#অপেক্ষারা
৬২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“তুই বাসায় চলে যা আশফাক।” ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল সায়েম।
আশফাক তার ভ্রুযুগল সামান্য কুঁচকে বলল, “আর তুই?”
সায়েম হতাশভঙ্গিতে বলল, “সারাদিন যা করেছি তাই করবো। খুঁজে বেড়াবো নাজকে।”
“আর আমি তোকে একা ফেলে রেখে চলে যাবো? এমনটা ভাবলি কী করে তুই?”
“সারাটাদিন তো আমার সাথে দৌড়ঝাঁপ করলি, তুই নিশ্চয়ই অনেক টায়ার্ড।”
“তাতে কী হয়েছে? একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আর আমি টায়ার্ড হয়ে বাড়ি ফিরে যাবো?”
সায়েম কিছুই বলল না। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো আশফাকের দিকে।
আশফাক হঠাৎ কী যেন ভেবে বলল, “খালাম্মা ফোন করেছিল একটু আগে, তুই না-কি তার ফোন ধরছিস না?”
সায়েম গম্ভীর গলায় বলল, “ইচ্ছা করেনি। ফোন ধরলেই তো সেই এক কথা। অনেক রাত হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরে আয়, আর খুঁজে কাজ নেই। এসব শুনতে ইচ্ছা করছিল না। তোকে কী বলল?”
“এগুলোই বলল। বলল তোকে যেন বুঝিয়ে বলি।”
“বুঝিয়ে বলছিস না কেন তাহলে?”
“বোঝালে বুঝবি তুই? তাছাড়া আমার মনে হয় না এই সময়টা ঘরে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার। যত রাতই হয়ে যাক, আমাদের ভাবিকে খুঁজে বের করতে হবে। একা একটা মানুষের জন্যে এই শহরটা সেফ নয়, বিশেষ করে রাতের বেলায় তো মোটেই না।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সায়েম বলল, “কোথাও খুঁজবো আমি নাজকে? কোথাও তো খুঁজতে বাদ রাখিনি। ওর বান্ধবীদের বাসা, ওর প্রিয় শপিং মল, বাসস্ট্যান্ড, হসপিটাল সবগুলো জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। আমার মাথা কাজ করছে না আশফাক।”
“একটা মানুষ তো আর উধাও হয়ে যেতে পারে না। আমার বিশ্বাস ভাবি ঢাকাতেই আছে। ঢাকার বাইরে কোথাও যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সায়েম শোন, এবার আমাদেরকে বুদ্ধি খাটিয়ে খুঁজতে হবে।”
“মানে?”
“তুই একটু মনে করে দেখ তো, এমন কোনো জায়গা আছে কিনা যেখানে সে খুব বেশি একটা যায়নি তবে জায়গাটা তার আছে বিশেষ।”
সায়েম খানিকক্ষণ ভেবে বলল, “এমন কোনো জায়গা আছে বলে মনে হয় না।”
“ভালো করে মনে কর দেখ। এমন কোনো জায়গা যেখানে তুই তাকে নিয়ে গিয়েছিলি।”
আচমকা তড়িৎ গতিতে কী যেন একটা খেলে গেল সায়েমের মস্তিষ্কে। মনে পড়ে গেল সবুজঘেরা নির্জন জায়গাটার কথা। তাদের ভালোবাসাময় দিনগুলোর সূচনাতেই ওই জায়গায়ই তো নিয়ে গিয়েছিল নাজকে। সেবার এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পাওয়ায় গ্রামের বাড়িতে নাজের জন্যে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষ বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরেই সেদিন সায়েম তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিল তার প্রিয় জায়গাগুলোতে। সবুজঘেরা ওই জায়গাটা তার মধ্যে একটি। কী ভয়ঙ্কর উচ্ছ্বাসে ঘাসের ওপরে ছুটে বেরিয়েছিল মেয়েটা। এরপর আরও দুয়েকবার নাজকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিল সায়েম। আচ্ছা, মেয়েটা ওখানে গিয়ে লুকিয়ে নেই তো?
ঠিকানাটা আশফাকে বলে তড়িঘড়ি করে বাইকে উঠে বসলো সায়েম। আশফাক বাইকে স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে তার হৃদস্পন্দনের গতিবিধিও। শহরের আনাচে-কানাচে চেনা-অচেনা এমন কোনো জায়গা বাদ নেই যেখানে মেয়েটাকে খোঁজেনি তারা। এই জায়গাটাই শেষ ভরসা। নাজকে এখানে থাকতেই হবে।
সবুজে ঘেরা বিস্তীর্ণ মাঠের বুক চিরে চলে গেছে পাকা রাস্তা। সেই রাস্তার ওপরেই এসে থামলো বাইক। দুপাশে এত এত সবুজের সমারোহ, অথচ আলোর অভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলো ছেয়ে থাকলেও তাতে পূরণ হয় না মানুষের চোখের তৃষ্ণা। সায়েম পকেট থেকে ফোনটা বের করলো ফ্ল্যাশলাইট অন করবে বলে। বিপদ যখন আসে, চারিদিক থেকে আসে – এই সত্যতার প্রমাণ আরও একবার এসে দাঁড়ালো তার মুখোমুখি। তার ফোনের ব্যাটারি লো, লো ব্যাটারিতে ফ্ল্যাশলাইট অন করা যায় না।
একরাশ রাগ আর বিরক্তির কালো ছায়ায় ছেয়ে গেল সায়েমের অন্তরাত্মা। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আশফাক তার ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে বাড়িয়ে দিলো সায়েমের দিকে। সেই কটমটে আলো হাতে নিয়ে সায়েম নেমে পড়লো মাঠে।
মাঠের দুপ্রান্তে ছোট ছোট কতগুলো বেঞ্চ। সায়েম বারবার চাইছে সেই বেঞ্চগুলোর কোনো একটায় বসে থাকবে এক ছায়ামূর্তির।
ছায়ামূর্তির কাছে গিয়েই সায়েম বিস্মিত গলায় বলবে, “নাজ! তুমি এখানে? আর আমি সারা শহরে তোমাকে খুঁজে বেরালাম।”
মানুষ কল্পনায় যা দেখে, তার দেখা বাস্তবে হয়তো মেলে না। তাই তো সায়েমকে আরও একবার হতাশ করে দিয়ে, মাঠের সবগুলো বেঞ্চ ফাঁকা। বড় বড় গাছের আড়ালেও কেউ লুকিয়ে নেই, ঘাসের ওপর বসে একদৃষ্টিতে আকাশের দিকেও কেউ চেয়ে নেই। নাজ নেই, এখানেও নেই। এটা কি করে সম্ভব? শুধুমাত্র সময়ের ব্যবধানে একটা মানুষ নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে?
