#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_২১
#শারমিন_আক্তার_পর্ব
_______
হুট করে বর্ষা আবদার করে বসল, তার রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে সবগুলো বেলুন চাই। নিভ আহত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কতক্ষণ চাহিয়া রইল। বর্ষার ইনোসেন্ট ফেস এর দিকে। চোখ দু’টো ডেবডেবে করে গোল বানিয়ে রেখেছে ঠোঁট উল্টিয়ে রেখেছে এতে বর্ষাকে পুরো বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। মুচকি হেসে আদুরে কন্ঠে নিভ বলল,’ আচ্ছা বস আমি নিয়ে আসছি। ‘
একশো টাকা দিয়ে দশটা বেলুন কিনলো। এক পিছ দশ টাকা করে হুহহ। বেলুনগুলো বর্ষার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,’ আসতে না আসতেই একশো টাকা খেয়ে দিলি। ‘
বর্ষার নিভের পিঠে আবার কনুই দিয়ে কিল মেরে বলল,’ তোর কপাল ভালো আমি মাত্র একশো টাকা খেয়েছি। কলেজে তো একবার যা দেখিস তোর আন্ডা বাচ্চারা কত শেষ করে। ‘
বলে সশব্দে হেসে উঠল বর্ষা। অভিমানী স্বরে নিভ বলল, ‘ আমি যামুই না। ‘
বর্ষার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। বর্ষা নিভের করুণ চাহনি দেখে আরও হাসতে লাগল। বর্ষার হাসিমাখা মুখটার দিকে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে নিভ!
নিভ মায়া ভরা চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
বুকে অজস্র প্রশান্তি বয়ে যচ্ছে। ভালোবাসি তোকে, খুব বেশি ভালোবাসি। ভালোবাসি আমি তোর হাসিকে, ভালোবাসি আমি তোর মায়াবী আঁখি জোড়া কে। ভালোবাসি আমি তোকে বর্ষা।
ভালোবাসি কথাটা হয়তো বলা হয় নি কভু। সিগ্ধ অনুভূতিগুলো কখনো প্রকাশও করিনি। তুই ও কখনো বুঝিসনি, আমার মনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা খুঁজিসওনি। তুই কি এতটাই নির্বোধ? যে একটা ছেলের চোখে ভালোবাসা দেখতে পাসনি। সে তোকে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ভালোবাসে। এতবছরের যত্ন করে গড়া আমার ভালোবাসাকে তুই কি একটুও পরক্ষ করতে পারিসন
এভাবে হেলা করিস না মানতে পারি না। বুকে অসহ্য যন্ত্রনা হয়। মুখে বলি নি বিধায় শাস্তি? শাস্তিটা আমার শান্তি কেড়ে নিচ্ছে, একটু সদয় হো, একটু আমাকে বোঝার চেষ্টা কর আমার অনাকাঙ্ক্ষিত অনূভুতি টাকে গায়ে মেখে নে৷ তোর শাড়ির আঁচলে বেধে নে। ব্যাপক কষ্টে দগ্ধ হয়েছি চার মাসের প্রতিটা রাত। বুকের বা পাশে তীব্র যন্ত্রণা হতো। চোখের তৃষ্ণা আর মনের খোরাক মিটাতে বেহায়া হয়ে ছুটে এসেছি। একনজর তোকে দেখতে, তোরও কি এমন হয়েছে বল?
