#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০১||
৬১.
খুব সাদামাটাভাবেই একটা বছর কেটে গেলো। এই একটা বছর ব্যস্ততার মাঝেই নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিল আরাফ। এখন সে পড়াশুনা নিয়েই খুব ব্যস্ত। কলেজ থেকে টিউশন, টিউশন থেকে বাসা, এভাবেই তার দিন কাটছে। টিউশনের অর্ধেক টাকা সে সায়ন্তনীর মায়ের হাতে দিয়ে দেয়। সায়ানকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে আরাফ। তাদের ভালো বাসায়ও নিয়ে এসেছে। এখন সায়ন্তনীর মা তার ছেলেকে নিয়ে শতাব্দীদের মহল্লায় থাকেন। তারা এখন আগের তুলনায় স্বচ্ছল জীবনযাপন করছেন।
কাছের মানুষকে হারালে, অনেকেই পাথর হয়ে যায়৷ আর আরাফ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে গেছে। সে হাসে না, কারো সাথে আড্ডাও দেয় না। সে কেমন যেন চুপসে গেছে। তবে সায়ন্তনীর মৃত্যু শুধু আরাফকে পরিবর্তন করে নি, ইমনকেই হয়তো সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন তার মধ্যে আর চঞ্চল ইমনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আগের সেই ইমন এখন পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। এখন সে পড়াশুনায় খুবই মনোযোগী হয়েছে। পাশাপাশি ছোট একটা ব্যবসা করছে। তবে মাওশিয়াতের সাথে তার সম্পর্কটা ভালোই চলছে। মাওশিয়াত তার বাবা-মাকে ইমনের ব্যাপারে জানালে তারাও আর আপত্তি করেন নি। আর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, মাওশিয়াতের পড়াশুনা শেষ হলেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেবেন। তবে ইমন মিস্টার মিরাজ আর মিসেস তিশাকে জানিয়ে দিয়েছে, বিয়ের পর মাওশিয়াত তার সাথে বাংলাদেশেই থাকবে। তবে ছুটিতে তাকে কলকাতায় নিয়ে আসবে৷ ইমনের এ প্রস্তাবে মিরাজ হোসেনের একটু আপত্তি ছিল। কারণ মাওশিয়াত তাদের একমাত্র মেয়ে। কিন্তু শেষে মেয়ের অতিরিক্ত ইচ্ছে দেখে তিনি আর কিছু বললেন না।
আর মাত্র এক বছর, এরপর ইভান আর আরাফ ছাড়া বাকী চারজনেরই পড়াশুনা শেষ হয়ে যাবে। এদিকে রহমত চাচাকে তারা জানিয়ে দিয়েছে আগামী বছর দেশে ফিরবে। ইমন এসেই মৈত্রী গ্রুপের দায়িত্ব নেবে। যদিও মৈত্রী গ্রুপটির এখন আর কোনো অস্তিত্বই নেই। শুধু কোম্পানির সেই পুরোনো ফ্যাক্টরি আর ভবনটি এখনো পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। এখনো জায়গাটা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়া হয় নি। আর কেউ সেই জায়গার দাবী নিয়েও আসে নি। তবে এতোবছরেও যেহেতু জায়গাগুলো অক্ষত আছে, তাহলে আরো এক বছর অক্ষত থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিকেলে রান্নাঘর থেকে চায়ের ট্রে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলো অরুণিকা। ইভান, ইমন, আহনাফ আর তূর্য সোফায় বসে আছে। তাহমিদ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“আরাফ কোথায়?”
আরাফ গোসল সেরে চুপচাপ সোফায় বসে চায়ের কাপ হাতে নিলো। সবাই চুপচাপ চায়ে মনোযোগ দিলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই৷ এদিকে অরুণিকা একপাশে বসে আহনাফের ফোনে গেইমস খেলছে। সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে এবার আহনাফ বলল,
“আমি এই সপ্তাহে আমার শখের বাইক কিনতে যাচ্ছি।”
আহনাফ কথাটি বলেই সবার মুখের দিকে তাকালো। অরুণিকা উৎসুক কন্ঠে বলল,
“আমিই কিন্তু প্রথম তোমার বাইকে চড়বো।”
আহনাফ হেসে বলল, “আচ্ছা।”
এবার তূর্য বলল,
“আমার একটা ভালো প্ল্যান আছে। আমরা তো আগামী বছর দেশে ফিরবো। ইভান আর আরাফই হয়তো এখানে আরো এক বছর থাকবে৷ এখন এখান থেকে যাওয়ার আগে আমাদের একটা ট্যুর দেওয়া উচিত।”
আহনাফ বলল,
“তুই আমার মনের কথা বলেছিস।”
তাহমিদ বলল,
“আমার তো সমস্যা নেই। কিন্তু বাকীরা….”
সবাই আরাফের দিকে তাকালো। অরুণিকা সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে আরাফের পাশে এসে বসলো। আরাফ অরুণিকার দিকে একনজর তাকিয়ে আবার চায়ে মনোযোগ দিলো। অরুণিকা বলল,
“আরাফ, তুমি যদি না যাও, তাহলে আমিও যাবো না। তুমি আমাকে স্কুলের পিকনিকে যেতে দাও নি। বলেছ তোমরা ঘুরতে নিয়ে যাবে। এখন তোমরাই সারাদিন বাসায় বসে থাকো।”
আরাফ বলল,
“অরু আমাকে জোর করো না। আমার পড়াশোনা আছে।”
“এতো পড়াশুনা করে কি হবে? শেষমেশ তো ডাক্তারই হবে, তাই না? তো ডাক্তার যেহেতু কাল পরশু হবেই, তাহলে এখন কেন রোগীদের মতো আচরণ করছো?”
“আমি রোগীদের মতো আচরণ করছি?”
“হ্যাঁ, তুমিই তো বলেছ একা একা থাকা একটা মানসিক রোগ।”
আরাফ চুপ করে রইলো। অরুণিকা বলল,
“এখন যাবে কি যাবে না, তা-ই বলো।”
আরাফ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আচ্ছা, যাবো।”
করিম সিদ্দিক ছেলের সাথে বসে এই বছর কোথায় ঘুরতে যাবেন, তাই ভাবছেন। একমাস হলো তিনি দেশে ফিরেছেন। প্রতিবারের মতো এবারও তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশে ডুব দিতে চাচ্ছেন। আদিল বাবাকে বলল,
“আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল দার্জিলিং যাওয়ার। এবার বরং আমরা সেখানেই যাই।”
করিম সিদ্দিক ছেলের মতামতে সম্মতি দিয়ে স্ত্রীকে ডেকে বললেন,
“কই শুনছো। এবার আমরা দার্জিলিং যাবো ভাবছি।”
মিসেস জুলেখা রুম থেকেই চেঁচিয়ে বললেন,
“তোমরা বাবা-ছেলে মিলে ঘুরাঘুরি করে টাকাগুলোই শুধু নষ্ট করবে, আর তো কোনো কাজ নেই।”
করিম সিদ্দিক এবার মেয়েকে ডেকে বললেন,
“মা, কোথায় তুমি?”
উপমা বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার স্টারের গান শুনছে। কানে হেডফোন থাকায় সে বাবার ডাক শুনতে পায় নি। আদিল বোনের রুমে এসে দরজা ধাক্কা দিতেই উপমা নড়েচড়ে বসলো। আদিল রুমে এসে চেয়ার টেনে বসলো। উপমা বলল,
“জানি এখানে কেন বসেছ। তোমরা দু’জন ঘোরার প্ল্যান করে, এখন আমাকে মায়ের কাছে পাঠাবে রাজী করানোর জন্য। শুনো, আমি কোথাও যাচ্ছি না, ভাই।”
“তুই এতো নিরামিষ কেন বল তো?”