হতাশা আর ব্যর্থতায় ধপাস করে মাটিতে বসে পড়লো সায়েম। তার নিঃশ্বাস ক্রমেই ঘন হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে যেন চারিদিকে শুধুই অন্ধকার। নাজ কি পারে না, এই কালো আঁধারে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াতে? বায়ুশূন্য ঘরে মানুষ দমবন্ধ হয়ে মরে যায়। শরীরের বেঁচে থাকার জন্যে বাতাস প্রয়োজন, আর মনের বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজন মাথার ওপরে প্রিয় মানুষটার ছায়াটুকু।
ভালোবাসার মানুষ আর তার ওপরে জন্মে ওঠা আস্থাই তো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। বাড়ি ফিরে নাজের হাসিমাখা মুখটায় হয় সায়েমের ক্লান্তির অবসান। পৃথিবীতে মহাপ্রলয় এসে গেলেও, সবগুলো মানুষ তাকে ছেড়ে চলে গেলেও, সায়েমের বিশ্বাস নাজ আজীবন শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখবে তাকে। নাজের প্রতি এই ছোট ছোট বিশ্বাসগুলোই তো তার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।
আর নাজ? নাজ কি একবারও পারলো না, তার ওপরে ভরসা করতে? এই কঠিন সময়ে কেউ নাজের পাশে না থাকলেও, সায়েম যে ঠিক আগের মতোই থাকবে বুঝতে পারলো না মেয়েটা?
আচমকা বেজে উঠলো সায়েমের ফোনের রিংটোন। এই রিংটোনের তীক্ষ্ণ শব্দটা ভীষণ অসহ্য লাগছে। বলতে গেলে পৃথিবীর কোনোকিছুই এই মুহূর্তে সহ্য হচ্ছে না তার। তবুও পকেট থেকে ফোনটা বের করলো সায়েম। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে ওসি হানিফের নাম। আর এক মুহূর্তও অপচয় না করে, সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করলো।
সায়েম কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওসি সাহেব উত্তেজিত গলায় বললেন, “সায়েম সাহেব! আপনার স্ত্রী তো ডেঞ্জারাস!”
সায়েম একরাশ বিস্ময় নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “মানে?”
“ধানমন্ডি থেকে পায়ে হেঁটে মিরপুরে চলে গেছে। ভাবা যায়? তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো এতদূর চলে এসেছেন কেন, তখন বলে জানি না।”
সায়েম প্রবল উত্তেজনায় খাবি খেয়ে বলল, “আপনারা কি ওকে খুঁজে পেয়েছেন?”
ওসি সাহেব অবাক হয়ে বললেন, “ওহ! আসল কথাটাই বলতে ভুলে গেছি! আমি তো বাসার কাছাকাছিই চলে এসেছিলাম, হঠাৎ মিরপুর এলাকার টহল পুলিশ ফোন করে বলল আমরা যে মেয়েটাকে খুঁজছি সে না-কি একটা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছি, আপনারাও চলে আসুন। আপনার স্ত্রীকে নিয়ে ওরাও প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে।”
আবারও হৃদস্পন্দন কয়েকগুণ বেড়ে গেল সায়েমের। তার তো এখন আনন্দে আত্নহারা হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কথা। কিছুই তা পারছে না সায়েম। অবশেষে পাওয়া গেল নাজকে? না-কি এবারও থানায় গিয়ে দেখবে ব্যাপারটা পুরোটাই ভ্রান্তি? পুলিশ অন্য কাউকে নাজ ভেবে নিয়ে এসেছে।
অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়ে গেলে মনের মাঝে বিচিত্র এক অস্থিরতা কাজ করে। মস্তিষ্ক চিন্তাভাবনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সায়েমের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে রইল সায়েম। তার যেন এখন কী করার কথা? ও আচ্ছা, পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার কথা।
আশফাক ঝড়ের গতিতে বাইক চালিয়ে পৌঁছে গেল ধানমন্ডি থানার সামনে। থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুলিশের জিপ। এই জিপে করেই কি নাজকে আনা হয়েছে? সায়েম উদভ্রান্তের দৃষ্টিতে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো জিপের ভেতরটা। নাহ্! ভেতরে কেউ নেই।
তড়িঘড়ি করে দুজনেই পৌঁছে গেল থানার ভেতরে। ওসি হানিফের কেবিন পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন পড়লো না। মেইন গেট দিয়ে ঢুকতেই সায়েম লক্ষ করলো কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন তিনি। সায়েমের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন ওসি সাহেবকে? তার মানে কি সে যা ভেবেছিল তাই? নাজকে কি তাহলে পাওয়া যায়নি?
ওসি সাহেব সায়েম এবং আশফাকে দেখেই বলে উঠলেন, “এতক্ষণে এলেন আপনারা?”
তিনি আরও কিছু বলতে যাবেন তার আগেই সায়েম উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “নাজকে কি সত্যি সত্যিই পাওয়া গেছে?”
