অরুণিকা পর্ব -৬০+৬১

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬০||

৯৯.
সবাই ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়েছে। একটু পরই তারা কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। তূর্য গাড়িতে ব্যাগগুলো উঠিয়ে গেইটের কাছে এসে দাঁড়ালো। তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আদিলের কল। সে রিসিভ করতেই আদিল ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“তূর্য, কোথায় তুমি?”

তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমরা বের হচ্ছি, ভাইয়া। আপনি ঠিক আছেন তো?”

“না, আমি ঠিক নেই৷ কিছুই ঠিক নেই। তুমি এখনই আমার দেওয়া লোকেশনে আসো। তুমি সব বুঝতে পারবে। তোমাদের সাথে অনেক বড় ধোঁকা হয়েছে৷ আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। কে তোমাদের পরিবারকে খুন করেছে, কেন করেছে সব তথ্য আমার হাতে আছে। তুমি তাড়াতাড়ি আসো।”

তূর্য ফোন রেখেই ঘরে ঢুকে আহনাফকে তার সাথে যেতে বললো, সাথে তার পিস্তলটি সাথে নিলো। উপমা তূর্যের হাতে পিস্তল দেখে ভীত কন্ঠে বললো,
“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

তূর্য কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তারপর আহনাফকে গাড়িতে আদিলের বলা কথাগুলো বললো। তারা হুড়োহুড়িতে সবাইকে জানাতে পারে নি। তাই আহনাফ আরাফকে মেসেজ দিয়ে সারসংক্ষেপ জানিয়ে দিলো।

বিশ মিনিটের মধ্যে আদিলের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে গেলো তারা। গাড়ি থেকে নেমেই দেখলো একটা পুরোনো বাড়ি। তূর্য পিস্তলটি পেছনের পকেটে নিয়ে ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলো। আহনাফ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“আমি তো আমার পিস্তলটিই সাথে আনি নি। এখন যদি কারো উপর এট্যাক করতে হয়?”

তূর্য বলল,
“করতে হলে করবো। এখন আমার পিস্তলে মাত্র তিনটা বুলেট আছে। আর আমি কারো উপর এট্যাক করতে ইচ্ছুক নয়। আমি শুধু আমার পরিবারের হত্যাকারীদের উপরই এই বুলেটগুলো ছুঁড়তে চাই। কিন্তু কেউ যদি সামনে চলে আসে, তাহলে শারীরিক শক্তি দিয়ে তার উপর এট্যাক করবো।”

আহনাফ বলল, “মারতে পারবি তো!”

“তুই পারবি?”

“কলকাতায় এক বছর তো এসবের উপরই ট্রেনিং নিয়েছি। কিন্তু তুই তো শিখিস নি। তোর উপর এট্যাক করলে, কিভাবে সামলাবি?”

“এখন এসব কথা বন্ধ কর। দেখি কি হয়!”

তারা ভেতরে ঢুকে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। আহনাফ বলল,
“তূর্য, তুই কি শিউর? আমাদের এখানেই আসতে বলেছে?”

“হ্যাঁ, এই লোকেশানটাই তো শেয়ার করলো।”

তারা দু’তলায় উঠতেই উপরে কারো কন্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে গেলো। এক সিঁড়ি উঠতেই উপর থেকে কেউ একজন তাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলো। অতর্কিত আক্রমণে গুলিটা সোজা তূর্যের হাতে এসে লাগলো। মুহূর্তেই তার হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেলো। আহনাফ তূর্যকে পেছনে সরিয়ে পিস্তল উঠিয়ে নিতেই মনে পড়লো, পিস্তলে শুধু তিনটি বুলেট আছে। তাই সে তাড়াতাড়ি পিছু ফিরে তূর্যকে নিয়ে পিলারের পেছনে চলে গেল। তূর্য শক্ত করে নিজের হাতটা ধরে রেখেছে। আহনাফ তার ফোন বের করে আরাফকে মেসেজ দিয়ে তাড়াতাড়ি সব জানালো। আরাফ ফোন হাতে নিয়ে আহনাফের মেসেজ দেখে চমকে উঠলো। উপরের মেসেজটার দিকে মিনিট খানিক তাকিয়ে সে ইভান আর ইমনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাহমিদ যেতে চাইলে ওকে অরুণিকা আর উপমার খেয়াল রাখতে বললো। অরুণিকা আরাফকে এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“ওরা এভাবে কোথায় যাচ্ছে? ওদের কিছু হয়ে গেলে? আমার খুব ভয় লাগছে, তাহমিদ!”

তাহমিদ অরুণিকার মাথায় হাত রেখে বলল,
“চিন্তা করো না। ওরা ফিরে আসবে।”

এদিকে আহনাফ তূর্যকে আড়াল করে পিলারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। শত প্রশিক্ষণ নিলেও এভাবে বাস্তবেই কারো উপর গুলি চালাতে হবে, এর জন্য এই মুহূর্তে তার প্রস্তুতি নেই। তার গুলিতে যদি কারো মৃত্যু হয়, হোক সে খুনী বা ভাড়া করা গুন্ডা, তাহলে সে কিভাবে এই অপরাধবোধ থেকে নিজেকে বের করবে, এখন সে সেটাই ভাবছে। তূর্য আহনাফের চেহারা দেখেই বুঝতে পারল, সে এই মুহূর্তে কি ভাবছে। তাই সে নিজের গুলিবিদ্ধ হাতটা দেখিয়ে বলল,
“আমার শরীরে এতো রক্ত নেই। তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের হ। নয়তো আমি এখানেই মারা যাবো। মনে রাখিস, এরা আমাদের পরিবারের কাউকে ছাড়ে নি। দুই বছরের দিশান, তাহমিদের প্যারালাইজড দাদি, তোর প্র‍্যাগনেন্ট চাচী কাউকেই ছাড়ে নি। তাহলে তুই ওদের উপর এতো দয়া দেখাচ্ছিস কেন? হত্যার বদলে হত্যা। এটাই ন্যায় বিচার। তারা আমাদের পরিবারকে এমন ভাবে হত্যা করেছে যে লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি।”

“কিছুক্ষণ আগেই তুই বললি, শারীরিক শক্তি দিয়ে এট্যাক কর‍তে।”

“হ্যাঁ, কিন্তু এখন ওরা তো আমাদের উপর সোজাসুজি এট্যাক করছে।”

আহনাফের এবার রক্ত গরম হয়ে উঠলো। সে হুট করে পিলারের পেছন থেকে বেরিয়ে পিস্তল তাক করলো উপরের সিঁড়িতে। উপরে কেউ নেই৷ সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। তিনতলায় উঠতেই তার দিকে গুলি ছোঁড়া হলো। সে নিজেকে দেওয়ালের পেছনে আড়াল করে আত্মরক্ষা করল। এখন শুধু ওদের বুলেটগুলো শেষ কর‍তে হবে। তাই সে কিছুক্ষণ পর পর নিজেকে সামনে এনে আড়াল করছে। এরই মধ্যে সে ভেতরে নিজেকে আড়াল করার মতো পিলার খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোনোভাবেই আহনাফ ভেতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।
সে জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো। সেই মুহূর্তেই তার মনে পড়ে গেলো তার মায়ের হাসি মাখা মুখটা, দিশান আর অরুণিকার করা দুষ্টু-মিষ্টি আবদারের কথা, বিকেলে মৈত্রী ম্যানশনের বাইরে বসে বড়দের চায়ের আড্ডা, আর অরুণিকার সেই চার বছর বয়সে করা প্রশ্ন,
“বাবা কোথায়? বাবা কখন আসবে? আমি মায়ের কাছে যাবো। মাকে ফোন করে আসতে বলো।”

আহনাফের চোখ ছলছল করে উঠলো। তার পুরো শরীর রাগে কাঁপতে লাগলো। এবার সে আর থামলো না। পিস্তল তাক করেই সামনে এগুতে লাগলো। প্রথম বুলেট, দ্বিতীয় বুলেট দু’টোই দেয়ালে এসে বিদ্ধ হয়েছে। তবে তৃতীয়টি সোজা এসে ঠেকেছে অপর পাশে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির উপর। আহনাফ এবার নিজেকে পিলারের পেছনে আড়াল করে অসহায় চোখে পিস্তলের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদের সাথে এট্যাক করার জন্য এই মুহূর্তে শারীরিক শক্তিটাই প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু যেখানে অপর পক্ষ বন্দুকধারী, সেখানে তার শারীরিক বল দেখানো মোটেও ফলপ্রসূ হবে না।
এদিকে লোক দুইটার মধ্যে অন্যটি বন্দুক হাতে সামনে আগাতেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঠা ঠা করে বুলেট ছুঁড়তে লাগলো ইভান আর ইমন। লোকটার বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেলো। পিস্তলে আবার বুলেট ঢুকিয়ে সামনে এগিয়ে পিলারের পেছনে আড়াল করে রাখা আরেকটা লোকের দিকে এগিয়ে গেলো ইমন। ইমনের চোখ লাল হয়ে গেছে। পানিগুলো চোখে চিকচিক করছে। সে লোকটার বুকে খুব জোরে লাথি মারতেই দেখলো সামনের মেঝেতে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ইভান লোকটাকে ইচ্ছেমতো ঘুষি মারতে লাগলো। আহনাফও এবার এগিয়ে এসে সমানে লোকটাকে মারছে। আর ইমন সেই রক্তের স্রোতের সূত্রপাত দেখতেই সামনে এগিয়ে গিয়ে থমকে গেলো। তার হাত থেকে পিস্তলটাই পড়ে গেলো। তার পুরো শরীরটা রিনরিনিয়ে উঠলো।
আদিলের গলা বেয়ে গলগল করে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ইমন আর আগানোর সাহস পেলো না। সেখানেই সে ধপ করে বসে পড়লো। ইভান আর আহনাফও লোকটাকে মেরে হাঁটার অনুপযোগী করে ফেলেছে। তারা ইমনের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে সামনে এগিয়েই দেখলো আদিলের গলা কাঁটা নিথর শরীর মেঝেতে পড়ে আছে। ইভান পেছন ফিরে সেই লোকটার চুল টেনে ধরে বলল,
“কে মেরেছে আদিল ভাইয়াকে?”

