অপেক্ষারা পর্ব -৫৯

#অপেক্ষারা
৫৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে ওসি হানিফ সাহেব বললেন, “আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?”

বিরক্তির ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল সায়েমের সমস্ত শরীরজুড়ে। দুশ্চিন্তায় তার চঞ্চল হৃদয়টা অস্বাভাবিক গতিতে ধড়ফড় করছে। মাথার পেছনের দিকটাতেও সূক্ষ্ম ধরনের একটা ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। একটু পর পর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। নির্ঘাত ব্লাড প্রেসারও বেড়েছে। বিপদ যখন আসে, চারিদিক থেকে তড়িৎ গতিতে ছুটে আসে।

এত বিপদের ভীড়ে নতুন করে বিপদের দূত হয়ে এসেছেন ওসি সাহেব। সেই তখন থেকে অবান্তর সব প্রশ্ন আর সস্তা আলাপ করে সময়ের অপচয় করে যাচ্ছেন। সায়েম উঁচু গলায় ধমকও দিতে পারছে না, রেগেমেগে এখান থেকে চলেও যেতে পারছে না।

অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে সায়েম শুকনো গলায় বলল, “ভালো।”

“কতোটা ভালো?”

সায়েম ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “বৈবাহিক সম্পর্ক কতোটা ভালো বা কতোটা খারাপ তা পরিমাপ করার কোনো স্কেল নেই তো। থাকলে আপনাকে মেপে বলতাম।”

ওসি হানিফ সরলভাবে হেসে বললেন, “এটা ভালো বলেছেন ভাই। তেমন কোনো স্কেল থাকলে আমাদের অর্ধেক কাজই তো কমে যেত। কী বলো শরীফ?”

ওসি সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শরীফ নামক এসআই তার সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, “একদম স্যার।”

হানিফ সাহেব বিজ্ঞের মতো বলতে শুরু করলেন, “আরে বাবা দুনিয়ার সব সমস্যা শুরু হয় এই বিয়ে থেকে। বিয়ের আসর থেকে কনে পালিয়ে যাওয়া, বিয়ের পর স্বামীর মারধর, ডিভোর্স! না জানি কত কী। এই বিয়ে করেই লোকে একটা না একটা ঝামেলা বাঁধায়, আর রাতের ঘুম হারাম করে এখানে বসে থাকতে হয় আমাদের। কী বলো শরীফ?”

“একটা জিনিস বাদ গেছে স্যার।”

“তাই? কোনটা বলতো?”

“পরকীয়া।”

হানিফ সাহেব হতবাক হয়ে বললেন, “আরে তাই তো! এত ইম্পর্ট্যান্ট একটা বিষয় বাদ পড়লো কী করে? ভালো কথা, সায়েম সাহেব! আপনার স্ত্রীর আবার অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্ক নেই তো?”

সায়েম এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। ভেতরে জমে থাকা সকল ক্রোধগুলোর প্রকাশস্বরূপ হুংকার দিয়ে বলল, “ওয়াট রাবিশ!”

ওসি হানিফ শান্ত গলায় বললেন, “কিছু মনে করবেন না ভাই। আপনারা ভদ্র সমাজের ভদ্র মানুষ। কিন্তু বাকিরা তো আপনাদের মতো না। স্বামী স্ত্রীর মিসিং কমপ্লেইন ফাইল করেছে, পরে দেখা গেছে স্ত্রী অন্য একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে। কম করে হলেও এমন পঞ্চাশটা কেস আমি নিজের হাতে হ্যান্ডেল করেছি।”

সায়েম বহুকষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল, “আমরা কী কাজের কথায় আসতে পারি?”

“অবশ্যই, অবশ্যই! আরে আপনাদেরকে সেবা দেওয়ার জন্যেই তো বসে আছি। কী যেন বললেন, আপনার স্ত্রী ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী?”

“জি।”

“তা উনি আজ সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন কেন? ঝগড়াঝাঁটি করেছিলেন না-কি?”

“না। ঝগড়া করবো কেন?”

“করতেই তো পারেন। মেয়েদের এক বদভ্যাস হলো কথায় কথায় স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যাওয়া। ভালো কথা, উনার বাপের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছেন?”

