অরুণিকা পর্ব -৫৪+৫৫+৫৬

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৪||

৯০.
অরুণিকার কথায় আহনাফ ইমানের সাথে দেখা করতে গেলো। তারা একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। ইমান কফির কাপে চুমুক বসাতেই আহনাফ বলল,
“ওদিন হঠাৎ তুমি চলে গেলে যে!”

ইমান আহনাফের প্রশ্নে মনে মনে ঘাবড়ে গেলেও মুখে হাসি টেনে বলল,
“হাসপাতাল থেকে মা ফোন দিয়েছিল। আমার বোনের একটা মেয়ে হয়েছিল তো তাই। মা বলল তাড়াতাড়ি আসতে। তাই চলে এলাম।”

আহনাফ গম্ভীরমুখে বলল,
“এটা তো খুশির খবর। এই খবরটা তো আমাদের জানিয়ে যেতে পারতে।”

ইমান আহনাফের দিকে সেকেন্ড খানিক শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
“মা ফোন করে বলেছিল, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে। মেয়ে হয়েছে সেটা আগে বলে নি। তাই চিন্তিত ছিলাম।”

“আচ্ছা, ভালো। মেয়েটার ছবি তো দেখাও। দেখতে কেমন হয়েছে দেখি!”

ইমান দাঁত কিড়মিড়িয়ে ফোন বের করলো৷ ছবি খুঁজতে খুঁজতে বলল,
“একটাই ছবি তুলেছিলাম। মা আসলে সদ্যোজাত শিশুর ছবি তোলা পছন্দ করেন না। আর কাউকে দেখানো তো একদমই না। মা মনে করেন নজর লেগে যাবে। আমি অবশ্য এসবে বিশ্বাস করি না।”

ইমান ফোন ঘেঁটে বলল,
“হায় হায়, মা তো ছবিটাই ডিলিট করে দিয়েছে। দেখেছেন ভাইয়া, মা এসব ব্যাপারে মারাত্মক সচেতন।”

আহনাফ কোণা চোখে ইমানের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমান প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“নতুন একটা প্রজেক্টের জন্য মির্জা গ্রুপ আর বাস্কার গ্রুপ মিলিত হয়ে কাজ করছে। ওদের প্রজেক্টটা খুব কোয়ালিটি সম্পন্ন। ওরা বাই এনি চান্স, প্রজেক্টটা লঞ্চ করলে, আপনারা উঠতে পারবেন কিনা সন্দেহ। আর মুন্সী গ্রুপ খুব দুর্বল একটা কোম্পানি। আপনারা বাকি কোম্পানি বাদ দিয়ে তাদের সাথে পার্টনারশীপ করেছেন, এটা একটু ভাববার বিষয়।”

“দেখো ইমান। তুমি তো জানোই মির্জা গ্রুপ আমাদের কতো বড় শত্রু। একটা প্রবাদ আছে, শত্রুর শত্রু মিত্র হয়৷ সুলতান মুন্সী আর শাহেদ মির্জার ঘোর দ্বন্ধ, আর সেই সুযোগে আমরা তাদের মিত্র হয়ে গেলাম।”

ইমান শূন্য দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া, মাঝে মাঝে চোখের দেখাও ভুল হয়।”

আহনাফ বাঁকা হেসে বলল,
“জানি, চোখের দেখা যেমন ভুল হয়, মুখের কথাও অনেক সময় মিথ্যে হয়।”

ইমান ভ্রূ কুঁচকে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল,
“তোমাকে নতুন কাজ দেওয়ার জন্য ডেকেছি। মুরশিদ জুবায়ের আর রহমতুল্লাহর সব তথ্য বের করে দেবে। তাদের ছবি, আর কিছু ডিটেইলস তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

আহনাফ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে একটা সিগারেট ধরালো। আর মনে মনে বলল,
“আই এম সরি অরু, তুমি ইমানকে যতোটুকু পছন্দ করো, তার চেয়ে বেশি আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর আহনাফ নিজের ভালোবাসা আদায় করে নিতে পারে।”

আহনাফ বাসায় আসতেই অরুণিকা দৌঁড়ে তার কাছে গেলো। আহনাফের কাছে আসতেই সিগারেটের গন্ধ পেয়ে অরুণিকা নাক চেপে ধরে বলল,
“তুমি আবার সিগারেট খেয়েছো?”

আহনাফ অরুণিকার কাছে এসে বলল,
“ছাড়ার কোনো সুযোগ পাচ্ছি না তাই।”

“সুযোগ পাচ্ছো না কেন? তোমাকে কেউ চেপে ধরে সিগারেট খাইয়ে দিচ্ছে নাকি!”

“তুমি বুঝবে না। এসব বোঝার জন্য তুমি এখনো অপরিপক্ব।”

অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে আহনাফের হাত ধরে তাকে উপরে নিয়ে গেলো। আহনাফ রুমে এসেই আলমারি থেকে নিজের কাপড় বের করতে লাগলো। অরুণিকা আহনাফের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কিছু বলছো না যে?”

আহনাফ পেছন ফিরে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আবার কাপড় খোঁজায় মনোযোগ দিলো। অরুণিকা আহনাফের শার্টের কোণা আঁকড়ে ধরে বলল,
“বলো না। আমি এতোক্ষণ তোমার অপেক্ষায় বসে ছিলাম।”

আহনাফ অরুণিকার দিকে ফিরে কিছুক্ষণ গম্ভীরমুখে তাকিয়ে থেকে বলল,
“প্রতিদিন তো আর অপেক্ষা করো না। আজ তো বিশেষ খবরের অপেক্ষায় বসে ছিলে, তাই না?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। আহনাফ তার আঙ্গুল ধরে বলল,
“ইমানের সাথে দেখা করে এসেছি।”

অরুণিকা আগ্রহী কন্ঠে বলল,
“হুম, কি বলেছে ও?”

“অরু, ইমানকে তোমার কথা তো বলি নি, শুধু এতোটুকু জিজ্ঞেস করেছি, কোনো প্রেমের সম্পর্ক আছে নাকি।”

অরুণিকা জিজ্ঞাসু চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মন বার-বার বলছে, আহনাফ তাকে ভালো খবরই দিবে। কিন্তু আহনাফ বলল,
“ও একটা মেয়েকে ভালোবাসে। ওদের বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে। আর খুব শীঘ্রই ওদের বিয়ে হবে।”

অরুণিকা আহনাফের হাত সরিয়ে দিয়ে বিছানার একপাশে গিয়ে বসে পড়লো। আহনাফ তার কাপড় আলমারি থেকে নামিয়ে অরুণিকার পাশে এসে বসলো। অরুণিকা মলিন মুখে বললো,
“ওর সাথে তো আমার আলাদাভাবে কখনো কথাও হয় নি। কিন্তু ওর চোখাচোখি হলেই মনে হতো ও আমাকে পছন্দ করে। ভাবীও বলেছিল, মেয়েরা ছেলেদের চোখ দেখলেই বুঝে ফেলে, তারা কি অনুভব করে। তাহলে আমি কিভাবে ভুল বুঝলাম?”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“আমার চোখ দেখে কি তুমি কিছু বোঝো নি?”

