#আবেগময়_সম্পর্ক2
#২য়_পর্ব
#লেখনীতে_মৃদু_সুপ্রিয়া
জোনাকির স্কুল ইতিমধ্যে ছুটি দিয়েছে। জোনাকির কিছু জরুরি কাজ থাকায় ছুটির পরেও সে স্কুলে রয়ে গেল। কাজ শেষ করে স্কুল থেকে বের হতে যাবে, এমন সময় দেখতে পেল একটা বাচ্চা স্কুলের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। জোনাকি এগিয়ে যায় বাচ্চাটার দিকে। জোনাকি বাচ্চাটাকে দেখে বলে, “কি হয়েছে তুমি কাঁদছ কেন?”
বাচ্চাটি বলে, “স্কুল ছুটি হওয়ার অনেক সময় হয়ে গেছে কিন্তু এখনো কেউ আমাকে নিতে আসে নি।”
জোনাকি বাচ্চাটির দিকে ভালো ভাবে তাকায়৷ কত মায়াবী লাগছে বাচ্চা মেয়েটিকে৷ যার কান্না দেখে যেকোন পাষাণ মানুষের মন গলে যেতে বাধ্য। জোনাকি মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, “কেঁদো না আর৷ কি নাম তোমার?”
“আমার নাম সুইটি।”
“বাহ খুব সুন্দর নাম। তোমার পরিবারের কারো নাম্বার কি তোমার মুখস্থ আছে?”
সুইটি বলে,“হুম।”
“নাম্বারটা আমাকে দাও আমি কল করছি।”
সুইটি নাম্বার দিলে জোনাকি ফোন করে। টানা ১০-১২ বার কল করে কিন্তু ফোনটা রিসিভ হয় না।
জোনাকি বিরক্ত হয়ে বলে, “কেমন কেয়ারলেস মা-বাবা। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়ে কোন খোঁজ রাখে না।”
জোনাকি সুইটিকে বলে,“তোমার বাড়ির ঠিকানা বলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
সুইটি ঠিকানাটা বলবে তার আগেই একটি গাড়ি এসে থামে তাদের সামনে। গাড়িটা থেকে দ্রুত গতিতে একজন যুবক নেমে আসে। জোনাকি একপলক তাকালো যুবকের দিকে। দেখতে বেশ ফর্সা এবং লম্বা, সুদর্শন বলা যায়। যুবকটি এগিয়ে এসে সুইটির দিকে তাকিয়ে বলে, “সরি সুইটহার্ট একটু দেরি হয়ে গেল আসতে। চলো আমার সাথে আমি এখন তোমাকে নিয়ে যাবো।”
জোনাকি রাগী গলায় বলল,“কেমন বাবা আপনি? নিজের বাচ্চার প্রতি একটুও খেয়াল থাকে না? জানেন স্কুল দেড় ঘন্টা আগে ছুটি দিয়েছে। বাচ্চাটা কতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। যদি কোন বিপদ হয়ে যেত তাহলে? কি এমন জরুরি কাজ ছিল যে নিজের বাচ্চাকেও নিতে আসতে পারেন নি?”
যুবকটিও রাগী ভাবে বলল,“আমাকে এসব বলার আপনি কে? আপনি চেনেন আমায়?”
জোনাকি বুকে হাত গুজে বলে,“চিনি না আর চিনতে চাইও না। আপনি শুধু নিজের বাচ্চার খেয়াল রাখতে শিখুন। জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায়না। বাচ্চার খেয়ালও রাখতে জানতে হয়।”
কথাটা বলেই জোনাকি চলে যায়। জোনাকি যাওয়ার পর বাচ্চাটা যুবককে বলল,“জানো উনি আমার স্কুলের টিচার। আজ উনি আমাকে সামলেছেন। ওনাকে দেখে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।”
সুইটির কথা শুনে যুবকের মুখের ভাব ভঙ্গিমা বদলে গেল৷ সে নিজের কানে হাত দিয়ে বলল,“সরি সুইটহার্ট। আজ আমার অফিসে খুব ইমট্যান্ট একটা মিটিং ছিল। সেই কারণেই আসতে দেরি হয়ে গেল। আর কখনো এত দেরি হবে না প্রমিস।”
__________________________
জু্ঁই সবেমাত্র ক্লাসরুম থেকে বেরোতে যাবে তখন তার স্যার তাকে থামতে বলল। এক এক করে ক্লাসের সবাই বেরিয়ে গেল। সবাই বেরিয়ে যেতেই জুঁইয়ের কলেজের ইংরেজি টিচার আব্দুল হক তার হাতটা চেপে ধরল। জুঁই কিছু বুঝতে পারছিল না। কিছু সময়ের মধ্যে জুঁই বলে উঠল, “স্যার আমার হাতে লাগছে ছাড়ুন।”
আব্দুল হক বললো, “তোমার ইংরেজি টেস্টে এবার নাম্বার কম এসেছে। তুমি চাইলে আমি ফুল নম্বর দিয়ে দেব। বিনিময়ে শুধু…”
জুঁইয়ের মাথায় রাগ উঠে গেল। জুঁই বলে উঠল,“আপনি আমার শিক্ষক। আমার কাছে আপনি একজন সম্মানীয় ব্যক্তি। এই ধরণের কথা বলে নিজের সম্মান নষ্ট করবেন না।”
জুঁইয়ের শিক্ষক বললো,“পরীক্ষায় পাস করতে চাও কি না?”
