আঁধারে_আলোর_হাতছানি ৩য় পর্ব

#আঁধারে_আলোর_হাতছানি
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া

  • ৩য় পর্ব
  • বিকালবেলা টিউশনি শেষ করে বাড়ির পথে হেঁটে যাচ্ছিলো আলো। হাঁটতে হাঁটতে সামনে কেউ চলে আসলে তাকে সুন্দর করে সালাম দিয়ে আবারও হাঁটতে থাকে। হঠাৎ আকাশে কালো মেঘের ভেলা এসে উপস্থিত হও। শুরু হয় ধমকা হাওয়া, যেন এই হাওয়া তার পথের সকল বাধাকে উড়িয়ে দিয়ে যাবে। ধুলাবালিতে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি বর্ষিত হবে তা বেশ ভালো বুঝতে পারছে আলো। দ্রুত পায়ের গতি বাড়ায়, কিন্তু লাভ হয় না কোন। মুশলধারায় বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে আলো একটি বিল্ডিংয়ের নীচে আশ্রয় নেয়। ঝুমঝুম বৃষ্টি পতিত হচ্ছে তো হচ্ছে৷ থামার কোন নামগন্ধ নেই। কি মনে করে আলো এক হাত বাড়িয়ে দেয়। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পানি জমছে তার হাতের মুঠোয়। বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির পানির ছিটা এসে তার চোখে মুখে লাগছে। মুহুর্তে বৃষ্টি এসে শহরকে উনি স্তব করে দিয়েছে। নীরব পরিবেশে দৃষ্টি বিলাস করতে বেশ ভালো’ই লাগছে আলোর৷ ফোনের রিংটোনের শব্দে উড়নায় হাত মুছে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সে। ফোন রিসিভ করেই বলে,

    “আসসালামু আলাইকুম, বাবা।”
    “ওয়ালাইকুম আসসালাম৷ কোথায় তুমি, মা?”
    “বাবা, বৃষ্টির জন্য আটকে গিয়েছি। ছাতাটাও নিয়ে আসি নি, একটা বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে আছি।”
    “তুই সেখানেই অপেক্ষা কর, আমি আসছি।”
    “জ্বি, আচ্ছা।”

    নিজ এলাকাতেই টিউশনি করালেও তার ছাত্রের বাসা নিজ বাসা থেকে বেশ দূরে। তার বাবার কথামতো আলো সেখানেই দাঁড়িয়ে তার বাবার অপেক্ষা করতে থাকে।
    আলোর বাবা দুটো ছাতা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছেন। পথিমধ্যে তাকে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। একদল ছেলে তার পথ আটকে ধরে। বলা যায় এলাকায় মাস্তানি করে বেড়ায় ছেলেগুলো। আলোর বাবা সাধারণ স্কুল শিক্ষক। মুটামুটি সকলেই তাকে চেনে। অভদ্র ছেলেদের থেকে একজন বলে উঠে,
    “মাস্টার মশাই, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
    “আসসালামু আলাইকুম, এই একটু সামনে যাচ্ছি,” আলোর বাবা সুন্দরমতো সালাম দিয়ে উত্তর দিলেন।
    “বৃষ্টির মাঝে সামনে কেন, মাস্টার মশাই? মেয়েকে আনতে নাকি? আপনার কষ্ট করে যেতে হবে না, আমরা গিয়ে নিয়ে আসছি।”

    অভদ্র ছেলেগুলোর কথাটি খারাপ ইঙ্গিত বহন করে। আলোর বাবা চুপচাপ তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ছেলেগুলো পুনরায় তার পথ আটকিয়ে একই কথা বলে।
    বেশ অনেকক্ষণ ধরেই আলো অপেক্ষা করতে লাগল। অবশেষে তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তার বাবা এসে উপস্থিত হলেন। একটি ছাতা মেয়ের হাতে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পথে চলতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে আলো প্রশ্ন করে,