ওসি সাহেব স্বভাবসুলভ হেসে বললেন, “মিথ্যামিথ্যি কাউকে পাওয়া যায় না-কি? আমার কেবিনে বসে আছেন, তাড়াতাড়ি যান।”
আশফাক শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “তুই যা, আমি তোর গাড়িটা বের করছি।”
কারোর কথার কোনপ্রকার উত্তর না গিয়ে সায়েম উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে পা বাড়ালো ওসি সাহেবের কেবিনের দিকে।
আশফাক হঠাৎ বাঁধা দিয়ে বলল, “কী রে? চাবিটা দিয়ে যা!”
সায়েম পকেট থেকে গাড়ির চাবিটা বের করে আশফাকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল তার বহুল প্রতীক্ষিত গন্তব্যে।
অধিকাংশ ঘরেই চারটি দেয়াল থাকে, তবে ওসি হানিফের কেবিনের দেয়াল তিনটি। একপাশটা কাঁচ দ্বারা আবৃত। সেই কাঁচের দেয়ালের সঙ্গেই ঘরের প্রবেশপথ। কেবিনে ঢোকার আগেই স্বচ্ছ কাঁচের ওই দেয়াল ভেদ করে দেখতে পেল চেয়ারে ক্লান্তভঙ্গিতে বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার দিকে।
কেবিনে না ঢুকে কয়েকমুহূর্ত দরজার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে রইল সায়েম। আজ সকাল থেকেই যতবার সে নিঃশ্বাস নিয়েছে প্রতিবারই মনে হয়েছে ফুসফুসের বড় একটা অংশ ফাঁকা রয়ে গেছে। আশেপাশে যাই দেখেছে তাতে চোখের সম্যক তৃপ্তি হয়নি। নিমিষেই সেসব অনুভূতি দূরে পালিয়ে গেল। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে সায়েম। ওই তো! তার নিঃশ্বাস নিতে পারার কারণটা ওখানেই বসে আছে, ঠিক তার চোখের সামনে।
দুয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো সায়েমের দুচোখ বেয়ে। যন্ত্রণা অশ্রুগুলোর থেকে আনন্দের অশ্রুর তীব্রতা ঢের বেশি। একটু একটু করে সায়েম এগিয়ে গেল তার ভালোবাসার মানুষটার দিকে। নাজের দৃষ্টি এখনো আঁটকে আছে মেঝের দিকে। মেয়েটা সায়েমের উপস্থিতি টের পাচ্ছে, তবে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। কিংবা হয়তো চোখ তুলে তাকানোর সাহস করে উঠতে পারছে না।
সায়েম ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো মেঝেতে, নাজের ঠিক সামনে। নাজের হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। মেয়েটা কি ভয় পাচ্ছে? কীসের ভয় তার?
সায়েম আলতো স্পর্শে একটা হাত রাখলো নাজের গালে। আকস্মিক এই স্পর্শে যেন আরও একটু কেঁপে উঠলো। সায়েম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাজের দিকে। কী আছে এই মেয়েটার মাঝে? কেন তার অনুপস্থিতি পাগল করে দেয় সায়েমকে? সায়েম জানে না, জানতে চায়ও না। ভালোবাসার মানুষটা ঠিক তার সম্মুখে, এর থেকে বেশি চাওয়ার আর কী বা হতে পারে?
হঠাৎই নাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সায়েম। দেহে যেন প্রাণ ফিরে পেলো আবারও। এই বিশাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্যে মানুষের খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না। ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকলে মনে হয় যেন শত বছর বেঁচে থাকার কঠিন কিছু নয়।
সায়েম হঠাৎ একরাশ অভিমানমিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলো, “এই মেয়ে! কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি? কী পাও আমাকে এত কষ্ট দিয়ে?”
নাজ কিছুই বলল না। হয়তো বলার সাহস করে উঠতে পারলো না। তার দুচোখ বেয়ে দুয়েক ফোঁটা অশ্রু টুপটাপ করে গড়িয়ে পড়লো। অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়লো সায়েমের চোখদুটোও। একটা মানুষের উপস্থিতি যে আমাদের জীবনে কতোটা জরুরি, আমরা তা বুঝতে পারি তার অনুস্পস্থিতিতে।
কিছুটা সময় পর নাজেকে নিয়ে ওসি সাহেবের কেবিনের বাইরে চলে এলো সায়েম। নাজের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। কোনোভাবেই যে এই বাঁধন ছাড়িয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে না পারে মেয়েটা।
তাদের দেখেই ওসি সাহেব উৎফুল্ল গলায় বললেন, “সায়েম সাহেব! দেখলেন ঠিকই খুঁজে বের করলাম উনাকে। এখন সোজা বাসায় নিয়ে যাবেন, উনার এখন রেস্ট দরকার। সারাদিন হাঁটাহাঁটি করেছেন।”
সায়েম শুকনো গলায় বলল, “জি।”
ওসি সাহেব এবার নাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি বরং গিয়ে গাড়িতে বসুন। সায়েম সাহেবের সঙ্গে দুয়েকটা কথা বলে তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
মনে মনে আঁতকে উঠলো সায়েম। কোনো অবস্থাতেই নাজকে একা ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। একা একা গাড়ির কাছে যাবে, এই সুযোগে যদি আবারও পালিয়ে যায়। আর একবার মেয়েটাকে হারিয়ে সেই দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারবে না সায়েম।
সায়েম তৎক্ষণাৎ বলল, “গাড়িতে গিয়ে বসতে হবে না, ও এখানেই থাকুক। আপনি কী বলবেন বলুন।”
ওসি হানিফ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, “বেশ বেশ! শুনুন সায়েম সাহেব যে একবার ঘর থেকে পালাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়, সে কিন্তু দ্বিতীয়বার আবারও চেষ্টা করে। আপনার স্ত্রীকে চোখে চোখে রাখবেন। প্রয়োজন হলে বাড়ির মেইন গেটে বিশাল একটা তালা ঝুলিয়ে চাবিটা লুকিয়ে রাখবেন।”
“থ্যাংক ইউ, আপনাদের সকলকে থ্যাংক ইউ। আপনারা না থাকলে এত তাড়াতাড়ি ওকে খুঁজে পেতাম না।”
ওসি সাহেব স্বভাবসুলভ হেসে বললেন, “কী যে বলেন! এটাই তো আমাদের দায়িত্ব। আপনাদের সেবা করার জন্যেই তো রাতের ঘুম হারাম করে বসে আছি, কী বলো শরীফ?”
ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে নাজ। সায়েম বাইরে আশফাকের সঙ্গে কথা বলছে। নাজের চোখদুটোতে একরাশ ঘুমেরা এসে ভর করেছে। ক্লান্তির সুপ্ত হওয়া বয়ে যাচ্ছে দেহমনজুড়ে। ক্লান্তি যে শুধু শরীরের হয় তা নয়, অফুরন্ত মানসিক যন্ত্রণার পর মনটাও ক্লান্তিতে ছেয়ে যায়।
নাজের পা দুটো ব্যথায় টনটন করছে। অপারেশনের পর ডাক্তার বেশি হাঁটাহাঁটি করতে নিষেধ করেছেন। সেই নিষেধ অমান্য করেই আজ দিনভর হেঁটে বেরিয়েছে নাজ, কোনো এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সে তো চেয়েছিল যত দূর সম্ভব ঠিক ততটা দূরে পালিয়ে যেতে। লুকিয়ে পড়তে কোনো অদৃশ্য চাদরের আড়ালে। নাজ চেয়েছিল হারিয়ে গিয়ে সায়েমের কষ্টগুলোকে নিমিষেই দূর করে দিতে। কিন্তু মানুষটা ঠিকই খুঁজে ফেলল তাকে? আবারও শক্ত করে আটকে ফেলল তার বাহুডোরে?
রাত একটা, ব্যস্ত শহরটা পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে গেছে। যে সড়কটা দিনের বেলায় যানজটে পরিপূর্ণ থাকে, এখন তা একেবারেই ফাঁকা। দুয়েকটা বড় বড় ট্রাক ছাড়া রাস্তায় আপাতত কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আসফাকে বিদায় জানিয়ে সায়েম এসে বসলো ড্রাইভিং সিটে। তার চোখেমুখে একরাশ গাম্ভীর্য। গম্ভীর ভঙ্গিতেই স্টার্ট দিলো গাড়িতে। নাজের দিকে একটাবার তাকাচ্ছেও না তার সঙ্গে কোনপ্রকার কথাও বলছে।
অভিমান অনুভূতিটা বড়ই অদ্ভুত। এই অনুভূতি যেকোনো মানুষের ওপরে জন্মাতে পারে না। জন্মায় শুধু ভালোবাসার মানুষটার ওপর। নাজ বারবার চেষ্টা করছে কিছু একটা বলে নীরবতা ভঙ্গ করতে, কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না।
কলিংবেল চাপতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো কনা। নাজকে দেখতেই আঁতকে উঠে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “নাজ! কোথায় চলে গিয়েছিলি তুই? জানিস, তোর জন্যে আমরা কত টেনশন করছিলাম। ভাইয়া? কোথায় পেলে নাজকে?”
সায়েম ক্লান্ত স্বরে বলল, “থাক না এসব কথা। মা-বাবা কোথায়?”
“ঘুমিয়ে পড়েছে। এতক্ষণ আমার সঙ্গে জেগেই ছিল, আমি জোর করে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
কনা এবার নাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই ঠিক আছিস তো নাজ?”
নাজ ধীর গতিতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
সায়েম বলল, “তুইও গিয়ে ঘুমিয়ে পড় কনা, রাত তো কম হলো না।”
শোবার ঘরে বিছানার ওপরে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বসে আছে নাজ। কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
সায়েম হঠাৎ তার কাছে এসে বলল, “এভাবে বসে আছো কেন? যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।”
এতক্ষণ চোখ তুলে সায়েমের দিকে তাকানোর সাহস করে উঠতে পারছিল না নাজ। অবশেষে মনের মাঝে একটু একটু সাহস জমিয়ে তাকালো সায়েমের দিকে। ছেলেটার ওই চোখদুটোতে রাগ, অভিমান, ক্লান্তি না জানি কতশত অনুভূতিরা খেলে বেড়াচ্ছে। তবুও, সকল অনুভূতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাটাকে খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হলো না নাজের।
সারাদিনের ধকল শেষে গোসল না করে পারলো না নাজ। যদিও এই মাঝরাতে গোসল করলে জ্বরে গা কেঁপে উঠবে, উঠুক! গোসল সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে যাবে, তখনি সায়েম এলো প্লেটভর্তি খাবার নিয়ে। নাজকে নিজ হাতে খাইয়ে দেবে বলে। একে তো সারাদিনের ক্লান্তি তার ওপরে আবার প্রচন্ড ক্ষুধা, নাজ বিনা বাক্য ব্যয়ে বাধ্য মেয়ের মতো খেতে শুরু করলো।
খেতে খেতে হঠাৎ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নাজ বলল, “শোনো…”
নাজকে থামিয়ে দিয়ে সায়েম থমথমে গলায় বলল, “শুনতে হবে না, চুপ করে খাও তো।”
আর কিছুই বলল না নাজ। বাকিটা সময় চুপচাপ খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষে সায়েম প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে সবগুলো ওষুধ খাইয়ে দিলো নাজকে। নাজকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো তার পাশে।
ডিম লাইটের আলোয় নাজ পরিষ্কার দেখতে পেলো সায়েমের মুখটা। কপালের ওপর একটা হাত রেখে চোখ বুজে শুয়ে আছে ছেলেটা। নাজ কী যে মনে করে তার একটা কম্পিত হাত রাখলো সায়েমের চুলের ওপরে। ভেবেছিল, ছেলেটা হয়তো রেগে গিয়ে ধমক দেবে তাকে। কিন্তু সায়েম সেসব কিছুই করলো না। ঠিক আগের ভঙ্গিতেই চোখ বুজে শুয়ে রইল।
নাজ হঠাৎ অস্পষ্ট গলায় বলে উঠলো, “সারাদিন কিছু খাওনি, না?”
