অরুণিকা পর্ব -৪৯+৫০

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৯||

৮১.
কলকাতায় এসে মাওশিয়াতের বাবা-মা, মিরাজ হাসান আর তিশা হাসানের সাথে দেখা করলেন উপমার বাবা-মা। ছেলের তো একজন অভিভাবক প্রয়োজন। অভিভাবক ছাড়া মেয়েকে ছেলের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব না। মূলত উপমার জোরাজুরিতেই তারা এই সম্পর্কে আগাচ্ছেন। নয়তো মেয়েকে এমন অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই তাদের ছিল না। তবে করিম সিদ্দিক আর মিসেস জুলেখার তূর্যকে পছন্দ হয়েছে। তারা সবাই কথাবার্তার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলেন দুই মাস পর একেবারে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করবেন।

এদিকে তূর্য কলকাতায় ফেরার পর থেকে অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। তূর্য তার আশেপাশে এলেই সে দূরে চলে যাচ্ছে। আহনাফের বিষয়টা একদমই পছন্দ হচ্ছে না। সে ভয়ে আছে, অরুণিকার এমন হাবভাব দেখে যদি তূর্য বিয়ে করতে না চায়?

বিকেলে অরুণিকা রুমে বসে টিভি দেখছিল। তখনই তূর্য তার সামনে এসে বসলো। অরুণিকা হাত নাড়িয়ে বলল,
“সরো। আমি টিভি দেখছি।”

তূর্য অরুণিকার দুই পা ধরে তাকে টেনে নিজের কাছে আনলো। অরুণিকা পা ভাঁজ করে বলল,
“কি সমস্যা তোমার?”

তূর্য মুখ ছোট করে বলল,
“আমার টুইংকেলটা কেন আমার সাথে রাগ করেছে?”

আহনাফ তখনই রুমে এসে তাদের একসাথে দেখে বলল,
“কি হচ্ছে? তূর্য, দেখছিস না ও টিভি দেখছে! তুই এদিকে আয়।”

তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এই তোর কি সমস্যা? আমি আমার টুইংকেলের সাথে কথা বলছি।”

“ও তোর সাথে কথা বলবে না। আয় এদিকে, বিয়ের শপিংয়ের লিস্ট করতে হবে।”

অরুণিকা আহনাফের কথা শুনে তূর্যের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে আগের জায়গায় বসে পড়লো। তূর্য আহনাফের কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে আবার ধরে টেনে তার কাছে আনলো। এবার আহনাফের প্রচুর রাগ হলো। সে রাগটা দমিয়ে তূর্যকে টেনে উঠাবে, তখনই অরুণিকা বসা থেকে উঠে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি দেখছো না রকস্টার আমার রাগ ভাঙাতে এসেছে? তুমি কেন ওকে বিরক্ত করছো?”

হুট করে এমন কথা শুনে আহনাফের খুব খারাপ লাগলো। সে তূর্যের হাত ছেড়ে দিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আচ্ছা, কথা বল তোরা।”

তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তূর্য কপাল চাপড়ে বলল,
“আহনাফ, তুই আবার গাল ফুলিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”

তারপর অরুণিকাকে বলল,
“দেখলে তো, আহনাফ রাগ করে চলে গেলো!”

অরুণিকা আহনাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও কি আমার কথায় রাগ করেছে?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, আমি ওর রাগ ভাঙাতে পারবো। তুমি আগে আমার রাগ ভাঙাও।”

এরপর অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে তাকালো। তূর্য অরুণিকার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আমার টুইংকেল কেন রাগ করেছে?”

অরুণিকা মলিন মুখে বললো,
“তুমি আমাকে বলেছ, বিয়ে করবে না। কিন্তু এখন বিয়ে করছ কেন?”

“হ্যাঁ, বিয়ে তো করতে চাই নি। কিন্তু এখন তো হয়ে যাচ্ছে।”

“এখন তো আমাকে কেউই সময় দেবে না।”

“কেন দেবে না? কে বলেছে দেবে না?”

“তুমিই তো বলেছো।”

তূর্য কপাল চাপড়ে বলল,
“ওটা তো এমনি বলেছি।”

“না, কেন বলবে? একদিন সবাই বিয়ে করে ফেলবে, তখন সবাই ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমাকে কেউ দেখবে না। আমার সাথে কথাও বলবে না, ঘুরতেও নিয়ে যাবে না। তুমি বলেছ, তুমি সবসময় আমার সাথে কথা বলবে। সবাই বিয়ে করলেও তুমি করবে না। সবাই ভাবী নিয়ে ঘুরবে, আর তুমি আমাকে নিয়ে ঘুরবে। কিন্তু দেখো, তুমিই বিয়ে করে ফেলছো! আমার তো কেউ নেই। এক কাজ করো, আমাকেও বিয়ে দিয়ে দাও। আমিও তখন আমার বর নিয়ে ঘুরবো।”

তূর্য হাতে মুখ গুঁজে বলল,
“হায় আল্লাহ, এ মেয়েটা বলে কি!”

তারপর অরুণিকার দিকে তাকিয়ে তার দুই হাত ধরে বলল,
“আমি, তুমি আর তোমার ভাবী, আমার তিনজন একসাথে ঘুরবো।”

“ভাবী কি আমাকে শতু আপুর মতো ভালোবাসবে?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই। ভালোবাসবে না কেন? আমার টুইংকেলকে ভালোবাসতে পারবে না এমন কেউ আছে?”

“না, আগে আমি ভাবীর সাথে কথা বলবো। তারপরই বুঝবো।”

তূর্য এবার উপমাকে ফোন দিয়ে অরুণিকার সাথে কথা বলিয়ে দিলো। অরুণিকা প্রায় এক ঘন্টা উপমার সাথে কথা বলার পর তূর্যকে ফোন দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি ভাবীকে ভাবী বলবো না কিন্তু। সুইট স্টার বলবো। কারণ ভাবী অনেক সুইট।”

তূর্য মুচকি হাসলো। ফোনটি কানের কাছে এনে উপমার মিষ্টি কন্ঠ শুনে বলল,
“আগে বলো আমার টুইংকেলকে কেমন লেগেছে?”

