#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬৮||
১১১.
অরুণিকা ইমানের দেওয়া ঠিকানায় যাওয়ার পর ইমান তাকে নিয়ে একটা গাড়িতে উঠলো। ইমান গাড়িতে উঠে স্থির দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি আমাকে এভাবে দেখছেন কেন?”
ইমান মাথা নেড়ে বলল,
“না, কিছু না। এমনতেই। আচ্ছা, তুমি তো বললে আরবান তালুকদারকে নিয়ে ছ’জনেরই অনেক সন্দেহ। তাহলে ওদের তো এই বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। কিন্তু ওরা আরবান তালুকদারকে বাসায় রেখেছে, এটা অদ্ভুত না?”
“আমিও এটাই বুঝতে পারছি না। আমার না আহনাফের জন্যই ভয় লাগছে। ওর যদি কিছু হয়ে যায়? তাই আমি ওকে প্রটেক্ট করার জন্য তোমার সাহায্য নিচ্ছি। আমি যদি আরবান মামার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাই, তাহলে ওদের দেখিয়ে উনাকে ঘর থেকে বের করে দেবো।”
তারা দু’জন কিছুক্ষণের মধ্যে একটা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে নামলো। অরুণিকা বাড়িটির চারপাশে তাকিয়ে বলল,
“এই বাড়িটা তো পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে। আশেপাশে তো কেউ নেই। তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছো?”
ইমান গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“রিল্যাক্স, অরুণিকা। এটা আরবান তালুকদারের পুরোনো ঘর। ভেতরে চলো, তুমি সব তথ্য পাবে।”
অরুণিকা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“তুমি এই ঘর সম্পর্কে কিভাবে জানলে?”
ইমান হেসে বলল,
“এটা সিক্রেট থাকাই ভালো। আর আমি গোয়ান্দা সংস্থাতে কাজ করি। তাই এসব কাজে আমি এক্সপার্ট।”
ইমান আর অরুণিকা বাড়িটিতে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠলো। নিচ তলায় দু’টি খালি ঘর ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় তলায় খুব সুন্দর পরিচ্ছন্ন একটা লাইব্রেরি আছে। দেখে মনে হচ্ছে, এখানে রোজ কারো আসা-যাওয়া আছে। অরুণিকা বলল,
“আরবান মামা যদি জানতে পারে, আমরা এখানে এসেছি?”
“জানতে পারতো। বাড়ির সামনে সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিল। কিন্তু এখন জানতে পারবে না। কারণ ক্যামেরাটা বন্ধ।”
“কিভাবে বন্ধ হলো?”
“বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছি।”
“তবুও যদি আরবান মামা বুঝতে পারে?”
“বুঝলেও সমস্যা নেই। ভেতরে ঢুকার কয়েক ঘন্টা পরই হয়তো বুঝবে। আর ততোক্ষণে আমরা সব জেনে নেবো। উনি ভালো হলে, আমাদের কিছু করবেন না। অপরাধী হলে, আমাদের মারতে আসবেন। আর আমি আগে থেকেই আমার লোকেদের বলে দিয়েছি। উনি কিছু করতে আসলেই উনাকে আটকে ফেলবো। এরপর সোজা থানায় নিয়ে যাবো।”
তারা লাইব্রেরিতে ঢুকতেই দরজাটা জোরে শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেলো। অরুণিকা ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। ইমান দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কোনোভাবেই দরজাটা খুলছে না। ইমান অরুণিকার ভীত চেহারা দেখে তার হাত ধরে বলল,
“যা করার আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে। আই থিংক, লাইব্রেরীর দরজাটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।”
তারা পুরো লাইব্রেরী তন্নতন্ন করে খুঁজলো। অনেকক্ষণ পর ইমান লাইব্রেরির শেষ মাথার একটি তাকের পেছনের দিকে বড় একটা চাবি দেখতে পেলো। ইমান চাবিটা হাতে নিয়ে আশেপাশের জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো চাবিটা কিসের। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো বইয়ের আলমারীগুলোর দিকে। পুরো ঘরে তিনটা আলমারী ছিল। ইমান তিনটা আলমারীই খুললো। কিন্তু কোনো তালা দেওয়া ড্রয়ার পেলো না। হঠাৎ সে দেখলো, চাবিটির রিংটা কেমন যেন ঢেউ খেলানো। দেখে মনে হচ্ছে কোনো বাটন। আর সেই বাটনে চাপ দিতেই কিছু একটা দেখবে। সে সাহস নিয়ে বাটনটিতে চাপ দিলো। কিন্তু কিছু হলো না। অরুণিকা চাবিটি হাতে নিয়ে বলল,
“হয়তো সব জায়গায় এটা কাজ করবে না। টিভির রিমোট যেমন টিভির সামনে আনলে চালু হয়, এটাও হয়তো ওভাবেই কাজ করবে।”
ইমান মাথা নেড়ে পুরো লাইব্রেরির এক এক জায়গায় তাক করে বাটনটি চাপলো। তখনই ইমান দেয়ালে একটা পেইন্টিং দেখলো। পেইন্টিংটার কাছে যেতেই অরুণিকা ইমানের চোখ অনুসরণ করে পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটা তো আমাদের বাগান বাড়ি।”
ইমান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কোন বাগান বাড়ি?”
“মৈত্রী ম্যানশনের বাগান বাড়ি। আমার কাছে এই জায়গাটার ছবি আছে। আরাফ পুরোনো ছবিগুলো এলবামে রেখেছিল, ওখানেই দেখেছি। ওখানে দাঁড়িয়েই আমরা সবাই ছবি উঠিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স দুই ছিল।”
ইমান ছবিটির দিকে ইশারা করে বলল,
“এই জায়গার পেইন্টিং এখানে কি করছে? আর ছবির মেয়ে দু’টি কে?”
অরুণিকা ভালোভাবে দেখে বলল,
“ডান পাশেরটাকে তো কখনো দেখি নি। কিন্তু বাম পাশেরটাকে চিনি। উনি আমার বড় মা। আরাফের আম্মু। আরাফের যখন তিন বছর বয়স ছিল, তখন উনি মারা গিয়েছিলেন।”
“ওহ, আরবান তালুকদার তো আরাফ ভাইয়ার মামা, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“হয়তো উনি বোনের ছবি পেইন্ট করে রেখেছেন।”
ইমান কি মনে করে ছবিটি সরালো। আর পেছনে একটা স্টেইনলেস স্টিলের দেয়াল দেখলো। ইমান এবার বাটনটি চাপ দিতেই দেয়ালটি নিচে নেমে গেলো। এটা দেখে অরুণিকা আর ইমান একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো৷ ছোট একটা বক্সের মতো জায়গায় কিছু কাগজপত্র রাখা আছে। ইমান সবগুলো কাগজ বের করে একটা টেবিলের উপর রাখলো। ইমান আর অরুণিকা একটার পর একটা কাগজ দেখছে, আর অবাক হচ্ছে। কাগজগুলোর মধ্যে তারা একটা চিঠিও পেয়েছিল। হাতে নিয়ে দেখলো আরবান তালুকদারকে সম্বোধন করে তন্নী চিঠিটি লিখেছে। ইমান পুরো চিঠি পড়ে বলল,
“এবার আমি সব বুঝতে পেরেছি।”
“কি বুঝেছো?”
