আকাশে তারার মেলা পর্ব ৮+৯

#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -৮

কালো একটা শাড়ি পড়ে চা বাগানের মাঝখানে দৌড়াচ্ছে তুলি। আবার পিছন ফিরে ফিরে খিলখিল করে হাসছে। কালো পাঞ্জাবির হাতা টা ফ্লোড করতে করতে দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে আদ্র। ঠোঁটে তৃপ্তির মনকাড়া এক হাসি। ছয় ফুট লম্বা,ফর্সা চেহারার মায়ায় গড়া যুবক কে কালো পাঞ্জাবি তে তুলির কাছে কল্পনার রাজ্যের নায়ক মনে হচ্ছে। আদ্রর হাসি দেখে থমকে গেল তুলি। হাসি টা অন্তরে গিয়ে বিঁধছে। পা নাড়ানোর শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলল । আদ্র দৌড়ে এসে তুলি কে হ্যাঁচকা টানে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসল। শ্বাস প্রশ্বাস ক্ষণিকের জন্য আটকে গেল তুলির। আদ্রর মুখ পানে লাজুক দৃষ্টি তাক করতেই খালি কোমরে নিজের ঠান্ডা হাত টা রাখল আদ্র। কেঁপে উঠল তুলি। খামচে ধরল আদ্রর বুকের কাছের অংশ। একটু হেসে আদ্র একটুখানি ঝুঁকল তুলির মুখের দিকে। দুজনের ঠোঁট কাছাকাছি। আদ্রর নরম ঠোঁট দুটো যেন তুলি কে টানছে ভীষণ করে। ভিতর জুড়ে শুরু হল প্রচন্ড তোলপাড়।নিজের ঠোঁটে আদ্রর ঠোঁটের হালকা স্পর্শ অনুভব করতেই চোখে মুখে বৃষ্টির ছটা আবিষ্কার করল। রৌদ্রময় দিনে বৃষ্টির আগমন। উহু! আবারও আদ্রর ঠোঁট কে আঁকড়ে ধরতে নিলে ভিজে চুপেচুপে হয়ে গেল পুরো মুখ। লাফ দিয়ে উঠে বসল তুলি। আমরিন কে দেখে মুখ ফুলিয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল। উচ্চস্বরে আমরিন দুষ্ট হেসে বলে উঠল,,,

–“সারা রাত আমার ভাইয়ের বুকে ঘুমিয়ে পুষে নি তাই না? এখন আবার পরে পরে ঘুমচ্ছিস। তাড়াতাড়ি রেডি হন বাহিরে যাব আমরা। দেরি হলে কিন্তু ভাইয়া এসে রেডি করিয়ে দিবে তার জন্য মোটেও কতৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।”

আমরিনের কথায় লজ্জা পেয়ে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল তুলি। এসে গোসল করে নি। লং জার্নি করে টায়ার্ড হয়ে পড়েছিল। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। ইশ! কি রকম স্বপ্ন দেখল আদ্র কে নিয়ে। নিজেকে নিজেই ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা যদি সত্যিই এমনটা হয়?আর ভাবতে পারছে না তুলি। কিভাবে প্রকাশ করবে নিজের মনের কথা আদ্রর সামনে? এই সাহস যে নেই। আদ্র যদি ফিরিয়ে দেয় অথবা থাপ্পড় মেরে দেয় সেটা ভেবেই শিউরে ওঠে তুলি। কি দরকার ছিল আদ্রর বুকে ঘুমানোর?এখন আমরিন ও রসাত্মক কথা শুনাচ্ছে। আমরিন ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিয়ে বলল,,,

–“তুলি আমি বাহিরে যাচ্ছি। তুই রেডি হয়ে চলে আয় শীগ্রই। ”
আমরিনের কথায় তুলি অস্ফুটস্বরে জবাব দিল,,,

–“হুম”

শাওয়ার নিয়ে খেয়াল হল কাপড় আনে নি সাথে। তখন স্বপ্ন ও আমরিনের কথা ভেবে লজ্জার ঘোরে বেমালুম ভুলেই গেছে কাপড় আনতে। কি আর করার?শরীরে ভালো করে তোয়ালে পেচিয়ে দরজা মেলে মাথা বের করে দেখল কেউ নেই রুমে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এক দৌড়ে গিয়ে কাপড় নিয়ে আসল ব্যাগ থেকে।লাল একটা ড্রেস পড়ে রুমে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে ভেজা চুল ঝাড়তে লাগল। হঠাৎ আয়নায় নজর যেতেই ভিতরকার ছোট্ট প্রাণটা বেড় হয়ে যাওয়ার উপক্রম তুলির। কারণ আয়নায় তুলি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দেয়ালে হেলান দিয়ে আদ্র বুকে হাত গুঁজে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। হাতের টাওয়াল টা ফেলে ঝটপট ওড়না টা গায়ে দিল তুলি।আদ্র কখন এলো দরজা তো লাগানো। তার মানেই আগেই এসেছেন? ওহ নো! ওনি কি দেখে ফেলেছেন? একটু আগের কথা মনে পড়তেই অভিশঙ্কিত হয়ে পড়ল তুলি। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,,

–“আপনি কখন আসলেন আদ্র? ”

–“বিশ মিনিট হবে।”

এবার বোধহয় তুলি বেহুশ হয়েই যাবে। তার মানে আদ্র টাওয়াল পড়া অবস্থায় দেখে ফেলেছে? তুলি কন্ঠে জড়তা নিয়ে বলল,,

–” তার মানে আপনি সব দেখে ফেলেছেন?”

