আঁধারে_আলোর_হাতছানি ১ম + ২য় পর্ব

যেই মূল সড়ক কিছুক্ষণ আগেও শান্ত ছিল, তাতে এখন মানুষ জনের ভীড় পরে আছে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। সম্ভবত কোন দূর্ঘটনা ঘটেছে। সত্যিই তাই। বাজারের ব্যাগ থেকে সবজিগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে পরে আছে। থ্রিপিস পরিহিত একটি মেয়ে সেখানেই বসে আঘাতপ্রাপ্ত হাতটি দেখছে। চোখে তার ব্যথার দৃষ্টি। ক্ষতস্থানে হাত দিতেই সে ব্যথায় শব্দ করে উঠলো। ভীড় ঠেলে হঠাৎ একজন পুরুষ এগিয়ে আসে। মাথায় তার হেলমেট, হাতে কালো দস্তানা। কথা নেই বার্তা নেই সে রাস্তায় বসে থাকা মেয়েটিকে ধমক দিয়ে উঠে।
“এই মেয়ে, এতো বড় হয়েছ কি পঙ্গু হয়ে? রাস্তা পাড় হতে সমস্যা হলে সাথে অভিভাবক নিয়ে আসবে। আজ আবার হাজার খানেক টাকা নষ্ট করতে হবে। তোমার জন্য আমার বাইকের কতটা ক্ষতি হয়েছে, জানো?”
মেয়েটি তার আঘাতপ্রাপ্ত হাত দিয়ে পরে যাওয়া উড়নাটা আবার মাথায় দিয়ে দেয়। উড়না মাথায় দেওয়ার সময় মেয়েটার হাত নাড়াতে কষ্ট হচ্ছিল তা বুঝাই যাচ্ছে। চুপচাপ উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি। সে মাথা নীচু করে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলে,
“দুঃখিত। ভুল হয়েছে আমায়। আমি খেয়াল করি নি আপনি বাইক চালিয়ে আসছিলেন। ক্ষমা করবেন আমায়। এবং, আপনি নিজেও বাইকের স্পিড নিয়ন্ত্রণে রেখে চালাবেন, যেন আপনার ও অন্যের কোন ক্ষতি না হয়।”
অপরাধী স্বরে কথাগুলো বলছিল মেয়েটি। কিন্তু সমাপ্তির কথা বলতে গিয়ে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকায়। মেয়েটির নাম আলো। মধ্যবিত্ত পরিবারের ও বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা সন্তান।
প্রথমে মেয়েটির অপরাধী কথায় ছেলেটির ভাব কিছুটা বাড়লেও, পরবর্তী কথায় সে হতবাক হয়ে তাকায় আলোর দিকে। বাবা-মায়ের বিগড়ে যাওয়া ছেলে আধাঁর। তার পূর্বপুরুষ যেই পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে গিয়েছে এবং তার বাবা যা উপার্জন করছে, তা বিভিন্নভাবে উড়ানোই যেন তার কাজ। ছেলের এমন কর্মকাণ্ডে বাবা-মা নিজেরাই অতিষ্ঠ। কি ঘটেছিল, তা জানা যাক!

ফাঁকা রাস্তা পেয়ে হাতের ভারী ব্যাগগুলো নিয়ে পাড় হচ্ছিল আলো। এতো এতো বাজার দেখেই বুঝা যাচ্ছে বড় কোন আয়োজন করা হবে। এতক্ষণ রাস্তা পুরো ফাঁকা ছিল। রাস্তার যতদূর চোখ গিয়েছে ততদূর পর্যন্ত একটা গাড়ির ছিটেফোঁটাও দেখা যায় নি। রাস্তার মাঝ বরাবর আসতে না আসতেই গাড়ির হর্ন শুনতে পায় আলো। গাড়ির দিকে তাকাতে না তাকাতেই বারি লাগে বাইকটির সাথে। হাতের সাথে বারি লাগায় ছিটকে পরে যায় আলো। হাতে থাকা বাজারের ব্যাগ থেকে সকল সবজিও পরে যায়। হাই স্পিডে বাইক চালানোর জন্য সময়মতো ব্রেকও করতে পারে নি আধাঁর। তার নিজের ক্ষতি না হলেও, বাইকের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। আধাঁরের দিকে জনগণ ধাবিত না হয়ে আলোর দিকেই এগিয়ে এসেছে। তারপরের কাহিনি তো জানা হলোই।