“আরবান তালুকদারই হয়তো তোমাদের পরিবারকে খুন করিয়েছে। তন্নী আন্টির চিঠিতে স্পষ্ট লেখা আছে, তিনি মানসিকভাবে ভালো ছিলেন না। তাই তার ভাইয়ের কাছে সাহায্য চাইছিলেন। চিঠি দেখলেই মনে হবে তার শ্বশুড় বাড়ির লোকেরা তার উপর মানসিক নির্যাতন করেছে।”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল,
“আমার পরিবারের সবাই অনেক ভালো। আরাফ বলেছিল আমাকে। সবাই ভালো ছিল।”
“হয়তো এই ব্যাপারে আরাফ ভাইয়া আরো ভালো বলতে পারবেন। কারণ তোমাদের পরিবারের যখন খুন হয়েছিল, তখন তাদের অনেক বুদ্ধি হয়েছিল।”
ইমান আবারও বক্সের ভেতরে ভালোভাবে দেখতে লাগলো। হঠাৎ তার হাতে কিছু আটকে গেলো। সে হাতড়াতে হাতড়াতে বস্তুটি বক্স থেকে বের করে দেখলো একটা কালো কোট। অরুণিকা সাথে সাথে কোটটি হাতে নিয়ে বলল,
“এই কোটটা আমি দেখেছিলাম।”
“কোথায় দেখেছো?”
অরুণিকা চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তার কিছুই মনে পড়ছে না। সে কোটটি হাতড়াতে লাগলো। আর তখনই সে কোটের পকেটের ভেতর একটি পিস্তল দেখতে পেলো। অরুণিকা পিস্তলটি দেখে চমকে উঠলো। ইমান বলল,
“কি ভাবছো, অরুণিকা?”
“এই কোটটি পরেই একটা মুখোশ পরা লোক বাড়িতে ঢুকে বড় বাবার উপর গুলি চালিয়েছিল। এই রঙের পিস্তল ছিল। এরপর বাবা আমাকে…”
“তখন তো তোমার বয়স চার বছর ছিল। তুমি শিউর হলে কিভাবে?”
“আমি জানি না। মাঝে মাঝেই এই দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। চারপাশে আগুন, গোলাগুলির শব্দ, রক্ত, চিৎকারের আওয়াজ।”
অরুণিকার চোখটা ছলছল করে উঠলো। সে ইমানের হাত ধরে বলল,
“উনিই আমার বাবা-মাকে মেরেছেন? উনি নিজ হাতে সবাইকে হত্যা করেছেন?”
“আমি এটা বুঝতে পারছি না, অরুণিকা। এতো আগের কথা তোমার এখনো কিভাবে মনে আছে?”
অরুণিকা কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,
“আমি জানি না। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আর আমি এই দৃশ্যটা ছোটবেলা থেকেই স্বপ্নে দেখি। জানো, আমার রাতে একা ঘুমাতে ভয় করতো। আরাফ আমার পাশে না বসলে আমার ঘুমই আসতো না। আমি যখন একটু বড় হতে থাকি, ওরা আমাকে আলাদা রুম দিয়েছিল। আমি কখনো সেই রুমের দরজা বন্ধ করে ঘুমাতাম না। রুমের দরজার বাইরে থেকে আরাফের বেড দেখা যেতো। ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই ঘুমাতাম। আমি অনেক ভয় পেতাম, জানো?”
“ওকে রিল্যাক্স, অরুণিকা। এখন এই ক্লু গুলো আমাদের খুব প্রয়োজন।”
ইমান তার ব্যাগের মধ্যে সব প্রমাণ নিয়ে আবার দরজার কাছে গেলো। কিন্তু কোনোভাবেই সে দরজাটা খুলতে পারছে না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে, সে তার সহকর্মীকে এই ব্যাপারে জানালো। এরপর অরুণিকাকে আশ্বস্ত করলো, কিছুক্ষণ পর তারা বেরুতে পারবে। তারা একটা বইয়ের শেল্ফে হেলান দিয়ে নিচে বসলো। অনেকক্ষণ দু’জনই নিঃশব্দে বসে ছিল। হঠাৎ অরুণিকা বলল,
“আচ্ছা, তুমি তো আগে আরাফদের সাথেই কাজ করতে। এখন করছো না কেন?”
ইমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ, আমি আদিল ভাইয়ার মৃত্যুর আগে ওদের আন্ডারেই কাজ করতাম। এরপরও কয়েকদিন কাজ করেছি। কিন্তু ধীরে ধীরে মনে হলো, আরাফ ভাইয়ারা আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।”
অরুণিকা ইমানের কথায় কিছুটা অবাক হলো। সে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি কি এমন কিছু করেছো?”
ইমান মলিন মুখে বললো,
“না, শুধু ভালো থাকার চেষ্টা করেছি। তবুও ভালো কিছু আমার সাথে থাকতে চায় না। যেমন ধরো তুমি। ভালোবাসা চেয়েছি, ভালোবাসার মানুষকেও দেখেছি, কিন্তু সেই ভালোবাসা নিজের করে নিতে পারি নি। আর তাই তুমি এখন অন্য কারো।”
অরুণিকা নিচের দিকে তাকালো। মলিন হেসে বললো,
“হয়তো এটাই ভাগ্যে ছিলো।”
ইমান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তুমি কি আমাকে এখনো ভালোবাসো, অরুণিকা?”
“জানি না। কিন্তু আমার কাছে আরাফ, আহনাফ, তাহমিদ, রকস্টার, ইমন আর ইভান, এরাই ভালোবাসার মানুষ। ভালোবাসা কি শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যেই হয়? ভালো তো একজন মানুষকেও বাসা যায়। নামহীন, সম্পর্কহীন অস্তিত্বকেও ভালোবাসা যায়। যেমন আমি ভালোবাসি আমার ছ’পুরুষকে। ওরা আমার ভাই না। ওদের সাথে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। তবুও ওদের ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগে না। জানো, রকস্টার কি বলতো?”
ইমান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“রকস্টার মানে তূর্য ভাই?”