নিভ মনে মনে এসব বললেও মুখে বাকশূন্য টু শব্দ টাও করেনি।
বর্ষা নিভের সামনে তড়ি বাজালো। এতে নিভ বাস্তবে ফিরে এলো৷ বর্ষা প্রশ্ন সূচন ভাবে তাকিয়ে রইল,
‘ সরি সরি একটু অন্য মনস্ক হয়ে পরেছিলাম। চল, সাবধানে বস। ‘
বলে বাইকে উঠে বসল। কলেজের গেইট দিয়ে বাইক ঢুকলেই মেয়েরা ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে নিভ এর দিকে। দুই হাত উপরনিচ করে লাফাচ্ছে কলেজের চকোলেট বয় সবার ক্রাশ কলেজে আগমন করেছে।
বর্ষা আর নিভকে একসাথে আরও চারটি চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে। নিভ ও বর্ষা আপন মনে কথা বলছে ও হাসতে হাসতে সকলের সামনে চলে আসে। নিভকে দেখে মুরাদ এগিয়ে এসে বলে,’ কি অবস্থা ব্রো? অনেকদিন পর। ‘ জড়িয়ে ধরে পিঠে চাপর বসিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল।
‘ আস্তে, মরি যাই মরি যাই। ‘ ন্যাকা কন্ঠে বলল নিভ৷
তার কথা শুনে সকলে সশব্দে হেঁসে উঠল। পাশ থেকে একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ কি ব্যাপার বিধবাদের মতো সাদা শাড়ি পরে কেন আসছিস? ‘
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। শেষমেশ বিধবা অপাধি দিলো What the ফাউ কথা।
‘ ইচ্ছে হয়েছে তাই পরেছি। আর সাদা বিধবা দের রং নাহ। সাদা হচ্ছে. ‘
‘ হইছে হইছে লাগতাছে তো পেত্নীর মতো যা ফোট চোখের সামনে থেকে। দেখ ওদের দেখে শিখ ওরা কি পরে আসছে আর তুই কি পরে আসছিস অসহ্য। ‘
অভ্রর বলা কথাগুলো বর্ষার হৃদয়ে তীরের মতো আঘাত হানল। চোখের কার্নিশে জমজমাট হলো অশ্রুকণা। মুখের হাসি মূহুর্তেই মলিন হয়ে যায়। অভ্র চলে গেলে আদ্রিক এসে বর্ষার সামনে দাঁড়াল বর্ষাকে খুশি করার জন্য বলল,’ তোমাকে শুভ্র রাঙা শাড়িতে পুরো শুভ্র পরীর মতো লাগছে। বর্ষা তার হয়তো চোখ নেই সেজন্য তোমাকে যা অপূর্ব লাগছে সে অপলক করতে পারেনি। ‘
পাশ থেকে ভ্রু কুঞ্চিত করে অপূর্ব ভাইয়া বলল,’ আমাকে কিভাবে লাগছে? ‘
অপূর্ব ভাইয়ার প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আদ্রিক। আমি সহ সকলে জোরে হেসে দিলাম। আদ্রিক অস্ফুটস্বরে আমতা আমতা করে বলল,’ মানে? ঠিক বুঝলাম না। ‘
অপূর্ব ভাইয়া হেসে বলল,’ মানে আমার নাম অপূর্ব। তো আমি কিভাবে বর্ষা তে হলাম? ‘
আদ্রিক চোখ জোড়া ছোটছোট করে নেয়। অপূর্ব আদ্রিককে আর অপদস্ত করতে চায় না বলে সে বলল,’ চিল ব্রো। জাস্ট কিডিং ‘
আমার মিড কিছুটা ভালো হলো। তবে দূর দূরান্তে অভ্র ভাইয়াকে কোথাও দেখতে পেলাম না। সে জেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
এদিকে বারবার আমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে আদ্রিক আর নিভ এত প্রশংসা করার কি আছে আল্লাহ জানে। সকলেই অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হয়েছি শুধু একজন বাদে। কিন্তু জানি না কেনো আমি চোখ জোড়া এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে সে কোথায় আছে দেখার জন্য কিন্তু কোথাও দেখতে পারছি না। মনে মনে ভাবতে লাগলাম সে হয়তো বাড়ি ফিরে গেছে।