“দেখ, ভাই। আমার ঘুরতে ভালো লাগে না। আর ওখানে নেটওয়ার্ক না থাকলে আমি আমার স্টারের কোনো আপডেটই পাবো না।”
আদিল বিরক্ত হয়ে বলল,
“মানুষ ট্যুর দেওয়ার জন্য সঙ্গী পায় না, আর তুই স্বয়ং নিজের বাবার কাছ থেকে অফার পেয়ে মানা করে দিচ্ছিস! তোর মতো মেয়েকে জেলখানায় বন্দি করে রাখলেও কোনো সমস্যা হবে না।”
“হ্যাঁ হবে না। আমাকে শুধু আমার স্টারের গান শুনতে দিলেই হবে। আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।”
আদিল উপমাকে রাজি করাতে না পেরে একরাশ হতাশা নিয়ে বাবার কাছে ফিরে এলো।
এদিকে তূর্য আর আহনাফ অনেক চিন্তাভাবনা করে দার্জিলিং যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। সবাই তাতে মত দিতেই অরুণিকা বলল,
“আমি যদি পাহাড় থেকে পড়ে যাই?”
আহনাফ বলল,
“বেহুশের মতো হাঁটলে তো পড়বেই।”
“দেখো আমি বেহুশের মতো হাঁটি না। তোমরাই তো সব জিনিসপত্র এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রাখো।”
“হ্যাঁ পাহাড়েও তোমার জন্য সব কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়েই রাখা থাকবে। সোজাসুজি রাস্তা তুমি কোথাও পাবে না। তাই তোমাকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।”
অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমি ওখানে যাবো ঠিক আছে, কিন্তু আমার তো কোনো ভালো জামা নেই।”
এবার তূর্য বলল,
“আজই তোমাকে শপিংয়ে নিয়ে যাবো।”
“কিন্তু আমি বাইকে করেই শপিং করবো।”
“আচ্ছা, তাহলে আহনাফ নিয়ে যাবে।”
“না ওর সাথে যাবো না। ও অনেক কিপটে৷ দোকানদারের সামনে আমাকে বকাঝকা করে।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আর তুমি মার্কেটে গেলে আমার পুরো মানিব্যাগ খালি করে আসো। আর আমি দর কষাকষি করবো না? দর করি দেখেই একটার পরিবর্তে চারটা জিনিস কিনতে পারো।”
তূর্য অরুণিকাকে বলল,
“দর কষাকষি করতে হয়, টুইংকেল।”
অরুণিকা বলল, “তুমি তো করো না।”
আহনাফ বলল,
“লাখপতি তাই। একটা এলবাম বের হলেই তো ও লাখপতি হয়ে যায়। তুমি বরং লাখপতির সাথেই ঘুরো। আমার বাইকের দিকে নজর দিও না।”
অরুণিকা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আমি তো মজা করেছি। সত্যি সত্যি বলি নি তো।”
আহনাফ বাঁকা হেসে সোফায় গিয়ে বসলো। অরুণিকা আহনাফের পাশে বসে বলল,
“আমি কিন্তু প্রথম তোমার বাইকে চড়বো বলেছি। আর ছোটদের দিয়ে কিছু শুরু করলো বরকত আসে।”
আহনাফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তুমি ছোট?”
“অবশ্যই। আঠারো বছরের নিচে সবাই শিশু।”
অরুণিকা কথাটি বলেই দাঁত বের করে হাসি দিলো। পরের দিন আহনাফ তার বাইক বের করলো। অরুণিকা গ্যারেজে এসে বাইকটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। আহনাফ বুকে হাত গুঁজে অরুণিকার সেই হাসিটাই দেখছে। এবার সে নিজে হেলমেট পরে অরুণিকাকেও ছোট একটা হেলমেট পরিয়ে দিলো৷ তারপর বাইকে উঠে বসলো। বাইক সোজা করে চাবি ঘুরিয়ে বলল,
“উঠে বসো।”
অরুণিকা বলল,
“আমি উঠতে পারবো না।”
“এই হাতলের ভার দিয়ে উঠো।”
অরুণিকা হাতলের উপর পা দিয়ে সিটের উপর ঝুলে পড়লো। তার পা দু’টি একপাশে ঝুলছে, মাথাটা অন্য পাশে ঝুলছে। ইমন দূর থেকে অরুণিকাকে দেখে হেসে দিলো। আহনাফ পিছু ফিরে দেখলো অরুণিকা বাইকের উপর ঝুলে আছে। সে বিরক্তির সুরে বলল,
“বানরের মতো ঝুলে আছো কেন? সোজা হয়ে বসো।”
অরুণিকা আবার হাঁটু দুইটা বাইকের উপর উঠিয়ে পেছন দিক থেকে আহনাফের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আহনাফ, আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। আমি পড়ে গেলে?”
ইমন তাদের কাছে এসে অরুণিকাকে ধরে সোজা ভাবে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“এভাবেই বসতে হয়।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি কিভাবে বুঝবো, আমি আগে কখনো বাইকে উঠেছি, বলো?”
আহনাফ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল,
“শক্ত করে ধরে বসো।”
অরুণিকাও আহনাফের কথামতো তাকে এতো শক্ত করেই চেপে ধরেছে যে তার শার্টটাই নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অরু, আমার শার্টের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি তো তোমাকে এভাবে চেপে ধরতে বলি নি।”
“তোমার এই শার্ট বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাকি আমি?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা বলল,
“আরেহ এভাবে চোখ দুইটা জোঁকের মতো না বাঁকিয়ে বাইক সামনে নিয়ে যাও। এখনো এক জায়গায় বসে আছো কেন?”
আহনাফ বাইক চালিয়ে গ্যারেজ থেকে বের হতেই অরুণিকা বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“রোলারকোস্টারের মতো টানছো কেন? আস্তে চালাও।”
“এটা রিক্সা না যে আস্তে চলবে।”
“এইটা কেমন বাইক! দুইপাশে হ্যান্ডেল রাখবে না? এখন আমি পড়ে গেলে?”
“আজব তো! তোমার জন্য নতুন পদ্ধতিতে কে বাইক তৈরী করবে? বাইক এমনই হয়। চড়লে চড়ো, নয়তো নামো। আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করো না।”
অরুণিকা আহনাফের কথায় চুপ হয়ে গেল। কিন্তু অর্ধেক যেতে না যেতেই সে চিৎকার করতে লাগলো। আহনাফ বাইক থামিয়ে বলল,
“তোমার কি মাথায় সমস্যা আছে?”
অরুণিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“তোমার বাইক তো রোলারকোস্টারের চেয়েও বেশি ভয়ংকর। আমি যাচ্ছি না তোমার সাথে।”
অরুণিকা বাইক থেকে নামার আগেই আহনাফ বলল,
“আচ্ছা, তুমি সামনে বসো। তখন আর ভয় পাবে না।”
আহনাফ অরুণিকাকে সামনে বসিয়ে আবার বাইক স্টার্ট দিলো। অরুণিকা যদিও এবার চুপচাপ বসে রইল, কিন্তু সে তার হাত দুইটা আহনাফের হাতের সাথে পেঁচিয়ে রেখেছে। এরপর শপিং শেষে ফেরার সময় অরুণিকা আহনাফের দিকেই ঘুরে বসলো। আহনাফ বলল,
“এভাবে বসেছো কেন, সোজা হয়ে বসো।”
অরুণিকা বলল,
“রাস্তার দিকে তাকাতে ভয় লাগছে।”
“তাহলে চোখ বন্ধ রাখো।”
“না।”
অগত্যা আহনাফ রাজি হলো। অরুণিকা যদিও নিজের সুবিধামতো বসলো। কিন্তু আহনাফের খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। অরুণিকা আহনাফের মনের অবস্থা বুঝতে পারলো না। এই বয়সে তার বোঝার কথাও না। ছোটবেলা থেকেই সে ছ’জনের কোলে কোলেই বড় হয়েছে। তাই সে বুঝতে পারছে না, সে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।
আহনাফ দাঁতে দাঁতে চেপে রেখেছে। বাইকের হাতলটাও শক্ত করে ধরে রেখেছে, তার দৃষ্টি একদম সামনের দিকে। যতোটুকু সম্ভব বাইকের স্পিড বাড়িয়ে সে বাসায় পৌঁছালো। অরুণিকা নামতেই সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এদিকে অরুণিকা প্যাকেটগুলো নিয়ে ধিন ধিন করে উপরে চলে গেলো। আর আহনাফ বাইক গ্যারেজে পার্ক করিয়ে সামনের দোকান গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো৷ ইদানীং তার এই বাজে অভ্যাসটা বেড়ে যাচ্ছে। ইমন থেকেই মূলত এই অভ্যাস তার কাছে এসেছে। সায়ন্তনীর মৃত্যুর পর থেকেই মানসিক চাপ মুক্ত থাকার জন্য ইমন সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে। কারণ তার মনে হচ্ছে, একটা অসুস্থ মানুষকে সে অনেক বড় আঘাত দিয়েই এই পৃথিবী থেকে বিদায় দিয়েছে। আর ইমনের দেখাদেখি এখন আহনাফও সিগারেট খায়। দু’জনই মানসিক চাপে আছে। ইমনের মানসিক চাপের যথাযথ কারণ আছে, কারণ আরাফ সায়ন্তনীর মৃত্যুর পর থেকেই চুপচাপ হয়ে গেছে, আর তার সাথে অনেক কম কথা বলে। অন্যদিকে আহনাফ অরুণিকার কাছে আসা, দূরে যাওয়া, তূর্যের সাথে সখ্যতা, তার অভিযোগের কারণ হওয়া, মোটামুটি অরুণিকার সব বিষয়েই সে মানসিক চাপে পড়ে যায়। এখন অরুণিকা যতোই বড় হচ্ছে, আহনাফ ততোই পাগল হয়ে যাচ্ছে। তাকে হারানোর ভয় আগে থেকে আরো বেশি বেড়েছে। আর অনুভূতিগুলো দিন দিন গাঢ় হয়ে যাচ্ছে।
চলবে —
(পরের বোনাস পর্বে দার্জিলিং ট্যুর হবে)#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০২||
৬২.
উপমা ফোন হাতে নিয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। পাশেই তার ভাই আদিল দাঁড়িয়ে আছে। বোনকে লাফাতে দেখে সে বলল,
“এভাবে ক্যাঙ্গারুর মতো লাফাচ্ছিস কেন?”
“ভাইয়া, রিকি নতুন গান ছেড়েছে। ওয়াও।”
উপমা হেডফোন লাগিয়ে ফোনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। আদিল বোনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। ভিডিওটা একটা কটেজের সামনে করা হয়েছে। সামনে একটা উঁচু ঢিপিতে পা রেখে গিটার হাতে নিয়ে রিকি দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনের ঢালু বেয়ে নেমে গেছে ছোট ছোট ঘাসের সারি। নিচে আরো কটেজ দেখা যাচ্ছে, আর মুখোমুখিতে অনেকগুলো পাহাড়। সব পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে সাদা সাদা মেঘ। ভিডিওটা পেছন দিক থেকে করা হয়েছে। আর রিকি গিটার বাজিয়ে তিনটা গানের মিশ্রণে ভিডিওটি বানিয়েছে। উপমা চোখ বন্ধ করেই সেই গান শুনছে।
“ইয়ে দোস্তি…হাম নাহি তোরেঙ্গে,
তোরেঙ্গে দাম আগার, তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে
.
ধারকান ইয়ে কেহতি হে,
দিল তেরে বিন ধারকে না,
এক তুহি ইয়ার মেরা
মুঝকো কিয়া দুনিয়া সে লেনা….
.
উড়ি একসাথে নীলে নীলে,
উড়ি একসাথে মিলে ঝিলে।
চল বন্ধু চল, চল বন্ধু চল, চল বন্ধু… চল।
.
তেরি জিত মেরি জিত,
তেরি হার মেরি হার
শুন ইয়ে মেরা ইয়ার
তেরা গাম মেরা গাম
তেরি জান মেরি জান
এইসে আপনা পিয়ার
জান পে ভি খেলেঙ্গে
তেরা লিয়ে লে লেঙ্গে
সাবসে দুশমানি
ও…
.
উড়ি একসাথে নীলে নীলে,
উড়ি একসাথে মিলে ঝিলে।
চল বন্ধু চল, চল বন্ধু চল, চল বন্ধু… চল।
.
লাগলে বলিস,
জায়গায় বসে আওয়াজ দিস।
কলিজাটা ছিঁড়ে তোকে দেবো
লবণ মাখিয়ে নিস।
একা লাগলে বলিস,
মনে মনে আমার নামটা নিস,
তোর মুড অন করে দেবো,
একটা ট্রিট দিয়ে দিস।
উড়ি একসাথে নীলে নীলে,
উড়ি একসাথে মিলে ঝিলে।
চল বন্ধু চল, চল বন্ধু চল, চল বন্ধু… চল।”
ভিডিওটা শেষ হওয়ার পর উপমা একটা প্রশান্তির হাসি হাসলো। মনে মনে বলল,
“যার কন্ঠ এতো মিষ্টি, সে দেখতে কেমন হবে? তার মনটা কেমন হবে? রিকি, দা স্টার… না, না, মাই স্টার। আমি তোমাকে না দেখেই ভালোবেসে ফেলেছি। এটা কি সম্ভব? কাউকে কি না দেখে ভালোবাসা যায়?”
এদিকে তূর্য পেছন ফিরে তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। আহনাফ এতোক্ষণ বসে বসে তার ভিডিও শুট করছিল। তূর্য আরাফ আর ইমনের মাঝখানে বসে বলল,
“শুনেছি বন্ধুরা পরিবারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কখনোই হয় না। কিন্তু আমরা পরিবার হারিয়ে যেই পরিবার পেয়েছি, সেটা আমাদের বন্ধুত্ব থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ছোটবেলা থেকেই বন্ধু। কিন্তু পরিবারের মতো আছি আজ আট বছর ধরে। অতীতে যা হয়েছিল, সব ভুলে আমাদের একটা নতুন জীবন শুরু করা উচিত। প্লিজ, আগের সবকিছু ভুলে যা।”
তূর্যের কথা শুনেও আরাফের কোনো হেলদোল দেখলো না ইমন। এখনো আরাফ চুপ করে বসে আছে। এবার ইমন শুকনো হাসি দিয়ে পকেট থেকে একটা সিগারেটের পকেট বের করলো। তারপর ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট রেখে বলল,
“পাপীদের সাথে কোনো বন্ধুত্ব হয় না। আমি তো পাপী। আমি তো খুনী।”
আরাফ রাগী দৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন সিগারেট জ্বালানোর আগেই সে সিগারেটটা টেনে নিয়ে বলল,
“এমন শান্তির পরিবেশটা কি দূষিত করবি?”
