আগন্তুক🍁
সপ্তম(শেষ) পর্ব
মিহি
সময় পেরিয়ে গেছে অনেকটা। আবিদ তন্বীকে ধর্ষণের চেষ্টা করার দায়ে এখন জেল খাটছে। আদৃতের কাছে ফিরেছে তন্বী তবে তাকে আর কেউই মেনে নেয়নি। না তার পরিবার আর না আদৃতের পরিবার। হয়তো আদৃত নিজেও পারেনি তন্বীকে মেনে নিতে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছেলেদের প্রথম ভালোবাসাটাই শেষ ভালোবাসা হয়। এরই দরুন আজও আদৃতের মন জুড়ে শুধু তন্বী। তবে মাঝে মাঝেই অস্থির মনটা আদিরাকে মনে করে। আদিরার প্রতি যে আদৃতের একটা দুর্বলতা কিংবা ভালোলাগার অনুভূতি ছিল তা কখনোই অস্বীকার করতে পারবে না আদৃত। বিষয়টা তন্বীও উপলব্ধি করে কিন্তু তার কিছুই করার নেই। ভুলের সূচনা সে-ই করেছিল। আগন্তুক মেয়েটার প্রতি আদৃত হয়তো দুর্বল হত না যদি তন্বী আদৃতের ভালোবাসাকে তাচ্ছিল্য করে ফেলে না যেত। তন্বী এখন আর আগের মতো নেই,সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আগের সেই রাগী,বখে যাওয়া মেয়েটা এখন শান্তশিষ্ট,সংসারী। আদৃত বরাবরই চুপচাপ। প্রয়োজন ব্যতীত তন্বীর সাথে তার কোন কথা হয় না। প্রয়োজনীয় কথা বলতে সারাদিনে বড়জোর দু’বার মুখোমুখি কথা হয় তাদের,সকালের নাস্তায় আর রাতের খাবারে। এরই মধ্যে একটা অঘটন ঘটে গেল। তন্বীর বাবা চলে গেলেন এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। তন্বীকে বাবার লাশটা অবধি দেখানো হলো না। সবার একটাই কথা,”এই দুশ্চরিত্র মেয়ে বাবার লাশ দেখলে তার কবরে আযাব হবে,ঘোর আযাব।” সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল সে। আদৃত চাইতেও যেন তন্বীকে সামলাতে পারছিল না কিংবা তন্বীই চাইছিল না সামলে উঠতে। তন্বীর অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হতে থাকল। আদৃত নিজের দিক থেকে চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব তন্বীকে সামলানো যায় কিন্তু তন্বী মেয়েটার মন কোনভাবেই ভালো করতে পারছে না সে। তন্বীর মানসিক অবস্থার অবনতি আর নিতে পারল না আদৃত। আগের মতো ভালোবাসা,যত্নে ঘিরে ফেলল তন্বীকে। রোজ অফিসে পৌঁছে তন্বীকে কল করে জানানো,দুপুরে খাওয়ার আগে তন্বীকে জানানো,রোজ বিকেলে ফেরার সময় তন্বীর জন্য তাজা বেলী কিংবা বকুলের মালা নিয়ে আসা-সবকিছু যেন তাদের ভালোবাসার এক নবসূচনা। তন্বী সামলে নিতে শুরু করেছে নিজেকে। আদৃতের ভালোবাসা তার মনকে আবার আগের মতো করে তুলেছে। সংসারী সে এখনো আছে তবে শান্তশিষ্ট আর নেই। সারাক্ষণ বকবক করে,রোজ রাতে আদৃতের বুকে মাথা রেখে সারাদিনের জমানো সকল কথা না বলা অবধি ঘুম নেই তার। এতসবের মাঝেও আদৃতের বুকের এককোণ সবসময় শূন্য লাগে তার। হয়তো সে শূন্যতা আদিরার জন্য কিন্তু তন্বী তার হৃদয়ের অনেকাংশের শূন্যতা পূর্ণতায় রূপ দিয়েছে। এই সামান্যটুকু শূন্যতার জন্য তন্বীকে ছেড়ে ঐ আগন্তুক মেয়েটার প্রতি মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ার কোন জোরালো কারণ নেই আদৃতের,থাকলেও হয়তো সে হত না।