তখনই উদয় হলেন মহাশয় সকলের সাথে বসে পরলেন। সবার সাথেই হেসে হেসে কথা বলছে আমি বাদে। মুড অফ করে নিচে ফ্লোরের দিকে তাকালাম। তখন আবারও কপালে ঠান্ডা জাতীয় কিছুর স্পর্শ পেলাম। চটপট মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি অভ্র ভাইয়া একটা কোণ আইসক্রিম আমার কপালের সাথে ছুঁয়ে রেখেছে। আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলল, ‘ সরি তখন প্রাঙ্ক করার জন্য। সত্যি বলতে আজ তোকে অমায়িক সুন্দর লাগছে। আর এই কথা সবার সামনে বললে তুই আসমানে উড়তি তাঔ বলিনি আর এখন কেউ দেখছে বা শুনছে না তাই টুক করে বলে দিলাম। এখন নে তোর জন্য এই আইসক্রিম টা এনেছি কাউকে বলবি না যে আমি আনছি তাহলে আমার মানিব্যাগ ফাঁকা করে দিবে। বোন আল্লাহ রসতে কাউকে বলিস না। ‘
আমি হেসে দিলাম জানি না কেনো? তবে তাকে দেখে ও তার এমন শান্ত ব্যবহারে আমার মন হয়েছে শীতল। সে থেকেই মুখে ঠোঁটে স্বচ্ছতা ভেসে উঠল। অভ্রর হাত থেকে বর্ষা আইসক্রিম টা নিয়ে নেয়। স্বাভাবিক ভাবে দু’জনে পাশাপাশি বসে রয়। বর্ষার দৃষ্টি স্টেজের দিকে আর বর্ষার উপর দৃষ্টি সঞ্চয় করে রেখেছে। তিন তিনটা মানব দেহ। তাদের তিনজনের মনেই বিষাদ ভয়ংকর বিষাদ।
অনুষ্ঠান শেষে সকলে একসাথে কলেজ থেকে বের হয়। কলেজ গেইটে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে। বাড়িতে আসতে আসতে কিছুটা সময় লেগে যায়। কারণ গাড়ির টায়ার পামচার হয়ে যায়। সে জন্য টায়ার চেঞ্জ করে টায়ার লাগাতে একটু সময় লাগে। অভ্র, অপূর্ব দু’জনেরই করুণ দষা। তা দেখে সকলে হাসতে হাসতে বেহাল।
অভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গাড়িতে উঠতে ইশারা করল। বর্ষা চুপচাপ গাড়িতে বাকিদের সাথে পেছনে বসলো।
বাড়িতে পৌঁছে সকলের সাথে কথা বলে রুমে চলে যায়।
রুমের বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানের বড় বড় ঝুমকো দুল গুলো খুলছিল। আয়নাতে দৃষ্টি সংযত রেখে অতি সাবধানে বর্ষা কানের দুলের হুক খুলছিল। পেছন থেকে রুমের সাদা লাইটের আলো তে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বর্ষার পেছন দিকে চুলের আড়াল থেকে নীল রঙের কিছু একটা বার বার উঁকি দিয়ে উঠছে৷ ফ্যানের বাতাসে আবারও ঘন চুলের অতলে ডুবে যাচ্ছে। জিনিসটা রিমা ও রিয়া দুজনেই খেয়াল করে। বৃষ্টি সে তো আসার সাথে সাথে ফোন নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পরেছে।
রিয়া উচ্চ স্বরে বলে উঠল,’ স্টপ বর্ষ্যু যেভাবে আছিস সেভাবেই থাক। ‘
বর্ষা পেছনে না ঘুরেই আকস্মিক প্রশ্ন ছুঁড়ল,’ কেনো? ‘
‘ তোর পিঠে কিছু একটা আছে? ‘ রিমা বলল।
‘ আল্লাহ গো। কি আছে তেলাপোকা নয়তো? ‘
‘ আরেহ নাহ। তুই দাঁড়া আমি দেখছি। ‘
রিয়া বিছানা থেকে নেমে বর্ষার পেছনে দাঁড়ালো। পিঠের উপর থেকে বাঁধনহারা খোলা চুলগুলো গুলো দুই হাত দিয়ে সরিয়ে সামনের দিকে ফেলে দিলো। পিঠে ব্লাউজের উপরে চুইঙ্গাম দিয়ে একটা চিরকুট লাগানো। রিয়া সশব্দে হেসে উঠল। সকলে তার হাসি শুনে বলল, ‘ কি হয়েছে রাত বিরাতে ভূত পেত্নীর মতো হাসছিস কেন? ‘
