আগন্তুক🍁
পঞ্চম পর্ব
মিহি
তন্বীর বিষণ্ণ মনে মেঘলা চিন্তা ভাবনা খেলা করছে। উদাসী বিকেলের বিষণ্ণতা তার মনকে অস্থির করে তুলছে। ঈশান কোণে মেঘের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। আবিদ নেই,হোটেলের আশপাশেও নেই আবিদ। কোথায় সে? তন্বীর ভাবান্তর ঘটলো বৃষ্টির ছিটেফোঁটায়। বারান্দার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তন্বী। বৃষ্টির ফোঁটা গ্রিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে আসছে তন্বীর গালে। বৃষ্টির ফোঁটার মুগ্ধতা যেন তন্বীর বিষণ্ণ মনকে সজীব করে তুলল যেমন করে মূর্ছে যাওয়া সবুজ প্রকৃতিতে সজীবতার পরশ বুলায় বৃষ্টির ফোঁটা। তন্বী হাসে তবে সে হাসি দৃশ্যমান হয় না। তন্বীর ঠোঁটের কোণা প্রসারিত হয় না তবে মনের মাঝে যে বিষণ্ণতার ঘনঘটা ছিল তা মুছে আনন্দের রৌদ্র দেখা দিতে শুরু করেছে। আবিদের কোন খোঁজ নেই যেন কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে নিরুদ্দেশ সে। নিঃসঙ্গতার গ্লানিতে যেন মুমূর্ষু তন্বী। নিঃসঙ্গ মস্তিষ্কে খেলা করছে আদৃত ছেলেটার সাথে কাটানো কয়েক মুহূর্ত। আদৃতের চেয়ে কি বেশি ভালোবাসে আবিদ তাকে? তন্বীর চিন্তা ভাবনা ঘুরে ফিরে বারবার আদৃতের দিকেই ইঙ্গিত করছে কিন্তু আদৃতের কাছে ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই তন্বীর কাছে। আদৃতের জীবন তো এখন আদিরা মেয়ের দখলে। অবশ্য তন্বী চাইলেই পারত স্ত্রীর অধিকারে এখনো আদৃতের জীবনে পড়ে থাকতে কিন্তু জোর করে কি আদৃতের ভালোবাসা পেতে পারবে তন্বী? পারবে না। জোর করে ভালোবাসা আদায় করা কখনোই সম্ভব না। তন্বী হাসছে,নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে। নিজের প্রতি ঘৃণা কাজ করছে তন্বীর মনে,মারাত্মক ঘৃণা।
শুভ্র আদৃতের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে। ভিতরে যেতে একটা সংকোচ কাজ করছে মনে। যে কেউ এখানে এভাবে তাকে দেখলে উল্টো পাল্টা ধারণা ব্যতীত ভালো কিছু মাথায় আনবে এ সম্ভাবনা শূণ্যের কোঠায়। আদিরার নম্বরে কল দিয়ে যাচ্ছে শুভ্র কিন্তু ফোন সুইচড অফ বলছে। আদিরার ফোনের লাস্ট লোকেশন এখানেই ট্র্যাক হয়েছে। শুভ্রর চিন্তিত মুখটা ঘেমে একাকার। স্তব্ধ বিল্ডিংয়ের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে শুভ্র। অবশেষে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল শুভ্র। ব্যাগটা ঠিকমতো কাঁধে নিয়ে আশেপাশে লক্ষ করে দ্রুত বিল্ডিংটার ভেতরে প্রবেশ করল শুভ্র। চারতলা বিল্ডিংয়ের প্রত্যেক তলায় একটা করে ফ্ল্যাট। আদিরা এখন কোথায় আছে কিভাবে বুঝবে শুভ্র? মেয়েটা তো কল অবধি ধরছে না। নিচতলার ফ্ল্যাটটার