অরুণিকা পর্ব -৫+৬

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৫||

১০.
দরজার কটকট শব্দে আহনাফের ঘুম ভেঙে গেলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে সে বারান্দায় এসে দেখলো দু’জন মহিলা তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“জ্বি, কিছু বলবেন?”

তাদের মধ্যে একজন বললেন,
“আমি পাশের বাড়ির। ওই যে কাল রাত্তিরে আমার বর তোমাদের এই বাড়ি নিয়ে এলো, আমি তারই গিন্নী। তোমাদের সাথে দেখা করতে এসেছি। এ হলো আলেয়া আপা।”

আহনাফ তালা খুলতে খুলতে বলল,
“সবাই এখনো ঘুম৷”

“সমস্যা নেই। আমরা ছোট্টো বাবুনটিকে দেখতে এসেছি৷ সে তোমাদের বোন?”

“জ্বি।”

আহনাফ দরজা খুলতেই ইভান আর তাহমিদও উঠে চলে এলো। আলেয়া আপা বললেন,
“এমা, এতো ছেলে মানুষ? তাহলে ছোট্ট বাবুনটা কোথায় ছিল?”

সালেহ আলীর স্ত্রী সুরাইয়া আলেয়াকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আহনাফ আর ইভান বাকীদের ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়ালো। অরুণিকা হাত-পা ছড়িয়ে পুরো খাট দখল করে ঘুমোচ্ছে। আলেয়া আপা মশারী উঠিয়ে অরুণিকার গালে হাত রেখে বললেন,
“এতোটুকু একটা বাবুন অনাথ হয়ে গেলো? এই বাবুনটা আমাকেই দিয়ে দাও। আমি ওকে দেখবো।”

আহনাফ আর আরাফ একসাথেই বলে উঠলো,
“অরুকে আমরা দেবো না।”

কথাটি বলেই দু’জনই একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। সুরাইয়া অবাক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেন। আলেয়া আপা হেসে বললেন,
“আরেহ বাবা, আমি তো এমনিতেই বললাম। তোমাদের বোনকে নিচ্ছি না, বাবা। আমাকে সালেহ ভাইজান বলল, ওকে একটু দেখতে। তাই এলাম।”

এবার সুরাইয়া বললেন,
“তোমাদের যিনি পাঠিয়েছেন, রহমত সাহেব, উনি আমার বরের ভাই। আমার বর বাংলাদেশী। আমিই কলকাতার। শুনেছি, তোমাদের বাবা-মা একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তোমাদের আত্মীয়-স্বজনও নেই। তাই তোমাদের এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখানে সবাই জানবে আমরা তোমাদের আপন চাচা-চাচী। সবাইকে এটাই বলবে কিন্তু। আলেয়া আপা আমার বাসায় কাজ করেন। উনি বাবুনকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেখে যাবে। তোমরা তো কাজে বা পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকবে। স্কুলেও যাবে। তখন বাবুন আমাদের সাথেই থাকবে। আর ও তো মেয়ে মানুষ। প্রয়োজনে আমি আসবো ওকে দেখতে।”

এবার আলেয়া আপা বললেন,
“পাশের বাড়ির মহিলার কতো বছর সন্তান হয় না। এই বাবুন একবার যদি তার নজরে পড়ে!”

আলেয়া আপার কথা শুনেই ছ’জনের মুখ শুকিয়ে গেলো। আলেয়া আপা তাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
“আবার ভয় দেখিয়েছি কিন্তু।”

এবার ইমন হেসে বলল,
“এমন ভয় দেখাবেন না, খালা। ওকে আমরা দেখতে পারবো। আমরা ছ’জন কি এইটুকু মেয়েকে খাওয়াতে পারবো না? আমরা খেলে ও অবশ্যই খাবে। আমরা না খেলেও ও খাবে।”

সুরাইয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“বাহ, তোমরা বাবুনকে কতো ভালোবাসো! দেখো, আপন বোন নয়, তবুও এতো ভালোবাসছো। আর আমার দু’টো ছানা আছে। সারাদিন ঝগড়াঝাঁটি করে বাড়িটা মাথায় তুলে রাখে। ওদের পাঠিয়ে দেবো এদিকে। বাবুনের সাথে খেলবে। তা বাবুন সোনার নাম কি?”

আরাফ বলল, “অরুণিকা চৌধুরী।”

হঠাৎ বারান্দার সামনে তেরো-চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“ও খালা, তুমি এই ঘরে? আমি তোমায় তোমার বাড়িতে খুঁজে এলাম।”

সুরাইয়া পেছন ফিরে হাতের ইশারায় মেয়েটিকে ভেতরে ডাকলেন। মেয়েটি ঘরে ঢুকতেই একনজর পুরো ঘরটি দেখে নিলো। তারপর এক এক করে ছ’জনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগলো। ইমন ইভানকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এই মেয়ে আমাদের এভাবে দেখছে কেন?”

ইভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এতো সুন্দর ছেলে আগে দেখে নি তো তাই।”

“ভাই, তোর সামনে আমি তো কিছুই না। একটু গরিবের মতো দাঁড়া।”

ইভান চোখ বড় বড় করে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন মুখে হাসি টেনে তাহমিদের পাশে এসে দাঁড়ালো। এবার সুরাইয়া মেয়েটির সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন,
“এ হলো আমাদের মহল্লার লক্ষী। আমাদের মেয়ে, শতাব্দী। তোমাদের মুখোমুখি বাড়ির দু’তলায় থাকে। ওর বাবা স্কুলের মাস্টার। সবাই মাস্টারমশাই বলেই ডাকেন।”

শতাব্দী হেসে বলল,
“আর আমাকে মাস্টারের মেয়ে বলেই ডাকে৷”

শতাব্দী অরুণিকার পাশে গিয়ে বলল,
“এ মেয়ে কি ওদের?”

শতাব্দীর কথা শুনে আরাফ ছাড়া সবাই হাঁ হয়ে গেলো। তাহমিদ অবাক কন্ঠে বলে উঠল,
“আমাদের মেয়ে! কিভাবে সম্ভব?”

আরাফ বলল,
“ও আমাদের বোন। ছোট বোন।”

শতাব্দী বলল,
“সেটাই তো বুঝিয়েছি। আপনাদেরই তো। বাইরের কারো তো নয়। আমি তো আর আপনাদের ওর বাবা বলছি না। ভাই-ই বুঝিয়েছি। কথা না বুঝলে কি আর করার।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে শতাব্দীর দিকে তাকালো। আর মনে মনে বলল,
“এই মেয়ে একে তো ভুলই বলেছিলো। এখন কথা ঘুরিয়ে আমাদের ভুল প্রমাণ করতে চাইছে।”

সুরাইয়া তাগাদা দিয়ে বলল,
“অরুণিকা তাহলে ঘুমাক। আমাদের পানি ধরতে হবে। আচ্ছা, তোমাদের তো বলা হয় নি। মহল্লায় সকাল আর বিকেল দু’বেলা পানি দেবে। পানি ধরতে না পারলে সারাদিন পানি ছাড়াই থাকতে হবে।”

আহনাফ বলল,
“ওয়াশরুমে তো কল ছিল! কিন্তু পানি আসে নি।”

“আরেহ আসবে কিভাবে? ট্যাংকই তো নেই। পানি বাইরে থেকে নিয়ে এসো। পরে যখন ট্যাংক লাগাবে তখন আর দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে হবে না। তোমাদের প্রয়োজন হলে এই বাড়ির মালিককেই বলতে পারো। তিনি আবার এখানে থাকেন না। ওদের বাড়ি দিল্লীতে। এখানে একটা লোক এসে টাকা-পয়সা নিয়ে চলে যায়।”

“মাসে কতো টাকা দিতে হয়?”

“তোমাদেরটা সাড়ে তিন হাজার।”

ইমন বলল, “অনেক কম।”

এবার শতাব্দী বলল,
“কম মনে হলে আরো বড় বাড়িতেই উঠতে পারতো। হুহ, বড়োলোকি ভাব!”

শতাব্দীর এমন কথায় ইভান রেগে গেলো। চোয়াল শক্ত করে সুরাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“চাচী, আপনাদের লক্ষী মেয়েটা হয়তো একটু বেশিই কথা বলে। তা মাস্টারমশাই কি কখনো বলে নি বোকারা একটু বেশিই বকবক করে।”

শতাব্দী নাক টেনে বলল,
“দেখেছো, খালা। এই লোক তোমার সামনে আমাকে বোকা বললো!”

তূর্য মুখ চেপে হেসে বলল, “ইভান লোক!”

ইভান কিছু বলতে যাবে তার আগেই সুরাইয়া তাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আলেয়া আপাও শতাব্দীর গালে হাত রেখে বললেন,
“অতিথিদের সাথে এভাবে কথা বলে না। এখন চলো।”

শতাব্দী যাওয়ার আগে ইভানের দিকে চোখ ছোট করে তাকালো। তাহমিদ হাত দেখিয়ে ইশারায় শতাব্দীকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিলো। শতাব্দীও অভিমানী মুখে বেরিয়ে পড়লো। সে বেরুতেই তাহমিদ গেইটের মুখে তালা লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সে এখনো তাহমিদের দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাহমিদ চোখ ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। ভেতরে ঢুকতেই দেখলো তূর্য আর ইমন ইভানকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। তূর্য কিছুক্ষণ পর পর টিটকারি দিয়ে বলছে,
“এই লোক, মশারী তোল। যা পানি ধর। এই লোক, যা নাস্তা বানা। ক্ষিধে পেয়েছে।”

ইভান রাগে ওয়াশরুম থেকে দু’টো বালতি নিয়ে পানি ধরার জন্য বেরিয়ে গেলো। ইভানের পিছু পিছু আরাফ আর তূর্যও গেলো।

১১.