রিয়া পিঠের উপরে আলতো চাপ দিয়ে ধরল। ব্লাউজ থেকে চুইঙ্গাম সহ চিরকুট টা খুলে নিয়ে বর্ষার সামনে ধরে বলল, ‘ ম্যাম তোর চিঠিবাজ আজও তোর নামে চিঠি পাঠিয়েছে আর দেখ তার কি মারাত্মক লেভেলের বুদ্ধি চিরকুট চিপকিয়েছে তো চুইঙ্গাম দিয়ে। ‘
হাসতে হাসতে রিয়ার মাটিতে গোড়াগুড়ি খাওয়ার মতো অবসু। একটানে ওর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নিলাম। যে লাগিয়েছে সে খুব সাবধানেই লাগিয়েছে। আমার একটা চুলও চুইঙ্গামে লেগে ছেড়ে যায়নি৷ কিন্তু এই চিঠিবাজ টা এটা কখন করল আর আমি ভ্রুনাক্ষে টের ও পেলাম না স্ট্রেঞ্জ। ‘
বৃষ্টি মোবাইল ছেড়ে বিছানার উপর বসে পরল। ইচ্ছুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিনজনে চিঠিতে কি লেখা আছে তা শোনার জন্য আমার ও অধিক আগ্রহ জন্মাচ্ছে হিহিহি পড়বার জন্য। ওদেরকে সাইড দিতে বলে তিনজনের মাঝখানে বসে পরলাম। তার আগে টিমটিম (রিমা কে) বললাম দরজা আটকিয়ে দিয়ে আসতে। আবার যদি কালকের মতো অভ্র ভাইয়া চলে আসে তখন কোনো রিস্ক নেওয়া চলবে না। গলা এদিকে সেদিক করে কেশে নিলাম কেমন জেনো এক অনূভুতি হচ্ছে। অবশেষে পড়তে শুরু করলাম।
🌸
‘ পড়েছো যখন সাদা শাড়ি
মুগধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছি আমি।
সাদা শাড়িতে ছড়িয়ে রেখেছো মুগ্ধতা
আবার বিস্ময়ে ছড়িয়ে রেখেছো সৌন্দর্যটা।
পরনে তোমার সাদা শাড়ি
রাগরাগিণী তোমার রূপে ভারী।
সাদা শাড়িতে তোমার রূপ মুদ্গ হয়ে উঠে দ্বিগুন।
আজই সাদা শাড়িতে তোমাকে দেখতে লাগছিল ভারী।
পরেছো সাদা শাড়ি মন চেয়েছে আবারও প্রেমে পড়ি।
যদি আবারও চায় মন পড়তে শাড়ি
বার বার বেঁছে নিও সাদা শাড়ি।
সাদা শাড়ি পরনে তোমার রূপ ফুটে উঠে দ্বিগুন
আজ দেখিছি তোমায় সাদা শাড়িতে মন চাইছে তোমার কাছে বার বার ফিরে যেতে।
সাদা যেমন শুভ্রতার রং
ঠিক তেমনি সাদা শাড়িতে তোমার সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে দ্বিগুন।
আজও মুগ্ধ আমি তোমার রূপে
পরনে তোমার সাদা শাড়ি ইচ্ছে হয়েছে আনার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।
জানো প্রিয়্য, মাঝে মধ্যে শাড়ি পরা ভালো। শাড়ির যে ক্ষমতা আছে তা অন্য কোনো পোশাকের এই ক্ষমতা নেই। শাড়িই পারে একটি মেয়ের পার্সোনালিটি পাল্টে দিতে তা যদি হয় শুভ্র রাঙা সাদা শাড়ি আমি বলবো পাগল হতে প্রস্তুত আমি। দেখেছি তোমারে শুভ্র রাঙা সাদা শাড়ি তে অযথা অবন্তর আসক্তিতে মরিয়া হয়ে উঠেছি আমি।
এই মেয়ে এই বলবে তুমি আমায় এত কিউট কেন তুমি? ইচ্ছে করে গাল দু’টো ধরে টেনে দেই। ‘
চিঠির অন্তিমের লেখাটা পরে বর্ষা আকস্মিক গালে হাত দিয়ে বসে অস্ফুটস্বরে বলল,’ আমার গাল। ‘
বর্ষার এমন কান্ড দেখে রিমা উচ্চ স্বরে হেসে ফেলল। বর্ষা হয়তো বাস্তবতা আর চিঠি দু’টোর মাঝে নিজেকে গুলিয়ে ফেলছে। বৃষ্টি বর্ষার হাতে চিমটি কেটে বলল, ‘ কিরে চিঠিবাজের প্রেমে পরে গেলি নাকি? ‘
বর্ষা তেজি কন্ঠে বলল, ‘ ধুর চিনিই তো না, সে কে? ‘
