#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ৩৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
১১৫,
রাইমার বিদায়ের পর নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়েছে শার্লিন। রাইমা চলে যাওয়ার পর পুরো বাড়ি তার অভাবে খা খা করছে। শার্লিন নিরবে পুকুরপাড়ের শান বাধানো ঘাটে বোসে আছে ইফরাদের কাঁধে মাথা এলিয়ে। শিখা, রেখা, সাইরা, সাইফা, তিশা, রাহান, মিহাল-নিহাল, মেসবাহ সবাই মিলে উঠোনে চেয়ার পেতে গোল হয়ে মনমরা হয়ে বোসে আছে। মাহিশা বারান্দা থেকে নামার জন্য তিনটে সিড়ি বানানো।,সেই সিড়ির উপর সামিদের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে শার্লিনের মতোই নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত। এটা যে আসলে বিয়ে বাড়ি তার চিত্র পাল্টে একট মানুষের অভাবে শোক বাড়িতে পরিণত হয়েছে। বাড়িতে এতো এতো মানুষ। অথচ সবথেকেও যেনো নেই। এতো শূ্ণ্যতা মানা যায়! শাহনাজ বেগম সবার দিকে নজর বুলিয়ে হতাশ হলেন। বাচ্চাদের এতো মনমরা অবস্থায় মানা তো যায়না। মেয়েকে বিদায় দিয়ে যে উনি সস্তি পাচ্ছেন বিষয় টা এমন নয়। কিন্তু নারীদের জীবনই তো এমন। বাবার ঘর আলো করে এসে নির্দিষ্ট একটা সময়ে গিয়ে পরের ঘর আলো করতে হয়। এই তিক্ত সত্য যতো তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া যাবে। ততো তাড়াতাড়িই বিষয়টা সুন্দর মনে হবে। এতো ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে সবার মাঝে এতো নিস্তেজ অবস্থা মানা যাচ্ছে না। শাহনাজ বেগম মেসবাহকে ডাকলেন। ধীরস্থির ভাবে কিছু একটা বললেন। মেসবাহ উনার কথামতো মিহাল এবং নিহালকে নিয়ে বাড়ি ছাড়লো। উদ্দেশ্য শাহনাজ বেগমের কথামতো একটা কাজ সম্পূর্ণ করা। শাহনাজ বেগম বোনকে ডেকে সাথে নিয়ে ঢুকলেন বাড়ির ভিতর। এরপর গামলা ভর্তি চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে, পেয়ারা স্লাইস করে কে”টে পেয়ারা দিয়ে খাওয়ার জন্য মশলা বানালেন। ছোটো জা-কে ডেকে তার সাহায্যে বিশাল কয়েকটি মাদুর নিয়ে বাহির উঠোনে আরও বেশ কয়েকটা লাইট জ্বা”লিয়ে দিলেন। মাদুর পেতে গামলা ভর্তি মুড়ি মাখা, কা”টা পেয়ারা আনলেন। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে শাহনাজ বেগমের কাণ্ড দেখছে। কি হচ্ছে তাদের মাথায় ঢুকছেনা। তিশা তো প্রশ্ন করেই বোসে,
“ফুফু এসব কি হচ্ছে!”
“অনেক শোক তাপালে সবাই। আসো সবাই গোল হয়ে বোসে পরো। মুড়ি মাখা খাও, পেয়ারা খাও। সাউন্ড বক্সে গান চালিয়ে দাও। আড্ডা দাও, মজা করো। এই বয়সে মজা করবেনা তো কি আমাদের মতো বুড়ো হলে মজা করবে?”
উনার কথা শুনে সব ছেলেমেয়েরা হতবাক। শাহনাজ বেগমের কথা যেনো মাথায় ঢুকছেনা। শাহনাজ বেগম নিজেই আগ বাড়িয়ে অল্প সাউন্ডে সাউন্ড বক্সে গান চালিয়ে দিলেন। এরপর সব ক’টার হাত ধরে এনে বসিয়ে দিলেন মাদুরে। শার্লিনের কাছে গিয়ে গলা খাকাড়ি দিতেই ইফরাদ সরে যায় চট করে। এরপর শার্লিন আর ইফরাদ দুজনেরই হাত ধরে এনে মাদুরে বসিয়ে দেন। মাহিশা আর সামিদকেও টেনে এনে বসিয়ে দিয়ে সব বড়োদেরও ডাকলেন। মুহুর্তে মন খারাবি গায়েব হয়ে যেনো উৎসবের আমেজ লেগে গেলো। এরমাঝেই মেসবাহ, মিহাল, নিহাল এসে উপস্থিত হয়। হাতে কোঁকাকোলা, আইসক্রিম তো তেমন ভালো মানের পাওয়া যায়না গ্রামের দোকানে। তবুও সবার জন্য চকবার আইসক্রিম, চকলেট একগাদা নিয়ে হাজির তারা। এসব আনতেই শাহনজা বেগম তাদের পাঠিয়েছিলেন। সেগুলো এনে মাদুরের উপর ছড়িয়ে দিতেই সবাই আড্ডায় মেতে উঠে। সবার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে শাহনাজ বেগম শান্তি পেলেন। এক মেয়ে চলে যাওয়ার বদলে এতোগুলো ছেলেমেয়ের মাঝে শোকের আবহ উনার মনে মানছিলো না। এজন্য বাড়ির সবাইকে একটু হাসানোর চেষ্টা করতে এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আড্ডা দিতে ব্যস্তরত সবার উদ্দেশ্যে আজাদ সাহেব এসে বললেন,
“আগামীকাল তো ছেলের বাড়িতে যেতে হবে, বউভাত। সকাল ১১টার মাঝে সবাই রেডি থাকবে বুঝলে? সকাল সকাল গিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে আসতে হবে। এরপর সব নিয়ম শেষ করে আবার ঢাকায় ফিরতে হবে। রমজান আসছে দুদিন পর, প্রস্তুতি তো শেষ করতে হবে। সবারই জীবনের ব্যস্ততা আছে।”
সবাই উনার কথার জবাবে একসাথে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো তারা রেডি থাকবে।
১১৬,
সব নিয়মের পার্ট শেষ করে সবে বাসর ঘরের দরজায় এসে দাড়ালো দিগন্ত। রাইমাকে আগেই বাসরঘরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাসরঘর দরজার সামনে আসতেই তার ভীমড়ি খাবার যোগার। স্নেহা, মাহাদ থেকে শুরু করে ইশা, ঐশী, আয়মান, ইশফাক সবাই দরজা আঁটকে দাড়িয়ে আছে। দিগন্তের সবাইকে দেখে হেঁচকি উঠে গেছে প্রায়। সে নিজের নার্ভাসনেস সবার সামনে প্রকাশ করলো না। বোকার মতো হেসে হাত নাড়িয়ে বললো,
“হাই এভরিওয়ান!”