আলোর কথায় আধাঁর প্রথমে হতবাক হলেও পরক্ষণে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সে অনেকটা হুংকার ছেড়েই বলে,
“এতো বড় সাহস তোমার! তুমি আমায় চোখ রাঙিয়ে কথা বলছ? আমায় উপদেশ দিচ্ছ।”
“যেখানে আমি নির্দোষ হয়েও আপনার কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি এবং আপনার রাগান্বিত কথাও শুনেছি, সেখানে আপনি দোষী হয়ে সামান্য উপদেশ শুনতে পারবেন না!” আলো প্রশ্ন করে উঠে।
“কি হচ্ছে কি এখানে?” ট্রাফিক পুলিশের আগমন ঘটে।
পুলিশ দেখে আধাঁর বা আলো কেউ’ই ভীত হয় না। আধাঁর নাকের ডগা চুলকে বলে,
“এই মেয়েটা, না দেখে রাস্তা পার হচ্ছিল এবং আমার বাইকের সামনে চলে এসেছিল। আমার বাইকের ক্ষতি হয়েছে।”
“আচ্ছা? আমি না হয় না দেখে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। আপনি কেন কানা হয়ে বাইক চালাচ্ছিলেন? স্যার, এই লোকটা এমনসময় এসে হর্ন বাজিয়েছে যে, বাইকের দিকে তাকাতে না তাকাতেই আমায় হিট করেছে।”
আধাঁর কোনপ্রকার কথা না বলে মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটি নোট বের করে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। আলো হতবাক ও রাগান্বিত হয়। কেননা, এরপর কি হবে সে ভালোমতো জানে। বাংলেদেশের পুলিশের পকেটে একটা দুইটা নোট ভরে দিলেই খেল খতম! তবে ব্যতিক্রম কেউ কেউ আছে। পুলিশ ভেটকি মাছের মতো হেসে নোটটা পকেটে ভরে নিল। আলোকে কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু আলো পুলিশকে ব্যর্থ করে দিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, জানি। আমার দোষ হয়েছে।”
বলতে বলতে সবজিগুলো কুড়িয়ে ব্যাগে ভরতে থাকে আলো। আধাঁর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলে যায়। যেতে যেতে নিজের হেলমেট খুলে নেয়। এতক্ষণ সে হেলমেট পরিহিত অবস্থাতেই ছিল। আলো সবজি কুড়িয়ে নিতে নিতে পুলিশকে ও আধাঁরকে বিরবির করে নানান কিছু বলতে থাকে। দ্রুত সবকিছু কুড়িয়ে নিয়ে সে চলে যায়। বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগমুহূর্তে আধাঁর পিছু ঘুরে তাকায়।