সায়েম চোখদুটো বন্ধ রেখেই বলল, “উহুঁ।”
“কিছু খেয়ে নাও। অসুস্থ হয়ে পড়বে তো!”
“তুমি শুধু শরীরের অসুখটাই দেখা, মনের অসুখ তো তোমার চোখেই পড়ে না।”
“মনের অসুখ?”
সায়েম এবার চোখদুটো মেলে নাজের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, “জানো নাজ, আমি কখনো হারতে শিখিনি। ব্যর্থতা যে কতটা ভয়ঙ্কর আমি জানতামই না। আজ জানলাম।”
নাজ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কীসের ব্যর্থতা সায়েম?”
সায়েম অভিমানের স্বরে বলল, “তোমাকে বোঝাতে না পারার ব্যর্থতা। এতদিনেও তোমাকে বোঝাতে পারলাম না, কতোটা ভালোবাসি। বোঝাতে পারলাম না, তুমি আশেপাশে না থাকলে আমার ঘড়ির কাঁটা থেমে থাকে, চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে। আমার পৃথিবীতে কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই, শুধু তোমাকে প্রয়োজন। তুমি কি কোনদিনও বুঝবে না নাজ? চিরকাল বাচ্চাই থেকে যাবে?”
কথাগুলোতে নাজের চোখদুটো ভরে গেল অবাধ্য অশ্রুগুলো দ্বারা। কান্নাজড়ানো গলায় নাজ বলল, “বুঝি তো!”
“খুব বোঝো তাই না? বোঝো বলেই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে!”
“আমি তোমার কষ্ট বাড়াতে চাইনি তাই…”
“আজকের এই দিনটায় আমাকে সবথেকে বেশি কষ্ট দিয়েছ তুমি।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে নাজ অন্যরকম গলায় বলল, “তোমার কি ইচ্ছা করে না, ফুটফুটে একটা বাবু তোমার ঘরজুড়ে ছুটে বেড়াক, তোমাকে বাবা বলে ডাকুক।”
“করে তো।”
“শুধুমাত্র আমার জন্যে তোমার সেই ইচ্ছা কখনো পূরণ হবে না। কী দরকার আমার আঁকড়ে ধরে রাখার?”
সায়েম দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “একটা ইচ্ছা পূরণ না হলে মানুষ মরে যায় না। কিন্তু বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে গেলে সে বাঁচে কী করে?”
নাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। মানুষটাকে যতবারই দেখে, নতুন করে ভালোবাসতে শেখে। আজ সারাদিন ধরে মনে হয়েছিল এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো কারণ তার অবশিষ্ট নেই। তবে এখন মনে হচ্ছে, কেবল এই মানুষটার জন্যেই তো বেঁচে থাকা যায় লক্ষ লক্ষ যুগ। নাজ বারবার কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
সায়েম শান্ত গলায় বলল, “থাক আর কথা বলতে হবে না। আমার কাছে আসো তো! সারাদিন প্রচুর জ্বালিয়েছো, এবার তো শান্তিতে ঘুমাই!”
সায়েম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো নাজকে। যেন হাতের বাঁধন একটু আলগা হলেই কোথাও পালিয়ে যাবে মেয়েটা।
(চলবে)#অপেক্ষারা
৬৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
জীবনটাকে স্বাভাবিকতার ছন্দে ফিরতে লেগে গেল আরও ছয়টি মাস। পূর্ণতা-অপূর্ণতা মিলেই তো জীবন। সে কারও জন্যে থেমে থাকে না। আপন গতিতে ছুটতে ছুটতে একদিন হুট করেই থেমে যায়। তবে মানুষ যতদিন বাঁচে, তাকে নিজ থেকে বেঁচে থাকতে হয়। লড়াই করে যেতে হয় অপূর্ণতাগুলোর বিরুদ্ধে। জীবনে আফসোস থাকে, থাকে ব্যথর্তা, হারানোর যন্ত্রণা কিংবা না পাওয়ার আক্ষেপ। এগুলো কাঁধে নিয়েই তো সামনে এগিয়ে যেতে হয়।
হাজার কষ্ট হলেও বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে নাজ। ছোট্ট এই জীবনে সবাই সবটা পায় না, কোনো কোনো আকাঙ্ক্ষা দিনশেষে অপূর্ণই রয়ে যায়। নাজের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল ছোট্ট একটা দেবশিশু ছুটে বেড়াবে তার ঘরজুড়ে, মা ডেকে বারবার তার কোলে উঠতে চাইবে। এই ইচ্ছাটা তো আর কোনদিন পূরণ হবার নয়। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সত্যটাকে মেনেই নিয়েছে নাজ।
জীবনে যতটুকু পেয়েছে তাই তো অনেক। কে জানে কোন পূণ্যবলে সায়েমকে পেয়েছিল জীবনে। ঝড়-তুফান এসে জীবনটাকে লন্ডভন্ড করে চলে গেলেও, ওই মানুষটার ভালোবাসা আজও সেই প্রথম দিনের মতোই সজীব। মাঝে মাঝে নাজ প্রশ্ন করে নিজেকে, এতটা ভালোবাসা কি আসলেই তার প্রাপ্য? সে জানে না, জানতে চায়ও না। দীর্ঘশ্বাসে ঘেরা জীবনে তার একমাত্র শান্তির নিঃশ্বাস সায়েম।
একটা স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলেই হয়তো নাজ ব্যস্ত হয়ে ছুটছে আরেকটা স্বপ্ন পূরণের পথে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে তার স্বপ্ন উদ্যোক্তা হবে। কারও অধীনে চাকরি না করে নিজেই হবে নিজের বস। নিজের জন্যে কর্মসংস্থান তো তৈরি করবেই, সেই সঙ্গে তৈরি করবে অসহায়-কর্মহীন মানুষদের কর্মসংস্থান।