ভ্রু কুঁচকে তাকাল আদ্র। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল তুলির দিকে। তুলি নড়ার শক্তি টুকু ও হারিয়ে ফেলল। ফ্লোরে পা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। কাছে এসে টাওয়াল টা দিয়ে তুলির ভেজা চুল গুলো মুছে দিতে দিতে আদ্র বলল,,

–“কি দেখার কথা বলছো তুলি?আমি এতোক্ষণ বেলকনিতে ছিলাম। নাস্তা করে তাড়াতাড়ি বের হতে হবে আমাদের।”

তুলি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। মুচকি হেসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে রেডি হয়ে নিল। চুল গুলো ছেড়ে রাখল। তারপর আদ্রর সাথে বেরিয়ে এল বাহিরে। রিসোর্ট টা বেশ সুন্দর। আগে থেকেই বুক করে রেখেছিল আদ্র। পুরো রিসোর্ট টা একাই শুধু নিজেদের জন্য বুক করেছে। তুলি আগে আগে যেতে নিল পিছন থেকে ডাকল আদ্র। বিস্ময় নিয়ে তাকাল তুলি। একটু হেসে আদ্র তুলির হাত টা মুষ্টিমেয় করে এগিয়ে যেতে লাগল সামনের দিকে। আদ্রর ছোঁয়া তুলির অন্তর কে নাড়িয়ে দেয় বার বার। অপলক চোখে আদ্রর দিকে তাকিয়ে রইল তুলি। আদ্রর হাটার তালে টানে টানে এগিয়ে যাচ্ছে সে। খাবার টেবিলের কাছে আসতেই অন্তু হেসে বলে উঠল,,,

–“স্পেশাল দু’জন মানুষ চলে এসেছে ভাই। তা আপনারা কি হারিয়ে গিয়েছিলেন অন্য জগতে? আপনাদের খুঁজতে খুজতে আমার পেটের অবস্থা খুবই বিভৎস।”

আদ্র তীক্ষ্ণ নজরে চাইল অন্তুর দিকে। হি হি করে হেসে উঠল অন্তু।

–“কি ভাই তুই ডাক্তার হইয়া এমন মাফিয়া গো মতো ভয় দেখাস কা? তোকে ডাক্তার কেডা বানাইছে? হার্ট সার্জন হইলি কেমনে ভাই?তোর চোখ রাঙানো তেই তো হার্ট এট্যাক হওয়ার উপক্রম। ও তুলি সাবধানে থাইক্কো। নিজের ছোট্ট হৃদপিন্ড টা রে সামলাই রাইখো।”

অন্তুর মুখের কথা শুনে হু হু করে হেসে উঠল সবাই। তুলি কে চেয়ার টেনে বসিয়ে আদ্র চেয়ারে বসতে বসতে পায়েলের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,,

–” পায়েল এই মদন রে দুই বেলা ঝাড়ু পেটা করিস। যা অবস্থা দেখছি মনে হয় না বেশিদিন সংসার করতে পারবি। শেষমেশ তোর মদন জামাই রাস্তাঘাটে গণ পিটুনি খেয়ে প্রাণ টাই হারাবে।”

আদ্রর কথা শুনে আবারও হাসির রোল পড়ে গেল। নাস্তা করে সবাই বেরিয়ে পড়ল মালনীছড়া চা বাগানের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে নিবিড়ের পাশের সিটে বসল আমরিন। কিছুটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর হুট করে প্রশ্ন করল,,,

–“আপনি কাউকে ভালোবাসেন নিবিড় ভাইয়া?”

অদ্ভুত চাহনি নিয়ে আমরিনের দিকে তাকাল নিবিড়। এ প্রশ্ন টা তার ভিতরে জমে থাকা অনুভূতি গুলো কে জাগিয়ে তুলল। মন বলছে এটাই সুবর্ণ সুযোগ নিবিড়। পরক্ষণেই মনে হল না সঠিক হবে না। আমরিন উত্তরের আশায় চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে। প্রশ্ন টা সে সুযোগ বুঝে ইচ্ছে করেই করেছে। নরম স্বরে জবাব আসল,,

–“না।”

উত্তর টা বিশেষ পছন্দ হল না আমরিনের। তাই অন্য টেকনিক অবলম্বন করল।

–“আচ্ছা ভাইয়া আমি একটা কথা বলব। ভাইয়া কে বলবেন না প্লিজ। আমি না একটা ছেলে কে ভালোবাসি। কিন্তু কিভাবে বলব সেটাই বুঝতে পারছি না।”