পাশ থেকে রিমা বলে উঠল, ‘ ও একবার চিনলে পরে পরবি। ‘
রিমার কথায় হাসির বন্যা বয়ে যাচ্ছে আমার রুমে আমি করুণ দৃষ্টিতে একবার ওদের তিনজনকে দেখছি আরেকবার চিঠিটা কে দেখছি। মনে মনে বলছি, ‘ কে তুমি চিঠিবাজ? আসবে না নাকি আমার সামনে কখনো? আমি যে দেখতে চাই তোমাকে। ‘#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_২২
#শারমিন_আক্তার_পর্ব
_______
‘ তুই কি ভাবছিস? ‘ পাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলল নিভ।
নিভের কথায় ঘোর কাটলো বর্ষার, দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে বিমূঢ় কন্ঠে বলল, ‘ কিছু না। ‘
বর্ষার কথার পিঠে মলিন হাসলো নিভ কথার প্রশংস পাল্টিয়ে বলল,’ তুই এমন ছিলি না। আজ থেকে চার মাস আগের বর্ষার সাথে তোর এখন কোনো মিল নেই। কিছুটা পাল্টেছে তবে সেটা তুই বুঝতে পারছিস না। ‘
বর্ষা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ‘ মানে? ‘
‘ মানে হচ্ছে তুই খুব তারাতাড়ি বুঝতে পারবি। ‘
‘ হেঁয়ালি না করে সোজাসাপ্টা বল কি বলতে চাচ্ছিস? ‘
‘ তুই খুব সহজ সরল বর্ষা দেখিস তুই খুব শীগ্রই কারো প্রেমে পরবি। ‘
‘ আজাইরা কথাবার্তা কম বলবি যত্তসব। ‘ বলেই পানিতে ইটের কোণা ঢিল ছুঁড়ে মারল।
*
এত মাস পর তাদের প্রিয় বন্ধু নিভ এসেছে তাদের সঙ্গে দেখা করতে৷ সে খুশিতে বাকিরা প্লান করে কলেজ ছুটির পর আজ সকলে বাহিরে ঘুরবে প্রথমে সকলে তাদের সব থেকে প্রিয় জায়গা নীল লেকে যাবে। সেখানে কতক্ষণ বসে আড্ডা দিবে লেকের স্বচ্ছ নিলাভ পানিতে পা ঝুলিয়ে তিড়ে বসে থাকবে। এদিকে সকলে এতক্ষণ তাই করছিল কিন্তু কয়েক মিনিট হলো ওরা সকলে উঠে গেছে। রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক ফুচকা ওয়ালা তা দেখেই বাকিরা ছুটে চলে যায় ফুচকা খেতে। এসেছে পর থেকেই বর্ষাকে বিষন্নতায় দেখা যায়। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে বর্ষা৷ পাশ থেকে নিভ কয়েকবার ডাক দিলেও বর্ষা তা শুনতে পায়নি। সে ভাবছে অনেক গম্ভীর কিছু। বর্ষার চোখে মুখে স্পষ্ট সে চোখ কাউকে খুঁজে তাকে না দেখেই চোখে বিষন্নতা অবসাদ ঘটেছে। নিভের কথাগুলো সত্য হলেও বর্ষা মুখের উপর নাকচ করে দিয়ে নিভকে ভুল প্রমাণিত করার চেষ্টা করে উঠে চলে যায়।
রাস্তার মাঝে লোক জনের ভীড়ে আচমকা কেউ একজন হাত ধরে টান মারে। প্রথমত বিষয়টা বর্ষা স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। বর্ষা ভাবে রাস্তার এত ভিড়ে ঠেলাঠেলির কারণে কারো সাথে হাতে গষা লেগেছে হয়তো। কলেজ ছুটির পর, সবার সাথে বর্ষাও রওনা দেয়। রাস্তায় যেদিক দিয়ে লেকে যেতে হয়। সেদিক টায় আজ অনেক ভীড়। আর এত মানুষের মধ্যে দিয়ে ঠেলেঠুলে যেতে চায়নি। শুধু নিঝুম, ও আহিতার জোরাজুরিতে যেতে হয়েছে৷