“হাই-টাই পরে হবে ভাই। আগে টাকা দাও। এরপর আমরা দরজা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। নিজের শালা-শালীকে অনেক টাকা দিয়ে আসছো। আমাদের জন্য এবার মনখুলে টাকা ছাড়ো, আমরাও মন খুলে তোমার বাসর যেনো সুন্দর হয় দোয়া করবো।”
আয়মান কথাটা বললো। ওর কথায় সবাই তাল মিলিয়ে বললো,
“ঠিক ঠিক। দিয়ে দাও এখন টাকা। আমরা গেইট ছাড়ি।”
মাহাদ বললো,
“এমনি অনেক ক্লান্ত লাগছে। মাঝরাত তো হয়েই গেছে শালাবাবু। আমাদের সাথে তর্ক করলে উল্টে বাকি বাসর করার সময় টাও মাটি হবে ভাই।”
দিগন্ত আর কি করবে, বেচারা একা হয়ে তো এতো মানুষের সাথে তর্ক করা চলে না। সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা টাকা ছিলো বের করে দিলো। এমনিতেও বেশি বড়ো এমাউন্টও ছিলো না। যা ছিলো তাতেই সবাই খুশিমনে দরজা ছেড়ে চলে গেলো। দিগন্ত হাফ ছেড়ে বুকের মাঝে ধুকপুকে অনুভূতি নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতর থেকে দরজা আঁটকিয়ে রাইমার দিকে দৃষ্টি ফেলে। মেয়েটা ক্লান্ত তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিছানার বোর্ডের সাথে অর্ধ ভাবে হেলান দিয়ে শুয়ে পরেছে ইতিমধ্যে। দিগন্ত প্রবেশ করার শব্দ পেতেই রাইমা চট করে চোখ মেলে। বিছানা থেকে নেমে দাড়ায়। দিগন্ত ধীর কদমে হেঁটে রাইমার সামনে দাড়াতেই রাইমা সালাম করতে উদ্দ্যত হয়। দিগন্ত হাত দিয়ে রাইমাকে আঁটকে দেয়। রাইমাকে দাড় করিয়ে দিয়ে দুগালে হাত ছোঁয়ায়। পূর্ণদৃষ্টি মেলে রাইমার চোখে চোখ মেলায়। দুজন দুজনকে এতোটা কাছ থেকে প্রথম দেখছে তো। সময়টা যেনো তাদের জন্য থমকে গেছে। দিগন্তের চোখে রাইমা নিজের জন্য অনুভূতি হাতরে বেড়ায়। চোখ দুটোয় কি যে মায়া! এই মায়ায় ডুবলে রাইমা কূল পাবে তো! ইশশ কি সুন্দর অনুভূতি। নিজের করে পাওয়া এই লোকটির প্রতি আচমকা কেমন একটা প্রেম প্রেম অনুভূতি হচ্ছে রাইমার। সে লাজলজ্জার মাখা খেয়ে দিগন্তকে বলেই বসে,
“আপনাকে দেখে আমার কেমন প্রেম প্রেম পাচ্ছে দিগন্ত সাহেব। খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে।” (কোথাও একটা পড়েছিলাম বোধহয়। সেই উক্তি লেখার দরুণ আবার কপি বলে চালিয়ে দিয়েন না)
রাইমার কথা শুনে দিগন্ত নিজের হেঁচকি আর থামাতে পারলো না। সে রাইমাকে ছেড়ে দূরে দাড়িয়ে পরলো। রাইমা বেড সাইড টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে দিগন্তের দিকপ বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“কি হলো? ঠিক আছেন আপনি?”
১১৭,
দিগন্ত রাইমার হাত থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে পানি ঢকঢক করে খেয়ে বললো,
“আপনি নির্লজ্জ এটা জানি আমার অ”সভ্য বউ। কিন্তু সোজা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে! এটা কেমন কথা!”
রাইমা দিগন্তের সামনে এসে কোমড়ে হাত দিয়ে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে বললো,
“আপনাকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করলে আমার কি দোষ! আপনি এতো কিউট কেনো হতে গেছেন?”
দিগন্ত হাতের গ্লাস টা রেখে রাইমার দুবাহু নিজ হাত দ্বয়ে আঁটকে বললো,
“পুষ্পবতী, অনেক মজা করলেন। এবার চলুন, ফ্রেশ হোন। নামাজটা আদায় করা যাক?”
রাইমা মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। প্রথমে রাইমা এরপর দিগন্ত বিয়ের ভারী সাজ ছেড়ে নরমাল।সুতির শাড়ি আর দিগন্ত পাজামা পাঞ্জাবি পরে নিলো। দুজনে একত্রে নামাজ পরে উঠলো। নামাজ শেষে রাইমা বিছানায় বসে নখ খুঁটতে শুরু করে দেয়। দিগন্তর সাথে একা এক রুমে ভাবতেই তো তার ঘুম উড়ে যাচ্ছে। দিগন্তও নার্ভাস হয়ে পরেছে। যতোই সে শক্ত মনের পুরুষ হোক! স্ত্রীর সামনে এসে তার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। রজনীগন্ধা, তাজা গোলাপে সাজানোর ঘরটায় রজনীগন্ধার সুবাস মো মো করছে পুরো রুম জুড়ে। রাইমার প্রিয় ফুল সূর্যমুখীরও দেখা মিলছে কিছু কিছু জায়গায়। দিগন্তও রাইমার পাশে বসে রাইমার দেখাদেখি নখ খুঁটতে শুরু করে। রাইমা তা দেখে মুখ থেকে নখ সরিয়ে বলে,
“আমার মতো আপনারও নখ খুঁটার বদ অভ্যাস আছে?”