পড়ন্ত বিকেল। সূর্য প্রায় ডুবে গেছে। তন্বীর মনে আজ এক অন্যরকম আনন্দ খেলা করছে। প্রসন্ন মুখে দরজার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে সে। কিছুক্ষণ বাদে বাদেই বারান্দায় গিয়ে আদৃত আসার প্রতীক্ষা করছে সে। সাড়ে ছ’টা বেজে গেছে অথচ আদৃত আসছে না যেখানে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই আদৃত বাসায় ফিরে। ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছুঁইছুঁই। চিন্তা যেন মাত্রা ছাড়াতে থাকে তন্বীর। শরীর ঘামতে শুরু করে তন্বীর। মাথা ঘুরে ওঠে। আদৃতকে কল করতে থাকে বারবার,রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ কল ধরছে না। আচমকা কল রিসিভ হয়। অপরপাশ থেকে প্রচুর হৈচৈ এর মাঝে একটা লোক কর্কশ গলায় বলে ওঠে,”এখানে একটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট হয়েছে। সবাই স্পট ডেড। সেখানেই ফোনটা পড়ে থাকতে গেলাম।” তন্বীর হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়,স্ক্রিণে স্পষ্ট কয়েকটা দাগের ছাপ দেখা যায়। মেঝেতে বসে পড়ে তন্বী। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল তন্বী। হাতের কাঁচের চুড়ি ভেঙে হাতে ঢুকে রক্তাক্ত হয়ে গেল। সাজানো চুলগুলোতে জট লাগতে শুরু করেছে,কাজল লেপ্টে গেছে চোখে। আচমকা কলিং বেল বেজে উঠল। তন্বীর অন্তঃআত্মা যেন কেঁপে উঠল। দরজার কাছে যেতে নিয়ে শাড়ির আঁচল পায়ে লেগে পড়ে যেতে নেয়। সেসব উপেক্ষা করে দৌড়ে দরজা খোলে সে।
ঘর্মাক্ত দেহে আদৃত বাইরে দাঁড়িয়ে। তন্বী জড়িয়ে ধরে আদৃতকে। তন্বীর চোখের জলে আদৃতের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। আদৃত তন্বীকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে।
আদৃতকে সব খুলে বলে তন্বী। তন্বীর কথায় হেসে ওঠে আদৃত। বলে,” ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছিল আর ঐ ফোনে ইম্পর্টেন্ট কিছু তথ্য ছিল তাই ফোন খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। পেলাম না। ফোন খুঁজতেই লেট হলো। চোরটার জন্য মায়া লাগছে। বেচারা!” তন্বী রাগে কটমট করছে। হঠাৎ তন্বী কেন যেন লজ্জা পেতে শুরু করল। লজ্জায় লাল হয়ে উঠতে থাকল ফর্সা মুখখানি। আদৃত তন্বীকে কোলের উপর বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল ঘটনা কি? তন্বী লজ্জামাখা মুখে আদৃতের বুকে মুখ ডুবিয়ে বলল,” আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।” আদৃত কি বলবে,কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তন্বীকে শক্ত করে বুকের মাঝে মিশিয়ে নিল সে।