    “বাবা, আসতে দেরি হয়েছে কেন?”
    “বৃষ্টি বাদলের দিন। রাস্তাঘাটে পানি তো আসতে একটু দেরি হবে স্বাভাবিক। ”
    “কিন্তু বাবা, বৃষ্টি হলেও তো একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে এতোসময় তোমার লাগে না। আজও কি সেই মাস্তানগুলো পথ আটকেছিল?”
    “সবটা যখন বুঝতেই পারিস, তখন প্রশ্ন কেন করিস?”
    “আজ কিভাবে ছাড়া পেলে?”
    “আয়াশের কারণে,” আলোর বাবা উত্তরে বলে। আলো কিছুক্ষণ মাথা নাড়ায়। আলোর বাবা আবার বলে উঠেন,
    “ছেলেটা বেশ ভালো হয়ে গিয়েছে।”
    “আল্লাহ তায়ালার পথে চললে যে কেউ ভালো হয়ে যাবে বাবা। বছরের বারো মাস তো আর বর্ষাকাল নয়,” আলো বলল।
    “তা ঠিক বলেছিস।”

    বাবা-মেয়ে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ি ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় আলো। তার মা সেখানে বিকালের নাস্তা তৈরি করছিলেন। আলো মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে,
    “চা বানিয়েছ, মা?”
    “হ্যাঁ, আমি চা বানাই আর তোর বাবা সবটুকু আমাকে পান করান। বিকালবেলা তোর বাবা তোর হাতের চা ছাড়া চা খায় না, সেটা জেনেও প্রতিদিন একই প্রশ্ন কেন করিস, আলো?”
    “মা, আসরের নামাজ আদায় করেছ? নিশ্চয়ই না। যাও যাও, বাকিটুকু আমি করে দিচ্ছি,” আলো পেছন থেকে ঠেলে তার মা’কে রান্নাঘর থেকে বের করে দেয়।
    বাকি কাজ শেষ করে তিনটি কাপে চা ঢেলে নিয়ে বসার কক্ষে যায় আলো। তার বাবা সেখানে বসে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। টেবিলের উপর ট্রে রেখে একটি চায়ের কাপ তার বাবার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আলোর বাবা হেসে কাপটি নিতে নিতে বলেন,

    “এতক্ষণ বিরক্ত লাগছিল। আলোর হাতের চা পান করলে এবার যদি একটু স্বস্তি পাই।”

    বাবার কথায় আলো মুচকি হাসে। নিজের চায়ের কাপ হাতে নিতেই তার মা-ও এসে উপস্থিত হয়। চা পান করে বেশ খানিকক্ষণ গল্প করে তিনজন। নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলে তার বাবার পিছুডাকে ফিরে তাকায়। আলোর বাবা বলে,
    “সময় থাকলে কয়েকটা খাতা দেখে দে তো, মা।”
    “দাও, বাবা। দেখে দিচ্ছি,” বলতে বলতে অর্ধেকের মতো খাতা নিয়ে আলো নিজের কক্ষে চলে যায়৷
    গভীর রাত পর্যন্ত খাতা দেখতে দেখতে সেভাবেই ঘুমিয়ে যায় আলো। বিছানার উপর তার আশেপাশে খাতায় ছড়াছড়ি৷ সকালে আযানের সুরে তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে উঠে সবগুলো খাতা গুছিয়ে নেয় সে৷ টেবিলের উপর খাতাগুলো রেখে ফ্রেশ হয়ে ওজু করে নেয় এবং ফজরের নামায আদায়ের সাথে কিছুক্ষণ কুরআন তেলওয়াত করে।
    মায়ের সাথে সকালের নাস্তা বানানোতে সাহায্য করে সকালের নাস্তা করে নেয়। খাবারের সময় আলোর মা আলোকে জিজ্ঞাসা করে,
    “আজ কি ভার্সিটিতে যাবি?”
    “হ্যাঁ, মা। নোট সংগ্রহ করতে হবে।”
    “আচ্ছা, সাবধানে যাবি।”
    “বাবা,” খাওয়া থামিয়ে সংকোচ নিয়ে আলো তার বাবাকে ডাকে।
    “কিছু বলবি?”
    “আসলে, ম্যাথম্যাটিকসে আমি খুব কাঁচা৷ যদি কিছুদিন প্রাইভেট টিউট,,,” আলোর কথা অসম্পূর্ণ রেখে তার বাবা জিজ্ঞাসা করেন,
    “টিচার ঠিক করেছিস? মানে কার কাছে পড়বি?”
    “না, তা এখনও ঠিক করি নি।”
    “টিচার ঠিক করে এসে টিচার সম্পর্কে তথ্য আমায় দিস। ভেবে তারপর জানাবো, পড়বি কি-না।”
    “হুম, আচ্ছা,” এতটুকু কথাতেই আলো খুশি হয়ে যায়।
    বাকি খাবারটুকু শেষ করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আলো। আলোর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার দুই বান্ধবী ও আয়াশ। তারা চারজন একই ভার্সিটির ও একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় একত্রে যাতায়াত করে। যদিও আয়াশ তাদের সিনিয়র। আয়াশ আলো ও শায়েলাকে বোনের নজরে দেখলেও, তিশার জন্য তার মনে আলাদা অনুভূতি। আর এই অনুভূতি তখনই বুঝা যায়, যখন আয়াশ তিশার আশেপাশে থাকে৷ অন্য কেউ না বুঝতে পারলেও আলো ঠিক বুঝতে পারে। আলো তাদের কাছে এসে পৌঁছাতেই আয়াশ বলে,