উপমা হেসে বলল,
“অনেক মিষ্টি একটা বাচ্চা। ও এতো সুন্দর করে কথা বলে! আমাকে বলছে, আমি যাতে ওর সখী হয়ে যাই। তারপর রকস্টার আর আমাকে নিয়ে সে বাইরে ঘুরতে যাবে। জানো, এতোদিন আমি খুব চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু ওর সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে, আমি বিয়ের পর একটা বোন পাবো।”

তূর্য প্রশান্তির হাসি দিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ, উপমা। তোমার কথাটা শুনে ভালো লাগলো। টুইংকেল আমাদের ছয় জনেরই প্রাণ। আমি চাই, তুমি ওকে আমাদের মতোই আগলে রাখো। ওর কিছু হলে আমরা সহ্য করতে পারবো না।”

“অরুণিকাকে অনেক ভালোবাসো, তাই না?”

“হ্যাঁ, নিজের চেয়েও বেশি। ওকে ছাড়া আমার দিনটাই ফিঁকে লাগে। এতোদিন বাংলাদেশে খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। এখন ওকে দেখার পর থেকে সব ভালো লাগছে।”

উপমা হেসে বলল,
“আচ্ছা, আমিসহ থাকলে হয়তো বিরক্ত লাগতো না।”

তূর্য মলিন হাসলো। উপমা মনে করছে, সে উপমাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে তো অনুশোচনা থেকে বাঁচার জন্য বিয়ে করছে। উপমা যদি জানতে পারে, সে উপমাকে ভালোবাসতো না। এসব সময় কাটানোর জন্য ছিল, তখন অনেক কষ্ট পাবে।

তূর্য উপমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফোন কেটে দিয়ে মনে মনে বলল,
“সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে, আমি কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারছি না। আমি এতো দুর্বল তো আগে ছিলাম না।”

এদিকে ইভানকে রহমত চাচা ফোন করলেন। তিনি অনেকক্ষণ ইভানের সাথে কথা বললেন। তার সাথে কথা বলার পর থেকেই ইভান ভাবনায় ডুবে গেলো। আহনাফ তাকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে?”

বাকিরাও ততোক্ষণে ইভানের সামনে এসে বসলো। সবাই ইভানকে চিন্তিত দেখে ভাবছে, কিছু একটা তো হয়েছে। এবার তাহমিদ বলল,
“ইভান, কার ফোন ছিল?”

ইমন বলল,
“হ্যাঁ, ভাই। কে ফোন দিয়েছে? কখন থেকে এভাবে পাথরের মতো বসে আছিস।”

ইভান এবার তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এভাবে কি দেখছিস?”

ইভান থমথমে কন্ঠে বলল,
“রহমত চাচা তোর বিয়ের খবর কিভাবে জানলো?”

“মানে? আমি তো উনার সাথে কথায় বলি নি।”

“তাহলে উনি তোর বিয়ের কথা কিভাবে জানলো? এই খবর তার কাছে যাওয়া একদমই অসম্ভব ছিল। কারণ আমরা ছ’জন, আর মাওশিয়াতের বাবা-মা ছাড়া এটা কারোই জানার কথা না।”

আরাফ কিছু একটা ভেবে বলল,
“উনি কি মাওশিয়াতের বাবা-মার সাথে যোগাযোগ করে?”

ইমন বলল,
“না। উনারা তো সালেহ আলীকে চেনে। রহমত চাচা তো কখনো কলকাতায় আসে নি।”

“তাহলে কি সালেহ আলীর সাথে যোগাযোগ আছে?”

তাহমিদ বলল,
“হয়তো অরুণিকা কাউকে বলেছে!”

ইভান অরুণিকাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে “না” বললো। এবার ইমন মাওশিয়াতকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো। সেও বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করে জানালো, তাদের সাথে সালেহ চাচার কোনো যোগাযোগ নেই।

আহনাফ বলল,
“তবে কি কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে?”

হঠাৎ ইমনের টনক নড়লো। সে সাথে সাথে মাওশিয়াতকে কল করলো আর বলল,
“তোমাদের বাসার কাজের মহিলাটি কি জানে তূর্যের বিয়ে?”

“হ্যাঁ কেন জানবে না? তিনি তো আমাদের সাথেই থাকে। ইনফ্যাক্ট, উনি সবসময় তোমাদের কথায় জিজ্ঞেস করে। উনার তো অনেক আফসোস হয় তোমরা একা একা থাকো তাই।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

“কিন্তু তুমি উনার কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?”

“এমনিতেই। আচ্ছা উনাকে আপতত আমাদের কথা কিছুই বলো না। আর তুমি সময় নিয়ে আমাদের বাসায় এসো।”

ইমন কল কেটে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমরাই পিছিয়ে আছি। শত্রুপক্ষ জানে, আমরা কি করছি, কি করছি না। রহমতুল্লাহ, আগের মহল্লায় আমাদের ওঠাবসার খবর সালেহ চাচার মাধ্যমে পেয়েছিল। নতুন এলাকায় যাওয়ার পর আমাদের বাসায় পারমানেন্ট কাজ করার জন্য এক মহিলা এসেছিল। কান্নাকাটি করছিল, তাকে কাজে রাখার জন্য। কিন্তু আমরাই তাকে রাখি নি। কিছুদিন আগে আমি সেই মহিলাকে মাওশিয়াতদের বাসায় দেখেছি। সে নাকি সাড়ে তিন বছর ধরে সেখানেই কাজ করে। তার মানে কি? মাওশিয়াতের কাছ থেকে সে সব তথ্য নিয়ে আমাদের শত্রুদের দিচ্ছে। আর রহমত চাচা সেখান থেকেই সব খবর পেয়েছে।”

(রাতে একটা বোনাস পর্ব দেবো।)

চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৮২.
দুই মাস পর, উপমা আর তূর্যের বিয়ে উপলক্ষে ছ’জনই অরুণিকাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তাদের সাথে মাওশিয়াত আর তার বাবা-মাও এসেছে। আদিল আগে থেকেই তাদের থাকার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। তার এক বন্ধুর মামার ফ্ল্যাট খালি ছিল। এখন সবাই সেখানেই উঠেছে।

আগামীকাল সন্ধ্যায় এনগেজমেন্ট। উপমা তার বান্ধবীদের ফোন করে জানাচ্ছে, তার রিকির সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে। কিন্তু তার বান্ধবীরা কোনোভাবেই তার কথা বিশ্বাস করছে না। উপমা সবাইকে একটা কথায় বলছে,
“আগে দেখা করিস, তারপর আমার স্টার তোদের সব কনফিউশান দূর করে দেবে।”

পরের দিন থেকেই আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। আর উপমা জানালার গ্রিল ধরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আদিল বোনের কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কি রে, মন খারাপ কেন? তোর প্রিয় স্টারের সাথেই তো তোর বিয়ে হচ্ছে।”

উপমা মলিন মুখে বললো,
“ভাইয়া, এই বর্ষায় বিয়েটা না রাখলে হতো না? মানুষ শীতের সময় বিয়ে করে। আর তোমরা বর্ষায় বিয়ের অনুষ্ঠান রেখেছো। দেখো, আজ নিশ্চিত বৃষ্টি নামবে। আর এই বৃষ্টি এক সপ্তাহ ধরে থাকবে।”

“থাক, সবাই শীতে বিয়ে করে, আর আমার বোন বর্ষায় করবে। চিন্তা করিস না, তোর বিয়েটা অনেক স্পেশাল হবে। আমি তোর জন্য এই দিনগুলো স্পেশাল বানিয়ে দেবো। দেখবি, তখন বর্ষা আসলেই আমার কথা মনে পড়বে।”

উপমা ভেজা কণ্ঠে বলল,
“বর্ষা কেন, আমার তো প্রতি ঋতুতেই তোমার কথা মনে পড়বে।”

আদিল বোনকে জড়িয়ে ধরলো। আদিলের খুব কান্না পাচ্ছে। একটা মাত্র বোন তার! বিয়ে দিয়ে দিলে ঘরটা খালি হয়ে যাবে।

এদিকে সন্ধ্যায় সব অতিথিরা চলে এসেছে। ছেলেপক্ষের সবাই উপস্থিত হওয়ার পর তূর্যকে ঘিরে উপমার বান্ধবীদের ভীড় জমলো। সেই হাত, সেই চুল, তাহলে কি উপমা সত্যি কথায় বলেছিল? এটাই ‘রিকি দা স্টার?’ কিন্তু এভাবে বিশ্বাস করা তো সম্ভব না। তাই সবাই তূর্যকে গান গাওয়ার অনুরোধ করতে লাগলো। কিন্তু এতো সহজে তূর্য আজ গান গাইবে না। সে বলল, অন্যদিন শুনাবে। আদিল তূর্যকে উপমার বান্ধবীদের ভীড় থেকে বের করে সোফায় বসালো। কিছুক্ষণ পর মিসেস জুলেখা উপমাকে একটা সোনালি রঙের শাড়ি পরিয়ে নিয়ে এলেন। তারপর তিনি উপমাকে তূর্যের পাশে বসিয়ে দিলেন৷ উপমা লজ্জায় তূর্যের দিকে তাকাতে পারছে না। তূর্যের মাখা সেই পরিচিত সুগন্ধির ঘ্রাণটা তার নাকে এলো। উপমার কেমন যেন মাতাল মাতাল লাগছে। তার মনের মধ্যে উত্তাল ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, রিকির সাথেই তার বিয়ে হতে যাচ্ছে। রিং পরানোর পর অরুণিকা উপমার হাত ধরে বলল,
“আজ থেকে তুমি আমার সুইট স্টার। ঠিক আছে?”

উপমা মুচকি হেসে অরুণিকার থুতনি ধরে বলল,
“আর তুমি আমার মুনলিট।”

অরুণিকা গালে হাত দিয়ে বলল,
“ওয়াও, আমার নামটা খুব পছন্দ হয়েছে।”

করিম সিদ্দিক মাওশিয়াতের বাবাকে বললেন,
“বেয়াই সাহেব, ভাবছি আমরা দুইদিন পর আক্দ অনুষ্ঠানটা করবো। তারপর এক সপ্তাহ পর মেয়েকে উঠিয়ে দেবো।”

মিরাজ হাসান বললেন,
“জ্বি, যেটাতে আপনাদের সুবিধা।”

রাতে বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগলো। অরুণিকা জানালার বাইরে হাত বের করে দিয়ে বৃষ্টির স্পর্শ অনুভব করছে। তখনই আহনাফ তার পাশে এসে দাঁড়ালো। সে বুকে হাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা আহনাফকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এভাবে ভ্যাবলা কান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

আহনাফ ধীর কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে একটুও সম্মান করো না।”

“আমি আবার কখন অসম্মান করলাম?”

“এই যে এখন ভ্যাবলা কান্ত বললে! এটা অসম্মান না?”

“ওটা তো এমনিতেই বলেছি।”

“সবাইকে তুমি কতো সুন্দর করে সম্বোধন করো। আমার সাথে তোমার কি সমস্যা? অরু, বলো না, আমার সাথে কেন এমন করো?”