অরুণিকা আহনাফের চোখের দিকে তাকালো। তারপর ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি বুঝবো!”

আহনাফ এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“কচু বুঝো তুমি। কচু। তুমি চোখ দেখে কিছুই বুঝো না। বুঝলে এখন বলতে পারতে আমি তোমার কতোটা কেয়ার করি।”

“আরেহ, ওটা তো জানিই। তুমি, আরাফ, তাহমিদ, রকস্টার আর ইমন, তোমরা আমাকে অনেক ভালোবাসো। শুধু ইভানই বাসে না।”

“আগে ও নিজেকে ভালোবাসুক, তারপর বাকিদের ভালোবাসবে। এখন ওর কথা বাদ দাও।”

তারপর আহনাফ মিনমিনিয়ে বলল,
“পুরো বিশ্বের সবার ভালোবাসা তার লাগবে, শুধু আমারটাই লাগবে না।”

অরুণিকা তার কানটা আহনাফের মুখের কাছে এনে বলল,
“বিড়বিড় করে কি বলছো!”

আহনাফ তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“উফ! অরু। যাও এখন। আমি ফ্রেশ হবো। ইমানের চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়ে গেছে।”

অরুণিকা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর যাওয়ার আগে বলল,
“এখন কি আমার তোমাকেই বিয়ে করতে হবে?”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“সমস্যা আছে বিয়ে করতে?”

“না, সমস্যা তো নেই। আসলে আমি তো তোমাকে নিয়ে ওভাবে চিন্তা করি নি!”

“তো এখন করো। যাও আমার জন্য শরবত বানিয়ে আনো। আফটার অল, আমি তোমার হবু বর। আমার সেবা করা তোমার দায়িত্ব।”

অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তোমার শরবত তুমি বানিয়ে খাও। একটা কাজ দিয়েছি ওটাও ভালোভাবে করতে পারো নি। হুহ।”

অরুণিকা হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আহনাফ মলিন হেসে বলল,
“তুমি এখনো অনেক ছোট অরু। এখনো কিছুই বুঝতে শেখো নি। নয়তো হবু বরকে কি কেউ প্রেমিকের কাছে পাঠায়? তাও আবার তার ভালোবাসার কথা জানার জন্য!”

আজই নতুন গাড়ি কিনেছে আরাফ। সেই গাড়ি করেই সে চেম্বারে যাচ্ছে। হঠাৎ তার গাড়ির সামনেই হাত এগিয়ে দিয়ে একটা লোক এসে দাঁড়ালো। আরাফ গাড়ি থামিয়ে নামতেই লোকটা আরাফের হাত ধরে বলল,
“বাবা, কিছু খেতে দেবে? আমার হাতে একটা টাকাও নেই।”

লোকটা কথাটি বলতে বলতেই শব্দ করে কেঁদে দিলো। আরাফ তার মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে লোকটার হাতে দিতেই সে লোকটির মুখোমুখী হলো। আরাফ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“মামা! আপনি?”

আরবান তালুকদার ভালোভাবে আরাফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কে তুমি? তোমাকে তো চিনলাম না।”

“মামা, আমি আরাফ। আরাফ চৌধুরী।”

আরবান তালুকদার আরাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
“তুমি বেঁচে আছো? আমার তন্নির ছেলে? তুমি তন্নি আর আরহামের ছেলে?”

“হ্যাঁ।”

আরবান তালুকদার শক্ত করে ভাগ্নেকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আর বলতে লাগলেন,
“বাবা, কেউ নেই আমার। সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বোনটাকে তো হারিয়েই ফেললাম, তোমার নানা-নানুও আর বেঁচে নেই। ছেলে দুইটাকে কতো টাকা খরচ করে মানুষ করিয়েছি৷ ওরা আমার ঘর থেকে আমাকেই বের করে দিলো। আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। আমার কোনো আপন মানুষ নেই।”

“কি বলছেন মামা? আমি আছি তো।”

আরাফ আরবান তালুকদারকে একটা দোকানে বসিয়ে কলা-পাউরুটি খাওয়ালো। তারপর মামার পাশে বসে বললো,
“মামা, বাসায় চলেন।”

“কার বাসায় যাবো? ওরা তো এতো স্বার্থপর হয়ে গেছে যে আমাকে বাবা বলেই আর স্বীকার করে না। ”

“আমার বাসায় যাবেন, মামা।”

“তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? কেন বাবা? আমি তো তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি তোমার বাবা-চাচাদের সাথে অনেক অন্যায় করেছি। আমার বোনটার মৃত্যুর দায় তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল। তোমার বাবা তো তন্নিকে অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু আমিই জেদ ধরে তোমার বাবার নামে মামলা করেছি। আল্লাহ এখন এই অপরাধের শাস্তিই দিচ্ছেন!”

“যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব তো বাবা অনেক আগেই ভুলে গিয়েছিলেন।”

“তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিল। আমি শুধু শুধু তোমার বাবার উপর রাগ করে সম্পর্কটা ভেঙে দিয়েছিলাম। তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা।”

আরাফ আরবান তালুকদারকে বাসায় আনল। তাকে নিজের রুমে বসিয়ে জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করলো। উপমাকে বলল খাবারের ব্যবস্থা করতে৷ ইভান আরাফের হাত ধরে তাকে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,
“উনাকে কেন এনেছিস?”