দিকে এগোচ্ছে শুভ্র। হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। এমনটা হয়েছিল ক্লাস সেভেনে থাকতে সিগারেটে প্রথম ঠোঁট ছোঁয়াতে। বাড়িতে ঝগড়া করে এক বন্ধুর কাছে সব বলতেই সে সিগারেট ধরিয়ে দিয়েছিল হাতে। প্রথম টান দেওয়ার আগে হৃদস্পন্দন এমনভাবেই বেড়েছিল। অতঃপর আদিরার প্রেমে পড়েও কখনো হৃদস্পন্দন বাড়েনি। মেয়েটার সাথে হুডতোলা রিকশায় গা ঘেঁষে বসেও বাড়েনি হৃদস্পন্দন অথচ আজ সে দূরে। তার কাছে যেতেই আজ হৃদস্পন্দনের এই উর্ধ্বগতি। আমরা সবসময় ভাবি অনুভূতিগুলো বুঝি খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে হয় অথচ দূরত্ব অনুভবের যে মাত্রা শেখায় তা কাছাকাছি থেকে শেখা যায় না। ভালোবাসার অনুভূতিটা দূরত্বই শিখিয়ে দেয়,দূরত্বই শিখিয়ে দেয় কল্পনা করতে,শিখিয়ে দেয় ভালোবাসার দূরে থাকার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে।
আজমিরা বেগম মুখে পান পুরে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। স্বামী ইরহাম সাহেব বেশ কয়েকবার ঘরের ভেতরে এসে আজমিরাকে কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন কিন্তু বলতে পারছেন না। এবার আজমিরা বেগম চটে গেলেন। এমনিতেই সারাদিনে শুভ্রর খোঁজ পাননি তিনি। তার উপর তার স্বামীর এমন কাজকর্ম যেন রক্ত চড়িয়ে দিচ্ছে মাথায়। ইরহাম সাহেব ঘরে ঢুকলেন আবার। এই নিয়ে চারবার চিরুনিটা হাতে নিয়ে চুলে বুলালেন। অতঃপর ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে থাকা ঘড়িটা হাতে দিতেই আজমিরা বেগম উঠে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। এনালগ যুগের সিনেমার ভিলেনের মতো তেড়ে আসলেন ইরহাম সাহেবের দিকে। ইরহাম সাহেব ভয়ে আঁতকে উঠলেন।
–কি হয়েছে কি? সকাল থেকে গুণে গুণে চারবার ঘরে ঢুকে চুল আঁচড়ালে। অফিস যাবেনা বুঝেছি,কিছু বলবে তো বলে ফালাও। এত ঢঙ করো কেন মাইয়া মাইনষের মতো!
–ঢঙ! কিসের ঢঙ? সরো তো,আমার অফিসে বহুত কাজ আছে।
–তাহলে এখনো যাওনি কেন?
–স্যার দেরিতে যেতে বলেছেন। হইছে? বুঝছো? এখন রাস্তা ছাড়ো।
–কি বলবি বলে তারপর যা। তোর ঐ ঢঙ দেখার লাইগা বসে নাই আমি।
–ছিঃ ছিঃ! লজ্জা করেনা স্বামীকে তুই করে ডাকতে?
–এখন অবধি তোর ঘাড় মটকায়নি হেইডাই তোর বাপের ভাগ্য। কি বলবি বল তাড়াতাড়ি। রাগ চরাস না মাথায়।
–আজমি! এমন করছো কেন তুমি? জ্বীনে ধরলো নাকি তোমায়। ওহ আল্লাহ্! আমার কলিজার টুকরো বউয়ের উপর কোন শয়তান জ্বীনের বদছোয়া পড়ল খোদা!
–তুই থামবি ইতরের বাচ্চা? যা বলবি সেটা বলে বিদেয় হ।
–বলছিলাম কি…বাবা আদিরার নামে যা লিখে দিছে তা ওকে দিয়ে আমরা মেয়েটাকে শুভ্রর বউ করে আনলে হয়না?