“ছিলো না, আপনাকে দেখে বোধ হয় হয়েই যাবে এই অভ্যাস।”
দিগন্তের উত্তরে দিগন্তের বাহুতে কি”ল মে”রে বসে রাইমা। কিল মে”রে বলে,
“ধুর কি বলেন এসব!”
দিগন্ত রাইমার কি”ল খেয়ে বিরবির করে বলে,
“আদরের বদলে মা”ইর দিয়ে বউয়ের সাথে আলাপ শুরু। বোঝা গেলো, ইনশা আল্লাহ কি”ল খেয়েই আমার জীবন পার হয়ে যাবে।”
রাইমা দিগন্তকে বিরবির করতে দেখে বললো,
“কিছু বললেন?”
“না, কিছু বলিনি। আপনার খিদে পেয়েছে? খাবারের ব্যবস্থা করবো? সারাদিন অনেক ধকল গেছে। কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পরি চলুন!”
“আপনি কি কা”না?”
আচমকা রাইমার এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে গেলো দিগন্ত। থতমত খেয়ে বললো,
“কানা হবো কেন?”
“আপনার চাচী, ফুফ যে আসার পরপরই ঘরে তুলে আমায় খাইয়ে দিয়েছে! চোখে দেখেননি?”
“দেখবো কি করে? আরফান ঘুমিয়ে কাঁদা হয়েছিলো। দাদী সহো তার শোয়ার ব্যবস্থা করতে গেছিলাম তো।”
“আচ্ছা বাদ দিন, আজ তো বাসর রাত। এই রাতে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যা সম্পর্ক হয়, আপনি চাইলে জড়াতে পারেন। আমার দিক থেকে সমস্যা নেই। জীবনের আঠাশ বছর সিঙ্গেল থেকে বউ পেয়ে তো আর তাকে না আদর করে থাকা যায় না বলেন!”
রাইমার এরকম সরাসরি কথাবার্তা বলার ধরণ দেখে দিগন্ত রিতীমতো ঘামতে শুরু করেছে। এই মেয়ে এতো নির্লজ্জ কেন বাপু! দিগন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে থমথমে গলায় রাইমার বাহু ধরে নিজের কাঁধের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
“আঠাশ বছর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলে আরও আঠাশ মাসও আমি ধৈর্য ধরে থাকতে পারবো আমার অস”ভ্য বউ। কিন্তু তার আগে আমাদের মাঝে নিজেদের বোঝাপরার বিষয়টা শুরু হোক! নারীর শরীর ছুইলেই যে তাকে পাওয়া হয়ে যায় এমনটা নয়! যদি আপনার মনেই আমার স্থান দৃঢ় না হয়, শরীর ছুয়ে আমি কি করবো? শরীর তো সব পুরুষই ছোয়! মন ছুতে পারে ক’জন পুরুষ! আপনি আমায় ভালোবাসতে শেখালে, অনুভূতি গুলো যত্ন সহকারে কুড়িয়ে মনের মনি কুঠোয় তুলে রাখতে সাহায্য করলে আমি আগে আপনার মন টাই পেতে ইচ্ছুক অস”ভ্য বউ।”
দিগন্তের কথাগুলো মন ছুয়ে গেলো রাইমার। শ্রদ্ধার সহিত দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো। দিগন্ত পলক ফেলে রাইমাকে দেখে শুধালো,
“কি সাহায্য করবেন?”
রাইমা মাথা হেলিয়ে বুঝালো, করবে সাহায্য। দিগন্ত মুচকি এসে আলতো ছোয়ায় রাইমাকে বুকে জড়িয়ে পরম তৃপ্তিতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। দিগন্তের বুকে মাথা রেখে রাইমা-ও ঘুমানোর চেষ্টায় মত্ত হলো। জার্নি করে দুজনেই ভীষণ টায়ার্ড।
১১৮,
পরদিন সকালবেলায়, সকালের খাবার দাবার সেড়ে বউভাতের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সবাই। রাইমাকেও তার রুমপ সাজানোর পর্ব চলছে। আরফান রাইমার বিছানায় বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে চকলেট খাচ্ছে আর বোনকে দেখছে। রাইমা সাজের ফাঁকে ফাঁকে ভাইয়ের দিকেও তাকাচ্ছে। পার্লার থেকে মানুষ আনা হয়েছে, তারাই আপাতত সাজাচ্ছে রাইমাকে। আরফানকে এতোটা গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে রাইমা ভাইকে জিগাসা করে,
“মায়ের জন্য মন খারাপ? ”
“না আমি কয়েকদিন হলো তোর সাথে মন খুলে ঝগড়া করতে পারছিনা আপা। আমার সেজন্য মন খারাপ।”
রাইমা হেসে ফেললো ভাইয়ের উত্তরে। দুটো দিন পর থেকে যে ঝগড়া তো দূর তাক, বোনকেই কাছে পাবে না! তখন কি করবে তার ভাইটা? এটা ভেবেই রাইমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইশা ঐশী রুমেই বসা ছিলো। তারা দুজনে সোফা ছেড়ে আরফানের দুপাশে বসে আরফানের গাল টেনে বললো,
“ওরে কি কিউট রে আমাদের বেয়াই মশাই।”
আরফান বিরক্ত হলো, বললো,
“আমার গাল টানবেনা তোমরা। আমার পছন্দ নয়।”
ইশা বললো,
“দুলাভাইয়ের পারফেক্ট শালাবাবু। সবকিছুতেই দেখছি গম্ভীর।”
রাইমা ওদের খুনশুটি দেখে মৃদু হাসলো। পার্লারের মেয়ে দুটোর সাজানোয় সমস্যা হবে বুঝে চুপটি করে বসলো। তার দাদী যে কোথায় কি করছে! তার ঠিক নেই। খোজই পাওয়া যাচ্ছে না উনার। এরমাঝেই দিগন্তের বেশ কয়েকবার কাজের উছিলায় চক্কর দিয়ে রাইমাকে দেখে যাওয়া শেষ। আবার যখন দেখতে আসলে, ঐশীর চোখে তা পরতেই দৌড় দিয়ে দিগন্তের হাত ধরে রুমে আনে। হাসির ছলে বলে,
“বউকে চোখে হারাচ্ছো ভাইয়া! এই নিয়ে ৭বার আসলে দেখতে। ব্যাপার কি হুম?”
