#আধার_রাতের_আলো
#নুসাইবা_ইভানা
পর্ব -১৬
হুর ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। ফুয়াদ হুরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আলত হাতে হুরের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,কাঁদছেন কেন হুর পরি?
– স্বামী যদি অন্য মহিলার চিন্তায় মন খারাপ করে তাহলে তো হুর পরি কাঁদবেই।
ফুয়াদ হুরের গাল টেনে বলে,আপনার স্বামী তার হুর পরি ছাড়া,আর কারো কোন মেয়ের কথা ভাবতে পারবে না তাইতো?
হুর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আহা তাহলে আপনি কে? আমার জীবন থেকে তো মেয়েদের ভাবনা বাদ দিতে হবে।
হুর আর একটু শক্ত করে ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরে বলে,আরেহহ আমি,নুর,বোন আর মা এ ছাড়া সব মেয়ের ভাবনা বাদ।
– ফুয়াদ হুরকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,ওকে বিবিজান। এবার চলুন আমার মেয়েটা-তো একা আছে।
হুর ফুয়াদকে ছেড়ে দিলো,নিজের হাতে চোখের জাল টুকু মুছে নেবে তার আগেই ফুয়াদ নিজের হাতে হুরের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,আপনার চোখের জল মুছে দেয়ার অধিকার শুধু আমার।
নুর বসে আছে। উদাস হয়ে হুর আর ফুয়াদ দু’জনে নুরের দু’পাশে বসে নুরকে আগলে নিয়ে বলে,আমার জান বাচ্চাটা মুখ ফুলিয়ে রেখেছে কেন?সে কি জানেনা তার ভালো মা, তার মুখ ফুলোনো দেখলে কষ্ট পাবে।
নুর হুরকে জড়িয়ে ধরে বলে,”ভালো মা”, আমি তোমাদের ছেড়ে যাবো না।
– আমার বাচ্চাটাকে আমি কোথাও যেতে দেবো না তুমি তোমার বাবাই আর ভালো মায়ের সাথেই থাকবে।নুর দু’জনের গলা জড়িয়ে একে একে দু’জনের গালে চুমু দিলো।
হুর নুরকে কোলে তুলে নিয়ে ফুয়াদের উদ্দেশ্য বললো,আপনি রুমে যান আমি নুরকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আসছি।
ফুয়াদ নিজের রুমে যাওয়ার সময় হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। আদিয়া নামাজ পড়ছে!
আদিয়া নামাজ শেষ মোনাজাত ধরলো। বেশ সময় নিয়ে আল্লাহ তায়ালার দরবারে কান্নাকাটি করলো। নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলো।জায়নামাজ ভাজ করে রেখে নিজের চোখের অশ্রুগুলো মুছে নিলো।
ফুয়াদ দরজায় কড়া নেড়ে বলে,আসতে পারি?
– আসো। ফুয়াদ ভেতরে আসলো। অদিয়ার পাশে বসলো।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,আমি সত্যি অবাক হয়েছি। তুই নামাজ পড়ছিস! তোর এই পরিবর্তনটা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
-ভাইয়া জীবন বড়ই অদ্ভুত জানো তো,আমরা জীবনের অর্ধেক সময় ভুল কাজেই ব্যায় করে দেই। দেখো হুর মেয়েটা কি জ্ঞানী! একটা মেয়ে, এইটুকু বয়সে কত বুঝ তার।ও আমাকে বলল,নামাজ মানুষকে সমস্ত খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। আপনি নামাজ পড়া শুরু করেদিন। আমি বলেছিলাম আমার এতো এতো অন্যায় আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবে? ও বলল,আল্লাহ তায়ালা দয়াশীল। যদি কেউ নিজের ভুল বুঝতে পরে অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা যায় তাহলে তিনি ক্ষমা করে দেন। আমরা ডিপ্রেশনে থাকলে ডিপ্রেশন কাটানোর জন্য গান শুনি, সিনেমা দেখি কিন্তু হুর বলল,তুমি নামাজ পড়ো,জিকির করো। একাকিত্বে আল্লাহ তায়ালাকে স্বরণ করো,দেখবে তোমার অন্তর প্রশান্তিতে ছেঁয়ে গেছে। তার কথা মতো কাজ করে দেখলাম। এখন মনে হচ্ছে আমার সাথে যাইহোক ভালোই হবে।কিন্তু এভুলের মাশুল আমি কি ভাবে দিবো। আল্লাহ তায়ালা আমাকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করুক।আমিন।
ফুয়াদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদিয়ার দিকে, গভীর চিন্তায় মগ্ন। মনে হচ্ছে তার চঞ্চল বোনটার মনে কোন তুফান চলছে।সরাসরি জিজ্ঞেস ও করতে পারছে না। দ্বিধা কাজ করছে।
আদিয়া বলল,কি ভাবছো ভাইয়া?