বেশ কয়েবছর আগে তাদের গ্রামে কয়েকজন দুস্থ এবং বিধবা নারীরা একত্রিত হয়ে শুরু করেছিলেন আমের আচারের ব্যবসা। তবে ব্যবসা কেবল শুরু করলেই হয় না, তাকে দক্ষতা আর বুদ্ধি দিয়ে টিকিয়েও রাখতে হয়। গ্রাম্য ওই নারীদের মাঝে কিছু একটা করে দেখানোর স্বপ্ন থাকলেও ছিল না দক্ষতা আর বুদ্ধি। তাই অল্প কয়েকদিনেই তাদের ব্যবসাটা বন্ধ হয়ে যায়।
তাদের মরে যাওয়া স্বপ্নটাকে আবারও বাঁচিয়ে তুললো নাজ। ‘নকশি আচার’ – তাদের স্বপ্নের নতুন গন্তব্যস্থল। ময়মনসিংহের সেসব অসহায় নারীদের কাছ থেকে আচার কিনে আনে নাজ। এরপর সেগুলোকে আধুনিক বোতলজাতকরণ এবং আকষর্ণীয় মোড়ক দ্বারা সুসজ্জিত করা হয়। সবশেষে নকশি আচারের ওয়েবসাইট কিংবা ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সেই আচার পৌঁছে যায় শহরের আনাচে-কানাচে।
প্রথম প্রথম বোতলজাতকরণ এবং মোড়ক লাগানোর কাজটা নাজ বাসায় নিজের হাতেই করতো। তবে আজকাল এত বেশি অর্ডার আসছে যে বেচারি একা পেরে ওঠে না। বাসায় ঝুট-ঝামেলা এড়াতে কাছেই একটা ওয়্যারহাউস ভাড়া নিয়েছে। ঢাকায় তার কর্মচারী সংখ্যা আপাতত এগারোজন। একজন সপ্তাহে দুদিন ময়মনসিংহে গিয়ে আচার নিয়ে আসে। তিনজন ওয়্যারহাউসে মোড়ক লাগানোর কাজ করে। আর বাকিরা ডেলিভারিম্যান। তবে ব্যবসার পরিধি দিন দিন যে হারে বাড়ছে, তাতে মনে হয় না এই কজন কর্মচারীরা সামলে নিতে পারবে।
পেইজ কিংবা ওয়েবসাইটে অর্ডার নেওয়া, সময়মতো ডেলিভারি হয়েছে কিনা নিশ্চিত করা – এসব কাজ একা হাতে করে নাজ। অবশ্য একা হাতে বললে ভুল হবে, তাকে সাহায্য করে তুষি। এই ব্যাবসায় তারও শেয়ার আছে।
এই ব্যবসাটা নাজের দুঃখ আর শোকগুলো ভুলিয়ে রেখেছে। নিজের প্রতি এখন আর তার ঘৃণা হয় না, নিজেকে দোষী বলেও মনে হয় না। সায়েম ঠিকই তো বলে, প্রকৃতি চায় না তাই তাদের সন্তান আসবে না। এতে নাজের দোষ কী? অপরাধবোধ কেটে গিয়ে নিজের প্রতি গর্ব হয় আজ নাজের।
কেবল তার জন্যে ওই অসহায় নারীরা আজ আর অসহায় নয়। তারাও নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছে, নিজের উপার্জনে দিনযাপন করতে পারছে, কারও ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না।
প্রায় দশ মিনিট যাবত সায়েমের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে নাজের ওয়্যারহাউসের সামনে। সায়েম ভ্রু কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকালো। এতটা সময় পার হয়ে গেল অথচ মেয়েটার আসার কোনো নাম নেই। এখনো সেই বাচ্চাই রয়ে গেল, সময়ের জ্ঞান যেন কোনোদিন হবে না।
হঠাৎই সায়েমের সাত-পাঁচ ভাবনায় ছেদ ফেলে নাজ বেরিয়ে এল ওয়্যারহাউসের দরজা পার করে। আনমনেই সায়েমের চোখদুটো আটকে গেল তার দিকে। পরনে ধবধবে সাদা সালোয়ার কামিজ, রূপার কানের দুল, খোলা চুল আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ। মাঝে মাঝে এই মেয়েটাকে মনে হয় বাস্তবের কেউ বলে মনেই হয় না, মনে হয় পুরোটাই তার কল্পনা। কিন্তু আবার পরমুহূর্তেই মনে হয়, মানুষ তো কল্পনাতেও এতটা নিখুঁত চিত্র দেখতে পায় না।
নাজ এসে বসলো ড্রাইভিং সিটে পাশে। তার চোখে মুখে একরাশ উচ্ছ্বাস খেলে বেড়াচ্ছে।
উৎফুল্ল গলায় নাজ বলল, “সরি! দেরি করে ফেললাম তাই না?”
কথাটা সম্ভবত পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো সায়েমের কর্ণকুহরে। তার নেশালো দৃষ্টিতে এখনো আবদ্ধ হয়ে আছে নাজের ওপরে।
নাজ আবারও বলল, “এই! কী হলো তোমার?”
সায়েম সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “কী? কিছু বললে?”
“বললাম সরি, দেরি হয়ে গেল।”
সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “ইটস ওকে।”
নাজ উচ্ছ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, “জানো! আজ সকাল থেকে এই পর্যন্ত একত্রিশটা অর্ডার এসেছে। এতগুলো অর্ডার কালকের মধ্যে সবার কাছে পৌঁছে কীভাবে ভেবে ভেবে, সবাই তো পাগল হয়ে যাচ্ছে।”
সায়েম মুগ্ধ গলায় বলল, “আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ নাজ।”
নাজ তার মোহনীয় হাসিটা সায়েমের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ।”
সায়েম গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে বলল, “তো? কী করলে আজ সারাদিন?”