“উনি রাস্তায় পড়ে ছিল। উনার ছেলেরা উনাকে বাড়ি ছাড়া করেছে।”

“ভুলে যাবি না, উনি তোর বাবার কতো বড় ক্ষতি করেছিল। আন্টির মৃত্যুর পর এই লোকটাই একাধারে চৌধুরী বংশের সবার নামে মামলা করে সবাইকে জেলের ভাত খাইয়েছিল।”

“কিন্তু এটা অনেক আগের ঘটনা। মামা উনার ভুল বুঝতে পেরেছেন।”

“তোর দাদা উনাকে পছন্দ করতো না, আরাফ।”

“হ্যাঁ, কারণ উনি আমাদের ক্ষতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু কেন? মায়ের মৃত্যুর জন্যই তো! আমার মা মারা গিয়েছিল। একজন ভাইয়ের জন্য এটা কতো কষ্টকর তুই বুঝতে পারছিস না? তোরও তো বোন ছিল।”

“আমার বোনের খুন হয়েছে। আর তন্নি আন্টি অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। দুইটা আলাদা ব্যাপার।”

“আর কতোদিন ঘৃণা করবো। দোষ তো আমারই। ডাক্তার বলেছিল, মায়ের জন্য সন্তান জন্ম দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও মা আমাকে জন্ম দিয়েছে। এখানে বাবারও দোষ নেই, মামারও দোষ নেই। আমার দোষে এতোগুলো সম্পর্ক এলোমেলো হয়ে গেছে। ইভান, এখন আমি অনাথ। বাবাকেও হারিয়ে ফেলেছি। এতো বছর পর একজন কাছের মানুষ পেয়েছি। আমি কি করে তাকে রাস্তায় ফেলে আসবো?”

ইমন তাদের কথোপকথন আন্দাজ করে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাই, তুমি একটু উদার হও। আংকেলটা অনেক অসুস্থ। আমাদের মামা হলে আমরা ফেলে আসতে পারতাম, বলো?”

চলবে–#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৫||

৯১.
উপমা অরুণিকাকে নিয়ে শপিং থেকে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই তার চোখ আটকে গেলো সামনের টেবিলে। উপমা এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। উপমার হেলদোল না দেখে অরুণিকা তার চোখ অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে দেখলো তূর্য একটা মেয়ের সাথে বসে কথা বলছে। উপমা সামনে পা বাড়াতে যাবে তখনই মেয়েটা হুট করে তূর্যের বুকে হাত রাখলো। অরুণিকা সেটা দেখেই তূর্যের সামনে এসে দাঁড়ালো। তূর্য অরুণিকা আর তার পেছনে উপমাকে দেখে সেকেন্ড খানিকের জন্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, আর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“টুইংকেল, তুমি এখানে?”

পাশের মেয়েটি উপমাকে দেখে ভীত চোখে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার চোখেমুখে আতংক ভীড় করেছে। মেয়েটি ব্যস্ত কন্ঠে তূর্যকে বলল,
“রিকি, আমি আসি। তোমার সাথে পরে কথা হবে।”

তূর্যও আর মেয়েটিকে আটকালো না। মেয়েটির বের হওয়ার সময় আরেকবার উপমার চোখাচোখি হলো। উপমা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এদিকে তূর্য প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলে উঠলো,
“ও আমার ফ্রেন্ড। আমরা একসাথে কাজ করি। স্টুডিও থেকে এখানে এসেছি লাঞ্চ করার জন্য।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোমার কেমন ফ্রেন্ড, যে তোমার এতো কাছে চলে এসেছে?”

“কোথায় কাছে এসেছে? আমরা কতো দূরত্ব রেখে বসেছি, দেখো নি?”

“রকস্টার, মিথ্যে বলছো কেন? আমি কি কিছু বুঝতে পারছি না ভাবছো?”

তূর্য ঠান্ডা গলায় বলল, “বাসায় চলো।”

উপমা হঠাৎ বলে উঠলো,
“না, বাসায় যাবো না। আমি মুনলিটের সাথে খেতে এসেছি। এখন তো খেয়েই বাড়ি ফিরবো। আপনার ফ্রেন্ড যেহেতু চলে গেছে, আপনিও চলে যান।”

উপমার থমথমে কন্ঠ শুনে তূর্য কিছুটা দমে গেলো। সে কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো। বাসায় এসে তূর্য ছটফট করতে লাগলো। ইমন তূর্যকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? বাসায় আসার পর থেকেই দেখছি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিস! সমস্যা কি?”

“একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। টুইংকেল আর উপমা আমাকে হৃদির সাথে দেখে ফেলেছে।”

ইমন ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এ আর নতুন কি! তোর মেয়ে বন্ধুর তো অভাব নেই।”

“ভাই, মেয়েটা হুট করে আমার কাছে চলে এসেছিল, আর ওইটাই ওরা দেখে ফেলেছে।”

ইমন ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুই না বললি মেয়েটা তোর জাস্ট ফ্রেন্ড। এখন এটা বলিস না যে তুই পরকীয়া করছিস। বাসার কেউ জানলে তোকে জুতা পেটা করে ঘর থেকে বের করবে।”

“আরেহ না। ও তো শুধুই আমার ভক্ত। মাঝে মাঝে দেখা করি৷ একটু ঘুরাঘুরি করি। ভাই, এক বছর আগে মেয়েটা আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। এরপর থেকে আমি ওকে অনেক ইগনোর করেছিলাম। আর আজকে দেখা করে হঠাৎ কাছে চলে এসেছে। আর সেটাই ওরা দু’জন দেখে ফেলেছে। এখন ওরা কি ভাববে আমাকে নিয়ে?”

ইমন তূর্যকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কি ভাববে মানে? উপমার কেমন লেগেছে, সেটা আগে তুই ভেবে দেখ। ও তোর বউ। আর তুই ওই মেয়ের সাথে দেখা করতে কিভাবে গেলি, যে তোকে প্রেমের প্রস্তাব দিলো?”

“আমি ওকে ইগনোর করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না। ও বারবার আমাকে ফোন দিচ্ছিল, রিকুয়েষ্ট করছিল দেখা করার জন্য।”

ইমন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তুই আদৌ ওই মেয়েটাকে ইগনোর করেছিলি? উপমাকে যেভাবে ইগনোর করিস মেয়েটাকেও ওভাবে ইগনোর করে দেখতি, হয়তো কাজ হতো।”

কথাটি বলেই ইমন চলে গেলো। এদিকে বিকেলে উপমা আর অরুণিকা বাসায় ফেরার পর তূর্য উপমার কাছে এসে বলল,
“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। আমরা একটু গাড়িতে গিয়ে বসি।”

উপমা গম্ভীরমুখে বলল,
“গাড়িতে কেন? অন্য কেউ আমাদের কথা না শোনার জন্য? আর আপনি এতো ছটফট করছেন কেন? আপনি কি কোনো অপরাধ করেছেন?”

“না, এমনিতেই। আমি তো একদমই ছটফট করছি না।”

“ছটফট না করলে আমি এই বাসায় ঢুকলাম, আর আপনি এই আমাকে বাইরে যেতে বলছেন?”