শুভ্রর বিয়ে সামনের মাসে। আদিরার সাথে নয়,রজনীর সাথে। শুভ্রর মা আজমিরা বেগমের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। বুকের ব্যথায় কাহিল তিনি,কোন রকম ব্যথা সহ্য করার মতো অবস্থায় নেই। রজনী হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলেনি এই বিয়ে সম্পর্কে। সম্ভবত তার মৌনতাকে আজমিরা বেগম হ্যাঁ ধরে নিয়েছেন।শুভ্র না করার সাহস পাচ্ছে না। মায়ের শেষ ইচ্ছে এটা। হয়তো এবার প্রকৃতিও চায় সে আদিরাকে ভুলে থাকুক যদিও সেটা সম্ভব না। ওহ হ্যাঁ, এসবের মাঝে একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেছে। তা হলো ইরহাম সাহেবের পালানোর কারণটা শুভ্র খুঁজে বের করেছে। অফিসের এক মহিলার সাথে শুভ্রর বাবার কয়েক মাসের গভীর সম্পর্ক। তাই পেনশনের টাকা নিয়ে তিনি সেই মহিলার সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে চলে গেছেন। এই বুড়ো বয়সে বাবার এই কাণ্ডে শুভ্র মোটেও বিচলিত নয়। তার মায়ের মতো মহিলার সাথে থাকা আসলেই সম্ভব না কিন্তু সে এখন মাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। আদিরা এখন ব্যস্ত নিজের স্বপ্ন নিয়ে। শুভ্রকে হয়তো তার আর প্রয়োজন পড়বে না। রজনী আজকাল শুভ্রর একটু বেশিই খেয়াল রাখে। প্রস্তুতি নিচ্ছে সংসার সামলানোর।
সবাই জীবনের পথে চলার জন্য একজন সঙ্গী পেয়ে গেছে। পায়নি শুধু আদিরা মেয়েটা। সে সবার কাছে আগন্তুক ছিল আর আগন্তুকই রয়ে গেল। ল’কলেজে টপার হিসেবে তার ভালোই সুনাম আছে। এল.এল.বির ডিগ্রিটা এখন মূল লক্ষ্য। অতঃপর একটা প্রফেশনাল লইয়্যার হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি আর সম্পত্তির টাকায় জীবন বেশ ভালোই চলছে তার। সবকিছুই ভালো চলছে তবে মাঝে মাঝেই শুভ্র নামক ভালোবাসার মরীচিকাটাকে ধরার জন্য তাড়া করে বেড়ায় সে মনে মনে। ব্যর্থ চেষ্টা। যা মরীচিকা,তাকে ধরা কি আদৌ সম্ভব? শুভ্রর বিয়ের কথাও সে জেনেছে কোন এক মাধ্যমে। জানার পর থেকেই শুভ্রর কথা মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলেছে। অবশ্য মন সাদা পৃষ্ঠা নয় যে কিছু লিখলাম,আবার রাবার দিয়ে মুছে দিলাম। এত সহজ তো নয় সবকিছু তবু চেষ্টা করছে আদিরা।
পরিণতিটা হয়তো এমন হবে কেউই ভাবেনি। আদৃত ভেবেছিল হয়তো তন্বী আর ফিরবে না,সে ফিরেছে। শুভ্র ভেবেছিল সে তার আদিরাকে ফিরে পাবে,অথচ আদিরা ফিরিয়ে দিল তাকে। আদিরার পরিণতি নিয়ে ভাবার কিছুই ছিল না। সে তার জীবনে কাউকে প্রত্যাশা করে থাকলে তা ছিল কেবল তার স্বপ্ন যা তার উপরই নির্ভর করছে। অবশ্য আদিরার এতদূর আসার ক্রেডিট কিন্তু সে আদৃত আর শুভ্রকেই দেয়। ক্যাম্পাসের অনেকেই ভাবে হয়তো আদিরার জীবনে দুজন পুরুষ ছিল,কেউবা ভাবে এরা আদিরাকে একতরফা ভালোবাসত কিংবা কেউ ভাবে ছেলেগুলো আদিরার আত্মীয়। অনেক আজগুবি ভাবনা তাদের তবে সত্যিটা কারোই অবগত নয়। আদিরা মেয়েটা যে দুইজনের কাছেই আজীবন আগন্তুক ছিল আর আগন্তুকই রয়ে যাবে তা তাদের মস্তিষ্কে বোধগম্য হওয়ার কথা নয়।
সমাপ্ত।
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পর্কে নিজেদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।]