নাজ হঠাৎ আঁতকে উঠে বলল, “এই দাঁড়াও! এখনি স্টার্ট দিও না।”
সায়েম অবাক গলায় বলল, “কেন?”
নাজ তার হ্যান্ডব্যাগের চেইন খুলতে খুলতে বলল, “এই কয় মাসে তো প্রফিটের টাকা কিছুই নিজের কাছে রাখিনি, সব বিজনেস দিয়েছে। কিন্তু এ মাসে বিজনেস দেওয়ার পরেও বেশ কিছু টাকা রয়ে গেল। অনেককে দেখেছি প্রথম ইনকাম দিয়ে প্রিয় মানুষকে উপহার দিতে, ভাবলাম আমিও দিই। আজ সকাল সকাল তুষির সঙ্গে শপিং মলে চলে গিয়ে তোমার জন্যে এই ছোট্ট উপহারটা কিনে ফেললাম। দেখো তো পছন্দ হয়েছে কিনা?”
মুখে ছোট্ট উপহার বললেও নাজের হাতে বড়সর একটা বক্স। সায়েম বিস্ময়ের সঙ্গে বক্সটা খুলে দেখলো, ভেতরে একটা হাতঘড়ি! কালো ডায়ালে গাঢ় নীল বেল্টের এই চমৎকার ঘড়িটার দিকে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েম।
নাজ জিজ্ঞেস করলো, “পছন্দ হয়েছে?”
সায়েম মুগ্ধ গলায় বলল, “অনেক পছন্দ হয়েছে। তুমি নিজে পছন্দ করে কিনেছ?”
নাজ চোখেমুখে বিচিত্র এক দুষ্টুমি ফুটিয়ে তুলে বলল, “আর কে পছন্দ করবে তাহলে?”
সায়েম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাজের দিকে। এই তো, কিছুদিন আগেও মেয়েটা ছিল নিতান্ত বাচ্চা। জিনিসপত্র হুটহাট হাত থেকে ফেলে দেওয়া, আচমকা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। সেই বাচ্চা মেয়েটা হুট করে এত বড় হয়ে গেল কী করে? এখন আবার তাকে উপহারও দিচ্ছে। সময়ের আসলেই অনেক ক্ষমতা। নিজের সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক সকল কিছুকে বদলে দেয়।
সায়েমের হাত থেকে পুরনো ঘড়িটা খুলে, নাজ নতুন ঘড়িটা পড়িয়ে দিতে দিতে বলল, “এখন থেকে এটা পড়বে আর সবসময় আমার কথা মনে করবে।”
সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “তোমার কি মনে হয়? সবসময় আমি তোমার কথা মনে করি না?”
কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল নাজ। মানুষটা মাঝে মাঝে এমনভাবে কথা বলে, লজ্জা না পেয়ে উপায় থাকে না।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নাজকে সহজ করতে সায়েম বলল, “কোথাও ঘুরতে যাবে, না-কি বাসায়?”
“বাসায়। আজ বাংলাদেশের খেলা হচ্ছে, ভুলে গেছো?”
সত্যিই খেলা ব্যাপারটা সায়েমের মাথাতেই ছিল না। মিরপুরে স্টেডিয়ামে চলছে বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ডের খেলা। বাংলাদেশ মাঠে খেলছে অথচ নাজ টিভির সামনে বসে নেই এমন দৃশ্য বিরল। তবে তারা বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রথম ইনিংস শেষ হয়ে গেছে।
সায়েম ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে নাজ রান্নাঘরে কী যেন করছে।
সায়েম জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলল, “কত করেছে বাংলাদেশ?”
নাজ হতাশ গলায় বলল, “দুইশ ছেচল্লিশ।”
“সর্বনাশ! আজকেও নির্ঘাত হারবে।”
“এত নেগেটিভ চিন্তা করছো কেন? জিততেও তো পারে।”
সায়েম আক্ষেপের স্বরে বলল, “কী করে জিতবে? ইংল্যান্ডের মতো স্ট্রং টিমের কাছে এটা কোনো টার্গেট হলো? তিনশ রান টার্গেট দিলেও তো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতো।”
নাজ মিটিমিটি হেসে বলল, “উফ সায়েম! মাঠে ওরা খেলছে আর এখানে দুশ্চিন্তা করে প্রেসার বাড়াচ্ছে তুমি। এত বেশি চিন্তা কোরো না তো, কফিটা নিয়ে যাও আমি আসছি।”
সায়েম বাধ্য ছেলের মতো তাদের দুজনের কফির কাপ নিয়ে বসলো টিভির সামনে। খেলায় আপাতত পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বিরতি। এই সময়টুকু কীভাবে কাটাবে ভাবতে ভাবতে রিমোটে চ্যানেল ঘোরাচ্ছে সায়েম। হঠাৎ এসে থামলো একটা নিউজ চ্যানেলে। চিরকাল এই নিউজ চ্যানেল থেকে নিজেকে দূরেই সরিয়ে রেখেছে সায়েম। একটা সময় মনে হতো দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করা কেবল বুড়োদের কাজ। তবে আজকাল সায়েম নিজেই অংশ নিচ্ছে সেই বুড়োদের কাজে।
কিছুটা সময় পর নাজ এসে বসলো তার পাশে। নাজের হাতে বড়সর সাইজের একটা স্টিলের গামলা।
নাজ আয়েশী ভঙ্গিতে বলল, “জানো, ছোটবেলায় মাকে দেখতাম প্রতিদিন সন্ধ্যায় আয়োজন করে মুড়ি মাখছে। আলু ভাজা, পেঁয়াজ কুচি, সরিষার তেল এসব হাবিজাবি দিয়ে কী যে অদ্ভুত একটা জিনিস বানিয়ে ফেলতো। আমিও আজকে চেষ্টা করলাম।”
“কই খেয়ে দেখি তো!”
