“আমি বিধবা। এটা জানার পরেও কি আমাকে বিয়ে করবেন?”
বিয়ের কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত হতে যাচ্ছিল এমন সময় জোনাকি কথাটা বলে তাকে দেখতে আসা পাত্রকে হতাশ করে দিল৷ যেই ছেলেটা একটু আগেও তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তার দৃষ্টি হঠাৎ বদলে গেল। কেমন অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। যেন বিধবা হয়ে অনেক বড় পাপ করে ফেলেছে সে। এর মাঝেই পাত্রের মা জোনাকির মা জাহানারা বেগমকে বললেন,“আপনারা তো ভালোই লোক ঠকাতে পারেন! এভাবে সব কিছু লুকিয়ে একটা বিধবা মেয়েকে আমার ছেলের গায়ে ঝুলিয়ে দিতে চাইছিলেন। তোমরা সবাই উঠে পড়ো, এই বিয়ে দিয়ে হবে না। কিছুতেই আমি একটা বিধবা মেয়েকে আমার ছেলের বউ করবো না। কিসের কমতি আছে আমাদের ছেলের?”
মহিলার এমন অবহেলা জনিত কথা সহ্য হলো না জোনাকির ছোট বোন জুঁইয়ের। তাই জুঁই বলে উঠল,“আপনি এমন কথা কোন মুখে বলছেন? আপনার বড় ছেলে তো শুনলাম দুই বাচ্চার বাপ, কয়েক বছর আগে নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর পর একটা কুমারী মেয়েকে বিয়ে করল। তখন তো এই নিয়ে আপনার অসুবিধা হয়নি। তাহলে আমার বুবুর বেলায় এমন করছেন কেন?”
মহিলা তাচ্ছিল্য করে বললেন,“কার সাথে কার তুলনা। পুরুষ মানুষ হচ্ছে সোনার আংটি। আর সোনার আংটি বাকা হলেও অসুবিধা নাই। সেটা জানো না?”
জুঁইও তাচ্ছিল্য করেই বলল,“আপনার ছেলে তো শুনলাম একটা ওষুধের দোকানে থাকে, সে যদি সোনার আংটি হয় তাহলে আমার বুবু যে একজন শিক্ষিকা সে তো হিরার আংটি। কারণ সে মানুষ গড়ার কারিগর। আপনি কি রিজেক্ট করবেন আমিই আপনার ছেলেকে আমার দুলাভাই হিসেবে রিজেক্ট করে দিলাম”
“অভদ্র মেয়ে। কিভাবে কথা বলতে হয় শিখো নি? এই বাড়িতে আর এক মুহুর্ত থাকব না।”
জাহানারা বেগম অনুরোধ করে বলেন,“দয়া করে আপনারা যাবেন না। আমার বড় মেয়েটা কিন্তু অনেক ভালো। ও বাড়ির সব কাজ পারে, চাকরিও করে আর…”
“থাক,আমাদের এই বিধবা মেয়ে লাগবে না।”
বলেই তিনি পরিবার নিয়ে বিদায় নেন।
জাহানারা বেগম এবার জুঁই ও জোনাকিকে বলতে লাগলেন,“এবার শান্তি হয়েছে তো তোদের? এই নিয়ে দশ দশটা সম্মন্ধ ভেঙে গেল। জোনাকি তোর কি দরকার ছিল সত্যটা বলার? ওনারা তো রাজিই হয়ে গেছিল। আর জুঁই তুই এভাবে কথা না বললেও পারতি। ওনাদের তো জোনাকিকে খুব পছন্দ হয়েছিল, আরেকটু বোঝালে বেশি যৌতুক দিলে ঠিকই রাজি হতো।”
জোনাকি উত্তরে বলল,“আমি না বললেও ওনারা অন্য কোন উপায়ে ঠিকই জানতেন। তখনও সমস্যা তৈরি হতো।”
জুঁই বলে, “আর হ্যাঁ আম্মা তুমি শুনে রাখো আমার বুবু এতটা বোঝা হয়নি যে এত কথা শুনে তাকে বিয়ে দেওয়াবো। যৌতুকের তো প্রশ্নই ওঠে না।”
জাহানারা বেগম এবার কেঁদেই ফেলেন। নাকি সুরে বলেন,“তোরা আমার জ্বালা বুঝবি না। তোদের বাপ তো মরে গিয়ে শান্তিতে আছে। তোদের দুই বোনের সব দায়িত্ব এখন আমার। তোদের বাপের পেনশন আর জোনাকির ইস্কুলের বেতন দিয়ে চলি আমরা। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? জুঁইয়ের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে কিন্তু জোনাকির একটা হিল্লে না করে তো কিছু করতে পারছি না।”
জুঁই বলে, “তোমাকে আমার বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি আগে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাড়াবো তারপর বিয়ের কথা ভাবব। আর বুবুকেও যার তার হাতে তুলে দেবো না।”
জোনাকির এসব কথা ভালো লাগছিল না৷ তার স্কুলে যাওয়ার সময়ও হয়ে আসছিল। তাই সে বলল, “আমি স্কুলে যাচ্ছি। আম্মা তোমার কোন আলোচনা করার থাকলে পরে করো।”
জুঁই বলল,“যাবি তো খেয়ে যাবি না?”
