাবটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
নাজ পা বাড়ালো শোবার ঘরের উদ্দেশ্যে। গত রাতে সায়েম বারবার করে বলেছিল সকাল সকাল তাকে ডেকে দিতে। আজ জাপান থেকে তার একদল ক্লাইন্ট আসছে। তাদের সঙ্গে মোটা অঙ্কের ডিল ফাইনাল করার মিটিং। এজন্যেই সায়েমসহ অফিসের সকলের গত এক সপ্তাহ ধরে ব্যস্ততার সীমা নেই।
সায়েমের গায়ে হাত রেখে নাজ আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল, “এই! ওঠো!”
এতটুকু ডাকায় যদিও সায়েমের ঘুমে কোনো ব্যাঘাত ঘটলো না। ঘুমের মধ্যেই সামান্য কেঁপে উঠে আবারও পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
নাজ আরেকটু উঁচু গলায় বলল, “উঠে পড়ো সায়েম! তোমার মিটিং আছে না?”
এবার সায়েমের ঘুম ভাঙলো। তবুও ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “কয়টা বাজে?”
“সাতটা।”
সায়েম ধড়মড় করে উঠে বসতে বসতে বলল, “ল্যাপটপটা অন করে শেষ মেইলটা ওপেন করে দাও না প্লিজ!”
“দিচ্ছি, তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।”
সায়েম হাতমুখ ধুতে চলে গেলে নাজ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে সায়েমের ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। ল্যাপটপের খুঁটিনাটি কাজ সায়েম তাকে অনেক আগেই শিখিয়েছে। তার মতে, একটা মানুষকে কেবল লেখাপড়ায় ভালো হলেই চলে না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকতার স্বাদও গ্রহণ করতে হয়।
সায়েমের পাওয়া শেষ মেইলটা হলো তার অফিসের ডিসাইন বিভাগের এক কর্মচারীর। আজ ক্লাইন্টদের সামনে যে প্রেজেন্টেশন দেওয়া হবে, তা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেই কর্মচারীকে। গত রাতে অবশ্য সেটা তৈরির সমস্ত নির্দেশনা সায়েম নিজেই দিয়ে এসেছিল।
প্রেজেন্টেশনের এক ঝলক দেখতেই রাগের প্রবল এক স্রোত বয়ে গেল সায়েমের শিরদাঁড়া বেয়ে। এক মুহূর্তও অপচয় না করে ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করলো প্রেজেন্টেশন তৈরিকারী ব্যক্তিকে।
অপরপ্রান্ত থেকে বিনয়ী এক পুরুষকণ্ঠ বলে উঠলো, “প্রেজেন্টেশন ভালো লেগেছে স্যার?”
সায়েম রাগী কিন্তু শান্ত গলায় বলল, “আপনার মনে হয় তারা জাপান থেকে এতদূর আসছে এই প্রেজেন্টেশন দেখার জন্যে?”
“কোথাও সমস্যা হয়েছে স্যার?”
“কোথায় সমস্যা হয়নি? জায়গায় জায়গায় অসংখ্য টাইপো, কোনো স্লাইডে টেক্সটের সাইজ বড় আবার কোনোটায় ছোট। আর বাগ্রাউন্ডে এমন বিশ্রী একটা সবুজ রঙ দিয়েছেন কেন? ইউ থিঙ্ক উই আর গনা গেট দ্যা ডিল বাই শোয়িং দিস?”
“স্যার আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনি আধ ঘন্টার মধ্যে সব ঠিক করে আপনাকে পাঠাচ্ছি।”
“চিন্তা না করে তো পারছি না। বারোটায় মিটিং আর আপনাদের কাজের ধরন দেখে মনে হচ্ছে হাতে অফুরন্ত সময়।”
ফোনে সায়েমের কথা শেষ হলেই নাজ ক্লান্ত গলায় বলল, “অফিসের সবাই তোমাকে খুব ভয় পায় তাই না?”
“হুঁ।”
“পাবেই তো। যেভাবে ধমকের ওপরে রাখো সবাইকে।”
সায়েম মুচকি হেসে বলল, “তুমিও তো ভয় পাও, পাও না?”
“মাঝে মধ্যে, সবসময় না।”
“নাজ?”
“উঁ?”
“তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“কেমন?”
“কেমন যেন, ক্লান্ত।”
“একে তো ঘুম হয়নি, তার ওপরে আবার সেই তখন থেকে মাথাটা ঘুরছে।”
সায়েম উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “সে কী এতক্ষণ আমাকে বলোনি কেন?”
“তুমি তো ব্যস্ত ছিলে?”
“ঘুম থেকে উঠেই তো ব্যস্ত ছিলে না, তখন বলতে পারতে!”