আলোর দুইজন বান্ধবী ফুটপাতের একপাশে দাঁড়িয়ে আলোর জন্য অপেক্ষা করছিল। আলো ফিরে আসতেই তাদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করে উঠে,
“সেই ২০ মিনিট আগে বলেছিলি তুই আসছিস। এটুকু আসতে ২০ মিনিট সময় লাগে?”
“আলো, তোর গালে রক্ত,,,” অন্য আরেকজন আলোর গালে রক্ত দেখে ভুলবশত তার আঘাতপ্রাপ্ত হাতে চাপ দিয়ে ধরে।
যন্ত্রণার জন্য আলো ছটফট করে উঠে। হাতে তরলপদার্থ জাতীয় কিছু অনুভব করতে তার দ্বিতীয় বান্ধবী অর্থাৎ তিশা বলে উঠে,
“কি হয়েছে তোর হাতে? এ-কি! এতখানি আঘাত পেলি কিভাবে?”
“আঘাত পেয়েছে? দেখি। ওহ আল্লাহ! কি ভয়াবহভাবে ক্ষত হয়েছে,” প্রথম বান্ধবী শায়েলা বলতে বলতে তার হাতে থাকা রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে।
“আহ, আহ! ব্যথা লাগছে। স্পর্শ করিস না, প্লিজ। আল্লাহ, কি ব্যথা!”
আলো ছটফট করতে করতে বলে। তার বান্ধবী দুজন তাকে ধমক দেয়৷ শায়েলা আশেপাশে তাকায়। বাজারের একপাশে একটি ফার্মেসীর দোকান দেখতে পায়। যেকোন বাজারে একাধিক ফার্মেসী থাকে। তাদের ভাগ্যও ভালো ছিল যে তা খোলা ছিল। আলোর হাত থেকে বাজারের ভারী বুঝাটি শায়েলা নিয়ে নেয়। তিশা আলোকে নিয়ে ফার্মেসীর দিকে যায়। শায়েলাও তাদের পেছন পেছন আসে। ফার্মেসীর লোকটি আলোর ক্ষতস্থান দেখে। লোকটি আলোর হাতের ক্ষতস্থান মুছে দিতে দিতে বলে,
“তবে আপনি-ই সেই মেয়ে, যে কিছুক্ষণ আগে বাইক এক্সিডেন্ট করেছেন?”
“বাইক এক্সিডেন্ট!?” তিশা ও শায়েলা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
“আপনি বলেন নি উনাদের?” লোকটি আলোর ক্ষতস্থানে তুলার সাহায্যে ঔষুধ লাগিয়ে দিতে দিতে বলল।
ঔষুধটি ক্ষতস্থানের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয় এবং এটা স্বাভাবিক। আলো হাত শক্ত করে চোখ বন্ধ করে নেয় এবং অন্য হাত দিয়ে নিজের কামিজ খামচে ধরে। লোকটিও আর কিছু বললেন না৷ তিশা ও শায়েলাও চুপ ছিল। কারণ পরে সবটা জানাই যাবে। হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে কিছু ব্যথার ঔষুধ দেয়া হলে তিশা টাকা পরিশোধ করে দেয়।
যাতায়াতের জন্য অতি পরিচিত ছোট যানবাহন অটো রিক্সাতে উঠে বসে তিন বান্ধবী। প্রচন্ড ব্যথায় আলোর ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু তিশা ছাড়বার পাত্রী নয়। সে জিজ্ঞাসা করে উঠে,

“কি হয়েছিল? কিসের বাইক এক্সিডেন্ট?”
“তেমন কিছু না, আমি ঠিকাছি এতেই অনেক। বাদ দে।”
আলোর উত্তরে শায়েলা ও তিশা দুজনেই ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায়। শায়েলা হুংকার করে বলে উঠে,
“ঠিকাছিস? এই তো ঠিক থাকা? হাতের অবস্থা দেখেছিস?”
“আচ্ছা, কয়টা বাজে দেখেছিস? বিকাল হয়ে আসছে। জলদি পৌঁছাতে হবে, বাচ্চাগুলো হয়তো অপেক্ষার আছে,” আলো কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলে।
“হ্যাঁ রে, অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। এই যে, মামা, একটু দ্রুত চালান তো,” তিশা চালককে তাড়া দিয়ে বলে।

মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হলেও তিন বান্ধবী তাদের টিউশনির টাকার এক অংশ আলাদাভাবে সরিয়ে রাখে। সেই টাকা একত্রিত করে তাদেএ নিজ এলাকার এতিমখানার বাচ্চাদের জন্য প্রতি মাসে বাজার করে দেয়। এতে বাচ্চারাও বেশ সন্তুষ্ট হয়, নিজেরাও তৃপ্তি পায়। এছাড়াও বিভিন্নভাবে, যতটুকু সম্ভব তিনজন অন্যদের সাহায্য করে। নিজেরা যেই এলাকায় থাকে, সেই এলাকায় তাদের ‘তিন তারা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।