অরুণিকা কিছু না বলে চলে যেতে নিবে তখনই আহনাফ তার হাত ধরে বলল,
“দাঁড়াও আমার পাশে।”

“না, দাঁড়াবো না।”

কথাটি বলেই অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে চলে গেলো। অরুণিকা যাওয়ার পর আহনাফ জানালার বাইরে বৃষ্টিস্নাত শহরকে দেখতে লাগলো। তার মনটা আজ অশান্ত। এই মুহূর্তে তার কিছুই ভালো লাগছে না। অরুণিকাকে সে কিভাবে নিজের করে পাবে, সেটাই ভাবছে। জোর করে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়? সে তো তার পিচ্ছি অরুকে ভালোবেসে ফেলেছে। এখন অরুণিকা বড় হয়ে যদি তাকে ভালোবাসতে না পারে? এখনই এমন খিটখিটে ভাব দেখায়, বড় হলে হয়তো সহ্যই করতে পারবে না। আহনাফ শক্ত করে জানালার গ্রিল আঁকড়ে ধরলো। তার গলা ভারী হয়ে আসছে। ভেজা কন্ঠে সে দু’টো শব্দ বের করল শুধু,
“ভালোবাসি অরু।”

সকালে ইভান রাস্তায় বের হয়ে দেখলো পানি জমে পুরো রাস্তা ভরে গেছে। প্যান্ট ভাঁজ করে সে পানিতে নেমে পড়লো। একটু বৃষ্টিতেই শহরের এই রূপ তার চির পরিচিত। ছোট ছোট বাচ্চারা পানিতে ধাপাধাপি করছে। কাল রাতে আহনাফের জ্বর উঠেছিল। তাই এই মুহূর্তে তার জন্য ওষুধ কিনতেই সে ফার্মেসিতে যাচ্ছে। মেইন রোডে আসতেই একটা গাড়ি জোরে তার সামনে দিয়ে চলে গেলো। আর রাস্তার সব পানি তাকে সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। ইভান সেখানেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমত ড্রেনের পানি রাস্তার পানির সাথে মিশে গেছে, দ্বিতীয়ত সেই পানিগুলোই তার মুখে এসে পড়েছে।

এদিকে গাড়িটা কিছুদূর গিয়ে থামলো। তারপর আবার পেছনে এসে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। তারপর গাড়ির গ্লাস নামিয়ে একটা মেয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“সরি সরি সরি, আমি আপনাকে দেখি নি। আচ্ছা, এই নিন টিস্যু। সব ময়লা পানি আপনার মুখে এসে পড়েছে। আসলে কিছু বদমাশ লোক আমার পিছু করছিলো, তাই হুড়োহুড়িতে খেয়াল করি নি।”

ইভান পরিচিত কন্ঠ শুনে চোখ খুলে দেখলো, এটা তো সেই মেয়েটাই। ইভান এক ঝটকায় টিস্যুটা টেনে নিয়ে মুখটা মুছে গাড়ির জানালায় ভর দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বদমাশ লোকগুলো এখনো আপনার পিছু ছাড়ে নি? নাকি জন্মের পর থেকেই আপনার পিছু নিচ্ছিলো?”

সানায়া হাঁ করে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি? আপনি, সেই লোকটা?”

“জ্বি, আমিই সেই ব্যাক্তি যার গায়ে আপনি কখনো পানি ঢেলে দেন, কখনো রিকশা থেকে ফেলে দেন, আবার এখন একেবারে গোসল করিয়ে দিয়েছেন।”

সানায়া গাড়ির দরজা খুলে নামতে গিয়ে রাস্তায় পানি দেখে আর নামলো না। ইভান হনহনিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো। ইভানের এমন অবস্থা দেখে সানায়ার খুব খারাপ লাগলো। সে গাড়িটা একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে গাড়ির অন্য দরজা খুলে উঁচু রাস্তায় উঠে দাঁড়ালো। তারপর ইভানের পিছু এসে বলল,
“সরি, আপনি আমার উপর রাগ করেছেন?”

ইভান রাগী দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্লিজ এখান থেকে যান। নয়তো আপনাকে সেই বদমাশ লোকগুলো উঠিয়ে নিয়ে যাবে।”

“আচ্ছা, আগে আমার কথাটা তো শুনুন। দেখুন একবার আমার কথা শুনলে আপনার নিশ্চিত আমার উপর মায়া হবে।”

“আমি কারো মায়ায় পড়ি না।”

কথাটা বলেই ইভান হাঁটা শুরু করলে সানায়া তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কেন? আপনি কি মানুষ না?”

“মানে?”

“মানুষ মানেই মায়ায় পড়বে। মানুষের মন আছে, মানুষ মহৎ হয়। সবগুলো শব্দই ম দিয়ে, তাই তাদের অন্যের সমস্যার কথা শুনলে মায়া লাগবে, স্বাভাবিক!”

“আমার এতো সময় নেই যে যার-তার সমস্যার কথা শুনে মায়া বাড়াবো!”

ইভান কথাটি বলেই চলে যাবে তখনই সানায়া চেঁচিয়ে বললো,
“আমাকে এ্যাটিটিউড দেখাচ্ছে! হুহ।”

ইভান পেছন ফিরে একনজর সানায়ার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। সানায়াও সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে গিয়ে বসলো। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“সব পুরুষ মানুষের একটাই সমস্যা, নিজেদের মহামানব মনে করে।”

৮৩.

তিন কবুল বলেই তূর্য আর উপমার আক্দ সম্পন্ন হলো। আক্দ হওয়ার পর তাদের পাশাপাশি বসানো হলো। আর তূর্যকে ঘিরে বসে রইলো উপমার বান্ধবীরা। তাদের মধ্যে একজন বলল,
“ভাইয়া, আপনি তো অনেক ভালো গান করেন, একটা গান শুনাবেন?”

আরেকজন বলল,
“হ্যাঁ, আপনার ভালোবাসার মানুষটার জন্য না হয় গান করেন। সে হয়তো আপনার গান শুনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে।”

তূর্যকে পাশের বাসার ভাড়াটিয়ার ছেলের গিটার এনে দেওয়া হলো। সে গিটারটিতে সুর তুলে কন্ঠে গান ধরলো,

“কারণে-অকারণে, নিষেধে বা বারণে,
তোমার নামেই যত জোছনা নিলাম,
নিয়মে-অনিয়মে, দহনে বা ধারণে,
আমায় নিখোঁজ ভাবো বাঁ পাশেই ছিলাম।
.
চোখে জল নোনা কি? নিয়ে গেল জোনাকি
কেন আমি পথে একা দাঁড়িয়ে?
আলোদের পিয়নে, সোডিয়াম নিয়নে যেন
সবই কোথায় হারিয়ে…
.
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি, তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে.. তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি, তোমার স্বপ্নে পুড়ে যাই
এমন সাধের পৃথিবীতে..তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
পুরোটাই…”