ঘুম ভাঙতেই আহনাফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো অরুণিকা। আহনাফ হাত ধরে অরুণিকাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে বলল,
“উঠো, তোমাকে ব্রাশ করিয়ে দেবো।”

ইমন আহনাফের কথা শুনে অবাক কন্ঠে বলল,
“তুই ওকে ব্রাশ করিয়ে দিবি? অবাক লাগছে!”

“হ্যাঁ। এখানে অবাক লাগার কি আছে?”

“এতোদিন এই কাজ তো আরাফ করতো। হঠাৎ তুই!”

“অদ্ভুত কথাবার্তা বলে মাথা খারাপ করিস না তো। আরাফ আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি?”

“তুই তো আবার বাচ্চা-কাচ্চা পছন্দ করিস না। এখন বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব নিচ্ছিস, তাই বললাম।”

তাহমিদ মনোযোগ দিয়ে রুটি বানানোর জন্য ময়দা মাখছিলো। সে বিরক্তির সুরে বলল,
“ইমন, তুই এই বিষয়টা বাড়াচ্ছিস কেন? তোর কি আর কোনো কাজ নেই? যা গিয়ে আরো কয়েকটা বালতি ভর্তি করে আন। একবেলায় সব পানি নিয়ে আসলে, আরেক বেলা আরাম করতে পারবি।”

ইমন বলল,
“পানি তো সব তোরই লাগবে। এখন নাস্তা বানাচ্ছিস। তারপর ধোয়া-মোছা সব তুই-ই করবি।”

“তো ঘরটা কি আবর্জনার স্তূপ হবে? পরিষ্কার তো করবোই। তুই আমার কাজে নাক গলাবি না। ঘরের মধ্যে যদি এক ইঞ্চিও ময়লা হয়, তোকে আমি দ্বিতীয়বার ঘর পরিষ্কার করতে দেবো।”

ইমন চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো। আহনাফ অরুণিকাকে হাত-মুখ ধুইয়ে দেওয়ার পর বলল,
“তুমি প্রতিদিন এভাবে ব্রাশ করতে পারবে?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “না।”

“তাহলে তোমাকে প্রতিদিন হাত-মুখ কে ধুইয়ে দেবে?”

অরুণিকা আঙ্গুল দিয়ে আহনাফের দিকে ইশারা করে বলল, “তুমি।”

তারপর দাঁত দেখিয়ে হেসে দিলো। আহনাফ চোখ ছোট করে বলল,
“কালকে ব্রাশ করা না শিখলে, ব্রাশটা মুখে ঢুকিয়ে সেলাই করে দেবো।”

আহনাফ শীতল কণ্ঠে কথাটি বলল, তাই অরুণিকা বুঝলো না এটা তার উপর বিরক্ত হয়ে বলেছে নাকি খুশি হয়ে বলেছে। সে ভাবলো, হয়তো কোনো জ্ঞান দিয়েছে। তাই সে গায়ে মাখলো না। সে লাফিয়ে লাফিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। গলির সামনেই কয়েকটা বাচ্চা খেলছে। অরুণিকা গ্রিলের ফাঁকে পা দিয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে তাদের খেলা দেখার চেষ্টা করছে। তাদের মধ্যেই একজন অরুণিকার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“এই বাবু তোমার নাম কি?”

অরুণিকা হেসে বলল, “অরুণিকা। আমিও খেলবো। আমাকে ওইটা দাও।”

বাচ্চাটির হাতে একটা লাটিম ছিল। অরুণিকা সেটি নেওয়ার জন্যই হাতটি গ্রিলের বাইরে বের করে দিলো। তখনই ইভান দুই বালতি পানি নিয়ে ধপ করে গ্রিলের দরজার সামনে রাখতেই অরুণিকা ভয়ে গ্রিল থেকে নেমে পড়লো আর দৌঁড়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। অরুণিকাকে দৌঁড়ে যেতে দেখে ইভান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। বিড়বিড় করে বলল,
“আমি কি ওকে বকলাম নাকি? অদ্ভুত!”