ভিড় ঠেলে বাহিরে আসতে বর্ষা খেয়াল করল তার হাত টনটন করছে। হাতের দিকে। তাকাতে দেখল সেই আগের ন্যায় চুইঙ্গাম দিয়ে হাতে একটা হলুদ কালারের পেপার লাগানো। ভ্রু খানিক কুঞ্চিত করে তাকালো হাতের দিকে কিছুক্ষণ পরক্ষণে সকলের আড়ালে চিরকুট টা ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। বর্ষা বসে বসে এটাই ভাবছিল। বেস্ট ফ্রেন্ড গুলা সব সময় ফেসের রিয়াকশন দেখেই সামনে থাকা বন্ধুটার মন খারাপের কারণ বুঝতে পারে। নিভের দিকটায় ও তাই হলো।
সে দেখেই বলে ফেলল বর্ষার মন খারাপের কারণ সে খুব শীগ্রই প্রেমে পরবে। তবে যথাযথ ইগনোর করে বর্ষা তার সামনে থেকে উঠে চলে যায়। যার মন যাকে চায়, সে সামনে থাকলে এমনিতেই চোখে মুখে ভালোলাগা ফুটে উঠে। আর সে সামনে না থাকলে আঁখি জোড়া শুধু তাকে এক নজর দেখার জন্য ছোটাছুটি করে। মরুভূমিতে এক ফোটা পানির জন্য এক জন পিপাসক ব্যাকুল হয়ে উঠে। তেমনই এই আঁখি জোড়া তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়। চারদিকে শুধু তারই অস্তিত্ব সন্ধান করে।
। সবাই বসে ফুচকা খাচ্ছিল মনের আনন্দে শুধু বিষন্নতায় ডুবে আছে বর্ষা।
দশ মিনিটের মাথা সেখানে আরও একজন সুঠাম দেহের লোক এসে উপস্থিত হলো সে সকলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,’ হেয়, গাইস! আমাকে রেখে একা একা ফুচকা খাচ্ছো নট ফেয়ার। ‘ অভিমানী স্বরে বলল।
মুরাদ ভ্রু কুঁচকালো। নিঝুম হা হয়ে তাকিয়ে বলল,
‘ তুমি ফুচকা খাও? ‘
লোকটা একটা চেয়ার টেনে বসে পরল, ধীর কন্ঠে বলল, ‘ কেনো আমার ফুচকা খাওয়া নিষেধ নাকি? ‘
‘ আদ্রিক তুমি ভুল বুঝছো। নিঝুম আসলে সেভাবে বলতে চাইনি। ও বলতে চেয়েছে যে, ‘ আহিতা কথা বলতেছিল তখন ওকে থামিয়ে দিয়ে আদ্রিক বলল,
‘ সে ও যাই বলতে চাকনা কেন তাতে আমার কিচ্ছু যায় না আসে না। এখন তো আমি শুধু ফুচকা খাবো৷ এই মামা এক প্লেট ফুচকা দিয়ো তো। ‘ আহিতার উদ্দেশ্য বলা কথাগুলো শেষ হলে ফুচকাওয়ালা কে ফুচকা দিতে বলল। এক নজর বর্ষার দিকে তাকালো তবে সে নিশ্চুপ নিরব পাবলিক হয়ে বসে আছে।
ফুচকা ওয়ালা ফুচকা দিয়ে যেতেই আদ্রিক খাওয়া শুরু করল। ফাঁকে ফাঁকে বারবার বর্ষাকে খোঁচাচ্ছে এই বলে, ‘ অনেক টেস্ট একবার খেয়ে দেখো ভালো লাগবে। ‘
কিন্তু আদ্রিক এটা জানে না যে, বর্ষার ফুচকা পছন্দ না। বর্ষা শুধু আইসক্রিম পছন্দ করে।
বারবার আদ্রিক এক কথা বলে বর্ষাকে তিক্ত করছে। রাগে রক্তবর্ণ চোখে আদ্রিকের দিকে তাকাতে আদ্রিক সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘ তোমার অনেক রাগ বর্ষা, যেমন টা রাগ রাগিনী। ‘
আদ্রিক কথা ইয়ার্কি করে বললেও বর্ষা কথাটা সিরিয়াসলি নিয়ে নেয়। কাউকে কিছু না বলে রাগে কটমট করে উঠে উল্টোদিকে প্রদক্ষিন করে।
নিভ কঠোর কন্ঠে বলল,’ বর্ষা ফুচকা পছন্দ করে না তুমি ওকে ওভাবে বিরক্ত না করলেই পারতে। ‘
‘ সরি। আমি জানতাম না বর্ষার ফুচকা পছন্দ না। ‘ মিনমিন কন্ঠে বলে।
‘ এজন্যই আগে থেকে সব জেনে নেওয়া ভালো। ‘
*
রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে বর্ষা। মনে হচ্ছে এই ব্যস্ত শহরে সব কিছুই ছুটে চলেছে শুধু তারই মস্তিষ্ক শূন্য।
রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। খানিকক্ষণ বাদে বাদে গাড়ির হন বেজে উঠছে। রাস্তার পাশে সরু রাস্তায় ঝালমুড়ি ওয়ালা ঝালমুড়ি বানাচ্ছে। তার লাঠি ঘুরানোর শব্দ সাথে কিছুটা দূরে মানুষের কোলাহল। রাস্তার কিনারে ফেরিওয়ালারা বসে আছে। তাদের ঘিরে কতশত মানুষের ভিড়, কিছু মানুষ ফেরিওয়ালার জিনিসগুলো হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আবারও রেখে দিচ্ছে তো অন্য কিছু মানুষ হাতিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছে দাম জিজ্ঞেস করছে আবারও তা আগের জায়গায় রেখে দিছে। আরও কিছু মানুষ জিনিস পছন্দ হলে টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। পাশের দোকানে চায়ের কাপ নাড়ানো শব্দ হচ্ছে। চতুর্দিক থেকে মানুষের নানান কথা ভেসে আসছে। এসব কিছুই বর্ষার আকস্মিক হৃদয়ে প্রভাব ফেলতে, আনমনে মাটির দিকে তাকিয়ে সে হেঁটে চলেছে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। মনে মনে ভাবছে, কে এই চিঠিবাজ যে এত সাবধানে চিঠি দিয়ে যাচ্ছে আর বর্ষা ভ্রু নাক্ষে টের পাচ্ছে না। তখনই তার মনে হলো তার এভাবে একা আসা ঠিক হয়নি। বর্ষার কি তার বন্ধুদের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত? উঁহু, যাওয়া ঠিক হবে না এতক্ষণে হয়তো তারা চলে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পেরিয়ে চলে আসছে বর্ষা। সে খেয়ালই করেনি কখন সে গ্রামের পথে হাঁটা শুরু করেছে। চারদিকে বড় বড় গাছ পালা। একসাথে একসারি তে তালগাছ রাস্তার পাশে। রাস্তার দু’পাশে অনেক বড় ধান ক্ষ্যাত যার কোনো শেষ নেই। মাঠে মাঠে গরু বেঁধে রাখা হয়ে তারা ঘাস খাচ্ছে। অন্য দিকে বাঁধনহারা ছাগল খোলা অবস্থায় এদিক সেদিক লাফিয়ে চলেছে৷ গাছের উপরে পাখিরা বাসা বেঁধেছে। এখনো বৈশাখ মাস শেষ হয়নি ধান গুলো পাকেনি তারা সবুজ রঙে নিজেদের সাজিয়ে রেখেছে। কিছুকিছু চাষীরা ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে খুব সতর্কতার সাথে হেঁটে চলেছে। হাতে তাদের কিছু রয়েছে। যা তারা ক্ষেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে।
বর্ষা সব দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো বুক চিরে এক ভারী দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসল। নিজেকে সংযত করে নিলো। তার এখন ইচ্ছে করছে গ্রামের রাস্তার পাশে ঘাসের উপর বসে চিঠিটা খুলে পরতে।
দ্বিতীয় বার চিন্তা ভাবনা না করে বর্ষা বসে পরল প্রাণোচ্ছল সবুজ ঘাসের উপরে, কাঁধ থেকে ব্যাগ টা খুলে মাটিতে ঘাসের উপর রাখল। ব্যাগের চেইন খুলে তার ভেতর থেকে হলুদ কালারের কাগজ বের করল। চিঠিটার দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে। এই যুগেও মানুষ চিঠি দেয়। ভাবতেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে বর্ষা৷ তবে কবি লেখকের লেখা দারুণ, কাগজের ভাজ খুলে চোখের সামনে ধরল তাতে লেখা রয়েছে কিছু আবেগপ্রবণ কথা। বর্ষা ভারী নিঃশ্বাস নিয়ে পড়তে শুরু করল।
🌸
________
‘হুটহাট চলে যাও, কাছে থেকে দূরে বহুদূরে
বুঝিনা কিসের তরে থাকো কোন কল্পনার ঘোরে!!