উপমা অবাক হয়ে তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বুকের মাঝে হঠাৎ একটা পাথর চেপে বসেছে। সে শুনেছিল, ভালোবাসার মানুষ চোখের দিকে তাকিয়ে গান করে। কিন্তু তূর্য একটিবারের জন্যও তার দিকে তাকালো না। তূর্যের চোখ কখনো অরুণিকার দিকে, কখনো বা উপমার বান্ধবীদের দিকে, কখনো বা নিচের দিকে যাচ্ছে। গান শেষ হওয়ার পর উপমার এক বান্ধবী তার কাছে এসে বলল,
“তুই অনেক ভাগ্যবতী রে, তোর ক্রাশের সাথেই তোর বিয়ে হয়েছে। তাও আবার যেমন তেমন ক্রাশ নয়, একেবারে সেলেব্রিটি ক্রাশ! ভাইয়াকে চোখে চোখে রাখিস কিন্তু। যেমন হ্যান্ডসাম, তেমনি চমৎকার তার কন্ঠ, তার উপর আবার সে সেলেব্রিটি মানুষ। এসব সেলেব্রিটিদের সংসার বেশিদিন টিকে না।”

উপমা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ও আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না।”

এদিকে অরুণিকা তূর্যের পাশে বসে ছবি উঠাচ্ছে। তূর্য একবারও ক্যামেরা ম্যানকে বলছে না, উপমার সাথে তার ছবি উঠিয়ে দিতে। উপমা তাই মন খারাপ করে বসে আছে। এদিকে রাতে তূর্যও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। এক সপ্তাহ পর সে উপমাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। তবে এর মধ্যে তূর্য একবারো উপমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে দেখায় নি। উপমাও তূর্যকে বিরক্ত করে নি।

পাঁচদিন পর আকাশে রোদ উঠেছে। আরাফ অরুণিকাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা মেয়ে দৌঁড়ে তার কাছে এসে বলল,
“ভাইয়া একটা সাহায্য করবেন?”

আরাফ মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটির চোখেমুখে ভীতি।
পরিবেশ ঠান্ডা। কয়েকদিন বৃষ্টি পড়েছিল, তাই মিষ্টি রোদ উঠলেও ঠান্ডা বাতাস বইছে। তবে এর মধ্যেও মেয়েটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অরুণিকা বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”

মেয়েটা কাঁপা কন্ঠে আরাফকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কিছু লোক আমার পিছু নিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরেই আমাকে ফলো করছে। আমি একটা কল করতে পারবো? আসলে আমার ফোনটা বাসায় রেখে এসেছি।”

আরাফ তার ফোন এগিয়ে দিতেই মেয়েটা একটা নম্বরে কল দিয়ে বলল,
“সাহিল, কোথায় তুমি?”

ওপাশ থেকে সাহিল বলল,
“রাহি! তুমি এটা কার নম্বর থেকে ফোন করেছো?”

“রাস্তায় একজনকে পেয়েছি, সেখান থেকেই কল করেছি।”

“তুমি জানো আমি কে? আমি সাহিল মির্জা। তুমি যে কারো কাছ থেকে ফোন নিয়ে আমাকে ফোন করতে পারবে না। তোমার ফোন কোথায়?”

রাহি রাগী কন্ঠে বললো,
“সরি সাহিল মির্জা, ভুল হয়ে গেছে আমার। তবে একটা কথা জানিয়ে দেই, আপনার কর্মকান্ডের ফলস্বরূপ আমাকে এখন রাস্তায় নিজেকে বাঁচানোর জন্য অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে। থাক, আপনার এখানে আসতে হবে না। আপনার তো সময় নষ্ট হবে। আমি না হয় অন্য কারো সাহায্য নেবো।”

কথাটা বলেই রাহি কল কেটে দিয়ে নম্বরটি ডিলিট করে দিলো। আর সাথে সাথেই সাহিলের কল এলো। রাহি কল রিসিভ করেই বলল,
“কেন ফোন দিয়েছ?”

“কোথায় তুমি?”

“জাহান্নামে।”

সাহিল চেঁচিয়ে বলল, “কোথায় তাড়াতাড়ি বলো?”

রাহি ঠিকানা বলতেই সাহিল দশ মিনিটের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির হলো, সাথে আরো দুইটা গাড়ি এসেছে। আরাফ এতোক্ষণ রাহির সাথেই দাঁড়িয়ে ছিল। সাহিলকে দেখে রাহি দৌঁড়ে যেতেই আরাফ হাঁটা শুরু করলো। সে অরুণিকাকে নিজের সামনে এনে পেছন ফিরে সাহিলের দিকে তাকালো। অরুণিকা ব্যথায় বলে উঠলো,
“আহ! আরাফ, তুমি এতো শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরেছো কেন?”

আরাফ সাথে সাথেই হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ওহ সরি। খেয়াল করি নি।”

তারপর আরেকবার সে পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো সাহিল মির্জা তার বডিগার্ড নিয়ে গাড়িতে উঠে গেছে। আরাফ গাড়িগুলোর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“শাহেদ মির্জা আমাদের পরিচয় কেঁড়ে নিয়ে, নিজের ছেলেকে উপরে উঠিয়ে দিয়েছে। এই অন্যায়ের প্রতিশোধ তো একদিন নিবোই, মির্জা সাহেব। আজ মির্জা গ্রুপের এমডির সাথে দেখা হয়ে গেলো, কাল আপনার সাথে দেখা হবে।”

দুই সপ্তাহ পর তূর্য আর উপমার বিয়ের দিনটি চলে এলো। উপমা বউ সেজে স্টেজে বসে আছে। বর পক্ষ আসার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু বর এখনো আসছে না। বিয়ে বাড়িতে সবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। উপমার বান্ধবীরা বলাবলি করছে,
“স্টার হয়তো বউ রেখে পালিয়েছে।”