আজ প্রথম তাহমিদ রুটি বানিয়েছে। দেশে রহমত চাচা দোকান থেকে সকালের নাস্তা কিনে এনেছিলেন। এখানে আসার পর সে ভাবলো, যেহেতু তার রান্নাবান্না করতে ভালোই লাগে, তাহলে ছোটখাটো এসবের মাধ্যমেই শুরু করা যাক। দোকান থেকে রান্না করা মুগডাল কিনে এনেছে তূর্য। তা দিয়েই তাদের সকালের নাস্তা শেষ। সুরাইয়া নাস্তা বানিয়ে পাঠাবে বলেছিল, কিন্তু আরাফ বারণ করে দিয়েছে। এখন তাদের স্বনির্ভর হওয়া দরকার। যখন তখন তারা আর মায়ের হাতের নাস্তা খেতে পারবে না, বাবাও তাদের শখ পূরণ করার জন্য পাশে নেই। এখন তারা নিজেরাই নিজেদের হাত ধরবে আর নিজেদের শখ পূরণ করবে।
নাস্তা খাওয়ার পর সবগুলোই তাহমিদ পরিষ্কার করে ফেললো। তাকে ইভান সাহায্য করেছিলো। এরপর ছ’জন মিলে কাজ ভাগ করে নিলো। কেউ কাপড় ধুয়ে শুকাতে দিলো, কেউ ঘর পরিষ্কার করলো, কেউ সব গুছিয়ে রাখলো। এবার তারা বসে বসে দুপুরের রান্নার জন্য কি কি প্রয়োজন তা লিখতে লাগলো। রহমত চাচা সালেহ আলীর কাছে তাদের খরচের টাকা পাঠাবেন। এই মাসেরটাও হয়তো পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো যখন তারা জানলো, তাদের খরচের তুলনায় তারা মাসে খুব কম টাকা পাবে। এমন হলে তো সব টাকা খাওয়া-দাওয়ার পেছনেই শেষ হয়ে যাবে। তারা কি স্কুলে ভর্তি হবে না? তারা ছ’জনই এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। কিন্তু এখন তো আর পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব না। নতুন করেই স্কুলে ভর্তি হতে হবে। তবে টাকার যা সংকট, হয়তো চারজন পড়াশুনা করবে, বাকীরা বসে থাকবে। কিন্তু তারা তা করবে না। হয়তো সবাই পড়াশুনা করবে, নয়তো কেউ-ই করবে না। এসব নিয়েই আলোচনা করার এক পর্যায়ে তূর্য বলে উঠলো,
“আমার গিটারটা বাসায় ছিলো। ওটা তো এখন ছাই হয়ে গেছে। ওটা সাথে থাকলে গান গেয়েও কিছু টাকা আয় করতে পারতাম। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ কতো কন্টেন্ট তৈরী করে। আর আমি ওতোটাও খারাপ গায় না।”

তখন আহনাফ আফসোস করে বলল,
“বাবা বাইক কিনে দিয়েছিল, ওটাও হয়তো ছাই হয়ে গেছে।”

অরুণিকা এক পাশে বসে আরাফের ফোন দেখছিলো। সে হঠাৎ আরাফের দিকে ফোনটা ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“মা কোথায়? আমি মায়ের কাছে যাবো।”

অরুণিকার কথা শুনে ইভান বলল,
“এক কথা বারবার বলতে ভালো লাগে না। বললাম তো মা অসুস্থ। সুস্থ হলে দেখা করবে।”

“না, মা সুস্থ। আমি মায়ের কাছে যাবো।”

আহনাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“মা আল্লাহর কাছে চলে গেছে। আর কখনো আসবে না। এখন চুপ করো।”

অরুণিকা আহনাফের কথা শুনে আরাফের পাশে এসে বসলো। তারপর তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“মা আর আসবে না?”

আরাফ অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আসবে। কিন্তু যেদিন তুমি লক্ষী মেয়ে হবে সেদিন আসবে। এখন তো তুমি দুষ্টুমি করছো। তাই আগে ভালো মেয়ের মতো আমরা যা বলবো, তাই শুনতে হবে।”

অরুণিকা মুহূর্তেই মায়ের কথা ভুলে বলল,
“আমাকে ওই খেলনটা দেবে?”

“কোন খেলনা?”

“ওই যে বাবুটা খেলছিল খেলনাটা দিয়ে।”

ইভান বলল,
“খাওয়ার টাকা নেই, তুমি খেলনা খুঁজছো? কোনো খেলনা চলবে না। একে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেই ভালো হবে।”

“আমি স্কুলে যাবো না। আমি খেলবো।”

হঠাৎ বারান্দার বাইরে থেকেই শতাব্দীর কন্ঠের স্বর পাওয়া গেলো। সে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে চোখ ঢুকিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ইভান বারান্দায় এসে বলল,
“কি সমস্যা?”

শতাব্দী স্বাভাবিক কন্ঠে বললো, “বাবু কোথায়?”

“বাবু!”