ইমন বলল,
“আমার একটা সিগারেটে এই পরিবেশ দূষিত হবে না।”
“এখানে অরু আছে। তোর জন্য অরুর সমস্যা হবে।”
অরুণিকা নিজের নাম শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকালো। এতোক্ষণ সে অন্যদিকে তাকিয়ে মানুষের যাওয়া-আসা দেখছিল। এবার ইমন বলল,
“অরুণিকার এতো আহামরি ক্ষতি হবে না৷ ক্ষতি হলে আমি অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি।”
ইমন উঠতে যাবে তখনই আরাফ বলে উঠলো,
“সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।”
“আমাকে তোর ডাক্তারি জ্ঞান দিতে আসিস না।”
তূর্য হাত উঁচু করে তাদের মাঝখান থেকে উঠে একপাশে এসে দাঁড়ালো। তাহমিদ তার পাশে এসে বলল,
“আগুনে ঘিঁ ঢেলে দিয়েছিস।”
“থাক, এই ঘিঁ যদি এখন পানিতে রূপান্তর হয়, তখনই আবার সব ঠিক হবে।”
অনেকক্ষণ ধরেই ইমন আর আরাফের বাকবিতণ্ডা চললো। এক পর্যায়ে দু’জনই শান্ত হয়ে দু’দিকে চলে গেলো। ইভান বলল,
“শতাব্দীকে আনলাম না, মাওশিয়াতকে আনতে পারবো না তাই। আরাফ আবার মাওশিয়াত আর ইমনকে দেখলে আরো মন খারাপ করে ফেলবে। কিন্তু শতাব্দী আসলে ভালোই লাগতো। মেয়েটা ভালোই রসিক।”
তূর্য বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
“বাহ, ইভান দেখছি শতাব্দীকে খুবই মিস করছিস!”
তাহমিদ ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই ওকে মিস করছিস?”
আহনাফ, তূর্য আর ইভান তাহমিদের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দিল। তাহমিদ বলল,
“তোরা হাসছিস কেন? অদ্ভুত তো!”
তাহমিদ উঠে একপাশে চলে গেলো। সে এখন হাঁটতে পারে। তবে বেশিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে তার হাঁটুতে ব্যথা করে, এমনকি সে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না।
এদিকে উপমা রিকির সেই ভিডিওটির কমেন্ট বক্সে ঘুরে এলো। সবার কমেন্ট দেখে সে বুঝলো, রিকি দার্জিলিং থেকেই এই ভিডিওটি ছেড়েছে। সে শুধু রিকিকে একনজর দেখার জন্য দৌঁড়ে বাবার কাছে গিয়ে বলল,
“আমি দার্জিলিং যেতে চাই।”
উপমার কথা শুনে আদিল আর করিম সিদ্দিক অবাক হয়ে উপমাকে দেখছে। আদিল কি ভেবে তার ফোনটা হাতে নিলো। তারপর কিছুক্ষণ পর বলল,
“আচ্ছা, তা-ই?”
করিম সিদ্দিক বললেন, “কি তাই?”
আদিল বলল,
“তোমার মেয়ের সেই রিকি দা স্টার এখন দার্জিলিংয়ে।”
“তুই কিভাবে জানলি?”
“আরেহ, তোমার মেয়েই তো জোর করে আমাকে সেই রিকির পেইজ আর ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করিয়েছে। এখন সেই ছেলের সব আপডেট আমার ফোনেও আসে।”
মিসেস জুলেখা নাক সিঁটকে বললেন,
“রিকি! কেমন জঙ্গলি নাম! নাম শুনেই মনে হচ্ছে কোনো বখাটে ছেলে।”
উপমা রাগ দেখিয়ে বলল,
“মা, রকস্টারদের নাম এমনই হয়।”
এবার উপমার জোরাজুরিতে মিসেস জুলেখাও রাজি হতে বাধ্য হলেন। করিম সিদ্দিক আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। কারণ তিনি স্ত্রী-কন্যাকে আজকেই রাজি করিয়ে দার্জিলিং যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু এখন উপমা নিজ থেকেই রাজি হয়ে গেছে, তাই তাকে আর কষ্ট করতে হয় নি। পরেরদিন উপমা তার বাবা-মা আর ভাইয়ের সাথে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্য রওনা দিলো।
৬৩.
রাস্তার দু’পাশে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আছে এক একটা কাঠের তৈরী কটেজ। পাশাপাশি দুইটা রুমের একটা কটেজে তারা উঠলো। সামনের কটেজে তাহমিদ, তূর্য আর ইভান। এর পাশের কটেজে আরাফ আর অরুণিকা। দূরের আরেকটা কটেজে ইমন আর আহনাফ উঠেছে। তারা সকালে নাস্তা করেই পাহাড়ের রাস্তা বেয়ে চা বাগানের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। একপাশে ঢালু রাস্তা নিচে নেমে চমৎকার দৃশ্য তৈরি করেছে, অন্যপাশে সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা ছোট ছোট টিলার মতো উঁচু রাস্তাগুলো সরু হাঁটার পথটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অরুণিকা আহনাফের টি-শার্টের কোণা ধরে পাহাড়ের নিচের দিকে পা উঁচিয়ে দেখছে। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি আমার টি-শার্টটা নষ্ট করে ফেলছো। এভাবে ভাঁজ করে ফেলছো কেন? ছাড়ো তো।”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে আরো শক্ত করে টি-শার্টটা আঁকড়ে ধরলো। টি-শার্টের অনেকখানি অংশ অরুণিকার হাতের মুঠোয় চলে আসায়, আহনাফের টি-শার্টের গলাটা নিচের দিকে নেমে গেছে। যার ফলে তার অনেক অস্বস্তি লাগছিল। সে অরুণিকার হাতের মুঠো থেকে তার টি-শার্টের অংশটি ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে শান্তিতে হাঁটতে দাও।”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে সামনে গিয়ে তূর্যের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“রকস্টার, আমার ভয় লাগছে। আমি তোমার শার্ট ধরে রাখি?”
তূর্য মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা।”
অরুণিকা মুচকি হেসে পেছনে ফিরলো। আহনাফ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে সামনে ফিরলো। আহনাফ তাদের পাশ কেটে আরো সামনে এগিয়ে গেলো।
এদিকে উপমা তার পরিবারের সাথে ভারতে চলে এসেছে। করিম সিদ্দিক ট্রেনের টিকেট কেটে নিলেন। এরপর তারা ট্রেনে উঠে বসলো। ট্রেনটি শুকনো বনের ভেতরে দিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের গতি সাধারণ গতির তুলনায় কম। আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে ট্রেনটি যাচ্ছে। উপমা জানালার বাইরে তাকিয়ে রিকির ভাবনায় ব্যস্ত। প্রতিটা রাস্তা পার করতেই তার মন তাকে বলছে,
“এই রাস্তা দিয়েই হয়তো রিকি এসেছে। এই রাস্তাটা রিকির পরিচয়ের সাক্ষী হয়ে আছে। এই পথ, তুমি কি আমার সাথে একটু কথা বলবে? তুমি কি বলবে রিকি দেখতে কেমন? ও যখন গানের ফাঁকে হাসে, তখন ওর হাসিটা কল্পনায় আমার কাছে স্বপ্নে দেখা ঝর্ণার মতো, একদম চঞ্চল, আর দুর্লভ। ও বাস্তবেও কি ঠিক আমার স্বপ্নের মতোই হাসে?”
উপমা এসব ভাবছে, আর আনমনে হাসছে। আদিল বোনকে ধাক্কা দিতেই উপমা নড়েচড়ে বসলো। আদিল বলল,
“একা একা হাসছিস কেন? মাথা কি আউট হয়ে গেছে?”
