অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১০.
পরের দিন সকালে উঠে বেশ ভোরেই ফাতিহ, ল্যায়লা এবং ইসাম রওনা হয় কাসাব্লাঙ্কার উদ্দেশ্যে। কাসাব্লাঙ্কা হলো মরক্কোর প্রধান বন্দর। এই বন্দরটি বিশ্বের বৃহত্তম কৃত্রিম বন্দরগুলোর মধ্যে একটি এবং উত্তর আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর। এই শহরটি রয়্যাল মরক্কোর নৌবাহিনীর প্রাথমিক নৌ ঘাঁটিও পরিচালনা করে।
ছিছাওয়া শহর হতে এর দূরত্ব ২৯৯ কি.মি। তাদের গাড়িতে করে পৌঁছাতে ৩ ঘন্টা সময় লাগে। মাঝখানে সেত্তাত শহরে এক রেস্টুরেন্টে নেমে তারা নাস্তা করে নিয়েছিলো সকালের। কাসাব্লাঙ্কাতে তুলনামূলক শীত কিছুটা কম অনুভূত হচ্ছে তাদের। সমুদ্র তীরবর্তী শহর হওয়ায় হয়তো।
কাসাব্লাঙ্কাতে পৌঁছে সর্বপ্রথম ল্যায়লা কার্ড থেকে কিছু ক্যাশ টাকা তুলে নেয়। টাকা তুলে বুথ থেকে বের হতেই সে সামনে একটি ভ্যান দেখে রাস্তার পাশে। ল্যায়লা এক পলক গাড়ির দিকে তাকায়। ফাতিহ আর ইসাম গাড়ির ভেতর বসে কিছু একটা কথা বলছে। যতই শীতকাল হোক, কিন্তু ফাতিহ আর ইসামকে দেখে মনে হচ্ছে তারা যেন ল্যায়লার সঙ্গে ঘুরতে নয় বরং তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে। মুখে মাস্ক, চোখে সানগ্লাস আবার গাড়ি থেকে বের হলেই মাথায় ক্যাপ পড়ে নিচ্ছে। ল্যায়লা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই ভ্যানের দিকে এগিয়ে যায়।
একটি বৃদ্ধ লোক ভ্যানে করে সুগ্যার কোটেড নাট বিক্রি করছে। ল্যায়লা উনার থেকে তিনটা ঠোঙায় করে সেই বাদাম কিনে নেয়। গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে সে চোখের ইশারায় ফাতিহকে গাড়ির গ্লাস নামাতে বলে। ফাতিহ গ্লাস নামিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই ল্যায়লা জানালা দিয়ে ঠোঙা তিনটা তার হাতে ধরিয়ে দেয়। ফাতিহ সামনে ড্রাইভিং সিটে বসেছে। ইসাম পিছনে বসা। ল্যায়লা দ্রুত গিয়ে ফাতিহর পাশের সিটে উঠে বসতেই ফাতিহ প্রশ্ন করে,
” এগুলো কি? ”
ল্যায়লা ফাতিহর হাত থেকে দুটো ঠোঙা নিয়ে একটা ইসামের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,
” আমি যদি ঠিক দেখতে পাই, তাহলে এগুলোকে বাদাম বলে। ”
সাথে সাথে ফাতিহর ভ্রু কুচকে উঠে। ইসাম পিছন থেকে শব্দ করে বলে উঠে,
” ওয়েল রিপ্লাইড। ”
কথাটা বলেই সে হাই ফাইভের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় ল্যায়লার দিকে। ল্যায়লা একবার ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকিয়ে সামনে ফিরে বসে। ইসাম আশাহত হয়। হাসি থামিয়ে বলে,
” নো হাই ফাইভ? ওকে। নো প্রবলেম। ”
ফাতিহ বলে,
” আমি বাদাম খেলে ড্রাইভ কে করবে? ”
এবার ল্যায়লার হুশ হয়। ইসাম সাথে সাথে সমাধান দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠে,
” ল্যায়লা, ফাতিহ ড্রাইভ করুক। তুমি ওকে খাইয়ে দাও। ”
ফাতিহ লুকিং গ্লাস দিয়ে রাগী দৃষ্টিতে তাকায় ইসামের দিকে। ইসাম এই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলে উঠে,
” আফটার অল হি সেভড ইউর লাইফ। এন্ড আই এম শিওর তুমি কারো কাছে ঋণি থাকা পছন্দ করো না। সো জাস্ট ডু ইট। ”
ফাতিহকে অবাক করে দিয়ে ল্যায়লা তার হাতের থেকে বাদামের ঠোঙাটা নিয়ে নেয়। মাথা নত করে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
” আচ্ছা। ”
__________
ফাতিহর কাছে ল্যায়লাকে ফুটবল ম্যাচের ৯০ মিনিটের পর একট্রা টাইমের সময় দুই দলের জেতার সম্ভাবনার মতো মনে হয়। পুরোই আনপ্রেডিক্টেবল। এইযে এখন ল্যায়লা এক হাত বাড়িয়ে তাকে বাদাম খাইয়ে দিচ্ছে, এই দৃশ্য সে ঘুণাক্ষরেও কখনো কল্পনা করে নি। ইসাম পিছনে বসে মিটমিটিয়ে হাসছে চুপচাপ।