চুরি করার পর চোর ধরা পরলে চোরের যে অবস্থা হয়! দিগন্তের অবস্থাও ঠিক সেরকম। স্নেহা এসেছিলো রাইমার জন্য গহনা দিতে। সে আসতেই ঐশীর কথা তার কানে যেতেই বললো,
“কি আর করবে! ভাইটা এতোদিন পর বউ পেলো! বউকেই তো দেখছে, পরনারীকে তো নয়। থাক আর লজ্জা দিস না।”
দিগন্তের অবস্থা এখন এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে সে। সবাই ঠোঁট টিপে হাসছে দিগন্তের অবস্থা দেখে। দিগন্ত কথা কা”টাতে পকেট থেকে কয়েকটা চকলেট বের করে আরফানের হাতে দিতে দিতে বললো,
“আরে আমি তো আরফানকে চকলেট দিতে আসছিলাম। আম্মাকে ছেড়ে আসছে! বাচ্চাটা কাদবে হয়তো। এজন্য খেয়াল রাখছিলাম। পকেটে চকলেটও রেখেছিলাম যেনো কাঁদলেই দিতে পারি। তোমরা এমনি এমনি আমায় লজ্জা দিচ্ছো। ”
দিগন্তের উত্তর যে পুরোটাই বানোয়াট বুঝতে পারলো সকলেই। রাইমা পারছেনা সবার মাঝে হেসে দিতে। তার যে ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আরফান তো হেল গরম কিছু বুঝেনা। আরও চকলেট পেয়ে খুশিমনে সে খেতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। দিগন্ত লজ্জা কমাতে হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেলো। সে চলে যেতেই সবাই হাসিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ৩৬(অন্তিমপর্ব)
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
১১৯,
বউভাতের জন্য সব রকম প্রস্তুতি শেষ। স্টেজে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে রাইমাকে। দাওয়াতের মানুষজন সব এসেই পরেছে। নতুন বউ দেখাদেখির পর্ব চলছে। ইশা ঐশী রাইমার পাশে দাড়িয়ে সব আত্মীয়স্বজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। আরফানকে রাইমার পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিগন্ত তো সবার সাথে ছুটছে অতিথি আপ্যায়নে। এই বউ দেখাদেখির পর্বের মাঝেই রাইমার বাবার বাড়ির সকল আত্মীয়স্বজন এসে পরায় অনুষ্ঠানে কিছুটা ভাঁটা পরলো। মাহাদ নিজ দায়িত্বে সবাইকে স্টেজের দিকে নিয়ে আসায় সবাই রাইমার সাথে কুশলাদি বিনিময়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। বাবা, চাচা, ফুফা, মামা-রা, কাজিন’স সবার সাথে ভালোমন্দ কথা বলে রাইমা তার বাবাকে জিগাস্যা করে,
“আম্মু না হয় না আসলো বাবা, খালামনি, ফুফু, মামী-রা আসলেন না যে!”
“নতুন জামাই যাবে। তাকে আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করায় ব্যস্ত তারা।”
আজাদ সাহেব মেয়ের গালে হাত দিয়ে জবাব দিলেন। উনার পাশেই দাড়ানো ছিলেন রাইমার বড়ো মামা, তিনি মেয়ের কথা শুনে হেসে বললেন,
“তোমার মামী-রা বিয়ের কোনো আয়োজনেই তেমন ভাবে থাকতে পারেনি। এজন্য তারা ব্যস্ত, মহা ব্যস্ত হয়ে পরেছে জামাই আদরের ব্যবস্থা করতে।”
রাইমা মৃদু হাসলো মামার কথায়। মাত্র একটা রাত একটা দিনের অর্ধেক পরিবারের মানুষজনকে দেখেনি, তাতেই মনে হচ্ছে হাজার বছরের দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে সবার সাথে। কতো যুগ পর যে দেখলো! দেখে তৃপ্তি মিটছেনা রাইমার। অথচ দিনের পর দিন যাবে সে কারোর দেখা পাবেনা নিজের মন চাইলেই। তার তৃষ্ণার্ত চোখ দুটি শার্লিন আর ইফরাদকে হাতরে বেড়াচ্ছে। সবাইকে দেখলেও ওর দেখা পায়নি রাইমা। তবে কি শার্লিন আসলো না! রাইমার চিন্তার অবসান ঘটলো কিছুক্ষণ পর। হালকা আকাশী রঙা শাড়িতে আবৃত শাড়ি সামলিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে তার দিকে এগিয়ে আসা শার্লিনকে দেখে। মেয়েটা শাড়ি পরেছে। কত্তো যে সুন্দর লাগছে! অথচ উস্টা খাওয়ার ভয়ে সে শাড়িই পরতে চায় না। বিষয়টা মনে আসতেই মৃদু হাসলো রাইমা। শার্লিনের পিছনে পিছনে ইফরাদ আসছে। তার কোলে মাহিশা। ওদের পিছনে মাহিশা আর সামিদ। কত্তো সুন্দর একটা পরিবার। রাইমা ওদের দেখে হাসিমুখে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। সাইফা, সাইরা, তিশা, রাহান, মিহাল-নিহাল সকলে মিলে এসেই চারপাশটা ঘুরে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। বড়োদের তো মাহাদ খাওয়া দাওয়া করানোর জন্য নিয়ে চলে গেছে। যার দরুণ রাইমা একপ্রকার একাই এখন। শার্লিন রাইমার মুখোমুখি দাড়িয়ে মৃদু হাসলো। রাইমার বুকের ভেতর কেমন একটা ছ্যাঁত করে উঠলো শার্লিনের মুখের অবস্থা দেখে। একদিনেই শুকিয়ে চোখমুখের অবস্থা এমন বানিয়েছে মনে হচ্ছে অসুস্থ রোগী। রাইমা ঠোঁট কামড়ে নিজের দীর্ঘশ্বাস লুকানোর চেষ্টায় শার্লিনকে জিগাসা করে,
“খুব কষ্ট হয়েছে! একদিনে চোখ মুখের এই অবস্থা।”
“আপনি হীন আমার অস্তিত্ব মরুভূমির মতোই প্রাণ৷ আচ্ছা বন্ধুত্বে এতো শোক তাপ আদৌও মানায়!”