উপমা হেসে বলল,
“হ্যাঁ। জানো, আমার ভাবতেই অনেক ভালো লাগছে যে আমি রিকিকে দেখবো।”
“এতোগুলো মানুষের মধ্যে তুই রিকিকে কিভাবে চিনবি? তুই তো ওর চেহারায় দেখিস নি।”
“ভাইয়া, মাঝে মাঝে তো একটু বুদ্ধিমানের মতো কথা বলো। রিকি একজন স্টার৷ ওর মধ্যে আলাদা একটা ভাব থাকবে। হাতে গিটার থাকবে। আশেপাশে ভীড় থাকবে।”
“ওকে তো কেউই দেখে নি। ভীড় কেন থাকবে?”
“আমার মনে হচ্ছে ভীড় থাকবে। স্টাররা এমনই হয়। কেউ না চিনলেও সবার কাছে পরিচিতি পায়।”
আদিল বোনের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকালো। দার্জিলিং পৌঁছে তারা একটা রিসোর্টে উঠল। তূর্যরা যেই রিসোর্টে উঠেছিল, সেটা ওতো বেশি উন্নতমানের না। আর উপমারা এখানকার সবচেয়ে উন্নত রিসোর্টেই উঠেছে।
রাতে কটেজের বাইরে বসে দাঁড়িয়ে গান গাইছে তূর্য। ঘুমানোর আগে সেই গানটিও পেইজে আপলোড করেছে সে। উপমা রুমে শুয়ে শুয়ে সেই গানটি শুনছে। গান শুনার পর সে কমেন্টে লিখল,
“তোমাকে দেখার ইচ্ছেটা কি স্বপ্নই থেকে যাবে?”
এদিকে আহনাফ বসে বসে তূর্যের পেইজের কমেন্ট পড়ে সবাইকে শুনাচ্ছে। তাহমিদ এসব কমেন্টগুলো শুনে বলল,
“শুনেছি, ছেলেরাই মেয়েদের পিছনে ঘুরতে থাকে। কিন্তু মেয়েরাও যে কম না, আজ এই কমেন্টগুলো দেখেই বুঝেছি।”
ইভান বলল,
“সবকটাই ছ্যাঁচোর। ভদ্র মেয়েরা এমন উদ্ভট কমেন্ট করবে না।”
তূর্য বাঁকা চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর তো মন বলতে কিছুই নেই। তাই তোর এসব উদ্ভট লাগছে। এগুলোকে বলে ভালোবাসা। দেখ, রিকি দা স্টারকে ভালোবাসে না এমন মেয়ে খুঁজে পাবি না। তোকে ক’জন বাসে?”
“আমার এতো ভালোবাসার প্রয়োজন নেই।”
পরের দিন সকালে তারা আবার ঘুরতে বেরিয়ে পড়লো। তারা ক্যাবল কারে উঠলো, যা মাটি থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট উঁচুতে। ক্যাবল কারটি মেঘের ভীড়ে চলছে। অরুণিকা উৎসুক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। আর আহনাফ অবাক হয়ে অরুণিকাকে দেখছে। তার চাহনী দেখে আরাফ তাকে হালকা ধাক্কা দিতেই সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। আরাফ ইশারায় তাকে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে বলল। ক্যাবল কার থেকে নেমে আরাফ আহনাফকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলল,
“আহু, কি করছিলি তুই?”
আহনাফ আমতা-আমতা করে বলল,
“কি করছিলাম আমি?”
“তোর চোখ-মুখ দেখে সব বোঝা যাচ্ছে। অরু থেকে একটু দূরত্ব রাখার চেষ্টা কর।”
“কেন দূরত্ব রাখবো? তুই তো জানিস….”
আরাফ আহনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ওর প্রেম করার বয়স হয় নি। ও এখন সব বুঝে। দেখিস না ইমন আর মাওশিয়াতকে একসাথে দেখলে কিভাবে হাসে। আর শতাব্দীও বাসায় আসলে ও তাহমিদকে শতাব্দীর সাথে ব্যস্ত রাখার ফন্দি আঁটে। এখন তোরটা বুঝলে তুই ঘরে থাকতে পারবি?”
“ঘরে থাকতে পারবো না কেন?”
“অস্বাভাবিক লাগবে দেখতে৷ বুঝিস না কেন এসব?”
“তো, তুই কি বলতে চাচ্ছিস? আমি ওকে ভুলে যাবো?”
“না আহনাফ। আগে ওর আঠারো হোক। এরপর আমি তোদের বিয়ে দিয়ে দেবো৷ এখন বাকিরাও এসব জানে না। ইভান হয়তো একটু আধটু বুঝে। কিন্তু ও নিজেও এটা নিয়ে কথা উঠাচ্ছে না। কেন বুঝতে পারছিস নি?”
“কেন?”
“দেখ, এখন ইমন আর মাওশিয়াত একটা সম্পর্কে আছে। কিন্তু তারা আলাদা বাসায় থাকছে। তাই বিষয়টা দেখতে ওতোটা খারাপ লাগছে না। আর তুই এখন আগাতে চাইলে এক ঘরে থাকলে সুন্দর দেখাবে না৷ সারাদিন তখন একসাথে সময় কাটাবি। তখন কোনো কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে, এসব আমরা নিতে পারবো না। ও আগে বড় হোক। এরপর একেবারে বিয়েই হবে। এর আগে কিছুই না।”
আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ওতো আমাকে পছন্দ করে না।”
আরাফ এবার জোর গলায় বলল,
“ওর এখন এসবের বয়স হয় নি। বারো বছরের মেয়ের সাথে কি প্রেম করবি তুই? মাথা ঠিক আছে তোর?”
আরাফের ধমক খেয়ে আহনাফ চুপ হয়ে গেলো। বাকি সময়টা সে অরুণিকার আশেপাশেও যায় নি। দূর থেকেই তাকে দেখেছে।
এবার তারা চুন্নু সামার ফল পার্কে টিকেট কেটে ঢুকলো। তারা ঢোকার একটু পরই আদিল চারটা টিকেট কাটলো। করিম সিদ্দিক তার স্ত্রী জুলেখার হাত ধরে একপাশে হাঁটছেন। আদিল ক্যামেরা হাতে আশেপাশের ভিডিও ধারণ করছে। আর উপমা এখনো কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনায় ব্যস্ত। সে গান শুনে শুনে হাঁটছে।
এদিকে তূর্য ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ঝর্ণার পানি উপর থেকে বেয়ে পাথরের ফাঁক দিয়ে ধেয়ে চলছে। আর পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে সেই পানি ধারার চমৎকার ধ্বনি সৃষ্টি হচ্ছে। তূর্য মনে মনে ভাবছে, গিটার সাথে থাকলে এখানে বসে একটা ভিডিও শুট করা যেতো। তখনই একটা শব্দ কানে আসতেই সে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো, ভেজা রাস্তায় পা ফেলতে গিয়ে একটা মেয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেছে। মেয়েটার ব্যথায় কাতর মুখ দেখে কেন যেন তূর্যের অনেক হাসি পেলো। যদিও সে এতোক্ষণ হাসি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিল, কিন্তু মেয়েটি তার দিকে তাকানোর পরই সে শব্দ করে হেসে দিলো। মেয়েটি তূর্যকে হাসতে দেখে লজ্জায় একেবারে নুইয়ে পড়েছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগলো। তখনই একটা ছেলে দৌঁড়ে এগিয়ে এলো।
উপমা আদিলের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। আদিল ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ব্যথা পেয়েছিস?”
উপমা কিছু বললো না। সে আঁড়চোখে তার সামনে থাকা ছেলেটির দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“কি অসভ্য ছেলে! একটা মেয়ে দুর্ঘটনাবশত নিচে পড়ে গেছে, আর সে দাঁত দেখিয়ে হাসছে?”