বাকিরা সবাই বসার ঘরেই ছিল। উপমার উঁচু গলার শব্দ শুনে সবাই বেরিয়ে এলো। তূর্য পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলল,
“রুমে চলো।”

অরুণিকা উপমার হাত ধরে তূর্যকে বলল,
“যেহেতু তোমার কোনো কিছুই রুমের ভেতরে নেই, রেস্টুরেন্টে উন্মুক্ত হয়ে গেছে, তাহলে এখন ভাবীকে রুমে কেন ডেকে নিয়ে যাচ্ছো?”

তূর্য রাগী কন্ঠে বলল,
“তুমি এসব ব্যাপারে কথা বলতে আসবে না। তুমি এখনো এতো বড় হও নি।”

“ঠিক আছে, আমি বড় হই নি। কিন্তু এতোটাও ছোট না যে বুঝবো না কোনটা ফ্রেন্ডশিপ, আর কোনটা রিলেশনশিপ।”

“ও জাস্ট আমার ফ্রেন্ড। আমি তো বলেছি, আমরা একসাথে স্টুডিওতে কাজ করি।”

উপমা চেঁচিয়ে বলল,
“মিথ্যা কথা। মেয়েটা স্টুডিওতেই কাজ করে না। আপনি যার সাথে লুকিয়ে প্রেম করছেন, মেয়েটার পরিচয় কি জানেন?”

“আমি মোটেও ওর সাথে প্রেম করছি না, উপমা। তুমি আমাকে ভুল ভাবছো।”

ইভান তাদের কথার মধ্যে দিয়ে বলে উঠলো,
“হয়েছে টা কি? কোন মেয়ের কথা বলছো তোমরা?”

অরুণিকা রেস্টুরেন্টে যা যা দেখেছে সব ঘটনাই খুলে বললো। সব শুনে আরাফ তূর্যকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“এগুলো করতে দেশে এসেছিস? এভাবে মৃত বাবা-মার হত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছিস? এসব নোরাংমি করে?”

তূর্য চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“না, ভাই না। মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি না। মেয়েটা জাস্ট আমার ফ্রে……”

উপমা তূর্যকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“মেয়েটা জাস্ট আপনার ফ্রেন্ড। আপনারা স্টুডিওতে একসাথে কাজ করেন, এটাই তো?”

“হ্যাঁ।”

“যদি আমি বলি মেয়েটা গানের ‘গ’ও জানে না তখন?”

“তোমাকে কে বলেছে ও গান জানে না?”

“কারণ আমি মেয়েটাকে চিনি। ইনফ্যাক্ট খুব ভালোভাবেই চিনি। মেয়েটাই হচ্ছে হৃদি আপু, যেই মেয়েটার জন্য আমার ভাইয়া এখনো বিয়ে করে নি। এই মেয়েটার সাথেই ভাইয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এই মেয়েটাই হুট করে তিন বছর আগে বিয়ের কথাবার্তা উঠতেই ভাইয়ার সাথে সম্পর্ক ভেঙে ফেলে, আর বলে দেয়, তার বাবা তার জন্য ডাক্তার ছেলে ঠিক করে ফেলেছে,যেই ছেলে সব দিক থেকে আমার ভাইয়ার চেয়ে উপযুক্ত।”

সবাই অবাক হয়ে উপমার দিকে তাকিয়ে রইলো। উপমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অরুণিকা তাকে সামলাতে গেলে তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। উপমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি চার বছর ধরে এই লোকটার সাথে সংসার করেছি। কিন্তু ও আমাকে একটুও ভালোবাসেনি। আমিও কখনো জোর করি নি। ভাবতাম, স্টারদের ভালোবাসা এমনই হয় হয়তো। যখন থেকেই এই মানুষটাকে আমার স্টার ভাবা শুরু করেছি, তখন থেকেই এর সব অপরাধ, সব ভুল আমি মাফ করেছি। বিয়ের পর তো আমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী ভাবতাম, আমার স্টারের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। যাকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম সে আমার বর হয়েছে। কিন্তু এই মানুষটা আমাকে কখনো ভালোবাসে নি। তারপরও আমি চুপ করে সব মেনে নিয়েছি। কিন্তু আজ সে আমার ভাইয়ার ভালোবাসার মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে।”

তূর্য উপমার সামনে হাত জোড় করে বলল,
“বিলিভ মি, আমি ওর সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াই নি। ও আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল, আর আমি শুধু দেখা করতে গিয়েছি। এরপর ও নিজেই আমার কাছে এসেছে।”

উপমা কোনো কথা না বলে উপরে উঠে গেলো। অরুণিকা বলল,
“আমি তোমাকে রকস্টার বলতাম। কিন্তু তুমি স্টার না, একটা ব্ল্যাক হোল। যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই মিথ্যে। তুমি একটা…..”

আরাফ উঁচু গলায় বলল,
“অরু, তুমি তোমার রুমে যাও।”

অরুণিকা আরাফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। ইমন অরুণিকার হাত ধরে তাকে উপরে নিয়ে গেলো। অরুণিকা ইমনের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তোমরা আমাকে কেন বকছো? আর আরাফ আমাকে এভাবে ধমক দিল কেন?”

ইমন রাগী কন্ঠে বলল,
“তূর্যকে কিছু বলার জন্য আমরা সবাই আছি তো নাকি। তুমি ওকে এতোকিছু বলার কে? ও তোমাকে এইটুকু থেকে এতো বড় করেছে। তোমার মুখ থেকে এসব কথা মানায় না।”

অরুণিকা মাথা নিচু করে রইলো। ইমন আবার বলল,
“তুমি দেখো নি তোমার কথায় ও কতো কষ্ট পেয়েছে? ও কাউকে খুন করলেও তুমি চুপ করে থাকবে। ওকে শাসন করার জন্য নিচে আরো অনেকেই আছে। আরাফ আর ইভান থাকতে তোমাকে কে বলেছে মুখ খুলতে? যাও, এখন নিজের রুমে যাও।”

অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে রুমের দিকে যাওয়ার সময় আরবান তালুকদারের মুখোমুখি হলো। আরবান অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“ওরা তো তোমার ভালো চায়। ওদের কথায় মন খারাপ করো না। চলো।আমার সাথে৷ আমি তোমাকে তোমার বাবা-চাচাদের গল্প শুনাবো।”

অরুণিকা আরবান তালুকদারের সাথে বারান্দায় চলে গেলো।

৯২.