“হ্যাঁ। ও বলতো সবার ফ্যামিলি আছে। আর আমাদের বন্ধু আছে। আমাদের একটা ছোট্ট ব্যাচেলর সংসার আছে। আমরা যখন কলকাতায় ছিলাম, তখন সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করতো, বাসায় কে কে আছে। আমি বলতাম আমার বাবা, মা, টিচার, ভাই, বন্ধু, কাজিন সবাই আছে। স্কুলে প্যারেন্টস ডাকালে, আরাফ আর তাহমিদ আমার বাবা-মা হয়ে যেতো। প্রথম প্রথম সবাই অনেক অবাক হতো। কিন্তু আমার অনেক ভালো লাগতো। ক্লাসের সব মেয়েরা আমার আলাদা কেয়ার করতো। কারণ ওরা ইভানকে অনেক ভয় পেতো। আর ওরা সবাই জানতো ইভান আমার হোম টিচার। ইমন আমার ভাই, আর রকস্টার আমার বন্ধু। আর আহনাফকে আমি কাজিন হিসেবেই পরিচয় দিয়েছি। কিন্তু ও আমার কাজিন কম শত্রু বেশি ছিল। ছ’জনের মধ্যে ওই আমাকে অনর্থক বকতো, আমার সাথে ঝগড়া করতো। তবে ভালোও বাসতো। ঘুরতে নিয়ে যেতো, চকোলেট কিনে দিতো। ওরা সবাই অনেক ভালো। স্পেশালি আহনাফ, যদিও ও একটু রাগী, কিন্তু মনের দিক থেকে একদম বিড়াল ছানা। জানো, ওর সাথে থাকলে আমার নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে হয়।”
কথাগুলো বলেই অরুণিকা আনমনে হাসলো। ছ’জনের কথা উঠতে ওর চোখে-মুখে যতোটা না আনন্দ ছিল, তার চেয়ে বেশি ঔজ্জ্বল্যতা আহনাফের কথা উঠতেই দেখা যাচ্ছে। ইমান মলিন হাসলো। সে মনে মনে বললো,
“তুমি অবচেতন মনেই আহনাফকে তোমার ভালোবাসার জায়গাটা দিয়ে দিচ্ছো, অরু। তুমি ধীরে ধীরে আমার নামটা তোমার মন থেকে মুছে ফেলছো।”
এরপর ইমান হুট করে অরুণিকার হাতটা ধরলো। অরুণিকা চমকে উঠে ইমানের দিকে তাকালো। ইমান ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“একটা গল্প শুনবে, অরুণিকা?”
অরুণিকা অবাক কন্ঠে বলল, “গল্প? এখন?”
“হুম, এখন। আজ তোমাকে একটা অদ্ভুত গল্প শোনাবো।”
অরুণিকা মিনমিনিয়ে বলল, “অদ্ভুত গল্প?”
ইমান বলতে লাগলো,
“একটা রাজ্যে দু’টো ভিন্ন প্রজাতির পাখি ছিল। যদিও পাখিগুলো দেখতে একই রকমের ছিল, কিন্তু সেই রাজ্যে তাদের আলাদা নাম দেওয়া হয়েছিল। একটা প্রজাতির নাম ছিল ময়ূর, আরেকটা প্রজাতির নাম ছিল কাক। দু’টি প্রজাতির মধ্যে ঘোর বিরোধ ছিল। একদিন কাক প্রজাতির পাখিটি উড়ে এসে ময়ূরের কক্ষে আটকে গেলো। এরপর তাদের বন্ধুত্ব হলো। ময়ূর আর কাক প্রেমে পড়ে গেলো। ময়ূর জানতোই না তার প্রেমিক পাখিটি কাক প্রজাতির। কিন্তু কাক পাখিটি তা জানতো। সে চাইতো ময়ূরকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। চাইতো প্রজাতির নামটাই মুছে দিতে। কিন্তু তার হাতে কিছুই ছিল না।”
ইমান থেমে গেলে। অরুণিকা আগ্রহী কন্ঠে বলল,
“কাক পাখিটি তো ময়ূর পাখিটিকে জানাতে পারতো। জানালে হয়তো সব ঠিক হয়ে যেতো।”
ইমান মলিন মুখে বললো,
“সব পরিচয় প্রকাশ করা যায় না।”
“ও, তারপর কি হলো?”
“কি আর হবে। কাক তার ময়ূরীকে হারিয়ে ফেললো। আর চিরজীবন একাই রয়ে গেলো।”
“ময়ূর পাখিটি কি করলো?”
“ময়ূরী বিয়ে করলো, আর কাক পাখিটিকে ভুলে গেলো। ময়ূরের ভালোবাসা একদম ঠুনকো ছিল। আজ আছে, তো কাল নেই।”
অরুণিকা ইমানের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো। ইমান অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“সব ময়ূরীই দিনশেষে স্বামীকেই ভালোবাসে। পুরোনো ভালোবাসা তাদের মস্তিষ্কে আর থাকে না।”
১১২.
কেটে গেলো ছয় ঘন্টা। ছয় ঘন্টা পর দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ইমান চোখ খুললো। দরজার ওপাশে আহনাফকে দেখে সে চমকে উঠলো। আহনাফ দরজার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইমান তার কোলের উপর ঘুমিয়ে থাকা অরুণিকার দিকে এক নজর তাকালো, তারপর আবার আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ হাত মুঠো করে ঘরটিতে ঢুকতেই দেখলে পেছনে আরবান তালুকদার দাঁড়িয়ে আছেন। আহনাফ ভেতরে ঢুকেই অরুণিকাকে টেনে উঠালো। অরুণিকা চোখ খুলে আহনাফকে দেখে বলল,
“আহনাফ, তুমি?”
আহনাফ অরুণিকাকে দাঁড় করিয়ে অরুণিকার গালে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিলো। ইমান আহনাফকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনি যেটা ভাবছেন, এমন কিছুই না।”
আহনাফ উঁচু গলায় বলল,
“চুপ। একদম চুপ।”
তারপর অরুণিকার হাত ধরে একপাশে টেনে এনে বলল,
“বাসার সবাই তোমাকে পাঁচ-ছ’ঘন্টা ধরে খুঁজছে। আর তুমি এখানে? এই ছেলের সাথে! কেন অরু?”