লোকটা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি মারি নি। বস মেরেছে।”

“কে তোমাদের বস?”

“আমাকে ছেড়ে দিন, স্যার। আমি সত্যটা বলবো।”

“ছেড়ে দেবো। আগে বলো কে মেরেছে?”

“শাহবাজ খান।”

ইভান নামটা শুনেই লোকটার মাথায় গুলিবিদ্ধ করলো। আর ইমনকে টেনে ধরে নিচে নামালো। এদিকে আরাফ তূর্যকে গাড়িতে বসিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছে। ইভান আর আহনাফকে নামতে দেখে সে বলল,
“কি হয়েছে? কোনো খবর পেয়েছিস?”

আহনাফ বলল,
“আদিল ভাইয়াকে মেরে ফেলেছে ওরা।”

তূর্য এই কথা শুনে থম মেরে রইলো। আরাফের কান দিয়ে যেন গরম কিছু প্রবেশ করানো হয়েছে। সে মুহূর্তেই থমকে গেলো। ইমন কাঁপা কন্ঠে বলল,
“উনি আমাদের জন্য খুন হয়েছেন? কি করবো এখন আমরা? উপমা আর ওর বাবা-মাকে কিভাবে ফেইস করবো এখন?”

ইভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আর এসব করেছে ওই শাহবাজ খান। উনার লোকই উনার নাম বলে দিয়েছে। ওই লোকটাকে এখন মরতেই হবে। আই উইল কিল হিম।”

১০০.

মুরশিদ জুবাইয়েরের সহযোগিতায় কোনো টানাহেঁচড়া ছাড়াই আদিলের লাশটা দাফন করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে আরো দুইটা লাশ পাওয়া গিয়েছে, আর তারা তূর্য আর ইভানের পিস্তল থেকে চালানো গুলিতেই মারা গেছে। তবুও তাদের উপর কোনো মামলা হয় নি। বরং এই লোক দুইটা যে ভাড়া করা আসামী, তার প্রমাণ দিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলেন মুরশিদ জুবাইয়ের৷ তবে আদিলের খুনের জন্য উপমার বাবা-মা ছ’জনকেই দোষারোপ করে যাচ্ছেন।
এদিকে উপমা পাথরের মতো ভাইয়ের রক্তাক্ত জামাকাপড় হাতে নিয়ে বসে আছে। মিসেস জুলেখা পুরো ঘরে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ছেলেকে খুঁজছেন আর পাগলামো করছেন। তাদের এলাকার সবাই জেনে গেছে তারা মৈত্রীদের সাথে আত্মীয়তা করেছে। প্রতিবেশীরাও কানাঘুঁষা করে বলছে,
“একেই বলে বেশি প্রভাবশালীদের ঘরে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার নমুনা।”

মিসেস জুলেখা এসব শুনে উপমাকে ইচ্ছেমতো চড় মারলেন আর বললেন,
“তোর জেদের জন্য আমার ছেলে আজ বলির পাঁঠা হয়েছে। আমার ছেলেকে মেরে দিয়েছে ওরা।”

উপমার বাবা থানায় গিয়ে তূর্য ও তার বন্ধুদের নামে মামলা করতে গেলেন৷ কিন্তু ক্ষমতার কাছে একজন বাবার পরাজয় হলো। মুরশিদ জুবাইয়ের জানতেন আবেগী হয়ে উপমার বাবা-মা ছ’জনের নামেই মামলা করতে যাবেন। কিন্তু তারা তো নির্দোষ। তবে এই মুহূর্তে ছেলেহারা বাবা-মা এই সত্যটা বুঝতে চাইবেন না। তাই আগে থেকেই তিনি তার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে পুরো প্রশাসনকে নিজের দিকে করে ফেললেন। আর থানায় উপমার বাবার দেওয়া অভিযোগটাও আর গ্রহণ করা হলো না।

এদিকে ইমন মাওশিয়াতকে ফোন করে বলল,
“মাও, তোমাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। আদিল ভাইয়ার খুন হয়েছে।”

মাওশিয়াত ধপ করে চেয়ারে বসে বলল, “কিভাবে?”

ইমন সবকিছুই মাওশিয়াতকে খুলে বলল। সব শুনে মাওশিয়াত কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“প্লিজ, এসব ছেড়ে দাও। আল্লাহ সেই খুনীদের শাস্তি দেবেন। তোমরা এসবে আর জড়াতে যেও না। তোমরা সবাই কলকাতায় চলে আসো। আমরা এখানেই ভালো থাকবো। এখানের সিটিজেনশিপ নিয়ে নিলে আর কিছু হবে না।”

ইমন বলল,
“এখন তো জবাব না দিয়ে আর সরে আসতে পারবো না। এতোদিন আমাদের আমানতের জন্য এতোদূর এসেছি। এখন অন্যের আমানতের জন্য লড়াই করবো। এখন আর পিছু হটার সময় নেই। আপতত বিয়ের তারিখ পেছাতে হবে। দুই মাস পর সব চিন্তাভাবনা করবো।”

“বিয়ে নিয়ে আমার হুড়োহুড়ি নেই। আমি জানি দিনশেষে তুমি আমারই থাকবে। কিন্তু তোমাকে নিয়েই আমার চিন্তা। স্পেশালি অরুণিকাকে নিয়ে। ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে দাও। আমার সাথে থাকুক। ওখানে যদি ওর কোনো বিপদ হয়।”

“একসাথে বেঁচে ফিরেছি, একসাথে বেড়ে উঠেছি। মরলেও একসাথেই মরবো। যতোক্ষণ বেঁচে থাকবো, জুবাইয়ের আংকেলের আমানতের হেফাজত করবো। অরুণিকার কিছু হবে না। আমরা ছ’জন ওর জন্য যথেষ্ট।”

এদিকে তূর্য উপমার পাশে এসে বসলো। উপমা মলিন মুখে দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। তূর্য তার হাতটি উপমার হাতের উপর রাখতেই উপমা এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“দূরে সরে যাও আমার কাছ থেকে। তোমার জন্য আমার ভাইয়ের খুন হয়েছে। তুমি আমার ভাইয়ের আসামী। যাও এখান থেকে।”

উপমার মুখ থেকে ‘তুমি’ ডাক শুনে তূর্য বুঝতে পারলো, তাদের সম্পর্কে অনেক বড় পরিবর্তন এসে গেছে। বিয়ের পর থেকেই উপমা তাকে আপনি করে ডেকেছে, আর আজ প্রথম তাকে তুমি করে ডাকছে। তূর্য বলল,
“ভাইয়ার সাথে যা হয়েছে, তার জন্য আমি খুব গিল্টি ফিল করছি। আর যে খুন করেছে, তাকে আমরা ছাড়বো না। তাকে আমরা শাস্তি দেবো।”

উপমা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“এতো বছরে নিজের বাবা-মার খুনীদের শাস্তি দিতে পারছো না, আর আমার ভাইয়ের খুনের শাস্তি দেবে? আমার ভাইয়ের খুনের? হাসালে আমাকে, তূর্য। আমি তোমার কে, হ্যাঁ? আমি এতো বছর তোমার রক্ষিতা হয়েই আছি। যাকে তুমি শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্যই ব্যবহার করেছো শুধু। তোমার কাছ থেকে এতোটুকু পরিমাণ ভালোবাসা আমি পাই নি।”

তূর্য উপমার হাত ধরে বলল,
“ছি! কি বলছো তুমি এসব। তুমি আমার ওয়াইফ। তুমি এমন বাজে শব্দ কিভাবে নিজের জন্য ব্যবহার করছো?”

“আমি তোমার ওয়াইফ, এটা শুধু তোমার রাতেই মনে আসে, তাই না?”

তূর্য উপমার হাতটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি এসব কথা বন্ধ করো। আমি অনেক খারাপ, তবুও নিজেকে নিয়ে এমন কথা বলো না। তুমি আমার কাছে অনেক সম্মানের। প্লিজ উপমা, এমন কথা আর বলো না।”

উপমা তূর্যকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তূর্য তার হাতের ক্ষতস্থান চেপে ধরে কুঁকড়ে উঠলো। উপমা একনজর তূর্যের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর উপমার বাবা এসে তূর্যের হাত ধরে তাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেলেন। আর বললেন,
“আমার ছেলে মারা গেছে, এখনো চারদিনও হয় নি। এখন আমরা আমাদের দ্বিতীয় সন্তানকে হারাতে চাই না। আমাদের এই দুইটাই সম্পদ ছিল। তোমরা একটা কেঁড়ে নিয়েছো। এখন আর একটাই আছে। তাকে মুক্তি দাও। তাকে অন্তত বাঁচতে দাও।”

তূর্য কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বাবা, আমি উপমার খেয়াল রাখবো, আমি থাকতে….”

তূর্যকে থামিয়ে দিয়ে করিম সিদ্দিক বললেন,
“আমি তোমার বাবা নই। আর উপমার খেয়াল রাখার জন্য ওর বাবা-মা বেঁচে আছে। তুমি আমার মেয়েকে মুক্তি দাও। এই সম্পর্কটা এখানেই শেষ হোক।”

“ও আমার ওয়াইফ। আমি ওর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবো না।”

মিসেস জুলেখা আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
“আমি উপমার মা। আমি জানি, তোমাদের সম্পর্ক কতোটুকু সুস্থ, আর কতোটুকু অসুস্থ। তাই এই সম্পর্ক বিচ্ছেদে তোমার এতো আফসোস হওয়ার কথা না।”

তূর্য মিসেস জুলেখার কথা শুনে কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা উপমার দিকে তাকালো। তূর্য তার দিকে এগুতে গেলেই সে দৌঁড়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতর থেকে বলল,
“আমি আমার বাবা-মার সাথেই থাকবো। আপনি আমাকে তালাক দিয়ে দিন। আমি আর আপনার সাথে ওই বাড়িতে থাকতে পারবো না।”

তূর্য বন্ধ দরজায় হাত দিয়ে বলল,
“সরি, উপমা। আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও। আমি সব ঠিক করে দেবো। প্লিজ, এমন কথা বলো না। আমি তোমাকে ছাড়তে চাই না।”

করিম সিদ্দিক তূর্যকে টেনে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বললেন,
“তোমাদের অনেক ক্ষমতা আছে। হয়তো আমার মেয়েকেও ঝুলিয়ে রাখবে। সমস্যা নেই। আমাদের কাবিনের টাকার প্রতি কোনো লোভ নেই। উপমা নিজেই তোমার কাছ থেকে তালাক নেবে। খুব শীঘ্রই তুমি কাগজ পেয়ে যাবে।”

তূর্য হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“বাবা, আমাকে একটু সুযোগ দিন। আমার তো বাবা-মা নেই। আপনাদেরই আমি বাবা-মার জায়গা দিয়েছি। প্লিজ, আমার সাথে এমনটা করবেন না। আমি উপমাকে ভালো রাখবো। আমাকে প্লিজ আরেকটা শেষ সুযোগ দিন।”

করিম সিদ্দিক তূর্যের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। আর তূর্য বসা থেকে উঠে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। অন্যদিকে উপমা তার রুমে লাগিয়ে রাখা তূর্যের ছবিগুলো একে একে নামাতে লাগলো। সে শব্দ করে কাঁদছে। রুমের বাইরে থেকে মিসেস জুলেখা মেয়ের কান্না শুনে মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, আর বললেন,
“আমার সাজানো-গোছানো সংসারটা শেষ হয়ে গেছে। আমাদের আদিল আমাদের ফেলে চলে গেছে। ও তো উপমাকে সবসময় সাহস দিতো, প্রেরণা দিতো। এখন আমার মেয়েটাকে কে দেখবে?”

