‘অবিশ্বাস’
সাবিহা আফরিন
৭.
অস্থিরভাবে একের পর এক বেল বাজিয়ে চলেছে আশফাক। রফিক সাহেব তড়িঘড়ি করে এসে দরজা খুলে দিলেন। উষ্কখুষ্ক আর মলিন চেহারার আশফাককে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। আশফাকের চোখ দুটো টকটকে লাল। দরজা খুলে দিতেই আশফাক তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে অস্থির কন্ঠে বলে উঠল,’নীরা কোথায় বাবা? আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই। আমার যে বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ‘
বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ফেলল আশফাক। আশফাকের কান্না দেখে রফিক সাহেব চেয়েও কঠোর হতে পারলেন না। ড্রইং রুমের সোফায় বসে ছিলেন নীরার মা আশালতা। আশফাককে দেখা মাত্রই ক্রোধে ফেটে পড়লেন তিনি,’কি চাই?কেন এসেছ এখানে? এত অপমান অপবাদ দেওয়ার পরও শান্তি হয়নি তোমাদের? ছেড়েই তো দিয়েছ আমার মেয়েকে। আবার কেন এসেছ এখানে? কোন নাটক দেখাতে এসেছ?’
‘মা বিশ্বাস করুন আমি সত্যিটা জানতাম না। আজ জানতে পেরে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। ছুটে এসেছি নীরার কাছে। আমায় ক্ষমা করে দিন মা। আমি শুধু একবার নীরার সাথে দেখা করতে চাই। ওকে একবার ডেকে দিন। ও ক্ষমা না করলে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না। প্লিজ মা একবার শুধু একবার আমাকে নীরার কাছে নিয়ে চলুন। আমি ওকে ফিরেয়ে নিয়ে যেতে চাই। কথা দিচ্ছি জীবনে আর কখনো ওকে সামান্য পরিমাণ কষ্টও দেব না।’ বলতে বলতে হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে নীরার মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ল আশফাক।
আশালতা দাঁতে দাঁত চেপে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,’নাটক নাটক সব এদের নাটক।’ তার চোখ ছলছল করছে।
তারপর নীরার বাবার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,’কেন ঢুকতে দিয়েছ ওকে? চলে যেতে বল ওকে।’
রফিক সাহেব শান্ত ভঙ্গিতে স্ত্রী কাছে এসে তার হাত ধরে কোমল স্বরে বললেন,’আহ! আশা থামো, চল ভেতরে চল।’
আশালতা রফিক সাহেবের হাত ঝারি দিয়ে ফেলে দিয়ে দ্বিগুণ জোরে বলতে লাগলেন,’থামবো মানে? কেন থামবো আমি? আর কোত্থাও যাব না আমি। ঐ ছেলেটা কেন এসেছে এখানে? ওকে আর এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারছি না আমি। বেরিয়ে যেতে বল ওকে এক্ষুণি। নইলে আজ একটা অঘটন ঘটিয়েই ছাড়বো আমি।’
রফিক সাহেব বুঝলেন আশালতার মাথা এখন ঠিক নেই। রাগের বশবর্তী হয়ে যেকোনো সময় যেকোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। তাই তিনি আশালতার হাত শক্ত করে ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। আশালতা খ্যাপা পাগলের মতো বারবার আশফাকের দিকে তেড়ে আসতে চাইছে। রফিক সাহেব খুব কষ্টে তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। আশালতা বারবার নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। যেতে যেতে আশফাকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন,’আমার মেয়েটাকে শেষ করে দিয়ে শান্তি হয়নি ওদের। এখন এসেছে নাটক দেখাতে। ছাড়বো আমি ওদের, একটাকেও ছাড়বো না। সবগুলোকে জেলের ভাত খাওয়াবো।’
রফিক সাহেব আশালতাকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিলেন। আশালতা ভেতর থেকে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে আর পাগলের মতো চিৎকার করেই যাচ্ছে। রফিক সাহেব আশফাকের কাছে ফিরে আসতেই আশফাক বিনীত ভঙ্গিতে বলল,’আমি জানি আমি কত বড় পাপ করেছি। এ পাপের কোনো ক্ষমা হয় না। আমায় একবার নীরার কাছে নিয়ে চলুন। আমি জানি আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইলে ও আমায় ঠিক ক্ষমা করে দেবে।’
রফিক সাহেব আশফাকের দিকে চেয়ে নরম স্বরে বলে উঠলেন,’তুমি সত্যি নীরার কাছে যেতে চাও?’
‘হ্যা বাবা। প্লিজ আমায় নীরার কাছে নিয়ে চলুন।’ দ্রুত উত্তর দিল আশফাক। তাকে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে।
‘ঠিক আছে। চল তবে।’
আশফাক উঠে দাড়ালো। নীরার বাবা রফিক সাহেব গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে আশফাকের উদ্দেশ্যে বলল,’এসো..’
আশফাক কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। নীরা কি তবে ঘরে নেই? আশফাক বেরিয়ে আসতেই রফিক সাহেব গেটে তালা লাগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা নিচে নেমে গেলেন। আলুথালু পায়ে ফুটপাত ধরে এগিয়ে যেতে লাগলেন। আশফাক বেশ অবাক হল। নীরা বাসায় নেই তাহলে কোথায় আছে? আর নীরার বাবাই বা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরতে লাগল মনে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারলো না আশফাক। তার মনের ভেতর বহুদিন পর নীরার সাথে দেখা করার আনন্দ এসে বাসা বেঁধেছে। মৃদু উত্তেজনা কাজ করছে তার মধ্যে। নীরা তাকে দেখলে কেমন রিয়েক্ট করবে? নীরা কি তাকে ক্ষমা করে দেবে? প্রথমে কি বলে শুরু করবে সে? কিভাবে ক্ষমা চাইবে নীরার কাছে? আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ওরা এসে হাজির হল এলাকার গোরস্থানের সামনে। আশফাক খানিকটা চমকে উঠল। গোরস্তানের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে রফিক সাহেব আশফাকের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে ছোট্ট করে বললেন,’এসো..’