“আপনার বাবু না। ছোট্ট বাবুটার কথা বলছি। ওই যে যখন এসেছিলাম, ঘুমিয়ে ছিল।”

অরুণিকা মেয়েলী কন্ঠ শুনে দৌঁড়ে এলো। শতাব্দীকে দেখে থমকে গেলো। শতাব্দী হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“বাবু আমার সাথে খেলবে?”

অরুণিকা কিছু বলার আগেই ইভান বলল,
“না, ও এখন বাইরে যাবে না।”

শতাব্দী তার পেছন থেকে একটা বিড়াল ছানা বের করে বলল,
“বাবু খেলবে ছানার সাথে?”

অরুণিকা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বিড়ালের বাচ্চাটির দিকে। ইভান গ্রিলের দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“খেললে ভেতরে এসো। অরুণিকা বাইরে যাবে না।”

তাহমিদ সাথে সাথেই আটকে দিয়ে বলল,
“না, না, অরুণিকাকে নিয়ে আসছি। এই বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে ভেতরে আসবে না। আমি মাত্র ঘর পরিষ্কার করেছি।”

তারা অরুণিকাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো৷

মহল্লাটির শেষ মাথা পর্যন্ত মোট আটটি বাড়ি। এখানে অনেক পরিবারই থাকে। সবাই খোলামেলা বসেই গল্প করছে। দেখে মনে হবে এক পরিবারের। কেউ মোড়ায় বসে পত্রিকা পড়ছে। কেউ বা একসাথে বারান্দায় বসে শাক পরিষ্কার করছে। আর বাচ্চারা পুরো গলিতেই ছুটোছুটি করছে। আরাফ বাচ্চাগুলোকে দেখে বলল,
“অরুর বন্ধুর অভাব হবে না।”

আহনাফ বলল,
“এদের সাথে বন্ধুত্ব করবে?”

“কেন সমস্যা কোথায়?”

“দেখছিস না কিভাবে একটা আরেকটার সাথে চুলোচুলি করছে। অরুকে মারলে?”

আরাফ বলল,
“স্কুলের মাঠে খেলতে গিয়ে কতোবার মার খেয়েছিস মনে আছে? এসব তো চলবেই।”

“আমার অরুর জন্য ভয় লাগছে। ও তো মেয়ে। আর এটা অপরিচিত শহর, ভিন্ন দেশ। কিছু হয়ে গেলে, আমরা কি করবো? ওকে কিভাবে দেখে রাখবো?”

ছ’জন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অরুণিকাকে দেখছে। অরুণিকা গেইট দিয়ে বেরিয়ে বিড়াল ছানাটার পেছন পেছন ছুটছে। সেটিকে আদর করছে। আর কিছুক্ষণ পর পর তাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। অরুণিকার এই মিষ্টি হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছে#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৬||

১২.
নতুন শহরে দু’মাস কেটে গেছে। এখন কলকাতার রাস্তাঘাট আর অপরিচিত নয়। খুব অনায়াসে এখান থেকে ওখান ছুটোছুটি করছে ছয় কিশোর। বয়সে তারা এখনো কিশোর, কিন্তু এই দুই মাসে তাদের অভিজ্ঞতা ঠিকই প্রাপ্ত বয়ষ্কদের মতো হয়ে গেছে।

ঘুম ভাঙতেই যার বেলা বারোটা বাজতো, সেই আহনাফ এখন ঘুম থেকে উঠেই মহল্লার সামনে খালি বালতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।
আহনাফ প্রচুর ভ্রমণ প্রিয় স্বভাবের ছিল। আর তার দুর্বলতা তার প্রিয় সেই বাইকটি, যেটি এখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সে খুব তাড়াতাড়িই বাইক চালানো শিখে ফেলেছিল, কারণ তার স্বপ্ন ছিল অল্প বয়সেই বাইকে চড়ে নিজ দেশ ভ্রমণ করবে। তারপর একদিন বাইরের দেশে ঘুরবে। কিন্তু এখন তার সেই স্বপ্নে ধুলো জমে গেছে। এখন তার বাইক কেনার সামর্থ্য নেই, বাইক নিয়ে দেশ ঘুরতে গেলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। যদিও তার আগে কোনো ভবিষ্যৎ চিন্তা ছিলো না। বাবার অর্থ-সম্পদে সে বাকী জীবন পার করতে পারবে সেই আশায় ছিল। কিন্তু এখন পড়াশুনা করে নিজেকে শক্ত করে তার পরিবার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ায় তার মূল উদ্দেশ্য। আহনাফ স্বভাবে প্রচুর বেপরোয়া। তার মনমতো কিছু না হলেই সে উগ্র হয়ে যায়। তবে এই উগ্রতা তার এখনো আছে। সম্পর্কে চাচাতো ভাই হলেও আহনাফের সাথে আরাফের অনেক পার্থক্য। সে খুবই শান্ত আর প্রচন্ড ধৈর্যশীল। সে বয়সের তুলনায় অনেক বুদ্ধিদীপ্ত। আর সে তার বন্ধুদের প্রাণ। একমাত্র আরাফই এমন পরিস্থিতিতে সব হারিয়েও এখনো শক্ত। সে বাকীদের মতো ভেঙে পড়ে নি। খারাপ লাগা, নিঃস্ব হওয়ার অনুভূতি, হতাশা, ক্লান্তি সবটাই সে নিজের মধ্যে হজম করে ফেলেছে। চার বছরের ছোট্ট অরুণিকা এখন আর ঘনঘন বাবার কথা বলে না। মাকেও খোঁজে না। সেই জায়গাটা আরাফের হয়ে গেছে। আরাফকে না দেখলেই ছোট্ট অরুণিকার অস্থিরতা বেড়ে যায়। সে সব আবদার আরাফের জন্যই জমিয়ে রাখে। তাদের বয়সের ব্যবধান মাত্র এগারো বছরের, অথচ আরাফ এখন অরুণিকার প্রধান অভিভাবক।