তূর্য উপমার পাশে চুপচাপ বসে আছে। তূর্যের চোখে পানি টলমল করছে। সে কথা বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। বার-বার অরুণিকার বলা ব্ল্যাক হোল শব্দটা তার কানে বাজছে। যদিও শব্দটা কোনো খারাপ অর্থ বোঝায় না। কিন্তু অরুণিকার মুখ থেকে খারাপ মানুষদের সংজ্ঞা এভাবেই বেরিয়ে আসে। তূর্যের চোখ থেকে টপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে চোখ মুছে উপমাকে বলল,
“আমি তোমাকে আজ সব সত্য কথা বলবো।”

তূর্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“উপমা, আমি তোমার সাথে বিয়ের আগে যেভাবে কথাবার্তা বলেছি, বাকি মেয়েদের সাথেও সেভাবেই কথা বলি। অনেক মেয়েই আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি কোনো মেয়ের মধ্যেই কোনো আগ্রহ খুঁজে পাই নি। সবক’টাই টাইম পাস ছিল। যারা আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল, সবাইকে আমি না বলেছি। যারা আমার মেয়ে ফ্রেন্ড, তারা সবাই জানে আমি বিবাহিত। এরপরও অনেকে আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চায়। হ্যাঁ, আমি অনেক খারাপ মানুষ, তাই হয়তো ওদের ইগনোর করি না। কিন্তু তোমার জায়গাটা আমি কাউকে দেই নি। আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে স্পর্শ করি নি। আমি….”

উপমা তূর্যকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“সব মেয়েগুলোকে আনফ্রেন্ড করে দিন। আমি চাই, আজকে থেকে আমি ছাড়া আপনার জীবনে আর কোনো মেয়ে না থাকুক।”

তূর্য চুপ করে রইলো। উপমা তূর্যকে নিরব দেখে বলল,
“মেয়ে মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করা আপনার নেশা হয়ে গেছে। এই নেশা ছাড়তে অনেক কষ্ট হবে আপনার, তাই না?”

তূর্য এবারও চুপ করে রইলো। উপমা হঠাৎ তূর্যের হাত ধরে কাতর কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনি কি বুঝতে পারছেন না, আমি আপনার কাছে ভালোবাসা চাচ্ছি! আমি আপনার কাছে স্ত্রীর অধিকার চাচ্ছি।”

তূর্য মাথা নেড়ে বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, উপমা। আমি তো তোমাকে সব অধিকার দিয়েছি।”

উপমা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“রাতে কাছে টেনে সকালে দূরে সরিয়ে দেওয়া ভালোবাসা না। আপনি এতোটাও মূর্খ না যে ভালোবাসা কি বুঝতে পারছেন না।”

তূর্য উপমার হাত ধরে বলল,
“হয়তো আমি ভালোবাসতে পারি না, নয়তো আমার ভালোবাসাগুলো এমনই। আর যাই বলো, তোমার জায়গা আমি কাউকে দিচ্ছি না, উপমা। রাত-দিন যেই সময়ই হোক, তুমি আমার চোখের সামনে থাকলেই আমি ভালো থাকি। আমার কাছে এটাই ভালোবাসা।”

“অরুণিকার ক্ষেত্রেও আপনি এটাই অনুভব করেন। ওকে না দেখলে আপনার অস্থিরতা বেড়ে যায়। ও আশেপাশে থাকলেই আপনি ভালো থাকেন। তাহলে ওটাও তো ভালোবাসা। কিন্তু আমি তো আপনার স্ত্রী। যেই ভালোবাসার চোখে আপনি অরুণিকাকে দেখছেন, সেই ভালোবাসা আর আমার জন্য ভালোবাসা কি আলাদা হওয়ার কথা না? অরুণিকা আপনার প্রাণ। আপনি কখনো ওকে নিজের বোন বলেন নি, কিন্তু আমি জানি, আপনার ওর জন্য অনুভূতিগুলো কতোটা ভিন্ন। কিন্তু আমার সাথে তো আপনার সম্পর্ক ওটা না। আমি কি সেই অনুভূতির ঊর্ধ্বে না? আমার কি আরেকটু বেশি ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই? আমাকে কি আপনার কিছু সময় দেওয়া যায় না? অন্য মেয়েদের পরিবর্তে কি আপনি আমার সাথে, আমাকে নিয়ে ঘুর‍তে যেতে পারেন না?”

তূর্য চুপ করে রইল। তূর্যের হেলদোল না দেখে উপমা মলিন হেসে অন্যপাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সেদিন সারারাত উপমা নিঃশব্দে কেঁদেছে। আর অন্যদিকে তূর্য সারারাত ছটফট করেছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, উপমাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে তার কেন এতো দ্বিধা কাজ করছে।

দুইদিন পর, হঠাৎ সকালে ভাংচুরের শব্দ শুনে সবাই নিচে নেমে এলো। নিচে নেমে দেখলো কোনো একটা বিষয়ে ইভান আর তূর্যের মধ্যে মারাত্মক ঝগড়া বেঁধেছে। আর একপাশে উপমা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য চেঁচিয়ে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“তোর আমার বউয়ের প্রতি নজর আছে, সেটাই বল না। নয়তো আমার চেয়ে তোর ওর প্রতি এতো মায়া কেন লাগছে?”

আহনাফ তূর্যকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,
“পাগলের মতো প্রলাপ বকছিস কেন?”

“আমাকে কেন পাগল বলছিস? ওদের দুইজনকে বল। রান্নাঘরে কি করছিল দুইটা?”

ইভান চেঁচিয়ে বলল,
“তোর আমাকে সন্দেহ হচ্ছে? চার বছর পর আজই তোর আমাকে সন্দেহ হচ্ছে? কেন, তূর্য? আজ হঠাৎ কি দেখে তুই আমাকে সন্দেহ করছিস? প্রতিদিন সকালে আমি উপমার সাথে সকালের নাস্তা বানাই। দুপুরে তাহমিদ উপমাকে সাহায্য করে, রাতে আরাফ বা ইমন। তুই কখনো রান্নাঘরে গিয়ে তোর বউকে সাহায্য করেছিস? এই বাসায় তোর বউ আছে, তোকে মুখে ভাত তুলে দেওয়ার জন্য। আর আমাদের রুটি আমরা নিজের হাতে বানিয়ে খাচ্ছি। আজ মেয়েটা হাত পুড়িয়ে ফেলেছিল, আমি শুধু বরফটাই লাগিয়ে দিচ্ছিলাম।উপমা আমার কাছে বোনের মতো।”