আদিল বার-বার ফোন দিচ্ছে তূর্যকে, কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। বাকিদের ফোনেও কল যাচ্ছে না। আদিল বোনের দিকে একনজর তাকিয়ে ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেলো। গাড়ি নিয়ে সে সোজা তূর্যরা যেই বাসায় উঠেছিল, সেখানে গেল। গিয়ে দেখলো দরজা খোলা, আর পুরো ঘর এলোমেলো। আদিল ঘর থেকে বের হতেই পেছন থেকে কেউ একজন তার পিঠে ছুরি ঠেকালো। আদিল পিছু ফিরতেই মুখোশধারী লোকটা তার একপাশে ছুরিকাঘাত করলো। আদিল সাথে সাথেই ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেলো।

এদিকে তূর্য আর আরাফ ক্লাবে এসেছে। বাকিরা কেউ আসে নি। তূর্য ক্লাবে আসতেই সবাই তাকে বরণ করে নিলো। কিন্তু তূর্য আর আরাফের চোখে-মুখে আতংক। তারা ক্লাবে ঢুকেই সোজা করিম সিদ্দিকের কাছে চলে গেলো। আর তূর্য বলল,
“আংকেল, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। আমাদের এখনই কলকাতায় ফিরে যেতে হবে। আপনি উপমাকে বিদায় করে দিন।”

“কি বলছো এসব? এভাবে হুট করে বিদায়?”

“প্লিজ আংকেল, আমরা এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না।”

তূর্য স্টেজে উঠে উপমার হাত ধরে তাকে স্টেজ থেকে নামালো। এদিকে করিম সিদ্দিক আদিলকে ফোন করছেন। অনেকবার কল হওয়ার পর ওপাশ থেকে আদিল কল রিসিভ করে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বাবা, আমি তূর্যদের ফ্ল্যাটে এসেছিলাম। কেউ একজন আমার কাঁধে ছুরি চালিয়েছে। অনেক রক্ত যাচ্ছে। আমাকে এখান থেকে নিতে আসো৷ সাথে পুলিশও নিয়ে আসো।”

করিম সিদ্দিক ছেলের এমন কথা শুনে হিতাহিতজ্ঞান হারালেন। তূর্য আর আরাফ আদিলের উপর আক্রমণ হয়েছে শুনে আরো চিন্তায় পড়ে গেলো। তারা সবাই তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাটে গেলো। এরপর আদিলকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করালো। সেখান থেকেই তূর্য উপমাকে বাসায় নিয়ে গেলো। উপমা শাড়ি পরিবর্তন করে তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। তূর্য এরপর তাকে নিয়ে স্টেশনে চলে এলো। উপমা যদিও ভাইকে এই অবস্থায় ফেলে যেতে চাচ্ছিল না। কিন্তু বাবা-মার চুপচাপ হয়ে থাকা, আর তূর্যের জোরাজুরিতে সে কলকাতায় যেতে বাধ্য হলো। আর এদিকে ডাক্তারও বলেছে, আদিল এখন ঠিক আছে। ক্ষত এতো বেশি গভীর ছিল না। তাই উপমাকে হাসপাতাল থেকে বের করানো গেলো। নয়তো তূর্য টেনে নিয়ে আসতে চাইলেও সে আসতো না।

বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে উপমা। তার হাতে মেহেদি, মুখে এখনো বিয়ের সাজ। শুধু বিয়ের শাড়িটাই পরিবর্তন করে একটা সাধারণ জামা পরেছে। তার পাশে তূর্য স্থির হয়ে বসে আছে। তূর্য ও তার বন্ধুদের থমথমে চেহারা দেখে সে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। তার জীবন এমন জায়গায় মোড় ঘুরিয়েছে, সে এর কোনো শেষ খুঁজে পাচ্ছে না। তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন। একদিকে আজ তার বিয়ে, আর তার বর বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তাকে স্টেজ থেকে নামিয়ে তার সাথে অজানা পরিবেশে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে তার ভাইয়ের উপর হামলা হয়েছে, অথচ সে তার পাশে থাকতে পারছে না। এভাবে তো কারো বিয়ে হয় না। জীবনে সে এমন বিয়ে হতেও দেখে নি। তার এই চমৎকার দিনটা আজ নষ্ট হয়ে গেলো।

চলবে–#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫০||

৮৪.
আদিল তূর্যের মুখোমুখি বসে আছে। সুস্থ হওয়ার এক সপ্তাহ পর সে বাবা-মাকে নিয়ে কলকাতায় এসেছে। আসার পর পরই সে তূর্যকে প্রশ্ন করলো, সেদিন রাতে কেন এমনটা হয়েছিল? তূর্যের পাশে ইমন দাঁড়িয়ে আছে। সে একনজর ইমনের দিকে তাকালো। ইমন সাথে সাথে মাথা নিচু করে নিলো। একপাশের সোফায় ইভান আর আরাফ বসে আছে। আর অন্যপাশে করিম সিদ্দিক ও মিসেস জুলেখার মাঝখানে উপমা বসে আছে। সেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ এতোদিন সে অনেকবার তূর্যকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু তূর্য প্রতিবারই তাকে এড়িয়ে গেছে। তাহমিদ রান্নাঘর থেকে নাস্তার ট্রে নিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। সবাই গম্ভীরমুখে বসে আছে। অরুণিকা সবার হাবভাব দেখে আহনাফকে গুঁতো দিয়ে বলল,
“সবাই এভাবে নিরবতা পালন করছে কেন?”