অসহনীয় পীড়া অনুভব করল নিবিড় বুকের বা পাশ টায়। নিষ্পলক চোখে চাইল আমরিনের দিকে। বিমূর্ত মৃদু স্বরে বলল,,

–” কাকে ভালোবাসো আমরিন?আর সত্যিই কি ভালোবাসো? এটা তোমার বয়সের আবেগ ও হতে পারে।”

তীব্র রাগ পেল আমরিনের। রাগী কন্ঠে বলল,,

–“আমি সত্যিই ভালোবাসি ভাইয়া।”

চড়চড় করে রাগ চেপে বসল নিবিড়ের মাথায়। নিজেকে শান্ত রাখার অগাধ চেষ্টা করেও রাখতে পারল না শেষ পর্যন্ত। আমরিনের কোমরে হালকা চাপ দিয়ে নিজের কিছু টা কাছে নিয়ে এল। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল আমরিন। চোখ দুটো লাল নিবিড়ের। আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিলে হুঁশশ করে উঠল নিবিড়।

–” এ বয়সে ভালোবাসা মারাও তাই না? হাত পা কেটে আমার বাহুতেই রেখে দিব বেশি পাকনামি করলে। কোনো ছেলের ধারে কাছে ও যদি দেখি তবে আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না। মনে আমি ব্যাতিত অন্য কেউ থাকলে রিমুভ করে দাও। দু দুটো বছর ধরে আমার মনে আগুন জ্বালিয়ে এখন অন্য কারো হওয়ার ভাবনা? ছেড়ে দেবার পাত্র আমি না। শুধু মাত্র ভদ্রতার খাতিরে চুপ ছিলাম।”

রাগী স্বরে কথাগুলো বলে আমরিন কে ছেড়ে দিল। স্তব্ধ হয়ে রইল আমরিন। কি ছিল এটা? নিবিড়ের এমন এক রূপ অকল্পনীয়। নিবিড় কে জেলাস ফিল করাতে গিয়ে নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেল বেচারি। আমরিনের চশমা টা মুছে চোখে পড়িয়ে দিল নিবিড়। হাত টা মুঠোয় পুরে বলল,,,

–” আমার হৃদয়ে দহন জালানো প্রথম রমণী তুমি চাশমিশ।”

_______

মালনীছড়া চা বাগান যা উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় এবং সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান হিসেবে ধরা হয়।সুন্দর মুহূর্ত কাটানোর জন্য পর্যটকদের কাছে পছন্দের একটা স্থান অপরুপ সৌন্দর্যে ভরপুর এই চা বাগান। গাড়ি থেকে নেমে তুলি আনন্দে চেপে ধরল পাশে থাকা আদ্রর হাত। খুশিতে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না একদম। হালকা হাসল আদ্র। এই ছেলের হাসি টা মানুষ কে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। এই যে রিমি কে ও ঘায়েল করে নিল আরো একবার। কিন্তু দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়া কিছুই নেই তার কাছে। কলেজ জীবনে আবেগময় সেই বয়সে আদ্রর মায়ায় পড়ে গিয়েছিল রিমি। কিন্তু বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে আজও মন খুলে পারে নি নিজের কিশোরী জীবন থেকে হৃদয়ে সঞ্চারিত সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে। আর কখনও করাই হবে না। কারণ আদ্র যে মাতোয়ারা অন্য কারো মোহ তে। মাতোয়ারা বললে ভুল হবে পুরো বন্ধুমহল জানে মেয়েটা কে ছাড়া আদ্রর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। তুলি ও আদ্রর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল রিমি। তার মতে থাকনা কিছু ভালোবাসা অপ্রকাশিত। একপাক্ষিক ভালো কয়জনই বা বাসতে পারে? সে পেরেছে। তার মধ্যে ও অন্যরকম সুখ খুঁজে পায় রিমি।

তুলির কান্ড দেখে আর বিলম্ব করল না আদ্র। হাত ধরে এগিয়ে গেল চা বাগানের ভিতরে। কিন্তু তুলি সে তো উড়তে চাইছে মুক্ত পাখির মতো। বুঝতে পেরে হাত টা ছেড়ে দিল আদ্র। নিজেও দ্রুত পা চালাতে লাগল তুলির সাথে। অন্যদিকে অন্তু-পায়েল, রিমি-সাগর,নিবিড় -আমরিন সবাই জোড়ায় জোড়ায় হাটছে। অন্তু-পায়েল ব্যতীত বাকি কেউ যুগল না হলেও যে কেউ দেখলে অনাসয়ে বলবে এরা একে অপরের সাথে বন্ধনে বাঁধা। দূরে কিছু মহিলাদের চা পাতা তুলতে দেখে দৌড়ে গেল তুলি। কোনো দিকেই খেয়াল নেই তার। প্রফুল্লতা বিরাজ করছে তার মাঝে। দু গালে হাত রেখে অবাক হওয়ার দরুন তাকিয়ে রইল মোহময় দৃষ্টিতে। তুলির এমন চাহনি দেখে খুব হাসি পেল সবার। সেই সাথে আদ্রর মনে শুরু হল ভালো লাগার বিস্তৃত। ঝটপট মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দী করে নিল মুহুর্ত টা। বাকি সবাই আলাদা আলাদা হয়ে ঘুরতে লাগল। আদ্র তুলি কে টেনে অন্যদিকে নিয়ে আসল। মুখ ফুলিয়ে ফেলল তুলি।

–“আপনি আমায় নিয়ে আসলেন কেন?”