– কিছু নাতো। আচ্ছা তুই থাক আমি যাই।
– একটা কথা বলি ভাইয়া?
– হ্যা বলো একটা কেন যত খুশি বল।
– তুমি মেয়েটাকে মেনে নাও।সবার জীবনে দ্বিতীয় বার বসন্ত আসে না। তোমার জীবনে দ্বিতীয়বার বসন্ত এসেছে। কালবৈশাখী ঝড়ের আগেই বসন্তকে আপন করে নাও।হারাতে দিলে এ শহরে কেয়বা রাখে খোঁজ। নিখোঁজ সংবাদ বিলীন হচ্ছে অন্ধকারে রোজ।
ফুয়াদ মুচকি হেসে বলে,এ বসন্তকে আর যেতে দিচ্ছি না।হাজার কালবৈশাখী ঝড়ের পরেও আমার এই ব্যক্তিগত বসন্তকে আগলে রাখবো।
– তোমার জন্য শুভকামনা রইলো ভাইয়া।নতুন জীবন সুখের হোক।
ফুয়াদ নিজের রুমে চলে আসলো,আজকে তার বিষাদের রাত হওয়ার কথা ছিলো? কিন্তু আজ কেমন ফুলসজ্জার রাতের মতো এক্সাইটেড লাগছে।কেমন অস্থির অনূভুতি হচ্ছে। সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ হিসেবে যেটা বড্ড বে মানান।রুমের মধ্যে পায়চারি করছে,কি থেকে শুরু করবে?কি বলবে সেসব ভেবে ভেবে অস্থির। এসির বাতাসেও ঘেমে যাচ্ছে। অনেক ভাবা ভাবির পর হাতে মোবাইল নিলো,স্ত্রীর অধিকার শরীয়ত মোতাবেক কি কি? এটা লিখে সার্চ দিলো। তারপর হুট করে সেদিনের হুরের গাওয়া গজলের কথা মনে পড়লো। সার্চ দিলো সঙ্গীনি গজল লিখে। পেয়েও গেলো। ঘন্টা খানিক সময় নিয়ে সেটা শিখলো। তারপর মু’য়ানাকার দোয়াটাও শিখলো।
এখন সেটা বারবার পড়ছে,,,
اللهم زد محبتي لله ورسوله
অর্থঃ-
(আল্লাহপাক আমাদের মধ্যে আল্লাহ ওয়াস্তে পরস্পর মোহাব্বত ও ভালবাসা বৃদ্ধি করে দিন।)
______________________________________________
আলো বেগম রেহানা বেগমের মুখোমুখি বসে আছে,রেহানা বেগমের দু’চোখে অশ্রু টলমল করছে।যে কোন সময় গড়িয়ে পড়বে।
দু’জনেই চুপ কারো মুখে কোন কথা নেই। বিথীর বড় বোন বর্ষা নিরবতা ভেঙে বলে,আম্মি যা হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি আমরা মানছি। কিন্তু তাই বলে কি নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক শেষ করে দেবো!
আলো বেগম কাটকাট ভাষায় বলে দিলেন,আমার আপনাদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। যে জিনিস ভেঙ্গে যায় তা জোড়া লাগনো যায় না। আর লাগালেও সেখানে দাগ থেকেই যায়।
– আম্মি বিথীর ভুলের জন্য আমরা ক্ষমা চাইছি। ওকে ক্ষমা করে দাও।একটা ভুল করেই ফেলেছি এটা নিয়ে পড়ে থাকলে হবে?
– সে কোন ফিডার খাওয়া বাচ্চা নয়। যে তাকে ক্ষমা করে দেবো।আমার ছেলের জীবনে ওর ছাঁয়া আমি সহ্য করবো না।
– তুমি না চাইলেও তো সম্পর্ক একটা থেকেই যায়। অস্বীকারতো করতে পারবে না। নুরের মা বিথী।এই নারীর টান কি ভাবে ছিন্ন করবে?