গাড়ি এসে থামে হাসান দ্বিতীয় মসজিদের সামনে। ফাতিহ ও ইসাম রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে নামে। ল্যায়লা আজকে একটা সাদা স্কার্ট এবং সাথে একটা সাদা টপস পড়েছে। তার উপরে একটি শ্রাগ পড়েছে। গাড়ি থেকে নেমে সে তার গলায় ঝুলানো স্কার্ফটা মাথায় টেনে নেয়।
হাসান দ্বিতীয় মসজিদ মরক্কোর ক্লাসাবাঙ্কার একটি মসজিদ। এটি আফ্রিকার বৃহত্তম কার্যকরী মসজিদ এবং বিশ্বের ১৪ তম বৃহত্তম মসজিদ। এই মসজিদের মিনারটি ২১০ মিটার এবং বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতর মিনার। রাজা দ্বিতীয় হাসানের নির্দেশনায় মিশেল পিনসেউ দ্বারা নকশা করা হয়েছিলো এবং সমগ্র রাজ্যের মরক্কোর কারিগররা এটা তৈরি করেছিলেন। মিনারটি ৬০ তলা উঁচু একটি লেজার দ্বারা শীর্ষে, যেখান থেকে আলো মক্কার দিকে পরিচালিত হয়। মসজিদটি আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে একটি প্রমোটরিতে দাঁড়িয়ে আছে।
মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করতে করতে এই সকল তথ্যগুলো ল্যায়লাকে জানায় ফাতিহ। ল্যায়লা মুগ্ধ হয়ে চারিদিক ঘুরে দেখছে। ল্যায়লা ফাতিহকে প্রশ্ন করে,
” এই মসজিদটা সমুদ্রের উপরে তৈরী করার পিছনে কোনো বিশেষ কারণ আছে? ”
ফাতিহ হেসে জবাব দেয়,
” রাজা দ্বিতীয় হাসান এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা নিয়ে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, আমি এই মসজিদটি জলের উপর তৈরী করতে চাই কারণ আমাদের প্রতিপালকের সিংহাসন জলের উপর রয়েছে। ”
ল্যায়লা চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে,
” এটা সত্যি? ”
” এটা আমার নয়, রাজার কথা। ”
ল্যায়লা বড় করে ওহ বলে আবার চারিদিকে চোখ বুলাতে থাকে। এতক্ষণ তারা মসজিদের বাহিরে ঘুরে দেখছিলো। এবার তারা জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। ল্যায়লা একবার চারিদিকে তাকিয়ে ফাতিহর দিকে ফিরে প্রশ্ন করে,
” তুমি বলেছিলে এটা একটা বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু মসজিদে তো খুব একটা মানুষ নেই। ”
ইসাম আগ বাড়িয়ে উত্তর দেয়,
” কারণ বছরের এই সময়টায় পর্যটকরা কম আসে। আর তাছাড়াও আজকে জুম্মার দিন না। জুম্মার দিনও এখানে প্রচুর ভীড় হয়। ”
ফাতিহ পাশ থেকে বলে,
” আর এখন জোহরের আজানের সময়। এই সময় কেউ তেমন একটা মসজিদে ভীড় জমায় না। বেশিরভাগ মানুষ আসর থেকে এশার ওয়াক্তের মাঝে আসে। ”
তারা তিনজন নামাজের ঘরের সামনে যায়। নামাজের হলটি জানালা দ্বারা আচ্ছাদিত মসজিদের শীর্ষে অবস্থিত। কেন্দ্রীয় হলটি আটলান্টিক মহাসাগরের অপূর্ব দৃশ্য দেখায়। হলের অলঙ্করণগুলী সূক্ষ্ম এবং বিস্তৃত। কাঠের খোদাই, জেলিজ কাজ এবং স্টুকো মোল্ডিংগুলি বিস্তৃত এবং অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক নকশার। খোদাই করার জন্য ব্যবহৃত কাঠটি মধ্য অ্যাটলাস পর্বত থেকে, মার্বেলটি আগদির থেকে এবং গ্রানাইট আনা হয় টাফ্রাউট থেকে।
ল্যায়লা সামান্য হেসে চোখ বুজে বলে,
” এখানে প্রশান্তি অনুভব করছি। ”
ইসাম ইতিমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সামনে চলে গিয়েছে। ফাতিহ ল্যায়লার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে ল্যায়লার কথা শুনে তার দিকে তাকায়। তখনই জোহরের আজান দেয়। ফাতিহ সামান্য হেসে বলে,
” আরো প্রশান্তি অনুভব করতে চাইলে এখানে নামাজ আদায় করো। মনের বোঝ হালকা হবে। ”
ল্যায়লা ঘাড় কাথ করে ফাতিহর দিকে তাকায়। ফাতিহ হাসিমুখে বলে,
” উপরের তলায় মেয়েদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে। ওযুও করতে পারবে। ”
” আর তুমি? ”