–“সারাদিন কি চা পাতা তোলা দেখবে? উম! ভালোই হবে। চা পাতা তোলার কাজে লাগানো যাবে তোমাকে।এমনিতে তো সারাদিন আজাইরা থাকো আর যত্তসব উদ্ভট কথা বলে বেড়াও।”

কথার মাধ্যমে যে খোঁচানো হচ্ছে তা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে তুলি। হঠাৎ তুলির মনে প্রশ্নের বিস্তার হল।মনে হল এটাই মুখ্য সুযোগ উত্তর টা জেনে নেওয়ার।এক বুক সাহস জুগিয়ে আদ্রর আঙুল আঁকড়ে ধরল। থমকে গেল আদ্র। তুলির দিকে তাকাল বিস্ময় নিয়ে। চোখ বুঁজে কিছুটা শান্ত কন্ঠে তুলি প্রশ্ন করল,,,

–“আচ্ছা ডাক্তার সাহেব আপনি কখনও কাউকে ভালোবেসেছেন?”

প্রশ্ন করতেই হাতে তীব্র টান অনুভব করল তুলি। নিজেকে আবিষ্কার করল আদ্রর অতি নিকটে। আদ্রর চোখে মাদকতা বিরাজমান। চোখে চোখ রাখতেই হৃদপিন্ডের উঠানামা হতে লাগল দ্রুত গতিতে। চোখের কার্ণিশে ফুটে উঠল লজ্জার ছাপ। তবে কি তুলি যা ভেবেছিল তাই? মনের গহীন থেকে আওয়াজ আসল আদ্র তোকে ভালোবাসে তুলি। আদ্রর মন জুড়ে তোরই বসবাস। এখনই তা প্রমাণ করে দিবে আদ্র। মুড়িয়ে নিবে তোকে ভালোবাসার চাদরে। কথাগুলো যেন তুলিকে আরও কাঁপিয়ে তুলল। মনে খুশিগুলো দলা পাকিয়ে উঠল। আদ্র ধীরে ধীরে মুখ টা কানের কাছে নিতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তুলির। একদিকে মনে অজস্র অনুভূতির ছড়াছড়ি অন্যদিকে আজ নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে যাচ্ছে। আরেকটু স্থির হতেই কানের পাতায় আদ্রর কোমল অধরের উষ্ম ছোঁয়ায় নড়ে উঠল তুলি। তবে কি সত্যি হতে যাচ্ছে স্বপ্ন টা?আদ্রর স্পর্শ তুলির সারা দেহে শিহরণ জাগিয়ে তুলছে। মৃদু স্বরে আদ্র বলে উঠল,,

–“আমি,,,আমি একটা সিক্রেট বলব? ”

তুলির গাল দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ইচ্ছে করছে আদ্র কে জড়িয়ে ধরে বলতে,,–“থাকুক না মনের কথা মনে আপনি বরং আমায় মিশিয়ে নেন আপনার অস্তিত্বে।”

–“শুনবা না?”

আদ্রর কন্ঠে আদর মাখানো বাক্য টা উপেক্ষা করতে পারল না তুলি। মন তো খুব করে চাইছে “ভালোবাসি” শুনতে। আচ্ছা শুনার পর নিজেকে কিভাবে কন্ট্রোল করবে তুলি?জ্ঞান হারাবে না তো?দুর্বল কন্ঠে জবাব দিল,,

–“হুম।”

–“সিক্রেট টা হলো সকালে তোমাকে টাওয়াল পড়া অবস্থায় কিউট একটা পিচ্চি লাগছিল।”

ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে কথাটা বলে সরে এল আদ্র। তুলি চোখের আকৃতি এতো বড় হয়ে এল যে এই বুঝি কোটর থেকে বেরিয়ে যাবে। কানটা ও ঝালাপালা হয়ে গেল। কথাটা বজ্রপাতের ন্যায় শুনাল।লজ্জায়, অভিশঙ্কায় মাটি ফাক করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। সে কি ভেবেছিল আর কি হল? উল্টো ইজ্জত শেষ। তুলি কে লজ্জামিশ্রিত চেহারায় দেখে ঠোঁট প্রসারিত করল আদ্র। লজ্জা দেওয়ার জন্য আবারও একটু ঝুঁকে বলে উঠল,,,