রাইমা মৃদু হাসলো। পাগল মেয়েটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আলতো স্বরে বললো,
“আপনার বিয়ে হলে আপনি কি আমায় ছেড়ে যেতেন না? হয়তো আমাদের মাঝে দূরত্ব এসেছে। আগে যেমন দুজন দুজনের বাড়িতে থাকতাম। মনে করবেন তেমনই আছি।”
“আপনি অনেক নিষ্ঠুর মানবী রাইমা খন্দকার।”
“তার থেকেও বড়ো নিষ্ঠুর মানবী আপনি শার্লিন হাসান। আপনি তো আমায় এতো টা ভালোবাসেন না যতোটা রাইকে বাসেন।”
ইফরাদ শার্লিনের পাশে দাড়িয়ে অভিযোগের সুরে কথাটা বললো। রাইমা শার্লিনকে ছেড়ে মুচকি হাসলো। মাহিশা এবং সামিদের সাথে টুকটাক কথাবার্তা বললো। সব আনুষ্ঠানিক পর্ব সেরে খাওয়া দাওয়া সেরে সবাই রওনা দিলো রাইমার বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। বিয়ের পরদিন বাবার বাসায় নাকি যেতে হয়! সেই নিয়ম চুকাতেই যাওয়া। এরপর আগামীকাল ফিরে এসে রওনা দিবে সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাইমাদের সাথে মাহাদ আর আয়মান, ইশফাক, ইশা ঐশীকেও নেওয়া হলো।
১২০,
পরদিন সকালবেলায়, দরজা খুলে পা দিয়ে বাইরে বেরুতে হাই তুলে সামনে দিকে তাকিয়েই রাইমার চোখ কপালে উঠেছে। পুরো বারান্দায় সব ছেলে মেয়েরা শুয়ে পরেছে। ছেলেরা একপাশে, মাঝখানে একটু ফাঁকা রেখে অপরপাশে সব মেয়েরা ঢালু বিছানা পেতে ঘুমিয়ে আছে।গতরাতেও আসার পর গভীর রাত অব্দি আড্ডার আসর জমিয়ে রাইমা আর দিগন্তকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে এরা যে এই কাহিনী করে বসেছে রাইমা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। পেলে তো কিসের ঘরে ঘুমানো! সবার মাঝেই শুয়ে পরতো। এমনিতেও ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে রাতে আড্ডা দেওয়ার কারণে। অথচ এরা এখনও ঘুমে। বিয়ে বাড়ির আমেজ কমে আসলেও আত্মীয় স্বজন কাছের মানুষগুলো রয়েই গেছে। সবাই পুরো উঠোন জুড়ে হাটাহাটি করে বেড়াচ্ছে। আর এরা বেক্কলের মতো ঘুমাচ্ছে! রাইমা চট করে ঘরে ঢুকে ঘরে রাখা পানির জগটা এনে একে একে সবার মুখের উপর ছিটিয়ে দিলো। সবাই ধরফরিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসতেই রাইমা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। তিশা গালে হাত দিয়ে বসে রাইমাকে জিগাসা করে,
“এটা কি হলো আপু! দিলে তো সাধের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে!”
“কিন্তু তোমরা ঘর ছেড়ে বারান্দায় কেনো?”
শিখা বললো,
“কি দরকার বলো ঘরে ঢুকে একজন বিছানায়! দুজন ফ্লোরে ঘুমানোর? এজন্য বড়মার বুদ্ধিতে সবাই বারান্দায় কাঁথা পেতে শুয়ে পরেছিলাম।”
“এটা ঠিক আছে, কিন্তু আমায় এই প্ল্যান থেকে বাদ দিলে কেনো তোমরা?”
“আরে রাই, নিউ কাপল, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!”
সামিদ মজা করে কথাটা বললো। রাই চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললো,
“ধ্যাত একেকটা যা তা।”
এরপর হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেলো দিগন্তের ঘুম ভাঙাতে। এদিকে উপস্থিত সকলেই হেসে উঠলো। হামিদা বেগম তখন উঠোন থেকে বাড়ির ভিতরে যাচ্ছিলেন। তিনি উঠে পরে সব মানুষকে দাঁত মাজতে মাজন দিয়েই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পা বাড়িয়ে সবার কথা কানে যেতেই মাথা দুলিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“আজ আমার নাতনীর অবস্থা দেইখা তোরা হাসতেছোস! তোগোরও এই দিন আসবো রে নাতী-নাতনী-রা।”
“আসতে দাও বুড়ি, আমরাও দাঁত কেলাবো। তোমার নাতনীর মতো লজ্জা পাবো না।”
শার্লিন একটু গলা উচিয়েই কথাটা বললো। ইফরাদ এমনি ঘুমে ঝিমোচ্ছিলো, শার্লিনের কথা শুনে তার ঘুম উবে গেলো। মনে মনে ভাবলো,
“লজ্জা থাকলে তো লজ্জা পাবে শালু। তোমার কথাবার্তা শুনে আমারই লজ্জা লাগে। আমার লজ্জার এক বিন্দু যদি তোমার থাকতো! উফফ খোদা মেয়েটাকে একটু লজ্জা দাও।”
মাহিশা নিজের ভাইয়ের মুখের অবস্থা দেখে শার্লিনের কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে বললো,
“তুমি লজ্জা না পেলেও আমার ভাই লজ্জা পাবে শার্লিন। সেই দিকে একটু তাকিয়ো, আমার ভাইয়ের মানসম্মান নিয়ে অন্তত টানাটানি করো না।”
“ওর তো আজীবনই লজ্জা। এই লজ্জা থাকলে বাপ ডাক ওর কপালে জুটবেনা।”
শার্লিন মুখ ভেঙচে কথাটা বললো। দিগন্ত তখুনি রাইমার টানাহেঁচড়ায় ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে দরজায় এসে দাড়িয়েছে। সবাই যখন শার্লিনের কথা শুনে আর ইফরাদের কপাল চাপড়ানো দেখে হাসায় ব্যস্ত, দিগন্ত বলে উঠে,
“আমার বউ কি করে এতো নির্লজ্জ! আমার আধা ঘরওয়ালীদের দেখলেই টের পাওয়া যায়। বাপরে কি ডেঞ্জারাস।”
রাইমা দিগন্তের পিঠে থাবা দিয়ে বললো,
“আমি ডেঞ্জারাস? ”
“না, আপনি কেন হবেন! ওটা তো আমার কপাল।”
দিগন্ত বোকা হেসে কথাটা বললো। সকাল সকাল কয়েকদফা হাসাহাসি হওয়ার পর সবাই শাহনাজ বেগম এবং সাহিরা বেগমের তাড়ায় ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে বসে। বারান্দাতেই মাদুর একটার পর একটা লাগিয়ে দিগন্ত এবং রাইমার সাথে সব ছেলে-মেয়েদের বসিয়ে দিয়েছেন আজাদ সাহেব। শ্বশুর বাড়ির বাহারি রকমের আয়োজন দেখে দিগন্তের মাথায় হাত। রাইমার কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
“এতো কিছু কি করে খাবে মানুষ! এতো কিছুর আয়োজন কেনো করা হলো রাই! আমায় দেখে কি রাক্ষস মনে হয়?”