আহনাফ তাকে ইশারায় চুপ করে থাকতে বলল। এবার করিম সিদ্দিক বললেন,
“বাবা, কিছু তো বলো! কি হয়েছিল? ওরা কারা ছিল? তোমরা এখনো আমাদের কিছু বলছো না।”

সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে আহনাফ বলল,
“আংকেল, আমরা আপনাদের কাছ থেকে একটা সত্য লুকিয়েছিলাম।”

সবাই আহনাফের দিকে তাকালো। ইভান চোখের ইশারায় আহনাফকে চুপ করে থাকতে বলল, কিন্তু সে ইভানের ইঙ্গিতের তোয়াক্কা না করে, নিজেদের আসল পরিচয় দিয়ে দিলো। সাথে বাংলাদেশ থেকে কলকাতা আসা, আর তাদের সংগ্রাম করে এতোটুকু আসার সব’টাই জানালো। সব শুনে করিম সিদ্দিক আর মিসেস জুলেখা পাথরের মতো বসে আছেন। আর আদিল তূর্যের দিকে তাকালো। তারপর শান্ত কন্ঠে বলল,
“তোমার সম্পর্কে জানার পর মনে হচ্ছে, আমার বোনটা বিশ্বাসযোগ্য হাতে আছে। অতীতে তোমাদের সাথে যা হয়েছিল, একদম ভালো হয় নি। কিন্তু এখন তোমাদের জীবনে একটা ভালো সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ ফেলে দেওয়া উচিত নয়। আমি তোমাদের সাথে আছি৷ তোমাদের পরিবারের খুনিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আমার পক্ষ থেকে যা যা সম্ভব, আমি এর সবটাই করবো।”

মিসেস জুলেখা আতংকিত কন্ঠে বললেন,
“কিন্তু এরা যদি আবার হামলা করতে আসে!”

ইভান বলল,
“এখন ওরা আমাদের কোনো তথ্য পাবে না। এতোদিন আমাদের সব তথ্য ওরা ওদের গুপ্তচর থেকে পেয়েছিল। মাওশিয়াতদের বাসায় একজন মহিলা কাজ করতো। তার নাম রাহেলা ছিল। তিনি বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় এসেছে, আমাদের সব খবরাখবর নেওয়ার জন্য।”

করিম সিদ্দিক বললেন,
“তোমরা তাকে ধরতে পেরেছ?”

আরাফ বলল, “জ্বি, আংকেল।”

“কি বলেছে সে? কে পাঠিয়েছে তাকে?”

“যে পাঠিয়েছে তাকে সে চেনে না। এক লোকের মাধ্যমে সে কাজ পেয়েছিল। যেই লোকটা কাজ দিয়েছিল, তার কোনো খবর পাই নি। আর যে আমাদের উপর নজরদারি করছে, সে নিজেকে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে। মহিলাটার ফোনের রেকর্ডিং বের করার ব্যবস্থা করছি। একজন ইন্সপেক্টর এই কেইসে আমাদের সাহায্য করছেন। দেখা যাক, মহিলাটা কার কার সাথে কথা বলেছে।”

এদিকে, অনেকক্ষণ ধরে রহমতুল্লাহর ফোন বাজছে। একটা পরিচিত নম্বর ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। কিন্তু তিনি কল ধরার সাহস পাচ্ছেন না। বার-বার কল আসায় অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি কলটা ধরলেন৷ কল ধরার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে কর্কশ কন্ঠে একজন বলে উঠল,
“কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? কতোবার তোমাকে ফোন করেছি? কোথায় থাকো তুমি?”

রহমতুল্লাহ ঠান্ডা গলায় বললেন,
“ক্ষমা করবেন, জনাব। আমি একটু অসুস্থ আছি।”

“তুমি মোটেও অসুস্থ নও। তুমি ইচ্ছে করে আমার কল ধরছো না। খবরদার আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবে না। নয়তো তোমার মাথার খুলি উড়াতে আমার দুই সেকেন্ডও লাগবে না।”

রহমতুল্লাহ আমতা আমতা করে বললেন,
“শুধু শুধু রাগ করছেন, জনাব। আমি কি করেছি?”

“তুমি কেন ওদের উপর হামলা করিয়েছো? আমার কাজ এখনো শেষ হয় নি। যতোদিন আমি আমার কাজ শেষ করতে পারবো না, ততোদিন ওদের ছ’জনকে বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু তুমি ওদের উপর হামলা করিয়েছো। আর ওরা আবার কলকাতায় পালিয়ে গেছে।”

“না, জনাব। আমি এই হামলা করাই নি। বস করিয়েছে।”

“বস? তোমার বসকে বলে দাও, আমার উপর খবরদারি না করতে!”

“জ্বি জনাব।”

“এর আগেও তোমার বস ওদের উপর হামলা করাতে চেয়েছিল। ওরা যখন সিলেটে ছিল, তখনও ওদের মারার জন্য লোক পাঠিয়েছিল।”

এবার রহমতুল্লাহ বললেন,
“কিন্তু মারতে তো পারে নি। আমি ওদের সরিয়ে দিয়ে ওই ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছি। জনাব, আপনি যেটা চাচ্ছেন, আমিও সেটাই চাচ্ছি। কিন্তু বস চাচ্ছে ওদের রাস্তা থেকেই সরিয়ে দিতে। আপনি আমেরিকা থেকে ফিরে বসের সাথে আলাপ করলে ভালো হবে। এরপর আপনি বুঝালে উনি বুঝবেন যে এই ছয়জনের এই মুহূর্তে বেঁচে থাকা কতো জরুরি। বিশেষ করে ইমন আর অরুণিকার।”

“আর যাই বলো জুবাইয়ের করিম চৌধুরী মৃত্যুর আগে অরুণিকাকে বাঁচিয়ে আমার রাস্তা আরো সহজ করে দিয়েছেন। এই মেয়েটাকেই এখন আমার প্রয়োজন। আমার সব কাজ শেষ হওয়ার পর ওই মেয়েকে সেই ছ’জনের সাথে জীবিত দাফন করেই সারাজীবনের জন্য মৈত্রী বংশের চিহ্ন মিটিয়ে দেবো।”

“কিন্তু জনাব, এখন তূর্য তো বিয়ে করেছে।”

“তো! ওই মেয়ে আমাদের কাজে বাঁধা হয়ে আসলে ওকেও মেরে ফেলবো। কেউ বাঁচবে না। কেউ না।”