অন্যদিকে,

গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যান থেকে কোল্ড ড্রিংক পান করছে আধাঁর। একজন তার বাইক ঠিক করছে। কিছুক্ষণ পরপর বাইকের দিকে তাকাচ্ছে আধাঁর। আধাঁরের বন্ধু হায়দার এবং আতিফ তার সাথে আছে। আধাঁরকে বারবার বাইকের দিকে তাকাতে দেখে আতিফ প্রশ্ন করে,
“তোর বাইক ঠিক হচ্ছে, ব্রো। বারবার ওদিকে তাকাতে হবে না।”
“আরে তা না। এসমস্ত গ্যারেজের কর্মীরা দামী গাড়ির পার্ট খুলে সস্তাগুলো লাগিয়ে দেয়। সেজন্য খেয়াল রাখছি। চোর যতসব!”
“আধাঁর, সবাইকে এভাবে কেন বলিস? ওরা নিম্নবিত্ত হতে পারে, কিন্তু মানুষ তো,” হায়দার বলল।
“তোর এসব দরদী মার্কা কথা তোর কাছেই রাখ। এই ছোটলোকের বাচ্চাদের যত বেশি সুযোগ দিবি, ততো মাথায় উঠবে এবং প্রতারণা করবে,” আধাঁর কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলল।
আধাঁরারের কথায় কয়েকজন কর্মী তার দিকে তাকায়, কিন্তু বলার সাহস পায় না। নিম্নবিত্তরা যে সবসময়ই উচ্চবিত্তদের থেকে তাচ্ছিল্য পেয়ে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে ন্যায় কিছু বললেও যেন তাদের দোষ। আগে রাজা প্রজাদের উপর অত্যাচার, জোর-জুলুম করতো, আর বর্তমানে উচ্চবিত্তরা মধ্যবিত্তদের। তফাত এতটুকুই। কবে হবে এর পরিবর্তন! তবে হাতে গুনা কয়েকজন পাওয়া যাবে এসব স্বভাবের উল্টো।

#আধাঁরে_আলোর_হাতছানি
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া

চলবে,,,,,,

আঁধারে_আলোর_হাতছানি
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া
২য় পর্ব

বন্ধুদের সাথে কথা বলতে মগ্ন আঁধার। তার বাইকটি ইতিমধ্যে ঠিক করা হয়েছে। ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সী একটি ছেলে আঁধারের নিকটে এসে তাকে তথ্যটি জানায়। যেই বয়সে বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করার কথা, বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলার কথা সে বয়সে একটা গ্যারেজে কাজ করছে দেখে আঁধার বেশ অবাক হয়। ছেলেটি ঘুরে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু আঁধারের ডাকে সে ফিরে তাকায়। উত্তরে সে জিজ্ঞাসা করে,

“ভাইজান, কিছু কইবেন?”
“তোর নাম কি?” আঁধার প্রশ্ন করে।
“আমার নাম রুহুল, ভাইজান,” ছেলেটির উত্তর।
“তোর বাড়ি কোথায়রে?” আঁধারের দ্বিতীয় ও শেষ প্রশ্ন।
“পিছনের বস্তিটাতেই থাকি।”

ছেলেটি পিছনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে বলল। আঁধার আর কোন কিছুই বলল না। সে ইশারায় ছেলেটিকে কাজে ফিরতে বলে। দুই ঠোঁটের ভাজে সিগারেট রেখে পকেট থেকে লাইটার বের করে তাতে আগুন ধরাতে থাকে ও বাইকের দিকে অগ্রসর হয় আঁধার। তার বন্ধু হায়দার তাকে প্রশ্ন করে,
“কি-রে? ছেলেটা কোথায় থাকে জিজ্ঞাসা করলি কেন?”
“এই বয়সে বস্তির ছেলেরা পকেটমার হয়। কিন্তু ছেলেটা খেটে খাচ্ছে। তাই,” সিগারেটে টান দিয়ে ধোয়া ছড়িয়ে উত্তর দেয় আঁধার।
“আর তুই কি করিস? বাবারটা শুধু উড়াস,” বলে আতিফ নিজের বাইকে উঠে বসে।
“রিলেক্স, ব্রো। আমার বাবা ইনকাম করে কার জন্য? অবশ্যই আমার পরিবারের জন্য। কিন্তু আমার তো ভাই-বোন নেই। তিন সদস্যের পরিবারে এতো টাকার কি দরকার। আমি না উড়ালে কে উড়াবে বল?” বাইকে উঠে বসে সিগারেটটি ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে বলতে বলতে লুকিং গ্লাসের সাহাযে নিজের চুল ঠিক করল আঁধার।
“আঁধার কখনও সুধরাবে না, ” হায়দার বলল।
“আমরা দুজনও তোর সাথে থেকে উড়নচণ্ডী হয়েছি, আঁধার,” আতিফ বলল।
ইতিমধ্যে আঁধার সিগারেটে শেষ টান দিয়ে তা ফেলে দিয়েছে। বাইক স্টার্ট দিয়ে আগের মতো অতিরিক্ত গতিতে এগিয়ে যেতে যেতে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে সে বলে,
“আঁধার মাহমুদ বলে কথা।”