ইভান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“কিন্তু আমি কাকে বোঝাচ্ছি এসব? তোর মতো পাগলকে বোঝাচ্ছি। তোর মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে।”

তূর্য কিছু বলতে যাবে তখনই তাহমিদ আর আহনাফ তাকে শান্ত করিয়ে উপরে নিয়ে গেলো। ইভান রাগে গজগজ করতে করতে উপরে চলে গেল। আর এদিকে উপমা বসে বসে কাঁদছে। অরুণিকা তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। এদিকে ইমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে,
“যতোদূর আমি দেখেছি, তূর্য সকাল সকাল ছাদে গিয়েছিল। সেখান থেকে সে সোজা নিচে নেমেছে। এর আগে কখনো তূর্য এমন রিয়েক্ট করে নি৷ আজ সামান্য এই বিষয়টাকে এতো বড় করে দেখার কি ছিল? এর মধ্যে কিছু একটা তো আছে!”

এদিকে রহমতুল্লাহ একজনকে ফোন দিয়ে বলল,
“বস, আমাদের কাজ হয়ে গেছে।”

ওপাশ থেকে আগন্তুক বলে উঠলো,
“বাসার পরিবেশ কেমন?”

“খুবই অস্থির। তিন-চারদিন ধরেই ঝামেলা চলছে। এদিকে আরাফ তার মামা আরবান তালুকদারকেও বাসায় উঠিয়েছে। এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি একসাথে মারা যাবে মনে হচ্ছে।”

ওপাশ থেকে উচ্চস্বরে হাসির শব্দ ভেসে এলো। হাসি থামিয়ে আগন্তুকটি বলল,
“আগে এদের ছ’জনকে আলাদা করতে হবে। তারপর আমাদের ছোট্ট সোনামণিকে খাঁচায় ঢুকাবো।”

“বস, শুনলাম। অরুণিকার সাথে আহনাফের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

“হুসস। অরুণিকা চৌধুরীর বিয়ে আমার ইচ্ছাতে হবে। এর আগেই ওই মেয়ের মনে আহনাফকে বিষিয়ে দিতে হবে। কারণ ওই মেয়ে আমার প্রথম শিকার। তাকে দিয়েই আমি বাকি ছ’জনকে নাচাবো।”

“তবে বস, এই কাজটাও শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ছোট্ট সোনামণি একদম তার বাবার মতো অস্থির, চটপটে আর সবাইকে বিশ্বাস করে ফেলে। আমাদের বিশ্বাস কর‍তে ওর তো কোনো প্রমাণই লাগবে না। এমনিতেই এই কাজ হয়ে যাবে।”

“আহ! আফসোস জুবাইয়ের করিম চৌধুরী। সেদিন নিজের মেয়েকে বাঁচিয়ে আজ এতো বড় বিপদ তৈরী করে ফেলেছে। এখন চৌদ্দ বছরের হত্যার রহস্য তো কখনো জাগবেই না, শুধু নতুন করে আরো কিছু কবর জাগবে আর জাগবে আমাদের স্বার্থ।”

কথাটি বলেই লোকটি আবার হাসতে লাগলো।

চলবে–#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৬||

৯৩.
“সবাইকে স্বাগতম আমাদের নতুন কোম্পানি মৈত্রী গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। যা পাঁচ বছর ধরে ইটা গ্রুপ নামে অনলাইনে সর্বাধিক পরিচিত ছিল। আমরা কলকাতায় প্রথম আমাদের ব্যবসা চালু করি। আর এই ব্যবসাটিই আমাদের পুরোনো কোম্পানিটিকে নতুন ভাবে চালু করার সুযোগ করে দিয়েছে। আর আমি হচ্ছি ইভান মাহবুব মৈত্রী গ্রুপের পুরোনো এম.ডি ইমতিয়াজ মাহবুবের বড় ছেলে।”

ইভানের কথা শুনে সুলতান মুন্সী অবাক হয়ে ইভানের দিকে তাকালেন। উপস্থিত সবাই ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য স্টেজে উঠে পেছনের ব্যানারটি খুলে ফেললো। ব্যানারটি খোলার সাথে সাথেই মৈত্রী গ্রুপের পুরোনো ব্যানাটি দেখা গেলো। তূর্য এবার মিডিয়ার লোকেদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আজকের দিনটা আমাদের জন্য খুব শুভ। আজ মৈত্রী গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জুবাইয়ের করিম চৌধুরীর জন্মবার্ষিকী। আজ হয়তো সে আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি গিয়েও রেখে গেছেন তার উত্তরসূরী। আমি তূর্য আহমেদ, মৈত্রী গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার হাকিম আহমেদের একমাত্র ছেলে।”

তূর্য নিচের পরিচয় দিয়ে গ্যালারিতে বসা শাহেদ মির্জা আর সাহিল মির্জার দিকে তাকালো। শাহেদ মির্জার চোখেমুখে রাগ ফুটে উঠেছে। সাহিল বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা, মৈত্রী গ্রুপের সবাই তো সপরিবারে খুন হয়েছিল! তাহলে এরা কারা?”

শাহেদ মির্জা কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি আশেপাশে কাউকে খুঁজতে ব্যস্ত। হঠাৎ তার সামনে রহমতুল্লাহ এসে দাঁড়ালেন। রহমতুল্লাহ স্থির দৃষ্টিতে শাহেদ মির্জার দিকে তাকিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পড়লেন।

আজ বাংলাদেশের স্বনামধন্য সব ব্যবসায়ীক গ্রুপগুলো একত্র হয়েছে। আর আজই ইটা গ্রুপের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন ইটার পরিবর্তে মৈত্রী গ্রুপের নতুনভাবে উদ্বোধন হচ্ছে। এবার তাহমিদ ইমনকে নিয়ে স্টেজে উঠলো। তাহমিদ মিডিয়ার সামনে এসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। আমি তাহমিদ হোসেন। আলিম হোসেনের ছোট ছেলে। আমার বড় দুই ভাই তাহসান হোসেন আর তাশিন হোসেন মৈত্রী গ্রুপের সিনিয়র পদে ছিল। তারা ক্লথ সেক্টরের বিজনেস করতো। কিন্তু আমি ফুড সেক্টরের বিজনেস করছি। আমার আলাদা রেস্টুরেন্ট আছে। যার নাম মিষ্টান্নভোজন। মিষ্টির পরিবর্তে আমি বিভিন্ন ধরণের খাবার তৈরীর কাজ করছি। মিষ্টান্নভোজনের দু’টি শাখা খোলা হয়েছে। এখন মৈত্রী গ্রুপ যেহেতু শুধু একটা সেক্টর নিয়ে কাজ করতো না। সেখানে কাপড়, ওষুধ, ইলেক্ট্রনিক ডিভাসসহ বিভিন্ন সেক্ট্রর ছিল। কিন্তু এই নতুন মৈত্রী গ্রুপে আমরা ভিন্ন ভিন্ন সেক্টর রাখছি।”