নারী ঘরের লক্ষী হয়। সংসার সামলানোর মতো জটিল দায়িত্ব তারাই নিয়ে থাকে। তবে তাদের ব্যাচেলর সংসারের সেই দায়িত্বটা তাহমিদের হাতে। ঘর পরিষ্কার আর রান্নাবান্না এই দুইটা কাজ সে একাই করে থাকে। তার হাতের জিলাপি আর নারকেল নাড়ু এখন পুরো মহল্লার মুখে মুখে। বাচ্চার দল বিকেল হলেই তাদের বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, আর তাহমিদ আজ বিকেলে কি বানাচ্ছে তা দেখার অপেক্ষায় থাকে। সালেহ আলী তার এই কাজের প্রশংসা করে খাবার বিক্রির পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু দোকান খোলার মতো সামর্থ্য তার নেই। আর ব্যবসা শুরু করলে তার পড়াশুনা হবে না। অন্যদিকে মহল্লার কেউ প্রতিদিন টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে নারকেল নাড়ু আর জিলাপি কিনবে না৷ এখন হয়তো খেতে আসে, টাকা খুঁজলে বাসায় আসাও বন্ধ করে দেবে। তার বিক্রি করতে হবে ভিন্ন ভিন্ন শহরে গিয়ে, যার বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতাও তার মধ্যে নেই। অভিজ্ঞতার চেয়ে তার এই পেশাটাই পছন্দের নয়। কারণ সে যেই পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, সেই পরিবেশ থেকে এসে ভ্যানে খাবার বিক্রি করাটা তার কাছে বেমানান।

এই ছয় কিশোরের মধ্যে একমাত্র ইমনই এখনো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে মহল্লার ছেলেদের সাথে দিন-রাত ফুটবল খেলে সময় পার করে। তাছাড়া সবাই তাদের রক্তের সম্পর্ক হারিয়ে ফেললেও ইভান এবং ইমন এই দুই ভাই এখনো একে অপরের জন্য বেঁচে আছে। ইভান পড়াশুনার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। সে এই দুই মাসে মাস্টার মশাইয়ের প্রিয় ছাত্র হয়ে গেছে। শতাব্দীর বাবার কাছে তার স্কুলের কিছু ছাত্র পড়তে আসে। একদিন ইভান তাদের মধ্যে একজনকে একটা অংক বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, যা দেখে ফেলে শতাব্দী। ব্যস, ওমনি সে বাবাকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“বাবা, দেখো দেখো, তোমার ছাত্রকে নিজের ছাত্র বানিয়ে ফেলেছে।”

মাস্টার মশাই পরবর্তীতে ইভানকে ডেকে এনে কয়েকটা অংক বুঝিয়ে দিতে বললেন, আর ইভানের বোঝানোর ধরণ অনেক সুন্দর আর সহজ ছিলো, তাই মাস্টার মশাই তাকেই নিজের ছাত্র বানিয়ে ফেললেন। তিনি এখন সময় নিয়ে ইভানকে মাধ্যমিক শ্রেণির বইগুলো পড়ান৷ কিন্তু কোনো টাকা নেন না। আর রাতে ইভান সেই পড়া তার বন্ধুদের বুঝিয়ে দেয়। এভাবেই তাদের ঘরোয়াভাবেই পড়াশুনা হয়ে যাচ্ছে। তবে এসবের মধ্যে পিছিয়ে আছে তূর্য। তার পড়াশুনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সাপ্তাহিক বাজারগুলো সে-ই করে আনে। মাঝে মাঝে তাহমিদকে সাহায্য করে। আর মহল্লার সামনে দাঁড়িয়ে সময় পার করে। যতোদিন একটা গিটার কিনতে পারবে না, ততোদিন সে এমনই ছন্নছাড়া সময় পার করে যাবে৷ তাই বাকী পাঁচজন সিদ্ধান্ত নিলো, প্রথমেই তূর্যকে একটা গিটার কিনে তাকে মানসিকভাবে সন্তুষ্ট করবে, তারপর বাকিটা দেখা যাবে।

বিকেলে শতাব্দী বারান্দার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“অরুণিকা, বাবু আছো?”