এদিকে নিয়াজ হোসেন রিয়াজুর রহমানের রুমে এসে বললেন,
“ভাই, ওই মেয়ের সব তথ্য পেয়েছি।”

রিয়াজুর রহমান মুচকি হেসে বললেন,
“কি নাম তার!”

“উপমা করিম।”

“খুব সুন্দর নাম।”

“আরেকটা খবর আছে।”

“হুম, বল।”

“উপমা তূর্য আহমেদের স্ত্রী।”

রিয়াজুর রহমান ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“তূর্যটা কে!”

“মৈত্রীদের সন্তান। হাকিম আহমেদের ছেলে।”

রিয়াজুর রহমান থমকে গেলেন। নিয়াজ হোসেন আবার বললেন,
“উপমা করিমের বড় ভাই আদিল সিদ্দিকের খুন হয়েছে দুই দিন আগে। ধারণা করা হচ্ছে মৈত্রীদের শত্রুই এই খুনের সাথে জড়িত ছিল।”

“আমি যতোদূর জানি মৈত্রীদের তো শত্রুর অভাব নেই। তাহলে এই কাজ কারা করেছে? আর কেনই বা করেছে?”

“আদিল খুনীদের ব্যাপারে কিছু তথ্য পেয়েছিল। লাস্ট কল রেকর্ডে এটাই পাওয়া গেছে। আর মুরশিদ জুবাইয়ের এই মামলায় তাদের সাহায্য করছেন।”

রিয়াজুর রহমান হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আমার গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বের কর। মিসেস উপমা করিমের বাসায় আজ আমার বিনা নিমন্ত্রণে আগমন হবে। আর আজকের রাতের খাবারটা আমার পক্ষ থেকে যাবে।”

চলবে—-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

১০১.
রুম বন্ধ করে বসে আছে তূর্য৷ উপমা ছাড়া ঘরটা শূণ্য শূণ্য লাগছে। এই ঘরের প্রতিটি দেওয়ালের ফাঁকে ফাঁকে উপমার দীর্ঘশ্বাস আটকে আছে। তূর্য প্রতিবারই বলেছে সে উপমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তার কাজে ভালোবাসার কোনো লক্ষণই ছিল না। তবে আজ তূর্য উপমাকে অনুভব করছে। সে বুঝতে পারছে নিরবে এতোদিন তার পাশে থাকা মানুষটিকে ছাড়া সে কতোটা অসহায়। বাড়ির সবাই নির্জীব হয়ে বসে আছে। অরুণিকা নিজেই রান্নাঘরে গেলো দুপুরের রান্না-বান্না করার জন্য। আহনাফও তার পিছু পিছু গেলো। অরুণিকা চুপচাপ রান্নার কাজ করছে। আহনাফ তার হাত ধরে বলল,
“কথা বলছো না কেন?”

অরুণিকা মলিন মুখে বললো,
“ভাবী চলে যাওয়ার পর থেকে আমার এই ঘরে মন বসছে না।”

“কেন? আমরা তো আছি।”

“ভালো লাগছে না, আহনাফ। সত্যিই ভালো লাগছে না। কেউ এভাবে আদিল ভাইয়াকে এসে মেরে দিলো?”

“অরু, যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। এখন আমাদের উচিত উপমাকে সান্ত্বনা দেওয়া। আর তুমি ওকে ফোন করে বুঝিয়ে বলো। তূর্যকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না।”

অরুণিকা “হুম” বলে রান্নায় মনোযোগ দিলো। রান্না শেষ হলে অরুণিকা তূর্যকে ডাকার জন্য উপরে গেলো। দরজা খুলেই দেখলো তূর্য উপমার হাতের চুড়ি নিয়ে বিছানায় বসে আছে। অরুণিকা ভেতরে গিয়ে তূর্যের পাশে বসলো। তূর্য অরুণিকার দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“টুইংকেল, ও কি আর ফিরে আসবে না? আমি কি ওকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?”

অরুণিকা কিছু বলার আগেই তূর্য ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আর অরুণিকার কোলে মাথা রাখলো। অরুণিকা তূর্যের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“রকস্টার, তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? আমি আমার সুইট স্টার ভাবীকে ফোন দেবো। আহনাফ তো আমাকে ভাবীর বাসায় নিয়ে যাবে বলেছে। দেখো, আমি গিয়েই ভাবীকে সাথে করে নিয়ে আসবো।”

তূর্য অরুণিকার হাত আঁকড়ে ধরে ভেজা কণ্ঠে বলল,
“তুমি আগে বলো, আমি কি বেশি খারাপ?”

“উহুম। কে বলেছে তুমি খারাপ?”

“সবাই তো বলে। আমিও তো জানি। উপমাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। কতো মেয়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছি।”

“আহনাফের যদি এতো এতো মেয়ের সাথে যোগাযোগ থাকতো, তখন কি তুমি আমায় ওর সাথে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করতে পারতে?”

“পারাপারি পরে হতো। আগে ওর নাক ফাটিয়ে দিতাম।”

“তো, উপমা ভাবীর মাও এসব বুঝতে পেরেছে। তোমাকে নাকি কোন মেয়ের সাথে রিক্সায় দেখলো। অনেককিছুই তো শুনেছি আমি। তুমিই যে রিকি দা স্টার, এটা তো এখনো সবাই জানে না। তুমি বরং সবাইকে এই সত্যটা জানাও। আর ভাবীকে তোমার স্ত্রী হিসেবে পুরো মিডিয়ার সামনে পরিচয় করিয়ে দাও। দেখবে, ভাবী অনেক খুশি হবে।”

“টুইংকেল, এরপর কি ও সত্যিই আমার কাছে ফিরে আসবে?”

“ভাবী তোমাকে অনেক ভালোবাসে৷ তাহমিদ যেভাবে শতু আপুকে ভালোবাসে, আরাফ যেভাবে সায়ন্তনী আপুকে ভালোবাসে, তার চেয়েও বেশি ভাবী তোমাকে ভালোবাসে। সারাদিন ভাবী তোমার কথা বলতো। তোমার জন্য কতো মজার মজার নাস্তা বানাতো। তুমি আসার আগে সুন্দর করে সাজতো। কিন্তু তুমি কখনোই ভাবীর দিকে মনোযোগ দাও নি। সারাদিন নিজের কাজেই ব্যস্ত ছিলে। ভাবী কতো সুন্দর! অথচ তুমি কিনা ওই মেয়েগুলোকে সময় দাও, যারা দেখতেও সুন্দর না, যাদের মনটাও নোংরা।”

আহনাফ তূর্যের ঘরের সামনে এসে ভ্রূ কুঁচকে তূর্য আর অরুণিকার দিকে তাকালো। তূর্য এভাবে অরুণিকার কোলে মাথা রেখেছে, বিষয়টা আহনাফের হজম হলো না। সে রুমে এসেই তূর্যকে টেনে উঠিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“চল, উপমাকে আনতে যাই। তুই ওর পছন্দের কিছু কিনে নিয়ে আয়। আর ইমনকে সাথে নিয়ে যা। ও ফ্রি আছে।”

এই কথা বলে আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“চলো, চলো টেবিলে খাবার সাজাতে হবে। আমি এসব একা একা করবো নাকি?”

এদিকে তূর্য এসে ইভানের পাশে বসলো। অনেকদিন ইভান আর তূর্য একে অপরের সাথে কথা বলে নি। উপমার ব্যাপার নিয়ে তাদের একটা ঝগড়া বেঁধেছিল। আহনাফ আর আরাফ মিলে তাদের মধ্যে সব ঠিক করিয়ে দিলেও ইভান তূর্যের সাথে কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছিল। তবে আজ নিজ থেকেই ইভান তূর্যের হাত ধরে বলল,
“ব্যথা কমেছে?”

তূর্য মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না, হাত নাড়াতে পারছি না। ভীষণ ব্যথা।”

ইভান তূর্যের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমরা উপমাকে ফিরিয়ে আনবো। মন খারাপ করিস না।”

তূর্য মলিন মুখে বললো,
“আমি তোর সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করেছিলাম। দোষটা আসলে আমার ছিল। একটা মানুষ সবার চোখে একসাথে খারাপ হতে পারে না। নিশ্চয় তার মধ্যে সমস্যা আছে, তাই সবাই তাকে খারাপ ভাবছে। আমি অন্যায় করেছি। ইভান, তুই আমাকে মাফ করে দে।”

ইভান তূর্যের কাঁধে হাত রেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“বন্ধু, তোর উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। দিনশেষে আমরাই নিজেদের জন্য আছি।”

এদিকে অরুণিকা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে বলল,
“আর আমি তোমাদের জন্য আছি৷ মা, মেয়ে, বোন, শাশুড়ি যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে তোমাদের জন্য তৈরী করবো।”

ইমন হেসে বলল,
“শুধু বউটা তুমি আহনাফেরই থাকবে।”

আহনাফ মুচকি হেসে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি এখনো ওকে বিয়ে করি নি। তাই আপতত আমি কারো বউ না।”

অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে আহনাফের হাতে চিমটে দিয়ে বলল,
“আমি তোমার বউ না, মনে থাকে যেন।”

আহনাফ হাত ঢলতে ঢলতে বলল,
“এটা কি চিমটে দিয়ে বলতে হয়?”