আহনাফের হাত কাঁপছে। তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। আহনাফ তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ইমানের দিকে এগিয়ে এসে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। অরুণিকা ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে আরবান তালুকদারের দিকে তাকালো। আরবান তালুকদার সাথে সাথেই ঘটনা আরো অস্বাভাবিক করার জন্য বলে উঠলেন,
“আমি তো আগেও এদের দু’জনকে একসাথে দেখেছি। তাই আমি চাই নি তোমাদের বিয়ে হোক। অরুণিকা তো ইমানকে ভালোবাসে। তোমাকে তো ভালোই বাসে না। তাহলে শুধু শুধু ওকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে গেলে কেন? সাথে এদের দু’জনের জীবনটাও নষ্ট করে দিলে। এখন তো সব দেখলে কিভাবে তোমার বউ তোমার সম্মান ডুবিয়ে দিলো! এখানে পড়ে পড়ে পরপুরুষের সাথে ঘুমাচ্ছে।”
আহনাফ হঠাৎ আরবান তালুকদারের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“চুপ। একদম চুপ। আপনাকে আমি এই বিষয়ে কথা বলার কোনো অধিকার দেই নি।”
ইমান ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আহনাফ ভাই, আমরা এখানে এসে আটকে গিয়েছিলাম। প্রায় কয়েক ঘন্টা এখানেই বসে আছি। তারপর অরুণিকা নিচে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি শুধু ওর মাথাটা আমার কোলে রেখেছিলাম। ও তো কিছু জানতোই না। ও ঘুমিয়ে গিয়েছিল।”
আহনাফের চোখ দু’টো রাগে লাল হয়ে গেছে। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই সে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখটা মুছে নিলো। আহনাফ অরুণিকার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। তারপর তাকে টেনে নিয়ে গেলো। ইমানও তাদের পিছু নেওয়ার আগে আরবান তালুকদার পেছন থেকে বলে উঠলেন,
“ইমান, তুমি এখানে এসে ভুল করেছো।”
ইমান পেছনে না ফিরে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“এতোদিন ভুল করেছিলাম, এবার সব ঠিক করবো।”
“তুমি অরুণিকাকে ভালোবাসো। ওকে কি নিজের করে পেতে চাও না?”
ইমান মলিন হেসে মনে মনে বলল,
“ময়ূরী তার কাক পাখিটাকে কখনোই ভালোবাসে নি। সবই তার মোহ ছিল। আর সেই মোহ এখন কেটে গেছে। কারণ ময়ূরী অন্য কারো মায়ায় আটকে আছে। আর আমি ওর মায়ার বাঁধন ছিন্ন করবো না। আমি এতোটাও স্বার্থপর নই।”
আহনাফ গাড়িতে উঠেই আরাফকে ফোন করে বলল অরুণিকাকে পাওয়া গেছে। আরবান তালুকদারই আহনাফকে এখানে এনেছেন। কিন্তু অরুণিকার চিন্তায় তার মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছে আরবান তালুকদার এই জায়গা সম্পর্কে কিভাবে জানলো।
বাসায় আসার পর থেকেই আহনাফ চুপচাপ বসে আছে। তাহমিদ অরুণিকাকে জেরা করতে লাগলো, সে ইমানের সাথে কি করছিলো? অরুণিকা শুধু নিরবে চোখের জল ফেলছে। আরাফ আহনাফের কাছে যেতেই আহনাফ কাঁপা হাতে আরাফের হাঁটুতে শক্ত করে হাত রাখলো। আরাফ বুঝলো আহনাফের এই মুহূর্তে খুব শূণ্য শূণ্য লাগছে। এর আগে তিনবার এমন হয়েছিল। প্রথমবার যখন তাদের পরিবারের হত্যা হওয়ার নিশ্চিত খবর পেয়েছিল, তখনও আহনাফের হাত-পা অনেক কেঁপেছিল, দ্বিতীয়বার যখন কলকাতায় দূর্গা বিসর্জনের সময় অরুণিকা হারিয়ে গিয়েছিল, তৃতীয় বার যখন যতির জন্য অরুণিকাকে এনজিওর মহিলারা এসে নিয়ে গিয়েছিল। আর আজও এভাবেই আহনাফের হাত-পা কাঁপছে। এই দুর্বলতা কাউকে হারিয়ে ফেলা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। আরাফ আহনাফের একটি হাত নিজের হাতের তালুতে আবদ্ধ করে বলল,
“শান্ত হ, আহু। এমন করছিস কেন? অরু তো বাসায় ফিরেছে।”
আহনাফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“ও ফিরে নি, আরাফ। ও ফিরে নি। ও ইমানের কাছেই আটকে আছে। আমি ওকে ফেরাতে পারি নি। হয়তো পারবোও না। ভুল করে ফেলেছি। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।”
আহনাফ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো,
“ও আমাকে কখনো ভালোবাসবে না, আরাফ। তোর কথায় আমি ছোটবেলা থেকেই ওর কাছ থেকে দূরত্ব রেখেছি। তুই বলেছিলি, ও যদি বুঝে ফেলে আমার সাথেই ওর বড় হয়ে বিয়ে হবে, তখন ও অনেক ইতস্তত ভাব নিয়ে থাকবে। আমার সাথে ফ্রি হতে পারবে না। আরাফ, ও অনেক ফ্রি হয়ে গেছে আমার সাথে। অনেক বেশিই ফ্রি হয়ে গেছে। এতো ফ্রি না হলে হয়তো, ও আমাকে ভালোবাসতে পারতো। ইমানের সাথে ওর কয় দিনের পরিচয়? তবুও কতো ফ্রি? আমার অরু ইমানের কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে! কেন আরাফ? আমার খালি বুকটা কি ওর মাথা রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল না?”
এদিকে অরুণিকা আহনাফের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। অনেকক্ষণ হলো আরাফ আহনাফের রুমের ভেতরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। তূর্য, ইমন আর তাহমিদ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান সিঁড়িতে বসে আছে। আরবান তালুকদার পুরো ঘটনা আরো জটিল করেই সবার সামনে উপস্থাপন করেছেন। অরুণিকা নিজেও ঘুমিয়ে ছিল। তাই সে বুঝতে পারছে না, ইমান তার সাথে কি করেছে, আর আহনাফও বা তাকে কোন অবস্থায় দেখেছিল। এই মুহূর্তে কান্না করা ছাড়া তার হাতের নাগালে কিছুই নেই। তূর্য অরুণিকার কাছে এসে বলল,
“টুইংকেল, যা হওয়ার হয়েছে। তোমার রুমে যাও। আর কাঁদতে হবে না।”
অরুণিকা তূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। এদিকে মাওশিয়াত শতাব্দীকে নিয়ে এলো। অরুণিকা শতাব্দীকে দেখে তার কাছে বসে বলল,
“শতু আপু, আমি তো তোমাকে সব বলেছি। আমি কেন বাইরে যাচ্ছি, তোমাকে তো বলেছি। তুমি কি আহনাফকে সত্য কথাটা বলবে?”
ইভান চেঁচিয়ে বললো,
“ও কিভাবে বলবে? ও কি কথা বলতে পারে?”
তাহমিদ ইভানকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,
“আগে আমরা অরুণিকাকে কথা বলার সুযোগ দেই।”
তাহমিদ আহনাফের দরজায় কড়া নাড়তেই আরাফ দরজা খুলে দিলো। তাহমিদ বলল,
“অরুণিকা কিছু বলতে চাইছে। মাঝে মাঝে চোখের দেখাও ভুল হয়। আমাদের ওর কথাটা তো অন্তত শুনা উচিত।”
তূর্য বলল,
“আহনাফকে বল, একটু ওর কথা শুনতে। আমাদের টুইংকেল এমন কিছু করবে না। আর তোরা আরবান মামার কথা বিশ্বাস করছিস?”