উপমা নিজের ভাব ধরে রাখার জন্য ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে জোর গলায় বলল,
“আপনার তো দেখছি বিন্দুমাত্র বিবেক নেই। রাস্তায় চলার পথে কতো এক্সিডেন্ট হয়। তখন কি আপনি এভাবে খিকখিক করে হাসেন?”
উপমার কথা শুনে তূর্যের এবার আরো বেশি হাসি পেলো। সে নিজের হাসি আটকাতে অন্যদিকে ঘুরে হাঁটতে লাগল। উপমা পিছু যাবে তখনই আদিল বলল,
“বাদ দে না। পাগল নাকি তুই? ছেলেটা হাসলে তোর সমস্যা কি?”
“ভাইয়া ওই বদমাশটা আমাকে দেখে হাসছিল।”
আদিল উপমাকে শান্ত করে তার সাথে নিয়েই হাঁটতে লাগলো। এদিকে তূর্য হাসি থামিয়ে পেছন ফিরে উপমাকে খুঁজতে লাগলো। ইভান তার সামনে এসে বলল,
“কাকে খুঁজছিস?”
“একটা আপন মানুষকে খুঁজছি।”
“মানে?”
“একটা মেয়েকে খুঁজছি। কথাবার্তার ধরণ দেখে মনে হলো আমাদের দেশের। কতো বছর পর বাংলাদেশী কন্ঠ শুনেছি!”
“কেন আমাদের কন্ঠ কি বিদেশী নাকি!”
“তা না। কিন্তু মেয়েলী কন্ঠ আট বছর পর শুনেছি৷ আর টুইংকেল তো রিমিক্স ভাষায় কথা বলে। সেই ভাষায় না আছে পুরোপুরি কলকাতার এক্সেন্ট, না আছে চট্টগ্রামের স্পর্শ। ওর কথাবার্তা শুনলে একেবারে জগাখিচুরি মনে হয়।”
ইভান হেসে বলল,
“ওর এই জগাখিচুরি ভাষাটার জন্যই ওর কথাগুলোর মধ্যে আলাদা মাধুর্য আছে। নয়তো ও যা ক্লু লেস কথা বলে, কেউ এক সেকেন্ডও শুনতে চাইবে না!”
তূর্য আরেকবার পেছন ফিরে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,
“মেয়েটা আমাদের চট্টগ্রামের মেয়ে!”
তূর্য পুরো পার্কে শুধু উপমাকেই খুঁজেছে। সে ভাবছে, দেখা হলে হাসার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে৷ কিন্তু সে আর উপমাকে পেলো না।
চলবে—#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৭||
৬৪.
রাতে কটেজের বাইরে ফায়ারপ্লেস তৈরি করে সবাই গোল হয়ে বসলো। তূর্য তার গিটার নিয়ে এসে বলল,
“চল, একটা গেইমস খেলি।”
অরুণিকা উৎসাহ নিয়ে বলল,
“আমিও খেলবো।”
“আচ্ছা। কিন্তু টুইংকেল, গেইমসটা তোমার জন্য একটু কঠিন হবে।”
আরাফ বলল,
“সমস্যা নেই। ও যতোটুকু পারবে আর কি।”
“আচ্ছা, এখন খেলাটা হচ্ছে, আমি যেকোনো পাঁচটা গানের যেকোনো অংশের সুর গিটারে তুলবো। সুরগুলো কিন্তু মনে রাখতে হবে। তারপর সেই পাঁচটা গান এক একজনকে দেওয়া হবে। যার ভাগ্যে যেই গান পড়বে। আর এরপর তাকে জিজ্ঞেস করবো সেটা কোন গান। যারা পারবে না, তাদের আমার ইচ্ছেমতো একটা প্রশ্ন করবো। উত্তর দিতে না চাইলে এক চামচ লবণ খেতে হবে।”
ইমন অবাক হয়ে বলল,
“এক চামচ লবণ! এটা কেমন আজগুবি শর্ত!”
“এই শর্ত মানতে না চাইলে, সত্য কথা বলতে হবে। সঠিক উত্তর দিলেই তো ঝামেলা শেষ।”
ইভান বলল,
“কিন্তু লবণ কোথায় পাবি?”
তূর্য তার পাশে থাকা একটা পলিথিন দেখিয়ে বলল,
“নিয়ে এসেছি।”
এরপর খেলা শুরু হলো। তূর্য গিটারে সুর তোলার আগে বলল,
“তাহমিদ সাবধান! না পারলে সব তথ্য ফাঁস হতে পারে।”
যদিও তূর্য এই কথা তাহমিদকেই বললো, কিন্তু তার মনোযোগ আহনাফের দিকে। সে মনে মনে ভাবছে,
“আজ তো আমি কিছু একটা করবোই, আহনাফ। তোর মাথায় কি চলছে, এটা বের করার জন্যই তো এই খেলার আয়োজন করেছি।”
মোট ছ’টা গানের ছন্দ তুলে তূর্য বলল,
“আরাফ দ্বিতীয়টা বল।”
খুবই পরিচিত গান হওয়ায় আরাফ সহজে উত্তর দিয়ে দিলো। ইভান আর ইমনও একইভাবে পেরে গেলো। এবার তাহমিদকে দিলে সে কোনোভাবেই গানটা মনে করতে পারছিলো না। তাই এবার তূর্য তাহমিদকে জিজ্ঞেস করলো,
“এখন যেহেতু পারিস নি, তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে তুই বাধ্য।”
তাহমিদ বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। দেবো।”
“প্রশ্ন হচ্ছে, তুই কি শতাব্দীকে ভালোবাসিস?”
তাহমিদ হালকা হেসে বলল,
“আমি জানতাম তোর মাথায় এমন উদ্ভট প্রশ্নই আসবে। তাই আমি প্রস্তুত ছিলাম। আর আমার উত্তর হচ্ছে, না। আমি ওকে ভালোবাসি না। ভালোবাসা এতো সহজ না যে হুট করে হয়ে যাবে।”
“তাহলে কি পছন্দ করিস?”
“একটাই প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল, যার উত্তর দেওয়া শেষ।”
“ঠিক আছে। এখন শতাব্দীকে এই কথা জানানো উচিত।”
তাহমিদ খানিকটা চমকে উঠলো। পরক্ষণেই বলল,
“আমার সমস্যা নেই।”
এবার অরুণিকা আর আহনাফ দু’জনই তূর্যের দেওয়া গানের সুরটা ধরতে পারলো না। যদিও তূর্য আহনাফকে ইচ্ছে করেই কঠিন সুরটাই ধরিয়ে দিয়েছিল, যেই গান আহনাফ কখনোই শুনে নি। এদিকে অরুণিকা না পারায় তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, সে ছ’জনের মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। অরুণিকার উত্তর ছিল আরাফ। আর এরপর তূর্য আহনাফকে প্রশ্ন করল,
“ছোটবেলায় টুইংকেলকে তুই সহ্যই করতে পারতি না, এখন ওর মনোযোগ খোঁজার কারণ কি?”
আহনাফ আর আরাফ দু’জনই এই প্রশ্নে চমকে উঠলো। ইভান তূর্যের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। কারণ অরুণিকাও সেখানে উপস্থিত আছে। কিন্তু তূর্য তাতে ভ্রূক্ষেপ করলো না। এদিকে ইমন আর তাহমিদও আহনাফের উত্তর শুনার জন্য কৌতূহলি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ এবার অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকাও তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে হালকা কাশি দিয়ে বলল,
“ও যখন ছোট ছিল, তখন খুব দুষ্টু ছিল। এখন সব কথা শুনে।”
তূর্য হেসে বলল,
“আমার প্রশ্নের উত্তর তো এমন হওয়ার কথা না।”
“তাহলে তোর প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমি জানি না।”
“তাহলে এক চামচ লবণ খেতে পারবি?”