“চাই কিন্তু লেখাপড়া করে, স্যারের শয্যাসঙ্গী হয়ে নয়।”
কথাটা বলেই জুঁই বেরিয়ে চলে আসল। আজ তার চোখে জল চলে আসল। নারীদের জীবন যে কত কষ্টের সেটা সমাজ বোঝে না। অনেক পুরুষ তাদের ভোগ্যপণ্য মনে করে, যেন তাদের কাজ শুধু পুরুষের মনোরঞ্জন করা। নারীদের যেন আলাদা করে কোন দাম নেই কারো কাছে! এই সমাজেই আমরা বসবাস করে চলছি।
জুঁই কলেজ থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলো টিউশনি করাতে। যেই সময় অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা সারাদিন কোচিং আর প্রাইভেট নিয়ে ব্যস্ত থাকে সেই সময় অন্যান্য বাচ্চাদের পড়ায়। এতে করে তার পড়াশোনা এবং হাত খরচের টাকা উঠে আসে। মা-বোনের উপর আর কত বোঝা হয়ে থাকবে? তাই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস তার। আজ একটি ছাত্রীকে পড়াতে আসল। পড়ানো শেষ করে বের হতে যাবে এমন সময় ছাত্রীর মা জুঁইকে বলে উঠল,“তুমি কি আমার একটা সাহায্য করতে পারবে?”
জুঁই সবিনয়ে বলে,“আপনি বলুন। আমি চেষ্টা করে দেখবো।”
“আসলে আমার মামাতো ভাইয়ের মেয়েটা দিন দিন পড়াশোনায় পিছিয়ে যাচ্ছে। তুমি কি দয়া করে ওকে পড়িয়ে আসতে পারবে? ওরা কিন্তু অনেক বেশি টাকা দিবে।”
জুঁইয়ের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা, তাই এই সময় তার টাকার অনেক প্রয়োজন। তাই জুঁই বলল,“হুম তা পড়াতেই পারি। কখন যেতে হবে?”
“তুমি চাইলে এক্ষুনি যেতে পারো। বেশি দূরে নয়। আমাদের বাড়ির থেকে এক কিলোমিটার পরেই, চলো আমি আজ তোমায় দেখিয়ে আসি।”
ঐ মহিলার সাথে জুঁই এলো তার মামাতো ভাইয়ের বাড়ি। বাড়ির সামনে এসে কলিং বেজ বাজানোর কিছু সময় বাদেই একজন পৌঢ়া এসে দরজা খুলে দিল। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পৌঢ়াকে দেখেই জুঁইয়ের ছাত্রীর মা বলে উঠল,“কেমন আছ মামী?”
“এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তোর কি খবর?”
“ভালো। এই যে দেখ সুইটির জন্য আমি প্রাইভেট টিউটর নিয়ে এসেছি। উনি আমার মেয়েকেও পড়ান।”
মহিলা চশমা ঠিক করে নিয়ে জুঁইকে ভালো করে পরখ করে নিয়ে বলেন,“মেয়েটাকে দেখে তো মনে হচ্ছে খুব বেশি বয়স না৷ এই মেয়ে কি পড়াতে পারবে?”
জুঁইয়ের ছাত্রীর মা বলে, “ও কিন্তু অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এসএসসি পরীক্ষায় বোর্ডের মধ্যে র্যাংক করেছিল। ওর একটু অভাবের সংসার জন্য এভাবে চলতে হচ্ছে। নাহলে ওর অনেক ভালো কিছু হতো।”
পৌঢ়া আর কিছু বললেন না। একটু পরেই সুইটি চলে এলো সেখানে। পৌঢ়া জুঁইকে দেখিয়ে বলল,“এই দেখো দাদুন, তোমার নতুন টিউটর। তোমাকে এখন থেকে উনিই পড়াবেন।”
সুইটি কোন আগ্রহ দেখায় না। পড়াশোনায় তার এক দম মন নেই। জুঁই সুইটিকে দেখে বলল,“তাহলে চলো আমরা পড়তে বসি।”
সুইটি বলে উঠল,“আজকে আমার পড়ার মুড নেই। এমনিই ড্যাডি আমায় দেরি করে স্কুল থেকে নিয়ে এসেছে। আমি এখন আর পড়তে পারব না।”
জুঁইয়ের কাছে এই সুইটি নামের মেয়েটাকে অনেক বেশি অসভ্য লাগে। কিরকম কথা বার্তার ধরণ। পৌঢ়া জুঁইকে বলল,“আজ ওর মুড ভালো নেই। তুমি এখন আসতে পারো। কাল থেকে পড়াতে এসো।”
নেহাৎ জুঁই এর জন্য এখন টাকার খুব দরকার তাই তাকে এই মেয়েটাকে পড়াতে হচ্ছে। নাহলে এরকম ছাত্রীকে সে কখনো পড়াতো না।
এর মধ্যে সুইটি বলে, “কারেন্ট চলে গেছে দাদি, ওয়াই ফাই ওফ হয়ে গেছে। তুমি ড্যাডিকে বলো আমার ফোনে টাকা রিচার্জ করে দিতে, আমাকে এমবি কিনতে হবে। তারপর ইউটিউবে কার্টুন দেখতে হবে।”
জুঁই বুঝল এই মেয়েকে পড়াতে তার অনেক বেশি বেগ পেতে হবে। আপাতত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সে।
#চলবে