পেছন পেছন আতিফ ও হায়দারও চললো। আতিফ ও হায়দার জোরপূর্বক আঁধারকে ক্লাবে নিয়ে যায়৷ এমনটা প্রায়’ই ঘটে। আঁধার বাবা-মায়ের টাকা নষ্ট করলেও এসমস্ত ক্লাবে বা বারে গিয়ে মদ্যপান সে করে না। খারাপ কিছু বলতে সিগারেটটুকুই, এর বেশি না।
উচ্চশব্দ, মানুষের ভীড়, নাচানাচি এসবে তার বিরক্ত লাগছে। আতিফ ও হায়দারের সাথে ভীড় ঠেলে বারে যায়। বার ম্যান কিছুটা এগিয়ে এসে কি পান করবে জিজ্ঞাসা করে। আতিফ ও হায়দার বিয়ারের কথা বললেও আঁধার কোমল পানীয়ের কথা বলে। এতে আতিফ বলে উঠে,

“সব জায়গায় আঁধারকে পাওয়া গেলেও, এই ক্লাব বা পার্টিতে আসলে কেন তাকে পাওয়া যায় না!”
“এটাই আঁধারের ব্যক্তিত্ব। আঁধার খারাপ ঠিকাছে, কিন্তু সস্তা নয় যে যার তার ব্যক্তিত্বের সাথে ব্যক্তিত্ব মিলে যাবে। খারাপেরও একটা লেভেল আছে বস!”
“বাহ! কি ডায়লগ দিলি আঁধার। তোর নামে,” আতিফের কথা শেষ হতেই আতিফ ও হায়দার এক ঢোক বিয়ার পান করে নেয়। কি ভেবে আঁধার বলে,
“আজকে তোদের বিয়ারের বিল আমি দিব। দেখি কতো খরচ করাতে পারিস।”
“বাহ! এতো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।”

আতিফ ও হায়দার একত্রে বলে উঠে। দুজন ইচ্ছামতো ড্রিংক করতে থাকে। যেদিন তিনজন ক্লাবে আসে একমাত্র আঁধার নিজের গাড়ি নিয়ে আসে, যেটাতে করে আতিফ ও হায়দারকে বাড়ি পৌঁছে দেয় সে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। আতিফ ও হায়দারকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আঁধার নিজের গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় ঠিকই, কিন্তু সে বাড়ির পথে যায় না। নির্দিষ্ট একটি এলাকার গলির মোড়ে গাড়ি থামায় আঁধার। নিজের মুখে একটি রুমাল পেঁচিয়ে নেয় সে। অতঃপর সামনের একটি রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। হাতে থাকা গাড়ির চাবিটি হাতের আঙুলে নিয়ে ঘুরাচ্ছে সে। দেখে নির্ঘাত কোন মাস্তান মনে হচ্ছে। বড়বড় বিল্ডিং অতিক্রম করে সে এগিয়ে যাচ্ছে। কোন বিল্ডিং এর একটি জানালাও খোলা নেই, আর না আছে বাতি জ্বালানো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ঘুমন্ত শহর এবং সেই শহরের নিশাচর আঁধার।
হেঁটে যেতে যেতে একটি ছোট বাড়ি অতিক্রম করার সময় তার কানে সুমধুর নারী কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত এসে বারি খায়। কয়েক কদম এগিয়ে গেলেও সে পিছিয়ে আসে। মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে সে কুরআন তেলওয়াত। শুনতে শুনতে তার শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। এক শীতল শিহরণ বয়ে যায় সমস্ত শরীরে। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুনছে তেলওয়াত। হঠাৎ কুরআন তেলওয়াত থেমে যায়। উঁকি দিয়ে আঁধার দেখতে পায় কক্ষটির জানালা লাগানো। আঁধার বুঝতে পারে যিনি কুরআন তেলওয়াত করছিলেন, তিনি ইতিমধ্যে শুয়ে পড়েছেন। বাড়িটি ভালোমতো দেখে সে। চলতে থাকে নিজ গন্তব্যে।