“ওর বাপের বাড়ি ময়মনসিংহে। আমি তো আপনাকে সবটাই বললাম। আমার চেনাজানা কোনো জায়গায় ও যাবে না। ও এমন কোথাও যাবে যে জায়গাটা আমি চিনি না।”

ওসি সাহেব কী যেন ভেবে বিজ্ঞ গলায় বললেন, “আমার মনে হয় কী এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। মন খারাপ করে বাড়ি থেকে চলে গেছে, দুদিন পর ফিরেও আসবে। হয়তো কোনো বান্ধবীর-টান্ধবীর বাড়িতে লুকিয়ে আছে। এই বান্ধবীগুলোই হলো যতসব কুবুদ্ধির দাতা। আপনি ভালোমত খোঁজ না নিয়েই চলে এসেছেন পুলিশের কাছে।”

সায়েম প্রতিবাদের সুরে বলল, “কিন্তু আমি ওর সব বান্ধবীদের ফোন করেছি। কোথাও যায়নি।”

“আরে ভাই ফোনে কোনো কাজ হয় না-কি? অন দ্যা স্পট গিয়ে প্রমাণ চাইতে হয়। বান্ধবীরা তাকে লুকিয়ে রাখার জন্যে মিথ্যাও তো বলতে পারে।”

সায়েম থমথমে গলায় বলল,“আপনি আমার কথাগুলোকে সিরিয়াসলি নেওয়ার চেষ্টা করুন। আমার ওয়াইফ অনেক অসুস্থ, ওর মানসিক অবস্থাও ভালো না। সে কোথায় গেছে নিজেও জানে না।”

“তার মানে আপনার ভাষ্য একটা চিঠি লিখে দিয়ে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে চলে গেছেন তাইতো?”

সায়েম চুপ করে রইলো। দ্বিতীয়দফায় বিরক্তির ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল তার ওপর দিয়ে।

ওসি হানিফ বললেন, “ঠিক আছে, নিলাম আপনার কথাগুলোকে সিরিয়াসলি। এবার আপনিও আমার কথাটা সিরিয়াসলি নিন। আপনার স্ত্রী চেনাজানা কারও বাড়িতেই লুকিয়ে আছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে শরীফকে বলি, কাগজ কলম আনুক। আমি সই করে লিখে দিচ্ছি, সে কারও বাড়িতেই লুকিয়ে আছে।”

ওসি সাহেব আরও কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি একজন ব্যস্ত ভঙ্গিতে তার কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আসালামালাইকুম।”

ওসি সাহেব অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বললেন, “ওয়ালাইকুমআসসালাম। আপনি?”

“আমি আশফাক, সায়েমের বন্ধু।”

“ও আচ্ছা বসুন।”

হানিফ সাহেব লক্ষ করলেন তার ফোনটা বেজে উঠেছে। স্ক্রিনের ওপর ভেসে ওঠা নামটা পড়তেই তিনি এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনারা একটু বসুন, আমি কথা বলে আসছি।”

আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে ওসি সাহেব ফোন নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

সায়েম বিরক্ত ভঙ্গিতে নিচু গলায় বলল, “এত দেরি করলি কেন?”

আশফাক অনুতপ্ত স্বরে বলল, “সরি দোস্ত, একটা জরুরি ফোন সারতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।”

সায়েম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোকে বারবার বলে দিলাম ইমারজেন্সি, তাড়াতাড়ি আয়! আর তুই পড়ে ছিলি তোর ফোন নিয়ে? কী এমন জরুরি ফোন?”

“একটু ওয়েট কর, এক্ষুনি টের পাবি।”

“মানে?”

দুজনের কথার মাঝেই পুনরায় ঘটলো ওসি সাহেবের আগমন। তবে এবার আর তার কণ্ঠস্বরে আগের মতো তাচ্ছিল্যের ভাবটা নেই।

আন্তরিকতায় বিগলিত হয়ে তিনি বললেন, “আরে কী আশ্চর্য! আপনারা যে ডিআইজি স্যারের এত কাছের মানুষ, আগে বলবেন না?”

সায়েম ভ্রুযুগল সামান্য কুঁচকে বলল, “ডিআইজি?”