স্বপ্ন দেখাও টুটাও, দূরে বসে খিলখিল হাসো
মনের আয়নায় যে তুমি মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ভাসো!!
বিবর্ণতায় সাজাও ভূবন আমার, আচম্বিতে
বুকের মধ্যে উথাল ঊর্মির তোড়ে ফিরি সম্বিতে।
চোখের নদীতে বন্যা বয়ে যায় সেকি বর্ষা বুঝে?
বুকের অথৈ-এ রক্ত চুয়ে চুয়ে সেকি বর্ষা খুঁজে!
অস্পৃশ্য ভালবাসায় ডুবে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি
মোহের টানে নাগালে কারো অস্তিত্ব ঠের পাচ্ছি!
সে কে? নীলাম্বরে ভেসে থাকা একটুকরো বর্ষা কি!
বর্ষা শুনো, তীরে ভেসে থাকা বর্ষার মন শুভ্র কি?
অস্থিরতায় কাটছে সময় তুমিহীন, আসোনি
তোমার শুভ্র বর্ষার ডানায় নিয়ে আজো ভাসোনি!!
শেষ ট্রামে চলে গেলে বর্ষা, হয়ে শেষ বর্ষাধারা
তোমার জন্য অস্থির মন হলো যে পাগলপাড়া!
নিপুণ ছোঁয়ায় তুমি ভেঙ্গে দিলে মনের দেয়াল
বর্ষা তুমি তীরে বসে দূরে ঐ কি জানি কি খেয়াল!
তোমাকে ভেবে ভরছি খাতা সব অজ্ঞান লেখায়
অস্থির সময় যেনো শুধু কষ্ট পেতেই শেখায়!
বর্ষা তোমার ডানায় ভর দিয়ে উড়ি ইচ্ছে নিবে?
শুভ্র বর্সার স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় হারাতে মন অস্থির দিবে?
গলে পড়ো অবিরাম চোখের পাতা ছুঁয়ে বুকেতে
আলিঙ্গনে আত্মহারা হতে চাই আবার সুখেতে।
বর্ষা বৃষ্টি হয়ে ঝরো, দাও সর্বাঙ্গে শীতল ছোঁয়া
তোমার তরেতে গেলে যাকনা আজ এ মন খোয়া! ‘
_________
🌸
তোমার এই চিঠি যে করে দিচ্ছে আমাকে পাগল পাড়া। আমার মনকে করে দিয়েছে উদাসীন। সে যে কাউকে খুঁজে কারো সঙ্গ পেতে সে বড্ড কাঁদে।
হেই চিঠিবাজ তোমার চিঠির প্রতি টা লেখার আড়ালে আমি কেনো তাকে খুঁজে পাই তুমি কি তা বলতে পারো?
আমার চোখ দু’টো এখন সারাক্ষণ ছুঁইছুঁই করে শুধু একটা নজর তাকে দেখার জন্য, তাকে দেখিলে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব হয়। শান্তির ধারা বয়ে যায় নদীর স্রোতে বাসা পদ্মর মতো।
আমার মন আমাকে বলে, আমার সে, আমার তাকে লাগবে। রগের শিরায় শিরায় শিহরন জাগ্রিত হয়। প্রতিটা শিহরণ শুধু তারই ছোঁয়া পেতে চায়। ইচ্ছা করে তারে দেখি আমি পরান ভরিয়া। আমার অন্তর আত্মা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। তাহলে কি আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি? প্রশ্ন হচ্ছে সে কি গ্রহণ করবে আমাকে? ইচ্ছে করে তাকে ধরে বন্ধি করে রাখি আমার মনের খাঁচায়। বলতে বলতে বর্ষা সবুজ শ্যামল ঘাসের উপর শুয়ে পরল। মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।
#চলবে?