ইমন বলল,
“আমাদের নতুন গ্রুপের প্রধান আকর্ষণ স্কিন। আমরা স্কিন প্রোডাক্ট তৈরী করছি। পাশাপাশি এখানে স্কিন থেরাপিও দেওয়া হবে। আর এই সেক্টরটি একদম নতুন সেক্টর। আর এখানে কাজ করছে ইভান মাহবুব। তবে আমাদের কাছে একজন স্কিন স্পেশালিষ্টও আছেন, আপনাদের পুরোনো মৈত্রী গ্রুপের এ ইউনিটের পরিচালক জুবাইয়ের করিম চৌধুরীর ভাতিজা, ডক্টর. আরাফ চৌধুরী। পাশাপাশি ফুড সেক্টরে থাকবে তাহমিদ হোসেন। ক্লথ সেক্টরে থাকবে তূর্য আহমেদ এবং আমি, ইমন মাহবুব। আর আমিই মৈত্রী গ্রুপের বি ইউনিটের নতুন এম.ডি।”

মিডিয়ার সবাই ইমনকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলো। ইমন হাতের ইশারায় আহনাফ আর আরাফকেও ডেকে আনলো। আহনাফ স্টেজে এসে মিডিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“আর আমি আহনাফ চৌধুরী, মৈত্রী গ্রুপের এ ইউনিটের নতুন এম.ডি। আমাদের সেক্টরটি ডেভেলাপিংয়ের কাজ করছে। আমরা আপনাদের প্লটে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে নতুন নকশায় বাড়ি নির্মাণ করে দেবো।”

সাহিল মির্জা রাগে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়াল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
“একটা ছোট কোম্পানি এতোগুলো সেক্টর কিভাবে খুলেছে?”

পাশের একটা লোক বলে উঠলো,
“স্যার, কোম্পানি একটা। কিন্তু চালাচ্ছে তো ছ’জন। একেই বলে একতাই বল। শুনেছি, মুন্সী গ্রুপও তাদের সাথে কাজ করছে।”

সাহিল মির্জা এবার হল থেকে বেরিয়ে এলো। এই মুহূর্তে তার মেজাজ ঠিক নেই। এতো বছর ধরে সে শুধু পোশাক খাতে কাজ করে যাচ্ছে। তার নিজস্ব ডিজাইনারও আছে। আর লাখ-লাখ টাকায় তার কোম্পানির কাপড় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ছ’জন যুবক নতুন কোম্পানি খুলে তার পুরো ব্যবসাকেই হেলিয়ে দিয়েছে? শুরুটাই যাদের এতো জাঁকজমকপূর্ণভাবে হয়েছে, তাহলে তাদের যাত্রাটা কেমন হবে?

ছ’জন বাসায় ফেরার পর অরুণিকা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমাদের টিভিতে দেখাচ্ছে কেন?”

আহনাফ বলল,
“সেলিব্রিটি মানুষ তাই।”

“সত্যিই, বলো না৷ কি বলেছো এসব? আমার না সব কথাবার্তা মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে।”

“এখন তোমার এসব বুঝতে হবে না। কাল মাওশিয়াত আর ইমনের আক্দ। তুমি উপমার সাথে মাওশিয়াতের বাসায় চলে যাও। মাওশিয়াত ফোন দিয়েছে, তোমাদের দু’জনকে যেতে বলেছে।”

পরেরদিন জুমার নামাজের পর মসজিদে ইমন আর মাওশিয়াতের আক্দ সম্পন্ন হলো। আক্দের অনুষ্ঠানটি কোনো ক্লাবে হবে না। ইভান একটা স্থান ঠিক করে রেখেছিল, সেখানেই অনুষ্ঠান হবে। মসজিদ থেকে এসে তাহমিদ আর আহনাফ ইমনকে তৈরী করিয়ে নিচে নামলো। সন্ধ্যার দিকে তারা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অনুষ্ঠানে মাওশিয়াতের বাবা-মা আর আত্মীয়রা, উপমার বাবা-মা ও ভাই এবং আরাফের মামা উপস্থিত হবে। পরিবারের বাইরে শুধু সুলতান মুন্সী ও তার ছেলে ইশমাম মুন্সীকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সব ক’টা গাড়ি চাঁদগাও পৌঁছে গেলো। গাড়ি থামার পর আরবান তালুকদার গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকিয়ে আরাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমরা ইমনের আক্দ অনুষ্ঠান এখানে রেখেছো?”

আরাফ প্রশান্তির হাসি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, এটাই তো আমাদের জন্মস্থান। এখানেই আমাদের সব স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখানে থাকা মানুষগুলো তো আর বেঁচে নেই। কিন্তু আমরা চাই, এখানের ইট-পাথর আমাদের মিলনমেলার সাক্ষী হোক। অন্তত এখানে এসে একটু হলেও পুরোনো মানুষগুলোকে অনুভব করতে পারবো।”

আরবান তালুকদার আরাফের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,
“একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আজকে তো খুশির দিন। মনে কোনো দুঃখ রেখো না৷ যাদের যাওয়ার তারা চলে গেছে৷ এখন যারা আছে, তাদের নিয়েই ভালো থাকতে হবে। কয়েকদিন ধরে দেখছি তূর্য আর ইভান একজন আরেকজনের সাথে কথাবার্তা বলছে না। কি হয়েছে ওদের?”