আশফাক নিচু গলায় বলল, “আমার মামী। তার সঙ্গেই জরুরি ফোন সারছিলাম।”

“আরে একটাবার বললেই তো হতো, আমি কি তাহলে এতগুলো সময় নষ্ট করি?”

সায়েম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে আপনি আমার জিডি নিচ্ছেন?”

“নিচ্ছি মানে? জিডি তো অলরেডি হয়ে গেছে। আর দেরি করা যাবে না, এক্ষুনি কাজে নেমে পড়তে হবে। চলুন আপনদের বাড়িটা একবার ঘুরে আসি।”

আশফাক জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে সায়েমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “তুই গাড়ি এনেছিস?”

সায়েম গম্ভীরভাবে বলল, “হুঁ।”

“ওসি সাহেব, সায়েমের গাড়িটা আপনাদের গ্যারেজেই থাকুক? আসলে আমি বাইক এনেছি তো, আমার বাইকে করেই আমরা চলে যাবো।”

“নিশ্চয়ই! আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে? আপনারা অ্যাড্রেসটা দিয়ে যান, আধ ঘন্টার মধ্যে আমরা চলে যাবো।”

ঢাকার ব্যস্ত সড়কে ছুটে চলছে আশফাকের বাইক। গন্তব্য সায়েমদের বাড়ি। এই ব্যস্ত নগরীতে প্রতিটা মানুষেরই তো রয়েছে নিজ নিজ গন্তব্য। এতগুলো মানুষের ভিড়ে নাজকে কোথায় খুঁজবে তারা?

সায়েম হঠাৎ কী যেন ভেবে বলল, “তোর মামীকে বিরক্ত করার কী দরকার ছিল?”

আশফাক বাইক চালাতে চালাতেই বলল, “না হলে এই ওসি কাজটাকে সিরিয়ালি নিতো? শোন সায়েম, দুনিয়ার সকলকে আমার চেনা আছে বুঝলি? মিসিং রিপোর্টের ফাইল দিনের পর দিন এদের টেবিলের কোণায় পড়ে থাকে, অথচ এরা একবার খুলেও দেখে না। ওপর থেকে একটু চাপ না পেলে পৃথিবীর কেউই উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে চায় না।”

সামনের লুকিং গ্লাস থেকে আশফাক লক্ষ করলো সায়েম অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছে। এতক্ষণ ধরে বলা কথাগুলো নিশ্চয়ই সায়েম শোনেনি। তার মস্তিকে কেবল একটা চিন্তারই বিচরণ, কোথায় খুঁজে পাবে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে।

“সায়েম?”

“হুঁ?”

“একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না।”

“কোন ব্যাপার?”

“ভাবিকে যতদূর চিনি, সে তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। জেদের বশে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ তো সে নয়।”

সায়েম ক্লান্ত গলায় বলল, “জেদ না আশফাক। নাজ এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। শি ইস হাইলি ডিপ্রেসড। একজন স্বাভাবিক মানুষের চিন্তাধারা আর একজন ডিপ্রেসড চিন্তাধারা কখনো এক রেখায় চলে না।”

“ডিপ্রেশন? তুই তো ছিলি পাশে, বোঝাতে পারলি না?”

সায়েম ব্যর্থ গলায় বলল, “হয়তো না। আমি ওকে বলেছিলাম, যা হবার আমরা একসাথে ফেস করবো। বিশ্বাস করলো না আমাকে। আমার প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে জানিস? মেয়েটা একা একা রাস্তা পর্যন্ত পার হতে পারে না, সিঁড়ি বেয়ে নামতে গেলেই হোঁচট খায়। না জানি একা একা কী করছে!”