অরুণিকা ভেতরে ঢুকে আহনাফের কাছে যেতেই দেখলো আহনাফের চোখে পানি। আহনাফ চোখ মুছতে যাবে তখনই অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে বলল,
“তুমি কাঁদছো, আহনাফ? কেন কাঁদছো? আমার জন্য? আমি কি খুব বেশি ভুল করে ফেলেছি? প্লিজ, আহনাফ, সরি। এরপর আর কখনোই এমন হবে না। তোমাকে না বলে আমি আর কোথাও যাবো না, প্রমিজ।”
ইমন শতাব্দীকে নিয়ে অরুণিকার সামনে এসে বলল,
“কি বলে গিয়েছিলে শতাব্দীকে, বলো?”
অরুণিকা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আরবান মামা কোথায়?”
ইভান বলল,
“উনার সাথে কি কাজ তোমার? তোমাকে যেটা জিজ্ঞেস করছি, সেটা বলো। ইমানের সাথে কেন ওখানে গিয়েছিলে?”
“ইমান আমাকে ওই লাইব্রেরিতে নিয়ে গিয়েছিল। ইমানের কাছে সব প্রমাণ আছে।”
অরুণিকা আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরাফ, আরবান মামাই আমাদের পরিবারের হত্যাকারী। সেদিন রাতে উনিই সেই কোট পরে আমাদের বাসায় এসেছিল। বড় চাচ্চুকে সেই নীল পিস্তল দিয়েই গুলি করেছিল। ওই লাইব্রেরিতে সব আছে। আমরা আরো অনেক কিছুই পেয়েছিলাম। ইমান সব প্রমাণ নিজের ব্যাগে নিয়েছিল।”
তূর্য বলল,
“ওর ব্যাগে নিয়েছিল মানে?”
আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“তুমি গাড়িতে আমাকে এই কথা বলো নি কেন?”
“তুমি তো রেগে আছো! কিভাবে বলবো?”
ইভান সাথে সাথেই রুম থেকে বের হয়ে আরবান তালুকদারের রুমে গেলো। দেখলো সেখানে কেউ নেই। তারপর মাওশিয়াতকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“আরবান মামা কোথায়?”
“একটু আগে বের হতে দেখলাম।”
ইভান তাড়াতাড়ি ফোন বের করে ইমানকে কল করলো। ইমান কল ধরতেই ইভান বলল,
“তুমি কোথায়?”
“আমার বাসায়।”
“তোমার কাছে আরবান তালুকদারের বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে। উনি হয়তো তোমার ক্ষতি করতে পারে।”
“আপনার কন্সার্ন দেখে ভালো লাগলো, ভাইয়া। চিন্তা করবেন না। আরবান তালুকদার আমার কোনো ক্ষতি করবে না।”
“কিন্তু?”
“আর প্রমাণগুলো সব আমি ই-মেইলে পাঠিয়ে দিয়েছি। একটা কোট আর পিস্তল আমার কাছে আছে। দেখা হলে আপনাদের দিয়ে দেবো। বাকি কাগজগুলোর ছবি তুলে পাঠিয়ে দিয়েছি। হয়তো এই প্রমাণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমি বেঁচে থাকবো। আরবান তালুকদার আমাকে মারবে না। আর অরুণিকার খেয়াল রাখবেন। ওর কোনো অপরাধ নেই। ও তো আরবান তালুকদারকে সন্দেহ করে আমার সাহায্য চেয়েছিল। কারণ আমি এই কেইসে আগে আপনাদের সাথে কাজ করেছিলাম। আর আহনাফ ভাই যা দেখেছেন, সব ভুল ছিল। আপনাদের অরুণিকা, আপনাদেরই আছে। ও আপনাদের খুব ভালোবাসে। তবে মেয়েটা একটু বোকা, আর খুব সরল। সবাইকে বিশ্বাস করে ফেলে। যেমন আজ আমাকে বিশ্বাস করে ফেলেছিল। আমি তো ওর কোনো ক্ষতি করতাম না। ভালোবাসার মানুষ শত্রু হলেও তার ক্ষতি করা যায় না। ভালোবাসা এমন একটা রোগ, সাথে থাকলেও পীড়া দেয়, দূরে গেলেও পীড়া দেয়।”
চলবে–#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬৯||
১১৩.
অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, তখনই কেউ একজন ইভানের হাত আঁকড়ে ধরলো। ইভান পিছু ফিরে দেখলো সানায়া দাঁড়িয়ে আছে। সানায়াকে দেখে সে প্রচন্ড অবাক হলো। আজ অনেকদিন পর সে সানায়াকে দেখছে। এই কয়েকদিনের মধ্যেই সানায়ার মুখে মলিনতার ছাপ ভেসে উঠেছে। পরিপাটি করে রাখা চুলগুলো আজ বড্ড অগোছালো। পরণের জামাটিতেও ভাঁজ পড়ে গেছে। হয়তো আলমারির কোণা থেকে তুলে এনেই গায়ে পরে নিয়েছে। আজ তার ঠোঁট জোড়ায় ব্র্যান্ডেড লিপস্টিকের ছোঁয়া নেই, বরং প্রচন্ড তাপদাহে যেমন মাট-ঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়, ঠিক তেমনি সানায়ার ঠোঁট জোড়ায় শুষ্কতা বিরাজ করছে। চোখ দু’টি দেখে মনে হবে বেশ কয়েকদিন ঘুম হয় নি।
সানায়ার এমন বিধ্বস্ত চেহারা দেখে ইভানের মনটা হাঁসফাঁস করতে লাগলো। সানায়া আলতো হাতে ইভানের হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে ধীরে ধীরেই বলতে লাগলো,
“অনেক ভেবেছি, ইভান। আমি আমার দিক থেকে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারি নি। আমি তোমাকে ভুলতে পারি নি, ইভান।”
ইভান কিছু বলতে যাবে তখনই সানায়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“প্লিজ, আমাকে বলতে দাও।”
ইভান সানায়ার কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। তারপর হাত দু’টো বুকে গুঁজে গাড়িতে হেলান দিয়ে সানায়ার দিকে তাকালো। সানায়া ইভানের হাবভাব দেখে বুঝলো, ইভান তার কথাগুলো বাধ্য হয়েই শোনার জন্য দাঁড়িয়েছে, নয়তো ব্যক্তিগত ভাবে ইভানের তার কথা শোনার মতো কোনো আগ্রহ নেই। সানায়া ইভানের ভাব দেখেই ভেতর থেকে আরো ভেঙে পড়লো। তার চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। সে মাথা নিচু করে চোখ মুছে নিলো। তারপর আবার বলল,
“আমি জানতাম না যে আমার রক্তের দোষ, এতোই বেশি হবে, যার জন্য আমি কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবো না বা কারো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজেকে যোগ্য ভাবতে পারবো না। আমার বাবা অনেক অন্যায় করেছে, আমার ভাইও অন্যায় করেছে। আমি শুধু এতোটুকু জানি, আমি কোনো অন্যায় করি নি। আমি শুধু বন্ধু চেয়েছি, ভালোবাসা চেয়েছি। কেউ আমার বন্ধু হতে চাইতো না। তাই আমি জোর করেই বন্ধু হতে চাইতাম। একাকিত্ব কি কারো ভালো লাগে, বলো? তার চেয়ে তো মরে যাওয়ায় ভালো। ভাইয়ার সাথে রাহির সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে রাহিও আমাকে তেমন একটা সময় দিতে পারতো না। তোমার সাথে থাকলে আমি আলাদা কিছু অনুভব করতে পারতাম। আমি জানি না, আমি হয়তো আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছি না। কিন্তু তুমি পাশে থাকলে সত্যিই আমার অনেক শান্তি লাগে। তুমি কি সব ভুলে আমাকে ভালোবাসতে পারবে না? মিথ্যেমিথ্যি ভালোবাসতে পারবে?”