নাজ অসহায় গলায় বলল, “উফ! তোমার সঙ্গে কোনোদিনই আমি তর্কে পেরে উঠবো না।”
“বেশি খারাপ লাগছে নাজ?”
“কিছুটা বেশি।”
“দাঁড়াও, ডক্টরকে ফোন করি।”
নাজ ব্যস্ত স্বরে বলল, “মোটেও না। ডক্টরকে ফোন করলেই বলবে হসপিটালে চলে আসুন। তারপর একগাদা টেস্ট। আমার ওসব ভালো লাগে না। একটু রেস্ট নিই, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সায়েম চিন্তিত গলায় বলল, “শিওর তুমি?”
“হুঁ। এখন তুমি গিয়ে রেডি হও, অফিসে আগেভাগে পৌঁছে সবাইকে ধমকাতে হবে তো!”
সায়েম অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যাওয়ার পরপরই শরীরটা আরও খারাপ হতে শুরু করলো। ক্রমেই হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। এই সকাল সকাল করার মতো কোনো কাজই খুঁজে পেল না নাজ। আগেকার সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর টিউশনিতে সময়টা কীভাবে যেন পার হয়ে যেত, অথচ আজকাল একেকটা দিনের দৈর্ঘ্য যেন কয়েকশ ঘণ্টা। তাও ভাগ্যিস আগামীকাল তার শ্বশুর-শাশুড়ি আর কনা ঢাকায় আসছে। সময়টা হয়তো এবার তাদের সঙ্গে আনন্দে কাটবে।
ছোট ছোট পা ফেলে নাজ চলে গেল ছাদে। বিল্ডিংয়ের কয়েকটা ফ্ল্যাটের মহিলারা দায়িত্ব নিয়ে সুন্দর করে ছাদটা সাজিয়েছেন। এক কোণে বিভিন্ন দেশি ফুলের গাছ আরেক কোণে চৌবাচ্চায় মাছের চাষ। উত্তর থেকে বয়ে আসা দমকা হাওয়ায় নাজের চুলগুলো ওড়াউড়ি খেলে। সবমিলিয়ে অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা মিশে আছে জায়গাটায়। এখানে সময় কাটাতে নাজের বেশ লাগে।
তবে সমস্যা একটাই। বিল্ডিংয়ের লিফট সাততলা পর্যন্তই। আর ছাদটা নয় তলায়। দুই তলা সিড়ি বেয়ে উঠতে হয়। এই সময়ে একা একা ছাদে আসতে সায়েমের কঠিন নিষেধ রয়েছে। তবুও সেই নিষেধ অমান্য করে নাজ চলে এলো।
পাশের বাড়ির মেয়ে ছন্দা ছাদে কাপড় মেলছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।
নাজকে দেখতেই আন্তরিক গলায় বলে উঠলো, “আপু কেমন আছেন?”
নাজ স্বভাবসুলভ হেসে বলল, “এইতো চলছে। তোমার কী অবস্থা?”
“আমার অবস্থা ভালোই। বাবু কেমন আছে?”
“বাবুও ভালো আছে।”
“সেদিন ভাইয়াকে দেখলাম বাবুর জন্যে একগাদা খেলনা নিয়ে আসছে। আমার দেখে কী যে ভালো লাগলো!”
“সে তো ওর রোজকার পাগলামি।”
“এটাই তো ভালো আপু! আমি তো চাই যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে, সেও আমার জন্যে পাগল হয়ে থাকবে। বাবা-মা বলেও দিয়েছি, আমার জন্যে একটা পাগল ছেলে খুঁজতে।”
“আঙ্কেল-আন্টি তোমার জন্যে ছেলে খুঁজছেন না-কি?”
“ওই আরকি…”
ছন্দা কথাটা আর শেষ করতে পারলো না। তার আগেই কানে ভেসে এলো মেঘের গর্জন। কী ভয়ঙ্কর সেই গর্জন, নাজের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠার উপক্রম হলো।
ছন্দা আকাশ পানে এক নজর তাকিয়ে বলল, “বৃষ্টি নামবে না-কি আপু?”
নাজ অনিশ্চিত গলায় বলল, “তাই তো মনে হচ্ছে। চলো ফিরে যাই। এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও যদি মাথায় পড়ে, তাহলে আমার খবর আছে।”
ঘরে ফিরে আসতেই আরেকদফা মাথাটা ঘুরে উঠলো নাজের। আজ সকাল থেকে তার সঙ্গে এসব কী হচ্ছে? ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে দরজাটা বন্ধ করলো। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু কষ্টটা কোথায় হচ্ছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। সকালে সায়েম যখন ডাক্তারকে ফোন করতে চেয়েছিল, তখন নিষেধ করা উচিত হয়নি। উফ! নিজের ভুলগুলো কেন যে মানুষ এত দেরিতে ধরতে পারে? এখন কী করবে নাজ? সায়েমকে ফোন করবে? না-কি একা একা হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করবে? কিন্তু সেটা তো অসম্ভব! যে মানুষটার সামান্য কয়েক পা হাঁটতেই প্রাণপণ কষ্ট হচ্ছে, সে আবার একা একা হাসপাতালে যাবে কী করে?