“হ্যাঁ, মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছি। সেট করে নাও। এমনি বললে তো মনে থাকবে না। তাই বাইরে থেকে প্রভাবক দিচ্ছি চিমটে দিয়ে।”

সন্ধ্যায় আরাফ আর আহনাফ ছাদে এসে বসলো। তাদের মৌনতা আদিলের আকস্মিক মৃত্যুকে ঘিরে। আহনাফ নীরবতা ভেঙে বলল,
“একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?”

আরাফ আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ বলল,
“আদিল ভাইয়ার সাথে ইমানের অনেক ভালোই সম্পর্ক। অথচ ভাইয়ার মৃত্যুর পর থেকে ওর অদ্ভুত ব্যবহার আমার চোখে পড়ছে। তোদের চোখে পড়েছে কিনা জানি না। কিন্তু ইমান খুবই সন্দেহজনক আচরণ করছে। আর সেদিন আদিল ভাইয়ার সাথে তো ওরও থাকার কথা ছিল, কারণ ওই তো ভাইয়ার সাথে কাজ করছে।”

আরাফ চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“সেটাই তো। কিন্তু এখন তো আমরা জেনেই গেছি আসল খুনি কে!”

“নাহ, আরাফ। খুনি এতো সহজে আমাদের সামনে আসে নি। শাহবাজ খানকে কেউ ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।”

“কি বলতে চাইছিস তুই!”

“ভালোভাবে চিন্তা করে দেখ। শুরু থেকে যদি আমরা ক্যালকুলেশন করি, তাহলে বুঝবো আমাদের গ্যাপটা কোথায়! রহমতুল্লাহকে আমরা সন্দেহ করেছি। তিনি আমাদের বলেছেন রিয়াজুর রহমান খুনিদের সাহায্য করেছেন। মিডিয়ার লোকেরা মির্জা গ্রুপকে সন্দেহ করেছে আর শাহবাজ খানের সাথে শাহেদ মির্জার ভালোই যোগাযোগ ছিল, এখনও আছে, তাই তাকেও সন্দেহ করা হচ্ছে। মুরশিদ জুবাইয়েরকে আমরা প্রথমে সন্দেহ করেছি, কিন্তু উনার সব কথা শুনার পর মনে হচ্ছে রহমতুল্লাহ আমাদের সাথে অনেক বড় মাইন্ড গেইমস খেলেছে। সবকিছু ঘুরেফিরে একটা জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে, আর তা হলো, আমরা ধোঁকা খেয়েছি। আদিল ভাইয়াই এই কথাটা বলেছে। যেখানে আমরা মির্জাদের সন্দেহ করছি, শাহবাজ খানকে সন্দেহ করছি, সেখানে ধোঁকা খাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। ধোঁকা কাদের থেকে খাওয়া যায়? যাদের আমরা বিশ্বাস করছি, তাদের থেকেই তো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা বিশ্বাস কাদের করছি? আদিল ভাইয়ার কথামতে, আমাদের বিশ্বস্ত কেউই আমাদের সাথে প্রতারণা করছে।”

আরাফ চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“কিন্তু আমরা ছ’জন তো নিজেদের ছাড়া কাউকেই বিশ্বাস করছি না।”

“করছি। ইমানকে বিশ্বাস করছি। এই মুহূর্তে ইমানকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। আর ভাইয়ার মৃত্যুর পর থেকেই ও কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে। ওদিন ভাইয়া কি ওর কথায় বলতে চেয়েছিল?”

“না, ইমান হবে না। ইমান হলে উনি নামটা নিয়েই নিতো। উনি তূর্যকে কারো নাম বলে নি। তার মানে উনি লোকটাকে চেনে, অথচ নাম জানে না। নাম জানে না তাই নামটা সাথে সাথেই নিতে পারে নি৷”

“আর যাই বলিস, তোকে যখন মেসেজ দিয়েছিলাম, সাথে সাথেই বেরিয়ে যেতে পারতি। আমরা অনেকক্ষণ নিজেদের আড়ালে রেখেছিলাম। ততোক্ষণে হয়তো ওই বিল্ডিংয়ে কোনো প্রমাণ থাকলে তা সরিয়ে ফেলেছে।”

“তোর মেসেজ দেখেই আমি বাকিদের বলে বের হয়েছি।”

“তাহলে তোদের আসতে এতো সময় লেগেছে কেন?”

“কি বলছিস তুই? সাথে সাথেই তো বের হয়েছি। আমরা তো তোদের দু’জনকে পুরো ঘরে খুঁজছিলাম। উপমা তো বলেই নি তোরা কোথায় গিয়েছিস। অনেকক্ষণ পর বললো তূর্য পিস্তল নিয়ে বেরিয়েছে। এরপর ফোন দিতে যাবো, দেখলাম তোর মেসেজ।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আরাফ, আমি গাড়িতে উঠার পাঁচমিনিটের মধ্যে তোকে মেসেজ দিয়েছিলাম। আর সাথে সাথেই তুই মেসেজ সিন করে ফেলেছিস।”

আরাফ ফোন বের করে আহনাফের সামনে দেখলো, আহনাফের আগের মেসেজটা আরো অনেক সময়ের ব্যবধানে এসেছিল। আরাফ বলল,
“কিন্তু আমি শেষ মেসেজটাই দেখেছি। আগেরটা আমার ওই সময়ই চোখে পড়েছিল। ভেবেছি ওইসময়ই মেসেজটা দিয়েছিলি।”

“আরাফ, আমি মেসেজ দেওয়ার সাথে সাথেই সিন হয়েছিল। আর তুই অনলাইনেই ছিলি।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ওয়েট, তোর ফোনটা দে।”

আহনাফ আরাফের ফেইসবুকের সিকিউরিটি চেক করতে গিয়েই দেখলো, আরাফের ফেইসবুক একাউন্ট আরো চারটা ফোনে লগ ইন করা আছে। আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“তুই এই ফোন কাকে দিয়েছিস?”

“কাউকেই তো দেই নি।”

“তোর ফেইসবুক অন্য কোথাও লগ ইন কিভাবে, আরাফ! তুই এতো বড় ভুল কিভাবে করেছিস? তারমানে এতোদিন আমাদের সব প্ল্যান অন্য কেউ পেয়ে যাচ্ছিল। চেঞ্জ ইউর পাসওয়ার্ড, আরাফ। সব জায়গা থেকেই লগ আউট করবি।”

আরাফ পুরো ফেইসবুকে সিকিউরিটি দিয়ে তার সব সোশ্যাল একাউন্টেও সিকিউরিটি বসিয়ে দিলো। এবার আহনাফ নিচে এসে সবাইকে কথাটা জানাতেই একই সমস্যা তারা তাহমিদের ফোনেও খেয়াল করলো। আহনাফ সবার ফোন নিয়ে বলল,
“আমাদের কথাবার্তা, এখন খুনির কাছে পৌঁছে গেছে। আর শাহবাজ খান যদি সত্যিই খুনি হতো, তাহলে উনার লোককে ওখানে বসিয়ে রাখতো না। কারণ উনি জানে আমরা ওখানে যাচ্ছি। অনেক আগেই সব ক্লিয়ার করে নিতো। কেউ একজন ইচ্ছে করে উনার নাম উচ্চারণ করে আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য ওই লোক দুইটাকে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। এটা ওদেরই প্ল্যান ছিল।”

ইমন গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তাহলে এখানে দুইটা কনফিউশান আছে। হয়তো খুনি নিজেকে শাহবাজ খান হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। নয়তো শাহবাজ খান সত্যিই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আছে।”

তূর্য বলল,
“আর যাই বল, আহনাফের কথা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ইমান খুনির ব্যাপারে কিছু তো একটা জেনেছে। কিছু একটা তো এখানে আছে। এখন এটাই আমাদের বের করতে হবে।”

কিছুদিন পর আরাফ, ইভান, আহনাফ আর অরুণিকা উপমাদের বাসায় গেলো। আরাফ উপমাকে অনেক অনুরোধ করলো, তাদের সাথে বাসায় ফিরে আসার জন্য। কিন্তু উপমা রাজি হলো না। সে তার বাবা-মাকে আর কষ্ট দিতে চায় না। উপমা ও তার পরিবারের ধারণা তূর্যকে বিয়ে করার ফলে আদিলের মৃত্যু হয়েছে। অরুণিকা উপমার হাত ধরে বলল,
“আমি রকস্টারকে আশা দিয়ে এসেছি যে আমি আমার সুইট স্টার ভাবীকে ফিরিয়ে আনবো। ও সারাদিন-রাত তোমার জন্য ছটফট করে। রকস্টার তোমাকে অনেক ভালোবাসে। সবার ভালোবাসা প্রকাশের ধরণ একই ধরণের হয় না। কেউ ভালোবাসে, তবুও মুখে আনে না। কেউ মুখে বললেও ভালোবাসা দেখায় না। আর কেউ ভালোবাসি না বলেও অনেক ভালোবাসা দিয়ে যায়। ভাবী, তোমার স্টার তোমাকে ছাড়া ভালো নেই।”

উপমা ছলছল চোখে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার বাবা-মা ভাইয়াকে হারিয়ে একদম একা হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমি ওই বাড়িতে থাকলে এরা শোকেই মারা যাবে। আমাকে এখানে থাকতে দাও। আমি তোমার রকস্টারকে এখনো ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসলেই যে সংসার করতে হবে, এমন তো নয়। আমি একটা চাকরি খুঁজছি। আমার সময় কেটে যাবে। তোমার রকস্টার এখন স্বাধীন। ও এখন মুক্ত হাওয়ায় মেয়েদের সাথে উড়বে, ঘুরবে। ঘরে বউ আছে সেই চিন্তায় অস্থির হতে হবে না। অরুণিকা, ওই বাড়িতে একমাত্র তুমিই আমাকে বুঝো। আশা করবো, এখনও আমাকে বুঝবে। আমাকে আমার বাবা-মার সাথে থাকতে দাও।”

“কিন্তু আংকেল যে তালাকের কথা বললো।”

“বাবা রাগের মাথায় বলেছে, আর আমি অভিমান থেকে বলেছি। কিন্তু যদি তোমার রকস্টার দিয়ে দিতে চায়, আমি সাইন করে দেবো। তবে আমার পক্ষ থেকে কোনো লেটার যাবে না। আমি তাকে ছাড়তে পারবো না, অরুণিকা। মানুষটা আমার সাথে মিশে গেছে। তাকে নিয়ে ভাবতে, তাকে ভালোবাসতে আমার খুব ভালো লাগে। তাকে পাওয়া, না পাওয়া ভাগ্যের লিখন৷ আমি এভাবেই তাকে ভালোবেসেছিলাম। তাকে পাওয়ার চেয়ে, তাকে ভালোবাসাটাই আমার জেদ ছিল। এই জেদ আমি কখনোই হারাতে চাই না।”

“তুমি রকস্টারকে ছাড়া ভালো থাকবে?”