সানায়ার ধরা গলার আবদারগুলো ইভানকে অস্থির করে তুলছে। সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। সানায়া অধির আগ্রহে ইভানের উত্তরের অপেক্ষায় তার দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। ইভান অনেকক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি খুব ঝামেলার মধ্যে আছি। পুরোনো ঝামেলার মধ্যে আমি নতুন ঝামেলা চাচ্ছি না, প্লিজ।”
সানায়া ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “আমি ঝামেলা?”
ইভান দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমার তোমাকে ঝামেলায় মনে হচ্ছে।”
সানায়া হঠাৎ ইভানের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“তাহলে কেন আমাকে মিথ্যে আশা দিয়েছো? কেন আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছো?”
“লিসেন, সানায়া। আমি তোমাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে গিয়েছি। তার মানে এই নয় যে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
“আচ্ছা? তাহলে আমার এতোটা কাছে কেন এসেছিলে? তোমার স্পর্শ আমাকে অনুভব করতে বাধ্য করেছিল যে তুমি আমাকে নিয়ে ভিন্ন কিছু ভাবো। বন্ধুত্বই যেহেতু ছিলো, তাহলে কেন প্রেমিক পুরুষের মতো আমাকে নিজের কাছে টেনে নিতে?”
ইভান চুপ করে রইলো। হুট করেই তার অতীতের কথা মনে পড়ে গেলো, যখন মাওশিয়াতকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ইমন সায়ন্তনীর সাথে ভালোবাসার অভিনয় করেছিল। সায়ন্তনীও সেদিন ইমনকে এমন প্রশ্নই করেছিল। আর শেষমেশ সায়ন্তনীর মৃত্যু হলো। এখনো সে সায়ন্তনীকে ভুলতে পারে নি। একবুক অভিমান নিয়েই মেয়েটা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল। আর আজ সানায়াও সেই একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ইভান চায় না, সানায়ার সাথে খারাপ কিছু হোক। সায়ন্তনী যদিও খুব শক্ত মনের মেয়ে ছিল, কিন্তু সানায়া মারাত্মক দুর্বল। সে যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে? ইভান অনুশোচনা নিয়ে সানায়াকে বলল,
“সরি, সানায়া। আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। কিন্তু যা করেছি প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই করেছি। সাহিল মির্জা তোমার বান্ধবী রাহির জন্য আরাফকে ভয়ংকর ভাবে মেরেছিল। সেদিন আরাফের সাথে খারাপ কিছুও হতে পারতো। ডাক্তার ওকে ভালোভাবে চেকাপ করে বলেছিল, অল্পের জন্য ওর বড় কোনো ক্ষতি হয় নি। ওর শরীরের অভ্যন্তরে অনেক সমস্যা দেখা গিয়েছিল। আরাফের সাথে যা হয়েছিল তা আমি সাহিল মির্জাকে কিভাবে ফিরিয়ে দেবো, বলো? তুমি ছাড়া আমার কাছে কোনো উপায় ছিল না। তুমিও আমার সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলে, আর আমি সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ছিলাম।”
সানায়া মলিন হেসে বলল,
“আর তুমি ভেবেছো, আমার মন ভাঙলে সাহিল মির্জা দুর্বল হয়ে পড়বে?”
ইভান চুপ করে রইলো। সানায়া আবার বলল,
“ভাইয়ার সাথে আমি অনেকদিন কথা বলি নি। হ্যাঁ, ভাইয়া কষ্ট পেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ভেঙে যায় নি। এখনো প্রতিদিন অফিসে যায়, খাওয়া-দাওয়া করে, বউকে নিয়ে ঘুরতে যায়। ভাইয়া তো দিব্যি ভালো আছে। শুধু আমিই ভালো নেই।”
সানায়া কিছু একটা ভেবে বলল,
“হ্যাঁ, তোমার পরিকল্পনা সাকসেস করার একটা উপায় আছে। যদি আমি একটা সুইসাইড নোট লিখে ভাইয়াকে দায়ী করে এই পৃথিবী থেকে মুক্তি নেই, তাহলে ভাইয়ার অনেক কষ্ট হবে। ও তখন জ্বলেপুড়ে মরবে। আমি আজ বাসায় গিয়ে এই কাজটাই করবো। এমনভাবে নোট লিখবো, যাতে সাহিল মির্জা যতোদিন বেঁচে থাকবে ততোদিন অনুতাপের আগুনে জ্বলতে থাকবে। এরপর দেখা যাবে, সেও আমার চিন্তায় হার্ট এট্যাক করে ফেললো। তখন তোমার প্রতিশোধও পূর্ণ হয়ে যাবে।”
ইভান সানায়ার হাত ধরে বলল,
“তুমি এমন কিছুই করবে না, সানায়া। তুমি যদি এমন কিছু করো তাহলে তোমার ভাই অনুতাপে মরুক, না মরুক, আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। আমি যেহেতু অন্যায় করেছি, তাই ক্ষমা চাচ্ছি। আর তুমি এখন বাসায় যাও। রেস্ট করো। আমার একটু তাড়া আছে। আমি সত্যিই অনেক বড় সমস্যার মধ্যে আছি। সমস্যার সমাধান হলে আমি তোমার সাথে দেখা করবো।”
ইভানের শেষ কথাটি শুনেই সানায়ার মনের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটলো। ইভান এরপর গাড়িতে উঠে বসলো। সিটে হেলান দিয়ে ইভান চোখ বন্ধ করলো, আর মনে মনে ভাবলো, সানায়াকে এমন কথা না বললে সে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবতো। অন্তত এখন আশা নিয়েই থাকুক। আশায় তো মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়।
রাতে নিজের ঘরে ঢুকেই রাহি অনেক অবাক হলো। পুরো রুম মোমবাতি দিয়ে সাজানো। সে কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
“কি করছো, সাহিল?”