নাজ কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে বলল, “তুমি খাবে মুড়ি মাখা? বাব্বাহ! এসব গ্রাম্য খাবার তোমার পোষাবে?”
সায়েম ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি এমনভাবে কথা বলছো যেন আমি ইউরোপ-আমেরিকায় বড় হয়েছি।”
নাজ কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই টিভির স্ক্রিনে ভেসে ওঠা একটা সংবাদ প্রতিবেদন স্তব্ধ করলো তাকে। “রাজধানীর গুলিস্তান এলাকার ডাস্টবিন থেকে এলাকাবাসী উদ্ধার করে দুইদিন বয়সী এক নবজাতকে। শিশুটির পরিচয় এখনো জানা যায়নি। বর্তমানে শিশুটিকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, হাসপাতালে জন্মের পরপরই তাকে ফেলে রেখে যাওয়া হয় ডাস্টবিনে।”
কয়েক মুহূর্ত শূণ্য দৃষ্টিতে টিভিতে ফুটে ওঠা বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল নাজ। অস্বাভাবিক গতিতে বেড়ে যাচ্ছে তার হৃদস্পন্দন। পৃথিবীটা কতো বিচিত্র তাই না? একদিকে মানুষ হাহাকার করে শুধুমাত্র একটি বার সন্তানের মুখে মা কিংবা বাবা ডাক শোনার, আর অন্যদিকে কেউ কেউ সেই সুযোগ পেয়েও দূর সরিয়ে দেয় সেই সুযোগটা।
নিমিষেই প্রবল এক ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গেল নাজের সমস্ত অন্তরাত্মা। ব্যাপারটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হলো সায়েমের।
সায়েম কোমল স্বরে বলল, “নাজ?”
নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ?”
“আমার কাছে এসো।”
বিনা বাক্য ব্যয়ে চুপিসারে সায়েমের বুকে গুটিশুটি মেরে রইল নাজ। প্রিয় মানুষটার হৃদয়ের সংকোচ-প্রসারণের ধ্বনি ক্রমেই প্রশান্তির বার্তা নিয়ে আসে মানুষের মনে। নাজের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
সায়েম নাজের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল, “আমি না অনেক দিন ধরে একটা কথা ভাবছি নাজ।”
নাজ সায়েমের বুক থেকে মাথা তুলে বলল, “কী?”
সায়েম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আল্লাহ তো আমাদের কোনোকিছুর অভাব দেননি। কী সুন্দর সাজানো-গোছানো সংসার আমাদের! আমার এত বড় একটা জব, তোমার সাকসেসফুল বিজনেস, আমাদের এই চমৎকার বন্ডিং! কিন্তু, একটা আক্ষেপ রয়েই গেছে। বাবা-মা হতে না পারার আক্ষেপ। তবে কী জানো নাজ? মানুষ চাইলেই নিজের আক্ষেপগুলোকে পূর্ণতায় বদলাতে পারে।”
নাজ ব্যর্থতার ভঙ্গিতে বলল, “কীভাবে সায়েম? আমার তো…”
নাজকে থামিয়ে দিয়ে সায়েম বলল, “আমি জানি। কথাটা শেষ করতে দাও।”
নাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। তার চোখেমুখে হাজারো প্রশ্নেরা খেলে বেড়াচ্ছে।
সায়েম কয়েক মুহূর্ত মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল, “আমাদের যেমন একটা সন্তানের অভাব, তেমনি পৃথিবীতে অনেক শিশু আছে যাদের অভাব বাবা-মায়ের। আমরা যেমন ওই একটা ডাক শোনার জন্যে অস্থির হয়ে আছি, ওরা তেমনি অস্থির হয়ে আছে কাউকে ওই ডাকে ডাকার জন্যে। ওদের চাওয়া কেবল একসেপটেন্স, মাথার ওপরে একটু ভরসার আশ্রয় আর ভালোবাসার। আমরা কি পারি না, তেমন কাউকে আপন করে নিতে?”
নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “কিন্তু…”
“আবার কিন্তু কী?”
নাজ শঙ্কিত গলায় বলল, “আমাদের কি পরিবারে কেউ এটা মেনে নেবে?”
সায়েম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তুমি মানবে?”
নাজ আর্দ্র গলায় বলল, “কেন মানবো না?”
“তাহলেই সবাই মানবে।”
দীর্ঘশ্বাসগুলো নিমিষেই কেটে গিয়ে একরাশ স্বপ্ন এসে জড়ো হয়েছে নাজের চোখে। চোখদুটো ভরে গেছে আনন্দের অশ্রুতে। এতদিন ভেবে এসেছে তার হয়তো মা হওয়াটা অসম্ভব। অসম্ভব কারও মুখে ওই মধুর ডাকটা শোনার। অথচ একবারের জন্যেও সে ভাবেনি চাইলেই এই অসম্ভবটা সম্ভব করা যায়। ভেবেছে সায়েম।
সায়েম নাজের হাতের ওপর দৃঢ় স্পর্শে একটা হাত রেখে বলল, “আমাদের ওই হারিয়ে যাওয়া বাবুটা যদি পৃথিবীতে আসতো তাহলে তাকে যেভাবে ভালোবাসতে, পারবে না এই নতুন বাবুটাকে সেভাবে ভালোবাসতে?”
নাজ সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালো।
হঠাৎ কী যেন মনে করে নাজ অন্যরকম গলায় বলল, “এই! আমাকে সত্যি কেউ মা বলে ডাকবে?”
সায়েম আশ্বাস দিয়ে বলল, “সত্যিই ডাকবে।”
দিনশেষে বাংলাদেশের জয়ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে এক অচেনা সুখের আন্দোলনে মেতে উঠলো তাদের ঘর।
(চলবে)