“আরে নতুন জামাই, তার আপ্যায়ন করা হবে না? নিন খাওয়া শুরু করেন।”
রাইমা ঠোঁট টিপে হেসে দিগন্তকে ইশারা দিয়ে খেতে শুরু করতে বলে। দিগন্ত সবার দিকে তাকিয়ে ফাঁকা ঢোক গিলে শুরু করে শ্বশুর বাড়ির জামাই আদর গ্রহণ করতে। খাওয়া দাওয়া শেষে সারাটা দিন হইচই, হাসি মজায় কেটে গেলো। পাড়া-প্রতিবেশী-রা এসে দিগন্তকে দেখে গেলো। খোজখবর নিলো। সবশেষে বিকেলের দিকে মাহাদ, দিগন্ত-রাইমা, ইশা-ঐশা, আয়মান-ইশফাক রওনা দিলো সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে। আজাদ সাহেব-শাহনাজ বেগম মেয়েকে বিদায় দিয়ে বাড়িতে আর মন টিকাতে পারলেন না। চারদিকে কেমন খা খা করছে। শার্লিন তো আর একদণ্ড টিকতে পারবেনা বলে নিজের সবকিছু গোছগাছ করা শুরু করে। রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে বলে জিদ করে। দিগন্তও জানিয়ে গেলো বোনের বিয়ে, নিজের বিয়ে কাজের অনেক গ্যাপ পরে গেছে। আগামীকাল সকালেই তারা ঢাকায় যাবে। তাই শার্লিনও থাকতে চাইলো না। আজাদ সাহেব তাকে থামিয়ে দিলো। আগামীকাল সকালে সবাই একসাথেই ঢাকায় যাবে।
১২১,
সময়ের স্রোতে সময় যাচ্ছে। দেখতে দেখতে কেটে গেলো কতগুলো মাস। সবার জীবন নিয়ে ব্যস্ত সবাই। দিগন্ত তার কাজ আর রাইমাকে নিয়ে। রাইমা ব্যস্ত দিগন্ত আর তার পড়াশোনা নিয়ে। রোজ ভার্সিটিতে যাওয়া, শার্লিনের সাথে পুরোটা সময় আড্ডা দেওয়া, এরপর বাড়ি এসে দুই টোনাটুনির সংসার সাজানোয় রাইমা ভীষণ ব্যস্ত। মাহাদও নিজের সংসার জীবনে ভীষণ ব্যস্ত, মাঝে মাঝে স্নেহাকে নিয়ে এসে দিগন্তের বাসা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া! তখনই একটু স্নেহার সাথে দেখা হচ্ছে রাইমার। স্নহা প্রেগন্যান্ট, দুমাস চলছে। এজন্য তার জার্নি করা নিয়ে ভীষণ ভয় সাহিরা বেগমের। স্নেহার ফিজিক্যালি কিছু সমস্যার জন্য সম্পূর্ণ বেড রেস্টে। দিগন্ত আর রাইমা-ই এখন গিয়ে দেখে আসে। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম শেষে শার্লিন আর ইফরাদের বিয়ে হবে। আপাতত ৩য় বর্ষের ফাইনাল এক্সাম শেষে ছুটি চলছে কিছু সময়ের। দিগন্তের কাজেও কিছু টা অবসর মিলেছে এখন। নয়তো সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে সেই যে হারায়! সারাদিনে আর খোজ পাওয়া যায় না তার। সন্ধ্যায় আসে বাসায়, ফ্রেশ হয়, ডিনার শেষে দুজনে আড্ডা, গল্প গুজব করতে করতে ঘুমিয়ে পরে। কিন্তু আজ সকালেই ঘুম ভাঙার পর দিগন্তকে পাশে পায়নি রাইমা। বেড সাইড টেবিলে তার চশমার নিচে একটা ছোট্ট চিরকুট রেখে গিয়েছিলো সে। তাতে লেখা ছিলো, দরকারি কাজে সে বাইরে গেছে, সময়মতো ফিরবে। রাইমা বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে শূণ্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনমরা হয়ে উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে সবার কথাই ভাবছিলো। তার জীবন টা কি একঘেয়েমিতে ভরপুর হয়ে উঠেছে! রোজ সংসারের টুকিটাকি কাজ, ভার্সিটি, স্নেহাকে সপ্তাহে ছুটির দিন দেখে আসা! আবার মাঝেমাঝে মা-বাবার সাথে একটু সময় কাটিয়ে আসা! এই তো চলছে জীবন বেশ। মাঝখানে আমিরা শেখের বিষয়টা রাইমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। সম্পর্কের অবস্থান টা আগের মতোই থিতু হয়ে আছে। থাক, কিছু কিছু সম্পর্ক গোছালো হয়না, স্বার্থপরতার হাতছানি এখানেও বিরাজ করছে। মা ডাকে যে কি সুখ! নারী ভালোমতোই জানে। যার ফলে আকাশ-সম কষ্টও দাঁতে দাঁত পিষে সয়ে নিতে পারে। সেই ডাকের লোভেই তো উনার দিগন্তের মান ভাঙানোর এতো তৎপরতা। যে সম্পর্কের প্রতি আর মায়া নেই! সেই সম্পর্ক আদৌও ঠিক হয়! রাইমা ঠিক করার বৃথা চেষ্টাও ছেড়ে দিয়েছে। দিগন্তের সাথে তার সম্পর্ক টা সে তিক্ত করতে চায় না। যেটা সুন্দর, সেটা সুন্দরই থাকুক। সুন্দর রাখতে সে-ও না হয় খানিকটা স্বার্থপর হলো। রাইমার এলেমেলো চিন্তার মাঝে পেটের উপর কারোর শীতল হাতের অস্তিত্ব বুঝিয়ে দিলো দিগন্তের উপস্থিতি৷ শীতের সময় এসে পরেছে যে! কাপড়ের উপর দিয়েই বেশ ঠান্ডা অনুভূতি অনুভব করলো রাইমা। ছিটকে সরে গিয়ে দিগন্তের দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকিয়ে বললো,
“একে তো জানিয়েই চলে গিয়েছিলেন! আবার এসেই মেজাজ খারাপ করলেন? কি বউয়ের হাতে কি’ল থাপ’র খাওয়ার শখ জেগেছে।”
“বউ তো! যা দিবে সেটাই আনন্দের।”
দিগন্ত রাইমার হাত ধরে নিজের জ্যাকেটের মাঝে সিধিয়ে নিয়ে আলতো হেসে কথা বললো। রাইমা দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“অস’ভ্য লোক।”
“সবই আপনার ছোয়ায় হতে পেরেছি। কিন্তু আপনি গায়ে শীতের কাপড় না জড়িয়ে ব্যালকনিতে কি করছেন? যদি ঠান্ডা লাগে?”