শতাব্দীর কন্ঠ শুনে অরুণিকা ভেতরে থেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো। এই দুইমাসে অরুণিকার সবচেয়ে কাছের মেয়ে বান্ধবী শতাব্দীই। শতাব্দী অরুণিকাকে দেখে বলল,
“বাবু, বাসায় ভাইয়ারা আছে?”

“হ্যাঁ।”

“কি করছে?”

“ডিসুম ডিসুম করছে।”

শতাব্দী কপাল কুঁচকে বলল,
“কার সাথে ডিসুম ডিসুম করছে?”

“জানি না। ফোনে ডিসুম ডিসুম করছে। আমাকে দেখতেও দিচ্ছে না। আমি কতোবার বলেছি আমি কার্টুন দেখবো। আমাকে দেখতেই দেই না। ওরা অনেক পঁচা। আরাফও পঁচা হয়ে গেছে।”

অরুণিকা ঠোঁট ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শতাব্দী বলল,
“পঁচা ভাইয়াদের বলো, ডিসুম ডিসুম বাদ দিয়ে বই খাতা নিয়ে বসতে?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল,
“আচ্ছা, বলে আসছি।”

অরুণিকা দৌঁড়ে ভেতরে গেলো। আবার কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বলল,
“ইভান আমাকে বকা দিয়েছে। বলেছে, আরেকবার বিরক্ত করলে আমাকে ফোনে ঢুকিয়ে দেবে। তুমি জানো, ফোনে সব ভূত। ওরা ভূতের সাথেই ডিসুম ডিসুম করছে। আমাকে ওখানে পাঠিয়ে দিলে তো ভূত খেয়ে ফেলবে।”

“আচ্ছা, তুমিই আমাকে দরজাটা খুলে দাও। চাবিটা দাও। আমি নিজেই খুলে ঢুকছি।”

অরুণিকা ভেতরে এসেই আরাফকে বলল,
“চাবি দাও। দরজা খুলে দেবো।”

আরাফ এবার ফোন থেকে চোখ সরিয়ে অরুণিকার দিকে তাকালো। আর ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কেন দরজা খুলবে?”

“শতু আপু এসেছে।”

ইভান বিরক্তির সুরে বলল,
“এই মেয়ে ঘনঘন এদিকে কেন আসে? ওর কি কাজ নেই?”

তাহমিদ ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালো। চাবিটা পকেট থেকে বের করতে করতে বারান্দায় এলো। শতাব্দী তাহমিদকে দেখে মুচকি হাসলো আর বলল,
“তা জিলাপি আজ ক’টা প্যাঁচ লাগিয়েছে?”

তাহমিদ চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
“ঠিক যতোটা প্যাঁচ তোমার চুলে লেগেছে।”

কথাটি শুনেই শতাব্দী মাথায় হাত দিলো। ইশ! আজও সে চুল আঁচড়ে আসে নি। এই তাহমিদ ছেলেটার এতো সূক্ষ্ম দৃষ্টি! শতাব্দী শুনেছে এলেমেলো চুলেও বালিকাদের সুন্দর লাগে, কিন্তু তাহমিদের দৃষ্টিতে সে অসুন্দর আর অগোছালো মেয়ে। শতাব্দী অন্তত তাহমিদের সামনে নিজেকে পরিপাটি রাখার চেষ্টা করে, কারণ বাকীরা কোনো মন্তব্য না করলেও তাহমিদ তাকে মুখের উপর খোঁচা দিয়ে বসে। যা শতাব্দীর খুবই অপমানজনক মনে হয়।

তাহমিদ গেইট খুলেই বলল,
“ভেতরে আসতে পারো।”

“আমি ভেতরে আসতে চেয়েছিলাম তোমাদের ডাকার জন্য। বাবা তোমাদের বাসায় আসতে বলেছিলো। অরুণিকাকে তো বললাম, কিন্তু তোমরা নাকি ওকে তাড়িয়ে দিলে!”

তাহমিদ শতাব্দীর কথার কোনো উত্তর না দিয়েই ভেতরে চলে গেলো। শতাব্দী সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো আর মনে মনে বলল,
“এই ছেলেটার এতো অহংকার! শুধু একটু ভালো রাঁধে, তাছাড়া তার আর কি গুণ আছে? চোখগুলোও ইঁদুরের মতো দেখতে।”

তাহমিদ এবার বেরিয়ে এলো। পেছন পেছন বাকীরাও বেরিয়ে এলো। অরুণিকা গেইট খোলা পেয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। আর শতাব্দীকে বলল,
“শতু আপু, তোমার ছানাটা কোথায়?”