“হুম পারবো।”
তূর্য এবার অরুণিকাকে বলল,
“টুইংকেল, তুমি কিন্তু নিজ হাতে খাইয়ে দেবে।”
অরুণিকা মাথা নেড়ে এক চামচ লবণ আহনাফের সামনে নিয়ে গেলো। আরাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“তূর্য, মজার ছলে বাড়াবাড়ি করবি না কিন্তু। অতিরিক্ত লবণ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।”
তূর্য বলল,
“এক চামচ লবণ খেলে কিছু হবে না।”
আহনাফ বলল, “সমস্যা নেই। আমি খেতে পারবো।”
অরুণিকা একবার আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ তাকে ইশারায় না করলো। অরুণিকা এবার আহনাফের মুখের কাছে চামচ নিয়ে সেটি হালকা বাঁকিয়ে অর্ধেক লবণ আহনাফের শার্টের উপর ফেলে দিলো। চামচে অল্প একটু লবণ ছিল সেটাই আহনাফ বুঝে উঠার আগেই তার মুখে ঢুকিয়ে দিলো। অরুণিকা আহনাফকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে বিধায়, বিষয়টা তূর্য খেয়াল করলো না। শুধু আহনাফই বুঝলো, তাও ঘটনা ঘটার সেকেন্ড খানিক পর। পরে সে বিষয়টা পুরোপুরি ঢাকার জন্য দাঁড়িয়ে গেল, যাতে সব লবণ মাটিতে পড়ে যায়। আর এমন ভান করলো, যা দেখে মনে হবে, লবণ খেয়ে তার অনেক খারাপ লাগছে। এবার আহনাফ সোজা তার রুমে চলে গেলো। অরুণিকাও পিছু পিছু গেলো। গিয়ে দেখলো আহনাফ একপাশে বসে আছে। অরুণিকা তার পাশে বসে বলল,
“দেখেছো, আমি তোমাকে কেমন লবণ থেরাপি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি।”
আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ দেখলাম।”
“এখন আমাকে কি দেবে?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোমার এতো ঘুষ কেন লাগে?”
“এটাই তো আমার আয়ের একমাত্র পথ। তোমরা বাইরে গিয়ে কাজ করো। আমাকে তো যেতে দাও না। তাহলে আমি কিভাবে টাকা পাবো? এই ছোটখাটো কাজ বা সাহায্যের পরিবর্তে আমাকে টাকা দেবে। তোমারও কাজ হয়ে যাবে, আমিও কিছু আয় করলাম।”
আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে হালকা হেসে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“যা ইচ্ছে নাও।”
অরুণিকা পুরো মানিব্যাগ খালি করে দিয়ে বলল,
“থাক, সবই নিয়ে নিলাম। ইচ্ছেমতো নিতে গেলে, তোমার ওই বড় আলমারিতে যেই টাকার ব্যাগ আছে, ওইটাও খালি হয়ে যাবে।”
আহনাফ তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই সে উঠে চলে গেলো।
সকালে তূর্য রুম থেকে বের হয়ে আশেপাশে একা একা হাঁটতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর সে দেখলো একটা বেঞ্চের উপর গতকালকের সেই মেয়েটি বসে আছে। তূর্য এই মুহূর্তে সেই মেয়েটিকেই পটানোর উদ্দেশ্যে সামনে এগুচ্ছে।
তূর্যের একটা অভ্যাস হলো, মেয়ে পটানো। সে সব মেয়েদের সাথেই এমন ভাবে কথা বলবে, যাতে মেয়েরা তার প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু সে কারো ব্যাপারেই ওতোটা গম্ভীর হয় না। কারণ প্রেমে ফেলা আর প্রেম করা দুইটা তার কাছে দুই মেরুর মুহূর্ত। প্রেমে ফেলা তার দৃষ্টিতে মানসিক আনন্দ, প্রেম করা তার দৃষ্টিতে মানসিক অশান্তি। মূলত তাকে প্রেমে অনাগ্রহী করে তুলেছে তার বন্ধুদের বিগত সময়ের মর্মান্তিক সম্পর্কগুলো।
তূর্য এবার মেয়েটির পাশে বসে পড়ল। মেয়েটি কান থেকে হেডফোন খুলে তূর্যের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। উপমা ভালোভাবে তূর্যকে দেখে বললো,
“আপনি তো গতকালকের সেই ফাজিল ছেলে!”
তূর্য কোনো উত্তর না দিয়ে উপমার দিকে তাকালো। হঠাৎ উপমা মনে মনে ভাবলো,
“আরেহ, এটা তো ইন্ডিয়া, এই ছেলে হয়তো আমার বাংলা ভাষা বুঝছে না।”
এবার উপমা ভাঙা ভাঙা কন্ঠে ইশারায় ছেলেটিকে বলল,
“মেনে কাল নিচে পারা। তুম হাসা, হোয়াই?”
উপমার কথা শুনে তূর্য হেসে বলল,
“আমি বাংলা বুঝি। বাই দা ওয়ে, আপনার হিন্দি শুদ্ধ হয় নি।”
উপমা একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
“আমি হিন্দি পারি না। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।”
“আমিও পারি না। যদিও এখানেই থাকি।”
উপমা উঠে চলে আসতে যাবে তখনই তূর্য বলল,
“আমি চাঁদগাঁও থাকতাম। আপনি চট্টগ্রামের কোথায় থাকেন?”
উপমা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
“আমি চট্টগ্রাম থাকি, ওইটা আপনি কিভাবে বুঝেছেন?”
তূর্য হেসে বলল,
“আপনার ভাষা শুনে। আপন ভাষা শুনলে কি বুঝবো না নাকি?”
উপমা বুকে হাত গুঁজে বলল,
“আমার বাসা দামপাড়া।”
“ওহ ওইদিকে আমি অনেকবার গিয়েছিলাম।”
উপমা কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যেতে নিবে তখনই তূর্য উঠে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“উঠে যাচ্ছেন কেন? বসুন।”
“না, আমি ছেলেদের সাথে কথা বলি না।”
উপমার কথা শুনে তূর্য মনে মনে হাসলো। এবার সে বলল,
“আমিও মেয়েদের সাথে কথা বলি না। কিন্তু আপনি চট্টগ্রামের এটা শোনার পর থেকে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। আসলে গত আট বছর ধরে আমি কলকাতায় থাকি। দেশের কাউকে আজ এতো বছর পর দেখেছি।”
উপমা তূর্যের কথা শুনে কিছুটা আগ্রহী হলো। বলল,
“এতো বছর এখানে কি করছেন?”
“পড়াশুনা করতে এসেছি।”
“ওহ আচ্ছা।”
তূর্য মলিন মুখে বললো,
“আসলে আমার বাবা-মা মারা গেছে। পরিবারের আর কেউ নেই৷ পরিচিত মানুষ এই দেশে ছিল, তাই এখানে চলে এসেছি। আমার অনেক ইচ্ছে করে দেশের কারো সাথে বসে গল্প করতে।”
উপমা তূর্যের কথা শুনে আবার সেই বেঞ্চে গিয়ে বসলো। তূর্য মনে মনে হেসে বলল,
“মিশন ওয়ান কমপ্লিট৷ এবার মিশন টু, এই মেয়ের সাথে ভাব জমানো।”
তূর্যও এবার উপমার পাশে বসল। উপমা জিজ্ঞেস করলো,
“কি নাম আপনার?”
“আমি তূর্য আহমেদ। আপনি?”