—শুধু কিউট না হ***

দুঃসাহসিক এক কাজ করে বসল তুলি। অসমাপ্ত থেকে গেল আদ্রর কথা। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হল আদ্রর। পুরো শরীর জমে গেল। চোখের চারপাশ টা জমাট বাঁধা রক্তের মতো লাল হয়ে গেল। তুলির ঠোঁট দুটো আদ্রর ঠোঁটে নিবদ্ধ। ধাক্কা দিয়ে তুলি কে সরিয়ে দিল আদ্র। দু চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে যা নিমিষেই জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিবে তুলি কে। লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল তুলি। আদ্র কে আটকাতে গিয়ে আবেগের বশে ঠোঁট ঠেকিয়ে দিয়েছে আদ্রর ঠোঁটে। বুকটা হাহাকার করে উঠল। এ মুহুর্তে মরে যেতে পারলে বেশ হতো। আদ্রর ধাক্কায় মন বলছে আদ্র তাকে ভালোবাসে না। নয়তো এভাবে অগ্নি বর্ষণ হতো না তার চোখ থেকে। যন্ত্রণা টা প্রখর হতে লাগল তুলির। চোখ থেকে টুপটুপ জল গড়িয়ে পড়ছে। শব্দবিহীন আদ্র চলে গেল তুলি কে ফেলে। আর্তচিৎকার করে উঠল তুলির অন্তর টা। আদ্রর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল রক্তজবার মতো লাল চোখ দুটো নিয়ে।
#আকাশে_তারার_মেলা ✨
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -৯

❝ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে যেদিন থেকে আপনার আগমন
সেদিন থেকেই আমার আকাশে হাজারো তারার বিচরণ। ❞

বিষাদময় মন নিয়ে তুলি বাসে বসে আছে আমরিনের পাশে। বাস ছুটে চলেছে সুনামগঞ্জের লক্ষ্যে। মালনীছড়া চা বাগান থেকে ফিরে আদ্রর সাথে একটা কথাও বলে নি তুলি। আদ্র কে ফেইস করার সাহস টুকু আর নেই তার। আবেগের বশে বড্ড বড় ভুলে করে ফেলেছে সে। এমনটা করা উচিত হয় নি! আদ্র হয়তো খুব খারাপ ভাবছে তাকে। আদ্রর রাগী ফেইস টা চোখে ভাসলে এখনও কান্না পায় তার। সারাদিন রুম থেকে বের হয় নি। আদ্র একবার ডেকে পাঠিয়েছিল আমরিন কে দিয়ে তবুও যায় নি। আদ্র ও ব্যাপার টা বুঝতে পেরে আর জোর করে নি। কেন যে মনে ভালোবাসার উদয় হল! কেন একবারও মনে হল না যে আদ্র ভালোবাসে না। একটু চিন্তা করলে নিজেকে সামলে নিলে হয়তো আজ এমনটা হতো না। আজ তুলির কাছে একটা কথা চরম সত্য মনে হচ্ছে তা হল—”আমরা এমন কাউকেই ভালোবেসে ফেলি যাকে আমরা কখনও পাবো না।” নিজের প্রতি নিজেই লজ্জিত তুলি। বাহির থেকে বাতাস এসে চোখে মুখে ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। খোলা চুল গুলো ভীষণ বিরক্ত করছে। নিজের ছোট্ট ব্যাগ থেকে একটা রাবার ব্যান্ড বের করে চুল গুলো বেঁধে নিল তুলি। বিষন্ন মন নিয়ে আকাশের দিকে চোখ স্থির করল। আজকের চাঁদ টা একদম গোলাকার ও প্রশস্ত। আকাশ জুড়ে তারার ছড়াছড়ি। তুলির কাছে মনে হল আজ বোধহয় আকাশে তারার মেলা বসেছে।

হঠাৎই বুকটা শূন্যতায় ভরে গেল তুলির। মাথা ঘুড়িয়ে আড়ালে এক পলক চাইল আদ্রর দিকে। সিটে হেলান চোখ বুঁজে রেখেছে আদ্র। তুলির মন ছটফট করছে আদ্রর সাথে একটু কথা বলার জন্য। কিন্তু পারছে না সে। আদ্র ও যে সারাদিন একটু ও কথা বলে নি তার সাথে। আদ্রর আচরণে তুলি টের পাচ্ছে সে প্রচন্ড রকমের ভুল করে ফেলেছে। আদ্রর আচরণ তার বুকে অদৃশ্য ছুরি গাঁথছে যার প্রভাবে রক্ত ঝরছে অনবরত।কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না তুলি অসহনীয় এ যন্ত্রণা। মাথা ঘুরিয়ে সোজা হয়ে বসল তৎক্ষণাৎ।

ধপ করে চোখ মেলে তাকাল আদ্র। আঁড়চোখে তুলি কে পর্যবেক্ষণ করছে শুরু থেকেই। তুলির অসহায় চাহনি ও যেন এক রাশ মায়ায় জড়ানো তার কাছে। নিজের মোবাইল বের করে তুলির আজকের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকল নিষ্পলক। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।নিম্নস্বরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