নাজ বসার ঘর থেকে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। অমনি কী জানি কী হলো, নাজ ধপাস করে বসে পড়লো মেঝে। বেশ অনেকটা সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেঝের দিকেই। তার মস্তিষ্ক ওই কয়েক মুহূর্তের জন্যে কোনপ্রকার ভাবনা-চিন্তা করার মতো অবস্থায় রইল না।
জাপানিজদের মুখের আদলটা এমন – এক নজর দেখলে বোঝা যায় না কখন তারা খুশি হচ্ছে আর কখন অখুশি। এদের ভেতরে ভেতরে কী চলছে বুঝতে হলে প্রায় কয়েক মিনিট চেহারার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু এভাবে কারও মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাটা নিতান্তই অভদ্রতা। তার ওপরে আবার যে জাপানিজ কোম্পানিতে এতগুলো টাকা ইনভেস্ট করবে, তাদের সঙ্গে তো একটু বেশিই অভদ্রতা।
জাপানিজ ক্লাইন্টদের সঙ্গে গত দু ঘন্টা ধরে মিটিং চলছে। সায়েমদের কোম্পানিতে তারা বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অন্তত চেহারা দেখে তো একেবারেই না। মাল্টিমিডিয়া স্ক্রিনে কয়েকটা প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশনের ভেসে উঠতেই রাগে থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো সায়েম। সকালে নিজের ল্যাপটপে যে প্রেজেন্টেশন সে দেখেছিল হুবহু সেটাই প্রদর্শিত হচ্ছে স্ক্রিনে। কোথাও করা হয়নি কোনো সংশোধন।
হঠাৎ করে চলন্ত মিটিংয়ে কোনপ্রকার অনুমতি না নিয়েই ব্যস্ত ভঙ্গিতে মিটিং রুমে প্রবেশ করলো সায়েমের সেক্রেটারি রিয়াজুল। আরেকদফা রাগের প্রবল স্রোত বয়ে গেল সায়েমের শিরদাঁড়া বয়ে। এসবের কোনো মানে হয়? একজন প্রেজেন্টেশনের নামে বাচ্চাদের ম্যাগাজিন তৈরি করেছে, আরেকজন বিনা অনুমতিতে ঘরে চলে আসছে। আর এই ডিলটা তারা পাক কিংবা না পাক, এদের একটা কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
রিয়াজুল সায়েমের কাছে এসে নিচু স্বরে বলল, “স্যার একটা ইমারজেন্সি আছে।”
সায়েম তার ভ্রুযুগল সামান্য কুঁচকে বলল, “কী?”
রিয়াজুল একেবারে ফিসফিস করে বলল, “ভাবি ফোন করেছিল। আপনাকে ফোনে পাচ্ছে না, ইমারজেন্সিটা তারই।”
সায়েম ব্যস্ত ভঙ্গিতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো গত দশ মিনিটে নাজের কাছ থেকে ষোলোটা মিসড কল। সায়েমের ফোনটা সাইলেন্ট থাকায় খেয়াল করে ওঠেনি। কী সাংঘাতিক! মেয়েটার আবার কী হলো?
সায়েম ভদ্রভাবে সকলের উদ্দেশ্যে বলল, “ইউ গাইজ কন্টিনিউ, আই উইল বি রাইট ব্যাক।”
মিটিং রুমের সঙ্গেই একটা বিশাল বারান্দা রয়েছে। সেখানে গিয়েই চিন্তিত ভঙ্গিতে নাজের নম্বর ডায়াল করলো সায়েম। একটা রিং বাজতেই অপরপ্রান্ত থেকে ফোনটা রিসিভ করলো নাজ।
সায়েম উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “নাজ? ঠিক আছো তুমি?”
ওপরপ্রান্ত থেকে কোনো কথা শোনা গেল না। শোনা গেল কেবল টেনে টেনে নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দ।
সায়েম চিন্তিত গলায় বলল, “নাজ? তুমি কাঁদছো?”
এবার নাজের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। মেয়েটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “তুমি বাসায় এসো, এক্ষনি এসো।”
তার এই কণ্ঠস্বর যেন সায়েমের বুকে গিয়ে কাঁটার মত বিধলো। নাজকে এমন বিপর্যস্ত শোনাচ্ছে কেন? ঠিক আছে তো মেয়েটা?