” আমি আর ইসামও নামাজ পড়বো। চিন্তা করো না, আমি তোমাকে খুঁজে নিবো। ”
ল্যায়লা আর কোনো কথা বলে না। সে উপরের তলায় যাওয়ার জন্য উল্টো রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করে। ফাতিহও মৃদু হেসে সামনের দিকে এগোয়। দুজনেই বিপরীত দিকে চলছে। কিন্তু গন্তব্য এবং উদ্দেশ্য একই। আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া।
__________
দো তলার মেয়েদের নামাজ ঘরের একপাশে জায়নামাজে বসে সালাম ফিরায় ল্যায়লা। আজ বহু বছর পর সে আবার নামাজ পড়ছে। হতাশা, বিষন্নতা, সুইসাইডিক্যাল চিন্তা চেতনা সব ধীরে ধীরে তাকে ইবাদত থেকে অনেক দূরে সরিয়ে ফেলেছিলো। তার মাথায় এক ধরনের চিন্তা সৃষ্টি হয়েছিলো যে, সে যেভাবে মৃত্যু গ্রহণ করতে চায় তা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মহাপাপ। আর সেই পাপ সাধনের আগে সে ইবাদত করলেও তা অর্থহীন হবে।
ল্যায়লা সবসময়ই মনে করতো তার সমস্যা শোনার মতো কেউ নেই। কিন্তু এই মুহুর্তে মসজিদের পাশের সমুদ্রের গর্জন যেন তাকে চিৎকার করে আহবান জানাচ্ছে যে, তার মনের কথা শোনার জন্য তার রব আছেন।
ল্যায়লা দু’হাত তুলে মোনাজাতে মশগুল হয়৷ মনে মনে সুধায়,
” আমি যতবার নিজের জীবন শেষ করতে চেয়েছি ততবার তুমি আমাকে আমার জীবন ফেরত দিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছো, আমি যত চেষ্টাই করি না কেন তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনোই আমার মৃত্যু সম্ভব না। আমার মনের সকল ব্যক্ত এবং অব্যক্ত আহাজারি তুমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পারবে না। হয় আমার জীবন সহজ করে আমাকে বেঁচে থাকার সুযোগ দাও নাহয় আমাকে এই নশ্বর দুনিয়া থেকে মুক্তি দাও তুমি। সবাই আমাকে মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছে, শুধু তুমি আমাকে একা ছেড়ে দিও না। আমাকে ক্ষমা করো ইয়া রব! ”
মনের কথা বলতে বলতে মোনাজাতের মাঝেই নিঃশব্দে কেঁদে উঠে ল্যায়লা৷ অনেক দিন পর সে মন খুলে নিজের কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। দূর থেকে হলের দরজার বাইরে থেকে এই দৃশ্য দেখে ফাতিহ। তাদের নামাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় সে ল্যায়লাকে খুঁজতে উপরে আসে। এখানে এসে এই দৃশ্য দেখে তার চোখেমুখে প্রশান্তির হাসি খেলে যায়। সে ল্যায়লার দিকে তাকিয়ে থেকেই মনে মনে বলে উঠে,
” যে নিজে এসে তোমার কাছে ধরা দিচ্ছে তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না আল্লাহ। ”
মনে মনে দোয়াটুকু করেই মুখ ফিরিয়ে কিছুটা পাশে সড়ে এসে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায় ফাতিহ। কিছুক্ষণ পর ল্যায়লা বের হলে ফাতিহকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে যায়। ফাতিহও দুই কদম এগিয়ে সামনে যায়। তাকে অবাক করে দিয়ে ল্যায়লা বলে,
” ধন্যবাদ ফাতিহ। ”
ফাতিহ অবাক হয়। এই পর্যন্ত সে তিনবার ল্যায়লার জীবন বাঁচিয়েছে। কিন্তু একবারও ল্যায়লা তাকে ধন্যবাদ জানায় নি। আবার তাদের পরিচয় হওয়ার পর থেকে ল্যায়লা তাকে কখনো তার নাম ধরেও ডাকে নি। অথচ এই মুহুর্তে সে এই দুটি জিনিস একসাথে উচ্চারণ করেছে। ফাতিহ নিজের বিস্ময় হাসির আড়ালে লুকিয়ে প্রশ্ন করে,
” সমুদ্রে যাবে ল্যায়লা? ”
ল্যায়লার চোখেও একই রকমের বিস্ময় খেলে যায়। তাদের পরিচয়ের পর থেকে ইসাম তাকে নাম ধরে ডাকলেও ফাতিহ কখনো তাকে নাম ধরে ডাকে নি। এই প্রথম বললো। অবশ্য ফাতিহর মুখে নিজের নাম শুনতে মন্দ লাগছে না ল্যায়লার। সে সামান্য হেসে সামনের দিকে পা বাড়ায়। ফাতিহ মুচকি হেসে সে-ও ল্যায়লার পিছু নেয়।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]