❝ যদি পরিস্থিতি অনুকূলে থাকত তবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতাম তোমায়। তুমি যে বছরের পর বছর আমার অস্তিত্বে উড়ে বেড়ানো এক সর্বনাশী তুলা। যাকে ছুঁতে গেলেও হাজার বাঁধা পেরোতে হয় আমার। তুমি আমার জীবনের এক সর্বনাশ। যেই সর্বনাশে তলিয়ে গেছে আমার মন। বিক্ষত হয়েছে আমার হৃদয়। ❞
_______________

খানিকক্ষণ আগেই রিসোর্টে এসেছে সবাই। রিমি, আমরিন, তুলি এক রুমে উঠেছে। ফ্রেশ হয়ে বাহিরে এল তুলি। রিসোর্টের সামনে একটা জায়গায় বসে চাঁদের আলোয় আড্ডা দিচ্ছে সবাই। একটা টুলে বসতেই তুলির চোখ পড়ল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে স্মোকিং করা আদ্র কে। শেষ টান দিয়ে সিগারেট টা ফেলে দিল আদ্র। চোখ ঘুরাতেই চোখ পড়ল তুলির ছলছল চোখে। এক নজরে তাকিয়ে আছে তুলি যা কারোই চোখ এড়ায় নি। তুলির ঘন মেঘে ঢাকা মুখশ্রী সবাই কে জানান দিচ্ছে কিছু একটা ঘেটেছে আদ্র ও তার মাঝে। কিন্তু কেউ একটা প্রশ্ন ও করল না। সবাই জানে আদ্রই সামলে নিবে সব। তবুও নরমাল করার জন্য পায়েল ডেকে উঠল,,

“তুলি? ”

পায়েলের ডাকে স্বাভাবিক হল তুলি। চোখে টলটল করা পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নিল অবিলম্বে। মুখে হাসি টেনে পায়েল কে সম্মতি জানাল।

“তুৃমি তো আমাদের সবার ব্যাপারে জানোই না। তো একটু সবাই কে অন্যরকম ভাবে পরিচয় করাই তোমার কাছে দেখি ধরতে পারো কিনা?এটা একটা গেম ধরে নিতে পারো।খেলতে রাজি তো?”

–“অবশ্যই আপু।”

–“উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে বেড়ায় আর মেয়ে দেখলেই দাঁত কেলিয়ে রাখে। এক সময় কলেজে মেয়েদের পিছু পিছু ঘুর ঘুর করতো। একবার এক মেয়ের বাড়িতে রাতের বেলায় দেখা করতে গিয়ে চোর ভেবে মানুষের কাছে গণপিটুনি ও খেয়ে এসেছে। কে হতে পারে?”

তুলি সাথে সাথেই হেসে জবাব দিল,,–“অন্তু ভাইয়া।”

সবাই ফিক করে হেসে উঠল। পায়েল ও মুখ চেপে হাসছে। অন্তু একবার চোখ রাঙিয়ে আবার হি হি করে হেসে দিল।পায়েল আবারও বলল,,

–“চুপচাপ থাকে। প্রয়োজন ছাড়া কথা কম বলে। ডাক্তার হিসেবে মন্দ নয়। কে সেই ব্যক্তি?

–“রিমি আপু।”

মুচকি হাসল রিমি। জোর গলায় বলল,,

–“আমি মোটামুটি না অনেক ভালো ডাক্তার বুঝেছিস পায়েল?”

–“জ্বি ম্যাডাম।” মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,,,

—” চোখ দুটো মাদকতায় ভরপুর। গম্ভীরতা যেনো তার সৌন্দর্যের বিকাশ। তার এক চিলতে হাসি মেয়েদের জন্য ঘায়েল হওয়ার কারণ। তবুও তার আচরণে প্রকাশ পায় তাহার প্রেমে পড়া নিষিদ্ধ। ভুল করে পড়ে গেলেও খেতে হবে বলিষ্ঠ হাতের থাপ্পড়। ”

–“আদ্র”

ঘোর লাগা কন্ঠে লাফিয়ে বলে উঠল তুলি। সবাই একসাথে হেসে রসাত্মক সুরে বলে উঠল,,”ওহহ্ আদ্র!!!”
লজ্জায় এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটে চলে এল তুলি। পিছে যে আদ্র ছিল সেটা ও খেয়াল করে নি। তুলির পিছু পিছু আদ্র ও এল ছুটে। রুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে দু চোখ বুঁজে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগল। সারা মুখে গরম নিশ্বাস অনুভব করতেই আদ্র কে দেখে চমকে গেল তুলি। বিশ্বাস হচ্ছে না আদ্র ওর সম্মুখে দাড়িয়ে। চৌচির হয়ে যাওয়া মনে হঠাৎই যেন ঠান্ডা ঢেউয়ের দেখা মেলল। তৃষ্ণা মিটে গেল। পরক্ষণেই সকালের ঘটনা মনে পড়ে গেল। নিজেকে কিভাবে লুকাবে সেই চিন্তায় ডুবে গেল। কোনো উপায় না পেয়ে আদ্রর মোহনীয় দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলল,,