“নাজ? কী হয়েছে?”
নাজ যন্ত্রের মতো বলল, “তুমি বাসায় এসো।”
“ঠিক আছে, কিন্তু কী হয়ে…”
সায়েমকে থামিয়ে দিয়ে নাজ অসহায় গলায় বলল, “প্লিজ!”
আরও একবার সায়েমের বুকটা ধক করে উঠলো। নাজকে যতদূর চেনে, সে তো ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে নয়। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি শক্ত হাতে সামাল দেওয়া মেয়ে নাজ। তবে আজ এমন কী হলো? এভাবে ভেঙে পড়েছে কেন নাজ?
কীসের মিটিং, কীসের ডিল আর কীসের ভদ্রতা রক্ষা? সায়েম বারান্দা থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেল নিচতলায়, গ্যারেজে নিজের গাড়ির কাছে। অধিক স্পিডে গাড়ি চালালে এখান থেকে বাড়ি ফিরতে খুব একটা সময় লাগার কথা না। মাঝখানে কেবল জ্যামে না পড়লেই হলো।
আচ্ছা নাজের কী শরীর খারাপ করেছে? নির্ঘাত তাই। সকাল বেলায়ও সায়েম থেকে এসেছিল মেয়েটা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। বিরাট ভুল হয়ে গেছে, নাজকে ওই অবস্থায় একা ফেলে আসা উচিত হয়নি। এসব সাত-পাঁচ ভাবনার মাঝে গাড়ি কখন যে একটা দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেল, সায়েম নিজেই বুঝতে পারলো না। গাড়ির সামনের দিকটা নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হোক গিয়ে! দ্রুত বেগে বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই আপাতত সায়েম বাঁচে।
অল্প সময়ের মধ্যেই বাড়িতে পৌঁছে গেল সায়েম। কয়েকবার কলিংবেল চাপলো, অথচ ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। নাজ কোথায়? বাড়ির বাইরে গেছে না-কি ভেতরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। একসঙ্গে কতগুলো চিন্তা যে তার মাথায় আসছে তার কোনোই হিসাব নেই। ভেতর থেকে দরজা খোলার অপেক্ষায় থাকলে দেরি হয়ে যাবে। সায়েমের কাছেও দরজার একটা চাবি আছে। সেটা দিয়েই দ্রুততার সঙ্গে দরজাটা খুলে ফেলল।
ওই তো! নাজকে দেখা যাচ্ছে। বসার ঘর আর ডাইনিং টেবিলের মাঝামাঝি মেঝেতে বসে আছে। কী আশ্চর্য! মেয়েটার কী কমন সেন্স নেই? এভাবে মেঝেতে বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে তো!
সায়েম ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল নাজের দিকে। হঠাৎই, তার ব্যস্ত পা দুটো কিছুক্ষণের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। একটু আগ পর্যন্তও যে মস্তিকে চলছিল হাজার চিন্তার আনাগোনা, সেই মস্তিষ্ক আর কিছু ভাববার পর্যায়ে রইল না। সায়েম বারবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পেরে উঠছে না। নির্বাক ভঙ্গিতে চোখে প্রবল বিস্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইল নাজের দিকে।
অবশেষে এক পা দু পা করে এগিয়ে গেল তার দিকে। এক স্রোত রক্তের মধ্যে বসে আছে নাজ। রক্তে চুপসে গিয়ে তার হলুদ রঙের কামিজটাও লাল বর্ণ ধারণ করেছে। নাজের চোখদুটো বয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুর সঙ্গে মিশে কাজল লেপ্টে গেছে চোখের আশপাশটায়।
সায়েম হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো নাজের সামনে। বারবার বিশ্বাস করতে চাইছে, এসব কিছুই তার চোখের সামনে ঘটছে না। সবকিছুই তার কল্পনা, একটু পরেই এই দুঃসহ কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে যাবে তারা।
সায়েমের চোখদুটো সরাসরি গিয়ে পড়লো নাজের চোখের ওপরে। চোখদুটোর মধ্যে যে কী তীব্র এক ব্যাথা খেলে বেড়াচ্ছে, তা হয়তো কেবল সায়েমই বুঝতে পারবে।
নাজ থেমে থেমে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “সব শেষ হয়ে গেল সায়েম।”
সায়েম আর দেরি না করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নাজকে। তার চোখভর্তি জল চলে এসেছে। যে করেই হোক সেই জল নাজকে দেখানো যাবে না। মেয়েটা আরও কয়েক হাজারগুণ বেশি ভেঙে পড়বে।
(চলবে)