“হ্যাঁ, কিছু মানুষকে স্মৃতিতে রেখেও ভালো থাকা যায়।”

“তুমি তাহমিদ আর আরাফের মতো কঠিন মানুষ হয়ে গেছো। কিন্তু আমার রকস্টার অনেক নরম মনের মানুষ। ও কাঁদলে আমার ভালো লাগে না। ওর এতো ভুল ক্ষমা করেছো, এই বারও ক্ষমা করে দাও। এমনিতেই আদিল ভাইয়ার মৃত্যুতে ওরা সবাই অনেক দুশ্চিন্তায় আছে। এর মধ্যে তুমি রকস্টারকে ছেড়ে চলে এসেছো। ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।”

উপমা বসা থেকে উঠে বলল,
“আমি তোমার সাথে যাচ্ছি না, অরুণিকা। চলে যাও তুমি।”

অরুণিকা মন খারাপ করে বেরিয়ে গেলো।
তারা চারজন রাস্তায় হাঁটছে। ইভান আর আরাফ চুপ করে আছে। আহনাফ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর গাড়ি খুঁজছে। হঠাৎ অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে বলল,
“চলো না, একবার ওই বাড়িতে যাই।”

আরাফ আর ইভান অরুণিকার দিকে তাকালো। ইভান বলল,
“কোন বাড়িতে?”

“ওই পোড়া বাড়িতে।”

আরাফ বলল, “ওখানে হঠাৎ!”

“মা-বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ওখানে গেলে হয়তো ভালো লাগবে।”

ইভান বলল,
“অরুণিকা, রাত নয়টা বাজছে। ওইদিকে তো কেউ থাকে না। ওইদিন ইমনের আক্দ উপলক্ষে আলাদা লাইটিং করা হয়েছিল। এখন ওই দিকটায় অন্ধকার।”

“মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে হাঁটবো। আর তোমরা থাকলে আমার ভয় লাগবে না।”

অরুণিকার অনুরোধে আরাফ আর আহনাফ সেখানে যেতে রাজি হলো। আর ইভান অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেলো। মৈত্রী ম্যানশনে পৌঁছাতেই অরুণিকা বলল,
“আমার না মাঝে মাঝেই মনে পড়ে, সেদিন রাতে আগুন লেগেছিল এই বাড়িতে। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে দৌঁড়াচ্ছিল। চাচিকে এক লোক মেরে দিয়েছিল। বাসার সবাই চেঁচামেচি করছিল। গুলির শব্দ হচ্ছিল। সবার মুখেই কালো মুখোশ। আমি কারো চেহারা দেখি নি। জানো, এসব বার বার আমার চোখের সামনে ভেসে আসে। কিন্তু সবকিছুই ঝাপসা। এতো পুরোনো কথা আমার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে কেন জানো?”

আহনাফ জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“কারণ আমি সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম। জানো, বাবার সেই পুরোনো চাদরটা তাহমিদ আলমারিতে রেখে দিয়েছিল। সেটা দেখেই আমার সব মনে পড়ে যায়। আমি সারাদিন এসব নিয়েই ভাবি। তাহমিদকে কতোবার শুনিয়েছি। ও নিজেও আমাকে বার-বার এই ঘটনাগুলো শুনিয়েছে, তাই আমি কিছুই ভুলতে পারি নি। আচ্ছা, আজ সবাই যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে কি আমি তোমাদের এতো ভালবাসতে পারতাম, বলো?”

ইভান বলল,
“হয়তো তুমিও তখন আমাদের এতো প্রিয় হতে না।”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“এসব পুরোনো কথা ভুলে যাও।”

অরুণিকা বলল,
“এসবের কি কোনো শেষ নেই? আজ আদিল ভাইয়া মারা গেছে, কাল যদি তোমাদের কিছু হয়? একটা মানুষ কি দুইবার অনাথ হতে পারে, বলো? আমি তো তোমাদের হারালে আবার অনাথ হয়ে যাবো।”

আরাফ অরুণিকার মাথায় হাত রেখে বলল,
“অরু, এসব কথা কেন বলছো?”

“চলো না, আরাফ। আমরা আবার কলকাতায় ফিরে যাই। ওখানে আমরা কতো ভালো ছিলাম। ওখানের সবাই কতো ভালো ছিল। স্কুলের ফ্রেন্ডরা কতো ভালো ছিল। কোথাও যেতে ভয় লাগতো না। কিন্তু এখন ফোন আসলেও ভয় লাগে।”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ফোন আসলে কেন ভয় লাগবে? কেউ কি তোমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছে?”

অরুণিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“না, এমনিতেই।”

তারা আবার পিছু ফিরলো। তারা মৈত্রী ম্যানশনের গলি দিয়ে বের হতে লাগলো। অরুণিকা একবার পেছন ফিরে তাকালো। মুহূর্তেই ভয়ে তার শরীর কেঁপে উঠল। সে শক্ত করে কারো হাত চেপে ধরলো। আহনাফ অরুণিকার হাতের স্পর্শ পেয়ে খুব অধিকার নিয়েই অরুণিকাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। বাকি পথ আহনাফের বাহুতেই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছে সে। আহনাফের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস সে অনুভব করেছে। এই প্রথম সে কাউকে অনুভব করছে। অরুণিকা বুঝতে পারছে না, এই অনুভূতিটা এতো প্রশান্তির কেন!

দুই মাস পর ছ’জন অরুণিকার সাথে কলকাতায় পৌঁছালো। দু’দিনের মধ্যে ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাদের ফেরার আগের দিন তাহমিদ একাই তাদের পুরোনো মহল্লায় গেলো৷ মহল্লার গলিতে ঢুকতেই কেমন যেন তার হাত-পা কাঁপছিল। যাকে দেখার জন্য সে এই মহল্লায় যাচ্ছে, সে তো এখানে নেই। সে তো তার স্বামীর ঘরে থাকবে। এতোদিনে হয়তো কয়েক সন্তানের মা হয়ে গেছে। তবুও কেন তার হাত-পা কাঁপছে?
তাহমিদ মহল্লায় ঢুকেই তাদের পুরোনো বাড়িটির দিকে তাকালো। গ্রিলের ফাঁকে হাত দিতেই তার শতাব্দীর গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটা মনে পড়ে গেলো। আনমনেই হাসলো তাহমিদ। সামনের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে পা বাড়াতেই সে থমকে গেলো। বারান্দায় বসে থাকা মানুষটিকে দেখে তার শরীরের পুরো শক্তি যেন হারিয়ে গেলো। মুহূর্তেই সে দৌঁড়ে মানুষটির দিকে এগিয়ে গেলো। তার হাতটি আলতো স্পর্শ করে বলল,
“শতাব্দী!”

মিতু বালা পুরুষালী কন্ঠ শুনে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাহমিদকে দেখে তিনি ছলছল চোখে তাকিয়ে গলা ছেড়ে বললেন,
“কই তুমি? দেখো। কে এসেছে।”

মাস্টারমশাই বের হয়ে তাহমিদকে দেখে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলেন। শ্রীজা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাহমিদকে দেখে মুখে কাপড় গুঁজে কেঁদে উঠলো। তাহমিদ মাস্টারমশাইকে ছেড়ে আবার শতাব্দীর পাশে এসে বসলো। শতাব্দী ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই চোখে অভিমান আর অভিযোগের পাহাড় জমেছে। তাহমিদ আজ সব বাঁধা ধুলোয় মিশিয়ে শতাব্দীর হাত আঁকড়ে ধরে শুধু সেই অভিযোগে ভরা চোখ দু’টির দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে—-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬১||

১০২.
বিয়ের পর থেকেই বিরাজ কুমারের সাথে শতাব্দীর সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছিলো না। শতাব্দী বিচার-বিবেচনা না করেই স্বামীকে তার পুরোনো ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেয়। কিন্তু বিরাজ কুমারের মন-মানসিকতা ওতো ভালো ছিল না। সে এরপর থেকেই শতাব্দীর কাছ থেকে দূরত্ব রাখা শুরু করে দেয়। বিয়ের কয়েক মাস পর সে দেশদ্রোহীদের হাতে শহীদ হয়৷ কিন্তু বিরাজ কুমারের মা কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন শতাব্দী অলক্ষুণে, তাই তার ছেলে অল্প বয়সে মারা গিয়েছে। এরপর থেকে তিনি শতাব্দীকে ঘরে বন্দি করে রাখেন। শতাব্দীর বাবা-মার সাথেও তাকে দেখা করতে দিতেন না। তবে এই নিয়ে শতাব্দীর খুব একটা অভিযোগ ছিল না। বরং একাকীত্বকেই সে মেনে নিয়েছিল। প্রায় দুই বছর পর শতাব্দীর মানসিক বিকার ঘটে। প্রথম প্রথম তার কথাবার্তা অস্বাভাবিক হয়ে উঠে, তারপর মাঝে মাঝে রাতে বা দিনে অস্বাভাবিক আচরণ করে বসে। শতাব্দীর এই আচরণের পর তাকে বাবার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে শতাব্দী শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, আর প্যারালাইজড হয়ে যায়। এরমধ্যে একবার সে ব্রেইন স্ট্রোকও করেছিল। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় সে লাইফ সাপোর্ট থেকে বেঁচে এসেছিল। এখন সে পুরোপুরি পঙ্গু। হুইলচেয়ারই তার ভরসা। কথাও ঠিকভাবে বলতে পারে না। কি বলে তা সহজে বোঝা যায় না। তবে সে সবার কথায় বুঝতে পারে।

মাস্টারমশাই শতাব্দীর সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা তাহমিদকে জানালেন। সব শুনে তাহমিদের মনের সব শক্তি যেন ধপ করে নিভে গেলো। এই চার বছর সে এই আশা নিয়ে ছিল, যে তার চন্দ্রিমা সুখে আছে, অথচ সে এতোদিন সম্পূর্ণ মিথ্যে আশায় বেঁচে ছিল। শতাব্দী তাকে ছাড়া কখনোই ভালো ছিল না। তাহমিদ শতাব্দীর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“আমি কি এই হাতটা ছেড়ে দিয়ে খুব ভুল করে ফেলেছিলাম? আমার অনুভূতি তো এই সমাজের কাছে পঙ্গু ছিল। কিন্তু এই সমাজ বিনিময়ে কি দিয়েছে?”