–“সকালের জন্য আমি দুঃখিত ভাইয়া। আমি বুঝতে পারি নি এমন কিছু হয়ে যাবে।”

আদ্রর মুগ্ধময় চেহারা মলিন হয়ে গেল। এক পা পিছিয়ে দাঁড়াল তুলির থেকে। ঘাবড়ে গেল তুলি। হঠাৎ কি হল বুঝতে পারছে না। আদ্র আবার মেরে বসবে না তো? ভয়ার্ত মন নিয়ে আদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সাহস করে এগিয়ে গেল কিছুটা। আদ্র যেন এটাই চাইছিল। তুলির গালে এক হাত রেখে মধুর সুরে বলে উঠল,,,

–“সকালে কেন রাগ দেখিয়েছিলাম জানো?”

মাথা নাড়িয়ে না বুঝাল তুলি। তুলির হাত টা শক্ত করে ধরে কাছে টেনে নিল আদ্র। তুলির ডাগরডাগর আঁখিতে নিজের নীলাভ চোখে দুটো রাখল।

–” সকালে এই চোখে আকর্ষণ ছিল। নেশা ছিল যা হৃদয়ের গহীনে আঘাত করছিল। যার জন্য আমার এতো সাধনা, যার একটুখানি ভালবাসা পাওয়ার জন্য আমি তৃষ্ণার্ত তার চোখে ভালোবাসার বদলে আবেগ, নেশা সহ্য করতে পারি নি আমি। এখন চোখ দুটো তে সরলতা, ভালোবাসার সমাহার, এক রাশ লজ্জা। আকর্ষণ, নেশা এক সময় ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ভালোবাসা আবেগের বশে হয় না। নেশা কেটে গেলে আমরা স্বাভাবিক হয়ে যায়। অথচ ভালোবাসা আমাদের কখনও স্বাভাবিক থাকতে দেয় না। ক্ষণে ক্ষণে বুকে ঝড় তুলে। গভীর হতে থাকে। বিরাজ করতে থাকে হৃদয় জুড়ে। মানুষ টা হারিয়ে গেলে আমরাও হারিয়ে যায়। সুখ গুলো হারিয়ে যায়। স্মৃতির পাতায় সজীব থাকে চিরকাল। আমি আকর্ষণ বা নেশা কোনোটাই চাই না। আমি তো ভালোবাসা চাই তুলি যেন আমার শূণ্যতায় তোমার হৃৎস্পন্দন থেমে যাবে, বুকটা হাহাকার করে উঠবে বারে বার। নেশায় ডুবে না আমার ভালোবাসায় ডুবে তুমি আলিঙ্গন করে নাও আমায়। ”

টুপ করে অশ্রু ঝড়ে পড়ল তুলির চোখ থেকে। অনুভূতিরা ছুটাছুটি করছে অন্তর জুড়ে। ছোট্ট মন টা সেকেন্ডেই নিজেকে সাতাশ বছরের যুবতী ভাবতে লাগল।আদ্রর কথার মানে স্বচ্ছ পানির মতো পরিষ্কার মনে হল তার। ভুল ছিল না তার মন। বহু কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে আজ হাসতে ভুলে গেল তুলি। অশ্রুসিক্ত নয়নে চাইল আদ্রর দিকে। অনুরোধের সুরে বলল,,,

–“আমায় একটু উঁচু তুলে দিবেন ডাক্তার সাহেব? আমি আপনার গাল টা নাগাল পাচ্ছি না। এতো লম্বা কেন আপনি?”

পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে ইশারা করল আদ্র। বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে গেল তুলি। জড়তা-সংকোচ নিয়ে বলল,,,

–” আপনি আমার অনেক বড়। আপনার পায়ের উপর পা রাখলে বেয়াদবি হবে না?”

–“একদমই না তুলা। উঠো।”

জুতা জোড়া খুলে ফেলল আদ্র। খালি পায়ে তুলি উঠে দাঁড়াল আদ্রর পায়ের উপর। পড়ে যেতে নিলে কোমড় জরিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল আদ্র। কাঁপা কাঁপা হাতে গালে হাত রাখল তুলি। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে লাগল। হুট করেই কেঁদে উঠল শব্দ করে। অসম্ভব যন্ত্রণা অনুভব করল আদ্র। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,,

–“কি হয়েছে তুলি?”

—“আপনি কি আমায় ভালোবাসেন আদ্র?”

—“সন্দেহ আছে?”