“লাগলে লাগবে! আপনি আছেন তো যত্ন করতে!”
দিগন্ত মুচকি হাসলো, মান-অভিমান, আদর-অবহেলায় তাদের সম্পর্ক টা খুবই সুন্দর পর্যায়ে এসেছে তবে। সে মুচকি হাসির রেখা ঠোঁটে বজায় রেখে বললো,
” এখন এসব ছাড়ুন, চটপট রেডি হোন যাবো এক জায়গায়।”
“কোথায়?”
“তাতো সারপ্রাইজ ম্যাম। আমাদের যেতে হবে, সময় কম, কাজ বেশি। সো ফাস্ট ফাস্ট রেডি হয়ে নিন। আর হ্যাঁ প্লিজ শাড়ি পরবেন। এসব থ্রিপিস নয়।”
রাইমা বুঝলো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সে কয়েক কদমে ব্যালকনি ছাড়লো তৈরি হওয়ার জন্য।
১২২,
রাইমা আর দিগন্ত দুজনেই রেডি হয়ে বেরিয়ে পরেছে দিগন্তের গন্তব্যে। কোথায় যাচ্ছে! রাইমা জানেনা। সে সীটে শীতের শাল চাদর টা ভালো মতো জড়িয়ে গা এলিয়ে বসে পরেছে চোখ বন্ধ করে। শরীর বেশ ক’দিন হলো অনেকটা খারাপই যাচ্ছে। কারণটা অবশ্য জানা। রাইমা তা মনে করতেই মুচকি হাসলো। বাসায় ফিরে খবরটা দিগন্তকে জানাবে বলে ঠিক করেছে রাইমা দেখা যাক, দিগন্ত কোথায় নিয়ে যায় তাকে! এরমাঝেই দিগন্তের অজান্তে একবার টেস্ট করে নিয়েছে রাইমা। দিগন্ত ড্রাইভ করতে করতেই চোখ ঘুরিয়ে রাইমাকে দেখছে। দেড় ঘন্টা মতোন সময় লাগিয়ে সেই চিরচেনা অনাথ আশ্রম-টার সামনে এসে দিগন্তের গাড়ি থামলো, যেটা দিগন্ত নিজে বানিয়েছে। রাইমা চোখ মেলে তাকিয়ে স্থান টা দেখে বেশ উৎফুল্ল বোধ করলো। আনন্দের সহিত নেমে পরলো গাড়ি থেকে দিগন্ত গাড়ি সাইড করে লক করে রাইমার পাশে দাড়িয়ে হাত আকড়ে অনাথ আশ্রমে প্রবেশ করলো। প্রবেশ করতেই রাইমা একদম হা হয়ে গেলো। অনাথ আশ্রমের প্রতিটা বাচ্চা ফুলের পাপড়ি ছুড়ে, বেলুন ফাটিয়ে তাকে ওয়েলকাম জানালো। এর পরপরই রাইমা দারুণ এক চমক পেলো। চোখের সামনে, মাহাদ-স্নেহা, ইফরাদ-শার্লিন, মিহাল-নিহাল, সাইরা-সাইফা, তিশা-রাহান, ইশা-ঐশী, আয়মান-ইশফাক, শিখা, রেখা, আরফান, সামিদ, মাহিশার কোলে আদ্রিশা, বাবা-মা, খালামনিকে দেখে সে হতবাক, বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে সবাইকে দেখছে। রাইমাকে দেখে সবাই একসাথে জোড়ালো স্বরে বলে উঠলো,
“হ্যাপি বার্থডে রাইমা খন্দকার।”
রাইমা খুশিতে হাসতেই যেনো ভুলে গেছে। দুহাতে মুখ চেপে কেঁদে ফেলেছে। কত্তোগুলো মাস পর একসাথে সবাইকে দেখলো। সবাই রাইমার দিকে এগিয়ে আসতে পা বাড়াতেই দিগন্ত রাইমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
“আজ আপনার জন্মদিন, জানতাম না। কিন্তু শার্লিন জানিয়েছিলো। আপনি জন্মদিন পালন পছন্দ করেন না। কিন্তু এই দিনটায় আপনার আপন মানুষদের তো কাছে এনে একটু দারুণ সময় কাটানো যায় বলুন! আর বিয়ের পর বাচ্চাদেরও সেভাবে সময় দেওয়া হয়নি। ভাবলাম একসাথে দুটো কাজই হয়ে যাক। সব পুরুষই পরিবারকে সুখী দেখতে চেয়ে খেটেখুটে হয়তো নিজের প্রিতয়মার স্পেশাল দিনগুলো মনে রাখতে পারেনা! কিন্তু তারা তাদের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে স্ত্রী-কে একটু খুশি করার।”
রাইমা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছে মৃদু হাসলো। ধীর স্বরে বললো,
“আপনার উপর শোধ তুলবো বলে বিয়েতে রাজী হয়েছিলাম। ভাগ্যিস হয়েছিলাম, নয়তো এতো সুন্দর সময় জীবনে আসতো না। ভালোবাসি মি: দিগন্ত আহসান। আপনাকে ভালোবাসি।”
১২৩,
বিয়ের পর ভালোবাসি কথাটা রাইমার মুখে প্রথম বার শুনলো দিগন্ত। মুখে বললেই যে ভালোবাসা হয়, নয়তো নয়! এমনটা তাদের সম্পর্কে হয়নি। তারা মুখে বলেনি, শুধু নিজেদের উপস্থিতি দিয়ে বুঝিয়ে গেছে তারা একে অপরকে ভালোবাসে। দিগন্ত আলতো হাসলো। সবাই এগিয়ে এসে রাইমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। বাচ্চাদের সাথে খাওয়া দাওয়া, আনন্দ মজা সব মিলিয়ে দিনটা বেশ ভালো কাটলো রাইমার। বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসলে শার্লিনকে উদ্দেশ্য করে রাইমা বলে,