পরদিন সকালে,

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আঁধার আবারও একই পথের উল্টো দিকে হাঁটছে। দ্রুত নিজের গাড়িতে উঠে বসে সে। ড্রাইভ করে চলে যায় নিজের বাড়িতে। আঁধারের পরিবারের সদস্যরা তখনও ঘুমাচ্ছিল। নিজের কক্ষে গিয়ে চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আঁধার। চোখে তার ঘুম নেমে আসে। তার সেই ঘুম ভাঙে দুপুরের পর। আতিফ ও হায়দার বহুবার কল করেছে আঁধারকে। ফোনের স্ক্রিনে পঞ্চাশের উর্ধে কল দেখেও ফোন ব্যাক করার প্রয়োজন মনে করে নি সে। নিজের মতো কাজ করছে। চুপচাপ প্রস্তুত হয়ে ডাইনিং এ গিয়ে বসে। বাড়ির কাজের লোক এসে তাকে খাবার দিয়ে যায়। ইতিমধ্যে তার মা আমেনা এসে তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে অন্য একটি টেবিলে বসেন। দেখে মনে হবে আমেনা আঁধারের বড় বোন, সে এতটাই যুবতী রয়েছেন এখনও। আঁধার নিজের মতো খাচ্ছে, একবারের জন্য তাকায়ও নি তার মায়ের দিকে। আমেনা খেতে খেতে আঁধারকে জিজ্ঞাসা করে,
“গতরাতে কি তার কাছে গিয়েছিলে?”
“যেখানে যাই, আপনাদের মহলে ফিরে এসেছি তো। এতেই অনেক,” কথাটা বলে আঁধার খাবার রেখে উঠে যায়।
আমেনা পিছু ঘুরে আঁধারের চলে যাওয়ার দিকে তাকায়। অতঃপর বিরক্তিকর এক শব্দ করে খাবারে মন দেয়। আঁধার বাইকের কাছে আসতে না আসতেই আতিফের আরেকবার কল দেয়। আঁধার কল রিসিভ না করে কেটে দেয়। এতে বুঝতে পারে আঁধার তার পথে। কান থেকে ফোন নামাতে দেখে হায়দার প্রশ্ন করে,

“কিরে? ধরলো না?”
“না ব্যস্ত দেখিয়েছে।”
“ওহ, তবে রাস্তায় আছে।”
“একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস?”
“আঁধারের পরিবারের ব্যাপারে?”
“হুম। কেমন যেন! আট-দশটা পরিবারের মতো না। আঁধার নাকি তার সতেরো বছর বয়স থেকে বাবা-মায়ের সাথে দরকার ছাড়া অতিরিক্ত কথা বলে না।”
“হ্যাঁ, শুনেছি বাবা-মায়ের সাথে তার সম্পর্ক আটদশটা পরিবারের মতো না, দূরত্ব বজায় রাখে না-কি!”
“কখনও আমাদের তার বাসায়ও নিয়ে যায় নি। এমন-কি নিজেদেরও যেতে নিষেধ করেছে।”
আতিফের কথা বলা শেষ হতে না হতেই আঁধার এসে হাজির হয়। বাইক থেকে নেমে সে তার হাতের দস্তানা খুলে নিতে নিতে বলে,
“কাকে নিয়ে কথা বলছিস? কে কাকে কি নিষেধ করেছে?”
“না, কিছু না। এমনি ক্যাম্পাসের বিষয়ে কথা বলছিলাম,” হায়দার দ্রুত বলে উঠে।
“কেন, ক্যাম্পাসে কি হয়েছে?” আধাঁর কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে।
“ক্যাম্পাসে আমাদের সিনিয়র আয়াশ আছে না? তার বিষয়ে, ” আতিফ হুট করেই বলে উঠল।
“আবার কোন গ্যাঞ্জাম করেছে না-কি?”
“ক্যাম্পাসের মেয়েরা তার জন্য বেশ বিরক্ত,” আতিফের কথায় আঁধার বিরবির করে কিছু বলতে বলতে মাথা নাড়ায়। কি ভাবছে কে জানে! হঠাৎ বলে উঠে,
“আগামীকাল ক্যাম্পাসে যাচ্ছি।”

আতিফ ও হায়দার একে অপরের দিকে তাকায়। আঁধার ডুবে যায় সিগারেটের ঘন ধোয়ায়।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here