আরবান তালুকদার সেদিনের ঝগড়ার মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তাই তিনি কিছুই জানতেন না। আরাফও তার মামাকে এসব জানাতে চায় না। তাই সে প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“এসব বাদ দিন, মামা। তেমন কিছুই হয় নি৷ চলুন ভেতরে যাই।”

মৈত্রী ম্যানশনের পোড়া বাড়িগুলো আবার রং করা হয়েছে। বাড়িগুলোর ভেতরে যদিও সব আগের মতোই আছে। কিন্তু এখন আর বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না, কিছু কাল আগেও বাড়িগুলো পোড়া বাড়ি ছিল। বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায় স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। পাশের গ্যারেজটি পরিষ্কার করিয়ে সেখানেই খাওয়ার আয়োজন করা হচ্ছে। চারপাশে নতুন করে বাতি জ্বালানো হয়েছে। সন্ধ্যায় পুরো এলাকা বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়েছে। গেইট থেকেই মরিচ বাতি ঝুলছে। যেহেতু অনেক বছর ধরেই বাড়িগুলো পরিত্যক্ত ছিল, তাই ইভান কাজ শুরুর আগেই হুজুর ডেকে দোয়া পড়িয়েছে। সবাই এখন অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। মাওশিয়াতের কাজিনরা নাচ-গানের আয়োজন করেছে। সবার মনোযোগ সেখানেই। কিন্তু অরুণিকার মনোযোগ তাদের পুরোনো বাড়ির দিকে। তার চৌদ্দ বছর আগের কিছুই মনে নেই। তবুও এই বাড়িটি তাকে খুব টানছে। চৌধুরী বাড়িতে ঢুকতেই অরুণিকা চারদিকে চোখ বোলালো৷ সব বাড়িগুলোর ভেতরে পরিষ্কার করানো হলেও রং করানো হয় নি। তাই সাদা দেয়ালে কালো দাগগুলো এখনো স্পষ্ট হয়ে আছে। হলরুমে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ পেছনে কারো উপস্থিতি পেয়ে অরুণিকা চেঁচিয়ে উঠলো। আহনাফ ব্যস্ত কন্ঠে অরুণিকার মুখে হাত চেপে ধরে বলল,
“পাগল হয়েছো? চেঁচাচ্ছ কেন?”

অরুণিকা হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি?”

“তো কাকে আশা করেছিলে?”

“ভূত আশা করেছিলাম!”

আহনাফ ভীত চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“কি উল্টাপাল্টা বলছো? চলো বাইরে আসো। তোমাকে বাড়িতে কে ঢুকতে বলেছে?”

অরুণিকা আগে আগে দৌঁড়ে বের হতে যাবে, তা দেখে আহনাফও দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসে আহনাফ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অরুণিকা কোণা চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি ভয় পেয়েছো?”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমি? মোটেও না। আমি কেন ভয় পাবো?”

“তাহলে আমার পিছু পিছু দৌঁড়ে এসেছো কেন?”

“তোমার সাথে সাথেই তো হাঁটছিলাম৷ তোমারই তো ভয় লাগছিল তাই।”

অরুণিকা বাঁকা হাসি দিয়ে পেছন ফিরে ভীত চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ অরুণিকার তাকানো দেখে আর অন্যদিকে না তাকিয়ে সোজা অরুণিকার হাত ধরে জোড়ে পা চালিয়ে স্টেজের কাছে চলে এলো। অরুণিকা হাসতে হাসতে বলল,
“ভীতু ছেলে।”

আহনাফ চোখ গরম করে বলল,
“চুপ করো। বেশি কথা বললে ওই ঘরে রেখে আসবো। আর দরজা বাইরে থেকে আটকে দেবো।”

অরুণিকা মুখ ভার করে বলল,
“আমি না তোমার হবু বউ? তুমি আমার সাথে এমন অবিচার করবে?”

আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। অরুণিকা নিজের মুখে এই সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছে দেখে তার খুব ভালো লাগছে। সে মুচকি হেসে অরুণিকার হাত ধরতে যাবে তখনই মাওশিয়াতের কাজিনরা এসে অরুণিকাকে টেনে নিয়ে গেলো।

এদিকে খাওয়া-দাওয়ার পর ইশমাম মুন্সী একা একটা চেয়ারে বসে আছে। তাকে একা বসে থাকতে দেখে ইভান তার পাশে গিয়ে বসলো। ইশমাম ইভানকে দেখে মুচকি হাসলো আর বলল,
“ছোট ভাইকে তো বিয়ে দিয়ে ফেলেছো। এখন নিজে কখন বিয়ে করবে?”

ইভান হেসে বলল,
“আমার সিনিয়ররাই যেখানে অবিবাহিত সেখানে আমি তো সিলেবাসের বাইরে।”

ইশমাম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ইভান ইশমাম সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছে। কিন্তু কখনো ইশমামের কাছ থেকে কিছুই শুনেনি। তাই ইভান তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাউকে পছন্দ করেন?”

ইশমাম মুন্সী ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার ভালোবাসা তো আমার মধ্যে নেই। পুরো মিডিয়া জেনে গেছে। এখন তুমি নতুন করে জিজ্ঞেস করে আমার কষ্টে আরেকটু কষ্ট মেশালে নাকি, অন্যকিছু?”

ইভান মুচকি হেসে বলল,
“মিডিয়া তো মিথ্যে কথাও ছড়ায়৷ তবে এটা ঠিক, যা রটে তা কিছু হলেও ঘটে। এবার বলেন, সত্যিই কি শাহেদ মির্জার মেয়ের সাথে আপনার সম্পর্ক আছে, নাকি শুধুই বন্ধুত্ব।”

ইশমাম মলিন হেসে বলল,
“ছেলে-মেয়ে কখনোই একে অপরের বন্ধু হতে পারে না। তারা প্রেমে পড়বেই। আর আমরাও পড়েছি। সমস্যাটা হলো শাহেদ মির্জা আমার হাতে সাবাকে দেবেন না।”

“কেন?”

“আমাদের বংশ ভালো হলেও, আমরা ছোট থেকে উঠে এসেছি। আমাদের মধ্যে আভিজাত্য ছিল না। বাবা খাবারের দোকানে চাকরি করতো। একসময় মুদির দোকানদার ছিল। চাচারাও ছোটখাটো কাজগুলোই করতো। আসলে আমাদের পরিবারের কেউই শিক্ষিত না৷ শুধু আমরা ভাই-বোনরা পড়াশুনা করেছি। তাই মির্জা সাহেব মনে করেন আমাদের স্ট্যাটাস মিলবে না। এমনিতেই আমরা প্রতিদ্বন্ধি গ্রুপ। তাই তারা মনে করে তাদের সাথে আত্মীয়তা করে আমরা উপরে উঠতে চাই।”

ইভান চুপচাপ সব শুনছে। ইশমাম বলল,
“আগে জানলে, এসব দেখেশুনেই ভালোবাসতাম। শুধু শুধু কষ্ট পেতে হতো না।”

ইভান মনে মনে বলল,
“মির্জা সাহেবের অনেক অহংকার। ভালোই তো। তার এই অহংকার দিয়েই তাকে জব্ধ করা যাবে।”

চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here