    “তোর আহারপর্ব তবে শেষ হলো, আলো রহমান?”
    “না, শেষ হয় নি। ভাই পথিমধ্যে ফুচকা খাইয়ে দিস!” আলোর উত্তরে আয়াশের কপালে হাত। তা দেখে তিশা হেসে বলে,
    “আলোকে কিছু বললেও প্যাঁচে পড়তে হয়, তাই না, আয়াশ ভাই?”
    আয়াশ তিশার কথার কোন উত্তর দেয় না, আর না তার দিকে ফিরে তাকায়।
    “আচ্ছা, চল এবার।”
    শায়েলা তাড়া দিয়ে বলে। বাস স্টপেজে এসে বাসে উঠে বসে চারজন। হঠাৎ আলোর উদ্দেশ্যে শায়েলা প্রশ্ন করে,
    “আঙ্কেলকে জানিয়েছিস ম্যাথম্যাটিকসের কথা?”
    “হুম, জানিয়েছি। কিন্তু,” আলো উত্তরে অসম্পূর্ণ কথা বলে।
    “কিন্তু আঙ্কেল নিষেধ করেছে, তাই তো?” তিশা প্রশ্ন করে।
    “আরে না। নিষেধ করে নি। বরং টিচার ঠিক করে জানাতে বলেছে,” আলো উত্তরে বলে।
    “তাহলে কিন্তু আসে কেন?” শায়েলার পুনরায় প্রশ্নে আলো বলে,
    “ভার্সিটি লেভেলে এসে টিউটর খোঁজার আগে বেতনটার কথা মাথায় আসে। বাবা কিভাবে ম্যানেজ করবে?”
    “সিনিয়রদের কাছেও পড়তে পারিস। ভার্সিটি টিউটরের থেকে কম’ই চাইবে,” আয়াশ সবটা শুনে বলল।
    “তোমার পরামর্শ তো ঠিকাছে, ভাই। কিন্তু, পাবো কোথায়?”

    আলোর প্রশ্নে সবাই হতাশ হয়ে চুপ হয়ে যায়। ভার্সিটির গ্যাটের কাছাকাছি এসে ব্যাগের ভেতর পানির বোতল রাখতে রাখতে হাঁটছিল আলো। হঠাৎ কয়েকজন ছেলে তাদের সামনে আসায় থ্রমে দাঁড়ায়। কিন্তু আলো তাদের দিকে না তাকিয়ে বাকিদের চলাচল অনুমান করেই থেমে যায়। যখন সামনের দিকে তাকায় তখন একটা হাত আয়াশকে চড় মারার জন্য এগিয়ে আসছিল। কিছু চিন্তা না করে হুট করেই আলো সেই হাতটি ধরে ফেলে ও চোখবন্ধ করে ফেলে ভয়ে।

    চলবে,,,,,,,,,, See less

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here