“ও তো বাসায় ঘুমাচ্ছে। তুমি চলো বাসায়। তোমাকে দেখলেই উঠে যাবে।”

তাহমিদ বলল,
“অরুণিকা, তুমি কিন্তু গোসল করেছো। আলেয়া আপা তোমাকে গোসল করিয়ে দিয়েছেন। বিড়াল ধরলে আমি কিন্তু বাসায় ঢুকতে দেবো না।”

শতাব্দী বলল,
“এ আবার কেমন কথা! আমি গতকাল আমার ছানাকে স্নান করিয়েছি। তোমার চেয়ে বেশি পরিষ্কার আমার ছানা।”

তাহমিদ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“যে নিজের চুলটাই পরিষ্কার করে না, সে আবার বিড়ালকে পরিচ্ছন্ন রাখবে!”

তূর্য হুট করে বলল,
“প্রতিদিন গোসল করালে বিড়াল তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর এরা খুব পরিচ্ছন্ন প্রানী হয়।”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার এসব ভালো লাগে না। আমাকে এতো যুক্তি দেখাতে হবে না।”

শতাব্দী এই কথা শুনে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলো। এদিকে তারা বাসায় ঢুকতেই মাস্টার মশাই তাদের বসতে বললেন। শতাব্দী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বাবা ওই চেয়ারে ধুলো পড়ে আছে। একটু মুছেই না হয় তাদের বসতে দেই। নয়তো আবার সন্ধ্যায় স্নান করতে হবে।”

তাহমিদের চেয়ারটা সরিয়ে শতাব্দী নিয়ে গেলো, আর মনে মনে বলল,
“তুমি আজ দাঁড়িয়েই থাকো। এই চেয়ার তোমার জন্য নয়।”

শতাব্দী ভেতরে চলে যাওয়ার পর মাস্টারমশাই বললেন,
“আমার স্কুলে তোমাদের ভর্তি করিয়ে দিতে চাইছি, কি বলো?”

তারা মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনেই অবাক হয়ে গেলো। ইভান বলল,
“কিন্তু স্যার, আমাদের কাছে তো এতো টাকা নেই যে সবাই একসাথেই পড়াশুনা করতে পারব। আমরা মাসে যা পাচ্ছি, তা দিয়ে বড়জোর চারজনের পড়াশুনার খরচ চালানো সম্ভব।”

“কিন্তু তোমরা এখন পড়লে ভবিষ্যতে আরো অনেক টাকা রোজগারের সুযোগ এসে যাবে৷ মাধ্যমিক পাশ না করলে তো এখন পিয়নের চাকরিও জুটে না। তোমাদের তো পড়াশোনা করতেই হবে। আর তোমরা পড়াশুনা না করলে অরুণিকাকে কে দেখবে? ওর ভবিষ্যৎ তোমাদের ভবিষ্যতের সাথেই সংযুক্ত। আর টাকার চিন্তা করো না। আমার স্কুলে বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। একটু বাসায় কয়েকদিন পড়ো। অন্তত তিনজন বৃত্তি পেলে, বিনা মূল্যে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা দিতে পারবে। এখন সামনের পরীক্ষাটাই দাও। তোমাদের হাতে এখনো দুই মাস সময় আছে।”

বৃত্তির কাগজে বাবা-মার নামের জায়গায় মৃত শব্দটা ব্যবহার করতেই খুব কষ্ট হচ্ছিলো তাদের। নিচে অভিভাবক হিসেবে সালেহ আলী আর সুরাইয়ার নাম লিখলো। এরপর কাগজগুলো মাস্টার মশাইয়ের হাতে দিয়ে তারা বেরিয়ে পড়লো।

এরপর দুই মাস তারা মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করলো। পরীক্ষাও দিলো। শেষমেশ তিনজনের পরিবর্তে ইভান, আহনাফ, আরাফ আর তাহমিদ এই চারজনই বৃত্তি পেলো। এখন তাদের পড়াশুনা বাবদ কোনো খরচ নেই। শুধু তূর্য আর ইমনের পড়াশুনার খরচটাই দিতে হবে৷ তাদের এই কয়েক মাসে অনেক টাকা সঞ্চয় হয়েছে। সেই টাকা দিয়েই তারা এবার তূর্যকে তার শখের গিটার কিনে দেওয়ার পরিকল্পনা করলো। কিন্তু যেদিন গিটার কিনতে যাবে সেদিনই ঘটলো এক দুর্ঘটনা।

চলবে- আজ সে অনেক খুশি।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here