শতাব্দীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মিতুবালা তাহমিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার মেয়ের পছন্দ কখনোই খারাপ ছিল না। শুধু ভুল সমাজে তোমাদের পরিচয় হয়েছিল।”

তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মাস্টারমশাই বললেন,
“চলে যাবে, বাবা?”

“হ্যাঁ, কাল দেশে ফিরবো। ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের জন্য এসেছিলাম। দেশে অনেক সমস্যার মধ্যে আছি। তাদের বিয়েটাও তাড়াহুড়োর মধ্যে হয়েছে।”

“বাকীরা কেমন আছে?”

শ্রীজা হুট করে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
“অরুণিকা কেমন আছে, দাদা?”

তাহমিদ মুচকি হেসে বলল,
“আমি বিকেলে ওকে নিয়ে আবার আসবো। তারপর না হয় ওর সাথেই গল্প করে সব জেনে নেবে। অরুণিকা তোমাদের কথা এখনো বলে। স্পেশালি ওর শতু আপুর কথা!”

শতাব্দীর বুক ফেঁটে কান্না এলো। কিন্তু সে শব্দ করে বলতে পারছে না, যে এতো বছর সে শুধু একনজর তার ছোট সখী, আর তার মিষ্টি মশাইকে দেখার অপেক্ষায় ছিল। তাহমিদ যাওয়ার আগে শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“আমি আবার আসবো।”

তাহমিদ মহল্লা থেকে বেরিয়ে সোজা রিক্সা নিয়ে নিলো। পকেটে একটা সানগ্লাস ছিল, ওইটা চোখে পরে নিলো। পকেট থেকে মাস্ক বের করে ওইটাও মুখে লাগালো। নিজের হাঁটু খামচে ধরে শক্ত হয়ে বসে আছে সে। কোনোভাবে নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়াচ্ছে। অর্ধেক রাস্তায় নেমে রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে সেই গাছের নিচে চলে গেলো, যেখানে সে আগে মিষ্টি বিক্রির পর এসে বসতো, আর তাকে সঙ্গ দিতো শতাব্দী। তাহমিদ গাছের নিচে এসে ধপ করে বসে পড়লো। মুখ থেকে মাস্কটা টেনে ফেলে দিলো। তারপর গলায় আটকে থাকা সব শব্দ যেনো বেরিয়ে এলো। আজ অনেক বছর পর সে শব্দ করে কাঁদছে। মনের সব আক্ষেপ, হতাশা তার ফুঁপিয়ে উঠা শব্দের সাথে আকাশ-বাতাস আন্দোলিত করছে। আজ খোলা হাওয়া তার ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে গেছে। অনেক তো নিজের ভালোবাসাকে সে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেই মনের ভেতর চাপিয়ে রেখেছে, অনেক তো সব অনুভূতিগুলোকে চার দেয়ালের ভেতর আটকে রেখেছিল। আর সব অশ্রুকণা বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়ে দিয়েছে, কখনোবা ওয়াশরুমের কল ছেড়ে দিয়ে আড়াল করেছে। কিন্তু আজ সে আড়াল করতে পারছে না।

পুরুষ মানুষের অশ্রু জমানোর গল্পগুলো অনেক ভারী আর গভীর। এই গভীরতা একবার প্রকাশ পেলে পুরো মুহূর্ত থমকে যায়। ঠিক এই মুহূর্তটাও তাহমিদের জন্য থমকে গেছে। পরিবেশটা আজ এতো বিষণ্ণ, যেন আজ প্রকৃতিও কাঁদতে চাইছে। কিন্তু সব কান্না দৃশ্যমান হয় না। তাহমিদের মনে জমানো আক্ষেপগুলো প্রকৃতি শুষে নিয়েছে। তাই সেও মিনিট সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে হালকা করে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাহমিদ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিলো। এবার সে সামনের রাস্তায় পা বাড়ালো। আর ধীরে ধীরে পায়ের গতি বাড়াতে লাগলো। রোদের তাপে সে যতো দ্রুত সম্ভব হাঁটছে। আজ সবাই এটাই জানবে তার চোখের ক্লান্তি শুধু বহুপথ হেঁটে আসার জন্যই এসেছে, কেউই এটা জানবে না, তার মনটা আজ কি পরিমাণ আঘাত পেয়েছে।

তাহমিদকে দেখে আহনাফ তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“কি রে চোখ-মুখের এই অবস্থা কেন?”

“রাস্তায় জ্যাম ছিল, তাই হেঁটে এসেছি।”

“ডাক্তার তোকে বেশি হাঁটাহাঁটি করতে নিষেধ করেছে, ভুলে গেছিস? হেঁটে এসেছিস কেন? বাইক রাইডার নিয়ে চলে আসতি।”

“বাদ দে, এসেই তো গেছি। আচ্ছা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

এই বলে তাহমিদ ভেতরে চলে গেলো। আর আরাফ তাহমিদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। বিকেলে তাহমিদ অরুণিকাকে বলল,
“চলো, পুরোনো মহল্লা থেকে ঘুরে আসি।”

তাহমিদের কথায় বাকিরাও যাওয়ার আগ্রহ দেখালো। এমনিতে আরাফ কলকাতায় এসে একবার সায়ন্তনীর মা আর ভাইয়ের সাথে দেখা করে এসেছে। সায়ান এখন কলেজে উঠেছে। সে নিজেই টিউশন করিয়ে টাকা আয় করতে পারছে। ভালো একটা বাসাও নিয়েছে। বলা যায়, তারা এখন একপ্রকার ভালোই আছে।

এদিকে বিকেলে সবার সাথে মাওশিয়াতও শতাব্দীদের বাড়িতে গেলো। সে আগে অনেকবার শতাব্দীকে ফোন দিয়েছিল, কিন্তু তাকে ফোনে পাওয়া যায় নি। শতাব্দীর বাড়িতে এসেও তার খোঁজ নিয়েছিল, কিন্তু তারাও কিছু জানায় নি। আর মাওশিয়াতের সাথে শতাব্দীর বাবা-মার তেমন কোনো ভালো যোগাযোগ ছিল না। ইমনদের মাধ্যমেই মাওশিয়াতের সাথে শতাব্দীর পরিচয় হয়েছিল। পারিবারিকভাবে কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিল না, তাই তারা মাওশিয়াতকে শতাব্দীর ব্যাপারে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করে নি।

তারা সবাই শতাব্দীকে দেখে থমকে গেলো। এদিকে আরাফ তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিদের মুখের ভাব স্বাভাবিক দেখে সে সবটা বুঝে নিলো, যে সকালে হেঁটে আসার জন্য তাহমিদকে বিধ্বস্ত দেখায় নি, বরং সে নিজের দুর্বলতা আড়াল করার জন্যই রোদে পুড়ে হেঁটে এসেছে।

এদিকে অরুণিকা শতাব্দীর হাত ধরে বসে আছে। সে কোনোভাবেই শতাব্দীকে ফেলে যাবে না। রাত হয়ে আসছে। কালই তাদের ফ্লাইট। সুরাইয়া, ডুমুর আর বাকী মহিলা প্রতিবেশী যারা অরুণিকাকে ছোট থেকে চিনতো, তারা সবাই অরুণিকাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাইরে আহনাফ আর তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। বাকিরা মহল্লার গলির সামনে চলে এসেছে। আহনাফ বাইরে থেকে বলল,
“অরু, চলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। শতাব্দীর হাত ছেড়ে দিয়ে সে তাহমিদের কাছে এসে হুট করে বলে ফেলল,
“তাহমিদ, তুমি কি আমার শতু আপুকে বিয়ে করবে?”