জোনাকি মৃদু হেসে বলে,“পাত্রপক্ষের কথা শুনেই তো আমার পেট ভড়ে গেছে। আর কিছু খেতে হবে না।”
❤️
স্কুলে পরপর দুটো ক্লাস নিয়ে অফিস রুমে এসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে জোনাকি। এমন সময় স্কুলের অন্য একজন শিক্ষিকা সবাইকে খুশি মনে তার বিয়ের খবর দিয়ে বলল,“আগামী সপ্তাহে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। তোমাদের সবাইকে কিন্তু আসতেই হবে।”
মুহুর্তেই সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় পুতুল নামের সেই শিক্ষিকা। সবাই তাকে অভিনন্দন জানায়। জোনাকিও ব্যতিক্রম নয়। সে পুতুলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলে,“আপনার নতুন জীবন সুখের হোক।”
পুতুল জোনাকিকে ধন্যবাদ জানিয়ে এরপর তার প্রসঙ্গ টেনে এনে বলে,“আপনি নিজের ব্যাপারে কিছু ভাবছেন না? না মানে আপনার স্বামীর মৃত্যুর তো এক বছর হয়ে গেছে, এখন তো জীবনটা নতুন ভাবে শুরু করার কথা ভাবতে পারেন। কতদিন আর এভাবে একা থাকবেন।”
এই কথার সূত্র ধরে আরেকজন শিক্ষিকা বলে ওঠে,”বললেই হলো নাকি। একজন বিধবা মহিলাকে কে আর বিয়ে করতে চাইবে।”
কথার আঘাত অনেক বড় আঘাত। যা একটা মানুষকে মানসিকভাবে শেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ঐ শিক্ষিকার মুখে এহেন কথা শুনে জোনাকির মনেও আঘাত লাগে। খুব সন্তপর্ণে সে উঠে যায় নিজের স্থান থেকে। তারপর অফিস রুমের বাইরে এসে বারান্দায় দাড়ায়। স্কুলের টিফিন টাইম চলছে। বাচ্চারা সবাই মাঠে খেলাধুলায় মগ্ন। জোনাকি একপলকে তাকিয়ে দেখতে থাকে এসব। ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের খুব ভালো লাগে তার। কারো বাচ্চা দেখলেই তাকে কোলে নিত। ছোটবেলায় যখন আমাদের জিজ্ঞেস করা হয়, আমরা বড় হয়ে কি হতে চাই, তখন আমরা কেউ বলি ডাক্তার, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু জোনাকিকে যখন জিজ্ঞেস করা হতো সে বড় হয়ে কি হতে চায় তখন সে উত্তর দিতো, সে বড় হয়ে একজন ভালো মা হতে চায়। অথচ মেয়েটার কি দূর্ভাগ্য যে, বিয়ের এক মাসের মধ্যেই তার স্বামী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে রইল। তিন বছর এভাবেই কা’টল লোকটার। এইসময় কতজন তাকে বলেছিল নিজের স্বামীকে ছেড়ে যেতে কিন্তু জোনাকি কারো কথা শোনে নি। এমনকি জোনাকির স্বামী নিজেও বলেছিল চলে যেতে তবুও সে আসে নি। শেষ দিন পর্যন্ত লোকটার পাশে ছিল। একজন আদর্শ জীবন সঙ্গীর সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছে। মাঝখান থেকে তাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে জীবনের সকল সুখ,আনন্দ। এখন অতীতের কথা মনে পড়লেই কেবল বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।
“ম্যাডাম আপনি কি কাঁদছেন?”
ছোট একটা বাচ্চার কন্ঠস্বর কানে আসতেই খুব যত্নে নিজের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া কয়েক বিন্দু অশ্রুকণা মুছে হাসি মুখে তার দিকে তাকায় জোনাকি। তারপর মিষ্টি হেসে তার গাল টেনে দিয়ে বলে,“না আমি কাঁদিনি তো। আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছে।”
বাচ্চাটা হয়তো ঠাহর করতে পারল না জোনাকির কথার মানে। সে নিজের মতো তার ক্লাসরুমে চলে গেল। ছোট ছোট বাচ্চাদের দিকে তাকালে জোনাকির মনে অদ্ভুত অনুভূতি হয়। মা হতে পারেনি সে, কিন্তু এই বাচ্চাদের দেখলেই মমত্ববোধ চলে আসে। এই কারণেই তো এত পেশা থাকা শর্তেও শিক্ষকতার পেশা বেছে নিয়েছে সে। যাতে বাচ্চাদের সান্নিধ্যে থাকতে পারে।
জোনাকি চলে যায় তার পরবর্তী ক্লাস নিতে। এবার তার ইংরেজি ক্লাস। প্রথমে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে মেয়। তারপর তাদের পড়া বোঝানোর দায়িত্ব নেয়। জোনাকি বই বের করে। আজ তাকে ইংলিশ প্যারাগ্রাফ মাই মাদার পড়াতে হবে। যা দেখে সামান্য আবেগাপ্লুত হয়ে যায় সে। নিজের আবেগকে সন্তপর্ণে লুকিয়ে রেখে পড়ানোয় মন দেয়।
#চলবে
#আবেগময়_সম্পর্ক2
#১ম_পর্ব
#লেখনীতে_মৃদু_সুপ্রিয়া
(প্রথম সিজনে গল্পটা ভালো ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি নি তাই নতুন ভাবে শুরু করলাম। আগের সিজনে একজন বিবাহিত পুরুষের গল্প ছিল এবার সেটা একজন বিধবা নারীর গল্প৷ সমাজে একজন পুরুষ যত সহজে দ্বিতীয় বিয়ে করে নারীর ক্ষেত্রে তা হয়না। এই নিয়েই গল্পটা। আশা করি আপনাদের মন মতো হবে।)