–কি বললি তুই!! তোর খুব বার বাড়ছে! তোর সাহস হয় কি করে আমার টাকাতে ঐ মেয়েছেলের ভাগ বসাইতে। ওরে একটা ফুঁটো কড়িও আমি দিব না। বের হ তুই। বের হ আমার ঘর থেকে।
আজমিরা বেগম লাঠি নিয়ে তেড়ে এলেন ইরহাম সাহেবের দিকে। ইরহাম সাহেব অফিসের ব্যগটা নিয়ে কোনরকম পালিয়ে বাঁচলেন। আজমিরা বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। এত রাগ কখনো হয় নি তার। অথচ এই টাকার মোহে তিনি হাসতে-কাঁদতে ভুলে গেছেন। বুকের ভেতর চিনচিন করছে,গলা শুকিয়ে আসছে তার। আচমকাই আজমিরা বেগম বুকে হাত দিয়ে কাঁতরাতে কাঁতরাতে নিচে পড়ে গেলেন।
আদিরার সামনে বসে আছে শুভ্র,পাশেই দাঁড়ানো আদৃত। শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে আদিরা। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতেই যেন গলা শুকিয়ে আসছে আদিরার। এতটা চাপা কষ্টেই কি শুভ্রর মুখমণ্ডল জুড়ে এমন বিষাদের ঘনঘটা নাকি এ আবার ভালোবাসার নাভে নতুন কোন খেলা। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে শুভ্রর দিকে তাকাতেই শুভ্র আদিরার হাতজোড়া ধরে তার পায়ের কাছে বসে কাঁদতে থাকে। বিশুদ্ধ জলের ফোঁটা বয়ে পড়ে গাল বেয়ে। একটা ছেলে একটা মেয়ের সামনে তখনি নত হতে পারে যখন সে মন থেকে মেয়েটাকে ভালোবাসে। অহংকার,অহমিকা,জেদ,রাগ,অভিমান সব ভুলে একটা মেয়ের সামনে নত হতে ভালোবাসা ছাড়া আর কি কারণ লাগতে পারে? আদৃত দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। অবশেষে আগন্তুক মেয়েটা চিরকাল আগন্তুকই থেকে যেতে চলেছে। স্মিত হাসলো সে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে আদিরার গাল স্পর্শ করল। আদিরার গাল বেয়ে বয়ে পড়া অশ্রুফোঁটা মুছে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
–অবশেষে আগন্তুক মেয়েটার প্রেমিক এল। এখন তোমরা যেখানেই থাকো,সুখে থাকো-এই প্রার্থনাই করি।
–ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি না থাকলে আদিরার কি হত! আমি আপনার কাছে চিরঋণী।
–আরে আরে! ঋণী হয়ে থাকতে হবে না। তোমাদের নিরাপদে পৌঁছে দিতে পারলেই আমি খুশি।
সব ভালোভাবে সম্পন্ন হতে যাচ্ছিল কিন্তু শেষটা চেয়েও যেন সুন্দর হলো না। ” আমার অংশের সম্পত্তি আমাকে দিয়ে দিন শুভ্র ভাইয়া। আমি পড়াশোনা শেষ করে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। লইয়্যার হওয়ার স্বপ্নটা আব্বু দেখিয়েছিল,পূরণের দায়িত্ব আমার। আপনি আমায় ভালোবাসেন ঠিক আছে কিন্তু আমি না আপনাকে মাফ করতে পারব আর না ভালোবাসতে পারব।” আদিরার কথায় থমকে যায় শুভ্র। মনের ভেতর রিজেক্টের ঘা’টা লুকিয়ে হেসে বলে,”বেশ তো! তোর স্বপ্ন পূরণে সবটুকু সহযোগিতা আমি করব। প্রেমিক না হয়ে কিন্তু বন্ধু হয়ে তো করতেই পারি। যদি কখনো তুই এক পা এখোতে পারিস আমাদের সম্পর্কের জন্য তবেই তোকে অর্ধাঙ্গিনী করে নিব তার পূর্বে না। আর এই নে তোর প্রপার্টির কাগজ। আসার সময় লুকিয়ে এনেছিলাম। মা কখনোই চান না এই সম্পত্তি তোর হোক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই শহর ছাড়তে হবে তোকে। বন্ধু হিসেবে সাথে থাকতে চাই। অন্তত তুই স্বনির্ভর হওয়ার আগ অবধি।”
আদৃত দেখছে,চেয়ে চেয়ে দেখছে দুটি হৃদয়ের ক্ষরণ। এ ক্ষরণ কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে তা জানা নেই আদৃতের তবে আদিরার চলে যাওয়াটা হয়তো কারণ আদৃতের বুকের চিনচিন ব্যথার।
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]