রাহির কন্ঠ শুনে সাহিল মুচকি হেসে রাহির দিকে এগিয়ে এলো। তারপর রাহির হাত ধরে তাকে কাছে টেনে এনে বলল,
“সেলেব্রেশন করছি। এখন থেকে তো আমার উপর নতুন দায়িত্ব পড়েছে।”
রাহি হালকা হাসলো। রাহির হাসি দেখে সাহিল বলল,
“মনে হচ্ছে গুড নিউজটা তোমার জন্য ব্যাড নিউজ ছিল।”
রাহি অবাক হয়ে বলল,
“এসব কি বলছো, সাহিল?”
“ঠিকই তো বলছি। তুমি তো আমার বাচ্চার মা হতে চাও নি। আমিই তোমাকে বাধ্য করেছি। তাই নিউজটা তোমার জন্য খারাপ।”
“সাহিল, বাচ্চাটা আমারও।”
“হুম, কিন্তু তার বাবা তো আমিই হবো। মিস্টার আরাফ চৌধুরী তো আর হবে না।”
রাহি সাহিলকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আরাফকে এর মধ্যে কেন আনছো? আমি কতোবার তোমাকে বুঝিয়েছি, আরাফকে আমার মানুষ হিসেবে ভালো লাগতো।”
সাহিল রাহিকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়ে বলল,
“রাহি, আরাফকে তুমি যেমন মানুষ ভাবার ভাবো। আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একটা সময় তো আমি মানুষটাই তোমার প্রিয় ছিলাম। আর এখন আরাফ তোমার প্রিয় হয়ে গেছে। আর আমাকে দেখো, কতো দেশে ঘুরেছি, কতো মেয়ে দেখেছি, কিন্তু তোমার নেশা ছাড়তে পারি নি। সাহিল মির্জা যতোই খারাপ হোক, বেইমানি করে না। যার হাত একবার ধরে তার হাত কখনোই ছাড়ে না।”
রাহি সাহিলের হাত ধরে বলল,
“যেই মানুষ একটার পর একটা অন্যায় করে, তাকে কি বিশ্বাস করা যায়?”
সাহিল মির্জা হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে এলো। সে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল,
“যখন আমি থাকবো না, তখন আমার গুরুত্বটা বুঝবে। আসলে কি জানো বউ, মানুষ পেয়ে গেলে অবহেলা করে। না পেলে আক্ষেপ করে। আর পেয়ে হারিয়ে ফেললে আফসোস করে। বউ, আমি তোমাকে আফসোস করতে দেবো না।”
এদিকে ইশমাম মুন্সী বিধ্বস্ত মুখ নিয়ে বসে আছে। ইমন এসে ইশমাম মুন্সীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ইশমাম ভাই, কি হয়েছে আপনার? অফিসে আসার পর থেকেই মুখ ভার করে রেখেছেন!”
ইশমাম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“শাহেদ মির্জা বাবার নামে মামলা দিয়ে এসেছে।”
“কেন?”
“আমার বাবা নাকি ওদের মেয়েকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছে।”
“কোন মেয়ে? সানায়া?”
“না, সাবা। আমি যাকে ভালোবাসি। আর সাবাও তো আমাকে ভালোবাসে। শুধু শুধু ওর বাবাই আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিচ্ছে না। আমি না আর এতো মানসিক চাপ নিতে পারছি না।”
ইমন ইশমাম মুন্সীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এক একটা কথা বলছে। কিন্তু ইশমাম একটা বাক্যেও সান্ত্বনা পাচ্ছে না। তখনই তাদের কেবিনে আহনাফ ঢুকলো। আহনাফকে দেখেই ইশমাম বলল,
“কি খবর, কোনো খবর পেয়েছো?”
আহনাফ বলল,
“না, তার কোনো খবর পাচ্ছি না।”
“লোকটা হুট করে কোথায় হারিয়ে গেলো?”
“সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
“আরবান তালুকদারের বিরুদ্ধে থাকা প্রমাণগুলো পেয়েছো তো?”
“হ্যাঁ, সংগ্রহ করেছি।”
ইশমাম আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। আহনাফ ইশমামের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“আর ইউ ওকে, ভাইয়া?”
ইশমাম মলিন মুখে বললো,
“আমি ভালো নেই, আহনাফ।”
“কি হয়েছে?”
ইমন আহনাফকে সবটা বললো। আহনাফ সব শুনে বলল,
“মির্জা সাহেবের সমস্যাটা কি?”
ইশমাম হতাশ কন্ঠে বললো,
“জানি না, ভাই। যখন থেকে আমরা তোমাদের কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছি, তখন থেকেই আরো ঝামেলা করছে। থাক এসব বাদ দাও। তোমাদের জীবনেই সমস্যার শেষ নেই, আমার কথা আর কি শুনবে?”
আহনাফ বলল,
“আপনি আর মুন্সী সাহেব আমাদের কোম্পানিটাকে ইটা থেকে মৈত্রীতে রূপান্তর করতে অনেক সাহায্য করেছেন। আর এখন কি আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারবো না? আমরা মুন্সী সাহেবের বিরুদ্ধে যতো মামলা হয়েছে, সব উঠিয়ে নেবো। আমাদের পরিচিত একজন উকিল আছেন, উনাকে বলবো।”
“ধন্যবাদ।”
ইশমামের মুখটা আবার অন্ধকার হয়ে গেলো। ইমন আহনাফকে ইশারায় বোঝালো, তাকে শান্ত করা কঠিন কাজ। তবুও আহনাফ ইশমামের পাশে এসে বলল,
“ভাইয়া, সাবা আপু তো চাইলে আপনার কাছে সহজেই চলে আসতে পারে।”
“পারতো। কিন্তু ও আমার জন্যই আসছে না। ওর বাবা কোন সিকান্দার বসের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে। এই সিকান্দার সম্পর্কে আমি সব তথ্য বের করেছি। মারাত্মক ভয়ংকর লোক। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সন্ত্রাসী। শুনেছি, অনেক বড় বড় খুন করে সে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করে।”
আহনাফ আর ইমন একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। তখনই ইশমাম আবার বলল,
“এই সিকান্দারকে আজ পর্যন্ত কেউ দেখে নি। শুধু শাহেদ মির্জাই দেখেছিল। সে নাকি বাংলাদেশে কয়েক সপ্তাহ আগেই এসেছে, এতোদিন কলকাতায় ছিল। প্রায় পনেরো বছর আগে সে কলকাতায় চলে যায়। বাংলাদেশে নাকি কার সাথে বড় একটা ঝামেলা হয়েছিল, তাই দেশ ছেড়েছিল। আর যা-ই বলো, আমার না মন মানছে না। এমন মানুষের সাথে সাবার বিয়ে হবে? এইটা একদম সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। না জানি পনেরো বছর আগে ঝামেলার নামে কাউকে খুন করে কলকাতায় পাড়ি দিয়েছিল কিনা। লোকটা সাবার যদি কোনো ক্ষতি করে ফেলে? আমরা তো এতো ক্ষমতাধর নই। মির্জাদের সাথে আমরা পেরে উঠবো না।”
আহনাফ ইশমামের কথা শুনতে শুনতেই অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। সে কেবিন থেকে বের হতেই ইমনও বের হয়ে এলো। ইমন বলল,
“তুই আবার কি ভাবছিস?”