“আমার নাম উপমা।”
“বাহ! কি সুন্দর নাম।”
উপমা মুচকি হাসলো। তূর্য হেডফোন দেখিয়ে বলল,
“কি শুনছিলেন এতোক্ষণ?”
“রিকির গান শুনছিলাম।”
তূর্য উপমার কথা শুনে চমকে উঠলো। বলল,
“কার গান?”
“রিকি দা স্টার।”
তূর্য হালকা কাশি দিয়ে বলল,
“আপনি ওর গান শুনেন?”
উপমা উৎসাহিত কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, আমি ওর ভক্ত। আমার রিকিকে অনেক ভালো লাগে। ও এখানে এসেছে দেখেই আমিও এই জায়গায় এসেছি।”
তূর্য তার শার্টের ভেতরে থাকা টি-শার্টটা ঢেকে দেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে শার্টের বোতম বন্ধ করতে লাগলো। কারণ সেই টি-শার্টটা পরে সে গতকাল রাতেই একটা ছবি তুলে ছেড়েছে। উপমা ফোন বের করে তূর্যের সামনেই সেই ছবিটা বের করে দেখালো আর বলল,
“দেখুন, মাথায় ক্যাপ পরাতে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। নয়তো আমি ওকে ঠিকই খুঁজে নিতাম।”
তূর্য বলল,
“আপনি না দেখেই প্রেম করছেন? বাহ, বেশ তো।”
উপমা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“প্রেম করছি না, ভালোবাসি ওকে।”
তূর্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“সামনে পেলে কি করবেন?”
উপমা অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“কিছুই করতাম না। শুধু তাকিয়ে থাকতাম।”
তূর্য মনে মনে হাসলো। এবার সে উপমাকে রাগানোর জন্য বলল,
“এভাবে একটা অচেনা ছেলের প্রতি দুর্বলতা রাখা ঠিক নয়। ছেলেটা তো ফ্রডও হতে পারে। তার চেয়ে দেখার পর বন্ধুত্ব করা ভালো। যেমন আমাদের মধ্যে হয়েছে।”
উপমা দাঁড়িয়ে বলল,
“কি বললেন, আপনি? আমাদের বন্ধুত্ব কখন হলো? আর আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি! আপনি আমার সামনে রিকিকে ফ্রড বলছেন? ফ্রড হচ্ছেন আপনি।”
তূর্যও দাঁড়িয়ে গেলো। বলল,
“আরেহ, আরেহ তুমি ভুল ভাবছো আমাকে?”
উপমা চেঁচিয়ে বললো,
“আপনি থেকে তুমি? বাহ! আপনাদের মতো ছেলেদের আমি ভালোভাবেই চিনি। সবই মেয়ে পটানোর পরিকল্পনা। দেখুন, আমি আপনার কথায় পটবো না। আমার অন্য কেউ আছে।”
তূর্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “রিকি?”
উপমা জোর গলায় বলল, “হ্যাঁ।”
তূর্য হেসে বলল,
“ওটা তো সম্ভব না। রিকি তো সেলেব্রিটি। ও তো আপনার সাথে কথাও বলার সময় পাবে না। তবে আমি, মানে আমার মতো সাধারণ ছেলেদের হাতে অনেক সময় আছে। আপনি বরং কোনো সাধারণ ছেলের সাথেই…..”
উপমার চোখ দু’টো চিকচিক করে উঠলো। তূর্য সাথে সাথেই তার কথা থামিয়ে দিলো। উপমা অন্যদিকে তাকাতেই তূর্য বলল,
“আই এম সরি। আমি হয়তো ভুল কিছু বলে ফেলেছি।”
উপমা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“রিকির সময় নাও থাকতে পারে, ও যেহেতু সেলেব্রিটি। কিন্তু আমার যথেষ্ট সময় আছে।”
কথাটি বলেই উপমা চলে গেলো। উপমা পুরো রাস্তা কেঁদেছে। মনে মনে ভাবছে,
“কি দরকার ছিল একটা অপরিচিত ছেলের সাথে এতো কিছু শেয়ার করার? ছেলেটা এখন দিলো তো অপমান করে?”
এদিকে তূর্য মনে মনে বলল,
“রিকি দা স্টার, তুই তো আমার চেয়ে সেরা, ভাই। আমি তো মেয়ে পটানোর জন্য ভাষা খুঁজে পাই না। আর তুই ভাষা ছাড়া, কথা ছাড়াই মেয়েদের পটিয়ে ফেলেছিস।”
এদিকে শতাব্দী আয়নার সামনে বসে বসে চুল বাঁধছিল। তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সে পেছন ফিরে দেখলো ডুমুর। ডুমুরকে দেখে সে মুচকি হেসে বলল,
“আরেহ, ডুমু এতো সকাল সকাল! আয় না।”
ডুমুর গম্ভীরমুখে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। শতাব্দী কিছুটা অবাক হলো। সে বলল,
“কি হলো, ডুমু? দরজা আটকালি কেন?”
ডুমুর চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“দিদি একটা ঘটনা ঘটে গেছে।”
“কি ঘটনা?”
“দিদি, বিষয়টা আমাদের নিয়ে নয়, আরাফ ভাইয়াদের নিয়ে।”
শতাব্দী ডুমুরকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে বলল,
“কি হয়েছে বল!”
“আরাফ ভাইয়াদের সাথে ধোঁকা হয়েছে।”
“মানে?”
“বাবা কাল রাত্তিরে রহমত চাচার সাথে কথা বলছিল। মা তখন সব শুনে ফেলেছে। তাই সকাল থেকেই বাবা-মায়ের ঝগড়া। মা বলছে চাচাজান ভাইয়াদের সাথে প্রতারণা করছে। বাবা বলছে, চাচাজান ভুল করছে না। এটাই করা উচিত। কি বিষয় নিয়ে এতো কথা হচ্ছে ওটা আমি বুঝতে পারি নি। কিন্তু রহমত চাচা ভাইয়াদের ধোঁকা দিচ্ছে, এটা আমি ভালোভাবেই শুনেছি।”
“রহমত চাচা তো উনিই, যিনি ওদের এখানে পাঠিয়েছিলেন!”
“হ্যাঁ গো দিদি৷ আরো একটা কথা শুনলে অবাক হবে তুমি। ভাইয়ারা আমাদের মতো না। ওই দেশে ওদের অনেক টাকা আছে। অনেক বড় ঘরের ছেলে। শুনেছি, ওদের বাবা-মাকে খুন করা হয়েছিল। ওরা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এখানে এসেছে। পড়াশুনা শেষে ওরা দেশে ফিরে ওদের বাবা-মার খুনীদের শেষ করে ফেলবে। মানে ভাইয়ারাও মানুষ মারবে।”
শতাব্দী আঁতকে উঠলো। ডুমুর আবার বলল,
“দিদি, অরুণিকার জন্যই চিন্তা হচ্ছে। বাচ্চাটা কি সব ঝামেলায় পড়ে গেছে!”
শতাব্দী বলল,
“আমি কিছুটা জানতাম। কিন্তু ওরা যে এখানে ওদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এসেছে এটা জানতাম না। ভেবেছি, সালেহ চাচা ওদের পরিচিত।”
“আমিও তো এটাই জানতাম গো দিদি। আমি ভেবেছি, ওরা আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়।”
“এখন ওদের বাবা-মাকে কি রহমত চাচাই মেরেছিলেন?”
“না, দিদি। কি বলছো এসব? রহমত চাচা তো এমন মানুষ না। আমি চাচাকে কতোবার দেখেছি। উনি মানুষ খুন করার মতো খারাপ নন। কিন্তু কিছু একটা তো করেছেন, যেটা ভুল।”
চলবে—