–“একদমই না।”

কথাটা বলেই আদ্রর কপালে কপাল ঠেকাল তুলি। এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল আদ্রর চোখের পাতায়। নিজের কম্পনরত ঠোঁট নিয়ে ঠেকাল আদ্রর কপালে। শীতল স্রোত বয়ে গেল আদ্রর শিরদাঁড়া বরাবর। লজ্জার ছাপ ফুটে উঠল তুলির চেহারায়। সরে আসতে নিলে কোমড় চেপে ধরে আরও কাছে টেনে নিল আদ্র। নিজের ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরল তুলির ওষ্ঠে। হৃদয়ের কম্পন প্রখর হতে লাগল তুলির। এমন অনুভূতি জীবনে আজ প্রথম! তুলি দু চোখ বুজে নিল অবলীলায়। মিনিট পাঁচেক পর ছেড়ে দিল আদ্র। ছাড়া পেতেই তুলি মুখ লুকাল আদ্রর বুকে। নিমিষেই তুলির কাছে মনে হল পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তির স্থান হয়তো এটা। আদ্রর হৃদপিণ্ডের স্পন্দন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল তুলি। হয়তো পরিমাপ ও করতে পারছে। ভালোবাসার মানুষ টা কাছে থাকলে বুঝি এমনই হয়? আজ সকালেই কত কষ্ট পাচ্ছিল তুলি আর এখন এই রাতের আঁধারে প্রিয়তমের বুকে মাথা রেখে স্পন্দন পরিমাপ করছে।


রিমি,অন্তু,পায়েল, সাগর বসে বসে কথা বলছে। অন্তু চারদিকে চোখ বুলাল। মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করল,,

–“আমরিন ও নিবিড় কে দেখছি না যে?”

–“হবে হয়তো রুমে। ওদের ছাড়াও কিন্তু আরও দু’জন গায়েব।”–দুষ্ট কন্ঠে বলল পায়েল।

–“ওদের তো গায়েব হবারই কথা ভাই। এখানে আসা টাই কিন্তু ওদের জন্য। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে কিন্তু এই সুযোগ টা তৈরি করেছে আদ্র। এবার একটু সব ঠিক হোক।”

–“একদম ঠিক বলেছিস সাগর। কিন্তু এখনও যে সবটাই বাকি!”

পাশ থেকে বলে উঠল রিমি।

–“আদ্রর মতো বিচক্ষণ মানুষ থাকতে কিসের চিন্তা ভাই? সোজা পথে নাহলে বাঁকা পথ টাই অবলম্বন করবে।”

–“হুম।”
_________

আদ্রর কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে তুলি। দুজনেই আকাশে তারা দেখছে। দূর থেকে ঝি ঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। রাতের বেলা বাহিরে বসে আকাশ দেখার তৃপ্তি একদম অন্যরকম। নীরবতা ভেঙে তুলি প্রশ্ন করল,,,

–“আপনি আমায় কবে থেকে ভালোবাসেন?”

–” বাইশ বছরের সেই যুবক বয়স থেকেই।”

সোজা হয়ে বসল তুলি। অবাক নয়নে চাইল আদ্রর দিকে। আদ্র তাকে পাঁচ বছর ধরে ভালোবাসে? তাহলে কোথায় ছিল এতোদিন? কেন সে আদ্র কে কোনোদিন দেখে নি?পাঁচ বছরের ভালোবাসা অথচ এতো দূরত্ব ছিল বছরের পর বছর। বিস্মিত তুলি কে একহাত দিয়ে বাহুতে জরিয়ে নিল আদ্র। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে তুলির মাথায় চুমু খেল।

–” বাইশ বছর বয়সে যখন নানুর বাড়িতে যাই তখন প্রথম দেখি তোমায়। সচরাচর নানুর বাড়িতে যাওয়া হতো না আমার। কাউকে চিনতাম ও না ভালোভাবে। একটা টপস ও স্কার্ট পড়ে পুকুর পাড়ে খেলছিলে তুমি। ছোট্ট সেই তুমি টা কে দেখে অদ্ভুত মায়া জাগে আমার মনে। সারাদিন তোমাকে দেখেছি, তোমার কার্যকলাপ খেয়াল করেছি। নিজেও জানতাম না কেন এমনটা করেছি আমি। পরেরদিন সকালে তোমার পুকুরে পড়ে যাওয়ার কথা শুনে দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম আমি। তোমাকে পাড়ে তুলে অজানা কারণেই কেঁদে দিয়েছিলাম। অবাক হয়েছিল সবাই। প্রচন্ড অবাক। ছোট থেকেই তীব্র ব্যাথা পেলেও আমায় চোখের পানি থেকে ঝড়তে দেখে নি কেউ। সত্যি বলতে আমি নিজেও চমকে গিয়েছিলাম। এত বড় হয়ে ছোট্ট পিচ্চি একটা মেয়ের জন্য কেঁদে দিলাম। জানিনা কেন তোমার জ্ঞান হারানো ফ্যাকাশে মুখটা দেখে বুকে চাপা যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম। ঢাকায় ব্যাক করার পর সারাক্ষণ তোমার কথাই মনে পড়ত। ছুটে যেতে ইচ্ছে করত তোমার কাছে। খেতে গেলেও মনে হতে খাবার টা হয়তো আমার জন্য বিষ। পড়াতে ও মন বসাতে পারছিলাম না অথচ সামনেই ছিল এক্সাম। আমার মনে হল আবেগে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি আমি। এটা আবেগ ব্যতীত কিছুই না। কারণ,,

চলবে,,,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here