অরুণিকার কথা যাদের কানে পৌঁছেছে তারা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তাহমিদ তাকিয়ে আছে মাস্টারমশাইয়ের দিকে।

মাস্টারমশাইয়ের এখন অনেক বয়স হয়েছে। চুল পড়ে গেছে। মুখের মধ্যে ক্লান্তি রেখা ফুটে উঠেছে। মাস্টারমশাইয়ের মুখের ভাব দেখেই তাহমিদ বুঝে ফেলেছে, তার সম্মানের কাছে শতাব্দীর অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। সে একজন বাবাকে তার মেয়ের অনুভূতির জন্য হারতে দেবে না। তাহমিদ অরুণিকার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“এটা অসম্ভব। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমাদের অনুশাসন আলাদা। একজনের অনুভূতির জন্য এতো বড় নিয়মের বিশৃঙ্খলা ঘটানো উচিত হবে না।”

তাহমিদ এই কথা বলে বেরিয়ে গেল। অরুণিকা হাত মুঠো করে বলল,
“তোমরা সবাই কঠিন হৃদয়ের মানুষ। তোমাদের মানুষ বলাই উচিত না।”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে নিয়ে নিচে নামলো। অরুণিকা পুরো গাড়িতে কারো সাথে কোনো কথা বলে নি। পুরো রাত সে কেঁদেছে। আর আরাফকে জিজ্ঞেস করেছে, কেন শতাব্দী তার ভাবী হতে পারবে না? আরাফ শুধু চুপ করে বসে ছিল। তাহমিদ যেখানে কোনো উত্তর দিচ্ছে না, সেখানে সে আর কি বলবে? রাত দুইটাই আহনাফ আর আরাফ তাহমিদের খোঁজে ছাদে উঠলো। দেখলো সে আগে থেকেই সেখানে তূর্যের সাথে বসে আছে। তূর্য তাদের দেখে বলল,
“আয়, আয়, সব দেবদাস মিলে একসাথে মিটিং করি।”

তারপর সে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই আপতত দেবদাসের কাতারে পড়ছিস না।”

আহনাফ বলল,
“বিয়ে হলে দেবদাস থেকে প্রমোশন নিয়ে নিবো। আপতত দেবদাসই থাকি। পারুর মনে তো আমার জন্য কোনো জায়গায় নেই। পৃথিবীর সবাইকে নিয়ে সে ভাববে, শুধু আমার শরীরে মরিচা ধরাবে।”

এদিকে আরাফ তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো পরিবেশই তাহমিদকে নাড়া দিচ্ছে না। কেমন যেন জড় পদার্থ হয়ে গেছে। আরাফ এবার তাহমিদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই চাইলে শতাব্দীকে মেনে নিতে পারিস। কারণ ওর বাবা-মা হয়তো এখন এই সম্পর্কে কোনো বাঁধা দেবে না।”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কেন বাঁধা দেবে না?”

তূর্য বলল,
“বাঁধা দেওয়ার মতো কিইবা বাকি আছে? আর তুই যদি এখনো ওকে ভালোবাসিস, এই অবস্থায়ও ওর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিস, তাহলে বসে থাকিস না।”

তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তোদের সবার কাছে এটাই মনে হচ্ছে, শতাব্দী শারীরিকভাবে অসুস্থ তাই ওর বাবা-মা আমার সাথে বিয়ে হলে কোনো অমত করবেন না, তাই তো? শুন, কোনো সন্তান তার বাবা-মার কাছে অসুস্থ হয় না৷ আমি মাস্টারমশাইয়ের চোখে কষ্ট দেখেছি। শতাব্দীকে হারানোর কষ্ট। তার চোখে আমি নিজের ভুল সিদ্ধান্তের অনুশোচনা দেখেছি। আমি একজন বাবাকে আরেকবার হেরে যেতে দেবো না। আমি শতাব্দীকে নিয়ে কি অনুভব করি, এটা আমি কাউকে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নই। কিন্তু ও আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। আর যাকে আমি সুস্থ অবস্থায় কাছে টেনে নিতে পারি নি, তাকে অসুস্থ অবস্থায় বিয়ে করে তাকে সবার সামনে দয়া দেখাতে পারবো না। শতাব্দী আমাকে বিয়ে করলে আমার ধর্ম মেনে নেবে, আর এটা মাস্টারমশাই চান না। কিন্তু এখন হয়তো সমাজের অনেকেই তাকে বলবে, বিয়ে হচ্ছে এটাই অনেক। যেই ধর্মে যাক, কোনো বাঁধা নেই। আমার শতাব্দী এতো অসহায় হয় নি যে তাকে আমি দয়া করে বিয়ে করবো। ওর জন্ম-পরিচয় পরিবর্তন করে দেবো। ও আমার কাছে আগের মতোই থাকবে।”

তূর্য বলল,
“তুই কি করতে চাইছিস তাহলে? শতাব্দীকে একা ফেলে চলে যাবি?”

“আমার ওকে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো অধিকার নেই। আর আমি সেই অধিকার অর্জনের চেষ্টাও করবো না। আমি শুধু এতোটুকু জানি, শতাব্দীর বাবা-মার তাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন আছে, তারা যতোদিন বেঁচে আছে, আমি তাদের স্বপ্ন ধ্বংস করতে পারব না।”

“কেমন স্বপ্ন!”

“ধর, তোর আর উপমার একটা মেয়ে হলো। তোরা আদর দিয়ে মেয়েটাকে বড় করলি, তার বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখলি। মেয়েটা একদিন অন্য ধর্মের এক ছেলেকে ভালোবেসে ফেললো। এটা তুই কখনো মেনে নিতে পারবি না, তূর্য। তোর মেয়ের কোনো ত্রুটি থাকলেও তুই পারবি না। সমাজ তোকে বলবে, বিয়ে দিতে পারলেই মুক্তি। তোর তখন বুকটা ফেঁটে যাবে। এতোটা অসহায় লাগবে, তুই অশ্রু লুকানোর জায়গা পাবি না। এরপর তুই মেয়ের খুশির জন্য যাকে সুস্থ অবস্থায় সেই ছেলের সাথে বিয়ে দিস নি, তাকে অসুস্থ অবস্থায় সেই ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সমাজের কাছে হেরে যাবি। একজন বাবা এই হার নিয়ে কখনোই শান্তিতে বাঁচতে পারবে না। কারণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে ধর্ম। আর মাস্টারমশাইও এটাই চান, তার মেয়ে তার ধর্ম নিয়েই মরুক। এটা উনার অধিকার। যতোদিন উনারা বেঁচে আছেন, এই কষ্টটা নিয়ে আমি ওদের মরতে দেবো না। আমি পারবো না এটা।”

আহনাফ বলল,
“তাহলে তুই শতাব্দীকে এই অবস্থায় রেখে দেশে যেতে পারবি?”

তাহমিদ উত্তরে মলিন হাসলো। তার কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।

পরেরদিন তারা ছ’জন এয়ারপোর্টে চলে এলো। মাওশিয়াত ওর বাবা-মার সাথে আলাদাভাবে আসছে। পুরো রাস্তা মেয়েটা কেঁদেকেটে অস্থির। বিয়ে করে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে, তাও আবার ভিনদেশে। কান্না করাটাই তো স্বাভাবিক। যখন তখন ছুটে আসার সুযোগ তো আর পাবে না।

তারা সব ফর্মালিটি পূরণ করতেই দেখলো মাস্টারমশাই আর মিতু বালা শতাব্দীকে নিয়ে এয়ারপোর্টে এসেছেন। অরুণিকা শতাব্দীকে দেখে দৌঁড়ে গেলো। তাহমিদ মাস্টারমশাইকে দেখে অবাক হলো। বাকিরাও যথেষ্ট অবাক হয়েছে। তার হাতে একটা লাগেজও আছে। মূলত লাগেজ দেখেই সবার এতো অবাক হওয়া। অরুণিকা শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“শতু আপু, তোমাকেও আমি আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু দেখো, সবাই চুপ করে আছে। সবাই এক একটা গাছ। সব বুঝে কিন্তু কোনো নড়ন নেই৷ এরা সবাই পাথর।”

মাস্টারমশাই অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“এই বাবাটা এতোটাও পাথর নয় যে তার মেয়েদের কষ্ট বুঝবে না। আমি আমার মেয়েকে তার ছোট সখীর কাছ থেকে আলাদা করতে পারবো না।”

তাহমিদ ধীর পায়ে মাস্টারমশাইয়ের দিকে এগিয়ে এলো। মাস্টার মশাই তাহমিদের সামনে হাত জোড় করে বললেন,
“আমি হেরে গেছি, বাবা। আমার শতাব্দীকে কি নিয়ে যাবে তোমার সাথে?”

তাহমিদ মাস্টারমশাইয়ের হাত ধরে বলল,
“এভাবে বলবেন না, মাস্টারমশাই। এভাবে কেন বলছেন আপনি?”

মিতু বালা বললেন,
“মেয়েটা তোমাদের দেখে কতো বছর পর হেসেছে! আমার মেয়েটা তো কথা বলতে পারে না। ও তো ওর মনের কথাগুলো আমাদের জানাতে পারছে না। কিন্তু ওর চোখগুলো সব বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা তো অসহায় হয়ে গেছি। মেয়ের খুশির জন্য আমরা সব করতে পারবো। সব মেনে নেবো। ওকে কি তোমাদের সাথে নিয়ে যাবে? কোনো দাবী থাকবে না, কোনো সম্পর্ক থাকবে না, শুধু শান্তিতে বলবো, মেয়েটা ভালোই আছে তার প্রিয় মানুষগুলোর সাথে।”

তাহমিদ এবার হাঁটু গেড়ে শতাব্দীর সামনে বসলো। তারপর তার হাত ধরে মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“শতাব্দী আপনাদের মেয়ে। ওর খুশির জন্য আপনারা সব পারছেন, আমি কি আপনাদের খুশির জন্য একটা দায়িত্ব নিতে পারবো না? আমার কাছে আপনারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। যখন আমাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না, তখন আপনারা আমাদের হাত ধরেছেন। আমাদের স্কুলের ভর্তি, আমাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা, আমাদের বিপদ-আপদ, অরুণিকার কেইস, আমার এক্সিডেন্ট, সব ব্যাপারে আপনারা আমাদের পাশে ছিলেন। অনেক কাছের মানুষও এতো কিছু করে না। আর আমি তো আপনাদের কাছের মানুষ মনে করি।”

তাহমিদ মাস্টারমশাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমি শতাব্দীকে আমার বন্ধুর জায়গাটা দিতে চাই। অরুণিকার শতু আপুকে ওর সখী করেই নিয়ে যেতে চাই। আপনারা যখন চাইবেন শতাব্দীকে দেখতে আসবেন। শতাব্দীকে নিয়েও যেতে পারবেন। কোনো দাবি-দাওয়া থাকবে না।”

অরুণিকা শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“আমার শতু আপু তার ছোট সখীর সাথে থাকবে। আপু জানো, আমার রুমটা অনেক বড়। আমরা দু’জন একসাথে সেখানে থাকবো। আমি তোমার অনেক যত্ন নেবো। তুমি ছোটবেলায় যেভাবে আমার খেয়াল রেখেছো, ঠিক সেভাবেই আমি তোমার খেয়াল রাখবো। দেখবে, তুমি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে।”