আশফাক আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “চিন্তা করিস না দোস্ত। পুলিশের সাহায্য তো আছে আমাদের সাথে। দেখিস, ঘণ্টাখানেকের
মধ্যে ঠিকই খুঁজে পাবো ভাবিকে।”

ধানমন্ডি এলাকার নয়তলা বিশিষ্ট অভিজাত ভবন ‘রংধনু অ্যাপার্টমেন্টস’। বেজমেন্টে বিশাল গ্যারেজ, দুটো চকচকে লিফট, পার্টি এরিয়া, অডিটোরিয়াম – কোনো কিছুর অভাব নেই এখানে। মেইন গেট দিয়ে ঢুকতে বাম পাশেই ছোট্ট একটা কামরা। কামরার দেয়ালে একটা জানালা রয়েছে। জানালা দিয়ে কামরার ভেতর থেকে মেইন গেটটা দেখা যায়। মূলত এখানেই সিকিউরিটি গার্ড বসে বসে দেখে বাড়িতে কে আসছে-যাচ্ছে।

ওসি হানিফ প্রথমেই জেরা করলেন সিকিউরিটি গার্ড কালামকে। স্বল্প শিক্ষিত মানুষদের কাছে পুলিশ মানেই এক মহা আতঙ্কের নাম। পুলিশ জেরা করতে এসেছে এর অর্থ নির্ঘাত তাকে ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে থানায়। সে কোনো দোষ করে থাকুক, কিংবা নয়। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাবেই। কালাম বেচারাও তাই ভেবে ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। ঘেমে-টেমে একাকার অবস্থা তার।

ওসি হানিফ হালকা গলায় বললেন, “এত বড় একটা বাড়ি, অথচ মাত্র একজন পাহারাদার? ঘটনা কী?”

কালাম ইতস্তত করে বলল, “স্যার দিনের বেলা আমি ডিউটি করি, আর রাত্রে করে
আরেকজন।”

“ও আচ্ছা। তাহলে নিশ্চয়ই তোমার নাজনীন ম্যাডামকে বাড়ি থেকে বের হতে দেখেছো?”

“জি স্যার। ম্যাডাম তো সেই ভোর বেলা তাড়াহুড়া কইরা বাইর হইয়া গেলেন।”

ওসি হানিফ ঘুরে ঘুরে কী যেন খুঁজে আবারও ফিরে এসে বললেন, “এখানে সিসি ক্যামেরা আছে না?”

“জি স্যার, আছে তো।”

“সকালের ফুটেজটা বের করো তো!”

ভোর পাঁচটা আটান্ন। সিসিটিভি ফুটেজে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কালো সালোয়ার কামিজ পরিহিতা একটি মেয়ে ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে ব্যস্ত পায়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে।

হানিফ সাহেব সায়েমকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, “এটাই তো আপনার স্ত্রী, তাই না?”

প্রশ্নটা সম্ভব পৌঁছালো না সায়েমের কর্ণকুহরে। তার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে সিসিটিভি ফুটেজের দিকে। নাজের হাঁটার ভঙ্গি স্বাভাবিক নয়। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কোনো এক প্রবল ঘোরে আচ্ছন্ন মেয়েটা। নাজ তো সেই ভোর বেলা বেরিয়েছে। এখন বাজে কাঁটায় কাঁটায় বারোটা। প্রায় ছয় ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। কোথায় গেছে মেয়েটা? ঠিক আছে তো সে? পরিচিত কোথাও গেলে দুশ্চিন্তায় তেমন কারণ নেই। তবে সায়েম নিশ্চিত, পরিচিত কোথাও নাজ যায়নি। নিজেকে লুকিয়ে রাখা তার উদ্দেশ্য নয়। নাজের উদ্দেশ্য নিজেকে কষ্ট দেওয়া।

হানিফ সাহেব সন্দেহের ভঙ্গিতে কালামকে বললেন, “একটা মানুষ সকাল সকালে বেরিয়ে গেল অথচ তুমি কিছুই জিজ্ঞেস করলে না?”

কলাম তো তো করে বলল, “আমার কোনো দোষ নাই স্যার। আগে সবাইরে জিগতাইম, কই যান, কখন আইবেন। পরে ফ্ল্যাট মালিকরা মিটিং কইরা কইল, আমি এইসব জিগাইলে তারার ডিস্টাব হয়। এহন আর জিগাই না।”

“ও কি সত্যি বলছে সায়েম সাহেব?”