“পনেরো বছর আগে, আমাদের পরিবারের হত্যাকাণ্ড, আমাদের কলকাতায় নিয়ে যাওয়া, এসবের সাথে ওই সিকান্দারের কোনো সংযোগ নেই তো? একটা কাজ কর, আজই সিকান্দারের সব তথ্য বের করে ফেল। লোকটা যেহেতু বাংলাদেশেই আছে, তাহলে আমাদের সাথেও দেখা হয়ে যাবে।”
এদিকে মুরশিদ জুবাইয়েরের সাহায্যে ইভান আর তূর্য গিয়ে সুলতান মুন্সীর মামলাটা উঠিয়ে নিয়ে আসে। থানা থেকে সোজা সুলতান মুন্সীকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিতে গিয়েই ইভান আর তূর্য অবাক হলো। মুন্সীদের পুরো বাড়ি কালো পোশাকধারী লোক দ্বারা ঘেরাও করা। সুলতান মুন্সী চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“এরা কারা? বাসায় তো আমার স্ত্রী-সন্তানরা আছে।”
সন্ধ্যা কিছুটা ঘনিয়ে এসেছে। তূর্য আর ইভান সুলতান মুন্সীকে আশ্বস্ত করে গাড়ি থেকে নেমে পেছনের গেইট দিয়ে ঘরে ঢুকলো। ভেতরে সুলতান মুন্সীর পুরো পরিবার কান্নাকাটি করছে। তূর্য আর ইভান তাদের পেছনের গেইট দিয়ে বের করার আগ মুহূর্তেই হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ হতে লাগলো। তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে এসে সবাইকে কোনোভাবে গাড়িতে বসিয়ে এলাকা থেকে বের হয়ে গেলো।
টুইংকেল হাউজে আতংক ভীড় করছে। শাহবাজ খান, মুরশিদ জুবাইয়ের আর রিয়াজুর রহমানও এসেছেন। সুলতান মুন্সীর পুরো পরিবার টুইংকেল হাউজে আশ্রিত। পনেরো বছর আগের রাতটা যেন এবার মুন্সী গ্রুপের উপরই নেমে এলো। ভাগ্য ভালো, ঠিক সেই মুহূর্তেই ইভান আর তূর্য তাদের উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল। নয়তো আরো একটা কাল রাত সৃষ্টি হতে পারতো। এই মুহূর্তে কারো মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তবে ঘুরেফিরে সবার একটা বিষয়ই মাথায় এলো, আর তা হলো, হয়তো মৈত্রীদের সাথে কাজ করছে, তাই মুন্সী গ্রুপকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনাটা করা হয়েছে। রিয়াজুর রহমান বললেন,
“এই বাড়িটাও কারো জন্য নিরাপদ মনে হচ্ছে না। সুলতান সাহেবের পুরো পরিবার আজ না হয় আমার নতুন বাড়িতেই উঠুক।”
এবার শাহবাজ খান বললেন,
“আমি বাইরে পুলিশ প্রটেকশনের ব্যবস্থা করছি।”
সুলতান মুন্সী বললেন,
“আমরাও তাহলে এই বাড়িতেই থাকি।”
সুলতান মুন্সী যে কোনোভাবেই রিয়াজুর রহমানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তা আহনাফ ভালোভাবেই বুঝেছে। সে মুন্সী সাহেবকে আশ্বস্ত করে পাঠিয়ে দিল। পুরো রাত কেউ আর ঘুমাতে পারে নি। এদিকে আহনাফ পুরো রাত সিকান্দারের তথ্যগুলো নিয়েই বসেছিল। এই নামটা তার অনেক বড় রহস্যের জট খুলে দিয়েছে।
আহনাফ লাইব্রেরিতে সবাইকে ডেকে আনলো, আর সিকান্দার ও আরবান তালুকদারের তথ্যগুলো পাশাপাশি রাখলো। বাকি পাঁচজন তথ্যগুলো দেখতে লাগলো। সব তথ্য পড়ার পর সবাই আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ হালকা হেসে বলল,
“অপরাধী ধরা খাওয়ার ভয়ে ভুল করে ফেলে। আর সেই ভুল করে ফেলেছে আসল খুনী।”
“তাহলে, আমরা যেটা ভাবছি, তুইও সেটাই ভাবছিস?”
“হ্যাঁ, শুধু একটা ছোট্ট হিন্টস পেলেই আমি নিশ্চিত হবো আসল খুনী কে। রহমতুল্লাহ শুধু আরবান তালুকদারের নাম স্বীকার করেছে। কারণ সে জানে আমরা আরবান তালুকদারের সব সত্য জেনে ফেলেছি। কিন্তু সে কিভাবে জানল এটা? আমরা ছাড়া তার সাথে আর কেইবা দেখা করতে গিয়েছিল?”
সবার হাত মুঠো হয়ে এলো। এতো বছর পর তারা আসল খুনীর সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু, শুধু বাকি আছে একটা সূত্রের। আর এই সূত্র হয়তো তারা কালই বের করতে পারবে।
এদিকে আরবান তালুকদার কাউকে ফোন করে বললেন,
“আজ যা হয়েছে, তারপর আমাদের হাতে কালকের দিনটাই বাকি। রুকন ধরা না পড়লে আমরা আরো সুন্দর ভাবে আমাদের কাজটা করতে পারতাম। আমি চেয়েছি আমাদের ছেলের সাথে অরুণিকার বিয়ে দিয়ে পুরো মৈত্রী সম্পত্তির ভাগ নিতে। কিন্তু তা আর সম্ভব হয় নি। এবার শেষ কাজটাই বাকি। বিনিময়ে কিছু না পেলেও শান্তিতে মরতে পারবো। আগামীকাল মুরাদপুরে ঠিক বিকেল তিনটাই বোমটা বার্স্ট হবে। আর এই ছ’জন তাদের মৃত্যুর পেছনে দৌঁড়াবে। কালই কয়েক’শ মানুষের সাথে অরুণিকার দি এন্ড। সাথে আমাদের বিশেষ অতিথিরও কাল শেষ দিন।”
ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল,
“এক ঢিলে দুই পাখি, ফেঁসে যাবে ছ’পাখি।”
কথাটি বলেই ওপাশের লোকটি হাসতে লাগলো, সাথে হাসছে আরবান তালুকদারও।
চলবে–