উপমা তূর্যের পাশে বসে আছে। তূর্য ফোন নিয়ে ব্যস্ত। তাদের বিয়ের কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেছে। এই কয়েক সপ্তাহে উপমা তূর্যের চোখে তার প্রতি কোনো ভালোবাসা দেখে নি। তূর্য কেমন যেন চুপচাপ থাকে। বেশিরভাগ সময় বন্ধুদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। রাতে যদিও একটু কাছে পায়, কিন্তু সেই কাছে পাওয়ার মাঝে উপমা কোনো ভালোবাসা খুঁজে পায় নি। এটা শুধু তূর্যকে দেওয়া একটা বৈধ অধিকার মাত্র। কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া এভাবে কাছে আসা কি বৈধ? অবৈধ হওয়ার কোনো যুক্তি নেই, কিন্তু উপমার মন যে তাকে বলছে এটা অন্যায় হচ্ছে। তূর্য তার উপর অন্যায় করছে। তবে এটা শুধু মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মুখে আর প্রকাশ পাচ্ছে না। কারণ তার এতো বছরের ভালোবাসা, তার প্রিয় মানুষটিকে বৈধভাবে পাওয়ায় তার জন্য বিরাট কিছু। এর চেয়ে বেশি চাইতে গেলে যদি হারিয়ে ফেলে? তাই উপমা চুপ করে আছে।

এদিকে তূর্য উপমাকে ঘরে উঠানোর পর থেকে ইমনকে রুম ছাড়তে হয়েছে। এখন সে তাহমিদ আর আহনাফের সাথে থাকে। ইমন রুমে আসার পর থেকে আহনাফ ঠিকভাবে ঘুমাতে পারছে না। একটা বিছানায় তিনজন কোনোভাবেই থাকা যাচ্ছে না। আজ বাধ্য হয়ে আহনাফ ডায়নিংয়ে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়েছে৷ আর সকালে এটা দেখার পর তূর্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে রুম ছেড়ে দেবে। সে সোজা এসে উপমাকে বলল,
“তুমি বরং অরুণিকার রুমে চলে যাও। আজ থেকে ওর সাথেই থেকো। আমাদের আলাদা রুম নিয়ে ফেলাতে বাকিদের থাকার অসুবিধা হচ্ছে।”

উপমা তূর্যের কথা শুনে চুপ করে রইলো৷ মনে মনে খারাপ লাগলেও ব্যাগপত্র গুছিয়ে সে চুপচাপ অরুণিকার রুমে চলে গেলো। আরাফ উপমাকে অরুণিকার রুমে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“উপমা, তুমি ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”

“অরুণিকার ঘরে যাচ্ছি।”

“কেন?”

“আমাদের জন্য সবার থাকার অসুবিধে হচ্ছে। আমি আর তূর্য একটা রুম নিয়ে বসে আছি। আমি অরুণিকার সাথে থাকলে ইমন ভাইয়া আবার তূর্যের সাথে থাকতে পারবে, তাই।”

আহনাফ অবাক হয়ে বলল,
“তোমাকে কে বলেছে রুম ছাড়তে? এটা আমাদের ব্যাপার। আমরা দু’একদিনের মধ্যে একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো। তুমি এখন তূর্যের স্ত্রী। এভাবে আলাদা কেন থাকবে? যাও ব্যাগ নিয়ে ঘরে যাও।”

উপমা আহনাফের কথায় আবার ব্যাগ নিয়ে রুমে চলে এলো। তূর্য উপমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“কি হলো, আবার চলে এসেছো যে!”

“আহনাফ ভাইয়া বলছে আমাকে এখানে থাকতে।”

তূর্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

এরপর তূর্য রুম থেকে বের হতেই আরাফ তাকে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলো। তূর্য হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“কি করছিস?”

আরাফ বলল, “তুই কি করছিস?”

“আমি আবার কি করলাম?”

“তুই নতুন বিয়ে করেছিস। কিন্তু তোকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়ের সত্তর বছর পার করে ফেলেছিস। তোর এই মুহূর্তে উপমাকে সময় দেওয়া উচিত, নাকি ফোনে আর আমাদেরকে।”

তূর্য শান্ত কন্ঠে বলল,
“আরাফ, প্লিজ। আমি ওকে যতোটুকু সময় দেওয়ার দিচ্ছি। আর কতো সময় দেবো ওকে? সারাদিন কি এখন ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকবো?”

আরাফ রাগী দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে কিছুক্ষনের তাকিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো। তূর্যও রাগ দেখিয়ে দেয়ালে পা দিয়ে জোরে আঘাত করে মিনমিনিয়ে বলল,
“বিয়েটা করেই ভুল করেছি৷ আমার তো বাংলাদেশে গিয়ে ওর সাথে দেখা করাই উচিত হয় নি।”

দুপুরে উপমা রান্নাঘরে এসে তূর্যের পছন্দের বিরিয়ানি রান্না কর‍তে লাগলো। তূর্য রান্নাঘরে এসে দেখলো উপমা খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে। সে রুম থেকে একটা মাথার কাঁটা এনে তার চুল বেঁধে দিলো। তূর্যের স্পর্শ পেয়ে উপমা কেঁপে উঠলো, মনে মনে খুশিও হলো। পরক্ষণেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো, যখন তূর্য বলল,
“বাসায় আমি ছাড়া অনেকেই আছে। তরকারিতে চুল পড়লে, বাকিরা কি মনে করবে? তাহমিদ এগুলো পছন্দ করে না। তাই একটু সাবধানে কাজ করো।”

তূর্য বের হতে যাবে তখনই উপমা বলল,
“আপনার পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করছি।”

তূর্য মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা, থ্যাংক ইউ। কিন্তু আমি দুপুরে বাসায় খাচ্ছি না। আমার স্টুডিওতে যেতে হবে।”

উপমা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তূর্য রুম থেকে তার গিটার নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। তূর্যের যাওয়া দেখে উপমার চোখ দু’টি ছলছল করে উঠল। খ্যাতিসম্পন্ন মানুষগুলো কি এমনই হয়? তারা কি অন্যের অনুভূতি বুঝে না? তূর্য কি বুঝতে পারছে না উপমা কি চাইছে?

চলবে–

(আগামী পর্বে সবার অনেকদিনের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটবে। 🤗)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here