সায়েম বিরক্ত গলায় বলল, “জানি না। এসব মিটিংয়ে কখনোই আমার যাওয়া হয়নি।”

ওসি হানিফ সরু গলায় বললেন, “অন্য সময়ে জিজ্ঞেস করা আর ভোর ছয়টায় জিজ্ঞেস করা তো এক কথা নয়। বিশেষ করে, যখন সে সচরার ওই সময়ে বের হয় না।”

ভয়ে কালামের হাত-পা থরথর করে কেঁপে উঠলো। ব্যাপারটা লক্ষ করে এসআই শরীফ শান্ত গলায় বললেন, “স্যার, আমার মনে হয় কী এই ছেলেটা জিজ্ঞেস করলেও মিসেস নাজনীন বলতেন না তিনি কোথায় যাচ্ছেন।”

“আরে তাই তো! তাহলে আমি এই গাধার সাথে কথা বলছি কেন? এই শরীফ, ফুটেজটা আরেকবার ভালো করে দেখো তো। কোনদিকে গেছে বোঝা যায় কি-না।”

শরীফ মনোযোগ দিয়ে আরও একবার ফুটেজটা দেখে অভিজ্ঞ গলায় বললেন, “মেইন রোডের দিকে স্যার।”

“শিওর তুমি?”

“জি স্যার।”

ওসি সাহেব নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “এখান থেকে মেইন রোড পর্যন্ত যতগুলো সিসিটিভি আছে সবগুলোর ফুটেজ আমার লাগবে। সময় সকাল ছয়টা থেকে সাতটা। পারবে না?”

“পারবো স্যার।”

“কতক্ষণ লাগতে পারে?”

“সর্বোচ্চ ঘন্টাখানেক।”

“ভেরি গুড। ফুটেজগুলো কালেন্ট করে আমাকে জানাও। আর সায়েম সাহেব, আপনি তখন বলছিলেন বছরে বেশ কয়েকবার আপনারা গ্রামের বাড়িতে যান। প্রতিবার নিশ্চয়ই একই বাস স্টেশন থেকে টিকিট কাটেন।”

“হ্যাঁ, মোহাম্মদপুর বাস স্টেশন থেকে।”

হানিফ সাহেব কিছু একটা বলতে যাবেন তখনই শরীফ চমকে উঠে বললেন, “স্যার মেইন রোড ধরে গেলেই তো মোহাম্মদপুর বাস স্টেশন!”

“তাই না-কি? তাহলে সায়েম সাহেব চলুন ওখান থেকে একটু ঢু মেরে আসি। বলা তো যায় না, হয়তো আপনার স্ত্রী আচমকা ঠিক করলেন তিনি গ্রামের বাড়িতে যাবেন। শরীফ?”

“জি স্যার?”

“তুমি ততক্ষণে সিসিটিভি ফুটেজগুলো জোগাড় করো, আমি ফিরে এসে দেখবো। ভালো কথা, সায়েম সাহেব আপনার স্ত্রী তো তার ফোনটা বাড়িতেই রেখে গেছে তাই না?”

সায়েম বলল, “হ্যাঁ।”

“ফোনটা আমার লাগবে। যদি পরিচিত কারোর বাড়িতে গিয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই আগের দিন যোগাযোগ করবেন।”

সায়েম আশফাকে নিয়ে ওপরে উঠে এলো। বাড়িতেই তো নাজের ফোনটা। সদর দরজা খোলাই ছিল। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই সায়েম দেখতে পেল তার মা-বাবা চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন বসার ঘরে। কনা অযথা পায়চারি করছে গোটা বাড়িজুরে।

সায়েম দেখেই হাসনা বেগম এক লাফে উঠে এলেন তার কাছে।

উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “সায়েম? বৌমাকে পেলি?”

মায়ের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নটা একপ্রকার তাচ্ছিল্য করেই সায়েম পা বাড়ালো শোবার ঘরের দিকে।

হাসনা বেগম তার পিছু নিয়ে বললেন, “কী হলো কথা বলছিস না কেন? পেয়েছিস বৌমার কোনো খোঁজ।”

সায়েম সাইড টেবিল থেকে নাজের ফোন হাতে নিয়ে থমথমে গলায় বলল, “না।”

“কী সাংঘাতিক মেয়ে রে বাবা। একে তো আমাদের এত বড় একটা সর্বনাশ করলো তার ওপরে আবার পালিয়ে বেড়ানো হচ্ছে। ভেবেছে কী নিজেকে? অপয়া মেয়ে একটা!”