আশফাকের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। নীরার বাবা তাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে? এক অজানা শঙ্কায় বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। আশফাক ধীর পায়ে এগিয়ে এল। ভেতরে ঢুকে রফিক সাহেব দুটি সদ্য নতুন কবরের সামনে এসে দাড়ালেন।
‘এই যে নীরা, আমার মেয়ে। এখানে ঘুমিয়ে আছে। আর ঐ যে নীরার পাশের কবরটা দেখছ ওটা আমার নাতনীর কবর। কি সুন্দর তাই না? মা মেয়ে দু’জনে একসাথে পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে।’
আশফাকের যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। চারপাশটা কেমন টলতে লাগল। বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে এল।
‘নীরাকে বের করে দেওয়ার পর তোমার সাথে অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। তোমার ফোনে অনেকবার ফোন করেছি কিন্তু তোমাকে পাইনি। শেষে বাধ্য হয়ে তোমার মায়ের নাম্বারে ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু তিনি আমাকে নানান অপমান করে ফোন কেটে দিয়েছিলেন। এমনকি নীরাও তোমার সাথে বহুবার যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু তুমি নিজেই সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছিলে। মেয়ের কষ্ট সইতে না পেরে পরদিন তোমাদের বাড়িতেও গেছিলাম কিন্তু তোমার মা আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন না। অপমান করে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তোমার অফিসে গেছিলাম কিন্তু তুমি আমার কথা শোনা তো দূর আমার সাথে দেখা পর্যন্ত করনি। টানা চার ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও যখন তুমি এলে না তখন হতাশ হয়েই আমাকে বাড়ি ফিরতে হল। মেয়ের সংসারটা ভাঙ্গার চিন্তায় বাসায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লাম আমি। প্রচণ্ড জ্বরে ভুগলাম বেশ কয়েকদিন। আমার অসুস্থতার জন্য আমার মেয়েটা নিজেকে দায়ী মনে করতে লাগল। সারাদিন কেমন মনমরা হয়ে থাকতো। নামাজের মোনাজাতে নীরবে চোখের জল ফেলতো। এর মাঝেও আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করার বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু লাভ হয়নি।’
রফিক সাহেব বলেই চললেন,’ হঠাৎ একদিন তুমি ডিভোর্স লেটার পাঠালে। মেয়েটা আমার সেদিন পাগলের মতো চিৎকার করে কেঁদেছিল৷ এমনকি তোমার সাথে যোগাযোগ করার বহু চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু বরাবরের মতোই ব্যর্থ হয়েছিল। খুব ভেঙে পড়েছিল জানো? তার ঠিক দিন দুয়েকের মাথায় ঘটল এক্সিডেন্ট। বাথরুমে পড়ে গিয়ে পেটে প্রচণ্ড আঘাত পেল নীরা। সাথে সাথে প্রচন্ড ব্লিডিং হতে লাগল। হসপিটালে নেওয়ার সময় আমার মেয়েটা বারবার তোমার নাম নিয়েছিল। তোমাকে শেষ বারের মতো দেখতে চেয়েছিল। বাহিরে সেদিন প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছিল। সমস্ত ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে মেয়ের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করার জন্য আমি মাঝ রাত্তিরে ভিজে ভিজে তোমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ছিলাম। আমি জানতাম ঐ সময় তুমি বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু দরজা খুললেন তোমার মা। বারবার আকুতি মিনতি করার পরও তোমার মা তোমার সাথে দেখা করতে দিলেন না। বললেন তুমি নাকি দেখা করতে চাওনা না। আরও অনেক অপমান করে বললেন আমি যদি এই মুহূর্তে নিজ থেকে না যাই তাহলে আমাকে দারোয়ান দিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন। তোমাকে এত করে ভিক্ষা চাওয়ার পরও উনি মানলেন না। উপরোন্তু আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন।’
রফিক সাহেবের চোখ ছলছল করছে, ‘আমিই এক হতভাগ্য বাবা যে কিনা নিজের মেয়ের শেষ ইচ্ছেটাও পূরণ করতে পারলাম না।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন রফিক সাহেব। বাম হাতে মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে ডান হাত ভাঁজ করে আঙুল দিয়ে দু’চোখ চেপে ধরলেন তিনি।
আশফাকের চোখ উঁপচে জল বেরিয়ে এল। ধপ করে বসে পড়ল নীরার কবরের পাশে। বুকের ভেতরটা অসম্ভব যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে তার। এত কষ্ট কেন হচ্ছে? আশফাক চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘এত বড় শাস্তি তুমি আমায় দিতে পারো না নীরা। এভাবে আমায় একা ফেলে চলে যেতে পারো না। আমি কথা দিচ্ছি আর কোনোদিন তোমায় কোনো খারাপ কথা বলবো না, কোনোদিন অবিশ্বাস করে কষ্ট দেব না। ফিরে এসো নীরা, ফিরে এসো। আমি যে তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারবো না। প্লিজ ফিরে এসো…’
বাতাস থেমে গেল। পাখিগুলোও কিচিরমিচির করা বন্ধ করে দিল। স্তব্ধ চারিপাশ যেন আশফাকের জানান দিতে লাগল- নেই নেই নেই…সে নেই,কোথাও নেই।
সমাপ্ত….