– সেটা অনেক আগেই ছিন্ন করে আপনার বোন চলে গিয়েছিল।আর আমার ছেলের গোছানো জীবনে আর কোন কালো ছাঁয়া পড়তে দেবো না।আর শরীয়ত অনুযায়ী ডিভোর্সের পর আর সেই স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়া যায় না।
– ওই ভাবে না নাও তোমাদের বাসার এক কোনায় পড়ে থাকবে শুধু ওর মাথা গোঁজার ঠাঁই দাও।
– আমার বাড়ি কোন ধর্মশালা বা আশ্রয় কেন্দ্র নয়, যে যাকে তাকে থাকতে দেবো।
বর্ষা বুঝে গেছে কোন লাভ হবেনা। তাই কথা না বাড়িয়ে ডিরেক্ট বলে,আমরা নুরের জন্য কেস ফাইল করবো।হয়তো তোমরা বিথীকে তোমাদের বাসায় থাকার অনুমতি দেবে। নয়তো নুরকে বিথীর হাতে তুলে দেবে।
– আপনাদের মানসিকতা যে কতটা নোংরা সেটা আমি জানি। আপনাদের যা ইচ্ছে করতে পারেন। দেখি আইনের দৌঁড়ে কে কতদূর যেতে পারে!
আলে বেগম উঠে আসার আগে একবার রেহানার দিকে তাকিয়ে বলে,শুনেছি, মেয়েরা মায়ের মত হয়। তোর মনে যে এতো,নোংরামী ছিলো বুঝতেই পারিনি।এখন মনে হচ্ছে দুধ,কলা দিয়ে কাল সা’প পুষে ছিলাম।
আলো বেগম চলে যেতেই রেহানা বেগম কেঁদে দিয়ে বর্ষাকে বলে,এই ঘোর পাপ তোরা করিস না।যে যেমন কর্ম করে তেমন ফল পাবেই। অন্যায়ের সঙ্গ দেওয়া আরো বড় অন্যায়।
– তোমার নীতি বাক্য তোমার কাছে রাখো,এখন ডিভোর্স নিয়ে নাড়া দিলে কম করে হলেও কাবিনের দশ লাখ টাকা তো পাবো।আমাদের না হয় দু’লাখই গেলো।
– লোভ সব সময় মানুষকে ধ্বংস করে,কথায় তো,আছেই লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
– তুমি মাঝখানে আসবে না বলে দিলাম। মা হয়ে কয় মেয়ের সাথে থাকবে তা-না করে বোনের পক্ষ করো।কেমন মা তুমি?নিজের মেয়ের দূর্দশা চোখে পড়েনা। তোমার চোখ নাকি চুলো। যা করার বোনটার জন্য আমাকেই করতে হবে।
– সফল তো হতে পারবি না।তোর বোন অন্যায় করেছে আর সেই অন্যায়ের শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
– তোমার কথা শুনে ইচ্ছে করছে তোমার চুলের গোঁছা ধরে যদি দু’চারটা থাপ্পড় দিতে পারতাম তো শান্তি পেতাম।
রেহানা বেগম আশ্চর্য দৃষ্টিতে নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন!চোখ থেকে অশ্রুকণা গড়িয়ে পরছে।এই মেয়েদের সে জন্ম দেয়ার জন্য এতো যন্ত্রণা সহ্য করেছে!
বিথী ঘরে ঢুকে বলে এদেরকে কিছু বলে লাভ নেই।দু’বোনই এক।যা করার আমাদের করতে হবে।তুই সুজনকে ধরতো বনু। ছেলেটাও আমার ক্লান্ত হয়ে গেছে।
– ওই বাসায় কেউ তোকে কিছু বলেছে?
– রিতীমত অপমান করেছে।আর ওই ফুয়াদ যাকে ভেজা বেড়াল ভাবতাম। সে-তো আসলে সেয়ানা পাবলিক।আমার সামনে ওই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো।আর কি ন্যাকা ন্যাকা কথা।
______________________________________________
হুর নুরকে ঘুম পাড়য়ে রুম থেকে বের হলো। আলো বেগম তখন মনমরা হয়ে নিজের রুমে ঢুকবেন। হুর দ্রুত নিচে যেয়ে এক গ্লাস লেবুর সরবত করে নিয়ে আসলো।আলো বেগমের দিকে সরবতের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,মা এটা খেয়ে নিন আপনাকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে।
এই প্রথম হুরের মুখে মা ডাক শুনে আলো বেগম আনন্দিত হয়।সরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলে,আমি জানি তুই পারবি সব মোকাবেলা করতে।তোর উপর আমার ভরসা আছে।
– আগে সরবতটা শেষ করে নিন পরে কথা বলুন।
আলো বেগম সরবতটা পান করে গ্লাসটা বেড সাইড টেবিলে রেখে বলে,তুই আমার ছেলেটাকে কোন ভাবেই আর একা ছাড়বি না তো হুর?
#চলবে
আসসালামু আলাইকুম।
ভেবেছিলাম গল্পটা শেষ করে দিবো,কিন্তু মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে। তাই আরো কিছু পর্ব বাড়িয়ে সুন্দর ভাবে শেষ করতে চাইছি।তোমরা কি বলো আরো বড় করবো, নাকি ইতি টানবো?