সায়েম কড়া গলায় বলল, “মা প্লিজ! সেই অপারেশন দিন থেকে মেয়েটাকে হেও করে কথা বলছো। এবার অন্তত ক্ষান্ত হও।”

হাসনা বেগম হতবাক গলায় বললেন, “তুই বউয়ের হয়ে ওকালতি করছিস?”

সায়েম নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ করছি। কাউকে না কাউকে তো ওর সাইডে থাকতে হবে।”

“কেন? থাকতে হবে কেন? ছি ছি, ভদ্র বাড়ির বৌ এভাবে বাড়ি ছেড়ে পালায়? কোনোদিন দেখেছিস না শুনেছিস এমন কথা? তার ওপরে আবার তুই পুলিশ ডেকে সবাইকে জানিয়ে বেরাচ্ছিস। লোকে কী বলবে?”

সায়েম কঠিন গলায় বলল, “আমার না কিছুই যায় আসে না মা। তোমার ওই সো কলড লোকেদের খুব ভালো করে চেনা আছে আমার। এরা সুখের দিনে পাশে থাকবে, সাফল্যে বাহবা দেবে কিন্তু জীবনে একটু ব্যাথর্তা এলেই এরা মুখ ফিরিয়ে নেয়।”

হাসনা বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আশফাক শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “সায়েম চল, ওসি সাহেব অপেক্ষা করছেন তো।”

মোহাম্মদপুর বাস স্টেশনে প্রতিদিন হাজারো মানুষের আনাগোনা। প্রতিটা মানুষ ছুটে চলছে নিজে গন্তব্যের দিকে। কেউ বা কাজের স্বার্থে, আর কেউ প্রিয়জনের মুখে ফুটে ওঠা প্রচ্ছন্ন হাসিটা দেখার লোভে। এত এত ব্যস্ততা, এতগুলো ব্যস্ত মানুষ – সকলের মুখের আদল মনে রাখা কষ্টকর। তবুও স্টেশনের ম্যানেজার এক দেখাই চিনে ফেললেন সায়েমকে। না চেনার কারণও অবশ্য নেই। অনেকগুলো বছর ধরে তাদের বাসে করেই তো সায়েমের ময়মনসিংহে যাতায়াত।

ওসি সাহেব নাজের খোঁজ করতেই ম্যানেজার বিনয়ী গলায় বলল, “ম্যাডাম আসছিল তো। আজকে খুব সকাল সকাল। আমি তো অবাক, এই সকালে…”

ম্যানেজারকে থামিয়ে দিয়ে ওসি হানিফ ধমকের সুরে বললেন, “খেজুরে আলাপ বন্ধ করো। তোমার খেজুরে আলাপ শোনার সময় আমাদের নেই। যা জিজ্ঞেস করবো তার ঠিক ঠিক উত্তর দাও।”

“জি স্যার।”

“উনি কি কোনো বাসের টিকিট কেটেছিলেন?”

“জি স্যার। ম্যাডাম সকাল সাতটার ঢাকা টু ময়মনসিংহ বাসের একটা টিকিট কাটছিলেন।”

হানিফ সাহেব সায়েমের দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি হেসে বললেন, “কী বলেছিলাম না? আমার কথা তো বিশ্বাস করলেন না!”

ওসি সাহেবের বিজয়ীর হাসি মোটেও বিগলিত করতে সক্ষম হলো না সায়েমকে। নাজ সকালের বাসে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে, ব্যাপারটা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। সায়েমের চোখেমুখে প্রগাঢ় চিন্তার ছাপ এখনো বিদ্যমান।

ম্যানেজার চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “কিন্তু স্যার!”

“আবার কিন্তু কী? বাসের নম্বর বের করো, এতক্ষণে তো পৌঁছে যাওয়ার কথা তাই না?”

“স্যার, ম্যাডাম তো বাসে উঠেন নাই।”

ওসি সাহেব হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, “মানে?

“উনি টিকিট কাটছেন, কতক্ষণ বাসের জন্যে ওয়েটও করছেন। কিন্তু শেষমেশ আর বাসে উঠেন নাই।”

বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন ওসি সাহেব। এতক্ষণ তার কাছে এই কেসটা সাধারণ কোনো মিসিং কেস বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে এই কেসের জটিলতা অনেক বেশি।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here