তাহমিদ এবার শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“সব সম্পর্কের নাম হয় না। কিছু সম্পর্ক নাম ছাড়াও অনেক সুন্দর হয়। আর তা গভীরভাবে মনে লালন করতে জানতে হয়। প্রয়োজন শুধু একটু সম্মান আর ভালোবাসার। আমি শতাব্দীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ধর্ম-অনুশাসন, আদর্শ সবকিছুকে অনেক সম্মান করি। আমাদের সমাজে অনেক সম্পর্কের নাম আছে। কিন্তু সেই সম্পর্কে কোনো সম্মান নেই। আর যেখানে সম্মান থাকে, সেখানে আর কিছুর প্রয়োজন হয় না। বাকি সব শৃঙ্খল এমনিতেই সৃষ্টি হয়ে যায়। আমি বা আমরা কেউই আমাদের সীমালঙ্ঘন করবো না। আমরা অরুণিকার দায়িত্বটা যেভাবে পালন করেছি, কোনো নাম ছাড়া, কোনো সম্পর্ক ছাড়া, ঠিক সেভাবেই শতাব্দীর দায়িত্বটা আমি নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ওর সন্তুষ্টি যদি আমাদের সাথে থাকায় হয়, তাহলে সেটাই হবে। কিন্তু বরাবরই ওর সব বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার বাবা-মার হাতেই থাকবে।”

মাওশিয়াত মুচকি হেসে শতাব্দীর পাশে বসে বলল,
“আসলেই অরুণিকা একটা দায়িত্বের নাম। একটা ছোট্ট অরুণিকা তার ছ’জন পুরুষকে এতো বড় করে তুলেছে যে তারা সব পরিস্থিতির জন্য এখন প্রস্তুত। তারা সব শৃঙ্খলের ঊর্ধ্বে। আর তা একমাত্র অরুণিকার দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। আজ তার ছয় পুরুষ তার জন্যই মানসিকভাবে শক্ত হয়েছে। নিজেদের সংযমী রাখতে শিখেছে।”

অরুণিকা হেসে বলল,
“হুম, আমি আছি বলেই তো এতোকিছু সম্ভব হয়েছে। আমি মানুষটাই খুব স্পেশাল।”

আহনাফ তূর্যের কানে ফিসফিস করে বলল,
“সবকিছুই স্পেশাল, কিন্তু বুদ্ধিটাই…”

তূর্য আহনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“মরিচাধরা।”

আহনাফ আর তূর্য উভয়ে মাথা নেড়ে একে-অপরের মতকে সম্মতি দিলো৷ অরুণিকা বাঁকা চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ যে তাকে নিয়েই কিছু বলছে তা সে বুঝতে পেরেছে। সে মনে মনে বলল,
“আগে বাসায় চলো, তারপর বুঝবে অবহেলা কাকে বলে! কতো প্রকার ও কি কি? হুহ।”

টিকেট না পাওয়ায় শতাব্দী বাকীদের সাথে বাংলাদেশে যেতে পারলো না। পরের টিকেটের জন্য তাহমিদ নিজেও তার টিকেট ক্যান্সল করলো। অরুণিকাও শতাব্দীর সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলো। কিন্তু মাওশিয়াতকেও তো বরণ করে নিতে হবে। বাসায় অরুণিকা ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই। উপমাও তো বাবার বাড়ি চলে গেছে। তাই অরুণিকা বাধ্য হয়ে চলে গেলো। এদিকে আরো সাত ঘন্টা পর আরেকটা ফ্লাইট। তাহমিদ সেই সময়টা কাটানোর জন্য শতাব্দীকে নিয়ে আবার মহল্লায় ফিরলো। শ্রীজা বোনকে দেখে অনেক খুশি হলো। চার ঘন্টা সে বোনের পাশে বসে বসে গল্প করলো। তাহমিদ পুরো সময়টা দুই বোনের গল্প দেখে কাটিয়ে দিলো। এক ঘন্টা হাতে নিয়ে তারা আবার এয়ারপোর্টে এলো। এবার মাস্টারমশাই, মিতু বালা আর শ্রীজাও সাথে এসেছে। শ্রীজা যাওয়ার আগে তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“দাদা, আমার দিদিকে তোমার ভরসায় পাঠাচ্ছি কিন্তু।”

তাহমিদ মুচকি হেসে বলল,
“ইনশাআল্লাহ, আমি তোমার ভরসা রক্ষা করবো।”

শতাব্দীকে সিটে বসানো হলো। সে হাতটা নাড়াতে পারছে না। কিন্তু তার খুব ইচ্ছে করছে তাহমিদের হাতটা ধরতে। তার মনের ভাষাগুলোও তো ধ্বনি খুঁজে পাচ্ছে না। তাহলে তা তাহমিদের কাছে কিভাবে পৌঁছাবে? তবে কিছু মনের ভাব ভাষাকেও হার মানিয়ে ফেলে, তাই হয়তো কোনো আবদার না শুনেই তাহমিদ নিজের আর শতাব্দীর সিট বেল্ট বেঁধে দেওয়ার পর তার হাতটি ধরলো। শতাব্দীর চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তাহমিদ তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“আমরা প্রতিদিন ভিডিও কলে বাবা-মার সাথে কথা বলবো। লম্বা ছুটি পেলে কলকাতায় আসবো। মাওশিয়াতও তোমার সাথে মাঝে মাঝেই আসবে। দু’টো আলাদা দেশ, তবুও মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ। তুমি শুধু ধৈর্য ধরবে, তখন এই কয়েক ঘন্টার পথও কম মনে হবে।”

শতাব্দী মনে মনে বলল,
“মিষ্টি মশাই, তোমাকে কবে যে আবার এই নামে ডাকবো! তুমি এতো মিষ্টি কেন বলো না, মিষ্টি মশাই? তুমি সারাজীবন আমার মিষ্টি মশাই হয়েই থাকবে।”

এদিকে আজ উপমার চাকরির প্রথম দিন। সে ভালো একটা কোম্পানিতে বসের পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দিয়েছে৷ প্রথম দিন তাই আলাদা উত্তেজনা কাজ করছে। একটু ভয়ও লাগছে। সে ভেতরে ঢুকতেই একজন পিয়ন তাকে তার ডেস্কে বসিয়ে দিলো। সে ভালোভাবে ডেস্কের উপর রাখা ফাইলগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলো। তখনই পেছন থেকে একজন বয়ষ্ক লোক এসে বলল,
“তুমি বসের কেবিনে যাও। তোমাকে কি করতে হবে, সে-ই বলবে।”

উপমা উঠে পেছন ফিরে বয়ষ্ক লোকটাকে দেখে সালাম দিয়ে মাথা নেড়ে বসের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। কেবিনের সামনে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে শব্দ এলো,
“আসতে পারো।”

উপমা অবাক হয়ে ভাবলো,
“দরজায় কড়া নাড়লাম না, তবুও কিভাবে বুঝলো?”

সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো দরজার বাইরে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সে সেটির দিকে তাকাতে তাকাতে দরজা খুললো। দরজা খুলেই সামনে বসা মানুষটিকে দেখে সে বলে উঠল,
“আপনি?”

রিয়াজুর রহমান মুচকি হেসে বললেন,
“আমার কোম্পানি, আমি থাকবো না?”

উপমা শক্ত মুখে ভেতরে ঢুকে বলল,
“আপনি সেদিন রাতে খাবার নিয়ে বাসায় গেছেন, আর আজ আমাকে চাকরি দিয়েছেন? কেন? তূর্য আহমেদ আপনাকে বলেছে আমাকে কাজ দিতে? এখন তাহলে আমাকে কনভিন্স করার জন্য সে এই পথ খুঁজে নিয়েছে!”

রিয়াজুর রহমান ভ্রূ কুঁচকে উপমার দিকে তাকালো। সে উপমার কথার কোনো অর্থই বুঝলো না। তবে এতোটুকু বুঝেছে হয়তো উপমা আর তূর্যের সম্পর্কে কোনো ঝামেলা চলছে। রিয়াজুর রহমান মুচকি হেসে উত্তর দিলেন,
“অন্যদেরটা তো জানি না। তবে আমার আপনাকে কনভিন্স কর‍তে অনেক ভালো লাগে।”

উপমা ভ্রূ কুঁচকে রিয়াজুর রহমানের দিকে তাকালো। এরপর সে আর কিছু বললো না। চুপচাপ কাজ বুঝে নিয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে এলো৷ এদিকে রিয়াজুর রহমানকে আনমনে হাসতে দেখে নিয়াজ হোসেন বললেন,
“আল্লাহর কাছে তোর হেদায়েতের জন্য দোয়া করেছিলাম। কিন্তু কথায় আছে না, হেদায়েতের মালিক আল্লাহ। যাকে দিতে চান না, তার কপালে কিছু নেই।”

রিয়াজুর রহমান বিরক্ত মুখে বললেন,
“মনটা ডিস্ট্রেক্ট করছিস কেন? আমি একটা জিনিস ভাবছি, আমাকে শান্তিতে ভাবতে দে।”

“দেখ, রিয়াজ, প্রথমত মেয়েটা বিবাহিত, দ্বিতীয়ত মেয়েটা তোর মৃত বন্ধুর ছেলের বউ। তৃতীয়ত তোর অর্ধেক বয়সী। এটা অসম্ভব।”

“অসম্ভব। তো?”

“তো! এই সম্পর্ক কখনোই সম্ভব না। কি উল্টাপাল্টা চিন্তা করছিস, হ্যাঁ?”

“দেখ, ও যদি আমার হতে না চাই, আমি ওকে জোর করবো না। ওর যার সাথে ইচ্ছে সংসার করুক। কিন্তু আমার ওকে দেখতে ভালো লাগে। আমি দেখবোই।”

কথাটি বলেই রিয়াজুর রহমান বাঁকা হেসে আবার বললেন,
“অনেক পুরোনো হিসেব জমে আছে। নতুন খাতায় এই নতুন হিসেবের নামটা উঠিয়ে নিস। এতোদিন মাঠে ছিল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, এবার নেমেছে নতুন খেলোয়াড়। মাঠ যাতে পরিষ্কার থাকে। কারণ আমি প্রথম ব্যাটেই আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে আউট করে দিবো।”

(আগামী পর্বে আরেকটা থ্রিলড অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। আর কয়েক পর্ব শুধু, অরুণিকার শেষ অংশ আসবে খুব শীঘ্রই।)

চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here