“ট্রিপল হয়ে যাচ্ছি শালু, এবার বিয়ে কর। বিয়ের দাওয়াত খেতে ইচ্ছে করছে।”
রাইমার কথা শুনে সবাই খুশিতে আত্মহারা। দিগন্ত হতবাক, সে বাবা হবে! এতো দারুণ অনুভূতির সাথেও অবশেষে সে পরিচিত হতে চলেছে! শাহনাজ বেগম, সাহিরা বেগম, স্নেহা তো খুশিতে রাইমাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছে। শার্লিন এক নজরে সব দেখে রাইমাকে সবাই ছাড়লে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ইশশ এতো সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে কেনো রাই! স্বপ্নের মতো লাগছে। আসলেই সত্যি তো!”
“হু সত্যি।”
রাইমা ছোট্ট করে উত্তর দিলো। দিগন্ত সবাইকে তাড়া দিলো, সন্ধ্যা হয়েছে বাড়ি ফিরতে হবে। বাইরে বেরুনোর আগে আগে ইফরাদ শার্লিনের পাশাপাশিই হাঁটছিলো। সে শার্লিনের কানে কানে বললো,
“সবাই সংসার জীবন গুছিয়ে নিলো আমার পাগলি। অনেক ধৈর্য ধরলাম, আর পারলাম না। আপনাকে আমার ঘরে নিয়ে তবে শান্তি লাগবে মনে হয়। সব কেমন অশান্তি অশান্তি মনে হচ্ছে।”
শার্লিন ইফরাদের চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অনেক টা শান্ত হয়ে এসেছে তার স্বভাব। কথায় কথায় আর বাচ্চামিও করেনা। ইফরাদ মিস করে খুব। সে শার্লিনের চোখে চোখ রেখে বললো,
“বিয়ের পর অন্তত এতো শান্ত থাকবেনা তুমি। আমার ভালো লাগেনা। ঝগরুটে, নির্লজ্জ মেয়েটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।”
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি ইফরাদ সাহেব।”
শার্লিন চট করে পা উচিয়ে ইফরাদের গালে সবার অলক্ষ্যে চুমু খেয়ে কথাটা বললো। ইফরাদ ‘থ’ হয়ে দাড়িয়ে পরে। নির্লজ্জ হতে বলেছে বলে! এতো মানুষের মাঝেই চুমু খাবে!! যদি কেউ দেখে ফেলতো! ভাগ্যিস অন্ধকার নেমেছে চারদিকে।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ঢুকলো রাইমা আর দিগন্ত। দুজনেই ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসেছে। বাবা হওয়ার বিষয়টা দিগন্ত জানার পর যতোটা খুশিখুশি লাগছে, তার থেকেও বেশি নার্ভাস লাগছে৷ রাইমার তো ভীষণ লজ্জা লাগছে। সে চোখ পিটপিট করে ফ্লোরের দিকেই তাকিয়ে আছে। দিগন্তের চোখে চোখ রাখতে পারছেনা৷ দিগন্ত রাইমার বাহু আঁকড়ে বুকে জড়িয়ে রাইমার মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে কাঁপা স্বরে বলে,
“একটা ছোট্ট অস্তিত্ব আমার পুষ্পবতীর মাঝে বেড়ে উঠছে! সে আসবে, ছোটো ছোটো হাত পা নিয়ে ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে এই বাড়ি মাতিয়ে তুলবে। আমাদের দায়িত্ব বাড়বে, সময় বোঝাবে আমরা একসাথে অনেক বছর যাবত কাটাতে পেরেছি। কেমন একটা সব এলেমেলো লাগছে পুষ্পবতী। আপনি সুন্দর, অসম্ভব রকম সুন্দর অনুভূতির সাথে আমায় পরিচিত করাচ্ছেন। ভালোবাসি আমার অস’ভ্য বউ।”
অস’ভ্য বউ ডাকটায় রাইমা আজও খিলখিলিয়ে হাসে। দিগন্ত মুগ্ধ নয়নে দেখে তার ঝগরুটে-নরম স্বভাবে মোড়ানো, লজ্জা-নির্লজ্জে, আদরে-অবহেলায় জড়ানো একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষটিকে। সম্পর্কে আদর থাকলে অবহেলাও থাকে। কোনো সম্পর্ক বিনা অবহেলায় সুন্দর হয়না। অবহেলা বোঝায় সম্পর্কের টান কতোটা। সব মিলিয়েই একটা সম্পর্ক সুন্দর হয়, পার্ফেক্ট হয়না, পার্ফেক্ট করে নিতে হয় যেটা দিগন্ত-রাইমা করে নিয়েছে। ভালো থাকুক তারা, তার সাথে ভালো থাকুক প্রতিটা ভালোবাসার মানুষগুলো।
সমাপ্ত।